শ্লোকঃ ২২
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতো বিমৎসরঃ ।
সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে ॥ ২২ ৷৷
যদৃচ্ছা — অনায়াসে; লাভ – লাভে; সন্তুষ্টঃ— সন্তুষ্ট; দ্বন্দ –দ্বন্দ; অতীতঃ – অতীত; বিমৎসরঃ—মাৎসর্যমুক্ত; সমঃ—স্থির; সিদ্ধৌ— সিদ্ধি লাভে; অসিদ্ধৌ – অসাফল্যে; চ—ও; কৃত্বা—করলেও; অপি – যদিও; ন–না; নিবধ্যতে — প্রভাবিত হন।
গীতার গান
যথালাভ তথা তুষ্ট সর্ব দ্বন্দমুক্ত ৷
নির্মৎসর সমচিত্ত নিজ কর্মে যুক্ত ।৷
সিদ্ধাসিদ্ধ সমদৃষ্টি নাহিত বিদ্বেষ।
করিয়াও সর্ব কর্ম কর্মফল শেষ ॥
অনুবাদঃ যিনি অনায়াসে যা লাভ করেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষ আদি দ্বন্দ্বের বশীভূত হন না এবং মাৎসর্যশূন্য, যিনি কার্যের সাফল্য ও অসাফল্যে অবিচলিত থাকেন, তিনি কর্ম সম্পাদন করলেও কর্মফলের দ্বারা কখনও আবদ্ধ হন না।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করেছেন যে মানুষ, তিনি তাঁর শরীর সংরক্ষণের জন্যও অতিরিক্ত প্রচেষ্টা করেন না। অনায়াসে তিনি যা পান, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন। অযাচিতভাবে তাঁর কাছে যা আসে, তিনি কেবল তা-ই গ্রহণ করেন। তিনি ভিক্ষা করেন না, আবার ঋণও করেন না। তাঁর সাধ্যানুসারে পরিশ্রম করে চলেন এবং তার ফলে তিনি যা পান, তা ভগবানের দান বলে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকেন। তাই, তাঁর জীবন ধারণের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণভাবে উদাসীন। শ্রীকৃষ্ণের দাসত্বে বিঘ্ন হবে বলে, তিনি অন্য আর কারও দাসত্ব করেন না, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের দাসত্ব করার জন্য তিনি যে কোন রকম কাজ করতে প্রস্তুত থাকেন। জড় জগতের দ্বন্দ্বভাব— শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ, তাঁকে কোন অবস্থাতেই প্রভাবিত করতে পারে না। কৃষ্ণভাবনামৃতের আস্বাদ লাভ করার ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয় অনুভূতির অতীত, তাই ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির প্রকাশ-স্বরূপ এই দ্বন্দ্বভাব থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থেকে সর্ব অবস্থাতেই শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধান করতে চেষ্টা করেন। তাই সাফল্য ও ব্যর্থতা—এই দুয়ের প্রভাব থেকেই তিনি মুক্ত থাকেন। পূর্ণরূপে যিনি ভগবৎ- তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন, তাঁর মধ্যে এই সমস্ত লক্ষণগুলি প্রকট হয়।
শ্লোকঃ ২৩
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ ৷
যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্ৰবিলীয়তে ৷। ২৩ ॥
গতসঙ্গস্য—জড়া প্রকৃতির গুণের প্রতি অনাসক্ত ব্যক্তি; মুক্তস্য— মুক্ত; জ্ঞানাবস্থিত —চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত; চেতসঃ – চিত্ত; যজ্ঞায় — যজ্ঞের (শ্রীকৃষ্ণের) উদ্দেশ্যে; আচরতঃ–আচরণ করে; কর্ম—কর্ম; সমগ্রম্—সম্পূর্ণরূপে; প্রবিলীয়তে—লয় প্রাপ্ত হয়।
গীতার গান
অসঙ্গ নিযুক্ত জ্ঞানী চিত্তে ক্ষোভ নাই ।
জ্ঞানাবস্থিত সেই সর্বদা সব ঠাঁই ॥
সেই সে যাজ্ঞিক সদা আচরণে দক্ষ ।
তার কর্ম প্রবিনীত একান্ত সমক্ষ ।।
অনুবাদঃ জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে, চিন্ময় জ্ঞাননিষ্ঠ ব্যক্তি যজ্ঞের উদ্দেশ্যে যে কর্ম সম্পাদন করেন, সেই সকল কর্ম সম্পূর্ণরূপে লয় প্রাপ্ত হয়।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভক্তি লাভ করে মানুষ যখন দ্বন্দ্বভাব থেকে মুক্ত হন, তখন তিনি প্রকৃতির ত্রিগুণের কলুষ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি তখন যথার্থ মুক্ত, কারণ তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর নিত্য সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারেন এবং তখন আর তাঁর মন কৃষ্ণভাবনা থেকে বিচলিত হয় না। তখন তিনি যা-ই করেন, তা কেবল আদি বিষ্ণু—শ্রীকৃষ্ণের জন্যই করেন। তাই, তাঁর সমস্ত কাজকর্ম যজ্ঞময় হয়ে ওঠে, কারণ যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে যজ্ঞেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করা। তাঁর সমস্ত কাজকর্মই অপ্রাকৃত তত্ত্বে পর্যবসিত হয়, তাই তাঁকে আর কর্মফল-জনিত ক্লেশভোগ করতে হয় না।
শ্লোকঃ ২৪
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্ ।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা ॥ ২৪ ॥
ব্রহ্ম চিন্ময় প্রকৃতি; অর্পণম্ –অর্পণ; ব্রহ্ম – পরম; হবিঃ – ঘৃত; ব্রহ্ম — চিন্ময়; অগ্নৌ—অগ্নিতে; ব্রহ্মণা— আত্মার দ্বারা; হুতম্― নিবেদিত হয়; ব্রহ্ম — চিৎ-জগৎ; এব—অবশ্যই; তেন—তাঁর দ্বারা; গন্তব্যম্—গন্তব্য; ব্রহ্ম — চিন্ময়; কর্ম-কর্ম, সমাধিনা—সমাহিত হয়ে।
গীতার গান
ব্রহ্মময় কর্ম, তার ব্রহ্মেতে অর্পণ ।
ব্রহ্ম হবি ব্রহ্ম অগ্নি হোতা ব্ৰহ্মফল ॥
তাহার সে ব্রহ্মগতি নিশ্চিত নির্ণয় ।
ব্রহ্ম কর্ম সমাধিস্থ সর্বত্র বিজয় ৷।
অনুবাদঃ যিনি কৃষ্ণভাবনায় সম্পূর্ণ মগ্ন তিনি অবশ্যই চিৎ-জগতে উন্নীত হবেন, কারণ তাঁর সমস্ত কার্যকলাপ চিন্ময়। তাঁর কর্মের উদ্দেশ্য চিন্ময় এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি যা নিবেদন করেন, তাও চিন্ময়।
তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত কর্মের প্রভাবে কিভাবে পরমার্থ সাধিত হয়, তা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম নানা প্রকারের হতে পারে। পরবর্তী শ্লোকগুলিতে তা বিশদভাবে বর্ণনা করা হবে। কিন্তু তার আগে, এখানে কেবল কৃষ্ণভাবনার মূল তত্ত্ব বর্ণনা করা হচ্ছে। বদ্ধ জীব জড় কলুষের দ্বারা কলুষিত, তাই তাকে নিশ্চিতভাবে জড়-জাগতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে কাজকর্ম করতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে পন্থা অবলম্বন করে বদ্ধ জীব এই পরিবেশ থেকে মুক্ত পাতে পারে, তাকেই বলা হয় কৃষ্ণভাবনামৃত বা ভগবদ্ভক্তি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, নানা রকম দুগ্ধজাত খাদ্যের অত্যাহারের ফলে যখন পেটের অসুখ হয়, তখন আর একটি দুগ্ধজাত খাদ্য দইয়ের দ্বারা সেই রোগ নিবারণ করা হয়। ঠিক তেমনই, বিষয়াসক্ত বদ্ধ জীবের ভবরোগ নিরাময় করা যায় ভগবদ্গীতায় বর্ণিত কৃষ্ণভাবনার অমৃতের দ্বারা। ভবরোগ নিরাময়ের এই পন্থাকে বলা হয় যজ্ঞ, অর্থাৎ যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণকে তুষ্ট করার জন্য কাজকর্ম বা যজ্ঞ করা। জড় জগতের যত বেশি কার্যকলাপ কৃষ্ণভাবনায় অথবা বিষ্ণুর জন্য অনুষ্ঠিত হয়, সম্পূর্ণ অভিনিবিষ্টতার ফলে তত বেশি জড় পরিবেশ চিন্ময়ত্ব লাভ করে। ব্রহ্ম বলতে বোঝায় ‘চিন্ময়’। ভগবান হচ্ছেন চিন্ময় এবং তাঁর দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটাকে বলা হয় ব্রহ্মজ্যোতি বিশ্বচরাচরের সব কিছুই এই ব্রহ্মজ্যোতিতে অবস্থান করছে। কিন্তু সেই জ্যোতি মায়া অথবা ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কলুষের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়লে তাকে প্রাকৃত বা জড়-জাগতিক বলা হয়। তখন সব কিছুই জড় বলে প্রতিভাত হয়। এই ভড় আবরণকে কৃষ্ণভাবনার প্রভাবে উন্মোচিত করা যায়। তাই, ভগবদ্ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমরা যখন ভগবানের চরণে কোন কিছু উৎসর্গ করি, তখন অর্পণ, হবি, অগ্নি, হোতা ও ফল অথবা যখন ভগবানের প্রসাদরূপে কোন কিছু গ্রহণ করি, তখন তা সবই একই তত্ত্বে পর্যবসিত হয়— ব্রহ্মন্ অথবা পরমতত্ত্ব। পরমতত্ত্ব যখন মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে, তখন তাকে জড় পদার্থ বলে মনে হয়। আবার এই জড় পদার্থ দিয়ে যখন ভগবানের সেবা করা হয়, তখন তা অপ্রাকৃত তত্ত্বে পর্যবসিত হয়। এভাবেই কৃষ্ণভাবনামৃত বা ভগবদ্ভক্তির দ্বারা আমরা আমাদের জড় চেতনাকে ব্রহ্মন্ অথবা পরমতত্ত্বে রূপান্তরিত করতে পারি। মন যখন সর্বতোভাবে কৃষ্ণভাবনায় মগ্ন থাকে, তখন তাকে বলা হয় সমাধি। এই প্রকার অপ্রাকৃত চেতনায় যখন কোন কিছু করা হয়, তখন তাকে বলা হয় যজ্ঞ। এই চিন্ময় চেতনায় অর্পণ, অর্পিত হবি, অগ্নি, হোতা — সবই ব্রহ্মময় হয়ে ওঠে, অর্থাৎ অপ্রাকৃত তত্ত্বে পর্যবসিত হয়। এটিই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পদ্ধতি।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ