আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
জি-না স্যার।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ। আপনাকে অ্যারেস্ট করা হয় নাই। বুঝতে পারছেন?
পারছি স্যার।
আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার। উনি যদি একটা Death note রেখে যেতেন, তাহলে কোনো ঝামেলা হতো না। আপনাকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করতাম না।
স্যার, এক গ্লাস পানি খাব।
অবশ্যই। চা দিতে বলব? চা খাবেন?
স্যার, আমার চায়ের নেশা নেই।
আপনার স্ত্রী, উনার কি চায়ের নেশা ছিল?
তেমন না।
তার আত্মহত্যার ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল আরেকবার বলুন। আগেও বলেছেন, আবার শুনি। পানি খান। পানি খেয়ে বলুন।
জহিরের সামনে পানির গ্লাস রাখা হয়েছে। জহির মাত্র দুই চুমুক পানি খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখল। তার অস্থির লাগছে। যদিও অস্থির লাগার কিছু নেই। যে
ওসি সাহেব প্রশ্ন করছেন তার চেহারা অতি দ্র। তার গায়ে পুলিশের ইউনিফর্মও নেই। তিনি পান খাচ্ছেন। পান খাওয়া মানুষরা শান্ত প্রকৃতির হয়। জহির ওসি সাহেবের মুখোমুখি বসে নি। কোনাকুনি বসেছে। সে ওসি সাহেবের সামনেই বসতে চাচ্ছিল। ওসি সাহেব বললেন, এই চেয়ারটা ভালো না। গদি ছিঁড়ে গেছে। অপিনি এই চেয়ারে বসুন।
ঘরটা ছোট। দুটা জানালার একটা বন্ধ। ঘরভর্তি ফাইলপত্র। মেঝেতেও অনেক ফাইল ছড়ানো। মনে হয় এই ঘরটা গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান আছে। সিলিং ফ্যানে ময়লা জমে কুচকুচে কালো হয়ে আছে। ফ্যান ঘুরছে, কিন্তু তেমন বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঘরের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে–ঘরভর্তি টিকটিকি। অনেকে টিকটিকি ঘেন্না করে। সে করে না। শায়লা করত। বিয়ের রাতে বাসরঘরে শায়লার শাড়িতে একটা টিকটিকি উঠে পড়েছিল। শায়লা ও মাগো! বলে এমন চিৎকার দিয়েছিল যে চারদিক থেকে লোকজন এসেছে। শায়লার মা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলেছেন, কী হয়েছে? এই শায়লা কী হয়েছে? লজ্জার ব্যাপার হয়েছিল।
জহির সাহেব শুরু করুন।
কী শুরু করব?
ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল, অর্থাৎ আপনি কখন জানলেন, আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন?
আমাদের ফ্ল্যাটে দুটা শোবার ঘর। সেই রাতে আমাদের সামান্য ঝগড়া হয়েছিল। দুজন দুঘরে শুয়েছি। ভোরবেলা তাকে ডাকতে গিয়ে দেখি, ভেতর . থেকে তালাবন্ধ। তখন দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সিলিং ফ্যানে। শাড়ি পেঁচিয়ে সে ঝুলছে।
আপনি তো একা দরজা ভাঙেন নি। আপনার সঙ্গে লোজন ছিল।
জি বাড়িওয়ালা ছিল। বাড়িওয়ালার এক শালা নাসিম ছিল।
ওরা কি নিজের থেকেই এসেছিল, না-কি আপনি ওদের ডেকে এনেছেন?
আমি ডেকে এনেছি। আমার একার পক্ষে দরজা ভাঙা সম্ভব ছিল না। নাসিম খুব শক্তিশালী। নিয়মিত ব্যায়াম করে। সে-ই দরজা ভাঙে।
পুলিশে কখন খবর দিয়েছেন?
ঠিক সময়টা বলতে পারব না। বাড়িওয়ালা খবর দিয়েছিলেন।
ঝগড়া কী নিয়ে হয়েছিল?
তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল স্যার। তার এক মামাতো ভাই সুমনের জন্মদিন। তারা থাকে চিটাগাং-এ। শায়লা জন্মদিনে যাবে। আমি যাব না।
আপনি যাবেন না কেন?
আমি ছুটি পাচ্ছিলাম না। শায়লা বলল, সে একাই যাবে। এই নিয়ে রাগারাগি।
জন্মদিনটা কবে?
আজই সেই ছাতার জন্মদিন।
এক কাপ চা কি খাবেন? আপনার চায়ের অভ্যাস নেই জানি। তারপরেও এক কাপ হয়তো ভালো লাগবে। সিগারেট খাবেন?
জি সিগারেট খাব।
সাবধানে ছাই ফেলবেন। চারদিকে কাগজপত্র।
ওসি সাহেব চা দিতে বললেন। সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিলেন। নিজে পানের কৌটা বের করে পান মুখে দিলেন।
আপনার স্ত্রীর মামাতো ভাই সুমন, যার জন্মদিনে যাওয়া নিয়ে এত বড় দুর্ঘটনা, তার বাবার নাম কী?
ফরিদ উদ্দিন।
উনি কী করেন?
ব্যবসা করেন। চায়না থেকে ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র এনে বিক্রি করেন।
এত বড় দুর্ঘটনার খবর কি আপনি ফরিদ সাহেবকে জানিয়েছেন?
জি জানিয়েছি। স্যার, একই ধরনের প্রশ্ন আপনি আমাকে আগেও দুবার করেছেন।
ভাই, আমাদের পুলিশের এই সমস্যা। একই প্রশ্ন আমরা দুদিন পর পর করতে থাকি। যদি উত্তরে কোনো বেশকম হয়। যে সত্যি কথা বলবে সে একই উত্তর দেবে। যে মিথ্যা বলবে তার স্মৃতিশক্তি খারাপ হলে একেক দিন একেক জবাব দিবে।
আমি কি এরকম কিছু করছি?
অবশ্যই না। চা-সিগারেট খান। ইচ্ছা করলে জর্দা দিয়ে একটা পানও খেতে পারেন। মিষ্টি চায়ের পর পানি খেতে ভালো লাগে।
জহির চা-সিগারেট শেষ করে একটা পান মুখে দিল।
আপনার স্ত্রী কি পান খেতেন?
হঠাৎ হঠাৎ। আনন্দের কোনো ঘটনা ঘটলে, বিয়ে বাড়িতে গেলে, কোনো উৎসবে।
আপনাদের ঝগড়াটা শুরু হলো কখন?
রাত দশটার দিকে। ঘড়ি দেখে তো কেউ ঝগড়া করে না। Exact সময় বলতে পারব না।
ওসি সাহেবের কাছে একটা টেলিফোন এসেছে। তিনি বললেন, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে একটু বসতে বলুন। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে আমার কথা বলা শেষ হবে। টেলিফোন শেষ করে তিনি হাতের ঘড়ি দেখলেন। জহিরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
জহির বলল, স্যার, আপনার ঘরভর্তি টিকটিকি।
ওসি সাহেব বললেন, আপনি টিকটিকি ভয় পান?
আমি ভয় পাই না। আমার স্ত্রী শায়লা খুব ভয় পেত। বাসররাতে তার শাড়িতে একটা টিকটিকি উঠে পড়েছিল। সে ভয়ে আধমরা হয়ে টান দিয়ে শাড়ি খুলে ফেলে ও মাগো বলে বিকট চিৎকার করেছে। সবাই ভেবেছে না জানি কী। আমি বিরাট লজ্জায় পড়েছিলাম।
লজ্জায় পড়ারই কথা।
শায়লা সবসময় বলত সে এমন একটা দেশে বাস করতে চায় যেখানে টিকটিকি নেই।
এমন দেশ কি আছে?
শীতের দেশে টিকটিকি থাকে না। আমেরিকা, ইংল্যান্ড। আমার পক্ষে তো তাকে ঐসব দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
জহির চোখ মুছতে মুছতে বলল, তবে এখন সে যেখানে আছে সেখানে। নিশ্চয়ই টিকটিকি নেই। স্যার যদি কিছু মনে না করেন তাহলে টিকটিকি নিয়ে
একটা অন্যায় রসিকতা শায়লার সঙ্গে করেছিলাম, সেই গল্পটা বলি?
বলুন।
আমাদের প্রথম ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে তাকে একভরি সোনার একটা টিকটিকির লকেট বানিয়ে গিফট দিয়েছিলাম। সে খুবই কান্নাকাটি করেছিল। এখন ভেবেই খারাপ লাগছে।
ওসি সাহেব টিসু পেপারের বাক্স এগিয়ে দিলেন। জহির চোখ মুছল। ওসি সাহেব বললেন, প্রশ্ন-উত্তরের ঝামেলাটা শেষ করে ফেলি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বসে আছেন।
জহির চোখে টিসু চাপা দিয়ে হা-সূচক মাথা নাড়ল।
দুজন ঘুমুতে গেছেন তখন ঝগড়া শুরু হলো?
হুঁ।
এক পর্যায়ে আপনি নিজের শোবার ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন?
জি।
ঘুম হয়েছিল, না-কি নিঘুম রাত কেটেছে?
দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি।
এক ঘুমে রাত কার?
জি।
জহির সাহেব, আপনার মোবাইল টেলিফোন আমরা চেক করেছি। দেখা গেছে আপনি সারারাতই কাউকে না কাউকে টেলিফোন করেছেন। আর আপনার ঘরেও প্রচুর সিগারেটের টুকরা পাওয়া গেছে। সর্বমোট সতেরোটা। আপনি তো সিগারেট খান না। ঐ দিন মনে হয় এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিলেন।
জহির জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। ওসি সাহেব বললেন, আপনার স্ত্রীর মামাতো ভাই সুমনকে আপনার স্ত্রী মোবাইল ফোনে একটা এসএমএস পাঠিয়েছেন। সেখানে লেখা আপনারা রাতের বাসে রওনা হচ্ছেন। এই বিষয়ে কিছু জানেন?
না।
বিভিন্ন বাস কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে যে বাস কোম্পানির টিকিট কেটেছেন সেটা আমরা বের করেছি।
টিকিট কাটলেও অফিস ছুটি দিচ্ছিল না।
আপনার টিকিট বৃহস্পতিবার রাতের। রিটার্ন টিকিট শনিবারের। অফিস শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকে।
স্টেশন লিভ করতেও অনুমতি লাগে।
আপনার স্ত্রীর গায়ে ছিল ঝলমলে শাড়ি। মুখে মেকাপ। চোখে কাজল। যেন তিনি বেড়াতে যাবার জন্যে তৈরি। এই পোশাকে কেউ ঘুমুতে যায় না।
জহির চুপ করে থাকল।
ওসি সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, খুন আপনি করেছেন। কীভাবে করেছেন সেই বিষয়ে একটা স্টেটমেন্ট দিন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আগেই খবর দিয়ে রেখেছি। উনি আপনার সঙ্গে থাকবেন। স্টেটমেন্ট তৈরিতে সাহায্য করবেন।
ওসি সাহেব ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। জহির চুপচাপ বসে আছে। একটা টিকটিকি টেবিলের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে। ঘাড় কাত করে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে জহিরের দিকে।
“আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ” সমগ্র সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ