এই মতবাদ দৈব প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করে না। ঈশ্বর বিশ্বাসকে সহজাত প্রবৃত্তি মনে করে না। এই মতবাদ মনে করে মানুষের সাধারণ যুক্তিবোধ ও বুদ্ধি থেকেই উপাসনা- ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে। এক সময় আদিম মানুষ তাদের সাধারণ যুক্তি- বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছে, সৃষ্টি থাকলে তার একজন স্রষ্টা থাকবে। এই যে নানা ধরনের প্রাণী, উদ্ভিদ, নদী, পাহাড়, বন, সূর্য, চন্দ্র, তারা, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি— এ’সব যখন আছে, তখন এদের একজন স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছে। এই স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া সত্যকেই মেনে নেওয়া। ঈশ্বর সত্য। ঈশ্বর-উপাসনা মানে সত্যকে উপাসনা। উপাসনা মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের মেলার উপায়। এই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনে ফোড়ে বা দালালের কোনও ভূমিকাই নেই। ভক্তিই স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির মিলনের শেষ কথা।

পুরোহিত সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থে নানা ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ম-কানুন ইত্যাদি তৈরি করেছে। ঈশ্বর ও মানুষের মাঝখানে যোগাযোগকারী হিসেবে নিজেদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এই ধূর্ত পরজীবী পুরোহিত সম্প্রদায়ই শক্তিমান শাসক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মকে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে।

ধর্মের মূল সত্য হলো—ঈশ্বর আছেন, আত্মা ঈশ্বরের সৃষ্টি, যাবতীয় সৃষ্টির স্রষ্টা ঈশ্বর। আত্মা অমর। যেহেতু যুক্তি-বুদ্ধি মানুষের সহজাত, তাই এই সত্যগুলো মানুষের কাছে ধরা পড়েছিল। আচারহীন উপাসনা-ধর্মই মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। ‘সত্য ধর্ম’, ‘স্বাভাবিক ধর্ম’ বা ‘বিশুদ্ধ ধর্ম-র উৎস হল মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি। পরবর্তী কালে পুরোহিতের স্বার্থপরতা ও প্রতারণা থেকে উঠে এসেছিল আচারসর্বস্ব বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাসনা-ধর্ম।

এই মতের প্রথম লিখিত প্রবক্তা ছিলেন লর্ড হার্বার্ট (Lord Herbert)। ১৬৬৩ সালে তাঁর এই ধর্ম বিষয়ক মতামত প্রকাশিত হয়। পরে ফ্রান্সের বেশ কিছু চিন্তানায়ক এই মতটি গ্রহণ করেন।

এই মতটি গ্রহণে আমাদের কিছু অসুবিধে রয়ে গেছে। (১) কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, ‘সৃষ্টি থাকলে স্রষ্টা থাকবে’—এই তত্ত্বকে মেনে নিলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। কারণ তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে—‘ঈশ্বরের স্রষ্টা কে?’ জানি না এই মতবাদীরা কী উত্তর দেবেন? যদি তাঁদের চতুর উত্তর হয়—ঈশ্বর স্বয়ম্ভু, তবে প্রশ্ন উঠবেই—প্রকৃতিকে স্বয়ম্ভু ভাবতে অসুবিধে কোথায়? (২) আদিম মানুষের বুদ্ধি কখনই এতটা উন্নত ছিল না যে আত্মা, আত্মার অবিনশ্বরতা ইত্যাদি আধুনিক ধর্ম বিশ্বাসের মূল তত্ত্ব চিন্তায় আসবে। (৩) এই মতবাদকে মেনে নিলে মানুষের মনের ক্রমবিবর্তনকে অস্বীকার করতে হয়। যা মনোবিজ্ঞান বিরোধী। (৪) সমস্ত ঐতিহাসিক ধর্মই পুরোহিতদের ধূর্ততা থেকে উদ্ভূত—এমন মতামতও ঠিক নয়।

মানুষের মনে প্রকৃতির রহস্যময়তা ঘিরে ভক্তি-ভয়ের উদ্ভব হয়েছিল

পুরোহিত সম্প্রদায়ের উৎপত্তির আগে। পুরোহিত সম্প্রদায়

মানুষের এই ভয়-ভক্তি-আবেগ ইত্যাদিকে কাজে

লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেছে।

পুরোহিতরা ধর্মের স্রষ্টা নয়।

ধর্মের পালক ও

পুষ্টকারী।

error: Content is protected !!