শ্লোকঃ ১৩

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ ।

তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্ ॥ ১৩॥

চাতুর্বর্ণাম্—মানব-সমাজের চারিটি বিভাগ; ময়া—আমার দ্বারা; সৃষ্টম্—সৃষ্ট হয়েছে; গুণ—গুণ; কর্ম—কর্ম; বিভাগশঃ — বিভাগ অনুসারে; তস্য—তার; কর্তারম্—স্রষ্টা; অপি—যদিও; মাম্—আমাকে; বিদ্ধি — জানবে; অকর্তার ম্—অকর্তারূপে; অব্যয়ম্—পরিবর্তন রহিত।

গীতার গান

চারি বর্ণ সৃষ্টি মোর গুণ কর্ম ভাগে ৷

যার যাহা গুণ হয় কহিব সে আগে ॥

তথাপি সে নহি আমি গুণ কর্ম মাঝে।

যদ্যপি নিয়ন্তা আমি সকলের কাজে ৷।

অনুবাদঃ প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারিটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে। তাৎপর্য

তাৎপর্যঃ ভগবানই সব কিছুর স্রষ্টা। তাঁর থেকেই সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তিনিই সব কিছু রক্ষা করেন, আবার প্রলয়ের পরে সব কিছু তাঁরই মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। সমাজের চারটি বর্ণও তারই সৃষ্টি। সমাজের সর্বোচ্চ স্তর সৃষ্টি হয়েছে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন লোকদের নিয়ে, তাঁদের বলা হয় ব্রাহ্মণ এবং তাঁরা সত্ত্বগুণের দ্বারা প্রভাবিত। এর পরের স্তর হচ্ছে শাসক সম্প্রদায়, এদের বলা হয় ক্ষত্রিয় এবং এরা রজোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। তার পরের স্তর হচ্ছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, এদের বলা হয় বৈশা এবং এরা রজ ও তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। তার পরের স্তর হচ্ছে শ্রমজীবী সম্প্রদায়, এদের বলা হয় শূদ্র, এরা তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। ভগবান যদিও এই চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছেন, তবুও তিনি এই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত নন। কারণ তিনি মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ জীবের মতো নন। জীব হচ্ছে ভগবানের অণুসদৃশ অংশ- বিশেষ, কিন্তু ভগবান হচ্ছেন বিভু। প্রকৃতপক্ষে, মানব সমাজ হচ্ছে যে-কোনও পশু-সমাজেরই মতো, কিছু মানুষকে পশুর স্তর থেকে প্রকৃত মানুষের স্তরে উন্নীত করবার জন্য ভগবান এই চারটি বর্ণ-বিভাগ করেছেন, যাতে মানুষ সুষ্ঠুভাবে পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে কৃষ্ণভাবনাময় হতে পারে। গুণ অনুসারে মানুষের কর্ম নির্ধারিত হয়। জড়া প্রকৃতির বিভিন্ন গুণ অনুসারে জীবনের বিভিন্ন লক্ষণ ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে, কৃষ্ণভক্ত বা বৈষ্ণব ব্রাহ্মণের থেকেও উত্তম। যদিও গুণগতভাবে ব্রাহ্মণ ব্ৰহ্ম বা পরব্রহ্মের জ্ঞানসম্পন্ন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতির উপাসক। তাঁরা সবিশেষ পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারেন না। বিষ্ণুতত্ত্ব বা কৃষ্ণতত্ত্বকে উপলব্ধি করতে হয় ব্রহ্মতত্ত্বকে অতিক্রম করে এবং তখন তিনি বৈষ্ণব পদবাচ্য হন। কৃষ্ণতত্ত্ব রাম, নৃসিংহ, বরাহ আদি সব কয়টি অংশ অবতারের তত্ত্ব সমন্বিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেমন সমাজের চার বর্ণের অতীত, তাঁর ভক্তও তেমন এই বর্ণ-বিভাগের অতীত, এমন কি তিনি জাতি, কুলাদি বিচারেরও অতীত।

শ্লোকঃ ১৪

ন মাং কর্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্মফলে স্পৃহা

ইতি মাং যোঽভিজানাতি কর্মভির্ন স বধ্যতে ॥ ১৪ ॥

ন—না; মাম্—আমাকে; কর্মাণি—সর্বপ্রকার কর্ম; লিম্পত্তি—প্রভাবিত করতে পারে; ন—না; মে—আমার; কর্মফলে – কর্মফলে; স্পৃহা – আকাঙ্ক্ষা; ইতি—এভাবে; মাম্—আমাকে; যঃ– যিনি; অভিজানাতি — জানেন; কর্মভিঃ—এই প্রকার কর্মের দ্বারা; ন–না; সঃ— তিনি; বধ্যতে – আবদ্ধ হন।

গীতার গান

আমি কর্মফলে লিপ্ত নহি কোন কালে ৷

স্পৃহা কভু নাই মোর কোন কর্মফলে ।।

আমার কর্মের কথা বুঝে ভাল মতে ৷

বন্ধন ঘুচিল তার কর্মের ফলেতে ॥

অনুবাদঃ কোন কর্মই আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না এবং আমিও কোন কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা করি না। আমার এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিও কখনও সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না।

তাৎপর্যঃ এই জড় জগতের সংবিধানে উল্লেখ থাকে যে, রাজা কোন ভুল করতে পারেন না, অথবা রাজা রাষ্ট্রের আইনের অধীন নন। তেমনই এই জড় জগতের অধীশ্বর ভগবানও জড় জগতের কোন কর্মের দ্বারাই আবদ্ধ নন। যদিও তিনি এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তবুও এই জড় জগৎ সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ও উদাসীন। কিন্তু জীব জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য করতে চায় বলে কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কোন প্রতিষ্ঠানের মালিক যেমন তাঁর কর্মচারীদের সৎ-অসৎ কোন কর্মের জন্যই দায়ী নন, কর্মচারীরাই তার জন্যে দায়ী হয়ে থাকে, জীবও তেমনই তার কর্মফল ভোগ করে থাকে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার জন্য জীব নানা রকম কর্ম করে চলে। ভগবান কখনও এই ধরনের কর্ম করার বিধান দেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও জীব উত্তরোত্তর আরও বেশি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করবার জন্য এই সংসারে কর্ম করে এবং মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ ভোগ করার কামনা করে। ভগবান যেহেতু স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাই তাঁর তথাকথিত স্বর্গসুখের প্রতি কোন রকম আকর্ষণ নেই। স্বর্গের দেব-দেবীরা হচ্ছেন ভগবানেরই দাস-দাসী, যাঁদের ভগবান নিজেই নিয়োজিত করেছেন। কর্মচারীরা যে প্রকার নিম্নস্তরের সুখভোগ করতে চায়, মালিক কখনই তা চায় না। ভগবানেরও তেমনই জড় সুখভোগ করার কোন স্পৃহা নেই। তিনি সব সময়ই জাগতিক কর্ম এবং তার ফল সম্বন্ধে নিরাসক্ত থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পৃথিবীতে নানা রকম গাছপালা সৃষ্টির জন্য বৃষ্টি দায়ী নয়, যদিও বৃষ্টির অভাবে কোন গাছপালা জন্মানোর সম্ভাবনাই থাকে না। বৈদিক স্মৃতিতে সেই সম্বন্ধে বলা হয়েছে—

নিমিত্তমাত্রমেবাসৌ সৃজ্যানাং সর্গকর্মণি ।

প্রধানকারণীভূতা যতো বৈ সৃজ্যশত্রুয়ঃ ॥

“এই জড় সৃষ্টির পরম কারণ হচ্ছেন একমাত্র ভগবান। জড়া প্রকৃতি হচ্ছে নিমিত্ত কারণ, যার ফলে জড় সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করা যায়।” সৃষ্ট জীব অনেক রকম, যেমন— দেবতা, মানুষ, পশু, পাখি আদি এবং তারা সকলেই তাদের পূর্বকৃত পুণ্য অথবা পাপকর্ম অনুসারে সুখ ও দুঃখ পেয়ে থাকে। ভগবান তাদের প্রকৃতির গুণ অনুসারে কর্ম করার সব রকম সুযোগ দেন। কিন্তু তিনি নিজে তাদের ভূত ও ভবিষ্যৎ কোন কর্মের জন্য দায়ী হন না। বেদান্ত-সূত্রে (২/১/৩৪) বলা হয়েছে, বৈষম্যনৈর্ঘণ্যে ন সাপেক্ষত্বাৎ—ভগবান সর্বদাই নিরপেক্ষ থাকেন, তিনি কোন জীবের প্রতি পক্ষপাতযুক্ত নন। জীব তার নিজের ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করে এবং সেই সমস্ত কর্মের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার নিজের। ভগবান বহিরঙ্গা শক্তি জড়া প্রকৃতির মাধ্যমে জীবের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করবার সুযোগ প্রদান করেন। সকাম কর্মের এই জটিল তত্ত্ব যিনি বুঝতে পারেন, তিনি তাঁর কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি ভগবানের অপ্রাকৃত তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন, তিনি কৃষ্ণভাবনার অমৃত আস্বাদন করেন, তার ফলে কর্মের অধীন হন না। ভগবানের অপ্রাকৃত তত্ত্ব বুঝতে না পেরে যে মনে করে, ভগবানও আর পাঁচটি বদ্ধ জীবের মতো কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ, তারা কোন দিনই কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু যিনি পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন, তিনি মুক্তাত্মারূপে কৃষ্ণভাবনায় দৃঢ়চিত্ত হতে পারেন।

শ্লোকঃ ১৫

এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম পূর্বেরপি মুমুক্ষুভিঃ ।

কুরু কর্মৈর তস্মাত্ত্বং পূর্বেঃ পূর্বতরং কৃতম্ ॥ ১৫ ॥

এবম্—এভাবে; জ্ঞাত্বা— জেনে; কৃতম্—অনুষ্ঠান করেছেন; কর্ম—কর্ম; পূর্বেঃ- প্রাচীন; অপি—যদিও; মুমুক্ষুভিঃ – মুক্তিকামীগণ কর্তৃক; কুরু—কর; কর্ম — শাস্ত্রোক্ত কর্ম; এব—অবশ্যই; তস্মাৎ – অতএব; জ্বম্—তুমি; পূর্বেঃ—প্রাচীন মহাজনগণ কর্তৃক; পূর্বভরম্—প্রাচীনকালে; কৃতম্—অনুষ্ঠিত।

গীতার গান

এই গূঢ় তত্ত্বকথা পূর্বে যে বুঝিল।

অনায়াসে তারা সব সংসার তরিল ।।

তুমি পূর্ব মহাজনে যথা অনুসার ৷

যথাবৎ সিদ্ধিলাভ হইবে বিস্তর ।।

অনুবাদঃ প্রাচীনকালে সমস্ত মুক্ত পুরুষেরা আমার অপ্রাকৃত তত্ত্ব অবগত হয়ে কর্ম করেছেন। অতএব তুমিও সেই প্রাচীন মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তোমার কর্তব্য সম্পাদন কর ।

তাৎপর্যঃ পৃথিবীতে দুই শ্রেণীর মানুষ আছে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষের হৃদয় সব রকমের কলুষে পরিপূর্ণ এবং অন্য শ্রেণীর মানুষের হৃদয় অত্যন্ত নির্মল। কৃষ্ণভাবনার অমৃত—ভগবদ্ভক্তি এই দুই শ্রেণীর লোকেরই হিত সাধন করে। যাদের হৃদয় কলুষে পরিপূর্ণ, তারা বিধিভক্তির অনুশীলন করে তাদের হৃদয়কে পরিষ্কার করতে পারে—তাদের হৃদয়ের আবর্জনা দূর করতে পারে; আর যাদের হৃদয় ইতিমধ্যেই পবিত্র হয়ে আছে, তারা কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন করার মাধ্যমে আর সকলকে কৃষ্ণভক্তি লাভ করার শিক্ষা দান করতে পারে। যারা মূর্খ, অথবা যাদের মনে কৃষ্ণভক্তির পূর্ণ প্রকাশ হয়নি, তারা অনেক সময় মনে করে, সব রকমের কাজকর্ম পরিত্যাগ করে নির্জনে ভগবদ্ভজন করাটাই হচ্ছে পরমার্থ সাধন করার পন্থা। কিন্তু এই ধারণাটি ভ্রান্ত। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুন যখন কর্তব্যকর্ম পরিত্যাগ করে বনবাসী হওয়ার বাসনা প্রকাশ করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে তা থেকে নিরস্ত করেন। আমাদের কেবলমাত্র জানতে হবে কিভাবে কর্ম করতে হয়। কৃষ্ণভক্তির ভান করে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করাটা মুঢ়তা। যথার্থ কৃষ্ণভক্তি হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার উদ্দেশ্যে সব রকম কাজকর্ম করা। তাই ভগবান অর্জুনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কৃষ্ণভক্ত মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করতে। ভগবান ত্রিকালজ্ঞ, তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত কথাই জানেন। তাঁর ভক্তেরা কখন কিভাবে তাঁর সেবা করেছেন, সেই কথা তিনি কখনও ভোলেন না। তাই তিনি সূর্যদেব বিবস্বানের উদাহরণ দিয়ে অর্জুনকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বলেন। এই বিবস্বানকে বারো কোটি বছর আগে ভগবান নিজেই ভগবদ্গীতার তত্ত্বজ্ঞান দান করেছিলেন। এই সমস্ত ভগবদ্ভক্ত মহাজনেরা সকলেই মুক্ত পুরুষ এবং তাঁরা সকলেই সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে তাঁর সেবায় রত। তাই, তিনি অর্জুনকে উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের উপদেশ দিয়েছেন যে, ভগবদ্ভক্ত মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভগবানের সেবায় কর্তব্যকর্ম করাটাই হচ্ছে সিদ্ধি লাভের একমাত্র উপায়।

error: Content is protected !!