শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি স্কুল, কলেজের প্রথাগত শিক্ষা। এই শিক্ষা চলে নির্ধারিত পাঠ্যসূচি মেনে। জীবিকার প্রয়োজনে পরীক্ষায় পাস করতে চাই আমরা। তাই পড়ি। পড়ার পিছনে ‘জীবিকা’ মোটিভেশন। তার সঙ্গে এটাই আমাদের মাথায় গেঁথেই আছে যে—এখন ক্লাশ নাইনে উঠলাম, ক্লাশ এইটের ইতিহাস-ভূগোল ইত্যাদি অনেক কিছুই আর মনে রাখার প্রয়োজন নেই। অবচেতন মন অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিকে বাতিল করে দেয়।
কেমিস্ট্রিতে এম এস সি করা সুজিত গুহ ব্যাঙ্কে ঢুকলেন ক্লার্ক হয়ে। ব্যাঙ্কের ডেপাচ সেকশনে চিঠি ‘সর্ট’ করে খোপে ঢোকাতে ঢোকাতে কেমিস্ট্রির প্রায় সব শিক্ষাই ভুলে বসলেন। আমার ছেলে ক্লাশ নাইনে ওঠায়, সপ্তাহে একটা দিন কেমিস্ট্রি পড়াবার অনুরোধ করেছিলাম। সুজিত বলেছিলেন-ধু-র, কিছু মনে নেই । আমার দ্বারা হবে না। এইভাবে চর্চার অভাবে, সঠিক পেশার অভাবে, বহু মানুষের বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়, প্রতিভার অকালমৃত্যু হয়।
জ্ঞান বলতে আমরা বুঝি দীর্ঘ কালের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। একজন কৃষক তাঁর শৈশব থেকে নিজে হাতে নিজের জমিতে চাষ করছেন। তিনি জানেন কোন্ ফসল চাষ করলে জমিটায় কী ধরনের মাটি বা সার মেশাতে হবে। কোন্ বীজ ভালো, কোল্টা খারাপ। জানেন, কখন কতটা জল সেচের প্রয়োজন। কখন কীভাবে কতটা কীটনাশক দিতে হবে। তাঁর এই বিস্তৃত কৃষি জ্ঞান থাকার পরও আমরা শহুরে বাবুরা তাঁকে জ্ঞানী মনে করি না। কারণ, আমাদের মগজে ঢুকে রয়েছে—স্কুল কলেজের প্রথাগত বিদ্যে না থাকলে জ্ঞানী হওয়া যায় না।
বাংলার কীট-পতঙ্গ নিয়ে বহু প্রবন্ধ লিখেছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। তাঁর এই জ্ঞান আজ স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত হয়েছে কয়েক শো প্রবন্ধ। কলেজ-ইউভার্সিটির প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই তিনি আজ ‘জ্ঞানী’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন গুণীজনের।
রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভা আমাদের অবাক করে। প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি যতটা স্বশিক্ষিত ছিলেন, আজ পর্যন্ত তাঁর ধারে কাছে যাওয়ার মতো প্রতিভার দেখা আমরা পাইনি। সমরেশ বসু থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেউ-ই গ্রাজুয়েট ছিলেন না। অথচ বাংলায় এম এ পড়তে গেলে তাঁদের লেখা না পড়ে উপায় নেই।
শিক্ষা জ্ঞানকে পরিমার্জন ও তীক্ষ্ণ করতে পারে। আবার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, আগ্রহ মোটিভেশন এবং নিষ্ঠা একজনকে জ্ঞানী মানুষে পরিণত করে। এই কথা যেমন বহু ক্ষেত্রে সত্য, তেমন সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যেমন, খেলাধুলায় আন্তর্জাতিক মানে উঠতে হলে কোচিং বা শিক্ষা জরুরি। ফুটবল, টেনিস, জিমনাস্টিক, সাঁতার, লংজাম্প বা দৌড়—যে কোনও খেলার বেলায় আধুনিকতম কোচিং অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। একইভাবে আরও বহু ক্ষেত্রেই জ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রতিভা বিকাশের সঙ্গে মনসংযোগের সম্পর্ক বড়ই নিবিড়
আসল নাম প্রকাশে অসুবিধে আছে। ধরে নিন, নাম জিৎ। জিৎ সুদর্শন ও স্মার্ট যুবক। নামী কলেজের ছাত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। এমন ছাত্র পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় ফেল। বাবা ও মা দু’জনেই একমাত্র সন্তানের এমন পতনে ভেঙে পড়লেন। দু’জনেই আমার বন্ধু। দু’জনেই চাকুরে। ছেলের বিষয়ে আমার সাহায্য চাইলেন। বললাম, জিৎ-কে আমার কাছে পাঠাতে। কিছু দিন আমার সঙ্গে ঘুরুক।
ঘোরাঘুরি, পত্রিকা, সেমিনার সবেই জিৎ আমার সঙ্গী। আমার অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গেও ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানান বিষয়ে ঢুকতাম। আলোচনায় বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের নাম উঠে আসতো। তাঁরা নারী সঙ্গের তীব্র ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টিতে অসাধারণ। আবার অসাধারণ সম্ভাবনার পরিসমাপ্তিও ঘটতে দেখেছি। নারী লিপ্সা তাঁদের প্রতিভাকে গ্রাস করেছে। সব সময় শুধুমার যৌনচিন্তায় আত্মমগ্ন থাকলে, অন্য কাজে গভীর মনোযোগ অসম্ভব ।
এক একজন করে লেখক, খেলোয়াড়, সিনেমার ডিরেক্টর, পেন্টারের নাম টেনে এনেছি। এদের মধ্যে অনেকেই যখন যা করেছেন, তাতে সমস্ত মনপ্রাণ লাগিয়ে করেছেন
যখন শিল্প কর্মে বা খেলায় মনসংযোগ করেছেন, তখন ভোগ চিন্তার
স্মৃতি মুহূর্তের জন্যেও চিন্তায় আনেননি। যাঁরা এমনভাবে
নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাঁরাই পেরেছেন
সৃষ্টিতে অসাধারণ হয়ে উঠতে। যাঁরা মুহূর্তে ভোগ
থেকে সৃষ্টিতে পুরোপুরি মনকে ডুবিয়ে দিতে
পেরেছেন, তাঁরাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সফল
হয়ে উঠতে পেরেছেন।
যাঁরা লাম্পট্যের স্মৃতিকে মুহূর্তে বিদায় দিয়ে সৃষ্টিতে পরিপূর্ণভাবে মন ঢেলে দিতে পারেননি, তাঁদের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ হয়েছে।
কিছু ছাত্র আছে, যারা শুধুমাত্র বইয়ের পোকা। কিছু ছাত্র আছে যারা দারুণ রেজাল্ট করে, কিন্তু আড্ডা, প্রেম, সিনেমা, টিভি, খেলার মাঠ থেকে ডিস্কো–সাবেই আছে। এরপরও তারা ভালো রেজাল্ট করছে। কারণ ওরা যখন পড়তে বসে, তখন অন্য কোনও চিন্তাই ওদের মনযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। ওরা ইচ্ছেমতো মনকে বিষয় থেকে বিষয়ে নিবিষ্ট করতে পারে।
জিৎ একদিন আমার কাছে বলে ফেললো তার চেপে রাখা মনের কথা। বাড়িতে মা-বাবা আর ও ছাড়া থাকে একজন পুরো সময়ের মধ্যবয়সী মহিলা। রান্না করা প্রধান কাজ। দুপুরে মাঝে-মধ্যে কলেজ অফ থাকলে, খেলা না থাকলে বাড়িতেই থাকতো। মহিলা জিৎ-কে প্রলুব্ধ করে ও দু’জনে মিলিত হয়। কিছু দিন মিলনটা ছিল নেশা। তারপর থেকে সর্বক্ষণের চিন্তায় ঘুরে ফিরে আসতে থাকে মিলন দৃশ্য।
শেষপর্যন্ত মহিলাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয় অন্য অজুহাতে। আমার কাউনসেলিং-এ জিৎ আবার স্বমহিমায় ফেরে। বর্তমানে সফল অধ্যাপক। ওর দৈনন্দিন রোজ-নামচা আমি জানি না। কিন্তু এটুকু জানি—ও ইচ্ছেমতো খেলা থেকে লেখাপড়ায় মনসংযোগ করতে পারছে।
প্রথম পর্বঃ মনের নিয়ন্ত্রণ
অধ্যায়ঃ এক
♦ বুদ্ধি, স্মৃতি, প্রতিভা নিয়ে বিভ্রান্তি বেচে খাচ্ছে অনেকে
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রচুর পড়েন মানে-ই মস্তিষ্কচর্চা করেন?
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্মৃতি-শক্তি ও প্রতিভা এক নয়
অধ্যায়ঃ চার
♦ জ্ঞান (wisdom) ও শিক্ষা (education) এক নয়
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ মস্তিষ্ক ও তার কিছু বৈশিষ্ট্য
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ পাভলভ-তত্ত্বে মস্তিষ্কের ‘ছক’ বা type
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত কিছু পাল্টে যায়
অধ্যায়ঃ নয়
♦ অলজাইমারস সৃষ্টিশীল মেধায় ভয়ঙ্কর অসুখ
অধ্যায়ঃ দশ
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জিন বা বংশগতি-ই ঠিক করে মেধা-বুদ্ধি?
অধ্যায়ঃ বারো
♦ বংশগতি গবেষণা ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতি
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ মগজধোলাই-এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলেছে
দ্বিতীয় পর্বঃ ধ্যাণ-যোগ-সমাধি মেডিটেশন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘রজনীশ’ এক শিক্ষিত যোগী, বিতর্কিত নাম
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ সাত
♦ শ্রীমাতাজী নির্মলা দেবীর সহজযোগ
অধ্যায়ঃ আট
♦ রিল্যাক্সেশন, মেডিটেশন নিয়ে বাংলাদেশের যোগী মহাজাতক
অধ্যায়ঃ নয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
অধ্যায়ঃ দশ
♦ ‘মেডিটেশন’, ‘রিলাক্সেশন’, বা ‘স্বসম্মোহন’
অধ্যায়ঃ এগারো
“মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ-মেডিটেশন” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ