শ্লোকঃ ৩৪

তদ বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া ।

উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ ॥ ৩৪ ॥

তৎ—বিভিন্ন যজ্ঞের সেই জ্ঞান; বিদ্ধি— জানবার চেষ্টা কর; প্রণিপাতেন—সদ্গুরুর শরণাগত হয়ে; পরিপ্রশ্নেন—ঐকান্তিক বিনম্র প্রশ্নের দ্বারা; সেবয়া — সেবার দ্বারা উপদেক্ষ্যস্তি—উপদেশ দান করবেন; তে– তোমাকে; জ্ঞানম্—জ্ঞান; জ্ঞানিনঃ- আত্ম-তত্ত্ববেত্তা; তত্ত্ব—তত্ত্ব; দর্শিনঃ— দ্রষ্টাগণ।

গীতার গান

অতএব সে বিজ্ঞান যে জানিবারে চায় ৷

উপযুক্ত গুরুপদ করয়ে আশ্রয় ৷।

প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন সেবার সহিত।

গুরুস্থানে জানি লও আপনার হিত ॥

অনুবাদঃ সদগুরুর শরণাগত হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা কর। বিনম্র চিত্তে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর এবং অকৃত্রিম সেবার দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট কর। তা হলে সেই তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষেরা তোমাকে জ্ঞান উপদেশ দান করবেন।

তাৎপর্যঃ পারমার্থিক উপলব্ধির পথ নিঃসন্দেহে দুর্গম। তাই, ভগবান আমাদের উপদেশ দিয়েছেন সেই সদ্গুরুর শরণাগত হতে, যিনি গুরু-পরম্পরার ধারায় ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছেন। শুরু-পরম্পরাক্রমে যিনি ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেননি, তিনি কখনই শুরু হতে পারেন না। ভগবান হচ্ছেন আদি গুরু। তিনি এই পরম তত্ত্বজ্ঞান সৃষ্টির আদিতে দান করেছিলেন। তারপর গুরু-শিষ্য ধারায় পরম্পরাক্রমে এই জ্ঞান প্রবাহিত হয়ে আসছে। তাই, এই পরম্পরার ধারায় যিনি এই জ্ঞান আহরণ করেছেন, তিনি এই জ্ঞানের প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তিনিই এই জ্ঞানকে যথাযথরূপে দান করতে পারেন। মনগড়া একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করে আমরা কখনই ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারি না। একদল মূঢ় প্রতারক গুরু সেজে নানা রকম অশাস্ত্রীয় পদ্ধতির উদ্ভাবন করে লোক ঠকায়। | এই জন্য ভাগবতে (৬/৩/১৯) বলা হয়েছে, ধর্ম, তু সাক্ষাদ্ভগবৎপ্রণীতম্ ধর্মের পথ স্বয়ং ভগবানই প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশ করেছেন। তাই, জল্পনা-কল্পনা বা বৃথা তর্ক অথবা শাস্ত্রগ্রন্থের মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে কখনই আধ্যাত্মিক জীবনে অগ্রসর হওয়া যায় না। পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার জন্য কৃষ্ণ-তত্ত্ববেত্তা গুরুদেবের শরণাগত হতে হয়, সুদৃঢ় বিশ্বাসে তাঁর চরণাম্বুজে আত্মসমর্পণ করতে হয় এবং সম্পূর্ণ নিরহঙ্কারী হয়ে ক্রীতদাসের মতো তাঁর সেবা করতে হয়। সদগুরুর সন্তুষ্টি বিধান করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতি লাভ করা যায়। আত্মসমর্পণ ও সেবা না করে কেবল প্রশ্ন করে কখনই এই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা যায় না। গুরুদেব পরীক্ষা করে দেখেন শিষ্যের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার বাসনা কতটা প্রবল হয়েছে এবং এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই গুরুদেব তাঁর শিষ্যকে পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার আশীর্বাদ দান করেন। এখানে অন্ধের মতো অনুকরণ করা অথবা মূঢ়ের মতো নিরর্থক প্রশ্ন করার নিন্দা করা হয়েছে। শিষ্য কেবল শ্রদ্ধা সহকারে গুরুপ্রদত্ত উপদেশ শ্রবণ করবে, তা নয়, তাকে আত্মসমর্পণ, গুরুদেবের ঐকান্তিক সেবা এবং তত্ত্ব-জিজ্ঞাসার মাধ্যমে এই জ্ঞানের মর্ম উপলব্ধি করতেও হবে। সদ্গুরু সর্বদাই তাঁর শিষ্যের প্রতি অত্যন্ত কৃপা পরায়ণ। তাই শিষ্য যখন বিনীত ও আজ্ঞানুবর্তী সেবায় সর্বতোভাবে তৎপর হয়, তখন জ্ঞান ও তত্ত্ব- জিজ্ঞাসার বিনিময় পূর্ণ হয়।

শ্লোকঃ ৩৫

যজ্ঞজ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং যাস্যসি পাণ্ডব ।

যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি ॥ ৩৫ ॥

যৎ—যা; জ্ঞাত্বা— জেনে; ন–না; পুনঃ—পুনরায়; মোহম্—মোহ; এবম্—এই প্রকার; যাস্যসি—প্রাপ্ত হবে; পাণ্ডব –হে পাণ্ডুপুত্র; যেন—যার দ্বারা; ভূতানি জীবসমূহ; অশেষাণি — সমস্ত; দ্রক্ষ্যসি — দর্শন করবে; আত্মনি—পরমাত্মায়; অথো — অর্থাৎ; ময়ি —আমাতে।

গীতার গান

সে সব জ্ঞানের কথা বুঝিতে পারিলে ।

মোহ আর হবে নাহি হারিলে জিতিলে ।।

তখন সে আত্মাদৃক দেখে ব্রহ্মসম ।

সম্পূর্ণ দর্শন সেই সম্পর্ক সে সম ।।

অনুবাদঃ হে পাণ্ডব ! এভাবে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে তুমি আর মোহগ্রস্ত হবে না, কেন না এই জ্ঞানের দ্বারা তুমি দর্শন করবে যে, সমস্ত জীবই আমার বিভিন্ন অংশ অর্থাৎ তারা সকলেই আমার এবং তারা আমাতে অবস্থিত।

তাৎপর্যঃ তত্ত্বদর্শী সদ্‌গুরুর কাছ থেকে পরম তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার ফলে শিষ্য বুঝতে পারে যে, সকল জীবই হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। শ্রীকৃষ্ণ থেকে আলাদা অস্তিত্ব থাকাকে বলা হয় মায়া। মা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘না’ আর যা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘যা’ অর্থাৎ ‘যার কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ কেউ মনে করে, আমাদের শ্রীকৃষ্ণের প্রয়োজন নেই। তাদের মতে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন একজন মহান ঐতিহাসিক পুরুষ এবং পরমতত্ত্ব হচ্ছে নির্বিশেষ ব্রহ্ম। কিন্তু ভগবদ্গীতার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, ব্রহ্মজ্যোতি হচ্ছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহনির্গত রশ্মিচ্ছটা। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সব কিছুর মূল কারণ। ব্রহ্মসংহিতায় স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান, সর্ব কারণের কারণ। অনন্ত কোটি অবতারেরাও হচ্ছেন তাঁর বিভিন্ন অংশ প্রকাশ মাত্র। জীবও হচ্ছে ভগবানের অংশ প্রকাশ। মায়াবাদী দার্শনিকেরা ভুল করে মনে করে যে, বিভিন্ন অংশ-প্রকাশের মাধ্যমে প্রকট হবার ফলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেন। এটি হচ্ছে প্রাকৃত চিন্তাধারা। প্রাকৃত জড় জগতে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, যখন কোন কিছু খণ্ডরূপে পরিবেশিত হয়, তখন তার মূল স্বরূপ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মায়াবাদী দার্শনিকেরা এটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না যে, ভগবান হচ্ছেন পরতত্ত্ব, তিনি হচ্ছেন অনন্ত। অর্থাৎ তাঁর সঙ্গে এক যোগ করলেও তাঁর কোন বিকার হয় না, আবার তাঁর থেকে এক বিয়োগ করলেও তাঁর কোন বিকার হয় না। এটিই হচ্ছে অপ্রাকৃত তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য।

পর্যাপ্ত পারমার্থিক জ্ঞান না থাকার ফলে আমরা বর্তমানে মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছি এবং তারই ফলে আমরা মনে করি, আমরা শ্রীকৃষ্ণের থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা যদিও শ্রীকৃষ্ণের ভিন্নাংশ কিন্তু তবুও আমরা শ্রীকৃষ্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন নই। জীবের দেহগত পার্থক্য হচ্ছে মায়া, অর্থাৎ তার সত্যিকারের অস্তিত্ব নেই। আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সন্তোষ বিধান করা। মায়ার প্রভাবে অর্জুন মনে করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর নিত্য চিন্ময় সম্পর্ক অপেক্ষা তাঁর দেহগত সম্বন্ধে যারা তাঁর আত্মীয়, তারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভগবদ্গীতার সমস্ত উপদেশই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে, জীব হচ্ছে ভগবানের নিত্যকালের সেবক এবং সে শ্রীকৃষ্ণ থেকে দূরে সরে থাকতে পারে না। সে যদি মনে করে, সে শ্রীকৃষ্ণ থেকে আলাদা, সেটিই হচ্ছে মায়া। ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে জীবদের বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। অনন্তকাল ধরে সেই উদ্দেশ্যকে ভুলে যাওয়ার ফলেই তারা কখনও মানুষ কখনও পশু কখনও দেবতা আদি রূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভগবানের সঙ্গে অপ্রাকৃত সেবার কথা ভুলে যাওয়ার ফলেই এই দেহগত পার্থক্যের উদয় হয়। কিন্তু কেউ যখন কৃষ্ণভাবনামৃত লাভ করে ভগবানের সেবায় নিয়োজিত হন, তখন তিনি এই মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হন। এই শুদ্ধ পারমার্থিক জ্ঞান কেবল সদ্গুরুর কাছ থেকেই লাভ করা যায়। এই জ্ঞানের প্রভাবেই কেবল জীব শ্রীকৃষ্ণের সমকক্ষ, এই মোহ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। পরম তত্ত্বজ্ঞান হচ্ছে সেই জ্ঞান, যার প্রভাবে আমরা জানতে পারি যে, পরম আত্মা শ্রীকৃষ্ণ‍ই হচ্ছেন সমস্ত জীবের পরম আশ্রয়। এই পরম আশ্রয় হারিয়ে ফেলার ফলেই জীবসমূহ তাদের নিজেদের পৃথক পরিচয় আছে, এরূপ কল্পনা করে মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এভাবেই তারা একটির পর একটি দেহ ধারণ করে জগৎকে ভোগ করতে চায় এবং সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যায়। এই ধরনের মোহগ্রস্ত জীবেরা যখন ভগবানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরে তাঁর শরণাগত হয়, তখন বুঝতে হবে যে, তারা মুক্তির পথে এগিয়ে চলেছে। সেই সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবতে (২/১০/৬) বলা হয়েছে— মুক্তির্হিত্বানাথারূপং স্বরূপেণ ব্যবস্থিতিঃ। মুক্তির অর্থ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাসরূপে নিজের স্বরূপে অধিষ্ঠিত হওয়া ।

শ্লোক ৩৬

অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ ।

সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈৰ বৃজিনং সন্তরিষ্যসি ৷। ৩৬ ॥

অপি—এমন কি; চেৎ – যদি; অসি—তুমি হও; পাপেভ্যঃ- পাপীদের থেকে; সর্বেভ্যঃ — সমস্ত; পাপকৃত্তমঃ – পাপিষ্ঠ; সর্বস্—এই প্রকার সমস্ত পাপকর্ম, জ্ঞানপ্লবেন— দিব্য জ্ঞানরূপ তরণীর দ্বারা; এর—অবশ্যই; বৃজিনম্ — দুঃখরূপ সমুদ্র; সম্ভৱিষ্যসি — অতিক্রম করবে।

গীতার গান

পাপী হতে পাপী যদি হয়ে থাক তুমি ৷

তথাপি জ্ঞানের পোতে তরিবে আপনি ৷।

অনুবাদঃ তুমি যদি সমস্ত পাপীদের থেকেও পাপিষ্ঠ বলে গণ্য হয়ে থাক, তা হলেও এই জ্ঞানরূপ তরণীতে আরোহণ করে তুমি দুঃখ-সমুদ্র পার হতে পারবে।

তাৎপর্যঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে আমাদের স্বরূপ উপলব্ধি করা এতই মাধুর্যময় যে, তা অজ্ঞানতার সমুদ্রে যে জীবন-সংগ্রাম, তা থেকে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করে। এই জড় জগৎকে কখনও অবিদ্যার সমুদ্র অথবা কখনও দাবানলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অতি সুদক্ষ সাঁতারুও যেমন সাঁতার কেটে সমুদ্র পার হতে পারে না, ঠিক তেমনই জড় জগতের যে জীবন-সংগ্রাম তা দুরতিক্রম্য। মাঝ সমুদ্রে যে মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে, তার উদ্ধারের একমাত্র উপায় হচ্ছে, যদি কেউ এসে তাকে তুলে নেয়। এই ভবসমুদ্রে আমরাও সেই রকম হাবুডুবু খাচ্ছি। এখন কেউ যদি কৃপাপরবশ হয়ে আমাদের এই ভবসমুদ্র থেকে তুলে নেয়, তা হলেই কেবল আমরা উদ্ধার পেতে পারি। ভগবানের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রাকৃত ভগবৎ-তত্ত্ব হচ্ছে একমাত্র মুক্তির পথ। এই ভগবৎ-তত্ত্বজ্ঞান বা কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে আমাদের উদ্ধারকারী নৌকা। মুক্তি লাভের এই পথ অত্যন্ত সহজ, সরল ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ।

error: Content is protected !!