জাহানারা বেগম (রংপুর)

লোকমুখে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জনকণ্ঠের সাংবাদিক বন্ধু মানিক সরকারের সহযোগিতায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরে বেলা বারটার দিকে জাহানারা বেগমের বাসায় পৌছাই। অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে কথা হয় অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা জাহানারা বেগমের সাথে। জাহানারা বেগমের জন্ম রাজশাহী জেলার ঘোড়ামারা থানার দরগাপাড়ায়। বাবা রফিক উদ্দিন ও মা আঞ্জুমান আরা বেগম। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। রাজশাহী মিশনারি স্কুল থেকেই লেখাপড়া শুরু করেন তিনি। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় মাত্র তের বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার নবতমপুর গ্রামের এ.কে.এম হাফিজউদ্দিনের সঙ্গে। হাফিজউদ্দিন চাকুরির সুবাদে রাজশাহী থাকতেন। বিয়ের পরে জাহানারা বেগম রাজশাহী মাতৃসদনে হেল্থ ভিজিটর হিসেবে কাজ করতেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামীর সাথে রংপুরে ছিলেন জাহানারা বেগম । তাদের বাসাটা ছিল রংপুরের বিহারি এলাকায়। মার্চের পুরো সময়টা রংপুরের অবস্থা ছিল থমথমে। ২৩ মার্চ রংপুর শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পরে বিহারিরা ভেতরে ভেতরে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে রংপুরে ব্যাপকভাবে এর প্রভাব পড়ে। পাকবাহিনীর সাথে অবাঙালি বিহারিরাও বাঙালিদের ওপর নির্যাতন শুরু করে।

পাকিস্তানিদের দুঃশাসন ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিশোধের জন্য জাহানারা বেগম তাঁর স্বামীর সাথে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়াতে চলে যান। পঞ্চগড়ে থাকার সুবিধামতো জায়গা না থাকায় তাঁরা প্রথমে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরে চলে যান। পরে তাঁর স্বামীর এক বন্ধুর সহযোগিতায় জলপাইগুড়ি জেলায় পানবাড়ি ক্যাম্পে যান জাহানারা । ৬ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার জনাব এম, কে বাশারের অনুমতি নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জাহানারা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার পানবাড়ি ক্যাম্পে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন। পানবাড়ি অস্থায়ী হাসপাতালে নার্সিংয়ের পাশাপাশি তিনি সশস্ত্র প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। অস্ত্রের মধ্যে গ্রেনেড, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরকদ্রব্য ব্যবহার অন্যতম। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কাজ শুরু করেন পানবাড়ি ক্যাম্পের অস্থায়ী হাসপাতালে। অসংখ্য আহত যোদ্ধাদের সেবা করেছেন তিনি। আহতের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা, ইনজেকশন পুশ করা, নিয়মিত ঔষধ খাওয়ানো ছাড়াও অপারেশনের সময় ডাক্তারদের সহযোগিতা করা ছিল জাহানারার মূল কাজ। আহতের অবস্থা বেশি খারাপ হলে জলপাইগুড়ি সদর সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হতো। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেন এবং প্রশংসিত হন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মন্তব্য করতে বললে তিনি জানান— আমরা কখনোই ভাবি নি যে, এত দ্রুত দেশ স্বাধীন হবে। আহত যোদ্ধাদের স্মৃতি মনে পড়তেই এখনো শিউরে উঠি আমি। কী নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা! দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য তাঁরা নিজের জীবনকে বাজি রেখে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছেন অথচ যে দৃঢ় প্রত্যয় তাঁদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে, তা জীবনে ভুলব না।

দেশের স্বাধীনতার পরে রংপুরে ফিরে আসেন জাহানারা। এরই মধ্যে তাঁর স্বামী মারা যান। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জননী তিনি। তিনি বর্তমানে অসুস্থ। ছেলে- মেয়েরা বেকার। সংসারে আয় নেই বললেই চলে। আর্থিকভাবে তিনি এখন খুবই বিপন্ন। রোগ, শোক এবং আর্থিক দীনতায় জরাজীর্ণ হয়েও, এখনো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে জীবনের শ্রেষ্ঠ গৌরব মনে করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পরিবারের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে।

সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জীবনবাজি রেখে রণাঙ্গনে নেমেছিলেন যে বীর নারী তার জীবন আজ মুক্তিহীন। দেশ ও জাতির কাছে তিনি চান একটি মুক্ত সমাজ, স্বাধীনতার চেতনায় ভাস্বর একটি সুন্দর স্বচ্ছন্দ সমাজ।

error: Content is protected !!