শ্লোকঃ ১৬

কিং কর্ম কিমকর্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ

তত্তে কর্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেঽশুভাৎ ৷৷ ১৬ ৷।

কিম—কি; কর্ম—কর্ম; কিম্—কি; অকর্ম—অকর্ম; ইতি—এভাবে; কয়ঃ – বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ; অপি—ও; অত্র—এই বিষয়ে, মোহিতাঃ – মোহিত হন; তৎ—তাই; তে—তোমাকে; কর্ম—কর্ম; প্রবক্ষ্যামি — আমি বিশ্লেষণ করব; য‍—যা; জ্ঞাত্বা জেনে, মোক্ষ্যসে— তুমি মুক্ত হবে; অশুভাৎ—অশুভ অবস্থা থেকে।

গীতার গান

কিবা কর্ম অকর্ম বা করিতে বিচার।

বড় বড় মুনি ঋষি হয় চমৎকার ॥

তাই সে বলিব আমি কিবা কর্ম হয় ৷

জানিলে সে তত্ত্বকথা অশুভের ক্ষয় ॥

অনুবাদঃ কাকে কর্ম ও কাকে অকর্ম বলে, তা স্থির করতে বিবেকী ব্যক্তিরাও মোহিত হন। আমি সেই কর্ম বিষয়ে তোমাকে উপদেশ করব। তুমি তা অবগত হয়ে সমস্ত অশুভ্র অবস্থা থেকে মুক্ত হবে ।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভক্ত মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম করা সকলেরই কর্তব্য। পূর্ববর্তী শ্লোকে ভগবান যে উপদেশ দিয়েছেন, পরবর্তী শ্লোকে তিনি তার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কেন স্বাধীনভাবে ভগবানের সেবা করা উচিত নয়।

এই অধ্যায়ের প্রথমেই বর্ণনা করা হয়েছে, পরম্পরার ধারায় ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন এমন কোন মহাপুরুষকে গুরুরূপে বরণ করতে হয়। ভগবান নিজেই ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান সর্বপ্রথমে সূর্যদেব বিবস্বানকে দান করেন। সেই তত্ত্বজ্ঞান বিবস্বান তাঁর পুত্র মনুকে দান করেন, মনু তা তাঁর পুত্র ইক্ষ্বাকুকে দান করেন। এভাবেই সৃষ্টির আদি থেকে এই তত্ত্বজ্ঞান প্রবাহিত হয়ে আসছে। তাই গুরু-শিষ্য পরম্পরায় পূর্বতন যে সমস্ত মহান আচার্যেরা রয়েছেন, তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এই জ্ঞান আহরণ করতে হয়। মানুষ যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, গুরু-পরম্পরার ধারায় এই জ্ঞান আহরণ না করলে, সে কখনই কৃষ্ণভাবনাময় তত্ত্বকে প্রামাণ্যরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। সেই জন্যই ভগবান নিজে অর্জুনকে এই তত্ত্বজ্ঞান সরাসরি দান করতে মনস্থ করলেন। অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যদি কেউ ভগবানের দেওয়া এই তত্ত্বজ্ঞান আহরণ করেন, তা হলে তিনি অনায়াসে জড় জগতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন।

কেবলমাত্র জাগতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে ধর্মীয় পন্থাগুলি কখনই নিরূপণ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে, একমাত্র ভগবানই পরমতত্ত্ব সম্বলিত ধর্মনীতি প্রণয়ন করতে পারেন। ধর্মং তু সাক্ষাদ্ভগবৎপ্রণীতম্ (ভাঃ ৬/৩/১৯)। জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে একটি মনগড়া ধর্ম তৈরি করলে তাকে ধর্ম বলে গ্রহণ করা যায় না। ব্রহ্মা, শিব, নারদ, মনু, কুমার, কপিল, প্রহ্লাদ, ভীষ্ম, শুকদেব গোস্বামী, যমরাজ, জনক, বলী মহারাজ আদি মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের ধর্মের প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে হয় এবং তা অনুশীলন করতে হয়। কল্পনা ও অনুমানের ভিত্তিতে আমরা আত্ম-উপলব্ধির পন্থা প্রতিপাদন করতে পারি না। তাই ভগবান তাঁর অহৈতুকী কৃপার বশবর্তী হয়ে সরাসরি অর্জুনকে সেই জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, শুধুমাত্র কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমেই আমরা এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।

শ্লোকঃ ১৭

কর্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যং চ বিকর্মণঃ

অকর্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্মণো গতিঃ ॥ ১৭ ॥

কর্মণঃ–কর্মের; হি—অবশ্যই; অপি—ও; বোদ্ধব্যম্—জানা উচিত; বোদ্ধব্যম্- জ্ঞাতব্য; চ–৩: বিকর্মণঃ— শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম, অকর্মণঃ – অকর্ম, চ–ও; বোদ্ধব্যম্ জ্ঞাতব্য; গহনা — অত্যন্ত কঠিন; কর্মণঃ–কর্মের; গতিঃ—গতি।

গীতার গান

কর্ম যে বুঝিতে তুমি অকর্ম বুঝিবে ।

বিকৰ্ম বুঝিতে তথা ভাবে বুদ্ধ হবে ৷।

দুর্গম কর্মের গতি নিগূঢ় সে তত্ত্ব ৷

যে বুঝিল সে বুঝিল তাহার মহত্ত্ব ৷৷

অনুবাদঃ কর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা অত্যন্ত কঠিন। তাই কর্ম, বিকর্ম ও অকর্ম সম্বন্ধে যথাযথভাবে জানা কর্তব্য।

তাৎপর্যঃ কেউ যদি সত্যিই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায়, তবে তাকে কর্ম, অকর্ম ও বিকর্মের পার্থক্য জানতে হবে। তাকে জানতে হবে ভগবৎ-তত্ত্ব কি, ভগবানের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক এবং এই জড় জগতের বিভিন্ন গুণের প্রভাবে সে কিভাবে তার কর্তব্যকর্ম করে। এই তত্ত্বের উপলব্ধিই হচ্ছে আত্ম-উপলব্ধি। এই তত্ত্ব পূর্ণরূপে যে উপলব্ধি করতে পারে, সে-ই বুঝতে পারে যে, জীবের ‘স্বরূপ’ হয়—’কৃষ্ণের নিত্যদাস। তাই কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভগবানের সেবা করাই প্রতিটি জীবের পরম কর্তব্য। সমগ্র ভগবদ্‌গীতায় ভগবান আমাদের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষাই দান করেছেন। যে চিন্তাধারা এবং যে কর্ম এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, তাকে বলা হয় বিকর্ম অর্থাৎ নিষিদ্ধ কর্ম। এই তত্ত্বজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে হলে মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তের সঙ্গ করতে হয়— সাধুসঙ্গ করতে হয় এবং তাদের কাছ থেকে এই জ্ঞানের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে হয়। ভগবদ্ভক্তের কাছ থেকে এই জ্ঞান আহরণ করা এবং ভগবানের কাছ থেকে তা আহরণ করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই পরম তত্ত্বজ্ঞান এভাবেই সদগুরুর কাছ থেকে আহরণ না করলে বড় বড় বুদ্ধিমান মানুষেরা পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং এই জ্ঞানের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না।

শ্লোকঃ ১৮

কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেদকর্মণি চ কর্ম যঃ

স বুদ্ধিমান্মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্মকৃৎ ॥ ১৮ ৷৷

কর্মণি—কর্মে; অকর্ম—অকর্ম; যঃ– যিনি; পশ্যেৎ—দর্শন করেন; অকর্মণি- অকর্মে, চ–ও; কর্ম কর্ম, যঃ – যিনি, সঃ— তিনি; বুদ্ধিমান্ —–বুদ্ধিমান, মনুষ্যেষু — মানব-সমাজে; সঃ—তিনি; যুক্তঃ – চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত; কৃৎস্নকর্মকৃৎ——সব রকম কর্মে লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও।

গীতার গান

কর্মেতে অকর্ম দেখে অকর্মে যে কর্ম ।

সে বুদ্ধিমান মনুষ্যে সে বুঝেছে মৰ্ম ৷।

অনুবাদঃ যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন এবং অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমান। সব রকম কর্মে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত।

তাৎপর্যঃ কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে মানুষ ভগবানের সেবায় ব্রতী হয়েছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবে সব রকমের কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত। তিনি তাঁর সমস্ত কর্মই করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবার জন্য। তাই তাঁর কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তাঁকে আর সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করতে হয় না। এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যাঁরা ব্রতী হয়েছেন, তাঁরাই মানব-সমাজে যথার্থ বুদ্ধিমান মানুষ। অকর্ম কথাটার অর্থ হচ্ছে কর্মফল রহিত কর্ম। নির্বিশেষবাদীরা কর্মফলের ভয়ে ভীত হয়ে সব রকম কর্ম পরিত্যাগ করে। তারা মনে করে, কর্ম করলেই তার ফল ভোগ করতে হবে এবং এই সমস্ত কর্মফল তাদের মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক-স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ভগবানের ভক্ত ভালভাবেই জানেন, তিনি হচ্ছেন ভগবানের নিত্যদাস। তাই তিনি সর্বতোভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। ভগবানের সেবা করার জন্য তিনি সমস্ত কাজকর্ম করেন, তাই সেই সমস্ত কর্মের ফল ভগবানই গ্রহণ করেন, তাঁকে আর তা ভোগ করতে হয় না। এভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার ফলে তিনি সব রকম কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন এবং সর্বদা চিন্ময় আনন্দ উপভোগ করেন। তাই বলা হয়, ‘কৃষ্ণভক্ত নিষ্কাম, কারণ তাঁর ব্যক্তিগত কোন কামনা নেই। তিনি তাঁর নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করবার জন্য কোন কিছুই আশা করেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাসত্ব করার পরম আনন্দ লাভের ফলে তিনি জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের সমস্ত বাসনার নিরর্থকতা উপলব্ধি করতে পারেন এবং তার ফলে তিনি সম্পূর্ণভাবে কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত হন।

error: Content is protected !!