শ্লোকঃ ৩৭

যথৈধাংসি সমিদ্ধোঽগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জুন ।

জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা ॥ ৩৭ ॥

যথা— যেমন; এধাংসি — দাহ্য কাঠ; সমিদ্ধঃ — সমারূপে প্রজ্বলিত; অগ্নিঃ—অগ্নি; ভস্মসাৎ—ভস্মীভূত; কুরুতে করে; অর্জুন– হে অর্জুন; জ্ঞানাগ্নিঃ—জ্ঞানরূপ অগ্নি; সর্বকর্মাণি—সমস্ত জড় কর্মফলকে; ভস্মসাৎ— ভস্মীভূত; কুরুতে — করে; তথা—তেমনই।

গীতার গান

প্রবল অগ্নিতে যথা কাষ্ঠ ভস্মসাৎ ।

জ্ঞানাগ্নি জ্বলিলে পাপ সকল নিপাত ৷।

অতএব জ্ঞানতুল্য নাহি সে পবিত্র ।

তাহা নহে জড় জ্ঞান লাভ যত্রতত্র ।।

অনুবাদঃ প্রবলরূপে প্রজ্বলিত অগ্নি যেমন কাষ্ঠকে ভস্মসাৎ করে, হে অর্জুন! তেমনই জ্ঞানাগ্নিও সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে ফেলে।

তাৎপর্যঃ যে জ্ঞান আত্মা ও পরমাত্মা এবং তাঁদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়, তাকে এখানে অগ্নির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই অগ্নি কেবল পাপ কর্মফলকেই দহন করে তাই নয়, তা পুণ্য কর্মফলকেও দহন করে তাদের ভস্মে পরিণত করে। কর্মের ফল নানা রকম হয়। কোন কোন কর্মের ফল অপরিণত, কোন কর্মের ফল পরিণত, কোন কর্মের ফল ইতিমধ্যেই ভোগ করা হয়ে গেছে, আবার কোন কোন কর্মের ফল পূর্বজন্মের থেকে সঞ্চিত হয়ে আছে। কিন্তু স্বরূপ উপলব্ধির পরম জ্ঞানের আগুনে তা সবই ভস্মীভূত হয়ে যায়। বেদে (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৪/২২) বলা হয়েছে, উভে উহৈবৈষ এতে তরত্যমৃতঃ সাম্প্রসাধনী “পাপ ও পুণ্য উভয় কর্মফল থেকেই পরিত্রাণ পাওয়া যায়।”

শ্লোকঃ ৩৮

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে ।

তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি ॥ ৩৮ ॥

ন—কিছুই নেই; হি—অবশ্যই; জ্ঞানেন—জ্ঞানের; সদৃশম্—তুল্য; পবিত্রম্ — পবিত্র ইহ—এই জগতে; বিদ্যতে – বিদ্যমান; তৎ—তা; স্বয়ম্—স্বয়ং; যোগ— যোগে; সংসিদ্ধঃ—সমারূপে সিদ্ধ; কালেন—কালক্রমে; আত্মনি – আত্মায়, বিন্দতি- উপভোগ করেন ।

গীতার গান

যোগসিদ্ধ সেই জ্ঞান চিন্ময় নির্মল ।

সে জ্ঞান লভিলে হবে আনন্দে বিহ্বল ॥

অনুবাদঃ এই জগতে চিন্ময় জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। এই জ্ঞান সমস্ত যোগের পরিপক্ব ফল। ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনের মাধ্যমে যিনি সেই জ্ঞান আয়ত্ত করেছেন, তিনি কালক্রমে আত্মায় পরা শান্তি লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ জ্ঞানের তাৎপর্য হচ্ছে পরমার্থ উপলব্ধি। তাই, এই দিব্য জ্ঞানের মতো মহিমান্বিত ও নির্মল আর কিছুই নেই। আমাদের বন্ধনের কারণ হচ্ছে অজ্ঞান এবং মুক্তির কারণ হচ্ছে জ্ঞান। এই জ্ঞান হচ্ছে ভগবদ্ভক্তির সুপক্ব ফল। এই জ্ঞান যিনি লাভ করেছেন, তাঁকে আর অন্যত্র শান্তির অন্বেষণ করতে হয় না, কেন না তিনি তাঁর অন্তস্তলে নিত্য শাস্তি উপভোগ করেন। পক্ষান্তরে বলা যায়, এই জ্ঞান ও শান্তি কৃষ্ণভাবনামৃতে পর্যবসিত হয়। ভগবদ্গীতার এই হচ্ছে চরম উপদেশ।

শ্লোকঃ ৩৯

শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ ।

জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ॥ ৩৯ ॥

শ্রদ্ধাবান্—শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি; লভতে – লাভ করেন; জ্ঞানম্—জ্ঞান; তৎপরঃ– সেই অনুষ্ঠানে অনুরক্ত, সংযত — সংযত; ইন্দ্রিয়ঃ— ইন্দ্রিয়সমূহ: জ্ঞানম্—জ্ঞান; লঙ্কা— লাভ করে; পরাম্—অপ্রাকৃত; শাস্তিম্—শান্তি; অচিরেণ—অচিরেই; অধিগচ্ছতি— লাভ করেন।

গীতার গান

শ্রদ্ধাবান যেই হয় লভে সেই জ্ঞান ।

সংযত ইন্দ্রিয় যার তৎপর সে হন ।।

সে জ্ঞান লভিলে শান্তি অচিরাৎ পায় ৷

সংসারের যত ক্লেশ সব মিটে যায় ৷।

অনুবাদঃ সংযতেন্দ্রিয় ও তৎপর হয়ে চিন্ময় তত্ত্বজ্ঞানে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এই জ্ঞান লাভ করেন। সেই দিব্য জ্ঞান লাভ করে তিনি অচিরেই পরা শাস্তি প্রাপ্ত হন।

তাৎপর্যঃ যিনি সুদৃঢ় বিশ্বাসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধাবান, তিনিই কেবল কৃষ্ণভাবনামৃতের এই জ্ঞান লাভ করতে পারেন। শ্রদ্ধাবান তাঁকেই বলা হয় যিনি বিশ্বাস করেন যে, কৃষ্ণভক্তি সাধন করলে সমস্ত কর্ম সুসম্পন্ন হয়। ভগবদ্ভক্তি সাধন করলে জীবনের পরমার্থ সাধিত হয়। সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে ভগবানের সেবা সম্পাদন এবং হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে / হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে—এই মহামন্ত্র কীর্তন করার ফলে অন্তর সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয় এবং তখন হৃদয়ে এই শ্রদ্ধার উদয় হয়। এ ছাড়া, ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করার সময় আমাদের ইন্দ্রিয় সংযম করতে হয়। যিনি ইন্দ্রিয়ের বেগগুলিকে সংযত করে সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তিনি অচিরেই কৃষ্ণভাবনামৃতের পূর্ণ জ্ঞান লাভ করে সিদ্ধি প্রাপ্ত হন।

error: Content is protected !!