শ্লোকঃ ২৮
দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাপরে ।
স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ ॥ ২৮ ॥
দ্রব্যযজ্ঞাঃ— দ্রব্য অপূর্ণরূপ যজ্ঞ; তপোযজ্ঞাঃ— তপস্যার মাধ্যমে যজ্ঞ; যোগযজ্ঞাঃ —অষ্টাঙ্গ যোগরূপী যজ্ঞে, তথা— তেমনই; অপরে অন্যেরা স্বাধ্যায় — বেদ অধ্যয়নরূপ যজ্ঞ, জ্ঞানযজ্ঞাঃ— দিব্যজ্ঞান লাভরূপ যজ্ঞ; চ–ও; যতয়ঃ— তত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ; সংশিতব্রতাঃ —কঠোর ব্রতপরায়ণ।
গীতার গান
দ্রব্যযজ্ঞ তপোযজ্ঞ যোগযজ্ঞ যত ।
স্বাধ্যায় যোগীর জ্ঞান শংসিত সে ব্রত ৷।
অনুবাদঃ কঠোর ব্রত গ্রহণ করে কেউ কেউ দ্রব্য দানরূপ যজ্ঞ করেন। কেউ কেউ তপস্যারূপ যজ্ঞ করেন, কেউ কেউ অষ্টাঙ্গ যোগরূপ যজ্ঞ করেন এবং অন্য অনেকে পারমার্থিক জ্ঞান লাভের জন্য বেদ অধ্যয়নরূপ যজ্ঞ করেন।
তাৎপর্যঃ এই সমস্ত যজ্ঞকে নানা রকম শ্রেণীবিভাগ করা যেতে পারে। অনেক লোক আছে, যারা নানা রকম দান-ধ্যান করার মাধ্যমে যজ্ঞ সম্পন্ন করে। ভারতবর্ষে অনেক ধনী-বণিক ও রাজ-পরিবারের লোক আছেন, যাঁরা ধর্মশালা, অন্নক্ষেত্র, অতিথিশালা, অনাথাশ্রম, বিদ্যাপীঠ আদি নানা রকম দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য দেশেও হাসপাতাল, বৃদ্ধদের আশ্রয়-ভবন এবং এই ধরনের নানা রকম দাতব্য সংস্থা রয়েছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে দুঃস্থ-দরিদ্রদের খাদ্যসামগ্রী দান করা, শিক্ষা দান করা ও ঔষধ বিতরণ করা। এই সমস্ত দানকর্মকে বলা হয় দ্রব্যময়-যজ্ঞ। অনেক লোক আছেন যাঁরা উন্নততর জীবন অথবা স্বর্গারোহণ করবার জন্য চন্দ্রায়ণ, চাতুর্মাস্য আদি স্বেচ্ছামূলক তপশ্চর্যার অনুশীলন করেন। এই সমস্ত পন্থায় বিশেষ বিধি-নিষেধের মাধ্যমে জীবনযাত্রাকে পরিচালিত করবার জন্য কঠোর ব্রত পালন করতে হয়। যেমন, চাতুর্মাস্য ব্রত পালনকারী চার মাস দাড়ি কামান না, নিষিদ্ধ জিনিস আহার করেন না, দিনে একবারের বেশি দুবার আহার গ্রহণ করেন না, অথবা কখনও গৃহ পরিত্যাগ করেন না। এভাবেই সাংসারিক সুখ পরিত্যাগ করাকে বলা হয় তপোময়-যজ্ঞ। আর এক ধরনের লোক আছেন, যাঁরা ব্রহ্মৈক্য লাভ করবার জন্য পাতঞ্জল-যোগ, হঠযোগ ও অষ্টাঙ্গযোগ আদির অনুশীলনে প্রবৃত্ত থাকেন। কেউ আবার সমস্ত পবিত্র তীর্থে ভ্রমণ করেন। এই সমস্ত ক্রিয়াকে বলা হয় যোগ-যজ্ঞ, অর্থাৎ এই জড় জগতে বিশেষ ধরনের সিদ্ধি লাভের জন্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা। অনেকে আছেন, যাঁরা নানা রকম বৈদিক শাস্ত্র, বিশেষ করে উপনিষদ, বেদান্ত-সূত্র অথবা সাংখ্য-দর্শন পাঠ করেন। এগুলিকে বলা হয় স্বাধ্যায়-যজ্ঞ। এই সমস্ত যোগীরা শ্রদ্ধা সহকারে বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞে নিয়োজিত এবং তাঁরা উচ্চতর জীবনের অভিলাষী। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত এই সমস্ত যজ্ঞ থেকে ভিন্ন, কারণ তা হচ্ছে পরম রসমাধুর্যপূর্ণ ভগবানের সাক্ষাৎ সেবা। উপরোক্ত কোন প্রকার যজ্ঞের মাধ্যমে এই কৃষ্ণভাবনামৃত বা ভক্তিযোগ লাভ করা যায় না, তা লাভ করা যায় কেবল ভগবান ও তার শুদ্ধ ভক্তের কৃপার ফলে। তাই, কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে দিবা, অপ্রাকৃত।
শ্লোকঃ ২৯
অপানে জুহুতি প্রাণং প্রাণেঽপানং তথাপরে।
প্রাণাপানগতী রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ।
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্ প্রাণেষু জুহুতি ॥ ২৯ ৷৷
অপানে—অধোগামী বায়ুতে; জুহুতি – আহুতি দেন; প্রাণম্ — ঊর্ধ্বগামী বায়ুকে; প্রাণে-ঊর্ধ্বগামী বায়ুতে; অপানম্ অধোগামী বায়ুকে; তথা — তেমনই; অপরে— অপর কেউ; প্রাণ— প্ৰাণবায়ু; অপান — অপান বায়ু; গতী — গতি; রুদ্ধা—নিরোধ করে; প্রাণায়াম— শ্বাস-প্রশ্বাস সংযমের মাধ্যমে প্রাণায়াম; পরায়ণাঃ—পরায়ণ ; অপরে—অপর কেউ; নিয়ত নিয়ন্ত্রিত করে; আহারাঃ—আহার: প্রাণান্ প্রাণবায়ুকে; প্রাণেষু – প্রাণবায়ুতে; জুহুতি—আহুতি প্রদান করেন।
গীতার গান
প্রাণাপান যোগক্রিয়া অপানে হবন ।
প্রাণাপান গতিরুদ্ধ প্রাণায়ামী হন ॥
আহারাদি খর্ব করি নিয়ত আহার ।
প্রাণকে প্রাণেতে দেয় হোমের আকার ।।
অনুবাদঃ আর যাঁরা প্রাণায়াম চর্চায় আগ্রহী, তাঁরা অপান বায়ুকে প্রাণবায়ুতে এবং ং প্রাণবায়ুকে অপান বায়ুতে আহুতি দিয়ে অবশেষে প্রাণ ও অপান বায়ুর গতি রোধ করে সমাধিস্থ হন। কেউ আবার আহার সংযম করে প্রাণবায়ুকে প্রাণবায়ুতেই আহুতি দেন।
তাৎপর্যঃ যোগে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের প্রণালীকে বলা হয় প্রাণায়াম। প্রাথমিক স্তরে হঠযোগে বিভিন্ন প্রণালী অভ্যাস করার মাধ্যমে এই প্রাণায়ামের অনুশীলন করা হয়। ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করে পারমার্থিক উন্নতি সাধন করবার জন্য এই সমস্ত বিধি বিধান দেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত ক্রিয়া অনুশীলন করার ফলে দেহস্থিত বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করে বিপরীত দিকে চালিত করা হয়। অপান বায়ুর গতি নিম্নমুখী এবং প্রাণবায়ুর গতি ঊর্ধ্বমুখী। প্রাণায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে যোগী এই বায়ু দুটিকে বিপরীত মুখে চালিত করে তাদের বেগকে দমন করেন এবং ‘পূরকে’ তাদের ভারসাম্যের সৃষ্টি করেন। এভাবেই নিঃশ্বাসকে যখন প্রশ্বাসে অর্পণ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ‘রেচক। দুটি বায়ুর গতিকে যখন স্থির করা হয়, তখন তাকে বলা হয় ‘কুন্তুক’। এই কুম্ভকের অনুশীলনের ফলে যোগীরা পারমার্থিক উপলব্ধির পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে তাঁদের আয়ু বৃদ্ধি করতে পারেন। প্রবুদ্ধ যোগী একই জন্মে পারমার্থিক উপলব্ধির চরম পূর্ণতা লাভ করতে চান, পরবর্তী জন্মের জন্য প্রতীক্ষা করতে ইচ্ছা করেন না। সেই জন্য, কুম্ভক-যোগ সাধনার মাধ্যমে যোগীরা বহু বহু বছর আয়ু বৃদ্ধি করে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ভক্তিযোগে নিত্যযুক্ত কৃষ্ণভক্ত অপ্রাকৃত ভগবৎ-প্রেমে মগ্ন থাকার ফলে, অনায়াসে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করতে সক্ষম হন। তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি সর্বক্ষণ ভগবানের সেবায় নিয়োজিত থাকে, তাই আর তিনি বিষয়ে প্রবৃত্ত হন না। সুতরাং জীবনের শেষে, তিনি অনায়াসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় স্তরে প্রবেশ করেন। বিভিন্ন যোগক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর আয়ুকে বর্ধিত করে বহু দিন এই জড় জগতে বাস করার কোন বাসনাই তাঁর থাকে না। সর্ব অবস্থাতেই তিনি মুক্ত পুরুষ। সেই সম্বন্ধে ভগবদ্গীতায় (১৪/২৬) বলা হয়েছে—
মাং চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্ৰহ্মভূয়ায় কল্পতে ॥
“যিনি ভগবানের প্রতি শুদ্ধ ভক্তিমূলক সেবায় নিয়োজিত থাকেন, তিনি জড়া প্রকৃতির গুণগুলিকে অতিক্রম করেন এবং অচিরেই চিন্ময় স্তরে উন্নীত হন।” প্রকৃতপক্ষে, কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শুদ্ধ ভক্ত জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন। ব্রহ্মভূত স্তর থেকেই কৃষ্ণভাবনামৃতের শুরু হয়। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত মহাত্মারা তাই সর্বদাই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত। এই স্তর থেকে তিনি কখনই পতিত হন না এবং অন্তকালে অবিলম্বে তিনি ভগবানের চিন্ময় ধামে নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হন। কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করেন বলে তিনি সর্বদাই অল্পাহারী এবং তার ফলে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলি সর্বদাই সংযত। আর ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত না করতে পারলে কোন মতেই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না।
শ্লোক ৩০
সর্বেহপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষপিতকল্মষাঃ।
যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্ ৷৷ ৩০ ॥
সর্বে—সকলে; অপি—আপাতদৃষ্টিতে পৃথক হলেও; এতে —এঁরা সকলে; যজ্ঞবিদঃ —যজ্ঞবিদ; যজ্ঞক্ষপিত – যজ্ঞ অনুষ্ঠানের ফলে নির্মল হয়ে; কল্মষাঃ — পাপ থেকে; যজ্ঞশিষ্ট—এই প্রকার যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফল; অমৃতভুজঃ—অমৃত ভোজনকারীরা; যান্তি—লাভ করেন; ব্রহ্ম – পরম; সনাতনম্—সনাতন প্রকৃতি।
গীতার গান
এই সব তত্ত্ববিৎ ক্ষীণ পাপ হয় ৷
ক্রমে ক্রমে পাপহীন ব্রহ্ম সে প্রাপয় ।।
যজ্ঞনিষ্ঠ ভোজী তারা নিষ্পাপ জীবন ৷
যোগ্য ব্যক্তি হয় লাভে ব্ৰহ্ম সনাতন ॥
অনুবাদঃ এঁরা সকলেই যজ্ঞতত্ত্ববিৎ এবং যজ্ঞের প্রভাবে পাপ থেকে মুক্ত হয়ে তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত আস্বাদন করেন, এবং তার পর সনাতন প্রকৃতিতে ফিরে যান।
তাৎপর্যঃ যজ্ঞাদি সম্পর্কিত পূর্বোক্ত বর্ণনায় জানতে পারা যায় যে, দ্রব্যময় যজ্ঞ, তপোময়- যজ্ঞ, যাগ-যজ্ঞ, স্বাধ্যায় যজ্ঞ আদি অনুষ্ঠানের সাধারণ উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্দ্রিয় সংযম করা। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনাই হচ্ছে ভবরোগের মূল কারণ। তাই, ইন্দ্রিয়- সুখের ভোগবাসনা পরিত্যাগ না করতে পারলে সচ্চিদানন্দময় জীবনের স্তরে উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। এই স্তর হচ্ছে শাশ্বত ব্রহ্ম পরিবেশ। পূর্বোক্ত সব কয়টি যজ্ঞ পাপপূর্ণ জীবনের কলুষ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে সাহায্য করে। এই আত্মোন্নতির দ্বারা কেবল এই জীবনেই সুখ-বৈভবের প্রাপ্তি হয়, তাই নয়, তা ছাড়া এই জীবনের শেষে নির্বিশেষ ব্রহ্মৈক্য লাভ অথবা ভগবৎ-ধামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ হয়।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ