শ্লোকঃ ৩১

নায়ং লোকোহস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোহন্যঃ কুরুসত্তম ৷ ৩১ ৷৷

ন—না; অয়ম্—এই; লোকঃ— জগৎ; অস্তি— আছে, অযজ্ঞস্য – যজ্ঞরহিত ব্যক্তির; কুতঃকোথায়; অন্যঃ – অন্য; কুরুসত্তম – হে কুরুশ্রেষ্ঠ।

গীতার গান

ইহলোকে যজ্ঞ বিনা কোন সুখ নাই ৷

পরলোক বিনাযজ্ঞে কেমনে সে পাই ৷।

অনুবাদঃ হে কুরুশ্রেষ্ঠ। যজ্ঞ অনুষ্ঠান না করে কেউই এই জগতে সুখে থাকতে পারে না, তা হলে পরলোকে সুখপ্রাপ্তি কি করে সম্ভব?

তাৎপর্যঃ জীব যে-রকম দেহই ধারণ করে এই জড় জগতে অবস্থান করুক না কেন, তার যথার্থ স্বরূপ তার কাছে অবধারিতভাবে অজ্ঞাত থাকে। পক্ষান্তরে বলা যায়, জন্ম- জন্মান্তরের সঞ্চিত পাপের ফলে জীবাত্মা এই জড় জগতে অবস্থান করে। অজ্ঞানতা হচ্ছে এই পাপ-পঙ্কিল জীবনের কারণ এবং জীবন যতক্ষণ পাপের দ্বারা কলুষিত থাকে, ততক্ষণ জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। জড় জগতের এই কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে মানব- শরীর। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ সাধন করার মাধ্যমে এই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার পথ বেদ দেখিয়ে দিচ্ছে। ধর্মের পথে অগ্রসর হয়ে বিভিন্ন যাগ- যজ্ঞের অনুষ্ঠান করলে, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে খাদ্য, শস্য, দুধ আদি পর্যাপ্ত মাত্রায় অর্জন করা যায়, তখন অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও খাদ্যদ্রব্যের কোন অনটন হয় না। দেহের এই সমস্ত স্থূল প্রয়োজনগুলি মিটে গেলে, তখন স্বভাবতই ইন্দ্ৰিয়- তৃপ্তির প্রশ্ন আসে। তাই, বেদে নিয়ন্ত্রিতভাবে ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্য বিবাহ-যজ্ঞের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এভাবেই ধীরে ধীরে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হবার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। মুক্ত জীবনের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে ভগবানের সঙ্গ লাভ করা। উপরের বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখতে পাই যে, যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে জীবনের পূর্ণতা আসে। কিন্তু বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে যদি কেউ এই সমস্ত যজ্ঞের অনুষ্ঠান না করে, তা হলে সে এই দেহের মাধ্যমে সুখী জীবনের কি করে আশা করতে পারে এবং অন্য গ্রহে গিয়ে পরবর্তী জীবনের তো কথাই নেই? বিভিন্ন রকমের স্বর্গলোকে সুখভোগ করার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সুতরাং বিভিন্ন রকমের যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে সব দিক দিয়েই অসীম সুখভোগ করা যায়। কিন্তু সর্বোচ্চ সুখ কেবল তখনই অনুভব করা যায়, যখন কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে, ভগবানের চিন্ময় ধামে ভগবানের সাহচর্য লাভ করে ভগবানের সেবা করা যায়। তাই কৃষ্ণভক্তি সাধন করাটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ এবং সব রকম সমস্যার সমাধান করার সেটি শ্রেষ্ঠ উপায়।

শ্লোকঃ ৩২

এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা ব্ৰহ্মণো মুখে ৷

কর্মজান্ বিদ্ধি তান্ সর্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে ॥ ৩২ ॥

এবম্—এভাবে; বহুবিধাঃ – বহুবিধ, যজ্ঞাঃ যজ্ঞ; বিততাঃ — বিস্তৃত, ব্রহ্মণঃ- বেদের; মুখে–মুখে; কর্মজান্ কর্মজাত; বিদ্ধি জানবে, তান—তাদের; সর্বান্- সকলকে; এবম্—এভাবে; জ্ঞাত্বা – জেনে; বিমোক্ষ্যসে—মুক্তি লাভ করতে পারবে।

গীতার গান

হে পুরুষোত্তম! অতঃ যজ্ঞই যে ধর্ম।

আর সব যাহা কিছু সকল বিকৰ্ম ৷৷

বেদাদি শাস্ত্রেতে তথা বহু যজ্ঞ হয় ।

কত শাখা প্রশাখাদি কে করে নির্ণয় ৷।

সে সব যজ্ঞাদি জান সব কর্মজান ।

মুক্তিপথ সেই জান যজ্ঞ সে সর্বান ৷৷

অনুবাদঃ এই সমস্ত যজ্ঞই বৈদিক শাস্ত্রে অনুমোদিত হয়েছে এবং এই সমস্ত যজ্ঞ বিভিন্ন প্রকার কর্মজাত। সেগুলিকে যথাযথভাবে জানার মাধ্যমে তুমি মুক্তি লাভ করতে পারবে।

তাৎপর্যঃ বিভিন্ন কর্মীর বিভিন্ন মনোবৃত্তি অনুসারে বেদে নানা রকম যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ মানুষই তার দেহাত্মবুদ্ধিতে তন্ময় হয়ে আছে। তাই, সমস্ত যজ্ঞের এমনভাবে ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে মানুষ তার দেহ, মন অথবা বুদ্ধির যোগ্যতা অনুসারে তাদের অনুষ্ঠান করতে পারে। কিন্তু সমস্ত যজ্ঞের চরম উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের বন্ধন থেকে জীবকে মুক্ত করা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে তাঁর নিজের মুখ থেকে সেই কথা প্রতিপন্ন করেছেন।

শ্লোকঃ ৩৩

শ্রেয়ান্ দ্রব্যময়াদ যজ্ঞাজ্‌জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ।

সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে ॥ ৩৩ ॥

শ্রেয়ান্—শ্রেয়; দ্রব্যময়াৎ- দ্রব্যময়; যজ্ঞাৎ— যজ্ঞ থেকে; জ্ঞানযজ্ঞঃ — জ্ঞানময় যজ্ঞ; পরস্তুপ—হে শত্রু দমনকারী; সর্ব—সমস্ত; কর্মকর্ম, অখিলম্ — পূর্ণরূপে পার্থ—হে পৃথাপুত্র; জ্ঞানে—জ্ঞানে; পরিসমাপ্যতে — সমাপ্ত হয় ।

গীতার গান

কিন্তু শ্রেয় জ্ঞানযজ্ঞ দ্রব্য যজ্ঞাপেক্ষা।

জ্ঞানীর নাহিক আর কর্মজ অপেক্ষা ॥

সর্ব কর্ম শেষ হয় জ্ঞানে সমাপন ৷

কর্মশুদ্ধ চিত্তে হয় জ্ঞানের সাধন ।।

অনুবাদঃ হে পরন্তপ। দ্রব্যময় যজ্ঞ থেকে জ্ঞানময় যজ্ঞ শ্রেয়। হে পার্থ! সমস্ত কর্মই পূর্ণরূপে চিন্ময় জ্ঞানে পরিসমাপ্তি লাভ করে।

তাৎপর্যঃ সমস্ত যজ্ঞের উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ণ জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া এবং অবশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অপ্রাকৃত প্রেম লাভ করে অপ্রাকৃত জগতে উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর নিত্য সাহচর্য লাভ করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি যজ্ঞেরই একটি নিগূঢ় রহস্য আছে এবং যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হলে সেই রহস্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া প্রয়োজন। অনুষ্ঠানকারীর বিশ্বাস ও বাসনা অনুসারে যজ্ঞ বিভিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়। অপ্রাকৃত দিব্যজ্ঞান লাভ করার কামনায় কেউ যখন জ্ঞানযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, সেই যজ্ঞ অপ্রাকৃত জ্ঞানরহিত কর্মযজ্ঞের থেকে শ্রেয়, কেন না জ্ঞানবিহীন যজ্ঞ লৌকিক ক্রিয়া মাত্র—তাতে পরমার্থ লাভ হয় না। প্রকৃত জ্ঞান সর্বোচ্চ পর্যায়ের অপ্রাকৃত জ্ঞানে অর্থাৎ কৃষ্ণভাবনায় পরিসমাপ্তি হয়। জ্ঞানের স্তরে উন্নীত না হলে যজ্ঞানুষ্ঠান কেবলমাত্র জাগতিক কার্যকলাপ। যখন যজ্ঞের সকল কাজকর্ম অপ্রাকৃত জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করে, তখন তার সুফল পারমার্থিক পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। স্তরভেদে যজ্ঞ-ক্রিয়াকে কর্মকাণ্ড (সকাম কর্ম) অথবা জ্ঞানকাণ্ড (সত্য-জিজ্ঞাসা) বলা হয়। কিন্তু সেই যজ্ঞই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ যজ্ঞ, যার ফলে পরম জ্ঞান লাভ করা যায়।

error: Content is protected !!