শ্লোকঃ ৪

অর্জুন উবাচ

অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ ।

কথমেতদ্ বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি ॥ ৪ ॥

অর্জুনঃ উবাচ—অর্জুন বললেন; অপরম্পরবর্তী; ভবতঃ —তোমার; জন্ম—জন্ম; পরম্—পূর্বে; জন্ম—জন্ম; বিবস্বতঃ — সূর্যদেবের; কথম্—কিভাবে; এতৎ—এই বিজানীয়াম্‌—আমি বুঝব; জ্বম্—তুমি; আদৌ – পুরাকালে, প্রোক্তবান্—বলেছিলে; ইতি—এভাবে।

গীতার গান

অর্জুন কহিলেনঃ

তুমি ত নবীন সখা সেদিন জন্মিলে ৷

কোটি কোটি বর্ষ পূর্বে সূর্য জন্ম নিলে ॥

এ কথা কি করে বুঝি পূর্ব এত দিনে ।

উপদেশ পুরাতন তুমি বলেছিলে ৷।

অনুবাদঃ অর্জুন বললেন—সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল তোমার অনেক পূর্বে। ভূমি যে পুরাকালে তাঁকে এই জ্ঞান উপদেশ করেছিলে, তা আমি কেমন করে বুঝব?

তাৎপর্যঃ অজুন হচ্ছেন ত্রিভুবন বিশ্রুত ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত; তা হলে এটি কি করে সম্ভব যে, তিনি ভগবানের কথা বিশ্বাস করছেন না? তার কারণ হচ্ছে, অর্জুন এই কথাগুলি তাঁর নিজের জন্য জিজ্ঞাসা করছেন না, কিন্তু যারা ভগবানকে বিশ্বাস করে না অথবা যে সমস্ত অসুরেরা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে মানতে চায় না, তাদের জন্য জিজ্ঞাসা করছেন। দশম অধ্যায়ে প্রমাণিত হবে যে, অর্জুন সব সময়ই জানতেন শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান, সব কিছুর উৎস এবং পরম- তত্ত্বের শেষ কথা। সাধারণ মানুষের পক্ষে এটি বুঝতে পারা খুবই কঠিন যে, বসুদেব ও দেবকীর সন্তান শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে অনন্ত শক্তির উৎস ও অনাদির আদিপুরুষ ভগবান হতে পারেন। তাই, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে সেই সম্বন্ধে প্রশ্ন করছেন, যাতে তিনি নিজেই তাঁর পরিচয় দান করে সকলের সন্দেহের নিরসন করেন। শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং ভগবান সেই কথা শুধু আজ নয়, পুরাকাল থেকে সমগ্র জগতের সকলেই বিশ্বাস করে আসছে, কিন্তু অসুরেরাই কেবল সেই সত্যকে মানতে চায় না। সে যাই হোক, শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু সর্বজনগ্রাহ্য প্রামাণ্য উৎস, সেই জন্য অর্জুন এই প্রশ্নটি তাঁর কাছেই উপস্থাপন করেছিলেন যাতে তিনি নিজেই তার যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারেন, অসুরদের কাছে ব্যাখ্যা শুনতে তিনি চাননি। কারণ, অসুরেরা সব সময়ে তাদের নিজেদের এবং অনুগামীদের বোধগম্য বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়েই শ্রীকৃষ্ণকে বোঝাতে চেয়েছে। প্রত্যেকেরই তার নিজের স্বার্থে শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কিত প্রকৃত তত্ত্ববিজ্ঞান জানা উচিত। তাই, ভগবান যখন নিজেই তাঁর অপ্রাকৃত পরিচয় দান করেন, তখন সমস্ত জগতের মঙ্গল হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া এই তত্ত্বজ্ঞান অসুরদের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হতে পারে, কারণ তারা অনাদি, অনন্ত ভগবৎ- তত্ত্বকে তাদের সীমিত মস্তিষ্কের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করতে চায়; কিন্তু ভগবানের ভক্ত ভগবানের নিজের দেওয়া ভগবৎ-তত্ত্বকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে কৃতার্থ হন। ভক্তবৃন্দ চিরকালই এই পরমতত্ত্ব গ্রহণে আগ্রহী, কারণ তাঁরা সর্বদা ভগবানের অনন্ত লীলা সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী। যারা নিরীশ্বরবাদী ভগবৎ-বিদ্বেষী, যারা মনে করে ভগবানও হচ্ছেন একজন সাধারণ মানুষ, তারাও এভাবেই শ্রীকৃষ্ণের লীলা শ্রবণ করে বুঝতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অতি মানবিক, তাঁর রূপ সচ্চিদানন্দময়, তিনি অপ্রাকৃত, তিনি মায়াতীত ও গুণাতীত। ভগবানের ভক্ত মাত্রই অর্জুনের মতো সর্বান্তঃকরণে শ্রীকৃষ্ণকে বিশ্বাস করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত তত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর মনে কোন সন্দেহ থাকে না। অসুরেরা যে শ্রীকৃষ্ণকে জড়া প্রকৃতির গুণবৈশিষ্ট্যের অধীন একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে, তাদের সেই অবিশ্বাস জনিত যুক্তি খণ্ডন করার জন্যই অর্জুনের মতো শুদ্ধ ভক্তেরা ভগবানের কাছে তাঁর ভগবত্তা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের মনে ভগবান সম্বন্ধে সন্দেহের কোন রকম অবকাশই থাকে না।

শ্লোকঃ ৫

শ্রীভগবানুবাচ

বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন ।

তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ॥ ৫ ৷।

শ্রীভগবান্ উবাচ— পরমেশ্বর ভগবান বললেন; বহুনি বহু; মে – আমার, ব্যতীতানি—অতীত হয়েছে, জন্মানি —জন্ম; তব – তোমার; চ–এবং; অর্জুন- হে অর্জুন; তানি—সেই সমস্ত; অহম্ — আমি; বেদ – জানি; সর্বাণি — সমস্ত; ন– না; ত্বম্—তুমি; বেখ— জান; পরন্তপ – হে শত্রু দমনকারী।

গীতার গান

ভগবান কহিলেনঃ

হে অর্জুন বহু জন্ম তোমার আমার ।

হয়েছে পূর্বকালে সে সব অপার ৷।

ভুলি নাই আমি সেই তুমি ভুলে গেছ ৷

আমি বিভু তুমি জীব এইভাবে আছ ৷।

অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন – হে পরন্তপ অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না।

তাৎপর্যঃ ব্রহ্মসংহিতাতে (৫/৩৩) আমরা ভগবানের নানাবিধ অবতারের সম্বন্ধে জানতে পারি। সেখানে বলা হয়েছে—

অদ্বৈতমচ্যুতমনাদিমনন্তরূপ-

মাদ্যং পুরাণপুরুষং নবযৌবনঞ্চ !

বেদেষু দুর্লভম দুর্লভমাত্মভক্তৌ

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি !!

“আমি পরম পুরুষোত্তম ভগবান, আদিপুরুষ গোবিন্দের (শ্রীকৃষ্ণের) ভজনা করি, যিনি অদ্বৈত, অচ্যুত ও অনাদি। যদিও অনন্ত রূপে পরিব্যাপ্ত, তবুও তিনি সকলের আদি, পুরাণ-পুরুষ এবং তিনি সর্বদাই নব-যৌবনসম্পন্ন সুন্দর পুরুষ। যাঁরা শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ, তাঁদের কাছেও ভগবানের সচ্চিদানন্দময় এই রূপ দুর্লভ, কিন্তু ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত সর্বক্ষণ ভগবানকে এই রূপে দর্শন করেন।” ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৯) আরও বলা হয়েছে

রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্

নানাবতারমকরোভুবনেষু কিন্তু ।

কৃষ্ণঃ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যো

গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি ।।

“আমি পরম পুরুষোত্তম ভগবান, আদিপুরুষ গোবিন্দের (শ্রীকৃষ্ণের) ভজনা করি, যিনি শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীনৃসিংহদেব আদি বহুরূপে অবতরণ করেন, কিন্তু পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন তাঁর আদি স্বরূপ এবং তিনি স্বয়ং অবতরণও করেন।”

বেদেও বলা হয়েছে যে, যদিও ভগবান অদ্বৈত, তবুও তিনি অনন্ত রূপে প্রকাশিত হন। বৈদূর্যমণি থেকে যেমন নানা বর্ণ বিচ্ছুরিত হলেও তার নিজের কোন পরিবর্তন হয় না, ভগবানও তেমন নানারূপে প্রকাশিত হলেও তাঁর নিজের কোন পরিবর্তন হয় না। ভগবানের সেই অনন্ত রূপ বেদ অধ্যয়নের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় না, কিন্তু তাঁর শুদ্ধ ভক্তেরা তাঁর অনন্ত রূপের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন (বেদেষু দুর্লভমদুর্লভমাত্মভক্তৌ)। অর্জুনের মতো ভক্তেরা হচ্ছেন ভগবানের নিত্য সহচর। ভগবান যখন অবতরণ করেন, তখন তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তেরাও তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁর সেবা করার জন্য তাঁর সঙ্গে অবতীর্ণ হন। অর্জুন হচ্ছেন সেই রকমই একজন ভক্ত। এই শ্লোকে বোঝা যায়, লক্ষ লক্ষ বছর আগে ভগবান যখন সূর্যদেব বিবস্বানকে ভগবদ্‌গীতা শোনান, তখন অর্জুনও অন্য কোন রূপে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ভগবানের সঙ্গে অর্জুনের পার্থক্য হচ্ছে যে, ভগবান তা ভোলেননি, কিন্তু অর্জুন তা ভুলে গেছেন। বিভুচৈতন্য ভগবানের সঙ্গে অণুচৈতন্য জীবের এটিই পার্থক্য। অর্জুন ছিলেন মহা শক্তিশালী বীর, তিনি ছিলেন পরন্তপ, কিন্তু তা হলেও বহু পূর্ব জন্মের কথা মনে তাই, ক্ষমতার মাপকাঠিতে জীব যত মহৎই হোক রাখবার ক্ষমতা তাঁর নেই না কেন, সে কখনই ভগবানের সমতুলা হতে পারে না। যিনি ভগবানের নিত্য সহচর, তিনি অবশ্যই একজন মুক্ত ব্যক্তি, কিন্তু তিনি কখনই ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। ব্রহ্মসংহিতাতে ভগবানকে অচ্যুত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, জড় জগতে এলেও ভগবান মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কখনই আত্মবিস্মৃত হন না। তাই, জীব কখনই ভগবান হতে পারে না, এমন কি অর্জুনের মতো মুক্ত জীবও সকল বিষয়ে ভগবানের সমকক্ষ হতে পারেন না। অর্জুন যদিও ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত, তবুও তিনি মাঝে মাঝে ভগবানের স্বরূপ বিস্তৃত হন, আবার ভগবানের দিব্য কৃপার ফলে ভক্ত মুহূর্তের মধ্যে সমর্থ হন। কিন্তু অভক্ত বা অসুরেরা কখনই ভগবানের অপ্রাকৃত রূপ উপলব্ধি করতে পারে না। তারই ফলস্বরূপ গীতায় বর্ণিত ভগবানের এই দিব্য তত্ত্বকে আসুরিক বুদ্ধি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর নিত্য সহচর অর্জুন উভয়েই নিত্য শাশ্বত, কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর আগে ভগবান যে লীলা প্রকট করেন, তা সমস্তই শ্রীকৃষ্ণের মনে আছে, কিন্তু অর্জুনের মনে নেই। এই শ্লোকের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, জীবের দেহান্তর হবার ফলে তার পূর্ণ বিস্মরণ ঘটে, কিন্তু ভগবান তাঁর সচ্চিদানন্দময় দেহ পরিবর্তন করেন না, তাই তিনি কিছুই ভোলেন না। তিনি অদ্বৈত অর্থাৎ তাঁর দেহ এবং তিনি স্বয়ং এক ও অভিন্ন। ভগবান সম্পর্কিত সব কিছুই চিন্ময়, কিন্তু জীবের স্বরূপ এবং তার জড় দেহ এক নয়। ভগবান যখন জড় জগতে অবতরণ করেন, তখনও তাঁর দেহ এবং তিনি স্বয়ং একই থাকেন। তাই, জড় জগতে অবতরণ করলেও তিনি জীবের থেকে স্বতন্ত্র থাকেন। ভগবানের এই অপ্রাকৃত তত্ত্ব অসুরেরা কিছুতেই বুঝতে পারে না। সেই কথা ভগবান পরবর্তী শ্লোকে বর্ণনা করছেন।

শ্লোকঃ ৬

অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্

প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ।৷ ৬ ।৷

অজঃ – জন্মরহিত; অপি – যদিও, সন্—হয়েও; অব্যয় — অক্ষয়; আত্মা – দেহ; ভূতানাম্ — জীবসমূহের, ঈশ্বরঃ পরমেশ্বর; অপি – যদিও; সন্—হয়ে; প্রকৃতি – চিন্ময় রূপে; স্বাম্—আমার; অধিষ্ঠায়—অধিষ্ঠিত হয়ে; সম্ভবামি — আবির্ভূত হই; আত্মমায়য়া— আমার অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা।

গীতার গান

সকলের নিয়ামক অজন্মা হইয়া ।

অব্যয়াত্মা পরমাত্মা ভুবন ভরিয়া ৷৷

তথাপি স্বশক্তি সাথে জন্ম লই আমি ৷

সেই ভগবত্তা মোর ভাল বুঝ তুমি ॥

অনুবাদঃ যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

তাৎপর্যঃ ভগবান এখানে তাঁর আবির্ভাবের বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে বর্ণনা করেছেন— যদিও তিনি সাধারণ মানুষের মতো আবির্ভূত হন, তবুও তাঁর বহু বহু পূর্ব জন্মের সমস্ত ঘটনাই তাঁর মনে থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কয়েক ঘণ্টা পূর্বে কি ঘটেছিল, তা মনে রাখতে পারে না। যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, একদিন আগে ঠিক একই সময়ে সে কি করেছিল, তবে সাধারণ লোকের পক্ষে সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাকে অনেক হিসাব-নিকাশ করে, স্মৃতি রোমন্থন করে, তবে মনে করতে হয় গত দিন ঠিক সেই সময়ে সে কি করেছিল, অথচ তারাই আবার ভগবান হবার দুরাশা পোষণ করে। এই ধরনের অর্থহীন দাবি শুনে কারও বিভ্রান্ত হওয়া ঠিক নয়। ভগবান এখানে তাঁর প্রকৃতি বা রূপের কথা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রকৃতি বলতে ‘স্বভাব’ ও ‘স্বরূপ’ দুই-ই বোঝায়। ভগবান বলছেন, তিনি তাঁর চিন্ময় স্বরূপে আবির্ভূত হন। সাধারণ জীবদের মতো তিনি এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হন না। বদ্ধ জীবাত্মা এই জন্মে এক রকম দেহ ধারণ করতে পারে, কিন্তু পরবর্তী জন্মে সে ভিন্ন দেহ ধারণ করে। জড় জগতে জীবের দেহ স্থায়ী নয়, প্রকৃতপক্ষে সে প্রতিনিয়তই তার দেহ পরিবর্তন করছে। কিন্তু ভগবানকে দেহ পরিবর্তন করতে হয় না। যখন তিনি জড় জগতে আবির্ভূত হন, তখন তিনি তাঁর সচ্চিদানন্দময় দেহ নিয়েই আবির্ভূত হন। অর্থাৎ, তিনি যখন এই জড় জগতে আবির্ভূত হন, তখন তিনি তাঁর দ্বিভুজ, মুরলীধারী শাশ্বত রূপ নিয়েই আবির্ভূত হন। জড় জগতের কোন কলুষই তাঁর রূপকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু তিনি যদিও তাঁর অপ্রাকৃত রূপ নিয়ে এই জড় জগতে আবির্ভূত হন এবং সর্ব অবস্থাতেই তিনি সমস্ত জগতের অধীশ্বর থাকেন, তবুও তাঁর জন্মলীলা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই বলে মনে হয়। তাঁর দেহ যদিও পরিবর্তন হয় না, তবুও তিনি শৈশব থেকে পৌগণ্ডে, পৌগণ্ড থেকে কিশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে যৌবনের ঊর্ধ্বে তাঁর দেহের আর কোন রূপান্তর হয় না। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় তাঁর অনেক পৌত্র ছিল, অর্থাৎ জাগতিক হিসাবে তাঁর তখন অনেক বয়স হয়েছিল, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হত যেন তিনি কুড়ি-পঁচিশ বছরের যুবক। যদিও শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সর্বকালীন আদিপুরুষ—সর্বপ্রাচীন পুরুষ, কিন্তু তাঁকে আমরা কোন অবস্থাতেই বৃদ্ধরূপে দেখি না, কোন ছবিতেও শ্রীকৃষ্ণকে বার্ধক্যগ্রস্ত অবস্থায় দেখা যায় না। কখনও তাঁর দেহের অথবা বুদ্ধির কোন রকম বিকার হয় না। তাই আমরা সহজেই বুঝতে পারি, এই জড় জগতে এসে সাধারণ মানুষের মতো লীলাখেলা করলেও তিনি চিরকালই অজ, নিত্য, শাশ্বত, পুরাতন, আদিপুরুষ ও সচ্চিদানন্দময়। বাস্তবিকপক্ষে, তাঁর আবির্ভাব ও অন্তর্ধান সূর্যের মতো যেন আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন, তারপর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন। আকাশে সূর্যকে দেখে যেমন আমরা মনে করি, সূর্য এখন আকাশে রয়েছে, তারপর আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে যেমন আমরা মনে করি সূর্য এখন অস্ত গেছে। প্রকৃতপক্ষে সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে রয়েছে, কিন্তু আমাদের ত্রুটিপূর্ণ ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে আমরা মনে করি যে, সূর্য উদিত হয় এবং অস্ত যায়। ভগবানও তেমন নিত্য। তাঁর আবির্ভাব ও অন্তর্ধান সাধারণ মানুষের জন্ম-মৃত্যুর মতো নয়, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর থেকে আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি, তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে ভগবান সৎ, চিৎ, আনন্দময় — এবং জড়া প্রকৃতির দ্বারা তিনি কখনই কলুষিত হন না। বেদেও প্রতিপন্ন হয়েছে যে, পরমেশ্বর ভগবান অজ, কিন্তু তবুও মনে হয় তাঁর বহুধা প্রকাশরূপে তিনি যেন সাধারণ মানুষের মতো জন্মগ্রহণ করেছেন। সমস্ত বৈদিক অনুশাস্ত্রাদিতেও অনুমোদন করা হয়েছে যে, ভগবান যখন অবতরণ করেন, তখন জীবের মতো জন্মগ্রহণ করেন বলে মনে হলেও তিনি তাঁর অপ্রাকৃত ও অপরিবর্তনীয় দেহ নিয়েই অবতরণ করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে, কংসের কারাগারে তিনি চতুর্ভুজ ও ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ নারায়ণ রূপ নিয়ে তাঁর মায়ের সামনে আবির্ভূত হন। জীবদের প্রতি তার অহৈতুকী কুপার ফলেই তিনি তাঁর শাশ্বত আদি রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন, যাতে তারা পরম পুরুষোত্তম ভগবানের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে—নির্বিশেষ রূপের প্রতি নয়, যা নির্বিশেষবাদীরা ভ্রান্তিবশত মনে করে থাকে। মায়া অথবা আত্মমায়া হচ্ছে ভগবানের সেই অহৈতুকী কৃপা — বিশ্বকোষ অভিধানে তাই বলা হয়েছে। ভগবান তাঁর পূর্ববর্তী সমস্ত অবতরণের এবং অন্তর্ধানের ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রাখেন। কিন্তু সাধারণ জীব অনা একটি দেহ পাওয়া মাত্রই তার পূর্ব জন্মের সমস্ত কথা ভুলে যায়। ভগবান সমস্ত জীবের ঈশ্বর, কারণ এই জগতে অবস্থান করার সময় তিনি বিস্ময়কর ও অতিমানবীয় অসীম শৌর্যবীর্যের লীলা প্রদর্শন করেন। তাই, ভগবান সব সময়ই পরমতত্ত্ব। তাঁর নাম ও রূপের মধ্যে, গুণ ও লীলার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ভগবান কেন এই জড় জগতে আবির্ভূত হন এবং আবার অন্তর্হিত হয়ে যান। সেই কথা পরবর্তী শ্লোকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

error: Content is protected !!