শ্লোকঃ ২৫

দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্যুপাসতে ৷

ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহুতি ॥ ২৫ ॥

দৈবম্—দেবতাদের পূজায়; এব—এভাবে, অপরে — অন্য অনেকে; যজ্ঞম্— যজ্ঞ; যোগিনঃ— যোগিগণ: পর্যুপাসতে – যথাযথভাবে উপাসনা করেন; ব্রহ্ম — চিন্ময় তত্ত্বরূপ; অগ্নৌ—অগ্নিতে; অপরে – অন্যেরা, যজ্ঞম্—যজ্ঞ; যজ্ঞেন — যজ্ঞের দ্বারা; এব—এভাবে; উপজুহুতি — আহুতি প্রদান করেন।

গীতার গান

দৈব যজ্ঞ করে পরে সেও যোগী হয় ।

ব্রহ্মজ্ঞানী সেও যোগী হোমাদি নিলয় ৷।

অনুবাদঃ কোনও কোনও যোগী দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার মাধ্যমে তাঁদের উপাসনা করেন, আর অন্য অনেকে ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে সব কিছু নিবেদন করার মাধ্যমে যজ্ঞ করেন।

তাৎপর্যঃ পূর্বের বর্ণনা অনুসারে, কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে যিনি তাঁর কর্তব্য পালন করেন, তাঁকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। কিন্তু এমনও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা দেবোপাসনা করার জন্য অনুরূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা ব্রহ্ম অথবা ভগবানের নির্বিশেষ রূপের উদ্দেশ্যে সব কিছু উৎসর্গ করেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, বিভিন্ন লোকে বিভিন্নভাবে যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে যজ্ঞ কেবল ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে তুষ্ট করার জন্য অনুষ্ঠিত হয় এবং বিষ্ণুর আর এক নাম যজ্ঞ। সমস্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠানকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। তার একটি হচ্ছে জড় সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য এবং অন্যটি হচ্ছে ভগবানকে জানবার জন্য। যাঁরা প্রকৃতই জ্ঞানী, যাঁরা ভগবানের ভক্ত, তাঁরা ভগবানকে তুষ্ট করার জন্য তাঁদের সব কিছুই ভগবানের চরণে অর্পণ করেন। কিন্তু আর এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা আরও বেশি করে জড় সুখভোগ করবার জন্য ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ আদি দেবতাদের উপাসনা করে যজ্ঞ করেন। এই সমস্ত দেবতারা হচ্ছেন অগ্নি, বায়ু, জল, বজ্র আদি প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির পর্যবেক্ষক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই তাঁদের এই সমস্ত দায়িত্বশীল কর্মে নিয়োগ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, এই সমস্ত শক্তি ভগবানেরই শক্তি, এগুলি কোন দেবতার নিজস্ব শক্তি নয়। তবে ভগবানের আদেশ অনুসারে তাঁরা এই সমস্ত শক্তির পরিচালনা করেন। যারা জড় সুখভোগ করার জন্য বৈদিক কর্মকাণ্ড অনুসারে বিভিন্ন যজ্ঞের দ্বারা দেব-দেবীর পূজা করে, তাদের বলা হয় ‘বহু-ঈশ্বরবাদী’। আর এক শ্রেণীর অধ্যাত্মবাদী আছেন, যাঁরা পরম তত্ত্বের নির্বিশেষ রূপের উপাসনা করেন এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর অনিত্যতা অনুভব করে ব্রহ্মজ্যোতিতে তাঁদের পৃথক সত্তা উৎসর্গ করে ব্রহ্মে লীন হয়ে যান। এই সমস্ত নির্বিশেষবাদীরা ব্রহ্মতত্ত্বের চিন্ময় স্বরূপ উপলব্ধি করবার জন্য দার্শনিক মনোধর্মের পন্থা অবলম্বন করেন। পক্ষান্তরে, সকাম কর্মী ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধনের জন্য তাঁর জাগতিক সম্পদ উৎসর্গ করেন, আর নির্বিশেষবাদী ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যাবার জন্য তাঁর জড় উপাধিসমূহ উৎসর্গ করেন। নির্বিশেষবাদীদের কাছে যজ্ঞাগ্নি হচ্ছে পরমব্রহ্ম এবং ব্রহ্মাগ্নিতে তাদের অস্তিত্বের আহুতি হচ্ছে যজ্ঞার্পণ । কিন্তু অর্জুনের মতো কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধানের জন্য সর্বস্ব অর্পণ করেন—এমন কি তাঁর আত্ম-স্বরূপও ভগবানের শ্রীচরণে সমর্পিত। এভাবেই, কৃষ্ণভক্ত হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী, কিন্তু তিনি কখনও তাঁর পৃথক স্বরূপের বিনাশ সাধন করেন না।

শ্লোকঃ ২৬

শ্রোত্রাদীনীন্দ্রিয়াণ্যন্যে সংযমাগ্নিষু জুহুতি ।

শব্দাদীন্ বিষয়ানন্য ইন্দ্ৰিয়াগ্নিষু জুহুতি ॥ ২৬ ৷৷

শ্রোত্রাদীনি—শ্রবণ আদি; ইন্দ্রিয়াণি – ইন্দ্ৰিয়সমূহ: অন্যে – অন্যেরা, সংযম- সংযমরূপ; অগ্নিযু— অগ্নিতে; জুহুতি—আহুতি দেন; শব্দাদীন্—শব্দ আদি; বিষয়ান্—ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় আদি; অন্যে – অন্যেরা; ইন্দ্রিয়—ইন্দ্রিয়রূপ; অগ্নিষু— অগ্নিতে; জুহুতি—আহুতি প্রদান করেন।

গীতার গান

নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর যজ্ঞ ইন্দ্রিয় সংযম ।

শ্রোতাদি মানস তপ অগ্নিতে অর্পণ ।।

রূপ রস শব্দ স্পর্শ বিষয়ে সংযম ৷

যজ্ঞাহুতি সেই হয় ইন্দ্রিয় হবন ৷।

অনুবাদঃ কেউ কেউ (শুদ্ধ ব্রহ্মচারীরা) মনঃসংযমরূপ অগ্নিতে শ্রবণ আদি ইন্দ্রিয়গুলিকে আহুতি দেন, আবার অন্য অনেকে (নিয়মনিষ্ঠ গৃহস্থেরা) শব্দাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলিকে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে আহুতি দেন।

তাৎপর্যঃ ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস — মানব-জীবনের এই চারটি আশ্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পূর্ণ যোগী হতে সহায়তা করা। পশুদের মতো ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করা মানব-জীবনের উদ্দেশ্য নয়। তাই, মানব-জীবনের এই চারটি আশ্রমকে এমনভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যাতে মানুষ তার পারমার্থিক জীবনে পূর্ণতা লাভ করতে পারে। ব্রহ্মচারীরা সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে ইন্দ্রিয় দমন করে মনঃসংযম করেন। এই শ্লোকে তাঁদের সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে, তাঁরা তাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে চিত্তসংযমরূপী আগুনে অর্পণ করে। ব্রহ্মচারীরা কেবলমাত্র কৃষ্ণভাবনা সম্বন্ধীয় শব্দই শ্রবণ করেন। জ্ঞান আহরণ করবার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে শ্রবণ, তাই প্রকৃত ব্রহ্মচারী সর্বক্ষণ হরেনামানুকীর্তনম্ অর্থাৎ, ভগবানের মহিমা শ্রবণ ও কীর্তনে তন্ময় হয়ে থাকেন। তিনি কখনও লৌকিক আলোচনা বা গ্রাম্য কথা শ্রবণ করেন না। জড় জগতের যে শব্দ, সেই শব্দ মনকে জড় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে—মনকে জড় অভিমুখী করে তোলে। তাই ব্রহ্মচারী কখনও সেই রকম শব্দে কর্ণপাত না করে সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম শ্রবণ ও কীর্তন করেন-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।।

তেমনই আবার যিনি গৃহস্থ, যিনি ইন্দ্রিয়তৃপ্তি করার অনুমতি লাভ করেছেন, তিনি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে সেই কার্যে লিপ্ত হন। যৌনসঙ্গ, মাদকদ্রব্য সেবন, আমিষ আহার আদির প্রতি মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু সংযমী গৃহস্থ মৈথুনাদি বিষয় বা ইন্দ্রিয়তর্পণে কখনই অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবৃত্ত হন না। তাই, প্রতিটি সভ্য সমাজেই ধর্মীয় জীবনের ভিত্তিতে বিবাহের প্রচলন দেখা যায়, কারণ সংযত যৌন জীবন যাপনের সেটিই ঠিক পথ। এই ধরনের সংযত, আসক্তি রহিত কামও এক প্রকার যজ্ঞ, কারণ এর মাধ্যমে সংযমী গৃহস্থ তাঁর বিষয়-ভোগোন্মুখ প্রবৃত্তিকে তাঁর পারমার্থিক জীবনের মহৎ উদ্দেশ্যের কাছে উৎসর্গ করেন।

শ্লোকঃ ২৭

সর্বাণীন্দ্রিয়কর্মাণি প্রাণকর্মাণি চাপরে ৷

আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহুতি জ্ঞানদীপিতে ৷৷ ২৭ ৷৷

সর্বাণি—সমস্ত; ইন্দ্রিয়— ইন্দ্ৰিয়; কর্মাণি – কর্মসমূহ; প্রাণকর্মাণি—প্রাণবায়ুর কার্যকলাপ; চ—ও; অপরে — অন্যেরা; আত্মসংযম — মনঃসংযমের, যোগযুক্ত হওয়ার পন্থা; অগ্নৌ—অগ্নিতে; জুহুতি —আহুতি দেন; জ্ঞানদীপিতে – আত্মজ্ঞানের দ্বারা প্রদীপ্ত।

গীতার গান

সর্বেন্দ্রিয় কর্ম প্রাণ সংযম অগ্নিতে ৷

যত্নশীল যত যোগী হবন করিতে ॥

আত্মসংযমাদি যোগ জ্ঞান দীপিতে ৷

পৃথক পৃথক যোগী হয় যুক্ত সে যোগেতে ॥

অনুবাদঃ মন ও ইন্দ্রিয় সংযমের মাধ্যমে যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভের প্রয়াসী, তাঁরা তাঁদের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ ও প্রাণবায়ু জ্ঞানের দ্বারা প্রদীপ্ত আত্মসংযমরূপ অগ্নিতে আহুতি দেন।

তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে পতঞ্জলি প্রণীত যোগপদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। পতঞ্জলির যোগসূত্রে আত্মাকে প্রত্যগাত্মা ও পরাগাত্মা নামে অভিহিত করা হয়েছে। আত্মা যখন ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত থাকে, তখন তাকে বলা হয় পরাগাত্মা। কিন্তু যখনই জীবাত্মা ঐ ধরনের ইন্দ্রিয়-সম্ভোগ থেকে আসক্তি রহিত হয়, তখন তাকে বলা হয় প্রত্যগাত্মা। আত্মা জীবদেহের অভ্যন্তরে দশ রকমের বায়ুর কার্যকলাপের অধীন থাকে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ার মাধ্যমে এটি অনুভব করা যায়। পতঞ্জলির যোগপদ্ধতি শিক্ষা দেয় কিভাবে দেহস্থিত বায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করে আত্মাকে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত করা যায়। এই যোগপদ্ধতি অনুসারে প্রত্যগাত্মাই হচ্ছে চরম উদ্দেশ্য। এই প্রত্যগাত্মা হচ্ছে জড় কার্যকলাপ থেকে প্রত্যাহার। ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে। যেমন শ্রবণের জন্য কান, দৃষ্টির জন্য চোখ, ঘ্রাণের জন্য নাক, আস্বাদনের জন্য জিহ্বা ও স্পর্শের জন্য ত্বক এবং এরা সকলেই আত্মার বাইরে নানা রকম কাজকর্ম করে চলেছে। প্রাণবায়ুর ক্রিয়ার প্রভাবে এগুলি সম্ভব হয়। অপান বায়ুর গতি অধোগামী, ব্যান বায়ুর প্রভাবে সংকোচন ও প্রসারণ হয়, সমান বায়ু সমতা বজায় রাখে, আর উদান বায়ু ঊর্ধ্বগামী। প্রবুদ্ধ মানুষ এদের সকলকে আত্মতত্ত্ব অনুসন্ধানে নিযুক্ত করেন।

error: Content is protected !!