“কলি যুগে তন্ত্র সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনা”—এই বক্তব্য বহু আধুনিক তন্ত্রগ্রন্থের শুরুর কথা। শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ-এর ‘বৃহৎ তন্ত্রসারঃ’ গ্রন্থটি তন্ত্র-পণ্ডিতদের কাছে আকরগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। গ্রন্থটির ভূমিকাতেই বলা হয়েছে, “সর্বশাস্ত্র অপেক্ষা তন্ত্রশাস্ত্র শ্রেষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ। মৎস্যসূক্তে লিখিত আছে—যেরূপ দেবতাদিগের মধ্যে বিষ্ণু, হ্রদের মধ্যে সমুদ্র, নদীর মধ্যে গঙ্গা, পর্বতের মধ্যে হিমালয়, বৃক্ষের মধ্যে অশ্বত্থ, রাজার মধ্যে ইন্দ্র, দেবীর মধ্যে দুর্গা, বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, তদ্রূপ সর্ব্ব শাস্ত্রের মধ্যে তন্ত্র শাস্ত্র প্রধান।”

 

তন্ত্র গুরুমুখী শাস্ত্র

‘বৃহৎ তন্ত্রসারঃ’-এর শুরু এ’ভাবে, “গুরুপদেশ ভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রবিহিত ক্রিয়াকলাপ কোন ফলপ্রদ হয় না।”

গুরুর কোনও জাত-বিচার, কূল-বিচার, বর্ণ-বিচার, নারী-পুরুষ বিচার নেই। হাড়ি, মুচি, ডোম, রজকী, নটী, বেশ্যা যে কেউ তন্ত্রগুরু হতে পারেন।

বৈশম্পায়ন সংহিতায় বলা হয়েছে—অপুত্রক, মৃতপুত্রক, কুষ্ঠরোগী ও বামন’কে গুরু হিসেবে স্বীকার করা উচিত নয়।

যোগিনীতন্ত্রে লেখা আছে—পিতা, মাতামহ, কনিষ্ঠ সহোদর ও শত্রুপক্ষের কারও কাছে দীক্ষিত হওয়া শাস্ত্র সিদ্ধ নয়।

মৎস্যসূক্তেও বলা হয়েছে—পিতার মন্ত্র নিবীর্য। পিতার কাছে দীক্ষা নিয়ে সেই মন্ত্রে জপ-পূজা করলে কোনও ফল হয় না। তবে নিজ কুলতিলক হিসেবে বড় জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পিতা দীক্ষা দিলে কোনও দোষ হয় না।

যোগিনীতন্ত্রে বলা হয়েছে, নারীর কাছে দীক্ষা নিলে শুভ ফল হয়। মা’য়ের কাছে দীক্ষায় অষ্টগুণ ফল লাভ হয়।

বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রে বিরোধীতার শেষ নেই। তবে একটি বিষয়ে সব্বাই এককাট্টা, তন্ত্র গুরুমুখী শাস্ত্র। গুরু বিনা তন্ত্র সাধনা হয় না।

 

দীক্ষামাস নির্ণয়

বৃহৎ তন্ত্রসারঃ অনুসারে দীক্ষামাস ঠিক করতে হয় যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে বৃহৎ তন্ত্রসারের বক্তব্য, “চৈত্র মাসে মন্ত্র পুরুষার্থ সিদ্ধি হয়, বৈশাখে রত্নলাভ, জ্যৈষ্ঠে মরণ, আষাঢ়ে বন্ধুনাশ, শ্রাবণে দীর্ঘায়ু, ভাদ্রমাসে সন্তাননাশ, আশ্বিনে রত্নসঞ্চয়, কার্ত্তিকে ও অগ্রহায়ণে মন্ত্রসিদ্ধি, পৌষ মাসে শত্রুবৃদ্ধি ও পীড়া, মাঘমাসে মেধাবৃদ্ধি ও ফাল্গুন মাসে মন্ত্র গ্রহণে সকল মনোরথ পূর্ণ হয়। এই রূপে মাসের গুণাগুণ বিবেচনা করিয়া মন্ত্র গ্রহণ করা বিধেয়, পরন্তু বিহিত মাসও যদি মলমাস হয়, তবে তাহা বর্জন করিবে। চৈত্র মাসে যে দীক্ষা উক্ত হইল তাহা গোপাল বিষয়ে জানিবে। চৈত্র মাসে মন্ত্র গ্রহণ করিলে দুঃখ ভোগ ও মরণ হইয়া থাকে ; এইরূপ গ্রহান্তরে লিখিত আছে। অতএব চৈত্র মাসে কেবল গোপাল মন্ত্র গ্রহণ করিতে পারিবে, অন্য দেবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হইতে পারিবে না। আষাঢ় মাসে মন্ত্র গ্রহণ করিলে বন্ধুনাশ হয়, এইরূপ যে লিখিত হইয়াছে তাহা সকল দেবতার পক্ষে নহে, “আষাঢ়ে মন্ত্র গ্রহণ করিলে সুখ ও সম্পদ হয়” যোগিনী হৃদয়ের এই বচন বলে আষাঢ় মাসে শ্রীবিদ্যার মন্ত্রে দীক্ষিত হইতে পারে। দীক্ষা বিষয়ে যে সকল মাসের দোষাদোষ লিখিত হইল, তাহা সৌর মাসে জানিবে। দীক্ষাতে সৌর মাসই প্রশস্ত, চান্দ্র মাসগ্রহণ করিবে না। বৈশম্পায়ন সংহিতায়ও এইরূপ মাসের নির্ণয় লিখিত আছে।”

এখানেই অবশ্য সব শেষ নয়। এর পরও আছে বার, তিথি ও নক্ষত্র নির্ণয়ের নানা নিয়ম-কানুন। যতই নিয়ম-কানুনের ফ্যাকড়া বাড়ে, ততই ব্রাহ্মণদের উপর নির্ভরতা বাড়ে, গুরুর উপর নির্ভরতা বাড়ে।

 

আগম, নিগম ও যামল

শৈব ও শাক্ত তন্ত্র মতে শিব ও শক্তি থেকেই সকল তন্ত্রের সৃষ্টি। তন্ত্রশাস্ত্রগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত। (১) আগম—-শিবের পঞ্চ-মুখে বলা তন্ত্রই হল ‘আগম’। (২) নিগম—শক্তির নিজের মুখে বলা তন্ত্র পদ্ধতি-ই হল ‘নিগম’।

বেদের যেমন ‘ব্রাহ্মণ’ গ্রন্থসমূহ আছে, তেমন-ই ‘আগম’ ও ‘নিগম’-এর ‘ব্রাহ্মণগ্রন্থ’ হল ‘যামল’।

‘তন্ত্রতত্ত্ব’ গ্ৰন্থ বলছে—“শিব বা সদাশিবের পাঁচটি মুখ থেকে বিভিন্ন তন্ত্রের সৃষ্টি বা বিকাশ হয়েছিল ও সে তন্ত্রগুলির নাম ‘আগম’। পূর্বেই বলেছি, যে তন্ত্রগুলির বিকাশ হয়েছিল শক্তি বা পার্বতীর মুখ থেকে সেগুলি নিগমের অন্তর্গত। সদাশিবের পাঁচটি মুখ— (১) সদ্যোজাত— পূর্বমুখ। এই সদ্যোজাতমুখ দিয়ে যে সকল তন্ত্ৰ ব্যাখ্যা (বা সৃষ্টি) করেছেন শিব তাদের নাম ‘পূর্বান্নায়’, (২) দ্বিতীয় অঘোর—দক্ষিণ মুখ ; সুতরাং অঘোর-মুখে যে সকল তন্ত্র ব্যাখ্যা ও প্রকাশ করেছেন শিব তাদের নাম ‘দক্ষিণান্নায়’, (৩) তৃতীয় তৎপুরুষ—পশ্চিম মুখ ; সুতরাং তৎপুরুষ-মুখ থেকে যে সকল তন্ত্র নিঃসৃত হয়েছিল তাদের নাম ‘পশ্চিমান্নায়’ ; (৪) চতুর্থ মুখের নাম বামদেব—উত্তর মুখ, সুতরাং বামদেব থেকে যে সকল তন্ত্রের বিকাশ হয়েছিল তাদের নাম ‘উত্তরান্নায়’ ; (৫) ঈশান—ঊর্ধ্বমুখ, সুতরাং ঈশান থেকে যে সকল তন্ত্রশাস্ত্র নিঃশাস্ত্র নিঃসৃত হয়েছিল তাদের নাম ‘ঊর্ধ্বান্নায়।”

যামলের ছটি ভাগ। (১) শ্রীযামল, (২) বিষ্ণুযামল, (৩) শক্তিযামল, (৪) ব্রহ্মযামল, (৬) রুদ্রযামল। বিভিন্ন তন্ত্রগ্রন্থগুলোতে এই ছটি ভাগের কথা থাকলেও বরাহীতন্ত্র মতে ‘যামল’ ছটি ভাগে বিভক্ত। ভাগগুলো হল (১) আদিত্যযামল, (২) ব্রহ্মযামল, (৩) বিষ্ণুযামল, (৪) ব্রুদ্রযামল, (৫) গণেশযামল বা শ্রীযামল। রুদ্রযামলে ষষ্ঠচক্র ও চক্রভেদের পথ নির্দেশ রয়েছে।

বরাহীতন্ত্র মতে আগম বারোটি। (১) মুক্তক, (২) প্রপঞ্চ, (৩) সারদা, (৪) নারদ, (৫) মহার্ণব, (৬) কপিল, (৭) যোগ, (৮) কল্প, (৯) কপিঞ্জল, (১০) অমৃতশুদ্ধি, (১১) সিদ্ধসম্বরণ।

আসলে যত তন্ত্র, তত মত। যত মত, তত দল। যত দল, তত কোন্দল।

এটা শুধু তন্ত্রের বেলায় নয়, সব উপাসনা-ধর্মেই একই ব্যাপার।

অভ্যন্তরীণ দলাদলি, ধর্মে-ধর্মে বিবাদ, হিংসা, হত্যা-

এই নিয়েই উপাসনা-ধর্মের সংস্কৃতি।

 

শক্তিতান্ত্রিক সম্প্রদায়

ভারতে শক্তি তন্ত্রসাধনার তিনটি প্রধান সম্প্রদায় বা ঘরানায় বিভক্ত। সম্প্রদায় বা ঘরানাগুলো হল (১) বঙ্গীয় বা গৌড়ীয় ঘরানা, (২) কাশ্মিরীয় সম্প্রদায় বা ঘরানা, (৩) দক্ষিণ ভারতীয় সম্প্রদায় বা ঘরানা।

বঙ্গীয় ঘরানা হল দশমহাবিদ্যা নির্ভর তন্ত্র। কাশ্মিরীয় সম্প্রদায় বা ঘরানার শক্তি শ্রীসারদা। শ্রীসারদাই তাঁদের উপাস্য ও তন্ত্রদেবী। কাশ্মিরীয় তন্ত্রশাস্ত্র ‘দৰ্শন’ নামেই তান্ত্রিকদের কাছে বেশি পরিচিত। এই সব দর্শনের নাম ‘ত্রিকদর্শন’। জীব-শিব- বিমর্শ এই তিন তত্ত্বের বিশ্লেষণ করে শিব-শক্তি-সাম্যরস লাভ করে তন্ত্রসাধকরা কৃতকৃতার্থ হন। সাম্যরসানুভূতির অর্থ শিব-শক্তির মিলনরসানুভূতি। দক্ষিণ ভারতের তান্ত্রিক ঘরানার শক্তি হলেন ত্রিপুরাসুন্দরী শ্রীবিদ্যা বা ললিতাদেবী।

 

বঙ্গীয় ঘরানা

গৌড়ীয় শক্তিন্ত্রের দশমহাবিদ্যা হলেন—(১) কালী, (২) তারা, (৩) ষোড়শী, (৪) ভুবনেশ্বরী, (৫) ভৈরবী, (৬) ছিন্নমস্তা, (৭) ধূমাবতী, (৮) বগলা, (৯) মাতঙ্গী, (১০) কমলা ।

 

বঙ্গীয় তন্ত্রশাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য রচনা

গৌড়ীয় তন্ত্রশাস্ত্রের কিছু উল্লেখযোগ্য নাম—কৌলাবলী, গান্ধর্ব, সারদাতিলক, কুলার্ণব, ফেৎকারিণী, সনৎকুমার, মহাচীনাচার, কামাখ্যা, গুপ্তসাধন, মাতৃকাভেদ, তারারহস্য, গায়ত্রী, গৌতমীয়, মহানির্বাণ, শ্যামারহস্য, ত্রিপুরাসারসমুচ্চয়, উড্ডামরেশ্বর, নিরুত্তর, কামধেনু, কঙ্কালমালিনী, নীলতন্ত্র, নির্বাণ, বৃহন্নীল, রুদ্রযামল, যোগিনী, যোগিনীহৃদয়, শাক্তানন্দতরঙ্গিণী, তন্ত্ররাজ, প্রভৃতি। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয়ের ‘তান্ত্রিক-সাহিত্য’ এবং শ্রীমৎ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মহাশয়ের ‘বৃহৎ তন্ত্রসারঃ’ পরবর্তী সময়ে রচিত হলেও তন্ত্রশাস্ত্রের অতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

 

কাশ্মিরীয় ঘরানা

কাশ্মিরীয় ঘরানার তন্ত্র ত্রিকদর্শনের তিনটি ভাগ। (১) আগমশাস্ত্র, (২) স্পন্দশাস্ত্র, (৩) প্রত্যভিজ্ঞাশাস্ত্র। আগমশাস্ত্রে আছে জ্ঞান ও তন্ত্রক্রিয়া। স্পন্দশাস্ত্রে আছে শাস্ত্রকারিকা। প্রত্যভিজ্ঞাশাস্ত্রে রয়েছে মনন ও বিচার। এইসব শাস্ত্রে শক্তি প্রবলভাবে থাকলেও শিবও আছেন। তবে শক্তিকে বাদ দিলে শিব শব। কাশ্মিরীয় ঘরানার উপাস্য শক্তি শ্রীসারদাদেবী।

এই ঘরানা অনুসারে বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টির কারণ শিব-শক্তি। এই শক্তি শিবের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা নয়। তবে এও ঠিক, শক্তির প্রকাশেই জ্ঞানের প্রকাশ । শক্তির যোগান বন্ধ হলেই জীবের মৃত্যু, জড়ের ধ্বংস। শক্তি রুদ্ধ হলে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের দিন শেষ হবে। সৃষ্টি ও প্রলয়—এই দু’য়ের কারণ শক্তি শ্রীসারদা ও শিব। সৃষ্টি ও প্রলয় বিশ্ব জুড়ে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এ’সবই শিব-শক্তির লীলা। এই লীলার আদি নেই, অন্ত নেই ।

কাশ্মিরীয় ত্রিকদর্শন বা ত্রিকতন্ত্র গ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। কাশ্মির সরকার সংস্কৃত ভাষায় ষাটের ওপর তন্ত্রগ্রন্থ প্রকাশ করেছে।

 

দক্ষিণীয় ঘরানা

দক্ষিণ ভারতীয় শক্তি তত্ত্বে জীব-ঈশ্বর-মায়া এই তিনের সত্তাকে স্বীকার করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় শৈবতন্ত্রের ও শাক্ততন্ত্রের আচরণবিধি, পূজাপদ্ধতি, তন্ত্র- পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। দক্ষিণে ত্রিপুরাসুন্দরী কামেশ্বরী, ষোড়শী, শ্রীবিদ্যা, ললিতা ইত্যাদি নামে পূজিতা হন। এঁরা শক্তির-ই বিভিন্ন রূপ। ‘বৃহৎ তন্ত্রসারঃ’ গ্রন্থে ত্রিপুরাদেবীর ধ্যান মন্ত্রে শক্তিরূপিনী মা’র যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা সংস্কৃতে। বাংলা করলে দাঁড়ায়—দেবী ষোড়শী, জবা ফুলকে হারিয়ে দেওয়ার মত লাল গায়ের রং। স্তনের উপর মুক্তাহার শোভা পাচ্ছে। নদীর লাবণ্যময়-আবর্তের মতো নাভিমণ্ডল। কলাগাছের মতো সুকুমার উরুদ্বয়। অতিমনোহর জঙ্ঘাযুগল। বেশভূষা সর্বপ্রকারে শৃঙ্গারের উপযোগী।

কোনও সন্তান মা’র শরীর নিয়ে এমন ধ্যান করলে তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। মুশকিল হল, সব দেবীর প্রার্থনায় ধ্যানে আমরা তান্ত্রিক হিসাবে তাঁদের শরীর নিয়ে কুরুচিকর চিন্তায় ডুবে থাকি। না-বোঝা ভাষায় যখন মন্ত্রগুলো বলে যাই, তখন ভাবি, দারুণ কিছু মন্ত্র বলছি।

দক্ষিণী শক্তি তন্ত্রে বলা হয়েছে, ধ্যান শেষে মনকে নর্তক করে শৃঙ্গারাদি ইত্যাদি তালসহ নৃত্য, গীত ও বাদ্যযন্ত্রদ্বারা দেবীকে সন্তুষ্ট করতে হবে। অনন্তর নিজের শরীরে শক্তিকে নিয়ে কামকলা ভাবনা করবে। (বুঝুন কাণ্ড, এ’বার মা’কে নিয়ে কামকলা ভাবনা?)

দক্ষিণী শক্তি তত্ত্ব অনুসারে সৃষ্টির যত সৌন্দর্য

সবই কামজ। কামজ-মিলন তাই সুন্দর।

দক্ষিণের শৈব ও শাক্ত তান্ত্রিকদের সম্পর্ক মৈত্রীর।

 

দশমহাবিদ্যা

বঙ্গীয় তন্ত্র সাধনা দশমহাবিদ্যা নির্ভর তন্ত্র—এ’কথা আগেই বলা হয়েছে। এই দশমহাবিদ্যা হলেন, (১) কালী, (২) তারা, (৩) ষোড়শী, ইত্যাদি, যা একটু আগেই বলেছি।

এই ষোড়শীই দক্ষিণের শাক্তদের শক্তিরূপী ষোড়শী, যার অন্যান্য নাম—শ্রীবিদ্যা, ললিতা, ত্রিপুরসুন্দরী ইত্যাদি। এই ষোড়শীর চার বা ষোল হাত আমরা দেখতে পাই ।

দশ মহাবিদ্যার নয় শক্তির নয়জন শিব আছেন। ধূমাবতীর কোনও শিব নেই। কালীর শিব মহাকাল, তারার অক্ষোভ্য, ষোড়শীর পঞ্চবকত্রশিব, ভুবনেশ্বরীর ত্র্যম্বক, ছিন্নমস্তার কবন্ধ, ভৈরবীর দক্ষিণমূর্তি কালভৈরব, বগলার একবকত্রশিব, মাতঙ্গীর মাতঙ্গ, কমলার সদাশিববিষ্ণু ।

বঙ্গে মাটির কালী প্রতিমার আবির্ভাব বিশিষ্ট তন্ত্র-পণ্ডিত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘তন্ত্র পরিচয়’ গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, এখন যে ধরনের মাটির কালীমূর্তি তৈরি করিয়ে পুজো করা হয়, ঐ ভাবের কালী মূর্তি পুজো কৃষ্ণানন্দ আলমবাগীশই এই দেশে প্রথম প্রচলন করেন। তিনি নিজের হাতে মূর্তি গড়ে প্রতি অমাবস্যায় পুজো করতেন এবং পুজো শেষে মূর্তি নিজের মাথায় বহন করে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসতেন। আলমবাগীশের এই ধরনের পুজোর আগে বঙ্গদেশে কালী পুজো হত মন্ত্রে, তন্ত্রে, ঘটে, অথবা সিদ্ধ সাধকের পীঠস্থানে। কোন কোনও ক্ষেত্রে তন্ত্র মতে কালী পুজোয় সর্বসুলক্ষণসম্পন্না শ্যামা সুন্দরীকে এনে তাকেই কালী জ্ঞানে পুজো করতো।

 

নারীকে শক্তিজ্ঞানে পুজো-বিধি ও মৈথুন

বৃহৎ তন্ত্রসারঃ-এ বলা হয়েছে সর্বসুলক্ষণা রমণীকে রমণেই শিবশক্তির

মিলন ঘটে। শিবশক্তির মিলনের নাম-ই ‘যোগ’। এই মিলন-ই

তন্ত্র-সাধনা। “এস্থলে শীৎকারই মন্ত্রজপ ; বাক্যই স্তব ;

আলিঙ্গনই কস্তুরী ; চুম্বনই কর্পূর ; নখক্ষত,

দন্তক্ষত প্রভৃতিই বহুবিধ পুষ্প; মৈথুনই

তর্পণঃ বীর্যপাতই বিসর্জ্জন।”

(পৃষ্ঠা-৭০২)

‘কুলার্নব’ বিখ্যাত তন্ত্রগ্রন্থ। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, আলিঙ্গন, চুম্বন, স্তনমৰ্দ্দন, দর্শন, স্পর্শন যোনিবিকাশ, লিঙ্গঘর্ষণ, প্রবেশ, স্থাপন ও এই নববিধ পুষ্পদ্বারা শক্তির পূজা করিবে।”

জ্ঞানার্ণবে আরও বলা হয়েছে, “এই আমি তোমার নিকট সমুদয় জ্ঞানের বিষয় কহিলাম। এ’বিষয়ে সন্দিহান হইলে মনুষ্য পাপভোগী হইবে। যে ব্যক্তি সন্দেহ করিবে, সে গুরুতল্পগামীর ন্যায় মহাপাতক হইবে। অতএব মহেশ্বরি! অসন্দিহান চিত্তে এই সমুদয় সাধন করিবে।” (ঐ গ্রন্থের ৭০৩ পৃষ্টায়)

বৃহৎ তন্ত্রসারঃ ও কুলচূড়ামণিতে বলা হয়েছে, সুলক্ষণা রমণীকে কেশচর্চা করিয়ে দিয়ে, সুসজ্জিতা করিয়ে, ভোজন করিয়ে, পান খেতে দেবে। তারপর গন্ধচন্দনচর্চ্চিত ফুলের মালা পরিয়ে রমণীকে প্রদক্ষিণ করে মন্ত্রসিদ্ধি প্রার্থনা করবে। এবার নিজে শিব জ্ঞানে বিবস্ত্র হবে এবং নারীকে শক্তি জ্ঞানে বিবস্ত্রা করে শিবশক্তির মিলন ঘটাবে। এই মিলন আনন্দময়।

তন্ত্র বলছে, শক্তিপূজার জন্য অন্য নারী না পেলে নিজের মা, বিমাতা,

ছোট বা বড় বোন, মামী বা মেয়েকে শক্তি জ্ঞানে পুজো

করে শিব জ্ঞানে তার সঙ্গে মিলিত হবে।

 

নারীশক্তি বিষয়ে তন্ত্রের সাবধান-বাণী

বৃহৎ তন্ত্রসারঃ অনুসারে নারী-শক্তির কোনও জাত-কূল নেই। যাকে কুল নায়িকা ও শক্তি হিসেবে গ্রহণ করবে সে নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রজককন্যা, নাপিতকন্যা, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা, মালকারকন্যা হলেও কোনও ব্যাপার নয়। এ’টাই শুধু দেখতে হবে, সে যেন রূপযৌবনবতী হয়।

এইসব শ্রমজীবী মহিলারা উচ্চবর্ণ পরিবারের গৃহবধূদের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী ছিল। তাদের দৈহিক সৌন্দর্যকে ভোগ করার ইচ্ছে থেকেই জাদু-পুরোহিতরা এইসব বর্ণের রমণীদের রমণসঙ্গিনী করতে তন্ত্রে নারীদের জাত-কূলের বিচার তুলে দিয়েছিল। কিন্তু পুরুষদের বেলায় বর্ণপ্রথা, শূদ্র-অদ্ভুত ইত্যাদি ভেদাভেদ পুরোপুরি বজায় রেখেছিল। তারা যে তন্ত্রের নামে নারীদের সুন্দর দেহকে ভোগ করার জন্যেই ভণ্ডামীর আশ্রয় নিয়েছিল, এমন ধারণা আরও জোরদার হয় যখন দেখি, ওই তন্ত্রগ্রন্থেই বলা হচ্ছে বৃদ্ধা, কুৎসিৎ, সন্দিগ্ধচিত্তা, প্রত্যাখ্যানপরায়ণা রমণীকে ‘শক্তি’ করবে না। এই শিব-শক্তির মিলনের তন্ত্র-প্রক্রিয়া নির্জন জায়গায় করবে। দেখবে যাতে লোকসমক্ষে তা প্রচারিত না হয়।

মেধা আর ভণ্ডামীর যুগলবন্দি থেকেই যে নারী-পুরুষের সহজ

স্বাভাবিক সম্পর্কের এমন বিকৃতি ঘটেছিল এ বিষয়ে

সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

 

তন্ত্র-সাধনার সাত আচার

ভারতীয় উপাসনা-ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সিদ্ধির সাফল্যহীন কোনও ধর্ম, ধর্মের মর্যাদা পায়নি। তন্ত্র-সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি-লাভ করা সম্ভব। তাই তন্ত্র-সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনায় জায়গা দখল করে নিয়েছে।

তন্ত্রে সাতটি পদ্ধতির উপাসনা ও আচার আছে। যেমন—(১) বীরাচার, (২) পার্শ্বাচার, (৩) বামাচার, (৪) চীনাচার, (৫) দক্ষিণাচার, (৬) সময়াচার, (৭) কুলাচার । বীরাচার, বামাচার, চীনাচার ও কুলাচার এই চার আচার সাধনে পঞ্চম কার, কুলচক্রভেদ, শব সাধনা ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে। তন্ত্র গ্রন্থগুলোতে এই চার ধারাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয় ।

সময়াচারী তান্ত্রিকরা ‘সময়’কে শিব ও ‘সময়া’কে শক্তি মনে করে ‘মানসপূজা’ করে। ‘মানসপূজা’অর্থে মনে মনে পঞ্চমকারের পূজা। তন্ত্রপণ্ডিত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘তন্ত্র পরিচয়’ গ্রন্থে বলছেন, “মনে মনে কল্পনা করিতে হইবে যে আমি সাধক দেবীকে সুরার সাগর, মাংসের পর্বত, মৎস্যের স্তূপ, মুদ্রার সম্ভার দিতেছি এবং পদ্মিনী নারীর সহিত মৈথুন সাহায্যে কুণ্ডলিনীকে জাগরিতা করিতেছি অর্থাৎ সোজা কথায় নারীর পরিবর্তে স্বমৈথুনের সাহায্যে তন্ত্র সাধন পদ্ধতি হল ‘সময়াচার’।

 

পঞ্চম’কার সাধনা

মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পাঁচটি শব্দই ‘ম’ অক্ষর দিয়ে শুরু। এই পাঁচটি দ্রব্য ও বিষয়কে নিয়ে সাধনাই ‘পঞ্চম’কার’ সাধনা হিসেবে খ্যাত। এই হল তন্ত্র সাধনার ‘পঞ্চম’কার তত্ত্ব বা ‘পঞ্চ তত্ত্ব’। তন্ত্রসাধনায় এ’সবের স্থূল প্রয়োগই করা হয়ে থাকে।

তন্ত্র মতে মদ বা সুরা অমৃত। সুরা তাই দেবভোগ্য। তন্ত্রে সুরার গুণগান গেয়ে বলা হয়েছে, সুরা কামজভাব বৃদ্ধি করে। ব্যথা, যন্ত্রণা ও পাপাশঙ্কা দূর করে। তন্ত্রে আট ধরনের পশুর মাংস গ্রহণের বিধি আছে। যেমন—গোমাংস, মেষমাংস, অশ্বমাংস, মহিষমাংস, গোধামাংস (গোসাপমাংস), ছাগমাংস, উষ্ট্রমাংস ও মৃগমাংস (বৃহৎ তন্ত্রসারঃ, পৃষ্ঠা ৬৯৮)।

মাছের মধ্যে তিন রকমের মাছকে তন্ত্রে উত্তম বলা হয়েছে। (১) শাল, (২) পাঠীন (বোয়াল), (৩) রোহিত। অথবা কাঁটাহীন মাছকে ‘উত্তম মৎস্য’ বলা যায়। যে মৎস্য তৈলাক্ত ও গ্রন্থিযুক্ত, তাকে বলে মধ্যম মৎস্য। এই ধরনের মৎস্য তান্ত্রিক তার সাধনায় লাগাতে পারে। কিন্তু ছোট এবং কাঁটাভর্তি মাছ অধম মৎস্য। এই মাছ তান্ত্রিকের ভোগে লাগানো উচিত নয়।

‘মুদ্রা’ বলতে তন্ত্রে দু-ধরনের মুদ্রার কথাই আছে। (১) স্বর্ণ বা রোপ্য, অথবা চিবিয়ে খেতে হয় এমন খাদ্যকে মুদ্রা বলে, যেমন চিঁড়ে, মুড়ি, খই ইত্যাদি। (২) ভঙ্গিমা, নানা মৈথুন ভঙ্গি।

যে শক্তির দ্বারা সৃষ্টির বিস্তার হয়, তাকেই বলে ‘আদি রস’। আদি রসের সাহায্যে যে সাধনা তা-ই শ্রেষ্ঠ সাধনা, তা-ই মৈথুন সাধনাকে শ্রেষ্ঠ সাধনা মনে করে তন্ত্র। বিশ্বসৃষ্টির যত সৌন্দর্য, যত আনন্দ—সবই কামজ, সবই মৈথুন-তত্ত্ব নির্ভর। মৈথুনেই ষটচক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রপদ্মের পাপড়ি খোলা যায়। তন্ত্র নিজের দেহস্থ আত্মা ছাড়া কোনও বাইরের শক্তিতে বিশ্বাস করে না।

একমাত্র মৈথুনের সাহায্যেই দেহের আত্মাকে ও

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি তত্ত্বকে জানা যায়।

দেহ-সাধনার জন্যে স্ত্রী থাকলেও অন্য নারীকে সাধনসঙ্গিনী করার বিধান তন্ত্রে আছে। এ’ধরনের সাধনসঙ্গিনী যে কোনও সুন্দরী নারীকেই করা যেতে পারে। এ’খানে নারীর সঙ্গে সম্পর্ক বা নারীর জাত-কুল ইত্যাদি বিবেচনার প্রয়োজন নেই। এ’বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি।

 

কুমারী পুজো ও ‘রজঃ’

প্রাচীন আমলে একটা বিশ্বাস বহু দেশেই প্রচলিত ছিল—পুরুষের ‘শুক্র’ ও নারীর ‘রজঃ’ মিলিত হয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। গোটা ধারণাটাই ভুল। শুক্র থাকলেই প্রজনন ক্ষমতা থাকবে—এমন ধারণা ঠিক নয়। প্রজননের ক্ষেত্রে শুক্রকীটের ভূমিকা রয়েছে। সাধারণভাবে একজন সুস্থ-সবল পুরুষ প্রতিবার সঙ্গমে ১০০ মিলিয়ন থেকে ৪০০ মিলিয়ন শুক্রকীট শুক্রের বা বীর্যের সঙ্গে বের করে দেয়। এক মিলিয়ন হচ্ছে ১০ লক্ষ। বীর্যে শুক্রকীটের পরিমান খুব কম হলে সেই বীর্য প্রজননে অক্ষম হয়।

দেহ-মিলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে শুক্রকীটগুলো নারীর ডিম্বকোষের দিকে ছুটতে থাকে। শুক্রকীটগুলো আবার সবাই সমান সবল হয় না। কোন্ শুক্রকীটটি ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হবে, তা নির্ভর করে শুক্রকীটের মাথার তীক্ষ্ণতা ও দৌড়ে এগিয়ে থাকার উপর। শেষ পর্যন্ত বলিষ্ঠ, তীক্ষ্ণ মাথার এগিয়ে থাকা শুক্রকীট ডিম্বকোষের গায়ে আঘাত করে ডিম্বকোষ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যায়। নারী-পুরুষের ডিম্বকোষ ও শুক্রকীটের মিলনে শুরু হয় নতুন জীবনের স্পন্দন। শুরু হয় কোষ বিভাজন । দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এ’ভাবে হাজার, লাখ …। সাত দিনের মাথায় কোষ-সমষ্টি জরায়ুর সংযোগনল বা ফ্যালোপিয়ন টিউব থেকে জরায়ুতে এসে ডেরা বাঁধে। একটু একটু করে তৈরি হতে থাকে শিশু।

রজঃ বা ঋতুস্রাবের সঙ্গে বীর্যের মিলনে প্রজননের কোনও সম্পর্ক নেই। রজঃ ডিম্বকোষের মৃত্যু ঘোষণা করে। সাধারণভাবে একটি ঋতুবতী নারীর ‘ওভারি’ বা ডিম্বগ্রন্থির মধ্যে অনেকগুলো ওভাম বা ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। তারপর শুরু হয় ডিম্বকোষগুলোর মধ্যে যুদ্ধ। যুদ্ধে জয়ী বলিষ্ঠতমা ডিম্বকোষ ডিম্বগ্রন্থি থেকে বেরিয়ে জরায়ুর সংযোগনলে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রতিটি ঋতুচক্রে এভাবে ডিম্বকোষ অপেক্ষা করে। কোনও শুক্রকীট তার ভিতর প্রবেশ না করলে ঋতুস্রাবের মধ্যে দিয়ে ডিম্বকোষটির মৃত্যু ঘটে।

বিজ্ঞানের এই পরীক্ষিত সত্যকে মেনে না নিয়ে আজও তন্ত্র বিশ্বাস করে রজঃ-ই হল ‘স্ত্রী-বীজ’, এবং শুক্র ‘পুরুষ বীজ’। দুয়ের মিলনে সৃষ্টি।

তন্ত্র রজঃকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তন্ত্রের ভাষায় রজঃ হল রক্তচন্দন বা খপুষ্প (আকাশের ফুল)। খপুষ্প দেবী শক্তির কাছে অতি পবিত্ৰ । সবচেয়ে পবিত্র হল অক্ষতযোনি কিশোরী বা কুমারীর প্রথম রজঃ। আর সবচেয়ে পবিত্র কাজ হল—প্রথম রজঃস্বলা কুমারীকে শক্তি জ্ঞানে পুজো করে শিব জ্ঞানে তার সঙ্গে মিলিত হওয়া।

সব নারী-ই শক্তিস্বরূপা। তবে কুমারী পুজোই শক্তির শ্রেষ্ঠ পুজো। এই পুজোয় দেবী সবচেয়ে খুশি হন। কূলচূড়ামণি-তে বলা হয়েছে রজঃস্বলা রমণীকে তিন রাত পুজো করলে লক্ষপীঠের ফল পাওয়া যায়। জ্ঞানার্ণবে বলা হয়েছে, কুমারীপূজা করলে পূজা-হোম-যজ্ঞ ইত্যাদি যা ফল পাওয়ার কথা তার কোটিগুণ ফল পাওয়া যায়। (বৃহৎ তন্ত্রসারঃ পৃষ্ঠা ৭১০ )

যামলে বিভিন্ন বয়সের কুমারীদের বিভিন্ন নামের শক্তিরূপে পূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। সপ্তমবর্ষীয়া কুমারীর নাম মালিনী, অষ্টমবর্ষীয়ার নাম কুজিকা, নবমবর্ষীয়া কুমারীর নাম কালসন্দর্ভা, দশমবর্ষীয়া-অপরাজিতা, একাদশবর্ষীয়ার নাম রুদ্রাণী, দ্বাদশবর্ষীয়া ভৈরবী, ত্রয়োদশবর্ষীয়া মহালক্ষ্মী, চতুর্দশবর্ষীয়া কুমারী পীঠনায়িকা, পঞ্চদশবর্ষীয়া কুমারীর নাম ক্ষেত্রজ্ঞা, ষোড়শবর্ষীয়া কুমারীর নাম অম্বিকা ।

মহানবমীতে, মহাপর্বে এবং পবিত্র দিনে কুমারীপূজা করার নির্দেশ রয়েছে। পূজাক্রমে বলা হয়েছে—কুমারীকে বস্ত্রে-পুষ্পে সুসজ্জিতা করবে। তারপর ‘ঐ’ (ওঁ নয়) বীজমন্ত্র পাঠ করে কুমারীর শক্তিনাম উচ্চারণ করতে হবে। যেমন, চতুর্দশবর্ষীয়া কুমারীর বেলায় ‘এঁ’ পীঠনায়িকা’ বলে জল দান করতে হবে। পরে ‘হ্রী’ বীজমন্ত্ৰ পাঠ করে তাকে পাদ্য (পা-ধোয়ার জল) দেবে। ‘শ্রী’ বীজদ্বারা অর্ঘ্য দেবে। ‘হুঁ’ বীজদ্বারা চন্দন। ‘ঐ’ বীজদ্বারা ফুল প্রদান করবে। তারপর এঁ হ্রী শ্রী এই তিন বীজমন্ত্র দিয়ে ষড়ঙ্গপূজা করতে হবে। ‘ষড়ঙ্গ’ শব্দের অর্থ ছ’টি অঙ্গ, যথা—দুই বাহু, দুই পা, মস্তক ও কটি বা কোমর। এই ছয়টি অঙ্গের দ্বারা পূজা-ই ষড়ঙ্গ পূজা।

বৃহৎ তন্ত্রসারঃ-এ বলা হয়েছে, “কুমারীই সাক্ষাৎ যোগিনী, কুমারীই সাক্ষাৎ পরমদেবতা। কুমারীপূজা করিলে তদ্বারা অসুরগণ, দুষ্টনাগগণ, দুষ্টগ্রহগণ, ভূতগণ, বেতালগণ, গন্ধর্ব্বগণ, ডাকিনীগণ, যক্ষগণ, রাক্ষসগণ, সমুদায় দেবগণ, ভূলোক, ভূবলোক, স্বর্লোক, ভৈরবগণ, পৃথিবীপ্রভৃতি সমুদায় চরাচর ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ঈশ্বর, সদাশিব, সকলেই সর্ব্বতোভাবে পরিতুষ্ট হয়েন।” (পৃষ্ঠা, ৭১২)।

কুমারী পূজায় সন্তুষ্ট হন অসুর থেকে সদাশিব। এই তালিকাভুক্তদের কতজনের অস্তিত্বে শিক্ষিত মানুষরা বিশ্বাস করেন, জানতে ইচ্ছে করে। যাঁরা ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে ‘পবিত্র’ কুমারী পূজা দেখতে হাজির হন, তাঁরা কি জেনে-বুঝে হাজির হন? নাকি এখানেও সেই ভেড়ার পালের গল্প ?

 

তন্ত্রে বলি ও ফললাভ

“তন্ত্র বলেন, দেহস্থ আত্মা উষ্ণ-শোণিতের দ্বারা সঞ্জীবিত থাকেন ; শোণিত ঠাণ্ডা হইলে আত্মাকেও দেহত্যাগ করিতে হয়, অতএব উষ্ণ শোণিত আত্মার খাদ্য, যাহার সাহায্যে শোণিতের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, তাহাই আত্মার খাদ্য। সুতরাং আত্মাকে ভোগ দিতে হইলে উষ্ণ শোণিতই প্রশস্ত ভোগ।” (তন্ত্র পরিচয়, ১৫০ পৃষ্ঠা) প্রশ্ন উঠতেই পারে—আত্মাকেই যখন চিন্তা বা চেতনা বলা হচ্ছে, তখন চিন্তা বা চেতনার দেহত্যাগ করার প্রশ্ন উঠছে কেন? দেহ ত্যাগ করে চিন্তা কোথায় ঘুরে বেড়ায় ?

শোণিতের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ শোণিত কি সত্যিই কার্যকর? বরফ ঘেরা ঘরে রেখে উষ্ণ শোণিত ভোগ দিলে কি কোনও তান্ত্রিকের পক্ষে নিজের শরীরকে গরম রাখা সম্ভব? শরীর গরম করতে আজকাল নানা রকমের উত্তেজক পানীয় ও ওষুধ বাজারে এসে গেছে। এসবের চেয়ে শোণিত বা রক্ত কি বেশি কার্যকর?

তন্ত্র ও বিজ্ঞানের অবস্থান দুই মেরুতে। সুতরাং এ’সব যুক্তির প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি রেখে আসুন, এ’বার ঢুকি বলি’তে।

মুণ্ডমালাতন্ত্রে ও বৃহৎ তন্ত্রসারঃ-এ বলা হয়েছে, শক্তির উদ্দেশ্যে ছাগ-বলি দিলে বাগ্মী হয়, মেষ-বলি দিলে কবি, (রবীন্দ্রনাথ আদৌ কবি হ’তে পেরেছিলেন তো? যেভাবে সরাসরি বলিপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন খুব অল্প বয়সেই, তারপরও তিনি কী করে যে ‘কবিগুরু’ হলেন!) মহিষ-বলি দিলে সম্পদ বৃদ্ধি হয়, মৃগ-বলি দিলে মোক্ষফল ভাগী হওয়া যায়, গোধিকা বলি দিলে মহাফল লাভ করা যায়। নরবলি দিলে মহাসমৃদ্ধি লাভ হয়, অষ্টসিদ্ধির অধিকারী হয়। বলিদানের ফল ভোগ করে যজমান। ব্রাহ্মণের নরবলি দেবার অর্থাৎ খড়গাঘাত করার অধিকার নেই।

ব্রাহ্মণ নিজ-হাতে নরবলি দিলে নরকে পতিত হবে। চণ্ডালকে দিয়ে

নরবলি দেওয়াতে হবে। যে চণ্ডাল নিজ-হাতে নরবলি

দেবে, তার মহাসিদ্ধি লাভ হবে। (এখানেও

সেই ভণ্ডামীর গন্ধ পাচ্ছি)।

যাকে বলি দেওয়া হবে তাকে গন্ধপুষ্প দিয়ে পুজো করতে হবে। পুজোর মন্ত্র পশুর কানে বলতে হয়। মন্ত্রটা হল, ‘পশ্চাৎ পশুপাশায় বিদ্মহে’। বলি দেবার আগে খড়েগর পুজো করতে হয় ‘হুঁ বাগীশ্বরীব্রহ্মভ্যাং নমঃ’ মন্ত্র দ্বারা।

বলিদানের বিরুদ্ধে ভারতে একটি আইন আছে, ‘Prevention of Cruelty to Animals Act, 1960’। এতে ঈশ্বর উপাসনার নামে বলিদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০০২-তে বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে এই আইনের প্রয়োগ কঠোর ভাবে করার নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যপাল। অন্যান্য রাজ্যে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। সত্যি বলতে কী, আইন ভাঙাকে মসৃণ রাখতে ব্যাপক পুলিশি ব্যবস্থা থাকে এই রাজ্যেও।

যত দিন এ’দেশের মানুষ প্রকৃত অর্থে ‘শিক্ষিত’ হয়ে উঠতে পারবে না, ততদিন বলিও থাকবে—এমন ভাবনায় একটা গোলমাল আছে। কড়া হাতে আইনের প্রয়োগ হলে বে-আইনি কাজ বন্ধ হবে-ই। যারা হৈ-হৈ করে আইন ভাঙছে, অজ্ঞানতা ও আবেগ থেকে, তাদের মূল অংশই শাস্তির ভয়ে আইন মেনে চলবে। অবশ্য আইন রক্ষকদের দুর্নীতি মুক্ত করতে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। পুলিশ প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের চিন্তা সরকারকে ছাড়তে হবে।

 

তন্ত্রে বীজমন্ত্র ও নাদধ্বনি

তন্ত্রে বিভিন্ন দেব-দেবীর আরাধনার জন্য ‘বীজমন্ত্র’ রয়েছে। তন্ত্রে ‘বীজমন্ত্র’ ও দেবতা সমার্থক। শব্দই পরমব্রহ্ম। বীজমন্ত্র উচ্চারণে যে শব্দের উৎপত্তি, তা- ই দেবী-দেবতা।

‘ক্রীং’ বীজমন্ত্ৰ কালীকে বুঝায়। কিন্তু ‘হ্রীং’ বীজে কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী প্রভৃতিকে বোঝায়। কোনও বীজমন্ত্রে যেমন একটি দেবতাকে বোঝায়, আবার কোনও বীজমন্ত্রে একাধিক দেবতাকেও বোঝায়।

বীজমন্ত্রকে কেন্দ্রীভূত শক্তি বলা হয়েছে। বীজই কামকলা কুণ্ডলিনী। বীজ- বর্ণমালাই দেব-দেবী স্বয়ং। যেমন একটা বিশাল বৃক্ষ ক্ষুদ্র বীজে সুপ্ত থাকে, তেমন- ই বর্ণমালার বীজের মধ্যেই সব-দেবীর অবস্থান।

নাভি বা নাদ থেকে উঠে আসা বীজমন্ত্রের ধ্বনিই শব্দব্রহ্ম, যা সর্বজীবাশ্রয়ী। নাভি থেকে শব্দকে তুলে আনাও সাধনা।

এ’সব-তন্ত্রের কথা। নাদধ্বনি বিষয়ে কী বলে? নাভি বা নাদ থেকে যে কোনও ধ্বনীই ওঠে না। ওঠা সম্ভব নয়। আমরা ধ্বনি সৃষ্টি করি ফুসফুসের বায়ুকে স্বরনালী দিয়ে বের করে। এ বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি।

বৈদিক বীজমন্ত্র ওঁকার। যার উচ্চারণ ‘অ-উ-ম’। ওঁকার বলতে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু- মহেশ্বরকে বোঝায়। ওঁ-এর মধ্যে সমস্ত দেব-দেবীর বীজমন্ত্রই নিহিত রয়েছে।

 

‘বিন্দু-সাধন’ ও মস্তিষ্কে বীর্য প্রেরণ

বাৎসায়নের কামশাস্ত্রে বলা হয়েছে—কামের অন্তরঙ্গ-সাধনা তন্ত্রের নির্দেশেই হয়েছে। তন্ত্রে বলা হয়েছে দীর্ঘ ও নিবিষ্ট মৈথুন-ই জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলন ঘটায়, শিব-শক্তির মিলন ঘটায়, কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করে।

যতক্ষণ বীর্যপতন রোধ করা যায়, ততক্ষণ মৈথুন সম্ভব। বীর্যপাতে মৈথুনের শেষ।

মিলন যত দীর্ঘস্থায়ী, জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনও ততটাই

দীর্ঘস্থায়ী। স্খলনহীন দীর্ঘ মৈথুনকে

বলে ‘বিন্দু-সাধন’।

দেবতত্ত্ববাদী পুরুষ তলায় নিক্রিয় থেকে শক্তিকে বিপরীত আসনে রেখে মিলনকে দীর্ঘস্থায়ী ও আনন্দদায়ক করে।

ছটি চক্র ভেদ করে কুণ্ডলিনী জাগ্রত করতে দুটি পদ্ধতির প্রয়োগ রয়েছে তন্ত্রে। (১) নারী-পুরুষের মিলন (২) মানস।

‘চক্র’ ছটি আছে আমাদের শরীরে, যথাক্রমে গুহ্যে, লিঙ্গমূলে, নাভিতে, হৃদয়ে, কণ্ঠে ও ভ্রূদ্বয়ের মাঝে। মস্তিষ্কের নীচে রয়েছে সহস্রদল পদ্ম। পদ্মের উপরে ফণা মেলে রয়েছে একটি সাপ। এ’সব আমরা আগেই আলোচনা করেছি।

নতুন যা নিয়ে আলোচনায় ঢুকতে চাইছি, তা তন্ত্রের-ই পুরোন কথা, তন্ত্রের মূল তত্ত্ব।

তন্ত্র বিশ্বাস করে, মানস সাধনার দ্বারা, অর্থাৎ মানসিকভাবে চিন্তা করে

বীর্যকে ঊর্ধ্বমুখী করে মস্তিষ্কের সহস্রদল-পদ্মে নিয়ে যাওয়া

যায়। এবং বীর্যকে আবার স্ব-স্থানে

নিয়ে আসা যায়।

এই যে একটার পর একটা চক্র ভেদ করে বীর্যকে মস্তিষ্কে নিয়ে আসা এটাই হল কুণ্ডলিনী জাগ্রত করার মানস সাধনা ।

বীর্যকে এ’ভাবে ওঠানো, নামানো বাস্তবে অসম্ভব। এমন বিজ্ঞান-বিরোধী চিন্তা নিয়েই তন্ত্র ও যোগ। জানি না কবে এসবের স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য বই লেখার প্রয়োজন ফুরোবে?

 

‘যন্ত্র’ বা ‘যন্ত্রম’ : যে কোনও সমস্যার স্থায়ী সমাধান

কলকাতা থেকে প্রকাশিত নামি দৈনিক পত্রিকাগুলোর দু’য়ের পৃষ্ঠা এখন তান্ত্রিক- জ্যোতিষীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। কিছু টিভি চ্যানেলে তো এখন পুরোপুরো ‘তন্ত্র- চ্যানেল’। তান্ত্রিক-জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপনের সুবাদে ‘যন্ত্র’ বা ‘যন্ত্রম’ শব্দটা অদৃষ্টবাদীদের কাছে খুবই সুপরিচিত।

জ্যোতিষীদের চেয়ে তান্ত্রিক-জ্যোতিষীদের রমরামই বর্তমানে বেশি। ওঁরা ‘যন্ত্র’কে প্রোমোট করতে দারুণ দারুণ স্লোগান হাজির করেছেন। কপি রাইটারদের তৈরি দামি স্লোগান— ‘বিনা রত্নে স্থায়ী প্রতিকার’, ‘যন্ত্রমে নিশ্চিত সমাধান’, ‘রত্ন মেলে লাখ লাখ, যন্ত্র মেলে এক’, ‘তন্ত্রের শেষ কথা যন্ত্রম’ ইত্যাদি কত না কথার রোশনাই।

রত্নের তুলনায় যন্ত্রমের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা বেড়েছে। তান্ত্রিক-জ্যোতিষীরা যেমন ‘যন্ত্রম’ দিতে বেশি বেশি করে ঝুঁকছেন, তেমন-ই নিয়তিবাদে বিশ্বাসীরাও প্রচারের চমকে গ্রহরত্নের চেয়ে যন্ত্রমের দিকে ঝুঁকেছেন বেশি। তান্ত্রিক-জ্যোতিষীদের ঝোঁকার কারণ, রত্নের তুলনায় যন্ত্রমে লাভ অনেক বেশি। সাধারণত পেসেন্টদের কাছে রত্ন বিক্রি করে মেলে দেড়শো থেকে তিন হাজার। কিনতে যায় দশ থেকে তিনশো। অর্থাৎ বাড়তি দাম মেলে একশো চল্লিশ থেকে দু’হাজার সাতশো টাকা। যন্ত্রম-এর বিক্রির দাম পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা—যা খুশি দাবে। বাড়তি দাম পাওয়া যায় চার হাজার ন’শো সত্তর টাকা থেকে আটচল্লিশ হাজার আটশো পর্যন্ত। সুতরাং যন্ত্রমের দিকে পাল্লা ভারী তো হবেই।

বিজ্ঞাপন-ই এখন সবচেয়ে বড় জাদু। বিজ্ঞাপনে ভুলে সোনা-চাঁদি চেটে মানুষ মেধা-স্মৃতিকে বাড়াতে চাইছে, মুক্তো ঘষে সাত দিনে ফর্সা হতে চাইছে। বিজ্ঞাপনের আকর্ষণী শক্তিতে মানুষ থেকে লক্ষ্মী-সরস্বতীকে বশ করতে চাইবে, তন্ত্রে নব্বই দিনে এইডস থেকে ক্যানসার সারাতে চাইবে—এতে অবাক হওয়ার কী আছে?

তন্ত্রে অবশ্য যন্ত্রের বা যন্ত্রমের কথা আছে। যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে নানা অসম্ভব কাজ, অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে দেবার কথাও আছে। সত্যিই আছে। ঈশ্বর সত্যি হলে, তন্ত্র সত্যি হলে, যন্ত্রও সত্যি—অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ‘যন্ত্ৰ’ সত্যি কাজের কি না, সেটা জানার আগে ‘যন্ত্র’ কী—সেটা জানা জরুরি। অর্থাৎ যন্ত্রের সংজ্ঞা কী?

যাঁরা তান্ত্রিক, ‘যন্ত্র’ বা ‘যন্ত্রম’ চড়া দামে বিক্রি করেন, তাঁরা যন্ত্রের সংজ্ঞা জানেন—এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। আমিও এমনটা-ই ভেবেছিলাম। জানি, এঁদের অনেকেই স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। তান্ত্রিক হওয়ার জন্য স্কুলের গন্ডি পেরুনো জরুরি নয়। কিন্তু যাঁরা হেঁকে-ডেকে সমস্ত সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখিয়ে ‘যন্ত্ৰ’ বেচছেন, তাঁরা ‘যন্ত্র’ শব্দটার সংজ্ঞাই জানবেন না—এটা অনৈতিক, এটা স্পষ্টতই প্রতারণা।

আজ পর্যন্ত রেডিও-টিভি ও সেমিনারে কম করে শ’দেড়েক জ্যোতিষীর মুখোমুখি হয়েছি। তাঁদের অনেকেই ‘যন্ত্র’ বা ‘যন্ত্রম’ দেন। ‘যন্ত্র’ জিনিসটা কী জিজ্ঞেস করলেই সব্বাই কেমন তোতলাতে থাকেন, গোলাতে থাকেন।

একটি ঘটনা। সময়—আজ থেকে বছর খানেক আগে। এ টি এন ওয়ার্ল্ড টিভি চ্যানেলের জন্য অনুষ্ঠান ক্যামেরা বন্দি করা হচ্ছে। আলোচক—আমি আর ‘বিনারত্নে স্থায়ী প্রতিকার’-এর বিজ্ঞাপনে বাজার মাত করে দেওয়া মহিলা জ্যোতিষী ‘কাম’ তান্ত্রিক। একথা সে’কথায় বিতর্ক জমে গেছে। এমন সময় জিজ্ঞেস করলাম— এই যে আপনি রত্নের বদলে তাবিজ-কবচ-যন্ত্র দেন, তা ‘যন্ত্র’টা কী?

মহিলা শুধু এড়িয়ে যাচ্ছিলেন এ’কথা বলে যে যন্ত্র বা যন্ত্রম ব্যাপারটা এতই বিশাল ব্যাপার যে, এত কম সময়ে বলা সম্ভব নয়। বললাম—এই যে আপনারা ‘তারা-যন্ত্র’, ‘কালী-যন্ত্র’, ‘বগলা-যন্ত্র’, ‘সরস্বতী-যন্ত্র’ এইসব বিক্রি করেন, সেই তারা-কালী-বগলা-সরস্বতীর সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্কটা ঠিক কী? আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘যন্ত্র’ মানে ‘যোনি’। অর্থাৎ তারা ‘তারা-যন্ত্র’ মানে তারার যোনি। এ’সব কথা সত্যি না কি ?

মহিলা চেঁচালেন—একদম বাজে কথা।

-তা হলে ‘যন্ত্র’ মানে কী? আপনি যখন জানেন, এটা বাজে কথা, তখন সত্যি কথাটাও নিশ্চয়ই জানেন ?

‘যন্ত্র’ যে এক-দু কথায় বলার মত বিষয় নয়, এটাই আবারও আমাকে বোঝাতে চাইলেন মহিলা ।

এ’বার বললাম—একজন আমাকে বলেননি। আমিই বলছি, ‘যন্ত্র’ বা ‘যন্ত্রম’ মানে ‘যোনি’। ‘তারা-যন্ত্রম’ মানে তারার যোনি। এই যোনির ছবি আঁকার পর বলে ‘যন্ত্র’। মহিলা চুপ মেরে গেলেন ।

‘যন্ত্র’ আঁকার আবার তান্ত্রিক বিধি রয়েছে। বৃহৎ তন্ত্রসারঃ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “কুঙ্কুম, রক্তচন্দন অথবা ভষ্মদ্বারা সুবর্ণাদি পাত্রে মাতৃকাযন্ত্র অঙ্কিত করিবে। শক্তিমন্ত্রে কুঙ্কুম, বিষ্ণুমন্ত্রে রক্তচন্দন ও শিবমন্ত্রে ভষ্মদ্বারা মাতৃকাযন্ত্র লিখিয়া মন্ত্র সংস্কার করিতে হইবে।”… “তৎপর অষ্টদল পদ্ম অঙ্কিত করিয়া ঐ পদ্মের অষ্ট পত্র মধ্যে অষ্টবর্গ লিখিবে। পদ্মের বহির্ভাগে চতুর্দ্বার ও চতুষ্কোণ অঙ্কিত করিয়া পদ্ম বেষ্টন করিবে। এই বর্ণময় যন্ত্র সাধক মনুষ্যের সৌভাগ্য ও সম্পদ বৃদ্ধি করে। যন্ত্রের চতুর্দ্দিকে এবং চতুষ্কোণে ঠং লিখিবে। গৌতমীয় তন্ত্রে পদ্মের পূর্ব্বদিক হইতে আরম্ভ করিয়া ঈশানকোণ পৰ্য্যন্ত অষ্টদলে লিখিতে হইবে। তৎপরে চতুরস্ত্র ও চতু- দ্বার লিখিয়া চতুর্দ্বারে বং এবং চতুষ্কোণে ঠং লিখিয়া যন্ত্র অঙ্কিত করিবে।”

সত্যিই অং বং চং! এর মধ্যে গভীরে কোনও মাহাত্ম্য খুঁজতে যাওয়া বৃথা। আসলে তন্ত্রকে একধরনের প্রাচীন ‘Sexology’ বা ‘কামশাস্ত্র’ বললে ভুল হয় না।

ভূবনেশ্বরীযন্ত্র

তবে তন্ত্র এমন-ই এক কামশাস্ত্র যেসখানে ভণ্ডামী ও বিকৃতির দাপটে কামকলার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও আনন্দ অনুপস্থিত। শক্তির মধ্যে ছিন্নমস্তাদেবী সবচেয়ে উগ্র। ছিন্নমস্তার যন্ত্রচিত্র কেমন? এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এ’কথা স্বীকার করে তন্ত্রের বিভিন্ন আকর গ্রন্থও। ছিন্নমস্তাদেবীর একটি যন্ত্র-চিত্র এখানে তুলে দিলামঃ

দেবী ছিন্নমস্তাযন্ত্র

যন্ত্র-চিত্র আঁকার নির্দ্দেশ এই রকম : প্রথমে ত্রিকোণ অঙ্কিত করিয়া তাহার মধ্যে মণ্ডলাকারে তিনটি রেখা অঙ্কিত করিবে। সেই মণ্ডলমধ্যে দ্বারত্রয়বিশিষ্ট যোনিমণ্ডল অঙ্কিত করিতে হইবে। ত্রিকোণের বহির্ভাগে অষ্টদলপদ্ম অঙ্কিত করিয়া তদ্বাহ্যে ভূবিম্বত্রয় লিখিবে। যোনিমধ্যে ‘হুঁ ফট্’ এই মন্ত্র লিখিয়া যন্ত্ৰ প্ৰস্তুত করিবে। দেবী নিজের মাথা কেটে

তন্ত্র মতে দেবী ছিন্নমস্তার রূপ এই রকম- ফেলেছেন। বাঁ হাতে ধরা রয়েছে নিজের কাটা মাথা। দেবীর ছিন্ন গলা থেকে ফিকি দিয়ে বের হচ্ছে রক্ত। দেবীর কাটা মাথা সেই রক্ত পান করছে। কেশ আলুলায়িত, নানা পুষ্পে বিভূষিতা। দেবীর ডান হাতে তলোয়ার, গলায় মুণ্ডমালা। দেবী নগ্না। ডান পা এগিয়ে, বাঁ পা পিছিয়ে। গলায় উপবীতের মত ঝুলছে সাপ। দেবীর এক রূপ যেমন ভয়ংকর, তেমন-ই দেবীর আর এক রূপ—কামকলারতা ষোড়শী সুন্দরী। একই দেবীর দুই রূপ। দুই-ই সত্য। ষোড়শী সুন্দরী দেবীর স্তনদ্বয় স্থূল ও উন্নত। উপবীতের মতো ঝুলছে সাপ, গলায় অস্থিমালা। ষোড়শী সুন্দরী দেবী ছিন্নমস্তা কামাতুরা, বিপরীত আসনে পুরুষের সঙ্গে মৈথুন-রতা।

দেবীর ডান ও বাঁয়ে রয়েছেন ডাকিনী ও বার্ণাণী নামের দুই নায়িকা। এঁরাও দেবীর গলদেশ থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত পান করছেন। বার্ণাণী সৌমাকৃতি, রক্তবর্ণ, মুক্তকেশী, নগ্না। বাঁ হাতে নরমুণ্ড, ডান হাতে তলোয়ার। গলায় নরমুণ্ডমালা ও সাপ। এঁর দক্ষিণ পা এগিয়ে, বাঁ পা পিছিয়ে। বয়সে ষোড়শী।

ডাকিনী ত্রিনয়না। স্তনদ্বয় অতিস্থূল ও উন্নত। ভয়ংকরদর্শনা, আলুলায়িত কেশী, নগ্না। গলায় নরমুণ্ড মালা, বাঁ-হাতে নরমুণ্ড, ডান হাতে তলোয়ার। ইনিও দেবীর রক্তপান করছেন। দু’জনেই দেবীর সেবিকা।

লক্ষ করার মতো বিষয় এই যে ; দেবীছিন্নমস্তা একই সঙ্গে রক্ত পিপাসু

এবং অনন্ত মৈথুনরতা। এ’সব দেখে-শুনে মনে হয় একটা

দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের উপাসনা-ধর্মে ‘কর্ম’

বলতে শুধু ‘মৈথুন-কর্ম’কেই প্রধান

বলে বোঝাতো।

দেবী ছিন্নমস্তা

ফিরি যন্ত্র বা যন্ত্রমের কথায়। রেডিমেড তান্ত্রিকদের জন্য রেডিমেড যন্ত্র পাওয়া যায়। এ’সব যন্ত্র সোনা-রুপো বা তামার পাতে খোদাই করে তৈরি হয় আজকাল। কলকাতার বড়বাজারে প্রধানত বিক্রি হয়। ক্রেতা—তান্ত্রিকরা। বড়বাজারের দাম তিরিশ টাকা থেকে হাজারের মধ্যে। এগুলোই হাত-ঘুরে পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।

এখানে কিছু যন্ত্র চিত্র দেওয়া হল

এ সি চেম্বার আর দৈনিক বিজ্ঞাপনের খরচ তুলে মাস গেলে তিন লাখ

থেকে তিরিশ লাখ লাভ-ই যদি না তোলা গেল, তবে তো

তান্ত্রিকের ভেক ধরায় সুখ থাকে না। অতএব দাম

তো এভাবে পঞ্চাশ থেকে একশো

গুণ বাড়বেই।

 

জপের মালা

জপের মালা বলতেই আমাদের চোখের সামনে যে তুলসি কাঠে তৈরি জপের মালার ছবি-ই ভেসে ওঠে, তা জপের মালার পুরো ছবি নয়। বীজ-মন্ত্র জপ করার মালা তৈরি নিয়ে তন্ত্র কী বলছে আসুন শুনি। জপ-মালা যে-সব বস্তু দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে, সেগুলো হল—রুদ্রাক্ষ, পদ্ম-বীজ, ছোট্ট শঙ্খ, মুক্তা, স্ফটিক, মণি, রত্ন, প্রবাল, কুশমূল, সোনা ও রূপা।

এক এক ধরনের জপ-মালায় বীজ-মন্ত্র জপ করলে এক এক ধরনের ফল পাওয়া যায়। যেমন শঙ্খমালায় শতগুণ ফল, প্রবালমালায় সহস্রগুণ, স্ফটিক, মণি ও রত্নমালায় দশসহস্রগুণ, মুক্তামালায় লক্ষ-গুণ, সোনারমালায় কোটিগুণ, কুশমূলমালায় শতকোটি গুণ এবং রুদ্রাক্ষমালায় অনন্ত ফল লাভ হয়। এই মত বৃহৎ তন্ত্রসারঃ সহ একাধিক তন্ত্রগ্রন্থের। কী হাস্যকর ছেলেমানুষী সব গপ্পো !

এ’খানেও তন্ত্রগ্রস্থগুলো একমত নয়। মুণ্ডমালা-তন্ত্র’-তে বলা হয়েছে, জপমালার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল মানুষের আঙুলের অস্থি দিয়ে তৈরি মালা। এই মালা গাঁথতে হবে মানুষেরই নাড়ি দিয়ে। এই জপমালায় বীজ-মন্ত্র জপ করলে সব কামনা পূর্ণ হয় । কী ভয়ংঙ্কর বীভৎস চিন্তা—ভাবা যায়!

ত্রিপুরাসুন্দরী তন্ত্রে বলা হয়েছে, রক্তচন্দন দিয়ে তৈরি বীজমালা শ্রেষ্ঠ। এই জপমালায় বীজমন্ত্র জপ করলে সব কিছু ভোগ করা যায় এবং মোক্ষ লাভ করা যায়। বিষ্ণুতন্ত্রে তুলসীমালাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। গণেশতন্ত্রে হাতিরদাঁতের মালাকে সেরার শিরোপা দেওয়া হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে—তন্ত্রে বীজমন্ত্রের চেয়ে জপমালা কী দিয়ে তৈরি, তার গুরুত্ব অনেক বেশি।

এ’খানেও একটা প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক—কোন্ তন্ত্রের কথা ঠিক, কোন্ তন্ত্রের বেঠিক? ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ বা ‘যত মত, তত পথ’-এ বিশ্বাস করার মত বোকা মানুষরাও আজও সংখ্যায় বেশি। এটাই তান্ত্রিকদের কাছে আশার কথা।

এ’খানে-ই শেষ নয়। জপমালা আঙুলে, নাকি আঙুলের পর্বে জপতে হবে— সেখানেও নিয়মের বেড়ি। আঙুলে জপলে একগুণ ফল হয়। আঙুল পর্বে গুণলে আটগুণ ফল। নানা ভাবে জপে নানা রকম ফললাভের গবেষণা একজনের পক্ষে অসম্ভব। কোনও একটায় জপে চূড়ান্ত ফল লাভ যার হয়ে গেছে তার পক্ষে অন্য জপমালার বা আঙুলে, পর্বের পার্থক্য বোঝা সম্ভব নয়। আবার সম্মিলিত গবেষণায়ও এমন নিত্তির হিসেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভব! তাহলে? একজনের মনে হল, তাই? এক একজন জাদু-পুরোহিতের এক এক রকম মনে হল, আর তাই তাঁরা গুরুবাক্য হিসেবে বলে গেলেন। ভক্তদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য বা নির্ভেজাল বোকামোর দৌলতে গুরুবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো!

 

জপমন্ত্র ও আসন

‘আসন’ বলতে এখানে কোনও যোগ মুদ্রাকে বোঝানো হয়নি। আসন বলতে স্পষ্টতই বসার আসন, যে আসনে বসে জপ করতে হবে সে বিষয়ে কিছু নিয়ম- বিধির কথা বলা হয়েছে।

‘বীজমন্ত্র’ আবার যেখানে-সেখানে বসে জপ করলে ফল মিলবে না। ‘হংসপরমেশ্বর তন্ত্র’ জপের আসন প্রসঙ্গে জানাচ্ছে, কম্বলের আসন, সুতোর তৈরি আসন, কাঠের আসন এবং চামড়ার আসন-ই প্রশস্ত। কম্বলের মধ্যে লাল কম্বল বেশি ভালো।

জ্ঞান সিদ্ধির জন্য কৃষ্ণসার হরিণের চামড়ার আসনে বসে জপ করতে হবে। সম্পদ কামনায় বাঘের চামড়ার আসন প্রশস্ত।

এখানেও দ্বিমত আছে। বৃহৎ তন্ত্রসারঃ’এ পাচ্ছি, লোম যুক্ত আসনে কোনও ধরনের জপ-সাধন করতে নেই। সঙ্গে বলা হয়েছে, মৃত্তিকাসনে দুঃখ, কাষ্ঠাসনে দুর্ভাগ্য, বংশনাশ, পাষাণে রোগ, তৃণাসনে যশোহানি, বস্ত্রাসনে জপ হানি এবং পাতার আসনে বসে জপ করলে পাগল হয়ে যায়। এ’সব কথা গৌতমী তন্ত্রেও বলা হয়েছে। আগম কল্পদ্রুমে বলা হয়েছে, “মেষচর্ম্ম, ব্যাঘ্রচর্ম্ম, গজচর্ম্ম, উষ্টচৰ্ম্ম ও সপচৰ্ম্ম এই সকল আসন অবিচার (ইষ্ট সিদ্ধিতে) কাৰ্য্যে বিহিত।”

আসনের লড়াই! আর পারি না! আসন ও জপমালার প্রাধান্যে দেব-দেবীদের পিছু হটার ছবিও এখানে স্পষ্ট।

 

যোগিনী

বিভিন্ন পুরাণে যোগিনীদের কথা রয়েছে। যোগিনীরা হলেন মাতৃকাশক্তি। বিভিন্ন দেবতাদের মাতৃকাশক্তি। যোগিনীদের সংখ্যা আট। এঁদের প্রকাশ আবার আটটি ভিন্ন রূপে। অর্থাৎ মোট যোগিনীর সংখ্যা আট গুণ আট। অর্থাৎ চৌষট্টি।

যেমন ধরুন ‘ভদ্রকালী’। ইনি একজন যোগিনী। এঁর আটটি রূপ হল (১) জয়ন্তী, (২) মঙ্গলাকালী, (৩) ভদ্রকালী, (৪) কপালিনী, (৫) দুর্গা, (৬) শিবা, (৭) ক্ষমা, (৮) ধাত্রী।

‘উগ্রচণ্ডা’ এক যোগনী। তাঁর অষ্টযোগিনী হলেন, (১) কৌশিকী, (২) শিবদূতি, (৩) হৈমবতী, (৪) ঈশ্বরী, ) শাকম্ভরী, (৬) দুর্গা, (৭) মহোদরী, (৮) উগ্রচণ্ডা । ‘উমা’র অষ্টযোগিনী হলেন, (১) জয়া, (২) বিজয়া, (৩) মাতঙ্গী, (৪) ললিতা, (৫) নারায়ণী, (৬) সাবিত্রী, (৭) স্বধা, (৮) স্বাহা।

এ’ছাড়াও কত না যোগিনী! নামগুলোও বেশ! সুরসুন্দরী, মনোরমা, পদ্মিনী, নটিনী, মধুমতী ইত্যাদি। ডাকিনী-যোগিনী বলতে আমরা পাড়ার কালীপুজোয় যে নগ্না ভয়ংকরী মূর্তি দেখে কল্পনা করি, জাদু-পুরোহিতদের কল্পনার যোগিনীরা কিন্তু আদৌ তেমন নন। এঁরা প্রত্যেকেই ষোড়শী সুন্দরী।

এক সময় চৌষট্টি যোগিনীর শক্তিপুজো ভারতবর্ষে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। খাজুরাহো, জব্বলপুরের কাছে ভেরাঘাট, ভুবনেশ্বরের কাছে হীরাপুর ও সম্বলপুরের কাছে রানিপুরে চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির আছে।

 

যোগিনীকে ভার্যা করার মন্ত্র-তন্ত্র

‘ভূতডামর’-এ বলা হয়েছে—যোগিনীরা দেবতাদের কাছেও দুর্লভ ‘শক্তি’। এঁরা পরমাসুন্দরী, চিরযৌবনা, স্তনদ্বয় উচ্চ ও স্থূল। এইসব দেবী-সুন্দরীদের পুজো করে যে ভাবে চাওয়া যায়, সে’ভাবেই পাওয়া যায়। যোগিনী পুজোর পর সাধক বর প্রার্থনা করবে। বর প্রার্থনা করার সময় দেবীকে ‘মাতা’, ভগিনী’, অথবা ‘ভাৰ্যা’ সম্বোধন করতে হবে।

দেবীকে ‘মা’ সম্বোধন করলে দেবী সাধককে নানা সুন্দর-সুন্দর ও দামী জিনিস- পত্তর উপহার দেন। এমনকি রাজ্য চাইলে রাজাও করে দেন। একই সঙ্গে সোনিয়াজী আর বাজপেয়ীজী ভারতের রাজত্ব চাইলে যোগিনীদেবী কী করবেন? তাত্ত্বিকভাবেও প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

সাধক যদি যোগিনীকে ‘বোন’ সম্বোধন করেন, তাহলে যোগিনী ভাই জ্ঞানে সাধককে অনেক কিছু দিয়ে থাকেন। যেমন ধরুন নানা ধরনের জিনিস, পোশাক এবং সহবাসের জন্য দারুণ সুন্দরী মেয়েদের এনে দেন (বাঃ, এই না হলে বোন!)। এ’ছাড়াও সাধক যা চান, যোগিনী সেই কামনাই পূর্ণ করেন।

সাধক যদি দেবী যোগিনীকে ‘ভার্যা’ সম্বোধন করতে চান, তাহলে এই সম্বোধনের আগে নিজের বিবাহিতা বউটির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। দেবীকে নিজের বউ করে নিলে দেবীর কিছুই অদেয় থাকে না। শরীর, মন, ধন সবই সাধককে দেন। ষোড়শী যোগিনীর সঙ্গে কামকলার অনন্য সুখের সঙ্গে বাড়তি পাওয়া যায় স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে ভ্রমণের ক্ষমতা। দেবীশক্তি যার বউ, তাঁর ক্ষমতা যে দেবতুল্য, এ’বিষয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

এবার যোগিনী সাধন প্রণালী ও মন্ত্র বলছি। এই সাধন প্রণালী ও মন্ত্র স্বয়ং মহাদেব কথিত। জাদু-পুরোহিতদের দাবি এমনটাই। সাধক বটবৃক্ষমূলে যোগিনীর পুজো করবে। ‘হ্রী’ এই মন্ত্রে প্রাণায়াম করবে।

তারপর ‘হ্রাং অঙ্গুষ্ঠাভ্যাং নমঃ’ বলে প্রতিদিন দশ হাজার জপ করতে হবে। সাতদিন এইভাবে জপ করার পর অষ্টম দিনে ওঁ হ্রী আগচ্ছ পদ্মিনী স্বাহা’ জপ করলে পদ্মিনী আসবেন প্রার্থনা পূরণ করতে। একই ভাবে জপ করে পদ্মিনীর বদলে দুর্গা স্বাহা’ বললে, ‘দুর্গা’ আসবেন। এভাবে মন্ত্রে যে কোনও যোগিনীকেই আনতে পারেন সাধক। অষ্টম দিনে অবশ্য দেবী-যোগিনীর উদ্দেশ্যে বলি দিতে বলা হয়েছে।

তন্ত্রে আরও একটি জরুরি নির্দেশ রয়েছে। যোগিনী প্রতিদিনই সাধককে একশো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে থাকেন। সাধককে প্রতিদিনই এই একশো স্বর্ণমুদ্রাই ব্যয় করতে হবে। অন্যথা হলে দেবী রাগ করেন। স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া তো বন্ধ করেন-ই, সঙ্গে আর যা যা দিচ্ছিলেন, সবই বন্ধ করে দেন।

হায়, আধুনিক তান্ত্রিকগণ, আপনারা কি তন্ত্রে বিশ্বাস করেন না? আপনাদের কি ভাল রকম জানেন যে—তন্ত্রে কিচ্ছুই হয় না? ‘যা বলি তা করো, যা করি তা কোরো না’—এটাই কি আপনাদের নীতি?

এমন একজন তান্ত্রিকও কি তন্ত্রের দেশ ভারতে নেই ; যিনি তন্ত্রে বিশ্বাস

করেন? থাকলে তিনি এগিয়ে আসুন। এ’দেশের সুমহান অধ্যাত্মবাদ

ও তন্ত্রের ঐতিহ্যকে আবার প্রতিষ্ঠিত করুন। তন্ত্রে যোগিনীকে

সন্তুষ্ট করে সম্পদে বিল গেইট’কে টেক্কা মারুন।

তন্ত্র সত্যি হলে এই টেক্কা মারাটা

কোনও ব্যাপারই নয়।

এতে তন্ত্র যে শুধু বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বলে প্রতিষ্ঠিত হবে, শুধু তাই নয়, একটা নোবেল পুরষ্কার সুনিশ্চিত। আমরাও পুলকিত হবো। মানব সম্পদ উন্নয়ণ মন্ত্ৰী মুরলী মনোহর যোশী তো হবেন-ই।

আমার একটি নিখুঁত ভবিষ্যদ্‌বাণী— কোনও তান্ত্রিক-ই এগিয়ে

আসবেন না। কারণ তাঁরাই সবচেয়ে ভাল জানেন,

তন্ত্র একটি নির্ভেজাল বুজরুকি।

 

বশীকরণ

তন্ত্রে এমন কিছু গোপন প্রক্রিয়া আছে, যার সাহায্যে নারী, রাজা, মন্ত্ৰী থেকে যে কোনও শত্রুকেই বশ করা যায়।

নারীদের মধ্যে যাঁদের বশে আনা যায়, প্রেমে পাগল করে দেওয়া যায়, তাঁরা হলেন—উর্বশী, মেনকা, রম্ভা’র মত যে কোনও অপ্সরা, (স্বর্গের ষাট কোটি অপ্সরার যে কেউ বলে বলে অন্তত এক ডজন গোলে হারাবেন মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্সদের) যে কোনও রাজকন্যা, যে কোনও দেবকন্যা (লক্ষ্মী, সরস্বতী সমেত সব দেবীই তো দেবকন্যা), ঋষিকন্যা, বিদ্যাধরী, দেবতাদের স্ত্রী ও শত্রুর পত্নী সহ যে কোনও মানব-কন্যা ।

নারী-বশীকরণের কয়েকটি অব্যর্থ তন্ত্র প্রক্রিয়ার কথা আকর তন্ত্র গ্রন্থগুলোতে আছে।

  • পদ্ধতি একঃ  দশমহাবিদ্যার যে কোনও একজন মহাবিদ্যাশক্তির চক্র আঁকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা এখানে দেবীমাতঙ্গীর চক্র বা যন্ত্রের ছবি দিলাম।
দেবীমাতঙ্গীযন্ত্র

যে নারীকে বশীভূত করতে চান, সাধক তার নাম ওই চক্র বা যন্ত্রের মধ্যে লিখবেন। এবং মনে মনে ওই রমণীর কথা চিন্তা করবেন। তাহলেই দেখা যাবে “সহস্রযোজন দূরস্থিতা অদৃষ্টপূৰ্ব্বা শ্রুতমাত্রা (যাকে দেখিনি, নাম শুনেছি মাত্র) দুৰ্লভা রাজকন্যা অথবা অন্যের ভার্য্যা মন্ত্রমূঢ়া ও লজ্জাভয়বিবর্জ্জিত হইয়া সাধকের নিকট

আগমন করে।” “সাধক যে রমণীকে কদাপি দর্শন করেন নাই, যদি তাহারও নাম চক্রমধ্যগত করিয়া যোনিমুদ্রা ধারণ করেন, তাহা হইলে যক্ষিণী, রাজকন্যা, নাগকন্যা, অপ্সরা, খেচরী, দেবকন্যা, বিদ্যাধরী, দিব্যরূপা ঋষিকন্যা অথবা শত্রুর পত্নীকে আনয়ন করিতে পারেন। মদনসম্ভূত সন্তাপে ঐ সকল রমণীর জঘন বসন স্খলিত হইতে থাকিবে, মদনবাণে তাহাদের অন্তঃকরণ বিভিন্ন হইবে। এইরূপ অবস্থায় তাহারা বিলোললোচনে সাধকের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইবে।”

  • পদ্ধতি দুইঃ একভাগ কুঙ্কুম, একভাগ গোরচনা (গো-পিত্তজাত উজ্জ্বল পীত রঙ) দুই ভাগ চন্দন একসঙ্গে ভালমত মেশাতে হবে। এই মিশ্রণের তিলক পরতে হবে। তবে তিলক পরার আগে মিশ্রণ সামনে রেখে বা মিশ্রণ স্পর্শ করে একশো বার কোনও এক দশমহাবিদ্যার বীজমন্ত্র জপ করতে হবে। জপ শেষে মিশ্রণের তিলক পরলে ত্রিলোক বশীভূত হবে। কৃতার্থচিত্তে আজ্ঞা পালন করবে।

দেবীমাতঙ্গী দশমহাবিদ্যার-ই একটি রূপ। দেবীমাতঙ্গীর মহামন্ত্র হল—“ওঁ হ্রী ক্লীঁ হুঁ মাতঙ্গৈ ফট্ স্বাহা।”

  • পদ্ধতি তিনঃ পান, ধূপ, দীপ, জল, ফুল, ফল, পাতা, দুধ, দই, ঘি, কর্পূর, কস্তুরী, কুঙ্কুম, লবঙ্গ বা বস্ত্র যে কোনও একটি দ্রব্যকে স্পর্শ করে একশো-আট বার বীজমন্ত্র জপ করে দ্রব্যটি যে মানুষটিকে দেওয়া হবে, সে ওই দ্রব্য ব্যবহার শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বশীভূত হয়ে যাবে। এই প্রয়োগদ্বারা সমুদায় রমণী বশীভূত ও দাসীর ন্যায় হইয়া থাকে।
  • পদ্ধতি চারঃ শ্রীখণ্ড, গুগ্লু, কর্পূর ও অগুরু সহ হোম করলে ত্রিভূবণের যে কোনও নারী বশীভূত হয়। ‘হোম’ মানে মন্ত্র উচ্চারণ করে দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে যজ্ঞের আগুনে ঘৃতাহুতি দান। আর মন্ত্র? সে তো ইতিমধ্যে আপনাদের জানাই হয়ে গেছে। তাই আর একই কথা আবার লিখলাম না।

পদ্ধতি পাঁচঃ গোরচনার উপর একশো বীজমন্ত্র জপ করার পর সাধকের দৃষ্টির সামনে যারাই আসবে, তারাই বশীভূত হবে।

হে পাষণ্ড, নরাধম তান্ত্রিকগণ, হে বিশ্বহিন্দু পরিষদের সাধু-সন্তগণ, আপনাদের মধ্যে কি জাতীয়তাবোধের তলানিও নেই?

আপনারা তান্ত্রিকরা প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলোতে বশীকরণের ঢালাও

বিজ্ঞাপন দেবেন, আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কদের বশ

করা থেকে বিরত থাকবেন—এ সহ্যাতীত !

এ দেশদ্রোহিতা।

আপনরা ভারতবন্ধু সাদ্দাম হুসেনের মহাশত্রু আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বশ করুন। আপনারা নীরব থাকলে জনগণ আপনাদের ‘ভণ্ড’ ও ‘পাষণ্ড’ অথবা ‘অর্থলোভী গণশত্রু’ বলে গাল পাড়বে। প্রতারণার ক্ষেত্রে দক্ষিণভারতের ‘কেপমারি’দের খুব নাম-ডাক। শুনেছি, তাঁরা প্রথমেই শেখান—প্রতারণা করতে হলে গায়ের চামড়া মোটা করতে হবে। জানি না ভারতের কত প্রতারক-সম্প্রদায় এই নীতিকে গ্রহণ করেছেন !

 

মারণ-উচ্চাটন

এবার আপনাদের বলবো তন্ত্রে মারণ-উচ্চাটন কীভাবে করতে হবে। আমি যা বলছি, তা তন্ত্রের কথা। বেশির ভাগ ভারতীয়-ই মনে করেন—এসবে কাজ হয়। এইসব তান্ত্রিক পদ্ধতি পড়ে (যা বিভিন্ন প্রাচীন ও আকর তন্ত্র গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করে লিখছি) বিশ্বাস করবেন কী না, সেটা আপনার ব্যাপার। মারণ-উচ্চাটন মন্ত্রে শত্রুর মৃত্যু ঘটানো যায় কী না, এ বিষয়ে দোলচালে থাকা আপনি পরীক্ষায় নামতেই পারেন। আবার মারণ-উচ্চাটনকে কল্পিত প্রস্তাবনা বা Hypothesis হিসেবে গ্রহণ করাটা পাগলামো মনে করতেই পারেন। সব-ই আপনার অভিরুচি। আমি এবার আমার ভূমিকা পালনে নামি।

বীরতন্ত্রে রয়েছে মারণ-উচ্চাটন পদ্ধতি। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও শত্রুকে তন্ত্রের সাহায্যে মারতে গেলে যা করতে হবে তা এই ধরনের

শনিবার রাতে শ্মশানে যেতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে এক টুকরো কালো কাপড় শ্মশানের শবদাহ করা কাঠকয়লা নিয়ে কালো কাপড়ে মুড়িয়ে লাল সুতো দিয়ে বাঁধতে হবে। এ’বার পুঁটলি ছুঁয়ে এক’শো বার কোনও এক মহাবিদ্যার বীজমন্ত্র জপ করতে হবে। জপ শেষে পুঁটলি শত্রুর ঘরে ফেললে এক সপ্তাহের মধ্যে তার মৃত্যু হবেই।

ফোকারিণীতন্ত্রে বলা হয়েছে, শনিবার রাত-ই মারণ-উচ্চাটন কাজের পক্ষে একমাত্র উপযুক্ত সময়। হলুদ-বাটা ও ক্ষীর একসঙ্গে ভালমত মেশাতে হবে। একটা মানুষের হাড় যোগাড় করতে হবে। হাড়ের ওপর হলুদ ও ক্ষীরের মিশ্রণ দিয়ে বীজমন্ত্র লিখতে হবে। তারপর ওই বীজমন্ত্র এক হাজার বার জপ করে যার বাড়িতে ফেলবেন, দু’মাসের মধ্যে তার মৃত্যু হবেই। হাড় কোনও ক্ষেতে ফেললে সেই ক্ষেতের ফসল মারা যাবে। গ্রামে ফেললে গ্রামের ক্ষতি হবে।

‘মারণ-উচ্চাটন’ এখানেই শেষ। আমি তো শেষ করলাম, আপনি?

 

গভীরে নামছি পিছল সিঁড়ি বেয়ে

সত্যকে জানা ও জানানোর উদ্দেশ্যেই এই বই লেখার তাগিদ অনুভব করেছিলাম। অতীতের অসম্পূর্ণ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ঈশ্বর ও উপাসনা ধর্মের বিশ্বাসগুলো। এ’সব নিয়ে জিজ্ঞাসা থাকা ভালো। আকাডেমিক জিজ্ঞাসা মানব-প্রজাতির উত্তোরণ আনে—ইতিহাস এ’কথাই বলে। অতীত ইতিহাসে গভীরভাবে না ঢুকে, ভালো কোনগুলো, খারাপ কোনগুলো না বুঝেই অতীত ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করাটা অনেক সময় নিজেদের অজ্ঞানতাকেই বে-আব্রু করে। আমাদের ঐতিহ্য তো বহুবিবাহ, সতীদাহপ্রথার মতো অনেক কিছুই ছিল। এগুলো কি গর্ব করার মতো ঐতিহ্য? তাই এইসব কদর্য প্রথাকে আমরা ‘ঐতিহ্য’ হওয়া সত্ত্বেও বিদায় করেছি। বড় কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জয় এসেছে, কু-ঐতিহ্য বিদায় নিয়েছে।

আজ যাঁরা নিজেদের পূর্বপুরুষকে ‘আর্য’ বলে গর্ব অনুভব করেন, আর্যভাষীদের সব কিছুকে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ বলে মনে করেন, আর্য সংস্কৃতির ভিতর গভীর ভাবে না ঢুকেই গদগদ হন, তাঁরা শুধু যুক্তিবিরোধী নন, বিপজ্জনকভাবে প্রগতিবিরোধী। এই সব ভণ্ডপ্রাজ্ঞদের বোকা বানানো খুব সোজা। মুশকিল হল আমাদের এই ‘মহান’ দেশে শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে কোনও বিষয়ে না জেনে সে’বিষয়ে জ্ঞান দানের প্রবণতা বেশি।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মধ্যমেধার মহাযজ্ঞ’ প্রবন্ধে ( দেশ, ১৮ নভেম্বর ২০০২) লিখেছেন, “আমাদের সমাজে এই মাঝারিয়ানার শাসন চলছে, সেই শাসনের দাপট বাড়ছে।” সত্যিই তাই। মধ্যমেধার মানুষের সংখ্যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ—সর্বত্রই বেশি। কিন্তু ও’সব দেশের মধ্যমেধার মানুষদের সঙ্গে আমাদের দেশে মধ্যমেধার মানুষদের একটা স্পষ্ট পার্থক্য আছে। আমেরিকার মধ্যমেধার নাগরিকরা উচ্চমেধার মানুষ আমদানি করেন। আমেরিকাকে যতই গাল-মন্দ করি, তারপরও স্বীকার করতেই হয়—আমেরিকা সবচেয়ে উন্নত দেশ। বাংলাদেশের মধ্যমেধার নাগরিকরা আমেরিকা হয়ে উঠতে পারেনি বটে, তবে একটি বিষয়ে তাদের-ই মতো। স্পষ্টভাষী। কোনও বিষয়ে জানা না থাকলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন—“জানি না”। এইসব স্পষ্টভাষীদের মনে জিজ্ঞাসা আছে। আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চান। জানতে চাওয়ার লজ্জা-জ্বরে আক্রান্ত হন না।

আমাদের দেশের মধ্যমেধার ভণ্ডরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোকা বনেন

স্কুলের চৌকাঠে পাঁচবার হোঁচট খাওয়া গুরু, জ্যোতিষী

বা তান্ত্রিক নামের প্রতারকদের কাছে।

উপাসনা-ধর্ম নিয়ে লিখতে লিখতে ভারতে ঢুকতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে অনেক কিছু। তন্ত্র, যোগ, বশীকরণ ইত্যাদি অনেক কিছু। সবেই গভীর ভাবে ঢুকতে চেয়েছি এই বিশ্বাস নিয়ে—মানুষ সত্যকে জানুক।

এই শহরেরই এক শ্রদ্ধেয় নাট্যকার বলেছিলেন—“সত্য ততটাই প্রকাশিত হয়, যতটা আমরা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাই।” কথাটা হয় তো ঠিক এ’রকম, অথবা একটু অন্য রকম ; কিন্তু অর্থটা একই। কথাটা মনে গেঁথে গেছে। সত্যি। কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যমেধার মানুষদের কথা মাথায় রেখে বিচারে বসলে মনে হয়— কথাটা আংশিক সত্যি। বিবেকানন্দ বা অরবিন্দকে জানতে, তাঁদের দৈর্ঘ্য মেপে নিতে, তাঁদের রচনাবলি-ই যথেষ্ট। রচনাবলীগুলোর বিক্রিও যথেষ্ট। মধ্যবিত্ত ও মধ্যমেধার

মানুষরাই প্রধান ক্রেতা। তাঁরা কেনেন। ঘরে সাজিয়ে রাখেন। পড়েন না। পড়লে সত্য প্রকাশিত হত। বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের স্বরিবোধী চরিত্র, বিজ্ঞান-বিরোধী চরিত্র, আজগুবি সব বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরা চরিত্র প্রকাশিত হত পড়ুয়াদের চোখে। সত্যকে সামনে পেলেও যাঁরা চোখ বুঝে থাকেন, ভণ্ডামীকে জীবনের সার বস্তু ও মহৎ চালাকি মনে করেন, তাঁদের কথা বোধহয় আমার প্রিয় নাট্যকার মাথায় রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। তবে বাঁচোয়া যে গোটা সমাজটা মধ্যবিত্ত ও মধ্যমেধার মানুষে ছেয়ে যায়নি।

‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড জ্যোতিষ নিয়ে। যতদূর মনে হয়, জ্যোতিষীদের সকলেই বইটি কিনেছেন। বইটি কেনার পর কেউ কেউ জ্যোতিষী হয়ে বসেছেন—শুনেছি। আবার বহু মানুষ বইটি পড়ে জ্যোতিষ বিশ্বাসকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। এটাই সত্যি।

পিছল সিঁড়িতে পা রেখেছি। এই গ্রন্থ যেমন উপাসনা-ধর্ম, যোগ-তন্ত্রের ‘মিথ’কে ভাঙবে মানুষের মননে ঢুকে, তেমনই অনেক ঠগ, লোক ঠকাতে এই গ্রন্থের জ্ঞানকে কাজে লাগাবে। তারপরও ঝুকিঁ নিতে হল। গ্রন্থটির ভালো-খারাপ প্রতিক্রিয়া ওজন করে করে ভালোটাই ভারী মনে হল। ভালোর জন্য এটুকু ঝুঁকি নেওয়া যায় ৷ নিতে হয়।

error: Content is protected !!