শ্লোকঃ ৭
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ ৭ ॥
যদা যদা—যখন ও যেখানে; হি— অবশ্যই; ধর্মস্য—ধর্মের, মানিঃ —হানি; ভবতি- হয়; ভারত—হে ভরতবংশীয়; অভ্যুত্থানম্ — উত্থান; অধর্মস্য—অধর্মের; তদা— তখন; আত্মানম্——নিজেকে; সৃজামি—প্রকাশ করি; অহম্—আমি ।
গীতার গান
যদা যদা ধর্মগ্লানি হইল সংসারে ।
হে ভারত। বিশ্বভার লঘু করিবারে ॥
অধর্মের অভ্যুত্থান ধর্মগ্লানি হলে ।
আত্মার সৃজন করি দেখয়ে সকলে ॥
অনুবাদঃ হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।
তাৎপর্যঃ এখানে সৃজামি কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এই সৃজামি কথাটি সৃষ্টি করার অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, পূর্ববর্তী শ্লোক অনুযায়ী, ভগবানের সমস্ত রূপই নিত্য বিরাজমান, তাই ভগবানের রূপ বা শরীর কখনও সৃষ্টি হয় না। সুতরাং, সৃজামি মানে- ভগবানের যা স্বরূপ, সেভাবেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন। যদিও ব্রহ্মার একদিনে, সপ্তম মনুর অষ্ট-বিংশতি চতুর্যুগে দ্বাপরের শেষে ভগবান তাঁর স্বরূপে আবির্ভূত হন, কিন্তু প্রকৃতির কোন নিয়মকানুনের বন্ধনে তিনি আবদ্ধ নন। তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে লীলা করেন— তিনি হচ্ছেন স্বরাট্। তাই, যখন অধর্মের অভ্যুত্থান এবং ধর্মের গ্লানি হয়, তখন ভগবান তাঁর ইচ্ছা অনুসারে এই জড় জগতে অবতরণ করেন। ধর্মের তত্ত্ব বেদে নির্দেশিত হয়েছে এবং বেদের এই নির্দেশগুলির যথাযথ আচার না করাটাই হচ্ছে অধর্ম। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, এই সমস্ত নির্দেশগুলি হচ্ছে ভগবানের আইন এবং ভগবান নিজেই কেবল ধর্মের সৃষ্টি করতে পারেন। বেদ ভগবানেরই বাণী এবং ব্রহ্মার হৃদয়ে তিনি এই জ্ঞান সঞ্চার করেন। তাই ধর্মের বিধান হচ্ছে সরাসরিভাবে ভগবানের আদেশ (ধর্মং তু সাক্ষান্ত- গবৎপ্রণীতম)। ভগবদ্গীতার সর্বত্রই এই তত্ত্বের বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবানের নির্দেশে এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে বেদের উদ্দেশ্য। গীতার শেষে ভগবান স্পষ্টভাবেই বলেছেন, সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ— সর্ব ধর্ম ত্যাগি লও আমার শরণ। বৈদিক নির্দেশগুলি মানুষকে ভগবানের প্রতি পূর্ণ শরণাগত হতে সাহায্য করে। যখনই অসুরেরা অথবা আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা তাতে বাধার সৃষ্টি করে, তখন ভগবান আবির্ভূত হন। শ্রীমদ্ভাগবত থেকে আমরা জানতে পারি, যখন জড়বাদে পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল এবং জড়বাদীরা বেদের নাম করে যথেচ্ছাচার করছিল, তখন শ্রীকৃষ্ণের অবতার বুদ্ধদেব অবতরণ করেছিলেন। বেদে কোন কোন বিশেষ অবস্থায় পশুবলি দেবার বিধান আছে, কিন্তু আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষেরা বৈদিক সিদ্ধান্ত অনুসরণ না করে নিজেদের ইচ্ছামতো পশুবলি দিতে শুরু করে। এই অনাচার দূর করে বেদের অহিংস নীতির প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভগবান বুদ্ধ আবির্ভূত হয়েছিলেন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই, ভগবানের সমস্ত অবতার কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য এই জড় জগতে অবতরণ করেন এবং শাস্ত্রে তার উল্লেখ থাকে। শাস্ত্রের প্রমাণ না থাকলে কাউকে অবতার বলে গ্রহণ করা উচিত নয়। অনেকে আবার মনে করেন, ভগবান কেবল ভারত-ভূমিতেই অবতরণ করেন, কিন্তু এই ধারণাটি ভুল। তিনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে যে কোন জায়গায়, যে কোন অবস্থায়, যে কোন রূপে অবতরণ করতে পারেন। প্রত্যেক অবতরণে তিনি ধর্ম সম্বন্ধে ততটুকুই ব্যাখ্যা করেন, যতটুকু সেই বিশেষ স্থান ও কালের মানুষেরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য একই থাকে—ধর্ম সংস্থাপন করা এবং মানুষকে ভগবন্মুখী করা। কখনও তিনি স্বয়ং আবির্ভূত হন, কখনও তিনি তাঁর সন্তান অথবা ভৃত্যরূপে তাঁর প্রতিনিধিকে প্রেরণ করেন, আবার কখনও তিনি ছদ্মবেশে অবতরণ করেন।
অর্জুনের মতো মহাভাগবতকে ভগবান ভগবদ্গীতা শুনিয়েছিলেন, কারণ ভগবদ্গীতার মর্মার্থ উন্নত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষেরাই কেবল বুঝতে পারে। দুই আর দুইয়ে চার হয়। এই আঙ্কিক তত্ত্ব একটি শিশুর কাছেও সত্য আবার একজন মহাপণ্ডিত গণিতজ্ঞের কাছেও সত্য, কিন্তু তবুও গণিতের স্তরভেদ আছে। প্রতিটি অবতারে ভগবান একই তত্ত্বজ্ঞান দান করেন, কিন্তু স্থান-কাল বিশেষে তাদের উচ্চ এ নিম্ন মানসম্পন্ন বলে মনে হয়। উচ্চ মানের ধর্ম অনুশীলন শুরু হয় বর্ণাশ্রম ধর্ম সমন্বিত সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমে। ভগবানের অবতরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বত্র সকলকে কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ করা। কেবলমাত্র অবস্থাভেদে সময় সময় এই ভাবনার প্রকাশ ও অপ্রকাশ হয়।
শ্লোকঃ ৮
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥ ৮ ॥
পরিত্রাণায়—পরিত্রাণ করার জন্য; সাধনাম্ — ভক্তদের; বিনাশায় — বিনাশ করার জন্য; চ—এবং; দুষ্কৃতাম্ — দুষ্কৃতকারীদের; ধর্ম — ধর্ম, সংস্থাপনার্থায়—সংস্থাপনের জন্য; সম্ভবামি—অবতীর্ণ হই; যুগে যুগে—যুগে যুগে।
গীতার গান
সাধুদের পরিত্রাণ অসাধুর বিনাশ ।
যে করে অধর্ম তার করি সর্বনাশ ৷।
আর ধর্ম স্থিতি অর্থ করিতে সাধন ।
যুগে যুগে আসি আমি মান সে বচন ॥
অনুবাদঃ সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
তাৎপর্যঃ ভগবদ্গীতা অনুসারে কৃষ্ণভাবনায় উদ্বুদ্ধ যে মানুষ, তিনি হচ্ছেন সাধু। কোন লোককে আপাতদৃষ্টিতে অধার্মিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর অন্তরে তিনি যদি সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণভাবনাময় হন, তবে বুঝতে হবে তিনি সাধু। আর যারা কৃষ্ণভাবনাকে গ্রাহ্য করে না, তাদের উদ্দেশ্যে দুষ্কৃতাম্ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এই সমস্ত অসাধু বা দুষ্কৃতকারীরা লৌকিক বিদ্যায় অলঙ্কৃত হলেও এদের মূঢ় ও নরাধম বলা হয়। কিন্তু যিনি চব্বিশ ঘণ্টায় ভগবদ্ভক্তিতে নিয়োজিত, তিনি যদি মূর্খ এবং অসভাও হন, তবুও বুঝতে হবে যে তিনি সাধু। রাবণ, কংস আদি অসুরদের নিধন করার জন্য পরমেশ্বর ভগবান যেমনভাবে অবতরণ করেছিলেন, নিরীশ্বরবাদীদের বিনাশ করবার জন্য তাঁকে তেমনভাবে অবতরণ করতে হয় না। ভগবানের অনেক অনুচর আছেন, যাঁরা অনায়াসে অসুরদের সংহার করতে পারেন। কিন্তু ভগবানের অবতরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাঁর ভক্তদের শান্তিবিধান করা। অসুরেরা ভগবানের ভক্তদের নানাভাবে কষ্ট দেয়, তাঁদের উপর উৎপাত করে, তাই তাঁদের পরিত্রাণ করবার জন্য ভগবান অবতরণ করেন। অসুরের স্বভাবই হচ্ছে ভক্তদের উপর অত্যাচার করা, ভক্ত যদি তার পরমাত্মীয়ও হয়, তবুও সে রেহাই পায় না। প্রহ্লাদ মহারাজ ছিলেন হিরণ্যকশিপুর সন্তান, কিন্তু তা সত্ত্বেও হিরণ্যকশিপু তাঁকে নানাভাবে নির্যাতন করে। শ্রীকৃষ্ণের মাতা দেবকী ছিলেন কংসের ভগিনী, কিন্তু তা সত্ত্বেও কংস তাঁকে এবং তাঁর পতি বসুদেবকে নানাভাবে নির্যাতিত করে, কারণ সে জানতে পেরেছিল যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সন্তানরূপে আবির্ভূত হবেন। এর থেকে বোঝা যায়, কংসকে নিধন করাটা শ্রীকৃষ্ণের অবতরণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দেবকীকে উদ্ধার করা। কিন্তু এই দুটি কাজই একসঙ্গে সাধিত হয়েছিল। তাই ভগবান এখানে বলেছেন, সাধুদের পরিত্রাণ আর অসাধুর বিনাশ করবার জন্য তিনি অবতরণ করেন।
শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃত গ্রন্থে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিম্নলিখিত (মধ্য ২০/২৬৩- ২৬৪) শ্লোকগুলির মাধ্যমে ভগবানের অবতরণের মূলতত্ত্ব সংক্ষেপে উপস্থাপনা করেছেন-
সৃষ্টি-হেতু যেই মূর্তি প্রপঞ্চে অবতরে ।
সেই ঈশ্বরমূর্তি ‘অবতার’ নাম ধরে ॥
মায়াতীত পরব্যোমে সবার অবস্থান ।
বিশ্বে অবতরি ধরে ‘অবতার’ নাম !!
“ভগবৎ-ধাম থেকে এই জড় জগতে প্রকট হবার ফলে ঈশ্বরমূর্তি অবতার নাম ধরে। এই অবতারেরা অপ্রাকৃত পরব্যোমে অবস্থান করেন। প্রাকৃত জগতে অবতরণ করার জন্য তাঁকে অবতার বলা হয়।”
ভগবানের অনেক রকম অবতার আছে, যেমন—পুরুষাবতার, গুণাবতার, লীলাবতার, শক্ত্যাবেশ অবতার, মন্বন্তর অবতার ও যুগাবতার। তাঁরা নির্ধারিত সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবতরণ করেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের উৎস—আদিপুরুষ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতরণ করেন তাঁর শুদ্ধ ভক্তদের আর্তিহরণ এবং পরিতোষণ করবার জন্য, যাঁরা তাঁর শাশ্বত সনাতন শ্রীবৃন্দাবন- লীলায় তাঁকে দর্শন করবার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকেন। তাই, শ্রীকৃষ্ণের অবতরণের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর শুদ্ধ ভক্তদের পরিতোষণ করা।
ভগবান এখানে বলেছেন, তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। এর থেকে বোঝা যায়, তিনি কলিযুগেও অবতরণ করেন। শ্রীমদ্ভাগবতেও বলা হয়েছে, কলিযুগের অবতার গৌরসুন্দর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সংকীর্তন যজ্ঞের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করবেন এবং সমগ্র ভারতবর্ষে ভগবদ্ভক্তি প্রচার করবেন। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন
পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম ।
সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম ॥
শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরূপে অবতরণের কথা উপনিষদ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশে গুপ্তভাবে উল্লেখ আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ নেই। শ্রীকৃষ্ণের ভক্তেরা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত সংকীর্তন যজ্ঞের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। ভগবানের এই অবতার দুষ্কৃতকারীদের সংহার করেন না, বরং তিনি তাঁর অহৈতুকী কৃপায় ভবসাগর থেকে তাদের উদ্ধার করেন।
শ্লোকঃ ৯
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ॥ ৯ ॥
জন্ম—জন্ম; কর্ম—কর্ম; চ–এবং; মে–আমার; দিব্যম্ — দিব্য; এবম্ – এভাবে; যঃ – যিনি; বেত্তি—জানেন; তত্ত্বতঃ – যথার্থভাবে; ত্যক্ত্বা— ত্যাগ করে; দেহম্— বর্তমান দেহ; পুনঃ—পুনরায়; জন্ম—জন্ম; ন–না; এতি—প্রাপ্ত হন; মাস্— আমাকে; এতি—প্রাপ্ত হন; সঃ— তিনি; অর্জুন – হে অর্জুন।
গীতার গান
আমার যে জন্মকর্ম সে অতি মহান
যে বুঝিল সেই কথা সেও ভাগ্যবান ॥
সে ছাড়িয়া দেহ এই নহে পুনর্জন্ম ৷
মম ধামে ফিরি আসে ছাড়ে জড় ধর্ম ৷।
অনুবাদঃ হে অর্জুন ! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাঁকে আর দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি আমার নিত্য ধাম লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ পরব্যোম থেকে ভগবানের অবতরণের কথা ষষ্ঠ শ্লোকে ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যিনি ভগবানের অবতরণের তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি জড় জগতের বন্ধন থেকে ইতিমধ্যেই মুক্ত হয়েছেন এবং তাই দেহত্যাগ করার পর তিনি তৎক্ষণাৎ ভগবৎ-ধামে ফিরে যান। জড় বন্ধন থেকে এভাবে মুক্ত হওয়া মোটেই সহজসাধ্য নয়। নির্বিশেষবাদী জ্ঞানী ও যোগীরা বহু জন্ম-জন্মান্তরের কৃচ্ছসাধনের ফলে এই মুক্তি লাভ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ব্রহ্মজ্যোতিতে বিলীন হয়ে গিয়ে তারা যে মুক্তি লাভ করে, তা পূর্ণ মুক্তি নয়, তাদের পুনরায় এই জড় জগতে পতিত হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত, ভগবানের সচ্চিদানন্দময় দেহ ও তাঁর লীলার অপ্রাকৃতত্ব অনুভব করতে পেরে দেহত্যাগ করার পরে ভগবানের ধামে গমন করেন এবং তখন আর তাঁর জড় জগতে অধঃপতিত হবার কোনও সম্ভাবনা থাকে না। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৩) বলা হয়েছে, ভগবানের রূপ অনন্ত, ভগবানের অবতার অনন্ত— অদ্বৈতমচ্যুতমনাদিমনন্তরূপম্। ভগবানের রূপ অনন্ত হলেও তিনি এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ভগবান। এই সত্যকে সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বুঝতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত জড় জ্ঞানী ও পণ্ডিতেরা এই পরম সত্যকে বিশ্বাস করতে পারে না। বেদে (পুরুষবোধিনী উপনিষদে) বলা হয়েছে— একো দেবো নিত্যলীলানুরক্তো ভক্তব্যাপী হৃদ্যন্তরাত্মা ।
“এক ও অদ্বিতীয় ভগবান নানা দিব্যরূপে তাঁর শুদ্ধ ভক্তদের সঙ্গে লীলা করতে নিত্য অনুরক্ত।” বেদের এই উক্তিকে ভগবান নিজেই গীতার এই শ্লোকে প্রমাণিত করেছেন। যিনি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বেদের এই কথাকে, ভগবানের এই কথাকে সত্য বলে গ্রহণ করে দার্শনিক জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে কালক্ষয় করেন না, তিনি সর্বোচ্চ স্তরের মুক্তি লাভ করেন। বেদের তত্ত্বমসি কথাটির যথার্থ তাৎপর্য এই ভে আছে। যিনি বুঝতে পেরেছেন, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর অথবা যিনি ভগবানকে বলতে পারেন, “তুমিই পরব্রহ্ম, পরমেশ্বর, স্বয়ং ভগবান”— তাঁর তৎক্ষণাৎ মুক্তি লাভ হয় এবং ভগবানের নিত্য ধামে তিনি নিশ্চিতভাবে ভগবানের চিন্ময় সাহচর্য লাভ করেন। অর্থাৎ, ভগবানের এই রকম একনিষ্ঠ ভক্তই যে পরমার্থ লাভ করেন, সেই সম্বন্ধে বৈদিক উক্তির মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয়েছে—
তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যুতেহয়নায় ।
“পরমেশ্বর ভগবানকে জানবার ফলেই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এ ছাড়া আর কোনই পথ নেই।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/৮) কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যে জানে না, সে তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত, তাই তার পক্ষে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব। মধুর বোতল চাটলেই যেমন মধুর স্বাদ লাভ করা যায় না, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে না জেনে ভগবদ্গীতা পাঠ করলে এবং তার মনগড়া ব্যাখ্যা করলেও তেমন কোন কাজ হয় না। এই সমস্ত দার্শনিকেরা জড় জগতে অনেক সম্মান, অনেক প্রতিপত্তি, অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারে, কিন্তু তারা ভগবানের কৃপা লাভ করে মুক্তি লাভের যোগ্য নয়। ভগবদ্ভক্তের অহৈতুকী কৃপা লাভ না করা পর্যন্ত অহঙ্কারে মত্ত এই সমস্ত পণ্ডিতেরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। তাই মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য হচ্ছে সুদৃঢ় বিশ্বাস এবং তত্ত্বজ্ঞান সহকারে কৃষ্ণভাবনামৃতের অনুশীলন করে পরমার্থ সাধন করা।
৯. পঞ্চম অধ্যায়ঃ কর্মসন্ন্যাস-যোগ
১২. অষ্টম অধ্যায়ঃ অক্ষরব্রক্ষ্ম-যোগ
১৫. একাদশ অধ্যায়ঃ বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ
১৭. ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ
১৮. চতুর্দশ অধ্যায়ঃ গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ
১৯. পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ পুরুষত্তম-যোগ
২০. ষোড়শ অধ্যায়ঃ দৈবাসুর- সম্পদ-বিভাগযোগ
২১. সপ্তদশ অধ্যায়ঃ শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ
২৪. বর্তমান সংস্করণ সম্পর্কে টীকা
শ্রীমদ্ভগভদ গীতা সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ