সূরা আল্-ফাতিহার তাফসীর শুরু
(۱ )
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ
১. যাবতীয় প্রশংসা বিশ্ব-জগতের প্রতিপালক প্রভুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
তাফসীরঃ বিখ্যাত সাতজন কিরাআত বিশেষজ্ঞের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, আলোচ্য আয়াতের الحمد শব্দের ‘দাল’ বর্ণে ‘পেশ’ (হরকত) হইবে। বাক্য বিচারে উহা বাক্যের উদ্দেশ্য অংশ। সুফিয়ান ইব্ন ‘উয়ায়না ও রূবাহ ইব্ন ‘আজ্জাজ হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তাঁহারা বলেন, الحمد পদে এখানে কর্মকারকের বিভক্তি হিসাবে ‘যবর’ হইবে। উহার পূর্বে কোন অসমাপিকা ক্রিয়া উহ্য রহিয়াছে এবং الحمد পদটি উহারই কর্মকারক হইয়াছে।
ইব্ন আবূ আবালাহ এইরূপে পড়িতেনঃ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ অর্থাৎ তিনি الحمد পদের د বর্ণের পেশ হরকতের সহিত সাদৃশ্য বিধানের জন্য لله পদদ্বয়ের প্রথম ل বর্ণে ‘পেশ’ দিয়া পড়িতেন। আরবী ভাষায় অনুরূপ সাদৃশ্য বিধানের একাধিক দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। কিন্তু এখানে উপরোক্ত নিয়মে পাঠ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের পাঠের পরিপন্থী। .
হযরত হাসান ও হযরত যায়দ ইবাল সম্বন্ধে বর্ণিত হইয়াছে যে, তাঁহারা لله পদের প্রথম লামের হরকতের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষার্থে الحمد পদের শেষ বর্ণ দালে যের দিয়া নিম্নরূপ পড়িতেনঃ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ
ইমাম আবূ জা’ফর ইব্ন জারীর বলেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ বাক্যের তাৎপর্য হইতেছে এই যে, সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। কারণ, তিনি স্বীয় বান্দাগণকে অসংখ্য নি’আমাত ও অবদানে বিভূষিত ও ধন্য করিয়াছেন। তিনি তাঁহার ইবাদতের জন্য এবং তাঁহার আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য স্বীয় বান্দাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বৈকল্যহীন ও কার্যোপযোগী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি তাহাদের বিশ্বময় রূযী ছড়াইয়া রাখিয়াছেন। তাঁহার নিকট তাহাদের প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও তাহাদিগকে অগণ্য ও অপরিমেয় সুখকর নি’আমাত ভোগ করাইতেছেন। যে আলোকময় পথে চলিলে মানুষ আখিরাতে চিরস্থায়ী সুখ ও আনন্দ লাভ করিতে পারিবে, স্বীয় কৃপাপরায়ণতার কারণে তিনি তাহাদিগকে সেই পথ দেখাইয়াছেন। এরূপ অজস্র নি’আমাত দ্বারা তিনি মানুষকে লালন-পালন করিতেছেন। তাঁহার নি’আমাতের সংখ্যা তিনি ভিন্ন অন্য কেহ গুনিয়া শেষ করিতে পারে না। এইসব নি’আমাত দানের ক্ষেত্রে তাঁহার কোন শরীক নাই। তাঁহার যে সকল সৃষ্টিকে মানুষ মা’বূদ বানাইয়া লইয়াছে, তাহাদেরও সেক্ষেত্রে কোন কৃতিত্ব বা কর্তৃত্ব নাই। তেমনি মানুষ যাহাদের মা’বূদ বানায় নাই তাহাদেরও উহাতে কোন কৃতিত্ব বা কর্তৃত্ব নাই। এইসব নি’আমাত শুধু একক আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হইতে তাঁহার বান্দাগণের প্রতি প্রেরিত হইয়াছে। তাই সকল প্রশংসা সকল সময়ে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই প্রাপ্য।
ইমাম ইব্ন জারীর বলিয়াছেন, الحمد لله বাক্য দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যক্ষভাবে নিজের প্রশংসা করিয়া পরোক্ষভাবে স্বীয় বান্দাগণকে তাঁহার প্রশংসা বর্ণনা করিতে নিৰ্দেশ দিয়েছেন । উহা দ্বারা যেন তিনি বলিতেছেন, তোমরা বল, الحمد لله
ইমাম ইব্ন জারীর আরও বলিয়াছেন, কেহ কেহ বলেন, الحمد لله বাক্যটির তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার সকল মহৎ গুণের কারণে সকল প্রশংসা তাঁহার উদ্দেশ্যে নিবেদিত । পক্ষান্তরে الشكر للّه বাক্যের তাৎপর্য এই যে, ‘আল্লাহ্ তা’আলার নি’আমাত সমূহের কারণে সকল প্রশংসা তাঁহার জন্য নিবেদিত।’ ইমাম ইব্ন জারীর এই মত প্রত্যাখ্যান করিয়া বলেন-‘সকল আরবী ভাষাবিদ الحمد ও الشكر শব্দদ্বয়কে সমার্থক শব্দ হিসাবে প্রয়োগ করিয়া থাকেন।’ সূফী সম্প্রদায়ের ইমাম জা’ফর সাদিক (রঃ) হযরত ইব্ন ‘আতা (রঃ) ও সালমী উক্ত শব্দদ্বয় সম্বন্ধে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেন, প্রত্যেক شاكر -ই الحمد لله বলিতে পারে। অর্থাৎ الحمد ও الشكر শব্দদ্বয় সমার্থক।
ইমাম কুরতুবী ইমাম ইব্ন জারীরের উপরোক্ত অভিমতের সমর্থনে বলিয়াছেন, الحمد لله شكرا বাক্যটি শুদ্ধ বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। এখানেও الحمد ও الشكر শব্দদ্বয় সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। কারণ, شكرا শব্দটি এবং উহার উহ্য সমাপিকা ক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত বাক্যটি الحمد لله বাক্যের তাকীদ অথবা তাফসীরের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে।
আমার (ইবুন কাছীর) মতে, ইমাম ইব্ন জারীরের উপরোক্ত অভিমত গ্রহণযোগ্য নহে । কারণ, পরবর্তী যুগের বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ এই অভিমত পোষণ করেন যে, الحمد শব্দের তাৎপর্য হইতেছে কোন ব্যক্তি বা সত্তার কোন দক্ষতা বা নৈপুণ্যের কারণে অথবা অপরের প্রতি তৎকর্তৃক প্রদত্ত নি’আমতের কারণে কথার মাধ্যমে উক্ত সত্তাকে প্রশংসা করা অথবা তাহার প্রতি নিবেদিত প্রশংসা। পক্ষান্তরে الشكر শব্দের তাৎপর্য হইতেছে কোন ব্যক্তি বা সত্তার পক্ষ হইতে অপরের প্রতি প্রদত্ত নি’আমতের কারণে মন, মুখ অথবা অন্য কোন অঙ্গের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তি বা সত্তাকে প্রশংসা করা অথবা উক্ত সত্তার প্রতি নিবেদিত প্রশংসা। কবি বলেনঃ
افادتكم النعماء منى ثلاثة – يدى ولساني وضميري المحجيا
‘আমার তিনটি অঙ্গ তোমাদিগকে নি’আমত দান করিয়াছে; আমার হস্ত, আমার জিহ্বা ও আমার অদৃশ্য অন্তর।’
الحمد ও الشكر শব্দদ্বয়ের কোটির অর্থ ব্যাপকতর সে সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আলহামদু’র অর্থ ‘আশুকরো’ হইতে ব্যাপকতর। আরেক দল বলেন, ‘আশ্ শুকরোর অর্থ আলহামদু হইতে ব্যাপকতর। তবে সঠিক কথা এই যে, উহার কোনটির অর্থই অন্যটি হইতে সার্বিকভাবে ব্যাপকতর নহে; বরং উহাদের প্রত্যেকটির অর্থই অপরটির অর্থ অপেক্ষা এক দিক দিয়া ব্যাপকতর এবং অন্য দিক দিয়া সংকীর্ণতর। (আরবী ভাষায় দুই শব্দার্থের এই সম্পর্ককে বলে ‘নি’স্ববাতুল উমূম ওয়াল খুসূস’।) যেই কারণে কাহারও প্রতি الحمد বা الشكر নিবেদিত হয়, সেই কারণের বিবেচনায় الحمد শব্দের অর্থ الشكر শব্দের অর্থ হইতে ব্যাপকতর। কারণ, কোন ব্যক্তি বা সত্তার অন্তর্নিহিত গুণ কিংবা অপরের প্রতি তাহার প্রদত্ত নি’আমতের কারণে তাহার প্রতি হামদ নিবেদিত হয়। পক্ষান্তরে শোকর নিবেদিত হয় কেবলমাত্র শেষোক্ত কারণে। পক্ষান্তরে যে সব অঙ্গের মাধ্যমে কাহারও প্রতি শোকর বা হামদ নিবেদিত হয়, সেই অঙ্গসমূহের বিবেচনায় শোকর হামদ অপেক্ষা ব্যাপকতর। কারণ শোকর আদায়ে হস্ত, অন্তর, জিহ্বার যে কোন অঙ্গ ব্যবহার করা যায়। কিন্তু হামদ আদায়ে শুধুমাত্র জিহ্বা কাজে আসে। আবার কাহারও বদান্যতার কারণে যেরূপ হামদ ব্যবহৃত হয়, তেমনি তাহার অশ্ব চালনায় নৈপুণ্যের জন্যও হামদ ব্যবহার করা যায়। অথচ শোকর কেবল কাহারও বদান্যতার কারণে আদায় করা যায়, কিন্তু কাহারও অশ্ব চালনায় নৈপুণ্যের জন্য করা যায় না। পরবর্তী যুগের জনৈক বিশেষজ্ঞের লিখিত অভিমতের ইহাই সারকথা। আল্লাহ্ই অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী।
আবূ নসর ইসমাঈল ইব্ন হাম্মাদ জওহরী বলেন, الحمد (প্রশংসা) শব্দটি الذم (নিন্দা) শব্দের বিপরীতার্থক। ক্রিয়া রূপ حبمد (সে প্রশংসা করিয়াছে), يحمد (সে প্রশংসা করে বা করিবে) المحمدة – الحمد (প্রশংসা করা), محمدة – الحمد (প্রশংসিত), التحميد (অধিক প্রশংসা করা)। الحمد শব্দের অর্থ الشكر শব্দের অর্থ হইতে ব্যাপকতর। الشكر শব্দের তাৎপর্য হইতেছে উপকারীর উপকারের কারণে তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা অথবা উপকারীর উপকারের প্রতি আদায়কৃত কৃতজ্ঞতা। যেমন شكرته (আমি তাহার কৃতজ্ঞতা আদায় করিয়াছি) এবং شبكرت له (আমি তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করিয়াছি) এই উভয়বিধ প্রয়োগই শুদ্ধ। তবে শেষোক্ত প্রয়োগে অধিকতর ব্যঞ্জনা-নৈপুণ্য বিদ্যমান। পক্ষান্তরে المدح (প্রশংসা করা) শব্দটির অর্থ المد শব্দের অর্থ অপেক্ষা ব্যাপকতর। কারণ, জীবিত, মৃত, প্রাণী, অপ্রাণী সকলের প্রতিই উপকারের পূর্বে কি পরে সকল অবস্থায়ই এবং ব্যক্তির নৈপুণ্য-দক্ষতা কিংবা অপরের প্রতি কৃত উপকার ইত্যাকার সকল কারণেই المدح (প্রশংসা) প্রযুক্ত হইতে পারে। পক্ষান্তরে المد অপ্রাণীর প্রতি নহে, বরং শুধু প্রাণীর প্রতি এবং মৃতের প্রতি নহে, বরং শুধু জীবিতের প্রতি প্রযুক্ত হইতে পারে।
‘আল্হাম্দু’র তাৎপর্য
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন আবূ মালীকাহ, হাজ্জাজ, হাস্, আবূ আম্মার আল কাতীঈ, আবূ হাতিম ও ইব্ন হাতিম বর্ণনা করিয়াছেনঃ
একদা হযরত উমর (রাঃ) বলিলেন, আমরা سبحان اللّه ও لا اله الا اللّه -এর তাৎপর্য জানি, কিন্তু الحمد للّه এর তাৎপর্য কি? ইহাতে হযরত আলী (রাঃ) বলিলেন, ‘উহা আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক নিজের জন্য মনোনীত ও তাঁহার মনঃপূত একটি বাক্য।’
উক্ত রিওয়ায়েতকে অন্যতম রাবী হাস হইতে আবূ মুআম্মার ভিন্ন অন্য এক রাবী এইরূপ বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত উমর (রাঃ) একদিন হযরত আলী (কঃ) সহ অন্যান্য সঙ্গীদের বলিলেন, আমরা سبحان اللّه ও لا اله الا اللّه এবং اللّه اكير -এর তাৎপর্য জানি; কিন্তু الجمد للّه -এর তাৎপর্য কি? তখন হযরত আলী (কঃ) বলিলেন, উহা আল্লাহ্ তা’আলার নিজের জন্য মনোনীত ও মনঃপূত একটি বাক্য। উহা পাঠ করা তাঁহার নিকট প্রিয় কার্য।
ইউসুফ ইব্ন মিহির হইতে আলী ইব্ন যায়দ ইব্ন জাদ’আন বর্ণনা করেনঃ
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেনঃ الجمد للّه কৃতজ্ঞতা প্রকাশক একটি বাক্য। বান্দা যখন বলে الجمد للّه তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শোকর আদায় করিয়াছে।
ইব্ন আবূ হাতিমও এই রিওয়ায়েতটি বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ক্রমাগত যাহ্হাক, আবূ রওক, বিশ্ব ইব্ন আম্মারাহ প্রমুখ বর্ণনাকারীর সূত্রে ইব্ন আবূ হাতিম ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন, الجمد للّه হইতেছে আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁহার সৃজন, পথ প্রদর্শন ইত্যাকার নি’আমাত সমূহের জন্য শোকর আদায়।’
কা’ব আহবার বলেন, الجمد للّه হইতেছে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা।
যাহ্হাক বলেন الجمد للّه হইল আল্লাহ্ তা’আলার চাদর। এই মর্মে হাদীসও বর্ণিত হইয়াছে।
হাকাম ইব্ন উমায়র (রাঃ) হইতে ক্রমাগত মূসা ইব্ন আবূ হাবীব, মূসা ইবন ইবরাহীম, বাকীয়্যা ইব্ন ওয়ালিদ, সাঈদ ইব্ন আমর সুকূনী ও ইমাম ইব্ন জারীর বর্ণনা করেন”
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, যখন তুমি বল, الحمد للّه رب العالمين তখন তুমি উহা দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলার শোকর আদায় কর। উহার ফলে আল্লাহ্ তাআলা তোমাকে আরও নি’আমাত দিবেন।’
হযরত আসওয়াদ ইব্ন সারী’ (রাঃ) হইতে ক্রমাগত হাসান, আওফ, রওহ ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
হযরত আসওয়াদ ইব্ন সারী’ (রাঃ) বলেন, একদা আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল ! আমি আল্লাহ্ তা’আলার প্রসংশাসূচক একটি কবিতা রচনা করিয়াছি। উহা কি আপনাকে শুনাইব? নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, শুনিয়া রাখ, তোমার প্রতিপালক প্রভু প্রশংসা পছন্দ করেন।
হযরত আসওয়াদ ইব্ন সারী’ (রাঃ) হইতে ক্রমাগত হাসান, ইউনুস ইবন উবায়দ, ইবন আলীয়্যা, আলী ইব্ন হাজার ও ইমাম নাসাঈও উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করেন।
হযরত জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রাঃ) হইতে ক্রমাগত তালহা ইব্ন ফারাশ, মূসা ইব্ন ইবরাহীম ইব্ন কাছীর প্রমুখ বর্ণনাকারীর সূত্রে ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসাঈ ও ইমাম ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, শ্রেষ্ঠতম যিকর হইতেছে, لا اله الا الله এবং শ্রেষ্ঠতম দোয়া হইল الحمد لله
ইমাম তিরমিযী উপরোক্ত হাদীসকে মাত্র একটি সূত্রে বর্ণিত বিশেষ নিয়মে গ্রহণযোগ্য হাদিস حديث حسن صحيح বলেন।
হযরত আনাস (রাঃ) হইতে ইমাম ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেন বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলা কাহাকেও কোন নি’আমাত দান করিবার পর যদি সে বলে, الحمد للّه তাহা হইলে আল্লাহ্ তা’আলা নিশ্চয় তাহাকে তৎকর্তৃক প্রত্যাহৃত নি’আমাত হইতে উৎকৃষ্ট নি’আমাত দান করেন।’
হযরত আনাস (রাঃ) হইতে ইমাম কুরতুবী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে ও ‘নাওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আমার উম্মতের কাহারও অধিকারে যদি দুনিয়ার যাবতীয় ধন-সম্পদ আসিয়া যায়, অতঃপর সে বলে, الحمد للّه তাহা হইলে তাহার الحمد للّه উক্ত ধন-সম্পদ হইতে মূল্যবান হইবে।’
কুরতুবী প্রমুখ বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ উহার ব্যাখ্যায় বলিয়াছেনঃ তাহার ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলা তাহার প্রাপ্ত পার্থিব ধন-সম্পদ অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান হইবে। কারণ, পার্থিব সম্পদ স্থায়ী নহে, উহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। পক্ষান্তরে আলহামদু লিল্লাহর নেকী ও সওয়াব স্থায়ী, উহা ধ্বংস হইবে না। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
اَلْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَوةِ الدُّنْيَا، وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرُ أَمَلاً
“ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি শুধু পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ। পক্ষান্তরে তোমার প্রভুর কাছে পুরস্কার ও ভাল আশার ক্ষেত্রে স্থায়ীত্বশীল নেককার্য উত্তম।”
হযরত ইবন উমর (রাঃ) হইতে ইমাম ইব্ন মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
নবী করীম (সাঃ) একদিন সাহাবাদের বলেন, একদা আল্লাহ্ তা’আলার জনৈক বান্দা বলিল,
يَا رَبِّ لَكَ الْحَمْدُ كَمَا يَنْبَغِي لِجَلَالِ وَجْهِكَ وَعَظِيمٍ سُلْطَانِكَ
(হে আমার প্রতিপালক প্রভু ! তোমার মহা পরাক্রম ও বিপুল প্রতিপত্তি যেরূপ ‘হাম্দ’-এর যোগ্য তোমার প্রতি সেরূপ হাম্দ (প্রশংসা) নিবেদন করিতেছি।) এতদশ্রবণে কিরামান কাতেবীন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গেলেন। তাহারা উহার পরিবর্তে কত নেকী লিখিবেন তাহা নির্ণয় করিতে পারিলেন না। তাহারা আল্লাহ্ তা’আলার কাছে আরয করিলেন,
‘হে আমাদের প্রভু! জনৈক বান্দা একটি বাক্য উচ্চারণ করিয়াছে। উহার পরিবর্তে কত নেকী লিখিব উহা আমাদের জ্ঞাত নহে।’ বান্দা কি বাক্য উচ্চারণ করিয়াছে তাহা আল্লাহ্ তা’আলা ভালরূপে জানিতেন। তথাপি জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার বান্দা কি বাক্য উচ্চারণ করিয়াছে? ফেরেশতাদ্বয় আরয করিলেন, হে পরোয়ারদিগার ! বান্দা বলিয়াছে, ‘ইয়া রাব্বী লাকাল হামদু কামা য়্যাম্বাগী লিজালালি ওয়াজহিকা ওয়া আজীমি সুলতানিকা।’ তখন আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদ্বয়কে বলিলেন, ‘আমার বান্দা যাহা বলিয়াছে তাহা অবিকল লিখিয়া রাখ। সে যখন আমার নিকট আসিবে, তখন আমি উহার প্রতিদান দিব।’
ইমাম কুরতুবী বলেনঃ একদল বিশেষজ্ঞ বলিয়াছেন, ‘আলহাম্দু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন’ বলা ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা হইতে অধিকতর নেকীর কাজ। কারণ, শেষোক্ত বাক্যে শুধু তাওহীদের ঘোষণা রহিয়াছে। পক্ষান্তরে প্রথমোক্ত বাক্যে তাওহীদ ও হাম্দ দুইটি বিষয় নিহিত রহিয়াছে।’
আরেক দল বলেন, শেষোক্ত বাক্য প্রথমোক্ত বাক্য হইতে শ্রেষ্ঠতর। কারণ, উহা দ্বারা মানুষের মু’মিন হওয়া না হওয়া নির্ণীত হয়। উহার দাবীতে কোন জাতি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলিম জাতির পক্ষ হইতে অমুসলিম জাতিসমূহের নিকট উহা মানিয়া লইবার দাবী জানানো হয় এবং উহা মানিয়া লইতে অস্বীকৃত হইলে যতক্ষণ না তাহা মানিয়া লয়, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলিতে থাকে। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম কর্তৃক হাদীসে অনুরূপ বিধান বিবৃত হইয়াছে।
অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত আছেঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলেন, আমার পূর্ববর্তী নবীগণ ও আমি যত কথা উচ্চারণ করিয়াছি, উহার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কথা হইতেছে, لااله الا اللّه وحده لاشريك له
(আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কোন মা’বূদ নাই। তিনি এক, তাঁহার কোন শরীক নাই।
ইতিপূর্বেও হযরত জাবির (রা) হইতে নিম্নোক্ত হাদীস বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলেন- افضل الذكر لا اله الا اللّه وافضل الدعاء الحمد لله
ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীসকে حدييث حسن (বিশেষ নিয়মে বিশুদ্ধ) নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন।
الْحَمْدُ لله رب الْعَالمِيْنَ আয়াতের শুরুর ال (আলিফ-লাম) অক্ষরদ্বয় হাম্দের সকল শ্রেণীকে উহার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। আরবী ভাষায় এরূপ ‘আলিফ-লাম’কে আলিফ-লামে ইস্তিগরাকী (lial) বলে। তাই এ অর্থ সকল শ্রেণীর সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। হাদীছে বর্ণিত আছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-
اللهم لك الحمد كله – ولك الملك كله – وبيدك الخير كله – واليك يرجع الامر كله – الحديث
‘হে আল্লাহ্ ! সকল প্রশংসাই তোমার প্রাপ্য। সকল আধিপত্যই তোমার জন্য সংরক্ষিত। সকল মঙ্গলই তোমার হাতের মুঠায়। তাই সকল কাজই তোমার কাছে প্রত্যাবৃত্ত হয়…… (অসমাপ্ত)।’
الرب শব্দের অর্থ হইতেছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী সত্তা; প্ৰভু, প্রতিপালক, ক্রমোন্নতি বিধায়ক ও ক্রমবিকাশ সাধক। একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই الرب নামে অভিহিত হইবার যোগ্য। তাঁহার কোন সৃষ্টি উক্ত নামে অভিহিত হইতে পারে না। তবে বস্তু বিশেষের মালিক হিসাবে সংশ্লিষ্ট বস্তুর উল্লেখসহ কোন সৃষ্টিকেও উক্ত নামে অভিহিত করা যায়। যেমন رب الدار (ঘরের মালিক)। কেহ কেহ বলেন, الرب নামটিই আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নাম (الاسمالاعظم)।
العالمين শব্দটি عالم শব্দের বহুবচন العالم অর্থ আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য সকল অস্তিত্বশীল বস্তু ৷ ইহা একটি বহুবচন পদ, ইহার সমধাতুজ কোন একবচনার্থক পদ নাই। العوالم বলিতে মহাবিশ্বে বিদ্যমান সৃষ্টির বিভিন্ন প্রকার ও শ্রেণীকে বুঝায়। উহার প্রত্যেক শ্রেণীও পৃথকভাবে العالم নামে অভিহিত হইয়া থাকে।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ক্রমাগত যাহ্হাক, আবূ রওক ও বিশর ইব্ন আম্মারাহ বর্ণনা করেনঃ ‘আলহামদু লিল্লাহ’র তাৎপর্য হইতেছে, সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার প্রাপ্য যিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তন্মধ্যকার সকল জ্ঞাত ও অজ্ঞাত বস্তুর মালিক ও প্রভু।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে সাঈদ ইব্ন জুবায়র ও ইকরামা বর্ণনা করেনঃ রব্বুল আলামীনের তাৎপর্য হইতেছে ‘জ্বিন ও মানবমণ্ডলীর রব (প্রতিপালক প্রভু)।’ সাঈদ ইব্ জুবায়র, মুজাহিদ ও ইব্ন জুরায়জও উহার অনুরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আলী (রাঃ) হইতেও উহার অনুরূপ তাৎপর্য বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু ইমাম ইব্ন আবূ হাতিম উহার সনদকে অগ্রহণযোগ্য বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইমাম কুরতুবী উপরোক্ত ব্যাখ্যার সমর্থনে নিম্নোক্ত আয়াতাংশ পেশ করিয়াছেনঃ
لِلْعَالَمِيْنَ نَذِيرًا
(যাহাতে সে [নবী (সাঃ)] সকল জ্বিন ও মানবের জন্য সতর্ককারী হয়।)
এখানে العالمين শব্দের তাৎপর্য শুধু জ্বিন ও মানব জাতি। বিখ্যাত ভাষাবিদ ফাররা ও আবূ উবায়দ বলেন, العالم শব্দটি শুধু বোধসম্পন্ন সৃষ্টির ব্যাপারে প্রযুক্ত হয় । নির্বোধ সৃষ্টির ব্যাপারে العالم শব্দের প্রয়োগ ঘটে না। মানুষ, জ্বিন, ফেরেশতা ও শয়তান-ইহারা العالم পদবাচ্য। পশু শ্রেণী ‘আল্-আলম’ পদবাচ্য নহে।
যায়দ ইব্ন আসলাম ও আবূ মুহায়মিন বলেন-প্রাণীমাত্রই العالم পদবাচ্য। কাতাদাহ বলেন, সৃষ্টির প্রতিটি শ্রেণী العالم পদবাচ্য।
الجعد (নীচাশয় ব্যক্তি) ও الحمار (গর্দভ) নামে খ্যাত উমাইয়া খলীফা মারোয়ান ইবন হাকামের জীবনীতেও হাফিজ ইব্ন আসাকির লিখিয়াছেন, মারোয়ান বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলার সতের হাজার মাখলূক (عالم)। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সকল সৃষ্টি উহার একটি। অবশিষ্ট আলমসমূহের খবর একমাত্র আল্লাহ্ই রাখেন।’
আবূল ‘আলীয়া হইতে ক্রমাগত রবী’ ইব্ন আনাস ও আবূ জা’ফর রাযী ‘রব্বুল আলামীন’-এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ ‘মানব জাতি একটি আলম। জ্বিন জাতি একটি আলম ৷
এতদ্ব্যতীত আঠার হাজার অথবা চৌদ্দ হাজার আলম রহিয়াছে (রাবীর সঠিক সংখ্যা স্মরণ নাই)। ফেরেশতাগণ পৃথিবীতে রহিয়াছে। পৃথিবীর চারিটি দিক রহিয়াছে। প্রত্যেক দিকে সাড়ে তিন হাজার আলম রহিয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে নিজের ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন।’
ইব্ন জারীর ও ইব্ন হাতিম বর্ণনা করিয়াছেন : ঊহা শুধু ইব্ন ‘আলীয়া হইতে বর্ণিত হইয়াছে । অন্য কেহ উহা বর্ণনা করেন নাই। এরূপ কথা প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস করা যায় না।
সাবী’ আল হুমায়রী হইতে ক্রমাগত মু’তাব ইব্ন সামী, ফুরাত ইব্ন ওয়ালীদ, ওয়ালীদ ইব্ন মুসলিম, হিশাম ইব্ন খালিদ, আবূ হাতিম ও ইব্ন আবূ হাতিম ‘রব্বুল আলামীন’-এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ
সাবী’ বলিয়াছেন, ‘পৃথিবীতে এক হাজার আলম আছে। তন্মধ্যে ছয়শত আছে জলভাগে ও চারিশত স্থলভাগে।’
সাঈদ ইব্ন মুসাইয়য়্যেব হইতেও অনুরূপ বর্ণনা মিলে। স্বয়ং নবী করীম (সা) হইতেও উপরোক্ত মর্মে হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। হযরত জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্ন মুনকাদির, মুহাম্মদ ইব্ন ঈসা ইব্ন কায়সার, আবূ উব্বাদ উবায়দ ইব্ন ওয়াকিদ আল কয়সী, মুহাম্মদ ইব্ন মুছান্না ও তাঁহার নিকট হইতে হাফিজ আবু ইয়ালা আহমদ ইব্ন আলী ইব্ন মুছান্না স্বীয় ‘মুসনাদ’ সংকলনে বর্ণনা করেনঃ
হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, হযরত উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের সময় একবার রাষ্ট্রে পঙ্গপাল দেখা দিল। তিনি লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পাইলেন, এই দেশে কেহ পঙ্গপাল দেখে নাই। তিনি উদ্বিগ্ন হইয়া পঙ্গপাল সম্পর্কে জানার জন্য ইয়ামান, সিরিয়া ও ইরাকে লোক পাঠাইলেন। ইয়ামানের সংবাদ সংগ্রাহক সেখান হইতে কতগুলি পঙ্গপাল ধরিয়া আনিয়া তাঁহার সম্মুখে রাখিল। তিনি উহা দেখিয়া ‘আল্লাহু আকবর’ বলিয়া উঠিলেন। অতঃপর বলিলেন-আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি, ‘আল্লাহ্ তা’আলা এক হাজার উম্মত (প্রজাতি) সৃষ্টি করিয়াছেন। উহাদের ছয়শত জলভাগে আছে ও চারিশত আছে স্থলভাগে। আর উহাদের মধ্য হইতে প্রথম বিলুপ্ত হইবে পঙ্গপাল। উহার ধ্বংস প্রাপ্তির পর একের পর এক সকল প্রজাতি এরূপ দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে যেভাবে ছিন্নমালার দানাগুলি পর পর দ্রুত পতিত হয়।’
উক্ত হাদীসের অন্যতম রাবী মুহাম্মদ ইব্ন ঈসা ইবন কায়সান একজন যঈফ রাবী।
সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব হইতে বাগবী বর্ণনা করেনঃ সাঈদ ইব্ন মুসাইয়্যেব বলেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলা এক হাজার আলম সৃষ্টি করিয়াছেন। উহাদের মধ্য হইতে ছয়শত জলভাগে রহিয়াছে এবং চারিশত রহিয়াছে স্থলভাগে।’
ওয়াহাব ইব্ন মুনাব্বিহ বলেন-আল্লাহ্ তা’আলা আঠার হাজার আলম সৃষ্টি করিয়াছেন। দুনিয়া উহাদের মধ্যকার একটি আলম।
মুকাতিল বলেন-আলমের সংখ্যা হইতেছে আশি হাজার।
কা’ব আহবার বলেন-আলমের সংখ্যা আল্লাহ্ তা’আলা ভিন্ন অন্য কেহ জানে না।
ইমাম বাগবী উপরোক্ত অভিমতসমূহ তুলিয়া ধরিয়াছেন। ইমাম কুরতুবী হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত খুদরী (রাঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা চল্লিশ হাজার আলম সৃষ্টি করিয়াছেন। সমগ্র দুনিয়া উহাদের মধ্য হইতে মাত্র একটি আলম।
যাজ্জাজ বলেন-‘আলম’ বলিতে দুনিয়া ও আখিরাতে সৃষ্ট ও সৃজিতব্য প্রতিটি বস্তু ও বিষয়কেই বুঝায় ।
ইমাম কুরতুবী মন্তব্য করেন, যাজ্জাজের উক্ত অভিমতই সহীহ ও সঠিক। স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قَالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ – قَالَ رَبُّ السَّمواتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَاء انْ كُنْتُمْ مُوقِنين –
(ফিরআউন বলিল, ‘রব্বুল আলামীন’ আবার কি বস্তু? সে (মূসা) বলিল, তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও উহাদের মধ্যকার সকল বস্তুর প্রতিপালক প্রভু-যদি তোমরা বিশ্বাস করিতে।)
ইমাম কুরতুবী বলেন, “আল-আলম’ ‘আল-আলামাত’ (চিহ্ন নিদর্শন)’ হইতে উৎপন্ন।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছি, এই কারণেই আল্লাহ্ তা’আলার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকেই ‘আলম’ বলা হয় যে, উহা আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্ব, একত্ব ও মাহাত্ম্যের এক একটি আলামত ও নিদর্শন। কবি ইবনুল মু’আয বলেনঃ
فيا عجبا كيف يعصى الا له – ام كيف يجحده الجاحد
وفى كل شئ له اية – تدل على انه واحد
‘কী আশ্চর্য ! মানুষ কিভাবে স্বীয় প্রভুর নাফরমানী করে অথবা নাস্তিক কিভাবে তাঁহার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে? প্রত্যেকটি বস্তুতেই তো তাঁহার অস্তিত্বের নিদর্শন রহিয়াছে । উক্ত নিদর্শন বলিয়া দেয় যে, তিনি এক, অদ্বিতীয়।’
(۲)
الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ة
২. অশেষ দয়াময়, অসীম দয়ালু।
তাফসীরঃ বিসমিল্লাহ্ শরীফের ব্যাখ্যায় ইহা আলোচিত হইয়াছে। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
ইমাম কুরতুবী বলেন رب العالمين শব্দ দুইটির মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় পরাক্রম ও ক্ষমতা সম্বন্ধে মানুষকে পরিজ্ঞাত করিয়া তাঁহার আযাবের ব্যাপারে তাহাদিগকে সতর্ক করিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে الرحمن الرحيم শব্দ দুইটি উল্লেখ করিয়া তিনি তাহাদের মনে আশার সঞ্চার তথা তাঁহার রহমত লাভ করিবার আগ্রহ সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছেন। এভাবে অন্যত্রও তিনি তাঁহার বান্দাগণকে একদিকে তাঁহার রহমতের আশা প্রদান ও অন্যদিকে তাঁহার আযাবের ভয় প্রদর্শন করিয়াছেন। যেমন তিনি বলিয়াছেনঃ
نَبِي عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ – وَأَنَّ عَذَابِى هُوَ الْعَذَابُ الْآلِيمُ
‘আমার বান্দাগণকে খবর দাও যে, আমি অশেষ ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। পক্ষান্তরে আমার শাস্তিও বড় যন্ত্রণাদায়ক।’
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
إِنَّ رَبِّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ – وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদাতা। পক্ষান্তরে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করিয়াছেনঃ ঈমানদাররা যদি জানিত, আল্লাহ্ তা’আলার নিকট কত শাস্তি রহিয়াছে, তাহা হইলে কেহই জান্নাতের আশা করিতে সাহসী হইত না। পক্ষান্তরে কাফিররা যদি জানিতে পাইত, আল্লাহ্ তাআলার নিকট কত রহমত রহিয়াছে, তাহা হইলে কেহই তাঁহার রহমত হইতে নিরাশ হইত না।
(۳)
مُلِكِ يَوْمِ الدِّينِ
৩. ‘প্রতিদান দিবসের বাদশাহ’।
তাফসীরঃ একদল বিশেষজ্ঞ আলোচ্য আয়াতের প্রথম শব্দকে ملك এবং আরেকদল বিশেষজ্ঞ مالك রূপে পড়িয়াছেন। উভয় কিরাআতই শুদ্ধ এবং বিখ্যাত সাত কিরাআতের অন্তর্ভুক্ত। কেহ কেহ উহাকে লামে সাকিন দিয়া ملك পড়িয়াছেন কিরাআত শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ নাফে’ উহার শেষে পড়িয়াছেন। এবং কেহ কেহ مليك রূপেও পড়িয়াছেন কিরাআত শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ নাফে’ উহার শেষে ى বর্ণ যুক্ত করিয়া ملكى রূপে পড়িয়াছেন।
একদল বিশেষজ্ঞ প্রথমোক্ত দুই কিরাআতের মধ্য হইতে প্রথম কিরাআতকে ও অন্যদল বিশেষজ্ঞ দ্বিতীয় কিরাআতকে অর্থগত দিক দিয়া শ্রেয়তর ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলিয়াছেন। তবে উভয় কিরাআতকেই তাঁহারা শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য বলেন।
আল্লামা যামাখশারী ملك রূপ কিরাআতকে শ্রেয়তর বলিয়াছেন। কারণ, উহা পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদীনার অধিবাসীদের কিরাআত।
তাহা ছাড়া আল্লাহ্ পাক বলেনঃ لمن الملك الَيوْم (আজ কাহার কর্তৃত্ব?)
কিংবা قَوْلُهُ الْحقَّ وله المُلّك (তাঁহার কথাই সত্য হইবে এবং তাঁহারই রাজত্ব হইবে।)
‘এই দুই আয়াতে কিয়ামতের দিনে الملك (রাজত্ব) একমাত্র তাঁহারই বলা হইয়াছে। উক্ত الملك এর অধিকারী সত্তাকে الملك বলাই শ্রেয়। ইমাম আবূ হানীফা হইতেও বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি উহাকে ملك রূপে পড়িতেন। কারণ, الملك শব্দ হইতে ملك مالك ও مملوك এই তিনরূপ শব্দই গঠিত হইয়া থাকে। অবশ্য তাঁহার এই মতের বর্ণনাকারী একজন মাত্র এবং ইহা তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত নির্ভরযোগ্য সূত্রের বর্ণনার পরিপন্থী।
ইবন শিহাব হইতে ধারাবাহিকভাবে আবুল মুতরাফ, আবদুল ওয়াহাব ইব্ন আদী ইব্ন ফযল, আবূ আব্দির রহমান ইযদী ও আবূ বকর ইব্ন দাউদ বর্ণনা করেনঃ
ইব্ন শিহাব বলেন, আমি জানিতে পারিয়াছি যে, নবী করীম (সাঃ), হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ), হযরত মুআবিয়া (রাঃ) ও তৎপুত্র ইয়াযীদ مُلِكِ يَوْمِ الدِّينِ পড়িতেন।’
উক্ত রিওয়ায়েতের সমর্থনে অন্য কোন রিওয়ায়েত নাই।
তিনি আরও বলেনঃ يوم يانتى لاتكلم نفس الا باذنه فمنهم شقى وسعيد (যেদিন উহা আসিবে, সেদিন তাঁহার অনুমতি ছাড়া কেহ কিছু বলিতে পারিবে না….।)
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেনঃ مُلِكِ يَوْمِ الدِّينِ -এর তাৎপর্য এই যে, দুনিয়ায় যদিও অন্যান্য বিচারপতি ছিল, কিন্তু আখিরাতের অন্য কাহারো হাতে বিচারের ক্ষমতা থাকিবে না। সেদিন তাঁহার বিচারকার্যে অন্য কেহ শরীক হইতে পারিবে না।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক আরও বর্ণনা করেনঃ يوم الدين -এর তাৎপর্য এই যে, উহা সকল মানব ও জ্বিনের হিসাবের দিন। উহা কিয়ামতের দিন। সেদিন আল্লাহ্ তা’আলা সকলকে তাহাদের কর্মফল প্রদান করিবেন। ভাল কর্মে ভাল ফল ও মন্দ কর্মে মন্দ ফল প্রদত্ত হইবে। তবে আল্লাহ্ তা’আলা যদি কাহাকেও ক্ষমা করেন, তাহা স্বতন্ত্র কথা।’
হযরত আব্বাস (রাঃ) ছাড়াও অন্যান্য অনেক সাহাবা, তাবেঈ ও পূর্বসূরী বিভিন্ন তাফসীরকার উহার অনুরূপ তাফসীর বর্ণনা করিয়াছেন। মূলত উহাই আয়াতের স্বাভাবিক তাফসীর।
অবশ্য ইমাম ইব্ন জারীর কোন কোন তাফসীরকার হইতে বর্ণনা করেন, فالك يوم الدرين -এর তাৎপর্য হইতেছে, ‘আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামত ঘটাইয়া বিচার দিবস কায়েমের ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতাবান।’ ইমাম ইব্ন জারীর এই উদ্ধৃতি দানের পর মন্তব্য করেন, বর্ণনাটি দুর্বল ও গ্রহণের অযোগ্য।
মূলত আয়াতের উভয়বিদ তাফসীরের মধ্যে কোন বিরোধ নাই। তাহা ছাড়া উভয় পক্ষ উভয় তাফসীরকেই শুদ্ধ মনে করেন। তবে আয়াতের পূর্বাপর আয়াত বিবেচনা করিলে প্রথমোক্ত তাৎপর্যই স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়। আয়াতের প্রথমোক্ত তাৎপর্যের সহিত নিম্নোক্ত আয়াতের সাদৃশ্য রহিয়াছেঃ
الْمُلْكُ يَوْمَنذِنِ الْحَقُّ الرَّحْمَنِ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا
(সেদিন রহমানেরই রাজত্ব কার্যকর হইবে এবং কাফিরের জন্য হইবে কঠিন দিন।) পক্ষান্তরে আয়াতের শেষোক্ত তাৎপর্যের সাদৃশ্য নিম্নোক্ত আয়াতে পাওয়া যায়ঃ
ويوم يقول كن فيكون (যেদিন তিনি বলিবেন, হও, অনন্তর হইয়া যাইবে।)
আল্লাহ্ তা’আলাই সর্বজ্ঞ। একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই الملك (শাহানশাহ)। যেমন তিনি বলেনঃ مو اللَّهُ انّذْئلا اله الهو الْمَلك الْقدُوس السسَّلام (আল্লাহ্ হইতেছেন সেই সত্তা যিনি ভিন্ন অন্য কোন মা’বূদ নাই। তিনি শাহানশাহ, পবিত্রতম, শান্তির উৎস।)
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলার নিকট বান্দার ঘৃণ্যতম আখ্যা হইতেছে ملك الاملاك (শাহানশাহ)। আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কেহ مالك (শাহানশাহ) নহেন।’
ইবন শিহাব আরও বলেন, সর্বপ্রথম মারোয়ান উহাকে مُلِكِ يَوْمِ الدِّينِ -এ রূপান্তরিত করেন।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলি, মারওয়ানের নিকট مُلِكِ يَوْمِ الدِّينِ এর বিশুদ্ধতার প্রমাণ ছিল বলিয়াই তিনি উহাকে ঐরূপ পড়িয়াছেন। ইবন শিহাব সেই প্রমাণ সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন না। আল্লাহ্ সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী।
ইব্ন মারদুবিয়্যা কর্তৃক উদ্ধৃত একাধিক সনদে বর্ণিত রহিয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) উহাকে مُلِكِ يَوْمِ الدِّينِ রূপে পড়িতেন। مالك শব্দটি ملك (মালিকানা স্বত্ব) শব্দ হইতে গঠিত হইয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
انا نْدْنُ نَرث الْأرْض وَمَنْ عَلَيْهَا وَالَيْنَا يُرْجَعُونَ
(নিশ্চয় আমি পৃথিবী ও উহাতে অবস্থিত সকল কিছুর মালিক এবং উহার সকল কিছুই আমার নিকট ফিরিয়া আসিবে।)
قل أعوذٌ برب النّاس ملك الثّاس (বল, আমি মানুষের প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় চাহিতেছি—মানুষের মালিকের নিকট।)
অপরদিকে দেখা যায় ملك শব্দটি الملك (কর্তৃত্ব) শব্দ হইতে গঠিত হইয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ لمن الملك الْيَوْمَ لله الُوَاحد الْقَهّار (আজ কাহার কর্তৃত্ব। একক মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর।)
তিনি আরও বলেনঃ
قَولَهُ الحقّ وله الْمُلك (তাঁহার কথাই কার্যকর এবং রাজত্ব শুধু তাঁহারই)।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
الْمُلْكُ يَوْمَئِذِنِ الْحَقُّ لِلرَّحْمَنِ وَكَانَ يَوْمًا عَلَى الْكَافِرِينَ عَسِيرًا
(সেদিন শুধু রহমানেরই রাজত্ব চলিবে আর কাফিরের জন্য হইবে বড়ই কঠিন দিন। )
আলোচ্য আয়াতসমূহে বিচার দিবসে আল্লাহ্ তা’আলার কর্তৃত্বের কথা বলা হইয়াছে। অবশ্য ইহার অর্থ এই নয় যে, অন্য সময়ে তাঁহার কর্তৃত্ব চলিবে না। কারণ, রব্বুল আলামীন হিসাবে সকল সৃষ্টির উপর সকল সময়ে তাঁহার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। বিচার দিবসের কর্তৃত্বকে জোর দিয়া বলার কারণই এই যে, সেদিন তাঁহার অনুমতি ছাড়া কাহারও কিছুই বলার বা করার ক্ষমতা থাকিবে না। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لايَتَكَلَّمُونَ الدَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ
(সেদিন রূহ ও ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইবে এবং রহমানের অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া কেহ কথা বলিতে পারিবে না।)
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
وَحَشَّعَت الآصوات للرحمن قلا تَسْمَعْ الأ همسا (অনন্তর সেদিন রহমানের ভয়ে কণ্ঠস্বরগুলি অনুচ্চ হইবে। ফলে তুমি ফিস ফিস শব্দ ছাড়া কিছুই শুনিতে পাইবে না।)
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে আরও বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেনঃ ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা আসমান ও যমীন নিজ হস্তে ধারণ করিয়া বলিবেন, আমিই শাহানশাহ (الملك)। কোথায় পৃথিবীর রাজা-বাদশাহগণ (ملوك)? কোথায় পরাক্রমশালী আমীর উমারাবৃন্দ (الجبار ون) ? কোথায় দাম্ভিক নাফরমানকুল (المتكبر ون ) ? অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলিবেন-আজ সর্বময় কর্তৃত্ব কাহার হস্তে? একমাত্র মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর হস্তে।
পৃথিবীতে আল্লাহ্ ভিন্ন তাঁহার সৃষ্টিও যে ملك নামে অভিহিত হইয়াছে, উহাতে শাহানশাহ বা রাজাধিরাজের অধিনস্থ রাজা অর্থ প্রকাশ করে। আল্লাহ্ তা’আলা বলিতেছেনঃ
إن الله قَدْ بَعَت لَكُمْ طالوت ملكا
(নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য তালূতকে রাজা (ملك) করিয়া পাঠাইয়াছেন।)
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
وَكَانَ ورَاءَهُمْ مَلِكُ يَأْخُذُ كُلُّ سَفِينَةٍ غَصْبًا
(আর তাহাদের পশ্চাতে জনৈক রাজা ছিল যে রাজা (ملك) জোর করিয়া প্রত্যেকটি নৌকা লইয়া যাইত।)
তিনি আরও বলেনঃ
اذ جَعْل فِيْكُمْ أَنْبيَاء وَجَعَلَكُهْ مُلُوكًا (কারণ, তিনি তোমাদের মধ্যে নবী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তোমাদিগকে রাজা (ملك) বানাইয়াছেন।)
বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন,
مثل الملوك على الاسرة
সিংহাসনারূঢ় বাদশাহদের দৃষ্টান্ত হইতেছে…….।’
الدين অর্থ প্রতিদান, কর্মফল, প্রতিফল, হিসাব-নিকাশ। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَوَمَنْذ يُوَفَيُهِم اللهُ دِينَهُمُ الْحَقُّ
(সেদিন আল্লাহ তা’আলা তাহাদের যথাযথ প্রতিফল দিবেন।)
তিনি আরও বলেনঃ
أَنْنًا لمدينون (অবিশ্বাসীদের প্রশ্ন) আমাদিগকে কি সত্যই কর্মফল দেওয়া হইবে’? হাদীস শরীফে আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ
الكيس من دان نفسه وعمل لما بعد الموت
‘সেই ব্যক্তি প্রকৃত বুদ্ধিমান যে ব্যক্তি নিজের হিসাব নিজেই লইল এবং মরণোত্তর জীবনের জন্য কাজ করিল।
হযরত উমর (রাঃ) বলিয়াছেনঃ
حاسبوا انفسكم قبل ان تحاسبوا وزنوا انفسكم قبل أن توزنوا وتأهبوا للعرض الاكبر على من لا تخفى عليه اعمالكم
“তোমাদের হিসাব লওয়ার আগেই নিজেরা নিজেদের হিসাব গ্রহণ কর। তোমাদের আমল পরিমাপিত হইবার পূর্বেই নিজেরা নিজেদের আমল মাপিয়া লও। যাঁহার কাছে তোমাদের কোন কাজই গোপন থাকিবে না, তাঁহার বৃহত্তম দরবারে হাজির হইবার প্রস্তুতি গ্রহণ কর।”
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَوْمَئْذ تُفرضون لأتخفى مثكم خافيّة সেদিন তোমাদের কোন কিছুই গোপন থাকিবে না।”
(٤)
اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ٥
৪. ‘আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য কামনা করি।’
তাফসীরঃ বিখ্যাত সাত কিরাআত বিশেষজ্ঞসহ অধিকাংশ কিরাআত বিশেষজ্ঞ اياك শব্দের ی কে তাশদীদ (দ্বিত্ব) সহকারে পড়িয়াছেন। আমর ইব্ন যায়দ নামক জনৈক কিরাআত বিশেষজ্ঞ উহাকে তাশদীদ ছাড়া প্রথম বর্ণ। (হামযাহ)-কে যের দিয়া পড়িয়াছেন। অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য কিরাআত বিশেষজ্ঞের কিরাআতের বিরোধী বিধায় আমর ইব্ন যায়দের উক্ত কিরাআত প্রত্যাখ্যানযোগ্য বটে। তাহা ছাড়া ايأ শব্দের অর্থ সূর্যের কিরণ।
কেহ কেহ أ (হামযাহ)-কে যবর দিয়া ও ی -কে তাশদীদ দিয়া اياك পড়িয়াছেন।
কেহ কেহ আবার i এর স্থলে ه বসাইয়া ی -কে তাশদীদ দিয়া هياك পড়িয়াছেন। আরবী সাহিত্যে অনুরূপ ব্যবহার পরিদৃষ্ট হয়। যেমন কবি বলেনঃ
فهياك والامر الذى ان تراحبت – موارده ضاقت عليك مصادره
‘সাবধান ! কোন কার্যের প্রবেশ পথ সুগম হইলেও যদি উহার নিষ্ক্রমণ পথ দুর্গম হয়, তাহা হইতে দূরে থাকিও।’
ইয়াহিয়া ইবন ওয়াহাব ও আ’মাশ ভিন্ন অন্য সকল বিশেষজ্ঞ نستعين শব্দের প্রথম ن যবর দিয়া পড়িয়াছেন। উক্ত বিশেষজ্ঞদ্বয় উহাকে যের সহকারে পড়িয়াছেন। অবশ্য বনী আসাদ, রবীআহ ও বনী তামীম গোত্রত্রয় সমাপিকা ক্রিয়ার উত্তম পুরুষের বহুবচনে অনুরূপভাবেই উচ্চারণ করিয়া থাকে।
العبادة শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হইল নীচতা, নত হওয়া। যেমন طريق المعيد অর্থ পদদলিত রাস্তা। তেমনি অর্থ পরিত্যক্ত উট।
শরীয়তের পরিভাষায় العبادة অর্থ পূর্ণ প্রীতি, ভীতি ও বিনয়ের সমাহার। اياك কর্মকারককে ক্রিয়ার পূর্বে স্থাপন করিয়া আল্লাহ্ তা’আলা ইবাদতকে একমাত্র তাঁহার জন্য নির্দিষ্ট হওয়াকে বুঝাইয়াছেন। অর্থাৎ আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তুমি ভিন্ন অন্য কাহারও ইবাদত করি না।
তেমনি আমরা তোমারই নিকট সাহায্য চাহি এবং তুমি ভিন্ন অন্য কাহারও সাহায্য চাহি না। পূৰ্ণ ইবাদত ইহাই।
পূর্বসূরী জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলিয়াছেন, ‘সূরা ফাতিহা কুরআনের তত্ত্বকথা এবং اياك نعيد واياك نستعين আয়াতটি সূরা ফাতিহার মূলতত্ত্ব। ‘ইয়্যাকা না’বুদু’ বলিয়া বান্দা সকল শিরক বর্জন করে এবং ‘ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ বলিয়া বান্দা নিজস্ব ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে যথেষ্ট না ভাবিয়া নিজেকে আল্লাহ্র সাহায্যের কাছে সোপর্দ করে। অন্যান্য অনেক আয়াতে মানুষকে উহাই শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
فأعبده وَتَوَكْل عليه وما رَبك بغافل عَما تَعْمَلُوَنَ “অতএব তাঁহার ইবাদত কর এবং তাঁহার নিকট নিজকে সঁপিয়া দাও। অনন্তর তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের আমল সম্পর্কে অনবহিত নহেন।”
তিনি আরও বলেনঃ
قل هو الرحمان امنا به وَعَلَيهٍ تَوَكُلْنَا “বল, তিনি ‘আর-রহমান’। আমরা তাঁহার উপর ঈমান আনিয়াছি এবং তাঁহারই উপর আমরা ভরসা করিয়াছি।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
رب المشرق وَالْمَفْرب لآ اله الأ هو فَاتَّحْدْهُ وكيّلاً “তিনি পূর্ব-পশ্চিম তথা সমগ্র সৃষ্টির প্রতিপালক প্রভু। তিনি ভিন্ন অন্য কোন মা’বূদ নাই। অতএব তাঁহাকেই অভিভাবক বানাও।”
পূর্ব আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা নাম পুরুষ হিসাবে উল্লেখিত হইবার পর আলোচ্য আয়াতে তাঁহার জন্য মধ্যম পুরুষ ব্যবহৃত হইয়াছে। বান্দা আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা বর্ণনা করিবার পর যেন আল্লাহ্ তা’আলার সামনে হাজির হইয়াছে। তাই এখন তিনি তাঁহার জন্য মধ্যম পুরুষ ব্যবহার করিয়া বান্দাকে তাঁহার নিকট স্বীয় নিবেদন পেশ করিতে বলিতেছেন। ইহা দ্বারা তিনি এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করিয়াছেন যে, পূর্ববর্তী আয়াতে তিনি স্বীয় মহিমান্বিত নামসমূহ উল্লেখ করিয়া যেরূপ নিজের প্রশংসাগুলি উল্লেখ করিলেন, বান্দা যেন সেরূপ উহা উল্লেখের মাধ্যমে তাঁহার প্রশংসা বর্ণনা করে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেহ যদি তাঁহার প্রশংসা বর্ণনা ছাড়া নামায আদায় করে, তাহা হইলে তাহা আদায় হইবে না।
‘হযরত উবাদা ইব্ন সামিত (রাঃ) হইতে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতে ফাতিহাতুল কিতাব পাঠ করে না, তাহার সালাত হয় না।’ হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ক্রমাগত আবদুর রহমান, আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান (হারাকার গোলাম) প্রমুখ বর্ণনাকারীর সনদে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেনঃ
‘আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, আমি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে সালাত (ফাতিহা)-কে আধাআধি ভাগ করিয়া দিয়াছি। উহার মাধ্যমে বান্দা যাহা চায় তাহা পাইবে। বান্দা যখন বলে তারা الحمد لله رب العالمين আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করিয়াছে। সে যখন বলে الرحمْن الرحيّم তখন আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করিয়াছে। সে যখন বলে এস مالك يوم الدَيْن আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলেন, আমার বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়াছে। সে যখন বলেন, اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলেন, ইহা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বিভক্ত রহিয়াছে। আমার বান্দা যাহা চাহিয়াছে তাহা সে পাইবে। সে যখন বলে,
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ – صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ইহা আমার বান্দার প্রাপ্য অংশ। অনন্তর সে যাহা চাহিয়াছে তাহা সে পাইবে।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেনঃ ‘ইয়্যাকা না’বুদু’র তাৎপর্য হইতেছে—‘হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু ! আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি, একমাত্র তোমাকেই ভয় করি এবং একমাত্র তোমারই নিকট রহমত পাইতে আশা রাখি। আমরা না অন্য কাহারও ইবাদত করি, না অন্য কাহাকেও ভয় করি, আর না অন্য কাহারও নিকট রহমত পাবার আশা করি। ‘ওয়া ইয়্যাকা নাস্তা’ঈন’-এর তাৎপর্য হইল যে, আমরা তোমার ইবাদত সহ সকল কার্যে তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।’
কাতাদাহ বলিয়াছেন-‘আয়াতটিতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহারই ইবাদত করিতে এবং সকল কাজে তাঁহারই সাহায্য কামনা করিতে স্বীয় বান্দাগণের প্রতি আদেশ প্রদান করিয়াছেন।’
اِيَّاكَ نَعْبُدُ বাক্যটি وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ বাক্যের পূর্বে উল্লেখ করার কারন এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদত করাই বান্দার মূল উদ্দেশ্য ও কাজ। পক্ষান্তরে তাঁহার নিকট প্রার্থনা করা হইল উক্ত মূল উদ্দেশ্য ও কাজের সহায়ক ব্যাপার। সুতরাং উদ্দেশ্যকে সহায়কের পূর্বে উল্লেখ করাই সমীচীন। আল্লাহ্ই অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী।
প্রশ্ন হইতে পারে, আলোচ্য আয়াতের ক্রিয়াদ্বয়ের জন্য বহুবচন কর্তা ব্যবহারের কারণ কি? নামাযে প্রত্যেক মুসল্লীই একক ও স্বতন্ত্রভাবে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট একমাত্র তাঁহারই সাহায্য প্রার্থনার সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা জানায় । এমতাবস্থায় ক্রিয়ার কর্তা তো বহু নহে, একজন ৷ অনেক সময় সম্মান প্রদর্শনের জন্য এক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বহুবচন ব্যবহৃত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে শব্দটি বহুবচন হইলেও উহার পদবাচ্য একবচন হয়। ইহা সেরূপ সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও নহে। তাই উহা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নহে।
তাফসীরকারগণ উক্ত প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, প্রত্যেক মুসল্লীই জামাআতে হউক কিংবা একাকী হউক, ইমাম কিংবা মুক্তাদী হইক, যেইরূপেই নামায আদায় করুক না কেন, সে নিজের ও তাঁহার মু’মিন ভাইদের পক্ষ হইতেই একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদত করার এবং কেবলমাত্র তাঁহারই সাহায্য প্রার্থনা করার সংকল্প জ্ঞাপন করে বলিয়াই বহুবচন ক্রিয়া ব্যবহৃত হইয়াছে।
কেহ কেহ বলেন, হয়ত এক্ষেত্রে ব্রিয়ার কর্তা একজনই। কিন্তু সম্মানার্থে তাহার জন্য বহুবচন ব্যবহৃত হইয়াছে। বান্দা যখন আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়, তখন সম্মানিত বান্দা পরিণত হয়। তাই আল্লাহ্ যেন তাহাকে বলিতেছেন, নামাযরত অবস্থায় তুমি সম্মানিত বিধায় তোমার একার জন্য বহুবচন ব্যবহার কর এবং বল, اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
কিন্তু নামাযের বাহিরে তোমার সহিত লক্ষ-লক্ষ বান্দা থাকিলেও অন্যান্য বান্দার পক্ষ হইতে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট কোন নিবেদন পেশ করিও না; বরং নিজের একার পক্ষ হইতে কর। তখন اعبد কি استعين ইত্যাকার শব্দ ব্যবহার কর। কারণ, প্রত্যেক বান্দাই আল্লাহ্র নিকট মুখাপেক্ষী।
কেহ কেহ উক্ত প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, আল্লাহ্ যেরূপ মহান, তেমনি তাঁহার ইবাদতও মহৎ কাজ। এই কারণে উক্ত মহৎ কার্য সম্পাদনকারীকে সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষাই এখানে দেওয়া হইয়াছে। অনেকের নিকট প্রিয়জনের দাসত্বও সম্মান ও গৌরবের বিষয় বলিয়া বিবেচিত হয়। কবি বলেনঃ
لا تدعنى الابيا عبدها – فانه اشرف اسمائی
‘ওহে তাঁহার দাস’-এই সম্বোধন ছাড়া আমাকে অন্য কোনভাবে সম্বোধন করিও না। উহাই হইতেছে আমার অধিকতর সম্মানিত নাম।
اعبد (আমি ইবাদত করি) ও استعين (আমি সাহায্য প্রার্থনা করি) ইত্যাদি একবচন শব্দ ব্যবহার করিলে প্রকাশ পায় যে, সংশ্লিষ্ট বান্দা একাই আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদত করে এবং সে একাই উক্ত মহা মর্যাদা ও মহা সম্মানের অধিকারী। পক্ষান্তরে বান্দার নিজের ও অন্যান্যের পক্ষ হইতে আল্লাহর ইবাদত করার কথা ব্যক্ত করিবার মধ্যে অধিকতর বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ পায়। এই জন্যই ক্রিয়ায় বহুবচন কর্তা ব্যবহৃত হইয়াছে।
আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদত যে মহা মর্যাদার কাজ তাহা আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বিভিন্ন সময়ে عبد নামে আখ্যায়িত করা হইতেও প্রকাশ পায়।
আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
الْحَمْدْ لله الّذئْ أَنْرْلَ على عَبْده الْكتّاب (সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিবেদিত যিনি স্বীয় عبد -এর প্রতি আল-কিতাব নাযিল করিয়াছেন।)
এখানে আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে عبد নামে অভিহিত করিয়াছেন। বলাবাহুল্য, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উপর আল-কিতাব অবতীর্ণ করার ভিতর দিয়া আল্লাহ্ তাঁহাকে মহা সম্মানে ভূষিত করিয়াছেন । আর সে ক্ষেত্রেই তাঁহাকে عبد নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন।
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
وامّهُ لَمَاقَامَ عبد الله يدعوه كَادوا يَكُوْنُوْنَ عَلَيْه لبَّدًا “অতঃপর তাহারা এইজন্য ধিক্কার দিয়াছে যে, আল্লাহর عبد যখন দাঁড়াইয়া তাঁহাকে ডাকে, তখন তাহারা তাঁহাকে জড়াইয়া ধরার উপক্রম করে।”
এখানে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নামাযরত অবস্থার কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে নিজের আব্দ নামে অভিহিত করিয়াছেন। বলাবাহুল্য, রাসূলুল্লাহ্ নামাযরত অবস্থা তাঁহার একটি সম্মানজনক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
سبحان الَذى أسرى بعيده ليلا “যে সত্তা স্বীয় বান্দাকে নৈশভ্রমণ করাইয়াছেন তিনি পবিত্র ও মহান।”
এখানে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে স্বীয় গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করাইবার নিমিত্ত বায়তুল মুকাদ্দাস পরিভ্রমণ করাইবার ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে স্বীয় ‘আব্দ’ নামে অভিহিত করেন। বলাবাহুল্য, আল্লাহ্ তা’আলার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনাবলী দেখিতে যাওয়া ছিল রাসূলুল্লাহ্ জীবনের সবচাইতে গুরুত্ববহ সম্মানজনক ঘটনা।
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর উপরোক্ত মহা মর্যাদাকর অবস্থাসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে নিজের ‘আব্দ’ নামে আখ্যায়িত করায় ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলার ‘আব্দ’ হওয়া তথা তাঁহার ইবাদত করা মহা মর্যাদার বিষয়। কাফিরদের সত্য প্রত্যাখ্যানের কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) অনেক সময়ে খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িতেন। এইরূপ মনঃক্ষুণ্ণ অবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদতে লিপ্ত হইতে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে পরামর্শ দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرَكَ بِمَا يَقُولُونَ فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ – وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
‘আমি নিশ্চয় জানি যে, তাহারা যাহা বলে তাহাতে তোমার মনঃক্ষুণ্ণ দশা ঘটে । তুমি স্বীয় প্রতিপালকের তাসবীহ পাঠ কর ও নামায পড়িতে থাক। তোমার নিকট নিশ্চিত ব্যাপার (মৃত্যু) না পৌঁছা পর্যন্ত স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদত করিতে থাক।’
ইমাম রাযী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন যে, কেহ কেহ বলেনঃ مقام العبودية (দাসত্বের স্থান) مقام الرسالة (রিসালাতের স্তর) হইতে ঊর্ধ্বে অবস্থিত। কারণ, রিসালাত আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হইতে প্রদত্ত হয় আর আবদিয়াত বান্দার পক্ষ হইতে আল্লাহ্র দরবারে নিবেদিত হয়। তাহা ছাড়া রাসূল স্বীয় উম্মতের কল্যাণ সাধন করেন আর আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই স্বীয় আবূদের কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’
ইমাম রাযীর উদ্ধৃত উপরোক্ত অভিমত ও উহার সমর্থনে প্রদত্ত যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ৷ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইমাম রাযী উহাকে দুর্বল বা প্রত্যাখ্যানযোগ্য বলিয়া আখ্যায়িত করেন নাই ৷
একদল আধ্যাত্মিক সাধক (সূফী) বলেনঃ নেকী লাভ অথবা আযাব ঠেকানোর উদ্দেশ্যে যে ইবাদত করা হয়, তাহা অনর্থক ইবাদত। কারণ, তাহা এক ধরনের স্বার্থপরতা। তেমনি যদি আল্লাহ্ তা’আলার বিধি-নিষেধ পালনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য ইবাদত করা হয়, তাহাও নিম্নস্তরের ইবাদত। পক্ষান্তরে সকল মহৎ গুণের পূর্ণতার অধিকারী মহান পবিত্র আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি ভালবাসার কারণে ও তাঁহার সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে যে ইবাদত করা হয়, তাহাই উত্তম ইবাদত। এই কারণেই মুসল্লীরা নামাযের নিয়্যত اصلى للّه (আমি আল্লাহর ওয়াস্তে নামায পড়িতেছি) বলিয়া থাকে। নেকী হাসিল ও আযাব ঠেকানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়িলে উহা বাতিল হইয়া যাইবে।’
একদল তত্ত্ববিদ উপরোক্ত অভিমতের বিরোধিতা করিয়া বলেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলাকে পাইবার উদ্দেশ্যে তাঁহার ইবাদত করা এবং নেকী হাসিল ও আযাব ঠেকানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত করা একই কথা। ইহা পরস্পর বিরোধী নহে। এই দুই ধারণা একই সঙ্গে অন্তরে পোষণ করিয়া নামায পড়া সম্ভব।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট একদিন এক বেদুইন আরয করিল, আমি আপনার ন্যায় অথবা মুআযের ন্যায় সুন্দরভাবে স্বীয় নিবেদন নীরবে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট পেশ করিতে পারি না। আমি শুধু আল্লাহর নিকট জান্নাত লাভের ও দোযখ হইতে পরিত্রাণের প্রার্থনা করি। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিলেন, আমরাও উহারই চতুষ্পার্শ্বে থাকিয়া নীরবে নিবেদন জানাই। (অর্থাৎ আমরাও উহার কাছাকাছি বা উহাকে কেন্দ্র করিয়া নিবেদন জানাই।)
(٥)
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
৫. ‘আমাদিগকে সরল পথ প্রদর্শন কর।’
তাফসীরঃ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ الصراط কে ص দিয়া পড়িয়াছেন। কেহ কেহ উহাকে س দিয়া السراط রূপে পড়িয়াছেন। কেহ কেহ উহাকে ز দিয়া الزراط পড়িয়াছেন। বিখ্যাত ভাষাবিদ ফাররা বলেন, বনী আজারাহ ও বনী কলব গোত্রদ্বয় الصراط শব্দকে الزراط রূপে উচ্চারণ করিয়া থাকে।
সূরার প্রথম অংশে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা বর্ণিত হইয়াছে। এখানে তাঁহার নিকট বান্দার প্রার্থনা নিবেদিত হইতেছে। যেমন ‘হাদীসে কুদসী’তে বর্ণিত হইয়াছেঃ (আল্লাহ্ তা’আলা বলেন) উহার (ফাতিহার) অর্ধেক আমার অংশ এবং অর্ধেক আমার বান্দার অংশ। আর আমার বান্দা যাহা চাহিবে, তাহা পাইবে।’.
প্রার্থনার সর্বোত্তম পদ্ধতি ইহাই যে, প্রার্থনাকারী স্বীয় প্রার্থনা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট পেশ করিবার পূর্বে তাঁহার প্রশংসা বর্ণনা করিবে। উদ্ধৃতির প্রার্থনা অন্য যে কোন পদ্ধতির প্রার্থনা হইতে উত্তম এবং উহা মঞ্জুর লাভের সম্ভাবনা বেশী। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাকে উক্ত পদ্ধতিতে প্রার্থনা করিতে শিক্ষা দিতেছেন। বান্দা প্রথমে আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা বর্ণনা করিবে । অতঃপর নিজের ও অন্যান্য মু’মিন ভাইদের অভাব ও প্রয়োজন তাঁহার নিকট নিবেদন করিবে। ইহাই আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক বান্দার জন্য মনোনীত প্রার্থনা সম্পর্কিত সর্বোত্তম পন্থা।
আল্লাহ্ তা’আলার নিকট বান্দার কোন কিছু প্রার্থনা করিবার একাধিক পন্থা রহিয়াছে। একটি হইল আল্লাহ্ তা’আলার নিকট স্বীয় প্রয়োজন সরাসরি জ্ঞাপন করা। অপরটি হইল, তাঁহার নিকট স্বীয় প্রয়োজন প্রকাশ করা। আলোচ্য আয়াত প্রথম প্রকারের প্রার্থনার দৃষ্টান্ত।
প্রার্থনা দ্বিতীয় পদ্ধতির আবার দুই রূপ। একটি রূপ এই যে, উহার পূর্বে কোন স্তুতি বাক্য উচ্চারিত হয় না; বরং সরাসরি বক্তব্য পেশ করা হয়। যেমন হযরত মূসা (আঃ) বলিয়াছেনঃ
رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنْزَلْتَ إِلَى مِنْ خَيْرٍ فَقِيرُ
“হে আমার প্রতিপালক প্রভু ! তুমি আমার প্রতি যে কল্যাণ অবতীর্ণ করিবে, আমি তাহার অবশ্যই মুখাপেক্ষী।”
দ্বিতীয় পদ্ধতির প্রার্থনার দ্বিতীয় রূপ হইল এই যে, প্রার্থনার পূর্বে বান্দা আল্লাহ্ গুণ বর্ণনা সহকারে বক্তব্য পেশ করিবে। যেমন হযরত ইউনুস (আঃ) বলিয়াছেনঃ
لآ اله الأ أَنْتَ سُبْحَائَك ابَّى كُنْتْ من الظالمين ‘তুমি ভিন্ন অন্য কোন মাবূদ নাই। তুমি মহান ও পবিত্র। নিশ্চয় আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হইয়া পড়িয়াছি।’
প্রার্থনার আরেকটি পদ্ধতি এই যে, প্রার্থনাকারী শুধু প্রার্থনা পূরণকারীর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করিবে। যেমন কবি বলেনঃ
أ أذكر حاجتي ام قد كفانی * حياؤك ان شيمتك الحياء
اذا اثنى عليك المرء يوما * كفاه من تعرضه الثناء
‘আমি কি আমার প্রয়োজনকে উল্লেখ করিব অথবা আপনার মহা সম্ভ্রমবোধই আমার জন্য যথেষ্ট? নিঃসন্দেহে আপনার স্বভাব হইতেছে লজ্জা। কেহ আপনার একবার প্রশংসা করিলে তাহার আর কিছু বর্ণনা করার প্রয়োজন হয় না।
আয়াতের الهداية ক্রিয়াটির অর্থ হইতেছে ‘সরল পথ প্রদর্শন করা, সরল পথে পরিচালনা করা ও সরল পথে পৌঁছাইয়া দেওয়া।’ الهداية ক্রিয়াটি কয়েক নিয়মে প্রযুক্ত হইয়া থাকে। উহার মুখ্য কর্মের পূর্বে কখনও বা الى ও ل এই দুই حرف الجر (কারক অব্যয়) ব্যবহৃত হয়। কখনও বা উহার পূর্বে কোন কারক অব্যয় ব্যবহৃত হয় না। আলোচ্য আয়াতটি শেষোক্ত প্রকারের দৃষ্টান্ত।
اهدنًا الصراط المستقيم অর্থ আমাদিগকে সরল পথ দেখাইয়া উহাতে পৌঁছাইয়া দাও; আমাদিগকে সরল পথের সন্ধান দাও, আমাদিগকে সরল পথ প্রদর্শন কর ও আমাদের সামনে সরল পথ সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়া ধর। এই শেষোক্ত অর্থ প্রকাশের একটি দৃষ্টান্ত হইল এইঃ
وهديناه التجدين ‘আমি তাহার নিকট ন্যায়-অন্যায় দুইটি বিষয়ই স্পষ্ট করিয়া তুলিয়া ধরিয়াছি।’ الهداية শব্দের ক্রিয়াপদের প্রথম প্রকারের দৃষ্টান্তঃ
اجِتَبَاهُ وَهَدَاهُ الى صراط مُسَْتَقيْم তিনি তাহাকে মনোনীত করিয়াছেন এবং তাহাকে সরল পথ প্রদর্শন করিয়াছেন।’ উহার আরেকটি দৃষ্টান্তঃ
فاهدوهُم الى صراط الْجَحيم ‘তাহাদিগকে দোযখের পথে লইয়া যাও।’
অন্য প্রকারের একটি দৃষ্টান্তঃ
وانّك لَتَهُدئ الى صراط مَسَتَقيم ‘অনন্তর তুমি তাহাদিগকে নিশ্চয়ই সরল পথ প্রদর্শন করিতেছ।’ উহার দ্বিতীয় প্রকারের প্রয়োগের একটি দৃষ্টান্তঃ
الحمد لله الّذئ هَدَانًا لهذا (জান্নাতীরা বলিবে) সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ্ তা’আলার যিনি আমাদিগকে এখানে পৌছাইয়াছেন।’ ইমাম আবূ জাফর ইব্ন জারীর বলেন-তাফসীরকারগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, الصراط المستقيم অর্থ ‘পূর্ণরূপে বক্রতামুক্ত সরল সুস্পষ্ট পথ।’ সকল আরব গোত্রই এই অর্থে উহা ব্যবহার করে। কবি জারীর ইব্ন আতিয়্যা আল্ খাতফী নিম্ন পংক্তিতে উহাকে উক্ত অর্থেই ব্যবহার করিয়াছেনঃ
امير المؤمئين على صراط اذا اعوج الموارد مستقيم
“যখন সব পথ বক্র হইয়া যায়, আমীরুল মু’মিনীন তখনও বক্রতামুক্ত সরল পথে অবস্থান করেন।’
অনুরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। আরবগণ الصراطl শব্দকে রূপকভাবে কথা, কার্য, গুণ, অবস্থা ইত্যাদির অর্থে ব্যবহার করিয়া থাকে। বক্র কথা, কার্য, গুণ বা অবস্থা বুঝাবার জন্য তাহারা উক্ত শব্দের সহিত المعوج (বক্র) বিশেষণ প্রয়োগ করে। صراط الْمستقيْم সরল কথা, কার্য, গুণ বা অবস্থা। صراط معوج বক্র কথা, কার্য, গুণ বা অবস্থা।
তাফসীরকারগণ বিভিন্নরূপে الصراط الْمستقيُم -এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন। এই ব্যাপারে তাহাদের শব্দ প্রয়োগে বিভিন্নতা থাকিলেও তাৎপর্য একই দাঁড়ায়। অর্থাৎ সকলের কথার তাৎপর্য হইল এই যে, ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ হইতেছে, ‘আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্যের পথ।’
একদল তাফসীরকার বলেনঃ الصراط الْمَسَحقيم হইতেছে ‘আল্লাহর কিতাব আল কুরআন’। হযরত আলী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হারিছ আওয়ার, তাহার ভ্রাতুষ্পুত্র সাঈদ ইব্ন মুখতার তাঈ, হামযাহ-আয-যাইয়াত, ইয়াহিয়া ইব্ন ইয়ামান, হাসান ইব্ন আরাফা ও ইব্ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, الصراط المستقيم হইতেছে ‘আল্লাহ্ তা’আলার কিতাব।’
এই রিওয়ায়েতের অন্যতম রাবী হামযাহ ইব্ন হাবীব আহ্ যাইয়াত হইতে ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং পরবর্তী বিভিন্ন সনদে ইমাম ইব্ন জারীরও উপরোক্ত হাদীস উদ্ধৃত করেন।
আমার রচিতঃ فضائل القران -এ হযরত আলী (কঃ) হইতে ক্রমাগত হারিছ আ‘ওয়ার প্রমুখ রাবীর সনদে ইমাম তিরমিযী ও ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত যে ‘মারফু হাদীস’ উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহার একাংশ এইঃ
‘(নবী করীম (সাঃ) বলেন) আল-কুরআন হইতেছে আল্লাহ্ তা’আলার শক্ত রজ্জু; উহা সূক্ষ্ম জ্ঞানে পরিপূর্ণ উপদেশ গ্রন্থ এবং উহাই হইতেছে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম।’
উক্ত বর্ণনা ‘মওকূফ হাদীস’ রূপে হযরত আলী (কঃ)-এর নিজস্ব উক্তি হিসাবেও বর্ণিত হইয়াছে। অবশ্য উহা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী হওয়ার পরিবর্তে হযরত আলী (কঃ)-এর উক্তি হওয়াই অধিকতর স্বাভাবিক ও সম্ভবপর। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
আবদুল্লাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ওয়ায়েল, মনসূর ও হযরত ছাওরী বর্ণনা করেনঃ
الصراط المستقيم হইতেছে, ‘আল্লাহ্ তা’আলার কিতাব।
আরেকদল তাফসীরকার বলেন الصتراط المستقيم হইতেছে ইসলাম। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যাহ্হাক বর্ণনা করেনঃ
“হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে বলিলেন, হে মুহাম্মদ ! আপনি বলুন, الصتراط المستقيم ‘উহা হইতেছে আল্লাহ্ দীন। উহাতে কোনরূপ বক্রতা নাই।’
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ মালিক, আবূ সালেহ ও ইসমাঈল ইব্ন আবদুর রহমান আস সুদ্দীয়্যুল কবীরও উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ সহ একদল সাহাবা হইতে ক্রমাগত মুররা হামদানী ও ইসমাঈল ইব্ন আবদুর রহমান আস সুদ্দীয়্যুল কবীর বর্ণনা করেনঃ الصراط الْمسحَقيْم হইতেছে ইসলাম।
হযরত জাবির (রাঃ) আবদুল্লাহ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন মুহাম্মদ উকায়ল বর্ণনা করেনঃ الصراط المستقيم হইল ইসলাম। উহা আসমান-যমীনের মধ্যবর্তী স্থান হইতে প্রশস্ত।
ইবনুল হানাফিয়্যাহ বলেন, الصراط الْمُسْفْقيْم হইতেছে আল্লাহর সেই দীন যাহা ছাড়া অন্য কোন দীন তিনি কবূল করেন না।’
আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম বলেন, الصراط الْمسحقيم অর্থ ইসলাম।
হযরত নাওয়াস ইন সুমআন হইতে ক্রমাগত জুবায়র ইব্ন নাফীর, মু’আবিয়া ইব্ন সালেহ, লায়ছ ইব্ন সা’দ, আবুল আ’লা হাসান ইব্ন সাওয়ার ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলেন-আল্লাহ্ তা’আলা একটি উপমা দিয়াছেন। একটি সরল রাস্তা রহিয়াছে (الصراط المستقيم)। উহার উভয় পার্শ্বে একটি করিয়া দেওয়াল রহিয়াছে। দেওয়াল দুইটিতে কতগুলি উন্মুক্ত দ্বার রহিয়াছে। দ্বারগুলিতে পর্দা ঝুলিয়া রহিয়াছে, রাস্তার ফটকে একজন আহ্বায়ক রহিয়াছে। সে লোকদিগকে ডাকিয়া বলিতেছে-‘ওহে লোক সকল ! তোমরা সবাই এই রাস্তায় আস। উহা ছাড়িয়া বাঁকা রাস্তায় যাইও না।’ উক্ত রাস্তার উপরও একজন আহ্বায়ক আছে। কেহ দেওয়ালের কোন দুয়ারের পর্দা তুলিতে চাহিলে সে ডাকিয়া বলে-খবরদার, উহা তুলিও না। তুলিলে বিপথগামী হইবে। সেই সরল রাস্তাটি ইসলাম। দেওয়াল দুইটি হইল আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা। পর্দা টানানো দুয়ারগুলি হইতেছে নিষিদ্ধ কাজসমূহ। রাস্তার ফটকে আহ্বানরত ব্যক্তি হইতেছে আল-কিতাব। রাস্তার উপর অবস্থানরত লোকটি হইল মু’মিনের বিবেক।’
ইমাম ইব্ন আবূ হাতিম এবং ইমাম ইব্ন জারীরও উক্ত হাদীস উহার অন্যতম বর্ণনাকারী লায়ছ ইব্ন সা’দ হইতে ঊর্ধ্বতন সনদে এবং পরবর্তী স্তরে অন্য সনদে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত নাওয়াস ইব্ন সুমআন (রাঃ) হইতে ক্রমাগত জারীর ইব্ন নাফীর, খালিদ ইবন মা‘দান, বাজীর ইব্ন সা’দ, বাকীয়্যাহ, আলী ইব্ন হাজার, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসাঈ উক্ত হাদীস বর্ণনা করেন।
উহার সনদ حسن صحيح (বিশেষ নিয়মে গ্রহণযোগ্য)। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।
মুজাহিদ বলেন- الصراط المستّقيم -এর তাৎপর্য হইতেছে الحق (সত্য)। তাই اهدنًا الصراط الْمُسَتقيم এর অর্থ ‘আমাদিগকে সত্য পথ প্রদর্শন কর।’
উক্ত তাৎপর্য অধিকতর ব্যাপক এবং উহা পূর্বোক্ত তাৎপর্য সমূহের বিরোধী নহে।
আসিম আহওয়ান হইতে ক্রমাগত হামযাহ ইব্ন মুগীরাহ, আবূন নযর হাশিম ইব্ন কাসিম প্রমুখ রাবীর সনদে আবূ হাতীম ও ইব্ন জারীর বর্ণনা করেনঃ
‘একদা আবুল আলীয়্যা বলেন, الصراط الْمَستقيْمَ হইল নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁহার পরবর্তী দুই খলীফা।’
বর্ণনাকারী আসিম বলেন, আমরা আবুল আলীয়্যার এই ব্যাখ্যা হযরত হাসান বসরীর নিকট উল্লেখ করিলাম। তিনি বলিলেন, আলীয়্যা ঠিকই বলিয়াছেন।
উপরে বর্ণিত তাফসীরসমূহের প্রত্যেকটি শুদ্ধ ও সঠিক। উহাদের একটি অপরটির সহিত সংঘর্ষশীল নহে। বরং উহাদের একটি আরেকটির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং একটি আরেকটির সমর্থক ও পরিপূরক। কারণ, যে ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ) হযরত আবূ বকর সিদ্দীক ও হযরত উমর (রাঃ)-কে অনুসরণ করে সে ব্যক্তি সত্যকেই অনুসরণ করে। তেমনি যে ব্যক্তি ‘সত্য’ কে অনুসরণ করে, সে ইসলামকেই অনুসরণ করে। তেমনি যে ব্যক্তি ইসলামকে অনুসরণ করে, সে কুরআনকেই অনুসরণ করে। ‘আল-কুরআন’ হইল আল্লাহর কিতাব, তাঁহার মজবুত রশি এবং তাঁহার সরল ও সোজা পথ। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলারই প্রাপ্য।
হযরত আব্দুল্লাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ওয়ায়েল, আ’মাশ, ইয়াহিয়া ইব্ যাকারিয়া ইব্ন আবূ যায়দাহ, ইবরাহীম ইব্ন মাহদী আল মাসীসী, মুহাম্মদ ইব্ন ফযল সাকতী ও ইমাম তাবারানী বর্ণনা করেনঃ
হযরত আব্দুল্লাহ বলিয়াছেন الصراط الْمَسَتَقيم হইল, নবী করীম (সাঃ)-এর প্রদর্শিত পথ।
ইমাম জা’ফর ইব্ন জারীর বলেন, আমার নিকট اهدنًا الصراط المستقيم -এর অধিকতর গ্রহণযোগ্য তাৎপর্য হইতেছে এইঃ
(‘হে প্রভু !) তোমার অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও দানে ধন্য বান্দাদের জন্য তুমি যে সব কথা ও কাজ পছন্দ ও মনোনীত করিয়া তাহাদিগকে উহা করার তাওফীক দান করিয়াছ, আমাদিগকে উহার উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকার তাওফীক দান কর।
মূলত উপরোক্ত পথই হইতেছে সিরাতুল মুস্তাকীম। কারণ, নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ সহ অন্যান্য নেককার বান্দা আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ দান ও নি’আমতে ভূষিত ছিলেন। তাই তাঁহাদিগকে অনুসরণ করার তাওফীক ও সৌভাগ্য যাহারা লাভ করে তাহারা রসূলগণকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইবার, আল্লাহ্ তা’আলার কিতাবকে আঁকড়াইয়া থাকিবার, তাঁহার আদেশ-নিষেধ পালন করিবার এবং নবী করীম (সাঃ), খোলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য নেককার বান্দাকে অনুসরণ করিবার তাওফীক ও সৌভাগ্য লাভ করে। আর ইহাই হইতেছে
الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
প্রশ্ন হইতে পারে, মূ’মিন বান্দা তো হিদায়েতের নি‘আমতে ভূষিত হইয়াই মু’মিন হইয়াছে। সে কেন প্রতি সালাতে আবার অহরহ হিদায়েত বর্ণনা করিবে? ইহা কি ‘অর্জিত বস্তু পুনঃঅর্জনের’ প্রচেষ্টার শামিল নহে?
উত্তরে বলা যায়, উহা অর্জিত বিষয় পুনঃঅর্জনের (تحصيل حاصل) অহেতুক প্ৰচেষ্টা নহে। কারণ, মু’মিন ব্যক্তির اهدنًا الصراط المستقيم কামনার তাৎপর্য হইতেছে এই যে, ‘প্রভু যতটুকু হিদায়েত আমাকে দান করিয়াছ, উহাতে আমাকে অবিচল রাখ এবং যে হিদায়েত আমি এখনও লাভ করি নাই তাহা আমাকে দান করা আমার জ্ঞানের পরিধিকে আরও বাড়াইয়া দাও; অধিকতর ইলম ও মা’রিফাত সমৃদ্ধ করিয়া দাও এবং আমাকে অধিকতর নেক আমল করার তওফীক দাও।’
বলাবাহুল্য, অনুরূপ সবিস্তার প্রার্থনায় ‘তাহসীলে হাসিল’ অনুসৃত ও অপরিহার্য হয় না; বরং প্রত্যেক মু’মিনের জন্য উহা জরুরী। আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় বান্দার অভাব ও প্রয়োজন মিটাইবার জন্য সদা প্রস্তুত। যে বান্দা বারংবার কান্নাকাটি করিয়া তাহার অভাব পূরণের জন্য তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে থাকে তাহার প্রার্থনা তিনি অবশ্যই মঞ্জুর করেন।
উক্ত মর্মে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا امَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ والكتاب الذي أنزل من قبل
‘হে মু’মিন সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর উপর, তাঁহার রাসূলের উপর, রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের উপর এবং অতীতে অবতীর্ণ কিতাবের উপর ঈমান রাখ।’
এই আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিনদের নিশ্চয়ই নতুন করিয়া ঈমান আনিতে নির্দেশ দেন নাই; বরং অর্জিত ঈমানের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকিতে এবং অধিকতর ইলম ও মারিফাতের দ্বারা উহাকে সবল ও সমৃদ্ধ করিতে আদেশ দিয়াছেন। ইহা অবশ্যই অর্জিত বিষয় পুনরর্জনের আদেশ নহে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
বস্তুত হিদায়েত লাভ করার পর হিদায়েত প্রাপ্ত ব্যক্তি যাহাতে হিদায়েতের উপর অবিচল থাকিতে পারে এবং উহা আরও সবল ও সমৃদ্ধ করিতে পারে, তজ্জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট বারংবার প্রার্থনা করা তাহার জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহ্ তা’আলা স্বয়ং মু’মিনদের নিম্নরূপ প্রার্থনা করিতে বলেনঃ
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً – إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
‘হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু ! আমাদিগকে হিদায়েত দান করিবার পর আমাদের অন্তরগুলি বিপথগামী করিও না। অনন্তর তুমি আমাদিগকে নিজের তরফ হইতে আরও রহমত দান কর। নিশ্চয় তুমি মহা দানশীল।’
হযরত আবূ বকর (রাঃ) মাগরিবের নামাযের তৃতীয় রাকআতে ফাতিহা পড়ার পর উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করিতেন।
উপরোক্ত আলোচনা সমুহের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতের তাৎপর্য হইতেছে এইঃ হে আল্লাহ্ ! আমাদিগকে হিদায়েতে অবিচল রাখ এবং বিপথগামী হইতে দিও না। (পরন্তু আমাদিগকে অধিকতর হিদায়েত প্রদান কর)!
(٦)
صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِم ة
(٧)
غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
৬. ‘তাহাদের’ পথ যাহাদের তুমি অনুগ্রহ দান করিয়াছে;
৭. যাহারা অভিশপ্ত নহে এবং পথভ্রষ্টও নহে।’
তাফসীরঃ ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদীসে বর্ণিত হইয়াছেঃ বান্দা যখন বলে এর।
الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ – صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضالين
তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,“ইহা আমার বান্দার অংশ এবং আমার বান্দা যাহা চাহিয়াছে তাহা পাইবে।’
মূলত হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত পূর্বোল্লিখিত তাৎপর্য অধিকতর ব্যাপক ও প্রশস্ত।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ আলোচ্য আয়াতের প্রথম শব্দ غير -কে পূর্ববর্তী আয়াতাংশ الْذين أَنْعَمْت عَلَيْهمْ -এর صفت হিসাবে الجر বিভক্তি সহকারে (যের দিয়া) পড়িয়াছেন। নবী করীম (সাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) উক্তরূপে পড়িতেন। ইব্ন কাছীর হইতেও অনুরূপ আয়াত বর্ণিত হইয়াছে। তাঁহাকে نصب দিয়া পড়িলে পূর্ববর্তী আয়াতের অন্তর্গত ا نعمت সমাপিকা ক্রিয়াটি উহার নসব বিভক্তির عامل (সংঘটক) হইবে।
আল্লামা যামাখশারী বলেন, কেহ কেহ উহাকে পূর্ববর্তী আয়াতের বle শব্দের অন্তর্গত সর্বনামের J (হাল) হিসাবে বিভক্তি সহকারে (যবর দিয়া) পড়িয়াছেন ৷
আয়াতত্রয়ের তাৎপর্য এইঃ আমাদিগকে সরল পথ দেখাও -যাহাদিগকে বিশেষ দানে বিভূষিত করিয়াছ সেই নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও অন্যান্য নেককারগণের পথ-তাহারাই (হিদায়েতপ্রাপ্ত, আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের প্রতি অনুগত এবং আল্লাহ্ তা’আলার বিধি-নিষেধ পালনকারী; যাহারা অভিশপ্ত তাহাদের পথে নহে। কাহারা অভিশপ্ত? যাহারা সত্যকে জানিয়া বুঝিয়া এবং চিনিয়াও উহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে, তাহারাই অভিশপ্ত। সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞতা নহে; রবং সত্যের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা হইতেছে তাহাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যাহারা পথভ্রষ্ট তাহাদের পথও নহে। কাহারা পথভ্রষ্ট? যাহারা অজ্ঞতার কারণে সত্যভ্রষ্ট ও সত্য হইতে বিচ্যুত তাহারাই পথভ্রষ্ট। সত্য-বিদ্বেষ নহে; বরং সত্যের প্রতি অনীহা হইতেছে তাহাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
আয়াতে المغضوب عليهم -এর পূর্বে যে غير শব্দটি প্রযুক্ত হইয়াছে الضالين -এর পূর্বে উহারই সমার্থক لا শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে الضالين ও المغضوب عليهم একই শ্রেণীভুক্ত নহে; বরং দুইটি পৃথক শ্রেণী। তাহাদের এই পার্থক্যের প্রতি ইঙ্গিত প্রদানের জন্যই الضالين শব্দের পূর্বে لا শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। উক্ত শ্রেণী দুইটি হইতেছে যথাক্রমে ইয়াহুদী জাতি ও নাসারা জাতি। الضالين হইল ইয়াহুদী জাতি এবং المغضوب عليهم হইল নাসারা জাতি।
এক দল ব্যাকরণবিদ বলেন, আয়াতে প্রযুক্ত غير শব্দটি استثشناء (ইস্তিছনা) হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে। উহাকে استثشناء ধরিলে উহা استثناء منقطع হইবে। কারণ, অভিশপ্ত শ্রেণী ও পথভ্রষ্ট শ্রেণী উভয়ই আল্লাহর দানে বিভূষিত শ্রেণী হইতে পৃথক ও স্বতন্ত্র।
আয়াতের المغضوب عليهم ও الضالين শব্দ দুইটির প্রত্যেকটির পূর্বে উহার مضاف হিসাবে صر اط শব্দটি উহ্য রহিয়াছে। বাক্যটির পূর্ণরূপ হইলঃ
غير صراط المغضوب عليهم ولاصراط الضالين
অর্থাৎ (আমাদিগকে সরল পথ দেখাও যাহাদের তুমি বিশেষ অনুগ্রহে ভূষিত করিয়াছ তাহাদের পথ) যে পথ অভিশপ্তদের পথ হইতে ভিন্ন এবং পথভ্রষ্টদের পথ নহে।
পূর্ববর্তী আয়াতদ্বয়ে বলা হইয়াছে, ‘আমাদিগকে সরল পথ দেখাও, যাহাদের তুমি অনুগ্রহে ভূষিত করিয়াছ তাহাদের পথ দেখাও।’ উক্ত বক্তব্যের আলোকে বিবেচনা করিলে আলোচ্য
صراط الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ
এর অর্থ হইতেছে, যাহাদিগকে তুমি বিবেকদানে বিভূষিত করিয়াছ তাহাদের পথ।’
মূলত ইহা পূর্ব বর্ণিত الصراط المستقيم এর ব্যাখ্যা। ব্যাকরণ শাস্ত্রবিদদের মতে ইহা الصراط المستقيم এর بدل (বদল)। অবশ্যই ইহা الصراط المستقيم এর عطف البيان ও হইতে পারে।(১) আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ্ তা’আলা যাহাদের বিশেষ দানে বিভূষিত করিয়াছেন, সূরা নিসায় তিনি তাহাদের পরিচয় দিয়াছেনঃ
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَيْكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ والصدِّقِينَ وَالشُّهَدَاء وَالصَّالِحِيْنَ – وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا – ذَالِكَ الْفَضْلُ مِنَ الله – وَكَفَى بِاللهِ عَلِيمًا
‘অনন্তর যাহারা আল্লাহ্ ও রাসূলকে অনুসরণ করে, তাহারা সেই সকল বান্দার সহিত থাকিবে যাহাদিগকে আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষ দানে ধন্য করিয়াছেন। তাহারা হইতেছে নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ ও নেক্কারগণ। কতই উত্তম সঙ্গী তাহারা। আল্লাহ্ তরফ হইতে এই দান। এই ব্যাপারে আল্লাহ্র জ্ঞানই যথেষ্ট।’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যাহ্হাক বর্ণনা করিয়াছেনঃ صراط الَّذَين أنعمت عليهم এর তাৎপর্য হইতেছেঃ
‘তোমার দাসত্ব ও আনুগত্যের দানে যাহাদের ধন্য করিয়াছ, তাহাদের পথ; তাহারা হইতেছেন তোমার ফেরেশতাবৃন্দ, নবীকুল, সিদ্দীকগণ ও নেক্কার সম্প্রদায়।’
নিম্নোক্ত আয়াতও আলোচ্য আয়াতের অনুরূপঃ
وَمَنْ يُطع الله وَالرَّسُولَ فَأُولئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ والصديقِينَ وَالشُّهَدَاء وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا
রবী’ ইবন আনাস (রাঃ) হইতে আবূ জাফর রাযী বর্ণনা করেনঃ أَلَّدَيْنَ أَنْعمت عَلَيْهم এর তাৎপর্য হইল শুধু ‘নবীগণ’।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ইব্ন জুরায়জ বর্ণনা করেন, أَلَّدَينَ أشعمت علَيهم -এর তাৎপর্য হইল ‘মু’মিনগণ’। মুজাহিদও অনুরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেন।
ওয়াকী’ বলেনঃ উহারা হইতেছেন ‘মুসলমানগণ’।
আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম বলেনঃ “উহারা হইতেছেন নবীকুল ও তাঁহাদের অনুসারীবৃন্দ।
আয়াতের পূর্বোল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের পূর্বে صر اط শব্দকে উহাদের مضاف হিসাবে উহ্য মানাই সঙ্গত। সাহিত্যে موصوف -কে উহ্য রাখিয়া শুধু উহার صففنت কে উল্লেখ করার প্রথা রহিয়াছে। যেমন কবি বলেন-
كانك جمل من جمال بنى اقيش – يقعقع عند رجليه بشن
“তুমি যেন বনূ উকায়শ গোত্রের একটি উষ্ট্র যাহা দুই পায়ের সাথে একটি মশক লইয়া চলে।”
উক্ত চরণের বাক্যটি ছিল এইরূপঃ
كانك جمل من جمال بني اقيش
جمل শব্দটি من جمال শব্দের موصوف অথচ উহাকে উহ্য রাখিয়া শুধু উহার صفت উল্লেখ করা হইয়াছে। অনুরূপভাবে উক্ত আয়াতে صراط শব্দটি একবার المفضوب عَلَيْهمٍ ও একবার الضالين শব্দের مضاف হইয়াছে। উহা উহ্য রাখিয়া শুধু مضاف اليه উল্লেখ করা হইয়াছে।
একদল বিশেষজ্ঞ বলেন, ولا الضالين শব্দের অন্তর্গত لا শব্দটি অতিরিক্ত। এখানে উহা কোন অর্থ প্রদান করে নাই। বাক্যটি মূলত এইরূপ ছিলঃ
غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَالضَّالِينَ
সাহিত্যে এইরূপ ব্যবহারের প্রচলন রহিয়াছে। যেমন কবি আজ্জাজ বলেনঃ
في بئر لاحور – السعى وماشعر
‘যে অজ্ঞাতসারে দৌড়াইয়া কূপে পড়িয়া গেল।’ এখানে حور শব্দের পূর্ববর্তী لا শব্দটি অতিরিক্ত। উহা কোন অর্থ প্রদান করে নাই। মূল বাক্যটি এইরূপ ছিলঃ
في بئر حور – سعى وما شعر
মূলত উক্ত বিশেষজ্ঞদের এই মতটি ভ্রান্ত। আমি ইতিপূর্বে উক্ত لا শব্দের ব্যবহারের তাৎপর্য ও রহস্য বর্ণনা করিয়াছি, উহাই সঠিক ও শুদ্ধ। এখানে لا শব্দটি অতিরিক্ত ও অর্থহীন নহে বলিয়াই হযরত উমর (রাঃ) لا শব্দের জায়গায় উহার সমার্থক শব্দ আনিয়া আয়াতটি এইরূপে পড়িতেনঃ
غير المغوب عليهم وغير الضالين
আসওয়াদ হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ ও আবূ মু’আবিয়ার একটি বর্ণনার ভিত্তিতে আবূ উবায়দ কাসিম ইবন সালাম স্বীয় فضائل قر ان গ্রন্থে বর্ণনা করেনঃ
হযরত উমর (রাঃ) এইরূপে পড়িতেন- غير المغضوب عليهم وغير الضالين
উক্ত বর্ণনার সূত্র শুদ্ধ। হযরত উবাই ইবন কা’ব সম্বন্ধেও বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি ও আলোচ্য আয়াতটি উক্তরূপে পড়িতেন। তাহাদের এইরূপ পড়ার ব্যাখ্যা স্বরূপ বলা হয় যে, তাহারা উহা আদত হিসাবে নহে; বরং আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে উক্তরূপে পড়িতেন।
ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, এখানে لا শব্দটি অতিরিক্ত ও অনর্থক নহে। কেহ যাহাতে الضالين শব্দকে الذين انعمت عليهم এর و শব্দ দ্বারা সংযোজিত বিধায় একই অর্থবোধক না মনে করে, তজ্জন্য ও বিশেষত শব্দ দুইটি যে দুইটি পৃথক শ্রেণীর জন্য ব্যবহৃত তাহা বুঝাইবার জন্য الضالين শব্দের পূর্বে لا শব্দ বসানো হইয়াছে। কারণ, যাহারা সত্যকে জানিয়া, বুঝিয়া, চিনিয়া শুধুমাত্র বিদ্বিষ্ট হইয়া উহা প্রত্যাখ্যান করে, তাহারা হইল المغضوب عليهم পক্ষান্তরে যাহারা সত্যকে জানিতে, বুঝিতে ও চিনিতে চেষ্টা করে না, তাহারা হইল الضالين প্রথমোক্ত দল হইল ইয়াহুদী সম্প্রদায় ও শেষোক্ত দল হইল নাসারা সম্প্রদায়। মু’মিন সম্প্রদায় যেন এই উভয় দল এবং তাহাদের ধ্যান-ধারণা ও আমল-আখলাক হইতে দূরে থাকে, তজ্জন্য উভয় দলকে পৃথকভাবে দেখাবার উদ্দেশ্যে الضالين শব্দের পূর্বে لا শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। ইয়াহুদীরা সত্যকে জানিত, কিন্তু মানিত না। পক্ষান্তরে নাসারারা সত্যকে জানিতে চেষ্টা করিত না। মু’মিনকে সত্য জানিতেও হইবে, মানিতেও হইবে।
ইয়াহুদী ও নাসারা এই উভয় সম্প্রদায়ের প্রত্যেক সম্প্রদায়ই একদিকে যেমন পথভ্রষ্ট, অন্যদিকে তেমনি অভিশপ্ত। তবে অভিশপ্ত হওয়া ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং পথভ্রষ্ট হওয়া নাসারা সম্প্রদায়ের মূল বৈশিষ্ট্য।
ইয়াহুদী সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ من لَعَنْهُ اللَّهُ وعْضب عَلَنْه ‘যাহাদের আল্লাহ্ অভিশপ্ত কারিয়াছেন এবং যাহাদের উপর তাঁহার গযব আপতিত হইয়াছে।’ পক্ষান্তরে নাসারা সম্প্রদায় সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
قد هلوا من بل وآضتلوا كيرا وَضَُوًا عَنْ سواء اسيل ‘তাহারা ইতিপূর্বে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হইয়াছে এবং অনেক লোকও পথভ্রষ্ট করিয়াছে। অনন্তর তাহারা সত্যপথ হইতে বিচ্যুত হইয়াছে।’
المفضوب علَيهم যে ইয়াহুদী জাতি এবং الضالين যে নাসারা জাতি তাহা একাধিক হাদীস ও প্রাথমিক যুগের মনীষীদের উক্তি দ্বারা সুপ্রমাণিত। হযরত ‘আদী ইবনে হাতেম তাঈ (রাঃ) হইতে যথাক্রমে আব্বাস ইবনে হুবায়শ, সিমাক ইব্ন হারব, শু’বা, মুহাম্মদ ইব্ন জা’ফর ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক প্রেরিত অশ্বারোহী বাহিনী আমার ফুফুসহ একদল লোককে গ্রেফতার করিয়া লইয়া গেল। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিগণ নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট নীত হইয়া তাঁহার সম্মুখে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হইলে আমার ফুফু বলিলেন-‘হে আল্লাহর রাসূল ! আমার তত্ত্বাবধায়ক ও সেবক আমার নিকট হইতে দূরে রহিয়াছে। আমি অত্যন্ত বৃদ্ধা ৷ আমার নিজের কিছু করিবার ক্ষমতা নাই। আপনি আমার প্রতি কৃপা প্রদর্শন করুন (আমাকে মুক্তি দিন)। আল্লাহ আপনার প্রতি কৃপা প্রদর্শন করিবেন।’ নবী করীম (সাঃ) প্রশ্ন করিলেন, আপনার তত্ত্বাবধায়ক কে? আমার ফুফু বলিলেন-‘আদী ইব্ন হাতেম।’ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন—সেই ‘আদী ইব্ন হাতেম, যে আল্লাহ ও তাঁহার রাসূল হইতে ভাগিয়া গিয়াছে? অতঃপর তিনি আমার ফুফুকে মুক্তি দিলেন। মুক্তি দিবার পর তিনি একটি লোক সঙ্গে করিয়া আমার ফুফুর নিকট আসিলেন এবং সেই লোকটির দিকে ইঙ্গিত করিয়া আমার ফুফুকে বলিলেন—ইহার নিকট হইতে সওয়ারী অশ্ব চাহিয়া নিন। আমার ফুফুর ধারণা, সেই লোকটি আলী হইবেন। আমার ফুফু অশ্ব চাওয়া মাত্র তিনি তাহাকে অশ্ব দিলেন। আমার ফুফু আমাদের নিকট পৌঁছিয়া আমাকে বলিলেন-‘তুমি যাহা করিয়াছ তোমার পিতা জীবিত থাকিলে উহা করিত না। মুহাম্মদ (সাঃ) একজন সহৃদয় মহামানব। এক ব্যক্তি তাহার নিকট আসিল। সে তাঁহার দানে অনুগৃহীত হইল। আরেক ব্যক্তি আসিল। সেও তাঁহার দানে ধন্য হইল। (এইরূপ তাঁহার ভাণ্ডার মানব কল্যাণে নিয়োজিত)। আমি (‘আদী ইব্ন হাতেম) নবী করীম (সাঃ)-এর খিদমতে হাজির হইলাম। দেখিলাম, তাঁহার নিকট নারী কি শিশুরাও আসে। তিনি তাহাদের সহিত নিরহংকারভাবে মেলামেশা করেন এবং তাঁহার চরিত্র এত মধুর যে, তাহারা নিঃসংকোচে তাঁহার নিকট আসা-যাওয়া করে। আমি বুঝিতে পাইলাম যে, তিনি রোমক সম্রাট কি পারস্য সম্রাটের মত (দাম্ভিক) নহেন। আমাকে তিনি বলিলেন-হে ‘আদী ! কেন তুমি لا اله الا الله বলিতেছ না? আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন মা’বূদ আছে কি? কেন তুমি اللّه اكبر বলিতেছ না? আল্লাহ অপেক্ষা মহান কিছু আছে কি? ইহা শুনিয়া আমি ইসলাম গ্রহণ করিলাম। দেখিলাম, তাঁহার পবিত্র মুখমণ্ডল আনন্দে ভরিয়া উঠিয়াছে। তখন তিনি বলিলেন, المغضوب عليهم হইতেছে ইয়াহুদী জাতি এবং الضالين হইতেছে নাসারা জাতি (অসমাপ্ত)। ‘
ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীছের অন্যতম রাবী সিমাক হইতে ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং পরবর্তী স্তরে অন্য রাবীর সূত্রে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। উহা সিমাক ইব্ন হারব ভিন্ন অন্য কোন রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হইয়াছে বলিয়া আমার জানা নাই। উহা غريب হাদীস হইলেও حسن غريب (বিশেষ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য)।
হযরত আদী ইব্ন হাতেম হইতে যথাক্রমে মারী ইব্ন কিতরী, সিমাক ইব্ন হারব, হাম্মাদ ইবন সালামা প্রমুখ রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত আছেঃ
“হযরত ‘আদী ইব্ন হাতেম (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট غير المفضوب علَيهم ولا الضالين আয়াতের অর্থ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন المغضوب عليهم হইল ইয়াহুদীরা এবং الضالين হইল নাসারারা।’
‘আদী ইব্ন হাতেম (রাঃ) হইতে যথাক্রমে শা’বী, ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ, সুফিয়ান ইব্ন উয়াইনিয়া প্রমুখ বর্ণনাকারীর সনদেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।
হযরত ‘আদী ইব্ন হাতেম (রাঃ)-এর আলোচ্য হাদীসটি একাধিক সূত্রে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণিত হইয়াছে ৷ উহাদের উল্লেখ দীর্ঘ হইবে বলিয়া এখানে উহা পরিত্যক্ত হইল।
জনৈক সাহাবী হইতে যথাক্রমে আবদুল্লাহ ইব্ন শাকীক, বুদাইল ইব্ন উকায়লী, মা’মার ও আবদুর রাযযাক বর্ণনা করেনঃ
وادى القرى (ওয়াদিউল কোরা) নামক স্থান দিয়া একদিন নবী করীম (সাঃ) যাইতেছিলেন। বনূ কয়েন গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তাঁহাকে প্রশ্ন করিল, হে আল্লাহর রাসূল ! المغضوب عليهم এবং الضالين কাহারা? তিনি বলিলেন, المغضوب عليهم হইল ইয়াহুদী জাতি এবং الضالين হইল নাসারা জাতি। জারীর, উরওয়াহ ও খালিদ আল হাজ্জা উপরোক্ত হাদীস আবদুল্লাহ ইব্ন শাকীক হইতে حديث مرسل (সাহাবী রাবীর নাম উহ্য) হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। অন্যত্র উরওয়ার এক রিওয়ায়েতের সনদে সাহাবা রাবী হিসাবে হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রাঃ)-এর নাম উল্লেখিত হইয়াছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
হযরত আবূ যর গিফারী (রাঃ) হইতে আবদুল্লাহ ইব্ন শাকীক, বুদায়ল ইব্ন মায়সারাহ্, ইবরাহীম ইব্ন তোহমান প্রমুখ রাবীর মাধ্যমে ইব্ন মারদুবিয়্যা বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ আমি একদিন নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট المغضوب عليهم এবং الضالين -এর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন المغضوب عليهم ইয়াহুদী জাতি এবং الضالين নাসারা জাতি।’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে আবূ মালিক, আবূ সালেহ ও সুদ্দী এবং হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) সহ একদল সাহাবী হইতে যথাক্রমে মুবারা হামদানী ও সুদ্দী বর্ণনা করেনঃ ‘উল্লিখিত সাহাবীগণ বলেন, المغضوب عليهم হইল ইয়াহুদী জাতি এবং الضالين হইতেছে নাসারা জাতি।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যাহ্হাক এবং ইবন জুরায়জ বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- المغضوب عليهم হইতেছে ইয়াহুদী জাতি ও الضالين হইতেছে নাসারা জাতি।’
রবী’ ইব্ন আনাস, আব্দুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম প্রমুখ বহুসংখ্যক তাফসীরকারও অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন। ইমাম ইব্ন আবূ হাতিম বলেন, ‘আল মাগদূবি আলায়হিম’ এবং ‘আদ্দাল্লীন’ এর উপরোক্ত তাফসীরের পরিপন্থী কোন তাফসীর কেহ বৰ্ণনা করিয়াছেন বলিয়া আমি জ্ঞাত নহি। উপরোল্লেখিত হাদীস ও নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ হইতেছে মুফাস্সিরগণ কর্তৃক বর্ণিত এতদসম্পর্কিত তাফসীরের ভিত্তি ও উহার যথার্থতার প্রমাণ।
সূরা বাকারায় ‘বনী ইসরাঈল’ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
نس مَا شرا به أَنْفْسَهُمْ آن يكرا بماأَدْرْلَ الله بَميا أن مَل الله من فَصْْله على منْ يَّشَاءُ من عبّاده ج فَبَاوًا بعَضمّب على عضب ه وَللْكَافِريْنَ عَدَابُ مهين
‘তাহারা যে জিনিসের বিনিময়ে নিজেদের বিক্রয় করিয়াছে, উহা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। উহা এই যে, আল্লাহ তা’আলা যাহা নাযিল করিয়াছেন তাহারা বিদ্বেষের বশীভূত হইয়া তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁহার বান্দাগণের মধ্য হইতে যাহার উপর চাহেন স্বীয় কৃপা বর্ষণ করেন। তাহারা ক্রোধের পর ক্রোধে দিশাহারা হইয়া ফিরিতেছে। অনন্তর কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি নির্ধারিত রহিয়াছে।
সূরা মায়িদায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
قل هل أَنْبمُكُمْ بشر من ذالك مَُويَةٌ عند الله مْنْ لَعْنْهُ اللّهُ وَعْضبْ عَلَيْه وَجَعَلَ مثهُم القردَة وَالْخْنَازِيْرَ وَعَبَّدَ الطّاعوت ط أولئك شر مَكَانًا وآضل عن سنواء السبيل
বল, আমি কি তোমাদিগকে আল্লাহর নিকট প্রাপ্তব্য প্রতিদানের দিক দিয়া নিকৃষ্টতম লোকদের পরিচয় দিব? স্বয়ং আল্লাহ্ যাহাদের অভিশপ্ত করিয়াছেন, যাহাদের উপর তাঁহার গযব আপতিত হইয়াছে এবং যাহাদের মধ্য হইতে তিনি বানর, শুকর ও তাগুতের গোলামে পরিণত করিয়াছেন তাহারাই। তাহাদের অবস্থান খুবই নিকৃষ্ট এবং সত্য হইতে তাহারা সর্বাধিক বিচ্যুত।’
তিনি আরও বলেনঃ
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُدَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ – ذالِكَ بِمَا عَصَوْاوَكَانُوا يَعْتَدُونَ – كَانُوا لا يَتَنَاهُونَ عَنْ مُنْكَرِ فَعَلُوهُ – لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ –
“বনী ইসরাঈলদের মধ্যে যাহারা কুফরী করিয়াছে তাহারা দাউদ এবং ঈসা ইব্ন মরিয়মের মুখে অভিশপ্ত হইয়াছে। উহা এইজন্য যে, তাহারা অবাধ্য হইত এবং সীমা লঙ্ঘন করিত। তাহারা যে পাপাচারে লিপ্ত ছিল তাহা হইতে বিরত হইত না। তাহাদের আচরণ ছিল বড়ই জঘন্য।’
জীবন চরিত গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছেঃ একদা যায়দ ইব্ন আমর ইবন নুফায়ল সত্য ধর্মের সন্ধানে একদল সঙ্গীসহ সিরিয়া গমন করেন। ইয়াহুদীরা তাহাকে বলিল, তুমি আল্লাহর গযব মাথায় না লইয়া আমাদের ধর্মে প্রবেশ করিতে পারিবে না। যায়দ বলিলেন, আমি উহা সহিতে পারিব না। তিনি ইয়াহুদী ধর্ম বা নাসারা ধর্ম কোনটিই গ্রহণ করিলেন না। অথচ তিনি মুশরিকদের ধর্ম ও মূর্তিপূজা হইতেও দূরে রহিলেন। তিনি স্বীয় বিবেক বুদ্ধি ও সহজাত স্বভাব অনুযায়ী চলিতে লাগিলেন। তাহার সঙ্গীগণ খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করিল। কারণ, তাহারা উহাকে ইয়াহুদী ধর্ম অপেক্ষা সত্যের কাছাকাছি মনে করিল। হযরত ওরাকা ইবন নওফিল (রাঃ) তাহাদের অন্যতম ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁহাকে নবী করীম (সাঃ)-এর মাধ্যমে হিদায়েতের নি’আমত দ্বারা সৌভাগ্যবান করিয়াছিলেন। নবূওত লাভ করিবার কালে নবী করীম (সাঃ) যে ওহী প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তিনি (হযরত ওরাকা) উহার উপর ঈমান আনিয়াছিলেন।
‘দাল্লীন’ ও ‘জাল্লীন’ সমস্যা
‘আরবী ض বর্ণ ও ظ বর্ণের মধ্যকার উচ্চারণগত ব্যবধান খুবই সামান্য। উহাদের উচ্চারণ স্থান পরস্পর কাছাকাছি অবস্থিত। ض এর উচ্চারণ স্থান হইতেছে জিহবার তিন দিকের প্রান্তভাগ এবং তৎসন্নিহিত দত্তমূল। পক্ষান্তরে ظ এর উচ্চারণ স্থান হইতেছে জিহ্বার অগ্রভাগ এবং উপরস্থ মাড়ির সম্মুখের দত্তদ্বয়ের অগ্রভাগ ৷ তদুপরি বর্ণদ্বয় উভয়ইالحروف المطبقه والحروف المجهوره ও حروف الرخوه শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। উপরোক্ত কারণে উহার উচ্চারণগত পার্থক্য নিরূপণ করা এবং তদনুযায়ী উহাদের সঠিক উচ্চারণ স্থান হইতে উচ্চারণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে বেশ কষ্টকর। তাই একদল ফকীহ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, উক্ত বর্ণদ্বয়ের একটির উচ্চারণ স্থানে অপরটি উচ্চারণ করা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ক্ষমাযোগ্য ত্রুটি বলিয়া পরিগণিত হইবে। উক্ত অভিমতই সঠিক ও শুদ্ধ। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
উল্লেখ্য যে, ض বর্ণকে আমিই অধিকতর শুদ্ধরূপে উচ্চারণ করিয়া থাকি-নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী বলিয়া কথিত এই উক্তিটি ভিত্তিহীন। উহা প্রকৃতপক্ষে তাঁহার বাণী নহে। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
ফাতিহার বিষয়বস্তু
মহা মর্যাদাশীল সপ্ত আয়াত বিশিষ্ট সূরা ফাতিহায় আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
সকল প্রশংসার মালিক ও প্রাপক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা। সকল প্রশংসা তাঁহারই জন্য নিবেদিত তিনি মহা বিশ্বের প্রতিপালক প্রভু, পরম করুণাময় ও নিরতিশয় কৃপাপরায়ণ।
নিশ্চয় একদিন মানুষের ভাল-মন্দ কার্যের বিচার অনুষ্ঠিত হইবে। সেই দিন সকল কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার আল্লাহ্ তা’আলা স্বহস্তে গ্রহণ করিবেন। সুতরাং একদিকে যেমন বদকারদের স্বীয় পাপাচারের শাস্তি এড়াইবার কোন পথ থাকিবে না, অন্যদিকে তেমনি নেককারদের স্বীয় পুণ্য কাজের পুরস্কার লাভের পূর্ণ নিশ্চয়তা থাকিবে।
মানুষ একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত করিবে এবং নিজ দাসত্ব ও ইবাদতে তাঁহার সহিত কাহাকেও শরীক করিবে না।
মানুষ নিজ নিজ শক্তি সামর্থ্যের উপর নির্ভর না করিয়া একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার হাতে নিজেকে সঁপিয়া দিবে। সত্য ও ন্যায়ের পথে চলিতে সে সর্বদা শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিবে।
মানুষ আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সঠিক ও সরল পথের নির্দেশনা প্রার্থনা করিবে। পৃথিবীতে সে সরল পথে চলিতে পারিলে আখিরাতেও জান্নাতে প্রবেশের পথ তাহার জন্য সহজ সরল হইয়া যাইবে। পৃথিবীর সরল পথ হইতেছে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও নেককারদের পথ। যাহারা বস্তু জগতে তাঁহাদের অনুসৃত আধ্যাত্মিক পথে চলিবে এবং তাঁহাদের সহিত আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে অবস্থান করিবে, তাহারা পারলৌকিক জীবনেও তাঁহাদের পথ ধরিয়া অনন্ত জান্নাত ধামে প্রবেশ ও বসবাসের সৌভাগ্য লাভ করিবে। সুতরাং মানুষের কর্তব্য হইতেছে আল্লাহ্ তা’আলা, তাঁহার রাসূল, তাঁহার কিতাব ও আখিরাতের উপর ঈমান আনিয়া এবং নেক কাজ করিয়া চির আনন্দ নিকেতন জান্নাত ধামে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করা।
আধ্যাত্মিক জীবন অনুসরণের জন্য যেরূপ সঠিক ও সরল পথ রহিয়াছে, তেমনি ভ্রান্ত ও বাঁকা পথও রহিয়াছে। উক্ত ভ্রান্ত ও বক্র পথে চলিয়া একদল মানুষ অভিশপ্ত এবং অন্য দল পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে। তাহাদের পথ হইতে মানুষকে সর্বদা দূরে থাকিতে হইবে। মানুষ তাহাদের পথ হইতে পরিত্রাণ লাভের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিবে। তাহাদের বিভ্রান্তির ফাঁদে জড়াইলে পারলৌকিক জীবনে যন্ত্রণাময় মহাশাস্তি মানুষের চিরসাথী হইবে। সুতরাং তাহাদের চক্রান্ত ও প্রতারণা হইতে মানুষকে সদা সতর্ক থাকিতে হইবে।
সূরা ফাতিহার কয়েকটি সূক্ষ্ম ও অনবদ্য শব্দ প্রয়োগ ধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
আল্লাহ্ তা’আলা الانعام ক্রিয়াটি কর্তৃবাচ্যে ব্যবহার করিয়া নিজেকে উহার কর্তা বানাইয়াছেন। পক্ষান্তরে الغضب ক্রিয়াটির কর্তা স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা হইলেও তিনি কর্তা হিসাবে নিজেকে উল্লেখ না করিয়া উক্ত ক্রিয়া হইতে কর্মবাচ্যের বিশেষণ (اسم مفعول) ব্যবহার করিয়াছেন। الغضب ক্রিয়াটির প্রকৃত কর্তা যে আল্লাহ্ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াতে তাহা বর্ণিত হইয়াছেঃ
ألم مر الى الَّدَيْنَ توَلّوًا قَوْما مضب الله عليهم “তুমি কি তাহাদের কথা ভাবিয়াছ, আল্লাহ্ যাহাদের প্রতি রুষ্ট হইয়াছেন তাহাদেরকে যাহারা বন্ধু বানাইয়াছে?”
আরেকটি উদাহরণ । যদিও আল্লাহ্ তা’আলাই মানুষকে পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী হওয়ার শক্তি যোগাইয়া থাকেন, তথাপি এখানে তিনি নিজেকে কর্তা হিসাবে উল্লেখ করিয়া الاضلال ক্রিয়াটি ব্যবহার করেন নাই। বরং মানুষকে কর্তা বানাইয়া الاضلال ক্রিয়া হইতে কর্তৃবাচ্যের বিশেষণ (أسم فاعل) ব্যবহার করিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলাই যে মানুষকে গোমরাহ হইবার শক্তি দান করেন নিম্নোক্ত আয়াতে তাহা বর্ণিত হইয়াছেঃ
مَنْ يَهْدِ اللهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ – وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُرْشِدًا
‘আল্লাহ্ যাহাকে সঠিক পথ দেখান সেই পথপ্রাপ্ত আর তিনি যাহাকে বিপথগামী করেন তাহার জন্য তুমি কোন দিশারী বন্ধু পাইবে না।’
অনুরূপ আরেকটি আয়াত এইঃ
من يُضلل اللَّهُ فَلاَ هَادى لَهُ وَيَدْرْهُمْ فئ طَعْيَانْهِمْ يَعْمَهُوْنَ “আল্লাহ্ যাহাদের পথভ্রষ্ট করেন, তাহাদের আর কোন পথ প্রদর্শক জোটে না। আর তিনি যাহাদের হাল ছাড়িয়া দেন, তাহারা স্বীয় অবাধ্যতার আবর্তে ঘুরপাক খাইয়া পেরেশান হইয়া ফিরে।”
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলি ছাড়া আরও একাধিক আয়াত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে হিদায়েতপ্রাপ্ত বা পথভ্রষ্ট করেন। القدرية সম্প্রদায় ও উহার অনুসারীগণ বলেনঃ বান্দা নিজেই হিদায়েত অথবা গোমরাহীর পথ গ্রহণ করিয়া থাকে। সে এক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীন।
কাদরিয়া সম্প্রদায়ের উপরোক্ত মতবিশ্বাস ভ্রান্ত ও বাতিল। তাহারা নিজেদের বিদআতী বিশ্বাসের সমর্থনে কুরআন মজীদের متشابه (দ্ব্যর্থবোধক) আয়াত পেশ করিয়া থাকে। অথচ যে সকল আয়াত দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাহাদের উক্ত বিশ্বাস ভ্রান্ত, তাহারা তাহা পরিত্যাগ করে। গোমরাহ ফির্কার অবস্থাই এইরূপ ৷
সহীহ হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘কোন দলকে কুরআনের ‘মুতাশাবাহা’ আয়াতের পশ্চাতে পড়িতে দেখিলে তোমরা বুঝিবে, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের কথাই (সূরা আলে-ইমরানে) বলিয়াছেন। অতএব তোমরা তাহাদের নিকট হইতে দূরে থাকিও।’
উক্ত আয়াতে রাসূল (সাঃ) নিম্নোক্ত আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছেনঃ
فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهُ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاء تلويله
“যাহাদের অন্তরে বক্রতা রহিয়াছে তাহারা ফিতনা সৃষ্টির জন্যে এবং ভ্রান্ত অর্থ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে উহার (মুতাশাবাহা আয়াতের) পশ্চাতে পড়িয়া যায়।”
আল্লাহ্ তা’আলার শোকর যে, কুরআন মজীদে বিদআতীদের আকীদা-বিশ্বাসের পক্ষে প্রকৃত কোন প্রমাণ বিদ্যমান নাই । কারণ, কুরআন মজীদ আসিয়াছে সত্য-মিথ্যা ও হক-বাতিল পৃথক করিয়া দিতে। উহাতে কোনরূপ স্ববিরোধিতার লেশমাত্র নাই। কারণ, উহা সর্বজন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী মহান আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হইতে অবতীর্ণ গ্ৰন্থ।
‘আমীন’ প্রসঙ্গ
ফাতিহা পাঠের শেষে امين (আমীন) বলা মুস্তাহাব। امين শব্দটি يس (য়্যা-সীন) শব্দের সমওজন বিশিষ্ট। উহার অর্থ-‘আয় আল্লাহ্ কবূল কর ৷’
কেহ কেহ উহার প্রথম বর্ণ أَ (হামযাহ)-এর পর আলিফ যোগ না করিয়া উহাকে امين রূপে পড়েন।
‘আমীন’ বলা যে মুস্তাহাব নিম্নোক্ত হাদীস হইতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত ওয়ায়েল ইব্ন হুজর (রাঃ) হইতে ইমাম আহমদ, ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত ওয়ায়েল ইব্ন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে غير المغضوب عليهم ولا الضالين পাঠের পর امين বলিতে শুনিয়াছি। তিনি আওয়াজ লম্বা করিয়া (مديها صوته) উহা পাঠ করিয়াছেন।
ইমাম আবূ দাউদের বর্ণনায় রহিয়াছে رفع بها صرته তিনি উচ্চস্বরে উহা পাঠ করিয়াছেন।
ইমাম তিরমিযীর মতে হাদীসটি حديث حسن অর্থাৎ বিশেষ বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য। হযরত আলী (কঃ), হযরত ইব্ন মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবা হইতেও উহা বর্ণিত হইয়াছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, ‘নবী করীম (সাঃ) عليهم ولا الضالين পাঠের পর বলিতেন أمين ‘আমীন’। প্রথম কাতারের মুসল্লীগণ উহা শুনিতে পাইতেন।’
ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম ইব্ন মাজাহ উহা বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম ইবন মাজাহ্ রিওয়ায়েতে ইহাও বর্ণিত হইয়াছে, ‘মসজিদে । শব্দের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইত।’ ইমাম দারা কুতনীও উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি উহাকে حديث حسن বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলিয়াছেন।
হযরত বিলাল (রাঃ) সম্বন্ধে বর্ণিত আছে, তিনি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিয়াছেন-‘আমার পূর্বে امين বলিবেন না।’ ইমাম আবূ দাউদ এই বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন।
আবু নসর কুশায়রী উল্লেখ করিয়াছেন-‘হযরত হাসান ও হযরত জা’ফর সাদেক امين শব্দের م বর্ণকে তাশদীদ দিয়া উহাকে أمين البيت الحرام আয়াতের অন্তর্গত أمين শব্দের ন্যায় উচ্চারণ করিতেন।’
আমাদের (ইব্ন কাছীরের) ফকীহগণ ও অন্য একদল ফকীহ বলেন- নামাযের বাহিরে ‘আমীন’ বলা মুস্তাহাব এবং নামাযের ভিতরে আমীন বলা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। মুসল্লী একাকী হউক কিংবা ইমাম হউক অথবা মুক্তাদী হউক-যে কোন অবস্থায় ‘আমীন’ বলা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। কারণ, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘ইমাম যখন আমীন বলে তখন তোমরাও আমীন বলিবে। কারণ, যাহার امين ফেরেশতাগণের আমীনের সহিত মিলিয়া যাইবে, তাহার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।’
ইমাম মুসলিমের বর্ণনায় রহিয়াছে-নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘যদি কেহ নামাযে বলে امين আর আকাশের ফেরেশতারাও বলেন, ‘আমীন’ এবং একটি অপরটির সহিত মিলিয়া যায়, তবে তাহার অতীতের গুনাহ মাফ হইয়া যায়।’
একদল বিশেষজ্ঞ ‘যদি ফেরেশতাদের আমীন বলার সহিত মুসল্লীর আমীন বলা মিলিয়া যায়’—এই বাক্যের এইরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেন, ‘যদি উভয়ের আমীন কবূল হইয়া যায় ৷
‘আরেকদল উহার এইরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘যদি উভয়ের امين ইখলাসপূর্ণ হয়।’
হযরত আবূ মূসা (রাঃ) হইতে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছেঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ইমাম যখন বলে, ولا الضالين তখন তোমরা বলিবে امين আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের উক্ত দোয়া কবুল করিবেন।’
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে যাহ্হাক ও যোয়াইবের বর্ণনা করেন-আমি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল ! امين শব্দের অর্থ কি? তিনি জবাবে বলিলেন—‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি উহা কবূল কর।’
জওহারী বলেন امين অর্থ ‘এইরূপ হউক।’ ইমাম তিরমিযী বলেন- امين অর্থ ‘আমাদিগকে নিরাশ করিও না।’
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলেন। امين অর্থ ‘আয় আল্লাহ্ ! আমাদের দোয়া কবূল কর।
ইমাম কুরতুবী উল্লেখ করিয়াছেন- ‘মুজাহিদ, ইমাম জা’ফর সাদেক এবং হিলাল ইব্ন ইয়াসাফ বলেন, امين শব্দটি আল্লাহ্ তা’আলার একটি নাম। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে অনুরূপ একটি বর্ণনা স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী حديث مرفوع হিসাবে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু আবূ বকর ইবনুল আরাবী উহাকে অশুদ্ধ ও অনির্ভরযোগ্য বলিয়াছেন। তাঁহার মতে উহা রাসূল (সাঃ)-এর বাণী নহে।
ইমাম মালিক (রঃ)-এর শিষ্যবর্গ বলেন-ইমাম ‘আমীন’ বলিবেন না, তবে মুক্তাদী ‘আমীন’ বলিবে। কারণ, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে যথাক্রমে আবূ সালেহ, সাম্মী ও ইমাম মালিক বর্ণনা করেন- “ইমাম যখন বলে ولا الضالين তখন তোমরা বলিবে امين
এতদ্ব্যতীত হযরত আবূ মূসা (রাঃ) হইতে মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছে-নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ইমাম যখন পড়িবে ولا الضالين তখন মুক্তাদিরা বলিবে امين
ইতিপূর্বে বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হাদীসের বর্ণনায় রহিয়াছেঃ ‘নবী করীম (সঃ) বলিয়াছেন, ইমাম যখন امين বলে, তোমরাও তখন امين বলিবে।’
ইতিপূর্বে উল্লিখিত অন্য বর্ণনায়ও রহিয়াছেঃ ‘নবী করীম (সাঃ) غير المغضوب عليهم ولا الضالين পাঠ করার পর امين বলিতেন।’
সরব নামাযে মুক্তাদী সরবে امين বলিবে, না নীরবে বলিবে, তাহা লইয়া আমাদের (শাফেঈ) মাযহাবের ফকীহদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। তাহাদের মতভেদের সারসংক্ষেপ এই যে, ইমাম যদি امين বলিতে ভুলিয়া যান, তাহা হইলে মুক্তাদী জোরে ‘আমীন’ বলিবে। ইহা আমাদের (শাফেঈ) মাযহাবের সর্বসম্মত অভিমত। ইমাম যদি জোরে ‘আমীন’ বলে, তাহা হইলে আমাদের মাযহাবের উত্তরসূরী ফকীহদের অভিমত অনুযায়ী মুক্তাদী আস্তে ‘আমীন’ বলিবে। ইহা ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এরও মাযহাব। ইমাম মালিক (রাঃ) হইতেও অনুরূপ একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।
উক্ত অভিমতের প্রবক্তাগণ বলেন- امين একটি যিকর। নামাযের মধ্যে অন্যান্য যিক্র যেরূপ জোরে পড়া হয় না, উহাও তেমনি জোরে পড়া হইবে না।
পক্ষান্তরে আমাদের (শাফেঈ) মাযহাবের পূর্বসূরীদের অভিমত এই যে, ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ই জোরে ‘আমীন’ বলিবে। ইহা ইমাম আহমদেরও মাযহাব। ইমাম মালিক (রঃ) হইতেও অনুরূপ একটি রিওয়ায়েত বর্ণিত হইয়াছে।
উক্ত অভিমতের প্রবক্তাগণ দলীল হিসাবে নিম্নোক্ত হাদীস পেশ করেনঃ
‘হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ইমাম ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেন, ‘নবী করীম (সাঃ) غير المغضوب علَيهم ولا الضَالِيُْنَ পাঠ করার পর امين বলিতেন এবং প্রথম কাতারের মুসল্লীগণ উহা শুনিতে পাইতেন। তখন উহা মসজিদে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইত।’
আমাদের (শাফেঈ) মাযহাবের ফকীহগণের তৃতীয় একটি অভিমত রহিয়াছে। উহা এই যে, মসজিদ ছোট হইলে মুক্তাদীগণ জোরে ‘আমীন’ বলিবে না। কারণ, সকল মুক্তাদীই ইমামের পাঠ শুনিতে পায়। কিন্তু মসজিদ বড় হইলে মুক্তাদীরাও জোরে ‘আমীন’ বলিবে যাহাতে মসজিদের সর্বত্র ‘আমীন’ শব্দের ধ্বনি পৌঁছিয়া যায়। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট ইয়াহুদী জাতির বিষয় উল্লেখ করা হইলে তিনি বলিলেন-আল্লাহ্ তা’আলা আমাদিগকে জুমআর নামাযের মত এক নি’আমাত দান করিয়াছেন যাহা হইতে ইয়াহুদীগণ বঞ্চিত রহিয়াছে। তিনি আমাদিগকে কিবলা দান করিয়াছেন যাহা হইতে তাহারা বঞ্চিত রহিয়াছে। ইয়াহুদীগণ আমাদের জুমআর নামায, আমাদের কিবলা ও ইমামের পিছনে আমাদের امين বলার প্রতি যতখানি ঈর্ষা পোষণ করে, ততখানি ঈর্ষা অন্য কিছুতেই পোষণ করে না।’
ইমাম ইব্ন মাজাহ্ অনুরূপ একটি রিওয়ায়েত বর্ণনা করিয়াছেন। উহা এইরূপঃ
“(নবী করীম (সাঃ) বলিলেন)-ইয়াহুদীগণ তোমাদের সালাম বিনিময় করা এবং امين বলার কারণে তোমাদের প্রতি যেরূপ ঈর্ষা পোষণ করে, সেরূপ ঈর্ষা আর কিছুতে পোষণ করে না।” হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ইমাম ইব্ন মাজাহ বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, তোমাদের। বলার কারণে ইয়াহুদীগণ তোমাদের প্রতি যেরূপ ঈর্ষা পোষণ করে সেরূপ ঈর্ষা অন্য কোন কারণে করে না। অতএব তোমরা বেশী করিয়া امين বল।’
উপরোক্ত রিওয়ায়েতের সনদে তালহা ইব্ন আমর একজন দুর্বল রাবী হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ইব্ন মারদুবিয়্যা বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- امين خاتم رب العالمين على عباده المؤمنين (‘আমীন’ হইতেছে মু’মিন বান্দাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার প্রদত্ত ‘মহর’।)
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আমাকে নামাযের মধ্যে ও (অন্যত্র) দোয়ার পরে বলার বিধান প্রদান করা হইয়াছে। আমার পূর্বে হযরত মূসা (আঃ) ব্যতীত অন্য কেহ উক্ত বিধান প্রাপ্ত হন নাই। মূসা (আঃ) দোয়া করিতেন আর হারূন (আঃ) امين বলিতেন। তোমরা দোয়ার পর امين বলিবে। ইহাতে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের দোয়া কবুল করিবেন।’
উপরোক্ত হাদীসের আলোকে কোন কোন বিশেষজ্ঞ নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা পরবর্তী বিষয় প্রমাণ করেনঃ
وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ أتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلاءَهُ زِيْنَةً وَأَمْوَالًا فِي الْحَيَوةِ الدُّنْيَا – رَبَّنَا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِكَ ، رَبَّنَا اطْمِسَ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوا حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الْآلِيمَ – قَالَ قَدْ أُجِيْبَتْ دَعْوَتُكُمَا فَاسْتَقِيْمَا وَلَا تَتبَّعَانِ سَبِيلَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ –
“মূসা বলিল-হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় তুমি ফিরআউন ও তাহার অনুসারীদের পার্থিব জীবনে ঐশ্বর্য ও আড়ম্বর দান করিয়াছ। হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু! তাহারা উহার বদৌলতে মানুষদিগকে তোমার পথ হইতে বিচ্যুত করিতেছে। হে আমাদের প্রতিপালক প্ৰভু ! তুমি তাহাদের ধন-সম্পদ ধ্বংস এবং তাহাদের অন্তর কঠিন কর, যাহাতে তাহারা আযাব না দেখা পর্যন্ত ঈমান না আনে। আল্লাহ্ বলিলেন, তোমাদের উভয়ের দোআ কবূল করা হইল ৷ এখন তোমরা অবিচল থাক এবং অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করিও না।”
উক্ত আয়াতের قال موسى দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়াটি করিয়াছিলেন হযরত মূসা (আঃ) একাই। অথচ আয়াতের قداجيبت دعوتكما অংশ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ পাকের দরবারে তাঁহারা উভয়ই দোয়া করিয়াছিলেন। ইহার সমন্বয় পাওয়া যায় পূর্বোক্ত হাদীসে। আয়াতের পরস্পর বিরোধীরূপে প্রতিভাত বিষয়টির যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা এই যে, আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়া পেশ করিয়াছেন হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত হারুন (আঃ) امين বলিয়া শরীক হইয়াছেন। এই কারণে তিনিও দোয়াকারীর অন্তর্ভুক্ত হইয়াছেন এবং আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা ‘তোমাদের উভয়ের দোয়া কবূল করা হইল’ বলিয়া উহার স্বীকৃতি প্রদান করিয়াছেন।
এতদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ পাকের দরবারে কেহ দোয়া করিতে থাকিলে যাহারা ‘আমীন’ বলে তাহারাও দোআকারীরূপে গণ্য হয়। অতএব মুক্তাদী ইমামের পেছনে ফাতিহা পড়িবে না। কারণ, তাহার امين বলাই ফাতিহা পাঠের স্থলাভিষিক্ত হইবে।
এই কারণেই হাদীসে বর্ণিত হইয়াছেঃ ‘যে ব্যক্তি মুক্তাদী হইয়া ইমামের পিছনে নামায পড়ে, ইমামের কিরাআতই তাহার কিরাআত বলিয়া গণ্য হইবে।’
উক্ত হাদীস ইমাম আহমদ (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে। হযরত বিলাল (রাঃ) বলিতেন——হে – আল্লাহর রাসূল ! আমার পূর্বে আপনি امين বলিবেন না।’
উপরোক্ত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সরব নামাযে কিরাআত পড়া মুক্তাদীর জন্য ফরয নহে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে যথাক্রমে কা’ব, ইব্ন আবূ সালীম, লায়ছ, জারীর, ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম, আবদুল্লাহ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন সালাম, আহমদ ইব্ন হাসান ও ইব্ন মারদুবিয়্যা বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ইমাম যদি غَيْر الْمَعْضوب علَيْهم ولا الضَالَِينَ বলিয়া امين বলে আর উহার সঙ্গে বিশ্ববাসী ও আকাশের বাসিন্দাদের امين মিলিয়া যায়, তাহা হইলে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার অতীতের গুনাহ মাফ করিয়া দেন। যে ব্যক্তি امين না বলে, তাহার অবস্থা সেই ব্যক্তির অবস্থার সমতুল্য, যে ব্যক্তি একটি দলের সহিত মিলিয়া যুদ্ধ করিয়া জয়ী হইল। অতঃপর দলের লোকেরা লটারী করিয়া প্রত্যেকের গনীমতের অংশ বুঝিয়া নিল। সে জিজ্ঞাসা করিল-আমার অংশ পাইলাম না কেন? উত্তর আসিল- তুমি امين বল নাই, তাই।
تمت بالخير
॥ সূরা ফাতিহার তাফসীর সমাপ্ত ॥