শ্লোকঃ ৪০

অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি ।

নায়ং লোকোঽস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ ॥ ৪০ ॥

অজ্ঞঃশাস্ত্রজ্ঞান রহিত মূঢ়; চ–এবং; অশ্রদধানঃ– শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন; চ— ও; সংশয়—সংশয়; আত্মা ব্যক্তি; বিনশ্যতি — বিনষ্ট হয়; ন–না; অয়ম্—এই লোকঃ—লোকে; অস্তি—আছে; ন–না; পরঃ–পরবর্তী জীবনে; ন–না; সুখম্‌ — সুখ; সংশয় – সংশয়; আত্মনঃ ব্যক্তির।

গীতার গান

সংশয়াত্মা অজ্ঞ যারা তাহে শ্রদ্ধা নাই ৷

বিনাশ নিশ্চয় তার কহিনু নিশ্চয়ই ৷।

সে সব লোকের নাই ইহ-পরকাল।

সংশয়ী আত্মা সে দুঃখী সে সংসারজাল ।।

অনুবাদঃ অজ্ঞ ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি কখনই ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে না। সন্দিগ্ধ চিত্ত ব্যক্তি ইহলোকে সুখভোগ করতে পারে না এবং পরলোকেও সুখভোগ করতে পারে না।

তাৎপর্যঃ সমস্ত প্রামাণ্য দিব্য শাস্ত্রের মধ্যে ভগবদ্‌গীতাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। যে সমস্ত মানুষের প্রবৃত্তি প্রায় পশুদের মতো, তাদের শাস্ত্রজ্ঞান অথবা শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে না। আবার এমনও কিছু লোক আছে, যাদের শাস্ত্রজ্ঞান থাকলেও বা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারলেও, শাস্ত্রের কথায় তাদের বিশ্বাস নেই। শাস্ত্র থেকে বিভিন্ন শ্লোক উদ্ধৃত করে এরা নানা রকম যুক্তি-তর্কের অবতারণা করতে পারে, কিন্তু শাস্ত্রের প্রতি তাদের মোটেই বিশ্বাস নেই। আবার আর এক ধরনের মানুষ আছে, যাদের ভগবদ্গীতার প্রতি বিশ্বাস থাকলেও তারা বিশ্বাস করে না যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর, তাই তারা তাঁর আরাধনা করে না। এই ধরনের মানুষদের মনে কৃষ্ণভাবনার উদয় হয় না। তারা অধঃপতিত হয়। এদের মধ্যে যাদের মোটেই বিশ্বাস নেই এবং যারা এই শাস্ত্রোক্ত বিষয় সম্বন্ধে সন্দিহান, তারা তাদের পারমার্থিক জীবনে কোন রকম উন্নতি লাভ করতে পারে না। ভগবান এবং তাঁর মুখ- নিঃসৃত বাণীর প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই, তারা কখনই ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতে পারে না। তাই শ্রদ্ধা সহকারে শাস্ত্র-সিদ্ধান্তের অনুগমন করে পরম জ্ঞান লাভ করাই হচ্ছে প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। পারমার্থিক উপলব্ধির অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হতে এই জ্ঞানই সাহায্য করবে। পক্ষান্তরে, সন্দিগ্ধচিত্ত মানুষদের পক্ষে পারমার্থিক মুক্তির কোনও মর্যাদা লাভ সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য হচ্ছে, গুরু- পরম্পরায় যে সমস্ত মহান আচার্য আছেন, তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাফল্য লাভ করা।

শ্লোকঃ ৪১

যোগসংন্যস্তকর্মাণং জ্ঞানসংছিন্নসংশয়ম্ ।

আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবন্ধন্তি ধনঞ্জয় ॥ ৪১ ॥

যোগ—কর্মযোগে ভগবদ্ভক্তির দ্বারা; সংন্যস্ত — ত্যাগ করেন; কর্মাণম্ — কর্মফল, জ্ঞান—জ্ঞানের দ্বারা; সংছিন্ন – ছেদন করেন; সংশয়ম্ – সংশয়; আত্মবন্তম্— আত্মবান; ন–না; কর্মাণি — কর্মসমূহ; নিবন্ধন্তি – আবদ্ধ করতে পারে; ধনঞ্জয়— হে ধনঞ্জয়।

গীতার গান

অতএব যোগ দ্বারা কর্মবিহীন ।

জ্ঞানলাভ দ্বারা হয় সংশয় বিলীন ৷।

আত্মবান জ্ঞানবান কর্ম হতে মুক্ত ৷

হে ধনঞ্জয়! তুমি সেই হও নিত্যমুক্ত ৷।

অনুবাদঃ অতএব, হে ধনঞ্জয়। যিনি নিষ্কাম কর্মযোগের দ্বারা কর্মত্যাগ করেন, জ্ঞানের দ্বারা সংশয় নাশ করেন এবং আত্মার চিন্ময় স্বরূপ অবগত হন, তাঁকে কোন কর্মই আবদ্ধ করতে পারে না।

তাৎপর্যঃ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ-নিঃসৃত গীতার জ্ঞানকে যিনি অনুসরণ করেন, এই দিব্য জ্ঞানের প্রভাবে তাঁর অন্তরের সমস্ত সংশয় বিদুরিত হয়। ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হবার ফলে তিনি ইতিমধ্যেই আত্মজ্ঞানে অধিষ্ঠিত। তাই, তিনি নিঃসন্দেহে সমস্ত কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত।

শ্লোক ৪২

তস্মাদজ্ঞানসম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞানাসিনাত্মনঃ ।

ছিত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত ॥ ৪২ ৷।

তস্মাৎ—অতএব; অজ্ঞানসম্ভূতম্ – অজ্ঞান থেকে উদ্ভূত; হৃৎস্থম্—হৃদয়স্থিত; জ্ঞান—জ্ঞানের; অসিনা – খঙ্গের দ্বারা; আত্মনঃ – আত্মার; ছিত্ত্বা— ছিন্ন করে; এনম্——এই; সংশয়ম্ – সংশয়; যোগম্—যোগে; আতিষ্ঠ—অধিষ্ঠিত হও; উত্তিষ্ঠ- যুদ্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াও; ভারত – হে ভরতবংশীয়।

গীতার গান

অজ্ঞানসম্ভূত মোহ জ্ঞান অসি দ্বারা ।

হৃদয়ে উদয় সব হইয়াছে যারা ৷।

এই সব ছিন্ন করি জাগিয়া উঠিবে ।

হে ভারত ! যোগোতিষ্ঠ হও এ সংসারে ।।

অনুবাদঃ অতএব, হে ভারত! তোমার হৃদয়ে যে অজ্ঞানপ্রসূত সংশয়ের উদয় হয়েছে, তা জ্ঞানরূপ খঙ্গের দ্বারা ছিন্ন কর। যোগাশ্রয় করে যুদ্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াও।

তাৎপর্যঃ এই অধ্যায়ে যে যোগমার্গের উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তাকে বলা হয় ‘সনাতন- যোগ’ অর্থাৎ জীবের উপযোগী শাশ্বত কার্যকলাপ। এই যোগে দুই রকম যজ্ঞ অনুষ্ঠান সাধিত হয়—তার একটি হচ্ছে দ্রবাযজ্ঞ অর্থাৎ সব রকম জড় বিষয়কে উৎসর্গ করা এবং অন্যটি হচ্ছে আত্মজ্ঞান যজ্ঞ, যা সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ পারমার্থিক কর্ম। দ্রব্যময় যজ্ঞ যদি পারমার্থিক উদ্দেশ্যে সাধিত না হয়, তবে তা জড়-জাগতিক কর্মে পর্যবসিত হয়। কিন্তু এই যজ্ঞ যদি পরমার্থ সাধন করবার জন্য, অর্থাৎ কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে সাধিত হয়, তবে তা সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। পারমার্থিক কর্মও দুটি ভাগে বিভক্ত — নিজের স্বরূপকে উপলব্ধি করা এবং পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করা। ভগবদ্গীতার যথার্থ জ্ঞান লাভ করলে এই দুটি তত্ত্বকেই অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। তখন অনায়াসে উপলব্ধি করা যায় যে, জীবাত্মা হচ্ছে ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই প্রকার উপলব্ধি পরম মঙ্গলময়, কারণ এই জ্ঞানের প্রভাবে ভগবানের দিব্য লীলার তত্ত্ব সহজেই বুঝতে পারা যায়। এই অধ্যায়ের প্রথমেই ভগবান নিজেই তাঁর অপ্রাকৃত কার্যকলাপের কথা বর্ণনা করেছেন। ভগবদ্গীতায় নির্দেশিত ভগবানের উপদেশ যে বুঝতে পারে না, সে হচ্ছে শ্রদ্ধাহীন ভগবৎ-বিদ্বেষী। ভগবান যে তাকে একটুখানি স্বাধীনতা দিয়েছেন, সে তার অপব্যবহার করছে। ভগবদ্গীতায় ভগবান এত সরলভাবে তাঁর স্বরূপ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও যে ভগবানের সচ্চিদানন্দময় স্বরূপকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না, সে নিতান্তই মুর্খ । কৃষ্ণভাবনামৃতের সিদ্ধান্ত হৃদয়ঙ্গম করলে ধীরে ধীরে অজ্ঞানতা দূর হয়। দেবযজ্ঞ, ব্রহ্মযজ্ঞ, ব্রহ্মচর্য-যজ্ঞ, গার্হস্থ্য পালনরূপ যজ্ঞ, ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ যজ্ঞ, যোগাভ্যাস-যজ্ঞ, তপোযজ্ঞ, দ্রব্যযজ্ঞ ও স্বাধ্যায় যজ্ঞের অনুষ্ঠানের দ্বারা এবং বর্ণাশ্রম ধর্ম আচরণের দ্বারা অন্তরে কৃষ্ণভাবনামৃতের বিকাশ হয়। এই সব কয়টিকেই বলা হয় ‘যজ্ঞ’ এবং সব কয়টি ক্রিয়াই নিয়ন্ত্রিত কর্মের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই সমস্ত ক্রিয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি। এই উদ্দেশ্যকে যিনি অনুসন্ধান করেন, তিনিই হচ্ছেন ভগবদ্গীতার যথার্থ শিষ্য। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব সম্বন্ধে যার মনে সংশয় আছে, সে অধঃপতিত হয়। তাই উপদেশ দেওয়া হয়েছে, যথার্থ সদগুরুর শ্রীচরণে আত্মসমর্পণ করে তাঁর সেবায় নিয়োজিত হয়ে, তাঁর কাছ থেকে ভগবদ্গীতা বা অন্য শাস্ত্রগ্রন্থ শিক্ষালাভ করা উচিত। সৃষ্টির আদি থেকে যে জ্ঞান গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, তা আহরণ করতে হয় পরম্পরার ধারায় অধিষ্ঠিত যে সদ্গুরু, তাঁর কাছ থেকে। কোটি কোটি বছর আগে সূর্যদেবকে ভগবান যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষা তাঁর কাছ থেকে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছে এবং সদগুরু তা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিতভাবে দান করেন। তাই, ভগবদ্গীতার যথাযথ উপদেশ প্রত্যেকের গ্রহণ করা উচিত। যে সমস্ত প্রতারক তাদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য ভগবদ্‌গীতার জ্ঞানকে বিকৃত করে তার কদর্থ করে মানুষকে বিপথে চালিত করে, তাদের সম্বন্ধে সাবধান হওয়াই মানুষের কর্তব্য। ভগবান হচ্ছেন অবিসম্বাদিত পরমেশ্বর এবং তাঁর সমস্ত লীলাই অপ্রাকৃত। এই সত্যকে সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি ভগবদ্গীতার জ্ঞান লাভ করার মুহূর্ত থেকেই মুক্ত।

ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।

শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ৷৷

ইতি—অপ্রাকৃত পারমার্থিক জ্ঞানের স্বরূপ উদ্ঘাটন বিষয়ক ‘জ্ঞানযোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।

error: Content is protected !!