শ্লোকঃ ১৯

যস্য সর্বে সমারম্ভাঃ কামসংকল্পবর্জিতাঃ ।

জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ ॥ ১৯ ॥

যস্য – যার; সর্বে—সব রকম; সমারম্ভাঃ—কর্ম প্রচেষ্টা; কাম—ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বাসনা; সংকল্প—–সংকল্প, বর্জিতাঃ —–রহিত; জ্ঞান — জ্ঞানের; অগ্নি—অগ্নি দ্বারা; দগ্ধ— দক্ষ, কর্মাণম্—কর্মসমূহ; তম্—তাঁকে; আহুঃ – বলেন; পণ্ডিতম্—পণ্ডিত; বুধাঃ— জ্ঞানীগণ ।

গীতার গান

সকল সমারম্ভে যার সংকল্প বর্জন ৷

জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ কর্ম পাণ্ডিত্যে গ্রহণ ॥

অনুবাদঃ যাঁর সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টা কাম ও সংকল্প রহিত, তিনি পূর্ণ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত। জ্ঞানীগণ বলেন যে, তাঁর সমস্ত কর্মের প্রতিক্রিয়া পরিশুদ্ধ জ্ঞানাগ্নি দ্বারা দগ্ধ হয়েছে।

তাৎপর্যঃ যে মানুষ প্রকৃতই জ্ঞানবান, তিনিই কেবল কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত বৈষ্ণবের কার্যকলাপ বুঝতে পারেন। কারণ, কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণব সব রকম ইন্দ্রিয়তৃপ্তি বিষয়ক বাসনা থেকে মুক্ত। তাঁর স্বরূপ যে ভগবানের নিত্যদাস, এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারার ফলে তাঁর অন্তর কলুষমুক্ত হয়েছে। শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তির আগুনে তাঁর অন্তরের সমস্ত কলুষ দগ্ধ হয়ে যায়। এভাবেই অন্তর যখন কলুষমুক্ত হয়, তখন জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার সমস্ত কামনা অন্তর্হিত হয়, তাই তিনি তখন নিষ্কাম। প্রকৃত জ্ঞানী তিনিই, যিনি এই পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পেরেছেন। ভগবানের নিত্য দাসত্বের এই পরম তত্ত্বজ্ঞানকে আগুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই আগুন একবার জ্বলে উঠলে, তা সব রকম কর্মফলকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিতে পারে।

শ্লোকঃ ২০

ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ ।

কর্মণ্যভিপ্রবৃত্তোঽপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ ॥ ২০ ৷।

ত্যত্ত্বা— ত্যাগ করে; কর্মফলাসঙ্গম্ — কর্মফলের আসক্তি; নিত্য – সর্বদা; তৃপ্তঃ- পরিতৃপ্ত; নিরাশ্রয়ঃ—আশ্রয়শূন্য; কর্মণি – কর্মে; অভিপ্রবৃত্তঃ – পূর্ণরূপে প্রবৃত্ত; অপি— সত্ত্বেও; ন–না; এব—অবশ্যই; কিঞ্চিৎ—কিছুই; করোতি — করেন; সঃ— তিনি।

গীতার গান

ত্যক্ত কর্মফলাসঙ্গ আশ্রয় বিহীন ।

নিত্য তৃপ্ত নিত্যানন্দ নিজ কর্মে লীন ॥

সে প্রবৃত্ত নিজ কর্মে কিছু নাহি করে ।

অনাসক্ত কর্মফল স্বচ্ছন্দ বিহরে ॥

অনুবাদঃ যিনি কর্মফলের আসক্তি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে সর্বদা তৃপ্ত এবং কোন রকম আশ্রয়ের অপেক্ষা করেন না, তিনি সব রকম কর্মে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও কর্মফলের আশায় কোন কিছুই করেন না।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধানের জন্য সব রকম কর্ম করার মাধ্যমেই কেবল কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। কৃষ্ণভাবনার অমৃত লাভ করেছেন যে ভক্ত, তিনি বিশুদ্ধ ভগবৎ-প্রেমের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্ম করেন, তাই তিনি কোন রকম কর্মফলের আশা করেন না। তিনি সর্বতোভাবে ভগবানের শরণাগত, তাই তিনি কিভাবে তাঁর জীবন ধারণ করবেন, সেই সম্বন্ধেও কোন রকম চিন্তা করেন না। তিনি জানেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর এবং তিনি সর্ব কারণের কারণ, তাই তিনি সব কিছুই ভগবানের শ্রীচরণে সমর্পণ করেন। তিনি কিছুই সংগ্রহ বা সঞ্চয় করতে চান না, কিংবা এ যাবৎ যা কিছু তিনি তাঁর অধিকারে লাভ করেছেন, সেই সবও সংরক্ষণ করে রাখতে চান না। তাঁর সমস্ত শক্তি, সমস্ত ক্ষমতা, সমস্ত সম্পদ দিয়ে তিনি কেবল ভগবানেরই সেবা করেন, এ ছাড়া আর কোন কাজেই তাঁর কোন রকম স্পৃহা থাকে না। এই ধরনের নিরাসক্ত কৃষ্ণভক্ত ভাল ও মন্দ সব রকম কর্মফল থেকে মুক্ত; যেন তিনি কোন কাজকর্মই করছেন না। এই হচ্ছে অকর্ম অর্থাৎ কর্মফলহীন কাজকর্মের লক্ষণ। তাই, কৃষ্ণভাবনা রহিত যে সব কর্ম, তা সবই জীবকে কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। তাকে বলা হয় বিকর্ম, এই কথা পূর্বেই বলা হয়েছে।

শ্লোকঃ ২১

নিরাশীর্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্বপরিগ্রহঃ ।

শারীরং কেবলং কর্ম কুর্বনাপ্নোতি কিল্বিষম্ ॥ ১॥

নিরাশীঃ—কামনাশূন্য; যত – সংযত, চিত্তাত্মা—মন ও বুদ্ধি; ত্যক্ত—পরিত্যাগ করে; সর্ব— সমস্ত; পরিগ্রহঃ – আধিপত্য করার প্রবৃত্তি; শারীরম্—শরীর রক্ষার্থে, কেবলম্—কেবল; কর্ম—কর্ম; কুর্বন্—করেও, ন–না; আপ্নোতি – লাভ করেন; কিল্বিষম্‌—পাপ ।

গীতার গান

কর্মফলে স্পৃহাহীন দত্ত চিত্ত আত্মা ৷

সর্ব পরিগ্রহ ত্যক্ত যুক্ত সে সর্বথা ৷৷

শরীর নির্বাহ মাত্র কর্ম যেই করে ৷

করিয়াও সর্ব কর্ম সর্ব পাপ হরে ।।

অনুবাদঃ এই প্রকার জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর মন ও বুদ্ধিকে সর্বতোভাবে সংযত করে কার্য করেন। তিনি প্রভুত্ব করার প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করে কেবল জীবন ধারণের জন্য কর্ম করেন। এভাবেই কর্ম করার ফলে কোন রকম পাপ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনার অমৃত যিনি লাভ করেছেন, তিনি তাঁর কাজকর্মের ফলস্বরূপ শুভ অথবা অশুভ কোন ফলেরই আশা করেন না। তাঁর মন, বুদ্ধি সম্পূর্ণভাবে সংযত। তিনি জানেন যে, যেহেতু তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই পরমেশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে তাঁর কোন কাজকর্মই তাঁর নিজের কাজকর্ম নয়, সেই কাজকর্ম করা হয় ভগবানেরই নিয়ন্ত্রণে। যেমন, আমরা যখন আমাদের হাতটিকে নাড়ি, তখন হাতটি নিজের ইচ্ছায় নড়ে না। সমস্ত শরীরের প্রচেষ্টার ফলেই তা সম্পন্ন হয়। কৃষ্ণভাবনাময় ভক্ত ভগবানের বাসনার দ্বারাই পরিচালিত হন, কেন না তাঁর নিজের ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির কোন রকম বাসনা নেই। একটি যন্ত্রের অংশ যেভাবে পরিচালিত হয়, তিনিও সেভাবেই পরিচালিত হন। যন্ত্রের কলকব্জায় যেমন তেল দিতে হয়, পরিষ্কার করতে হয়, ভগবদ্ভক্তও তেমন ভগবানের সেবা করার জন্যই কেবল নিজেকে সুস্থ-সবল রাখেন। তাই তিনি সব রকম কর্মফল থেকে মুক্ত। যেমন, একটি পশুর নিজের দেহের উপরেই কোন মালিকানার অধিকার নেই। পশুর নিষ্ঠুর মালিক ইচ্ছা করলেই সেই পশুটিকে বলি দিতে পারে, তবু পশুটি কোন প্রতিবাদ করে না। তার সত্যিই কোন স্বাধীনতা নেই। ভগবদ্ভক্তও তেমনই নির্বিকার। সম্পূর্ণভাবে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হয়ে তিনি যখন পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করেন, তিনি যখন পরম সত্যকে দর্শন করেন, তখন জড় জগতের উপর আধিপত্য করার কোন বাসনা তাঁর থাকে না। জীবন ধারণের জন্য অসৎ উপায়ে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টাকে তিনি তখন নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে করেন। তাই, এই সমস্ত জড়-জাগতিক পাপের দ্বারা তিনি আর কলুষিত হন না। তখন তিনি তাঁর সব রকমের কাজকর্মের ফল থেকে মুক্ত থাকেন।

error: Content is protected !!