শ্লোকঃ ১০

বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ ।

বহুবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ ।। ১০ ।।

বীত—মুক্ত; রাগ—আসক্তি; ভয় ভয়; ক্রোধাঃ – ক্রোধ; মন্ময়া —আমাতে নিবিষ্ট চিত্ত; মাম্—আমার; উপাশ্রিতাঃ – একান্তভাবে আশ্রিত হয়ে; বহবঃ বহু; জ্ঞান- জ্ঞান; তপসা—তপস্যার দ্বারা; পূতাঃ– পবিত্র হয়ে; মদ্ভাবম্—আমার প্রতি অপ্রাকৃত প্রেম; আগতাঃ— লাভ করেছে।

গীতার গান

ছাড়ি রাগ ভয় ক্রোধ ত্রিবিধ অসার।

মন্ময় মদ্ভক্তি সাধ্য করিয়া বিচার ॥

বহু ভক্ত জ্ঞানী সব তপস্যার দ্বারে ।

বিধৌত হইয়া পাপ পেয়েছে আমারে ॥

অনুবাদঃ আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত হয়ে, সম্পূর্ণরূপে আমাতে মগ্ন হয়ে, একান্তভাবে আমার আশ্রিত হয়ে, পূর্বে বহু বহু ব্যক্তি আমার জ্ঞান লাভ করে পবিত্র হয়েছে এবং এভাবেই সকলেই আমার অপ্রাকৃত প্রীতি লাভ করেছে।

তাৎপর্যঃ আগেই বলা হয়েছে, যে সমস্ত মানুষ জড়ের প্রতি অত্যধিক অনুরক্ত, তাদের পক্ষে পরম-তত্ত্বের সবিশেষ রূপ উপলব্ধি করা দুষ্কর। সাধারণত, যে সমস্ত মানুষ দেহাত্মবুদ্ধির দ্বারা প্রভাবিত, তারা জড় বস্তুবাদ চিন্তায় এমনই মগ্ন যে, তাদের পক্ষে ভগবানের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সচ্চিদানন্দময় স্বরূপ উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব । এই সমস্ত জড়বাদীরা কোনমতেই বুঝে উঠতে পারে না যে, ভগবানের একটি চিন্ময় দেহ আছে, যা অবিনশ্বর, পূর্ণ জ্ঞানময় এবং নিত্য আনন্দময়। জড়বাদী চিন্তাধারায়, আমাদের জড় দেহটি নশ্বর, অজ্ঞানতার দ্বারা আচ্ছন্ন এবং সম্পূর্ণ নিরানন্দ। সুতরাং, এই জড় দেহটিকেই আমাদের প্রকৃত স্বরূপ বলে মেনে নিয়ে আমরা মনে করি, ভগবানের দেহটিও তেমন নশ্বর, অজ্ঞান এবং সম্পূর্ণ নিরানন্দ। সুতরাং, সাধারণ মানুষকে যখন ভগবানের ব্যক্তিগত স্বরূপ সম্পর্কে কিছু বলা হয়, তখন তারা জড় দেহগত ধারণাই মনে ভাবতে থাকে। এই জড় দেহাত্মবুদ্ধির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেহসর্বস্ব মানুষ মনে করে, বিশ্বচরাচরের যে বিরাটরূপ সেটিই পরমতত্ত্ব। তার ফলে তারা মনে করে, পরমেশ্বরের কোন আকার নেই—তিনি নির্বিশেষ। আর তারা এতই গভীরভাবে বিষয়াসক্ত যে, জড় জগৎ থেকে মুক্ত হবার পরেও যে একটি অপ্রাকৃত ব্যক্তিত্ব আছে, তা তারা মানতে ভয় পায়। যখন তারা অবহিত হয় যে, চিন্ময় জীবনও হচ্ছে স্বতন্ত্র ও সবিশেষ, তখন তারা পুনরায় ব্যক্তি হবার ভয়ে ভীত হয় এবং তাই নিরাকার, নির্বিশেষ শূন্যে বিলীন হতে পারলেই পরম প্রাপ্তি বলে তারা মনে করে। সাধারণত তারা জীবাত্মাকে সমুদ্রের বুদ্বুদের সঙ্গে তুলনা করে, যা সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়ে সমুদ্রের মধ্যেই আবার বিলীন হয়ে যায়। তাদের মতে এটিই হচ্ছে পৃথক ব্যক্তিসত্তা রহিত চিন্ময় অস্তিত্বের চরম সিদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে যথার্থ আত্মজ্ঞানশূন্য জীবনের এক ভয়ংকর অবস্থা। এ ছাড়া আর এক দল লোক আছে যারা অপ্রাকৃত অস্তিত্বের কথা একেবারেই বুঝতে পারে না। মানুষের কল্পনাপ্রসূত নানা রকম দার্শনিক মতবাদ এবং তাদের মতভেদের ফলে বিভ্রান্ত হয়ে তারা এতই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে যে, শেষকালে তারা মূর্খের মতো সিদ্ধান্ত নেয়, ভগবান নেই এবং এক সময় সব কিছুই শূন্যে পর্যবসিত হবে। এই ধরনের লোকেরা বিকারগ্রস্ত রুগ্ন জীবন যাপন করে। আর এক ধরনের লোক আছে, যারা জড় বিষয়ে এতই আসক্ত যে, পারমার্থিক তত্ত্ব নিয়ে তারা একেবারেই মাথা ঘামায় না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরম চিন্ময় কারণে লীন হতে চায় এবং কেউ কেউ আবার মনগড়া দার্শনিক তত্ত্বের কোন কূল-কিনারা না পেয়ে, নিরাশ হয়ে সব কিছুকেই অবিশ্বাস করে। এই ধরনের মানুষেরা গাঁজা, চরস, ভাঙ আদি মাদকদ্রব্যের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তাদের সেই নেশাগ্রস্ত বিকৃত মনের অলীক কল্পনাকে দিব্য দর্শন বলে প্রচার করে ধর্মভীরু কিছু মানুষকে প্রতারিত করে। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, পারমার্থিক কর্তব্যে অবহেলা করা, ভগবানের অপ্রাকৃত স্বরূপকে আমাদের জড় রূপের মতো বলে মনে করে ভীত হওয়া এবং জড় জীবনের নৈরাশ্যের ফলে সব কিছুকে শূন্য বলে মনে করা— জড় জগতের এই তিনটি আসক্তির স্তর থেকে মুক্ত হওয়া। জড় জীবনের এই তিনটি বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে—সদ্গুরুর চরণাশ্রয় গ্রহণ করে ভগবানের সেবা করা, বিধি অনুসারে ভক্তিযোগের অনুশীলন করা। ভক্তির সর্বোচ্চ স্তরকে বলা হয় ‘ভাব’ অর্থাৎ ভগবানের প্রতি অপ্রাকৃত প্রেমের অনুভূতি।

শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রণীত ভক্তিবিজ্ঞান শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (১/৪/১৫-১৬) বলা হয়েছে–-

আদৌ শ্রদ্ধা ততঃ সাধুসঙ্গোহথ ভজনক্রিয়া ।

ততোহনথনিবৃত্তিঃ স্যাৎ ততো নিষ্ঠা রুচিত্ততঃ ॥

অথাসক্তিস্ততো ভাবস্তুতঃ প্রেমাভ্যুদঞ্চতি ।

সাধকানাময়ং প্রেণঃ প্রাদুর্ভাবে ভবেৎ ক্রমঃ ॥

“প্রথমে অবশ্যই আত্ম-উপলব্ধি লাভের প্রতি প্রারম্ভিক আগ্রহ জাগাতে হবে। এই থেকে পারমার্থিক স্তরে উন্নীত সাধু ব্যক্তিদের সঙ্গ লাভের বাসনা জন্মাবে। পরবর্তী স্তরে কোনও ভগবৎ-জ্ঞানী সদগুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে নবদীক্ষিত ভক্ত সাধনভক্তির পদ্ধতি অনুশীলন করতে শুরু করবেন । সদ্‌গুরুর অধীনে এভাবেই ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার ফলে, মানুষ জড় বন্ধনের আসক্তি থেকে মুক্তি লাভ করে, আত্ম-উপলব্ধির পথে অবাধ গতি লাভ করে এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথায় রুচি অর্জন করে। এই রুচি অর্জনের ফলে মানুষ কৃষ্ণভাবনার প্রতি আরও আসক্তি লাভ করে-যা থেকে ভগবানের প্রতি পারমার্থিক প্রেমভক্তির প্রারম্ভিক স্তর ‘ভাব’ পর্যায়ে উন্নীত হওয়া যায়। ভগবানের প্রতি প্রকৃত ভালবাসার নাম প্রেম। এই প্রেম হচ্ছে জীবনের চরম সার্থকতার পরিণতি।” এই প্রেমভক্তির স্তরে ভক্ত নিরন্তর ভগবানের অপ্রাকৃত প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত থাকে। সুতরাং সদ্গুরুর পথনির্দেশ অনুসারে ধীরে ধীরে ভগবৎ-সেবার পদ্ধতি অনুসরণ করতে করতে মানুষ আত্মোন্নতির সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হতে পারে। সে তখন জড় বন্ধনের সমস্ত আসক্তি থেকে মুক্তি লাভ করে, তার নিজের পৃথক চিন্ময় ব্যক্তিসত্তার আতঙ্ক থেকে মুক্ত হয় এবং শূন্যবাদী জীবনদর্শন চিন্তার ফলে সৃষ্ট হতাশাবোধ থেকে নিষ্কৃতি পায়। তখন সে পরমেশ্বর ভগবানের ধামে অবশেষে পৌঁছতে পারে।

শ্লোকঃ ১১

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ ।

মম বর্থানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ ॥ ১১ ৷৷

যে—যারা; যথা— যেভাবে; মাম্—আমাকে; প্রপদ্যন্তে— আত্মসমর্পণ করে; তান্ তাদের; তথা—সেভাবে; এর—অবশ্যই; ভজামি পুরস্কৃত করি; অহম্ –আমি; নম— আমার; বা—পথ; অনুবর্তন্তে — অনুসরণ করে; মনুষ্যাঃ— সমস্ত মানুষ; পার্থ—হে পৃথাপুত্র; সর্বশঃ— সর্বতোভাবে।

গীতার গান

যেভাবে যে ভজে মোরে আমি সেই ভাবে ।

যথাযোগ্য ফল দিই আপন প্রভাবে ॥

আমাকেই সর্ব মতে চাহে সব ঠাঁই ।

আগুপিছু মাত্র হয় পথে ভেদ নাই ৷৷

অনুবাদঃ যারা যেভাবে আমার প্রতি আত্মসমর্পণ করে, আমি তাদেরকে সেভাবেই পুরস্কৃত করি। হে পার্থ। সকলেই সর্বতোভাবে আমার পথ অনুসরণ করে।

তাৎপর্যঃ সকলেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রীকৃষ্ণের অন্বেষণ করছে। পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণকে তাঁর নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি রূপে এবং অণু-পরমাণু সহ সর্বভূতে বিরাজমান পরমাত্মারূপে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু তাঁর শুদ্ধ ভক্তেরাই কেবল শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারেন। সমস্ত তত্ত্ব অনুসন্ধানী সাধকের সাধনার বস্তু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ, তবে যে যেভাবে ভগবানকে পেতে চায়, তার সিদ্ধিও হয় তেমনভাবে। অপ্রাকৃত জগতেও ভগবান তাঁর শুদ্ধ ভক্তের ভাবনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে ভাবের বিনিময় করে থাকেন। সেখানে কেউ শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর জ্ঞানে সেবা করে, কেউ তাঁকে সখা বলে মনে করে খেলা করে, কেউ সন্তান বলে মনে করে স্নেহ করে, আবার কেউ পরম প্রিয় বলে মনে করে ভালবাসে। ভগবানও তেমন তাঁদের বাসনা অনুযায়ী তাঁদের সকলের সঙ্গে লীলাখেলা করে তাদের ভালবাসার প্রতিদান দেন। জড় জগতেও তেমন, বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে ভজনা করে এবং ভগবানও তাদের ভাবনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে ভাবের বিনিময় করেন। ভগবানের শুদ্ধ ভক্তেরা অপ্রাকৃত জগতে এবং এই জড় জগতে ভগবানের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর সেবায় নিয়োজিত হয়ে অপ্রাকৃত আনন্দ অনুভব যে সমস্ত নির্বিশেষবাদী তাদের আত্মার সত্তাকে বিনাশ করে দিয়ে করেন।

আধ্যাত্মিক আত্মহত্যা করতে চায়, শ্রীকৃষ্ণ তাদের তাঁর ব্রহ্মজ্যোতিতে আত্মসাৎ করে নেন। এই সমস্ত নির্বিশেষবাদীরা ভগবানের সচ্চিদানন্দময় রূপ বিশ্বাস করে না; তাই তারা ভগবানের সান্নিধ্য লাভের আনন্দও উপলব্ধি করতে পারে না এবং পরিণামে তাদের ব্যক্তিগত সত্তার অনুভূতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ব্রহ্মেও বিলীন হয়ে যেতে পারে না, তারা এই জড় জগতে ফিরে এসে তাদের সুপ্ত ভোগবাসনা চরিতার্থ করে। তারা অপ্রাকৃত জগতে প্রবেশ করার অনুমতি পায় না, কিন্তু এই জগতে এসে আবার পবিত্র হবার সুযোগ পায়। যারা সকাম কর্মী, যজ্ঞেশ্বররূপে ভগবান তাদের যাগ-যজ্ঞ অনুষ্ঠানের ফল প্রদান করেন এবং যে সমস্ত যোগী সিদ্ধি কামনা করে, তিনি তাদের সেই ক্ষমতা প্রদান করেন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই, সকলের সাধনার সিদ্ধি লাভ হয় ভগবানেরই করুণার ফলে এবং পরমার্থ সাধনের বিভিন্ন পন্থাগুলি হচ্ছে সেই একই মার্গের বিভিন্ন স্তর। তাই, কৃষ্ণভাবনার চরম সিদ্ধির স্তরে অধিষ্ঠিত না হলে সমস্ত প্রচেষ্টাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শ্রীমদ্ভাগবতে (২/৩/১০) এই সম্বন্ধে বলা হয়েছে –

অকামঃ সর্বকামো বা মোকাম উদারধীঃ ।

তীরেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ॥

“সব রকম কামনা-রহিত ভক্তই হোক, সব রকম কামনা-বিশিষ্ট যাজ্ঞিকই হোক, বা মোক্ষকামী যোগীই হোক না কেন, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে ভক্তিযোগের দ্বারা ভগবানের আরাধনা করা।

শ্লোকঃ ১২

কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।

ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্মজা ৷৷ ১২ ৷৷

কাঙ্ক্ষন্তঃ—কামনা করে; কর্মণাম্ — সকাম কর্মসমূহের, সিদ্ধিম্ – সিদ্ধি; যজন্তে- যজ্ঞের দ্বারা উপাসনা করে; ইহ—এই দেবতাঃ – দেবতাদের; ক্ষিপ্রম্—অতি শীঘ্র; হি—অবশ্যই; মানুষে— মানব-সমাজে; লোকে – জড় জগতে, সিদ্ধিঃ— ফল লাভ; ভবতি – হয়; কর্মজা – সকাম কর্ম থেকে।

গীতার গান

কর্মকাণ্ডী সিদ্ধি লাগি বহু দেবদেবী ।

ইহলোক হয় সব বহু সেব্য সেবী !!

শীঘ্র যেই কর্মফল এ মনুষ্যলোকে ।

অনিত্য সে ফল ভুঞ্জে দুঃখে আর শোকে ৷।

অনুবাদঃ এই জগতে মানুষেরা সকাম কর্মের সিদ্ধি কামনা করে এবং তাই তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করে। সকাম কর্মের ফল অবশ্যই অতি শীঘ্রই লাভ হয়।

তাৎপর্যঃ এই জড় জগতের দেব-দেবীদের সম্বন্ধে বিষয়াসক্ত এসকদের একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে। অল্প-বুদ্ধিসম্পন্ন বেশ কিছু লোক, যারা নিজেদের মহাপণ্ডিত বলে লোক ঠকায়, তারা এই সমস্ত দেব-দেবীকে ভগবানের বিভিন্ন রূপ বলে মনে করে এবং তাদের ভ্রান্ত প্রচারের ফলে জনসাধারণও সেই কথা সত্য বলে মনে করে। প্রকৃতপক্ষে, এই সমস্ত দেব-দেবী ভগবানের বিভিন্ন রূপ নন, তাঁরা হচ্ছেন ভগবানের বিভিন্ন অংশ-বিশেষ। ভগবান হচ্ছেন এক আর অবিচ্ছেদ্য অংশেরা হচ্ছে বহু। বেদে বলা হয়েছে, নিত্যো নিত্যানাম্ — ভগবান হচ্ছেন এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ—“ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর।” বিভিন্ন দেব-দেবী হচ্ছেন শক্তিপ্রাপ্ত যাতে তাঁরা এই জড় জগৎকে পরিচালনা করতে পারেন। এই সমস্ত দেব-দেবীও হচ্ছেন জড় জগতের বিভিন্ন শক্তিসম্পন্ন জীব ( নিত্যানাম্), তাই তাঁরা কোন অবস্থাতেই ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। যে মনে করে যে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবিষ্ণু, শ্রীনারায়ণ ও বিভিন্ন দেব-দেবী একই পর্যায়ভুক্ত, তার কোন রকম শাস্ত্রজ্ঞান নেই, তাকে বলা হয় নাস্তিক অথবা পাষণ্ডী। এমন কি দেবাদিদেব মহাদেব এবং আদি পিতামহ ব্রহ্মাকেও ভগবানের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। প্রকৃতপক্ষে শিব, ব্রহ্মা আদি দেবতারা নিরন্তর ভগবানের সেবা করেন (শিববিরিঞ্চিতম্ )। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানব-সমাজে অনেক নেতা আছে, যাদেরকে মূর্খ লোকেরা ‘ভগবানে নরত্ব আরোপ, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অবতার জ্ঞানে পূজা করে। ইহ দেবতাঃ বলতে এই জড় জগতের কোন শক্তিশালী মানুষকে অথবা দেবতাকে বোঝায়। কিন্তু ভগবান শ্রীনারায়ণ, শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর, তিনি এই জড় জগতের তত্ত্ব নন। তিনি জড় জগতের অতীত চিন্ময় জগতে অবস্থান করেন। এমন কি মায়াবাদ দর্শনের প্রণেতা শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য বলে গেছেন, নারায়ণ অথবা শ্রীকৃষ্ণ এই জড় জগতের অতীত। কিন্তু মূর্খ লোকেরা (হৃতজ্ঞান) তা সত্ত্বেও তাকালিক ফল লাভ করার আশায় বিভিন্ন জড় দেব-দেবীর পূজা করে চলে। এই সমস্ত মূর্খ লোকগুলি বুঝতে পারে না, বিভিন্ন দেব-দেবীকে পূজা করার ফলে যে ফল লাভ হয়, তা অনিতা। যিনি প্রকৃত বুদ্ধিমান, তিনি ভগবানেরই সেবা করেন। তুচ্ছ ও অনিতা লাভের জন্য বিভিন্ন দেব-দেবীকে পূজা করা নিষ্প্রয়োজন। জড়া প্রকৃতির বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত দেব-দেবী এবং তাঁদের উপাসকেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। দেব-দেবীদের দেওয়া বরও হচ্ছে জড় এবং অনিত্য। জড় জগৎ, জড় জগতের বাসিন্দা, এমন কি বিভিন্ন দেব-দেবী এবং তাঁদের উপাসকেরা সকলেই হচ্ছে মহাজাগতিক সমুদ্রের বুদ্বুদ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই জগতের মানব সমাজ ভূসম্পত্তি, পরিবার-পরিজন, ভোগের সামগ্ৰী আদি অনিত্য জড় ঐশ্বর্য লাভের আশায় উন্মাদ। এই প্রকার অনিত্য বস্তু লাভের জন্য মানুষেরা মানব-সমাজে বিভিন্ন দেব-দেবীর অথবা শক্তিশালী কোন ব্যক্তির পূজা করে। কোন রাজনৈতিক নেতাকে পূজা করে যদি ক্ষমতা লাভ করা যায়, সেটিকে তারা পরম প্রাপ্তি বলে মনে করে। তাই তারা সকলেই তথাকথিত নেতাদের দণ্ডবৎ প্রণাম করছে এবং তার ফলে তাদের কাছ থেকে ছোটখাটো কিছু আশীর্বাদও লাভ করছে। এই সমস্ত মূর্খ লোকেরা জড় জগতের দুঃখকষ্ট থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত হবার জন্য ভগবানের শরণাগত হতে আগ্রহী নয়। পক্ষান্তরে, সকলেই তাদের ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সাধন করার জন্য ব্যস্ত এবং তুচ্ছ একটু ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করার জন্য এরা দেব-দেবী নামক বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত জীবদের আরাধনার প্রতি আকর্ষিত হয়। এই শ্লোক থেকে বোঝা যায়, খুব কম মানুষই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণের শরণাগত হয়। অধিকাংশ মানুষই সর্বক্ষণ চিন্তা করছে কিভাবে আরও একটু বেশি ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করা যায়। আর এই সমস্ত ভোগবাসনা চরিতার্থ করবার জনা তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে ‘এটি দাও’ ‘ওটি দাও’ বলে কাঙ্গালপনা করে তাদের সময় নষ্ট করছে।

error: Content is protected !!