রাতের আকাশ ভ’রে থাকে তারায়; দিনে পৃথিবীর আকাশে ওঠে একটি তারা বা নক্ষত্র, যার নাম সূর্য। সুর্যের অজস্র নাম- রবি, ভাস্কর, ভানু, আদিত্য, তপন, মিহির, অর্ক, মার্তণ্ড, দিননাথ, অরুণ, দিনেশ, সবিতা, দিবাকর, বিবস্বান, বিভাবসু, পূষণ, বিভাকর, প্রভাকর, অংশুমান, ত্বিষাম্পতি, ও আরো অনেক। সূর্য নামের তারাটি আছে বেশ দূরে বা মহাবিশ্বের মানদণ্ডে বেশ কাছে, ১.৪৯৫৯৭৯ × ১০৮ বা ১৪৯,৫৯৭,৯০০ কিমি, বা এক জ্যোতি-একক দূরে। কিন্তু পৃথিবী থেকে এর পরের তারাটি— প্রোক্সিমা সেন্টোরি- আছে এ-দূরত্বের ২৬০,০০০ গুণ বা পুটো যতো দূরে আছে, তার ৬,৮০০ গুণ দূরে। মহাবিশ্বে আছে বিকট মহাকায় তারা- আয়তনে মঙ্গলের কক্ষপথের থেকেও বড়ো, আছে পৃথিবীর সমান তারা গ্রহাণুর সমান তারা । আছে লাল তারা, নীল তারা; আছে খুবই পাতলা তারা, যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় এক পাশ থেকে অন্য পাশ, আছে কঠিন শিলায় গঠিত তারা- যেগুলোর ভেতরে হয়তো আছে হীরক; আছে এমন তারা, যেগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছে । তারা কী? তারা এমন বস্তু, যার ভেতরে প্রচণ্ড তাপে ও চাপে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় উৎপাদিত হয় শক্তি । আকাশের দৃশ্যমান তারাগুলোর অধিকাংশই গ্যাসের গোলক; আকারে সূর্যের থেকে কয়েক গুণ বড়ো বা ছোটো।
তারা অজস্র, নামও অজস্র; তারাদের নাম রাখার ও তালিকাবদ্ধ করার রীতিও আছে বেশ কয়েকটি । পশ্চিমে তারাদের অনেক নামই এসেছে আরবি থেকে, – আলগোল, আলডেবরন, আলতাইর, আলনাথ, ডানেব প্রভৃতি তারার নাম আরবি । প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদেরা রেখেছিলেন অজস্র সুন্দর নাম : ধ্রুব, ব্রহ্মহৃদয়, লুব্ধক, অগ্নি, স্বাহা, অনসূয়া, লজ্জা, প্রীতি, আর্দ্রা, বিশাখা, বাণরাজা, অগস্ত্য, প্রভাস, মঘা, উত্তরফল্গুনী, পূর্বফল্গুণী, অরুন্ধতী, চিত্রা, অভিজিৎ, স্বাতী, নহুষ, পূর্বাষাঢ়া, শ্রবণা, উত্তর ভাদ্রপদ, জ্যেষ্ঠা প্রভৃতি । নাম দিয়ে তারা চেনা কঠিন; – রোহিণী বললে একটি তারার সুন্দর নাম পাই, কিন্তু আকাশে একে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তাই তারার তালিকায় বিভিন্ন তারামণ্ডলের তারাগুলোকে বিন্যস্ত করা হয় প্রভার মাত্রানুসারে; প্রভার মাত্রা নির্দেশ করা হয় গ্রিক বর্ণানুক্রম আলফা, গামা, ডেলটা, এপসাইলন প্রভৃতির ক্রমে। যেমন, সেন্টোর বা কিন্নর তারামণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারাটিকে বলা হয় আলফা সেন্টোরি, লুব্ধক বা সিরিয়াস তারাটিকে বলা হয় আলফা ক্যানিস মেজোরিস, অর্থাৎ বড়ো কুকুরমণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারা এটি, রোহিণী বা আলডেবরন হচ্ছে বৃষমণ্ডলের আলফা- আলফা টৌরি, অর্থাৎ এটি বৃষমণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারা । এভাবে তারাগুলোকে শনাক্ত করা যায় সহজে। তারারা আছে বহু দূরে; তাদের দূরত্ব দৈনন্দিন এককে প্রকাশ করলে মাথা অসুস্থ বোধ করে; তাই বের করা হয়েছে মহাজাগতিক দূরত্ব প্রকাশের একক। তারাদের দূরত্ব নির্দেশের সবচেয়ে ছোটো একক হচ্ছে ‘আলোক-বর্ষ’ ১ বছরে আলো যতো দূর যায়। আলো ১ বছরে যায় প্রায় ৬ মিলিয়ন মিলিয়ন মাইল, বা ১০১৬ মিটার, অর্থাৎ ১০, ০০০,০০০,০০০, ০০০, ০০০ মিটার । আলোক-বর্ষ দূরত্বের একক, সময়ের একক নয়; তবে অনেকেই ভুল করেন । সূর্য আছে আমাদের থেকে ৮ আলোক-মিনিট দূরে; সূর্যের পরেই নিকটতম তারা প্রোক্সিমা সেন্টোরি আছে পৃথিবী থেকে ৪.৩ আলোক-বর্ষ দূরে। ধ্রুবতারা বা পোলারিস আছে ৬৫০ আলোক-বর্ষ দূরে; লুব্ধক বা সিরিয়াস আছে ৮.৭ আলোক-বর্ষ দূরে, হংসপুচ্ছ বা ডেনেব আছে ১৬০০ আলোক-বর্ষ দূরে; অগস্ত্য বা ক্যানোপাস আছে ৯৮ আলোক-বর্ষ দূরে, বাণরাজা বা রিগেল আছে ৯০০ আলোকবর্ষ দূরে, মঘা বা রেগুলাস আছে ৮৭ আলোক-বর্ষ দূরে, চিত্রা বা স্পাইকা আছে ২২০ আলোক-বর্ষ দূরে, অভিজিৎ বা ভেগা আছে ২৬.৫ আলোক-বর্ষ দূরে। উত্তর আকাশে যখন বিখ্যাত ধ্রুবতারাটি দেখি, তখন আজকের ধ্রুবতারাটিকে দেখি না, দেখি ৬৫০ বছর আগের বা ১৩৫০ অব্দের ধ্রুবতারাটিকে; আর ২০০০ অব্দে যদি বিস্ফোরিত হয় ধ্রুবতারাটি, আমরা তা জানবো ২৬৫০ অব্দে! আলোক-বর্ষ দৈনন্দিন মানদণ্ডে বড়ো একক, মহাবিশ্বের মানদণ্ডে নয়; তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন এর থেকে কিছুটা বড়ো একটি একক; তাকে বলা হয় ‘পারসেক’- সংক্ষেপে ‘পিসি’। ‘পারসেক’ গঠিত হয়েছে ‘প্যারাল্যাক্স অফ ওয়ান সেকেন্ড অফ আর্ক’ কথাটির ‘পার’ ও ‘সেক’ অংশ দুটিকে যুক্ত ক’রে। ৩.২৬ আলোক-বর্ষে ১ পারসেক; এ-সময়ে আলো ভ্রমণ করে ৩ × ১০১৬ মিটার। পারসেকের থেকে বড়ো একক ‘কিলোপারসেক’, ‘মেগাপারসেক’ প্রভৃতি।
তারাগুলো এতো দূরে আছে যে ওগুলোকে মনে হয় আলোর ফোঁটা। ওগুলো কতোটা উজ্জ্বল বা প্রভাময়? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন তারার দু-রকম প্রভা কোনো তারাকে দেখে, আপাতদৃষ্টিতে, যতোটা উজ্জ্বল মনে হয়, তাকে বলা হয় আপাতপ্রভাঃ অ্যাপারেন্ট ব্রাইটনেস, আর তারাগুলোকে যদি এক বিশেষ দূরত্বে এক সারিতে সাজিয়ে ফেলা যেতো, তাহলে তাদের যেমন উজ্জ্বল দেখাতো, তাকে বলা হয় ধ্রুবপ্রভাঃ অ্যাবসোলিউট ব্রাইটনেস । খ্রিপূ ১৩০ অব্দে ১০০০ তারার প্রভা মেপেছিলেন হিপ্পারকাস; তিনি তারাগুলোকে আপাতপ্রভা অনুসারে বিন্যস্ত করেছিলেন ১ থেকে ৬ প্রভার ছটি শ্রেণীতে। তাঁর ১ম প্রভার তারা সবচেয়ে উজ্জ্বল, ২য় প্রভার তারা তার চেয়ে কম উজ্জ্বল, ৩য় প্রভার তারা তার চেয়ে কম উজ্জ্বল- এভাবে সাজিয়েছিলেন তারাগুলোকে হিপ্পারকাস । পরীক্ষার ফলের মতো সংখ্যা যার যতো বড়ো সেটি ততো ম্লান। কিন্তু তারা আছে ১ম প্রভার তারার থেকেও প্রভাময়, আর ৬ষ্ঠ প্রভার তারার থেকেও ম্লান; তাই উনিশ ও বিশশতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ওই তারাগুলোর প্রভা নির্দেশের জন্যে বের করেছেন নতুন রীতি । তাঁরা দেখেছেন হিপ্পারকাসের কোনো ম্লান প্রভার তারার থেকে পূর্ববর্তী প্রভাময় তারাটি 2½ গুণ উজ্জ্বল। এ-মাত্রানুসারে হিপ্পারকাসের ১ম প্রভার তারার থেকে প্রভাময় তারার প্রভা স্থির করা হয়েছে ০.০ (শূন্য), তার থেকে প্রভাময় তারা – ১ (বিয়োগ ১)। বেশি প্রভাময় তারা পেয়েছে ঋণাত্মক সংখ্যা। যেমন, সূর্য – ২৬.৫ প্রভার, চাঁদের প্রভা – ১২.৫, অভিজিৎ বা ভেগার প্রভা ০.০, চিত্রা বা স্পাইকার প্রভা ১.০, আর সবচেয়ে প্রভাময় তারা লুব্ধক বা সিরিয়াসের প্রভা – ১.৪, দ্বিতীয় প্রভাময় তারা অগস্ত্য বা ক্যানোপাসের প্রভা -০.৭।
প্রতিটি তারার রয়েছে একগুচ্ছ রঙ; তারার আলো বিভিন্ন মাত্রায় বিচ্ছুরিত হয়ে সৃষ্টি করে বিভিন্ন রঙের বর্ণালি বা বর্ণচ্ছটা : স্পেকট্রাম । তারার বর্ণালি থেকে জানা যায় তার বায়ুমণ্ডল, ওপরতল ও ভেতরের তলের সংবাদ। ১৮৭২ অব্দে হেনরি ড্র্যাপার প্রথম ছবি তোলেন বর্ণালির। বর্ণালির ছবি বিশ্লেষণ ক’রে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করেন তারাদের বৈশিষ্ট্য । তারাগুলোকে তাদের বর্ণালি অনুসারে বিন্যস্ত করা হয় বিভিন্ন বর্ণালিশ্রেণীতে। একেক বর্ণালিশ্রেণী নির্দেশ করে তারাদের একেক রকম তাপমাত্রা; কেননা তাপমাত্রা হচ্ছে কোনো বস্তুর অণুপরমাণুর গড়ত্বরণের সমষ্টি । কোনো তারার গ্যাস যতো বেশি গরম, ততো বেশি দ্রুত আলোড়িত হয় তার অণুপরমাণু । সবচেয়ে গরম তারাগুলোকে বিন্যস্ত করা হয় ও শ্রেণীতে; এগুলোর তাপমাত্রা ৪০,০০০ কেলভিন বা তারচেয়ে বেশি, এগুলো নীলতম; তারপর বি-শ্রেণীর তারা, এগুলোর তাপমাত্রা ১৮,০০০ কেলভিন, এগুলো নীলাভ; তারপর এ-শ্রেণীর তারা, এগুলোর তাপমাত্রা ১০,০০০ কেলভিন, এগুলো নীলাভ-শাদা; তারপর এফ-শ্রেণীর তারা, এগুলোর তাপমাত্রা ৭,০০০ কেলভিন, এগুলো শাদা; তারপর জি-শ্রেণীর তারা, এগুলোর তাপমাত্রা ৫,৫০০ কেলভিন, এগুলো হলদে-শাদা; তারপর কে-শ্রেণীর তারা, এগুলোর তাপমাত্রা ৪,০০০ কেলভিন, এগুলো কমলা; তারপর আছে এম-শ্রেণীর তারা, এগুলো সবচেয়ে শীতল, এগুলোর তাপমাত্রা ৩,০০০ কেলভিন, এগুলো সবচেয়ে লাল । মহাবিশ্বের ৯৯%টি তারাই এম-শ্রেণীর। আমাদের সূর্য জি২ শ্রেণীর তারা ।
প্রতিটি তারার ১২টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা । এগুলোর মধ্যে আছেঃ দূরত্ব (মাপা হয় ত্রিকোণমিতিক প্যারাল্যাক্সের সাহায্যে), ধ্রুবপ্রভা (নির্ণয় করা হয় দূরত্ব ও আপাতপ্রভা মিলিয়ে), তাপমাত্রা (নির্ণয় করা হয় রঙ বা বর্ণালির সাহায্যে), ব্যাস (মাপা হয় ধ্রুবপ্রভা ও তাপের সাহায্যে), ভর (মাপা হয় যুগল তারা ও কেপলারের সূত্রে), গঠন (নির্ণয় করা হয় বর্ণালির সাহায্যে), চৌম্বক ক্ষেত্র (নির্ণয় করা হয় বর্ণালি ও জিমান-প্রভাব রীতিতে), আবর্তন বা ঘূর্ণন (নির্ণয় করা হয় বর্ণালি ও ডপলার-প্রভাব রীতিতে), গতিবেগ (মাপা হয় ডপলার- প্রভাব রীতিতে বর্ণালির সাহায্যে)। ব্যাপারগুলো খুবই দুরূহ । তারার দূরত্ব মাপা হয় প্যারাল্যাক্স বা আপাত-অবস্থানান্তর রীতিতে। মনে করা যাক একজন দর্শক দেখছেন দূরের কোনো জিনিশ; তিনি যদি তার অবস্থান বদল ক’রে আবার দেখেন জিনিশটি, তাঁর মনে হবে যেনো জিনিশটি বদল করেছে অবস্থান। দর্শকের অবস্থান বদলের ফলে দৃষ্টবস্তুর অবস্থানের কৌণিক আপাতবদল হচ্ছে প্যারাল্যাক্স । ব্যাপারটি এমনঃ সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে একটি আঙুল উঁচু ক’রে ধ’রে আঙুলের পাশ দিয়ে দূরের জিনিশ দেখুন । এখানে আঙুলটি হচ্ছে একটি কাছের তারা, জিনিশগুলো দূরের তারা। এখন ডান চোখ বুজে দেখুন আঙুলটি, আবার বাঁ চোখ বুজে দেখুন আঙুলটি; মনে হবে আঙুলটি (অর্থাৎ কাছের তারাটি) অবস্থান বদল করছে। এবার আঙুলটি চোখের খুব কাছাকাছি এনে আগের মতো ডান চোখ বুজে আবার বাঁ চোখ বুজে দেখুন; দেখা যাবে আঙুলের অবস্থানবদলের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আবার আঙুলটি দূরে নিয়ে দেখুন, দেখা যাবে আঙুলের অবস্থানবদলের পরিমাণ ক’মে গেছে। এভাবেই দর্শিত তারাটি যতো দূরের হবে, তার প্যারাল্যাক্স হবে ততো কম । প্যারাল্যাক্স মাপা হয় ডিগ্রি, মিনিট, ও সেকেন্ডে; তবে তারাদের প্যারাল্যাক্স সাধারণত হয় আর্ক বা চাপের এক সেকেন্ডেরও কম।
কোনো তারার ঠিক প্যারাল্যাক্স ও দূরত্ব প্রথম মাপেন, ১৮৩৮ অব্দে, ফ্রিডরিখ বেসেল। তিনি দেখেন যে রাজহংস (সাইগনাস) তারামণ্ডলের ৬১ সংখ্যক তারাটির প্যারাল্যাক্স হচ্ছে চাপের ১/৩ সেকেন্ড, আর দূরত্ব ৩ পিসি । অধিকাংশ তারাই আছে ৩ পিসির থেকে দূরে, সেগুলোর প্যারাল্যাক্সও কম। কোনো তারার প্যারাল্যাক্স চাপের যতো সেকেন্ড, তার দূরত্ব হচ্ছে চাপের সেকেন্ডের ব্যস্তরূপের পারসেক । যদি কোনো তারার প্যারাল্যাক্স হয় চাপের ১/৩ সেকেন্ড, তাহলে তার দূরত্ব ৩ পিসি বা পারসেক; যদি কোনো তারার প্যারাল্যাক্স হয় চাপের ১/২০ সেকেন্ড, তাহলে তার দূরত্ব ২০ পিসি । পারসেক কথাটি এসেছে এ থেকেই; ‘প্যারাল্যাক্স অফ ওয়ান সেকেন্ড অফ আর্ক’-এর সমতুল্য দূরত্বই পারসেক । তারা যতো দূরের, তার প্যারাল্যাক্স ততো কম।
তারার ধ্রুবপ্রভাকে বলা হয় দীপ্তিঃ লিউমিনোসিটি । প্রতি সেকেন্ডে কোনো তারা বিকিরণ করে যে-পরিমাণ শক্তি, তাই তারাটির দীপ্তি। দীপ্তি তারার সহজাত উজ্জ্বলতা। তারার দীপ্তি সম্পর্কিত একটি উপকারী ধারণা হচ্ছে বোলোমিটারিক দীপ্তিঃ বোলোমেট্রিক লিউমিনোসিটি । কোনো তারা সব রূপে সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যে মোট যে-পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে, তাই তারাটির বোলোমিটারিক দীপ্তি । সূর্যের বোলোমিটারিক দীপ্তি ৪ × ১০২৬ ওয়াট। কোনো তারার দীপ্তি কতোটা, তা নির্ধারণ করার জন্যে জানা দরকার হয় তারাটির দূরত্ব; দূরত্ব নির্ণীত হয়ে গেলে দীপ্তি নির্ণয় করা যায় সহজে।
তারার উত্তাপ পরিমাপ করা হয় কীভাবে? তারার বর্ণালি পরীক্ষা ক’রে দেখতে হয় কোন রঙটি বিকিরিত হচ্ছে তীব্রতমভাবে; তার ওপর ডিয়েনের সূত্র প্রয়োগ ক’রে পরিমাপ করা হয় তারার উত্তাপ। কীভাবে মাপা হয় তারার ব্যাস? অধিকাংশ তারার ব্যাস নির্ণয় করা হয় তারার উত্তাপ ও দীপ্তির ওপর স্টেফান-বোমানের -সূত্র প্রয়োগ ক’রে । কীভাবে মাপা হয় তারার ভর। যুগল তারার ভর মাপা হয় তারা দুটির একবার কক্ষপথ প্রদক্ষিণের সময় ও তাদের দূরত্বের ওপর কেপলার ও নিউটনের সূত্র প্রয়োগ ক’রে। তারার গঠন পরিমাপ করা হয় কীভাবে? এটাও বের করা হয় তারার বর্ণালি থেকে। কীভাবে মাপা হয় তারার আবর্তন বা ঘূর্ণন? কোনো আবর্তনশীল তারার দিকে তাকালে দেখা যায় তারাটির এক ধার এগিয়ে আসছে দর্শকের দিকে, এবং আরেক ধার স’রে যাচ্ছে দর্শকের দিক থেকে । দর্শকের দিকে অগ্রসরমান দিকটি যে-আলো বিকিরণ, বা শোষণ, করে, তার ঘটে ‘নীল পরিবর্তনঃ ব্লু শিফ্ট্, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্ষুদ্র হ’তে থাকে; আর অপর ধারটি থেকে বিকিরিত আলোর ঘটে ‘লাল পরিবর্তন’ রেড শিফ্ট্, দীর্ঘ হ’তে থাকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য । যদি তারাটি আবর্তিত না হতো, তাহলে এমন পরিবর্তন ঘটতো না । সবচেয়ে দ্রুত আবর্তিত হয় ও-শ্রেণীর বিকট মহাকায় তারাগুলো; এগুলো সেকেন্ডে ৩০০ কিমি বেগে আবর্তিত হয় বিষুবাঞ্চলে। আমাদের সূর্য বিষুবাঞ্চলে ঘোরে সেকেন্ডে মাত্র ২ কিলোমিটার বেগে। তারার গতি নির্ধারণ করা হয় কীভাবে? তারাটি চ’লে যাচ্ছে, না এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে, এটা নির্ধারণ করা হয় ‘ডপলার পরিবর্তন’ : ডপলার শিফ্ট রীতিতে। এসবই খুবই জটিল ব্যাপার; কিন্তু বিস্ময়কর যে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানীরা এসব উদ্ধার করেছেন চমৎকার নির্ভুলভাবে, যা কল্পিত পৌরাণিক বিকট বিধাতাদের পবিত্র ভয়াবহ বইগুলো পারে নি।
তারারা সব একই আকারের নয়, বিচিত্র তাদের রূপ ও আকার । কোনো তারা বিকট মহাকায়, কোনোটি ততো মহাকায় নয়, কোনোটি বেশ বড়ো, কোনোটি বেশ ছোটো । কোনোটি দীপ্ত, কোনোটি ম্লান। তারারা যে বিচিত্র রূপের হয়, তার কারণ বিবর্তন ঘটে তারাদের; এক আকারের তারা এক সময় বদলে হয়ে ওঠে ভিন্ন আকারের তারা । তারাদের বিবর্তনের সময়ও ভিন্ন; বিভিন্ন আদিভরের তারা বিবর্তিত হয় বিভিন্নভাবে, এবং পরিগ্রহ করে বিভিন্ন রূপ । অধিকাংশ তারাই নবীন, মধ্যবয়সী ও প্রৌঢ় । তারার জন্ম দেখা বেশ দুর্লভ ঘটনা, মৃত্যু দেখাও দুর্লভ, যদিও দুটিই ঘটছে মহাবিশ্বে। মহাবিশ্বের অধিকাংশ তারার ভরই সূর্যের ভরের ০.১ ভাগ থেকে ৬০ সূর্য-ভরের (সূর্যের যা ভর) সমান । ৬০ সূর্য-ভরের থেকে বেশি ভরের তারা পাওয়া যায় ১০০ কোটিতে একটি; সূর্যের থেকে ১০০০ গুণ ভরের তারাও সম্ভবত রয়েছে। কোনো কোনো তারা আছে, যেগুলোর দীপ্তি সূর্যের দীপ্তির ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ, আবার কোনো কোনো তারা আছে, যেগুলোর দীপ্তি সূর্যের দীপ্তির ১০ লাখ গুণ । তারার বর্ণালি রয়েছে- তারাগুলো সাজানো হয় বর্ণালির শ্রেণী অনুসারে, ও রয়েছে দীপ্তি; এবং দেখা গেছে অধিকাংশ তারার বর্ণালি-শ্রেণী ও দীপ্তির মধ্যে রয়েছে সম্পর্ক । এমনভাবে সম্পর্কিত তারাদের বলা হয় প্রধান পরম্পরার তারাঃ মেইন সিকুয়েন্স স্টার। অধিকাংশ তারাই পড়ে প্রধান পরম্পরার তারার গুচ্ছে; এগুলোর মধ্যে সূর্য সবচেয়ে দীপ্র । এ-তারাগুলোর রয়েছে এক বিশেষ স্বভাব; এগুলো একলা থাকতে চায় না, অধিকাংশই থাকে দুটি কি তিনটি একসাথে, এবং ঘোরে একে অন্যকে কেন্দ্র ক’রে। নিঃসঙ্গ তারার সংখ্যা খুবই কম; আমাদের সূর্য একটি নিঃসঙ্গ তারা, এর কোনো সাথী নেই।
সেন্টৌরাস বা কিন্নর তারামণ্ডলে আছে আলফা সেন্টোরি নামের তিন-তারার একটি সংশয়; মাত্র ১.৩ পারসেক দূরে এটি সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারা-সংশয় । আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি তারাই মনে হয়, কিন্তু এতে আছে তিনটি তারা; এর মুখ্য সদস্য হচ্ছে আলফা সেন্টোরি এ এবং বি। এ-দুটি সূর্যের মতোই অনেকটা । এ-সদস্য দুটি বিরাজ করে যুগলবন্দীরূপে; একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করে ৮০ বছরে একবার। এ-তারা দুটিকে ১৫ লক্ষ বছরে একবার প্রদক্ষিণ করে আরেকটি তারা, প্রোক্সিমা সেন্টোরি, যার ভর সূর্যের ভরের ১০ ভাগের ১ ভাগ। এটির দূরত্ব সূর্য থেকে মাত্র ১.২৯ পারসেক; সূর্যের নিকটতম প্রতিবেশী তারা ব’লে স্নান এই তারাটিকে বলা হয় প্রোক্সিমা সেন্টোরিঃ কিন্নরের নিকটতম।
আকাশে রাতে যে-সব তারা দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো বেশি দীপ্ত, জ্বলজ্বলে, সেগুলো খুবই দূরের তারা; এবং এগুলোর সংখ্যা খুবই কম । এগুলো বিকিরণ করে অনেক বেশি আলো, কেননা এগুলোর আয়তন বেশি। হার্টম্পুং এগুলোর নাম দিয়েছিলেন দানবিক তারা : জায়েন্ট স্টার। এগুলোর অধিকাংশকে বলা হয় ‘রেড জায়েন্ট’ বা লাল দানব, কেননা এগুলো কে এবং এম শ্রেণীর লালাভ তারা । এক শ্রেণীর তারা আছে, যেগুলো খুবই ছোটো, এগুলোর রঙ নীলও নয় লালও নয়; এগুলো বলা হয় শাদা বামন তারাঃ হোয়াইট ডোয়ার্ফ স্টার। আরেক শ্রেণীর তারা আছে, যেগুলো দানবিক তারাগুলোর থেকেও উজ্জ্বল; এগুলো মহাদানবিক তারাঃ সুপারজায়েন্ট স্টার। তাই তারা পাওয়া যায় কয়েক গোত্রেরঃ প্রধান পরম্পরার তারা, দানবিক তারা, বামন তারা, ও মহাদানবিক তারা।
তারা যে বিভিন্ন গোত্রের প্রধান পরম্পরা, দানবিক, বামন, ও মহাদানবিক, এর কারণ কী? তারাদের রয়েছে বিভিন্ন রকম ভর। প্রধান পরম্পরার তারাগুলোর মধ্যে যেগুলোর ভর বেশি, সেগুলো বেশি উত্তপ্ত ও বেশি বড়ো- কম ভরের তারাগুলোর থেকে । তারারা একবারেই চূড়ান্ত রূপ নিয়ে সুস্থির হয়ে থাকে না, তারা রূপান্তরিত বিবর্তিত হয়, এবং তাদের বয়সও বিভিন্ন। তাই মহাবিশ্বে দেখা যায় তারার বিভিন্ন রূপ । প্রতিটি তারার অভ্যন্তরে কাজ করে দুটি বিপরীতমুখি শক্তি : অভিকর্ষ ভেতরের দিকে টানে তারার গ্যাসকে, আর গ্যাসের ও বিকিরণের চাপ গ্যাসকে ঠেলে বাইরের দিকে। কোনো সুস্থিত তারায় প্রতিষ্ঠিত হয় অন্তর্মুখি ও বহির্মুখি চাপের ভারসাম্য। প্রধান পরম্পরার সুস্থিত তারার অভ্যন্তরে নিরস্তর চলে হাইড্রোজেনের পারমাণবিক বিক্রিয়া; এ-তারায় যেহেতু থাকে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন, তাই দীর্ঘকাল ধ’রে প্রধান পরম্পরার তারা থাকে সুস্থিত রূপে । যদি কোনো সুস্থিত তারাকে হঠাৎ অনেক সম্প্রসারিত ক’রে দেয়া যেতো, তাহলে তারাটির গ্যাস শীতল হয়ে কমতো তার পারমাণবিক বিক্রিয়া, হ্রাস পেতো বহির্মুখি চাপ, এবং তারাটির বাইরের স্তর ধ’সে পড়তো ভেতরের দিকে । সূর্যের থেকে বড়ো কোনো তারার- যার ভেতরে পুড়ছে হাইড্রোজেন- দীপ্তি ও তাপ অনেক বেশি সূর্যের থেকে। সূর্যের সমভরের ও অভিন্ন গঠনের যে-কোনো হাইড্রোজেন-জ্বলা তারা হবে সূর্যেরই মতোই। ও-শ্রেণীর মহাদানবিক তারাগুলোর ভর ৪০ থেকে ১০০ গুণ বেশি সূর্যের ভরের থেকে । তারার ভর ও গঠন জানা হয়ে গেলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সহজেই বের করতে পারেন তারাটির রূপ ও স্বভাব, এবং সব কিছু। কোনো তারার ভর ও রাসায়নিক গঠন জানার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেমন পারেন তারাটির সম্পূর্ণ বর্তমান রূপ বা কাঠামো বর্ণনা করতে, তেমনি পারেন তার ভবিষ্যৎ নির্দেশ করতে। তাঁরা এখন সূর্যের অভ্যন্তরের রূপ কী, শুধু তাই বর্ণনা করতে পারেন না, ১% হাইড্রোজেন কমলে সূর্যের কী অবস্থা হবে, ৪% হাইড্রোজেন কমলে কী অবস্থা হবে, তাও নির্দেশ করতে পারেন।
সূর্য উদ্ভূত হয়েছিলো এক শীতল ম্লান আন্তনাক্ষত্রিক মেঘরূপে। সূর্যের মতো যে-কোনো তারার জীবন শুরু হয় শীতলভাবে, তখন তার দীপ্তি থাকে কম, কিন্তু ব্যাসার্ধ থাকে খুব বড়ো- সূর্যের ব্যাসার্ধের ১০০ গুণেরও বেশি। তারাটি সংকুচিত হয় তাড়াতাড়ি, হয়ে ওঠে উজ্জ্বল, এবং কয়েক মিলিয়ন বছরে তার ব্যাসার্ধ ক’মে হয় সূর্যের ব্যাসার্ধের কয়েক গুণ। এ-সময়ে তারাটি এগিয়ে আসে প্রধান পরম্পরার দিকে। তার ভেতরে শুরু হয় পারমাণবিক বিক্রিয়া, কেননা তখন তার কেন্দ্রস্থলের তাপ হয় ১০ মিলিয়ন ডিগ্রিরও বেশি । পারমাণবিক বিক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তার ভেতরের হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হ’তে থাকে হিলিয়াম বা সৌরকে; এবং তারাটি লাভ করে একটি সুস্থিত প্রধান পরম্পরার অবয়ব। কোনো তারার প্রধান পরম্পরায় পৌঁছোতে লাগে ১০ কোটি বছর, পৌঁছোনোর পর ওই অবস্থায় থাকে মোটামুটি ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি বছর।
এক সময় কেন্দ্রস্থলের হাইড্রোজেন ফুরিয়ে দ্রুত বদল ঘটতে থাকে তারাটির। এ-সময়ে তার কেন্দ্রস্থল থাকে হিলিয়ামপূর্ণ। তার উপাদান বদলে গেছে, তাই বদলে যেতে থাকে অবয়ব : তার অন্তর্ভাগ সংকুচিত হ’তে থাকে, অত্যন্ত উচ্চ তাপে পুড়তে থাকে হাইড্রোজেন, প্রসারিত হ’তে থাকে বাইরের স্তরগুলো। তারাটি আর স্বাভাবিক তারা থাকে না, দীপ্তি ও ব্যাসার্ধ বেড়ে তারাটি হয়ে ওঠে এক প্রকাণ্ড দানবিক তারা । এর ভেতরের একেকটি উপাদান পুড়তে থাকে, পুড়ে পুড়ে ঘটতে থাকে বিস্ফোরণ; তারাটির ভেতরের সমস্ত দাহ্য বস্তু নিঃশেষ হয়ে সংকুচিত হয় সম্পূর্ণ তারাটি । অবশেষে তারাটি এতো সংহত ঘনীভূত সংকুচিত হয় যে আর সংকুচিত হ’তে পারে না; তখন এটি হয়ে ওঠে খুবই ছোটো- একটি গ্রহের আকারের; তারাটি আর আগের তারা থাকে না, হয়ে ওঠে একটি শাদা বামন তারা। তারার বিবর্তন ঘটে পরম্পরাক্রমে : প্রথমে উদ্ভূত হয় প্রত্নতারা, বিবর্তিত হয়ে হয় প্রাক-প্রধান পরম্পরা তারা, তারপর বিবর্তিত হয়ে হয় প্রধান পরম্পরা তারা, তারপর হয় দানবিক তারা, শেষে হয় শাদা বামন বা অন্যান্য ছোটো তারা। তারার বিবর্তন ঘটে বিভিন্ন হারে; যে-তারার ভর যতো বেশি সেটি নিঃশেষিত হয় ততো তাড়াতাড়ি। সূর্যের সমান ভরের তারা টিকে থাকে ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি বছর, আর সূর্যের থেকে ১০ গুণ ভরের তারা টিকে থাকে মাত্র ২ কোটি বছর— মহাজাগতিক চোখের এক পলক। সূর্যের বয়স এখন ৪.৬ বিলিয়ন বছর; সূর্য টিকে থাকবে আরো ৪:৪ বিলিয়ন বা ৪৪০ কোটি বছর।
তারাদের সূচনা ঘটে অন্যান্য তারার মধ্যবর্তী স্থানে ছড়ানো পাতলা লঘু বস্তু থেকে । এক তারা থেকে আরেক তারার মধ্যবর্তী স্থান থাকে প্রায় শূন্য, সেখানে থাকে স্বল্প পরিমাণে লঘু ঠাণ্ডা গ্যাস। তার ৪ ভাগের ৩ ভাগ হাইড্রোজেন, বাকিটা হিলিয়াম । মহাশূন্যের কোনো কোনো স্থানে গ্যাস ও ধুলোকণার ঘনত্ব হয় বেশি, প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে পরমাণুর পরিমাণ ১০,০০০-এর মতো। এমন স্থানে পরমাণুরাশি আসে বেশ কাছাকাছি, তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, ও তাতে গ’ড়ে ওঠে অণুরাশি । এমন অঞ্চলকে বলা হয় আণবিক মেঘমণ্ডল । আণবিক মেঘমণ্ডল আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসের থেকে ঘন, তবে তা অনেকটা শূন্যই। এই আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধুলো এক সময় যথেষ্ট পরিমাণে ঘন ও শীতল হয়ে অভিকর্ষের টানে সংকুচিত হয়, তখন জন্ম নেয় প্রত্নতারা : প্রোটোস্টার।
কোনো আন্তনাক্ষত্রিক মেঘ এ-অবস্থায় থাকতে পারে লাখ লাখ বছর; তারপর নিকটে কোথাও হয়তো বিস্ফোরিত হয় কোনো তারা, বা ঘটে অন্য কোনো গোলমাল, যার ফলে গ্যাসের মেঘমণ্ডল ভেঙেচুরে ধ’সে সংকুচিত হয়ে জড়ো হ’তে থাকে একখানে । এটা ঘটতে লাগে হাজার হাজার বছর,- খুবই কম সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের কালের মাপে। কখনো একটি আবর্তিত মেঘমণ্ডল ভেঙে টুকরো হয়ে জন্ম নিতে পারে দুটি বা তার বেশি তারা। গ্যাসের মেঘমণ্ডল ভেঙেচুরে ধ’সে যখন লাভ করে তারার আয়তন, তখন বহির্মুখি চাপে শ্লথ হয়ে আসে তার ধস নামা । এমন তারাকে বলা হয় প্রাক-প্রধান পরম্পরার তারা।
বৃষ তারামণ্ডলের ‘টি টৌরি’ তারাগুলো প্রাক-প্রধান পরম্পরার তারাগুলোর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর বয়স ২০,০০০ থেকে ১,০০০,০০০ বছর। টৌরোস (বৃষ) ও অরিয়ন (কালপুরুষ) তারামণ্ডলে ছড়িয়ে আছে প্রচুর প্রাক-প্রধান পরম্পরার তারা; আকাশের অন্যান্য এলাকায়ও এ-তারা প্রচুর মেলে । যে-তারার ভর যতো বেশি সেটি ততো দ্রুত বিবর্তিত হয়, এবং হয়ে ওঠে প্রধান পরম্পরার তারা, কম ভরের তারারা বেশি সময় নেয় বিকাশে। ১৫ সূর্য-ভরের তারা ১০০,০০০ বছরেই প্রধান পরম্পরার তারা হয়ে ওঠে; কিন্তু সূর্যের সমান ভরের তারার প্রধান পরম্পরার তারারূপে বিকশিত হ’তে সময় লাগে বহু মিলিয়ন বছর । কোনো প্রাক-প্রধান পরম্পরার তারা যখন অন্তর্ভাগে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন শুরু করে, তখনই তারাটি হয়ে ওঠে একটি প্রধান পরম্পরার তারা। এর আগে তারাটিতে শক্তি উৎপাদিত হয় সংকোচনের ফলে।
সূর্য ও তার মতো প্রধান পরম্পরার তারায় শক্তি উৎপাদিত হয় পরম্পরাক্রমে সংঘটিত একরাশ পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে; এমন বিক্রিয়াপরম্পরাকে বলা হয় প্রোটন-প্রোটন শেকল : প্রোটন-প্রোটন চেইন। শুধু সূর্যে নয়, যে-সব তারার ভর সূর্যের ভরের দেড় গুণের কম, সে-সব তারায় এ-প্রক্রিয়ায়ই উৎপাদিত হয় শক্তি । এসব তারার অন্তর্ভাগের তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন কেলভিনের কম । যে-সব তারার ভর সূর্যের ভরের দেড় গুণের বেশি ও অন্তর্ভাগের তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন কেলভিনের বেশি, সেগুলোতে শক্তি উৎপাদিত হয় ‘কার্বন চক্র’ নামের বিক্রিয়ায়।
মহাশূন্যের যে-সব বস্তুর ভর সূর্যের ভরের ৮% ভাগেরও কম বা বৃহস্পতির ভরের ৮০ গুণ, এবং গ্রহের আকারের থেকে বড়ো, সেগুলোকে বলা হয় বাদামি বামন : ব্রাউন ডোয়ার্ফ। এগুলো তারা হয়ে উঠতে পারে নি, কেননা এদের ভেতরে কোনো পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটে না। কোনো আণবিক মেঘমণ্ডলের ভর যদি হয় ১০০ সূর্য-ভরের মতো এবং যদি হয় যথেষ্ট ঘন, তাহলে তার ঘটে প্রচণ্ড তীব্র সংকোচন; এবং ভেতরে সৃষ্টি হয় চরম উত্তাপ ও চাপ। এর ফলে উৎপাদিত হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি, তারাটি হয়ে ওঠে অত্যন্ত দীপ্ত; এজন্যে তারাটি বেশি সময় টিকে থাকতে পারে না, অল্পকালের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়।
তারাদের জন্ম হয় এবং মৃত্যু ঘটে- কিছুই অবিনশ্বর নয় । কোনো ভরের ভেতরে যখন শুরু হয় পারমাণবিক বিক্রিয়া, তখন জন্মে তারা; যখন অবসান ঘটে পারমাণবিক বিক্রিয়ার, তখন মারা যায় তারাটি। সূর্যের ১০৭ বছর লেগেছে বিকশিত হ’তে, প্রধান পরম্পরার তারারূপে সূর্য জীবন যাপন করবে ১০১০ বছর, মোটামুটি ১০ বছর কাটাবে দানবিক তারারূপে, এবং এরপর স্বল্প সময় টিকে থাকবে অস্থির তারারূপে। তারার আছে ভ্রূণরূপে বাড়া, জন্ম নেয়া, বাল্যকাল ও যৌবন ও বার্ধক্য কাটানো, অসুস্থ হওয়া, ও তারপর মৃত্যু। তারা ধীরেধীরে মরতে মরতে এক সময় হঠাৎ মারা যায় । আমরা যেমন ধীরেধীরে মরি অর্থাৎ বেঁচে থাকি, তারারাও তেমনি, যখন বাঁচতে থাকে তখন ফুরোতে থাকে ভেতরের হাইড্রোজেন, এক সময় সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে বরণ করে মৃত্যু- অভিকর্ষ চেপে ধরে তার গলা । কোনো প্রধান পরম্পরার তারার অন্তর্ভাগের হাইড্রোজেন ফুরিয়ে এলে ঘটে নানা ঘটনা । প্রথম দিকে অন্তর্ভাগটি নিজেকে দগ্ধ ক’রে বেরিয়ে আসতে পারে বাইরের স্তরগুলোর দিকে, যেখানে তখনও অবশিষ্ট আছে কিছুটা হাইড্রোজেন; তার ফলে ফেটে ফুলে বিশাল আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে তারাটি । বাইরের স্তরের হাইড্রোজেন ফুরিয়ে যাওয়ার পর তারাটি নিজের অভিকর্ষের টানে সংকুচিত হয়ে ছোটো হয়ে পড়ে। এ-সময়ে ভেতরে পুড়তে থাকে হিলিয়াম, তাপ বাড়তে থাকে; এক সময় হিলিয়ামও শেষ হয়ে যায় । সব কিছু পুড়ে নিঃশেষ হয়ে তারাটি ধারণ করে অতিশয় ঘনীভূত সংহত রূপ।
কোনো তারার ভেতরের হাইড্রোজেন পুড়ে পুড়ে যখন নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন তারাটির অন্তর্ভাগ ঘিরে থাকে একটি পাতলা আবরণ । আবরণের ভেতর চলতে থাকে হাইড্রোজেনের দহন । তাপ বেড়ে তারাটির বাইরের স্তরগুলো প্রসারিত হয়, তারাটি বিবর্তিত হ’তে থাকে দানবিক রূপের দিকে। তার বাইরের মণ্ডল বেড়ে হয় বিপুল, লঘু, শীতল; তবে তার অন্তর্ভাগ থাকে ছোটো, অত্যন্ত উত্তপ্ত, ঘনীভূত । বাইরের দিক থেকে তারাটির বহির্মণ্ডলকে জ্বলতে দেখা যায় নিষ্প্রভ মৃদু লাল আগুনে বা আলোতে । একে বলা হয় লাল দানব। এগুলো সূর্যের আয়তনের ১০০০ গুণ বড়ো হ’তে পারে। সূর্য যখন হয়ে উঠবে ভয়াবহ করুণ লাল দানব, তখন সূর্যের বহির্মণ্ডল প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথেরও বাইরে! আর্কটুরুস ও আলডেররন তারা দুটি লাল দানব।
লাল দানব তারার প্রসারণের পর তার বহির্মণ্ডলের কিছু গ্যাস বাইরে ছড়িয়ে প’ড়ে তারাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এভাবেই অনেক লাল দানব হারিয়ে ফেলে ভর ৷ তারা যতো বড়ো ততো বেশি প্রচণ্ড ততো অস্থির হয় তার বিবর্তন আর রূপান্তর। সূর্যের থেকে কয়েক গুণ বেশি ভরের তারা থাকে বেশি উত্তপ্ত, তাদের বিবর্তনও ঘটে দ্রুত। এসব তারার বহির্মণ্ডল বেড়ে এগুলো উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে দানবিক তারার থেকেও; এজন্যে এগুলোকে বলা হয় মহাদানবঃ সুপারজায়েন্ট। এগুলো আকারে দানব তারার থেকে বড়ো নয়, এগুলোর উজ্জ্বলতা বেশি দানব তারার থেকে। কালপুরুষ তারামণ্ডলের আর্দ্রা (বেটেলজিউস) ও বৃশ্চিক তারামণ্ডলের জ্যেষ্ঠা (অ্যান্টারেস) লাল মহাদানব তারা।
কোনো কোনো তারা অস্থির চঞ্চল, এগুলোর প্রভা বাড়ে কমে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বা বছরে বছরে। এগুলো অস্থির তারা। অধিকাংশ অস্থির তারাই দানবিক স্তর পেরিয়ে আসা তারা, তবে প্রাক-প্রধান পরস্পরার কোনো কোনো তারাও অস্থির। এগুলো কখনো স্পন্দিত হয়, কাঁপে, তীব্রভাবে জ্ব’লে ওঠে কখনো; খ্রিপ্ ১৩৪ অব্দে এমন একটি ‘নতুন তারা’র জ্ব’লে ওঠা দেখেছিলেন হিপ্পারকাস। পৃথিবী থেকে ৭৭ পারসেক দূরে অবস্থিত মিরা (এর অর্থ ‘বিস্ময়কর’) বা ‘অমরিক্রন সেটি’ একটি অস্থির তারা ৷ ধ্রুবতারাকে যতোই ধ্রুব মনে করি না কেনো, ধ্রুবতারার ধ্রুবত্ব নিয়ে যতোই রূপক তৈরি করি না কেনো, এটি একটি অস্থির তারা; এটির প্রভাও স্থির নয়, অবস্থানও স্থির নয়। এটির প্রভা ২.৫ থেকে বেড়ে ২.৬ হয়ে ওঠে ৪ দিনেরও কম সময়ে; আর পৃথিবীর শির নাড়ানোর ফলে এটি ২৬,০০০ বছরে উত্তর আকাশে থাকে মাত্র কয়েক শতাব্দী । এ পর্যন্ত ২২,৬৫০টি অস্থির তারা শনাক্ত করা হয়েছে।
সূর্যের ০.১ ভাগ থেকে কয়েক গুণ বেশি ভরের তারাগুলোর রয়েছে এক বিশেষ পরিণতি; এগুলো পরিশেষে হয়ে ওঠে শাদা বামন । বিবর্তিত হ’তে হ’তে এগুলোর বাইরের মণ্ডল প্রসারিত হয় ব্যাপকভাবে, অন্তর্ভাগ থাকে ঘনীভূত ও অতি উত্তপ্ত । এক সময় দহন বন্ধ হয়ে যায় অন্তর্ভাগে, এবং নিজের অভিকর্ষের টানে ধসে পড়ে তারাটি । বিধ্বস্ত অবস্থায় এটি হয়ে ওঠে অতি ঘনীভূত অতি উত্তপ্ত এক ছোটো তারা; আকারে পৃথিবীর সমান। এটি শাদা বামন তারা। ২০০ শাদা বামন শনাক্ত করা হয়েছে এ পর্যন্ত । ১৮৪৪ অব্দে ফ্রিডরিখ বেসেল বোধ করেন যে আকাশের উজ্জ্বলতম তারা সিরিয়াস বা লুব্ধককে প্রদক্ষিণ করছে একটি অদৃশ্য তারা । ১৯১৫ অব্দে অ্যাডাম্স্ আবিষ্কার করেন তারাটি; দেখেন এটি এক অচেনা অদ্ভূত তারা;- আকারে পৃথিবীর সমান, খুবই ঘনীভূত; এর এক ঘনইঞ্চির ওজন হবে এক টন । এটি একটি শাদা বামন তারা। শাদা বামন তারার উদ্ভব ও বিবর্তন ব্যাখ্যা করেন আর্থার এডিংটন ও এস চন্দ্রশেখর। যখন তারায় বহির্মুখি চাপ সৃষ্টির মতো কোনো শক্তি থাকে না, তখন তারাটি ধসে পড়ে, তার অণুরাশি ঠেসে গাদাগাদি ক’রে সৃষ্টি করে এক অতি ঘনীভূত পদার্থ, যাকে বলা হয় ভ্রষ্ট পদার্থঃ ডিজেনারেট ম্যাটার। এর ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ১০১ কেজি। ভ্ৰষ্ট পদার্থে গঠিত ব’লে-শাদা বামান তারাকে ভ্রষ্ট তারাও বলা হয় । শাদা বামন তারার ভর ১.৪ সূর্য-ভরের বেশি হ’তে পারে না। সূর্য যখন লাল দানব হয়ে উঠবে ৫ বিলিয়ন বছর পর, তখন সূর্য শরীর থেকে হয়তো ঝেড়ে ফেলবে তার ৪০% ভর; এবং ধ’সে প’ড়ে সূর্য হয়ে উঠবে ০.৬ সূর্য-ভরের একটি শাদা বামন।
প্রকাণ্ড আকারের কোনো লাল দানব বিধ্বস্ত হ’লে তার অন্তর্ভাগটি পুড়তে পুড়তে বেরিয়ে আসে বহির্ভাগের দিকে । এ প্রকাণ্ড লাল দানবগুলো শাদা বামন হয় না; মহাবিস্ফোরণে ঝেড়ে ফেলে বাইরের সব মণ্ডল। তারার মহাবিস্ফোরণকে বলা হয় সুপারনোভাঃ নতুন তারা । আছে নানা রকম সুপারনোভা । এক ধরনের সুপারনোভা ঘটে যুগলবন্দী তারায়ঃ এতে ভর ঝেড়ে ফেলতে থাকে একটি তারা, সেটিকে ঘিরে ঘোরে একটি শাদা বামন। আরেক ধরনের সুপারনোভা ঘটে তারাটির বিবর্তনের ফলে । প্রকাণ্ড কোনো লাল দানবে যখন তাপ বেড়ে কয়েক বিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিনে গিয়ে পৌঁছে, তখন ঘটে মহাবিস্ফোরণ- সুপারনোভা । সুপারনোভা বিস্ফোরণে তারাটির দীপ্তি হয় সূর্যের দীপ্তির ১০ বিলিয়ন গুণ ৷ বিস্ফোরিত তারাটি কয়েক দিনের জন্যে জ্বালিয়ে রাখে সারাটি নক্ষত্রপুঞ্জকে; তারপর নিভে যায় কয়েক মাসে। সৌরজগতের বেশ কাছে ঘটেছে এমন অনেক বিস্ফোরণ; প্রাচীন কালের মানুষেরা এগুলোকে মনে করেছে ‘নতুন তারা’ । প্রাচীন চিনারা একে বলতো ‘অতিথি তারা’। কয়েকটি বিখ্যাত সুপারনোভা হচ্ছে লুপুস সুপারনোভা (দেখা গেছে ১০০৬ অব্দে), ক্র্যাব নীহারিকা বিস্ফোরণ (দেখা গেছে ১০৫৪ অব্দে), টাইকোর তারা (দেখা গেছে ১৫৭২ অব্দে), কেপলারের তারা (দেখা গেছে ১৬০৪ অব্দে) প্রভৃতি। সবচেয়ে বিখ্যাত সুপারনোভা হচ্ছে ক্র্যাব নীহারিকা বিস্ফোরণ; ১০৫৪ অব্দের জুলাই মাসের ২৩ দিন ধ’রে এটিকে দিনের বেলাও দেখা গেছে । ১৯৮৭ অব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭:৩৫ মিনিটে বৃহৎ মেগেলান মেঘ নক্ষত্রপুঞ্জে বিস্ফোরিত হয় ২০ সূর্য-ভরের একটি তারা । এটি আমাদের সময়ের সুপারনোভা।
শাদা বামন অতি সংহত ইলেকট্রন তারা- এর ভেতর চলে ইলেকট্রনের বিক্রিয়া; তবে এর থেকেও সংহত অধিকতর ঘনীভূত তারা আছে। সবচেয়ে সংহত অতিশয় ঘনীভূত তারা হচ্ছে নিউট্রন তারা বা পালসারঃ স্পন্দনশীল তারা। নিউট্রন তারা শুধুই নিউট্রনে গঠিত, শাদা বামনের থেকেও ছোটো; এর ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ১০১৭ কেজি। এক চামচ নিউট্রন তারার ওজন হবে ১০০ মিলিয়ন টন! ২০ কিলোমিটার একটি নিউট্রন তারা ধারণ করতে পারে সূর্যের সমস্ত ডর। নিউট্রন তারার স্বপ্ন দেখেছেন জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানীরা অনেক বছর, কিন্তু কেউ দেখেন নি । ১৯৬৭ অব্দের নভেম্বরে আবিষ্কৃত হয় এক অদ্ভুত নতুন ধরনের রেডিও সংকেতের উৎস, জানুয়ারিতে আবিষ্কৃত হয় আরেকটি উৎস। উৎসগুলো স্পন্দনশীল ব’লে এগুলোর নাম দেয়া হয় পালসারঃ স্পন্দনকারী। তারপর ধরা পড়ে এই স্পন্দনকারীরাই নিউট্রন তারা। ১৯৭৩-এর মধ্যে আবিষ্কৃত হয় ১০০টি পালসার। ধ’সে পড়ার পর এ-তারাগুলোর ঘূর্ণন হয় অতিশয় দ্রুত। ১৯৮২ অব্দে আবিষ্কৃত হয় সবচেয়ে দ্রুত ঘূর্ণনশীল একটি পালসার; পারমাণবিক পদার্থের এ-গোলকটি প্রতি সেকেন্ডে ঘোরে ৬৪২ বার।
পালসারের পর শুরু হয় আরো ঘনীভূত আরো সংহত বস্তু খোঁজা; এবং জানা যায় আছে আরো অদ্ভুত বিস্ময়কর অভাবিত বস্তু, যার নাম কৃষ্ণগহ্বরঃ ব্ল্যাক হোল । কৃষ্ণগহ্বর এতো ঘনীভূত সংহত জিনিশ যে তার অভিকর্ষ বন্দী ক’রে ফেলতে পারে আলোকেও। ১৭৯৮ অব্দে পিয়ের লাপ্লাস বলেছিলেন এমন ঘনীভূত বস্তুও থাকতে পারে, যার থেকে মুক্তির বেগ হবে আলোর গতির থেকেও বেশি । তিনি ভেবেছিলেন এমন বস্তু হবে চিরকৃষ্ণ। কৃষ্ণগহ্বর কি আছে? আইনস্টাইনের তত্ত্ব প্রয়োগ ক’রে অনেক তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন কৃষ্ণগহ্বর সম্ভবত আছে । তাঁরা মনে করেন কৃষ্ণগহ্বর অতিশয় ঘন বস্তু, যাকে ঘিরে থাকবে একটি ‘ঘটনা দিগন্ত’ : ইভেন্ট হরাইজন। ঘটনা দিগন্ত হচ্ছে এমন এক তাত্ত্বিক তল বা এলাকা, যার থেকে কোনো বিকিরণ বা বস্তু বেরিয়ে যেতে পারে না। এখান থেকে মুক্তি পেতে হ’লে লাগবে আলোর গতির থেকে বেশি গতি, যা অসম্ভব। কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হ’তে পারে ২৫ বা তার থেকেও বেশি সূর্য-ভরের তারা ভেঙেচুরে ধ’সে পড়ার ফলে; বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর তারার পরিত্যক্ত বস্তু থেকে। কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন স্টিফেন হকিং : তাঁর মতে মহাবিশ্বের সূচনার সময় পদার্থ ছিলো অতিশয় ঘনীভূত, সেই ঘনপদার্থে গঠিত কৃষ্ণগহ্বর শুরু থেকেই থাকতে পারে মহাবিশ্বে; আর কৃষ। কৃষ্ণগহ্বর এতো সংহত যে এক কিলোমিটার একটি ধারণ করতে পারে একটি তারার ভর, বা ১০৩০ কেজি ভর ৷
কৃষ্ণগহ্বর যদি সত্যিই থাকে, তাহলে তার থাকবে সম্পূর্ণ অজানা বৈশিষ্ট্য । কিন্তু কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে কৃষ্ণগহ্বর, কেননা সেখান থেকে তো কিছুই বেরিয়ে আসতে পারবে না। কোনো অনুসন্ধানী যান সেখানে গেলে সেটি লুপ্ত হয়ে যাবে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব থেকে । লুপ্ত হয়ে কোথায় যাবে? অন্য কোনো মহাবিশ্বে কৃষ্ণগহ্বর কি তাহলে অন্য কোনো মহাবিশ্ব? কেউ জানে না। কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না কিছুই, এমনকি বিকিরণও; তাহলে কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কৃত হবে কীভাবে? একটি উপায় আছে হয়তো;- ‘ঘটনা দিগন্ত’-এর বাইরে কৃষ্ণগহ্বরের আচরণ তার সমভরের তারার মতোই । কৃষ্ণগহ্বর কোনো যুগল তারার সদস্য হ’তে পারে, এবং ঘুরতে পারে অন্য তারাটি ঘিরে। দূর থেকে কৃষ্ণগহ্বরটি দেখা যাবে না, কিন্ত তার কক্ষপথের গতি নির্ণয় করা যাবে, হিশেব করা যাবে অদৃশ্য সঙ্গীটির ভর। অদৃশ্য সঙ্গীটিই হবে কৃষ্ণগহ্বর। এমন দুটির অস্তিত্ব টের পাওয়া গেছেঃ একটিকে বলা হয় সাইগনাস এক্স-১ (আছে ২৫০০ পারসেক দূরে), আরেকটি পাওয়া গেছে বৃহৎ মেগেলান মেঘ নক্ষত্রপুঞ্জে, নাম দেয়া হয়েছে এলএমসি এক্স-৩ (আছে ৫৫,০০০ পারসেক দূরে)।
মহাকাশ এক ধরনের মহাশূন্যতা, তবে সম্পূর্ণ শূন্য নয়; সেখানে ছড়িয়ে আছে গ্যাস ও ধুলোর সুবিশাল গেমের পর মেগ, যাদের বলা হয় নীহারিকাঃ নেবুলা। নানা আকার বা রূপ নীহারিকাদের, কোনোটি দোমড়ানো মোচড়ানো, কোনোটি অন্ধকার কালো, কোনোটি রঙে রঙে বোনা। ১৭৮১ অব্দে নীহারিকার তালিকা তৈরি করেছিলেন চার্লস মেসিয়ের। নীহারিকাগুলো সাধারণ পরিচিত মেসিয়ের সংখ্যা বা এম সংখ্যা দিয়ে; যেমন, অরিয়ন নীহারিকা হচ্ছে এম ৪২। এর পরও দুটি তালিকা তৈরি হয়েছে; একটি ‘নিউ জেনারেল ক্যাটালগ’, আরেকটি ‘ইন্ডেক্স ক্যাটালগ’। এ-দুটি তালিকার নীহারিকাগুলো পরিচিত তাদের এনজিসি সংখ্যা বা আইসি সংখ্যা দিয়ে।

মহাশূন্যে, এক তারা থেকে আরেক তারার মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে, ছড়িয়ে আছে গ্যাসের অণু ও পরমাণু, অতিক্ষুদ্র ধুলোকণা, এবং সম্ভবত আরো বড়ো আকারের কিছু বস্তু । আন্তনাক্ষত্রিক বস্তুরাশি সুষমভাবে ছড়িয়ে নেই; কোথাও আছে আন্তনাক্ষত্রিক বস্তুর ঘন মেঘমণ্ডল অর্থাৎ নীহারিকা, বিভিন্ন এলাকার তাপ ও বিভিন্ন। বিভিন্ন এলাকার গ্যাসের অবস্থা অনুসারে আন্তনাক্ষত্রিক শূন্যতাকে ভাগ করা হয় চারটি অঞ্চলে (১) গ্যাস ও ধুলোকণার অন্ধকার ঠাণ্ডা এলাকাকে বলা হয় ‘আণবিক মেঘ’; এখানে তাপমাত্রা ১০ কেলভিন, এবং গ্যাস আছে অণু অবস্থায়; (২) নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন অণুর বিস্তৃত এলাকাকে বলা হয় ‘এইচআই এলাকা’ (এইচআই নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন অণুর প্রতীক); এখানকার তাপমাত্রা ১০০ কেলভিন; (৩) উত্তপ্ত ও এবং বি তারার চারপাশের ১০,০০০ কেলভিন উত্তপ্ত এলাকাকে বলা হয় ‘এইচআইআই এলাকা’ (এইচআইআই আয়নিত হাইড্রোজেন অণুর প্রতীক); (৪) ১০৬ কেলভিন উত্তপ্ত এলাকাকে বলা হয় ‘সুপারবাবেল’ বা ‘পরাবুদ্বুদ’ । আণবিক মেঘ এলাকায়ই সাধারণত জন্ম নেয় তারা। এ-মেঘ টিকে থাকতে পারে ৩০ মিলিয়ন বছর, আর এখানে সেখানে জন্ম নিতে পারে তারা।
দূরবিনে দেখতে যেমন দেখায় নীহারিকাগুলোকে সাধারণত সেই নামে ডাকা হয়; যেমন, ‘অশ্বমুণ্ড নীহারিকা’, ‘ডামবেল নীহারিকা’, ‘কয়লার বস্তা নীহারিকা’ ইত্যাদি । নীহারিকার দুটি প্রধান শ্রেণী হচ্ছে অন্ধকার নীহারিকা ও উজ্জ্বল।
নীহারিকা। আণবিক মেঘের অন্ধকার এলাকাগুলো সাধারণত দেখা দেয় অন্ধকার নীহারিকারূপে; উজ্জ্বল নীহারিকাগুলো অনেকটা লালাভ। এক ধরনের উজ্জ্বল নীহারিকাকে বলা হয় প্রতিফলনকারী নীহারিকা, কেননা এগুলো পাশের কোনো তারার আলো প্রতিফলিত করে। আরেক ধরনের উজ্জ্বল নীহারিকাকে বলা হয় গ্রহ-নীহারিকা; এগুলোর কেন্দ্রে থাকে একটি তারা, তারাটি আলোড়িত ক’রে চলে নীহারিকাটিকে। অরিয়ন (কালপুরুষ) তারামণ্ডলের দিকে, পৃথিবী থেকে ৪০০ পারসেক দূরে, আছে একটি এলাকা, যেখানে নীহারিকার ভেতরে চলছে তারা সৃষ্টির উৎসব। ফেব্রুয়ারির কোনো সন্ধ্যায় অরিয়নের দিকে তাকালে দেখা যায় অজস্র উজ্জ্বল তারার সমারোহ। অরিয়নে আছে আকাশের ১০০টি উজ্জ্বলতম তারার ৭টি তারা, আর বেটেলজিউস ছাড়া ওগুলোর প্রতিটিই প্রকাণ্ড । ওগুলো ও এবং বি-শ্রেণীর তারা, আছে ১৪০ থেকে ৫০০ পারসেক দূরে। প্রকাণ্ড তারাদের আয়ু কম; তাই বোঝা যায় অরিয়নকে ঘিরে যে-নীহারিকা আছে, সেখানে এগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে সম্প্রতি। কয়েকটি বিখ্যাত নীহারিকা হচ্ছে অরিয়ন নীহারিকা, অশ্বমুণ্ড নীহারিকা, এটা কারিনা নীহারিকা, গাম নীহারিকা।
সূর্য একটি নিঃসঙ্গ তারা; তবে মহাশূন্যের অধিকাংশ তারাই এমন নিঃসঙ্গ নয়, তাদের রয়েছে সঙ্গী— দুটি তিনটি তারা আছে এক মহাস্থানে, ঘুরছে পরস্পরকে ঘিরে। যখন দুটি তারা এক সাথে থাকে, প্রদক্ষিণ করে পরস্পরকে, তখন তাদের বলা হয় যুগল তারা সংশয়ঃ বাইনারি স্টার সিস্টেম, বা যুগল তারা। যদি একত্রে থাকে দুয়ের বেশি তারা, তাদের বলা হয় বহু-তারা-সংশয় : মাল্টিপল স্টার সিস্টেম। পৃথিবী থেকে তারাগুলো আছে সুদূরে, তাই অনেক তারাকে দেখা যায় পরস্পরের কাছাকাছি, যেনো লেগে আছে গায়ে গায়ে। দেখতে এমন লাগলেও ওগুলো হয়তো আছে কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে পরস্পরের থেকে; এমন তারাদের বলা হয় দৃশ্যমান যুগ্মতারা। এগুলো প্রকৃত যুগল তারা নয়। যে-সমস্ত তারা পরস্পরের খুবই কাছে, শারীরিকভাবে কাছে, এবং ঘোরে পরস্পরকে ঘিরে, সেগুলোই প্রকৃত যুগল তারা। আগে মনে করা হতো আমরা যে দেখি কিছু তারা আছে খুব কাছাকাছি গায়ে গায়ে লেগে এটা নিতান্তই আমাদের দৃষ্টির বিভ্রম, দেখতে মনে হয় কাছে আছে; ১৭৬৭ অব্দে জন মিশেল বলেন যে এতো বিভ্রম ঘটতে পারে না, কিছু তারা নিশ্চয়ই আছে পরস্পরের কাছে। এগুলো শারীরিকভাবেই সন্নিকট। ১৮০৪ অব্দে উইলিয়াম হার্শেল দেখেন জেমিনি বা মিথুনরাশির ক্যাস্টর তারাটিকে ঘিরে ঘুরছে অন্য একটি তারা। যুগল তারাগুলোর মাধ্যে উজ্জ্বলতর তারাটিকে বলা হয় ‘এ’-তারা, ম্লানটিকে বলা হয় ‘বি’-তারা; যেমন, ক্যাস্টর এ, ক্যাস্টর বি; আবার বড়োটিকে বলা হয় প্রধান তারা, ছোটোটিকে বলা হয় গৌণ তারা । সাধারণত প্রধানটিই হয় বেশি উজ্জ্বল, বা তারা -এ।
যুগল তারা ও বহু-তারার উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে? এ-সম্পর্কে তত্ত্ব আছে কমপক্ষে তিনটি : বিভাজনতত্ত্ব (ফিশন), বন্দীকরণতত্ত্ব (ক্যাপচার), ও ভগ্নাংশতত্ত্ব (সাবফ্র্যাগমেন্টেশন) । বিভাজনতত্ত্বের সারকথা হচ্ছে প্রত্নতারার অতিঘূর্ণনের ফলে উৎপন্ন হয়েছে এসব তারা। অনেকে মনে করেন বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ডব্লিউ উরসা মেজরিস’ যুগল তারা। বন্দীকরণতত্ত্বের মূলকথা হচ্ছে দূরবর্তী একাধিক তারা পরস্পরের কাছাকাছি এসে বন্দী হয়ে পড়েছে পরস্পরের অভিকর্ষের বন্ধনে । ভগ্নাংশতত্ত্বের মতে তারা সৃষ্টির আগেই তারাগর্ভ কোনো মেঘ ভেঙেচুরে সৃষ্টি হয় যুগল তারা ও বহু-তারা সংশয়।
মহাশূন্যে তারাগুলো একটি দুটি ঝরা ফুলের মতো ছড়িয়ে নেই, ছড়িয়ে আছে গুচ্ছেগুচ্ছে, স্তবকে স্তবকে, ঝাঁকেঝাঁকে। তারার পর ছড়িয়ে থাকা তারাগুলোকে বলা হয় তারাগুচ্ছঃ ক্লাস্টার। তিন রকম গুচ্ছ আছে তারারঃ মুক্তগুচ্ছঃ ওপেন ক্লাস্টার, সমবায়ঃ অ্যাসোসিয়েশন, ও বটিকাকার গুচ্ছঃ গ্লোবিউলার ক্লাস্টার। উরসা মেজর (২১ পারসেক দূরে), হাইয়াডেস (৪২ পারসেক দূরে), প্লেইয়াডেস (১২৭ পারসেক দূরে) প্রভৃতি তারার মুক্তগুচ্ছ; আই অরিয়নিস (৪৭০ পারসেক দূরে) তারার সমবায়; এম ৪ (২০০০ পারসেক দূরে), এম ২২ (৩৫০০ পারসেক দূরে) প্রভৃতি তারার বটিকাকার গুচ্ছ।
মুক্ততারাগুচ্ছে তারারা থাকে বেশ ঘনবিন্যস্ত, তবে ছড়িয়ে থাকে অনেকটা এলোমেলোভাবে। একেকটি মুক্তগুচ্ছে তারা থাকে ১০০ থেকে ১০০০টি, গুচ্ছটির ব্যাস হয় ৪ থেকে ২০ পারসেক। আমাদের সূর্য সম্ভবত আছে একটি ঢিলেঢালা মুক্তগুচ্ছের প্রান্তে; ওই গুচ্ছটির কেন্দ্র ২২ পারসেক দূরে উরসা মেজর বা বড়ো ভালুক তারামণ্ডলের দিকে। সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি মুক্তগুচ্ছ হচ্ছে হাইয়াডেস ও প্লেইয়াডেস । ছায়াপথে বা মিল্কি ওয়ে নক্ষত্রপুঞ্জে ছড়িয়ে আছে প্রায় ৯০০ মুক্ততারাগুচ্ছ । তারার সমবায়ে থাকে অল্প পরিমাণ তারা, তবে ছড়িয়ে থাকে বেশি জায়গা জুড়ে; তারার সমবায়ের গঠনও বেশ শিথিল । সমবায়ে থাকতে পারে ১০টি থেকে কয়েক শো তারা, আর ব্যাস হ’তে পারে ১০ থেকে ১০০ পারসেক । এখানেই আছে প্রচুর নবীন তারা। তারার বটিকাকার গুচ্ছ বেশ ভিন্ন মুক্ততারাগুচ্ছ ও সমবায় থেকে । এগুলো অনেক বেশি প্রকাণ্ড, তারায় তারায় নিবিড়ভাবে ঠাসা, তবে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং অত্যস্ত প্রাচীন বা বৃদ্ধ । বটিকাকার তারাগুচ্ছে থাকে ২০,০০০ থেকে কয়েক মিলিয়ন তারা; কিন্তু এর ঘনবসতির আবাসিক এলাকার আয়তন মাত্র ৫ থেকে ২৫ পারসেক । এখানে তারামৌমাছিরা গিজগিজ করে, একটির গায়ে এসে লাগে আরেকটি। আমাদের থেকে সবচেয়ে কাছের বটিকাকার তারাগুচ্ছটিও হাজার হাজার পারসেক দূরে। আমাদের ছায়াপথকে ঘিরে আছে প্রায় ১৫০টি তারার বটিকাকারগুচ্ছ। মহাবিশ্বের মহাশূন্য অসীম শূন্যতা, তবে তাকে বেশ ভ’রে রেখেছে তারারা। দূরে ছোটো ছোটো তারা মিটিমিটি জ্বলে, কিন্তু বিস্মিত হয়ে আর বলতে হয় না- মিটিমিটি ছোটো তারা, তোমরা যে কী ভেবে ভেবে আমি কোনো কূল পাই না।
“মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ