জান হচ্ছে আমাদের ডাইনের হাইকোর্ট। ওই যে যারা ডাইন হয়, ওদেরই সত্যিই ডাইন বলি। কি জানি সত্যিই পায়, না মিথ্যা, আমরা বিশ্বাস করি সত্যিই পায় বলে, কেননা মারাং বুরুর কাছে সিদ্ধ লাভ করেছে। আর পরীক্ষাও করছি, দেবতার শক্তিতেই বলে না ফাঁকিবাজি করে জান হচ্ছে।
কোন লোক ওষুধে ভাল না হলে প্রথমে ওঝার কাছে নিয়ে খাড়ি (গুটি চালান বা খড়ি দেখা) করাই; তারপর গ্রামে গ্রামে ডাল পুঁতি, অতঃপর জানের কাছে যাই, গ্রাম শুদ্ধ লোকের অসুখ করলে, মাঝি সমস্ত পুরুষ মানুষদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, আর একজনের অসুখ করলে সেই মাঝির কাছে কাঁদবে, তারপর রোগীর তরফের দুই একজন আর খাড়িতে যাকে পাওয়া গেছে তার স্বামী বা ভাই আর গ্রামের পাঁচ ছয়জন সাক্ষী জানের কাছে যাবে। এক সঙ্গেই থাকবে, যেন কেউ লুকিয়ে জানকে কিছু না বলতে পারে। জানের কাছে একবারে যাবে না (সোজাসুজি যাবে না), বাইরে ডেরা বাঁধে। কোথাকার লোক, কি জন্য এসেছে, কার জন্য এসেছে, আর কি অসুখ, সে সবের কথা কাউকে কিছু বলে না। জানের গ্রামের মাঝিকে বলবেঃ ওগো বাবা, গুরুর কাছে তেল, পূজা করতে দাও। তারপর সে জিজ্ঞাসা করবেঃ কতজন পূজা করাবে (দেখাবো)? বলিলঃ এতজন অতজন আছি। সেই মাঝি জানের কাছে নিয়ে যাবে। মাঝি তাদিগকে পূজার জিনিস হাজির করাবে, যেমনঃ একটি সুপারি, একটি ভাউনিচ (পাতার খলা বা বাটি) আতপচাল, তেল সিন্দুর, ধূনা আর বেলপাতা।
তখন জান বলিবেঃ আচ্ছা এসো তবে পরে এই এই বেলা। তারা ডেরায় ফিরে যাবে। সেখানে গ্রামের কোনও লোক এসে কিছু জিজ্ঞাসা করলে কথা বলবে না, অন্য দেশ আর অন্য গ্রামই বলবে। ধার্য সময়ে জানের কাছে যাবে। জান কখনো তার ঘরেরই দোষ দেয়, আর কখনো ‘জাহেরে’ কি বাইরে। তারা চুপচাপ বসে আছে, আর নিজ আতপ চাউল অনেক জায়গায় দেবতার বানে রেখে যায়, আর বেলপাতা তাতে রেখে যায়; ওর পর চাল রাখা জায়গাতে সিন্দুর দিয়ে যাবে তেলে গুলে; আর ধূপের সরার আগুনে ধুনা ফেলে রাখবে, শাঁখ বাজাবে আর পূজার ঘণ্টা বাজাবে আর দেবতাদের পূজা করে তারপর ভর দেয়, ভর দিয়ে বকতে থাকে।
প্রথমে তাদের দেশের নাম বলবে, ওটার পর গ্রাম, তারপর কুলহই (গ্রামের রাস্তা) কোন কোন দিকে আছে, সেই সব বলেঃ তারপর মাঝি, ওটার পর ফরিয়াদী লোক, ওটার পর তার কাকা, জ্যেঠা, ভাই, ভগিনীদের ছেলেদের, মেয়ে আর ওঝা যতজন আর সকলের নাম বলবে।
তারপর জিজ্ঞাসা করবেঃ কি বাবা এই সমস্ত ঠিক বলেছে কি না? তারপর বলবেঃ ঠিকই, বিশ্বাস করলাম, এবারে ভেঙ্গে বলে দেন। জান উত্তর দেয়ঃ দাও ‘বুন্দা’ (ঠাকুরের টাকা) দাখিল কর; তবে তো বলবো। তারপর একটি করে টাকা দেয়। আর চুক্তি করে গিয়ে থাকলে, যত টাকা চুক্তি করেছে, সেটাও চেয়ে নিবে; সে সব দিলে পরে তবে বলবে ডাইন কি দেবতা, আর তারা কারা। তারপর জান বলবে; এত এত জায়গায় ‘ঠালি ঢাউরা’ করেছ, এটা-ওটা ঠিক করে ছিলে কি না? তাহার জবাব দিবে হে বাবা ঐগুলিই। তখন জান তাদের বলবেঃ যদি তৃপ্ত না হয়ে থাক তাহলে সাত সখার কাছে (সাত জায়গায়) বুঝে দেখ। সাত সখার আলাদা হলে বুন্দা টাকা ফেরৎ দিয়ে দিব। তারপর ঘরে ফিরে আসবে। বঙ্গা ধরা হলে, অসুস্থ লোক বাজী মানত করবে, আর ডাইন ধরা হলে হুড়ুম দুড়ুম করে জরিমানা করে আর বে-আবরু করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। এক জানের কাছে ডাইন হয়েছে, লোক খুশি না হলে অন্য জানের কাছে নিয়ে যায়, পুনরায় প্রমাণ করবে বলে কিন্তু সেটা আজকাল, কিন্তু ডাইনেরা এক জায়গায় দোষী হলে, হাজার জানের কাছে গেলেও সেই কাথাই বলে। শুধু দুই একজন ডাইনী গুণে (বিদ্যায়) জানদের কথা গড়বড় করতে পারে মাঝির স্ত্রী ডাইনি ধরা হলে তাড়াতে পারে নাঃ নিজেই উল্টো যে লোকটিকে খাচ্ছে তাকে বলবেঃ যাও দেখে নাও কোন দিক, সুখ যদি না হচ্ছেত, আমি গ্রাস করেছি; আমি কোথায় যাব?
আজকাল জানেরা ভীষণ ঠকাচ্ছে। পূর্বের মত ধরম জানদের (ধার্মিক জানদের) মত সত্য এদের নাই। পূর্বে জানেরা জান শিক্ষা করে নাই, আপনা হতেই পেয়েছিল। তারা ভার দিচ্ছিল না, রাত্রের বেলা স্বপ্নে পেত কি দিনের বেলা জলে দেখে। দেবতা এসব বলে দেয় যে, অমুক অমুক অমুক আসছে এটা ওটার জন্য, তুমি তাদের এইরকম বলবে। আজকাল সে রকম জান নাই, বেশির ভাগই ফাঁকিবাজি করে সূত্র জিজ্ঞাসা করছে, টাকা খাচ্ছে। সেইজন্য ‘ফুলধারিয়া’ (পূজার ফুল যোগাড় করে জানের পূজা ইত্যাদিতে সাহায্য করে) রেখেছে বেড় কাটাবার জন্য। আর যে জানের ‘ফুলধারিয়া’ নাই তারা দেখে শুনে বলে। আধা নাম বলে দেখে, আর জান করতে আসা লোকদের দিকে তাকায়, ঠিক কিনা আর বেঠিক হলে আরও নাম বলে দেখবে। সেই জন্য আল জানদের মিল খাচ্ছে না। ‘ফুলছারিয়া’ রাখা জান সহজেই বের করে নিতে পারে সেরকম জান ঠিক না বলতে পারলে বলেঃ বাবা বেড় আছে, ওটা সরান করাও। তারপর ফুলধারিয়ার কাছে যায়। বেড় কাটাবার জন্য কি কি লাগিবে, সেসব জান বলে দিয়েছে। ফুলধারিয়া সেসব পূজা করবে, মুরগী ফরিড়ং কি ব্যাং কি শেওলা কি সাদা বিড়াল। পূজা করবার আগে জিজ্ঞাসা করেঃ কার নামে বেড় কাটব? তখন মাঝি পারানিকদের নাম বলে দেয়, ফরিয়াদী লোকের নামও বলে, আরও দুই এক কথা বলে দিয়ে পূজা করবে। তারপর তাদের বলবেঃ সন্দেহ তোমাদের থাকলে আমাকে পাহারা দিতে পার, জানের কাছে যাব না। কিন্তু নিজের ঘরে যাবেই, আর তার ঘরের লোক আর জালেনর ঘরের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা হতে পারে, তাহলে অনেক চালাকি হতে পারে।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ২য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ কিছু কথাঃ যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে
একঃ ভূতের ভর
♦ ভূতের ভরঃ বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা
♦ গুরুর আত্মার খপ্পরে জনৈকা শিক্ষিকা
♦ প্রেমিকের আত্মা ও এক অধ্যাপিকা
ভূতে পাওয়া যখন ম্যানিয়াস ডিপ্রেসিভ
♦ সবার সামনে ভূত শাড়ি করে ফালা
♦ গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা
♦ একটি আত্মার অভিশাপ ও ক্যারেটে মাস্টার
দুইঃ পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
♦ ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনী ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
♦ এক সত্যি ভূতের কাহিনী ও এক বিজ্ঞানী
♦ বেলঘরিয়ার গ্রীন পার্কে ভূতুরে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
♦ দমদমের কাচ-ভাঙ্গা হল্লাবাজ-ভূত
তিনঃ যে ভূতুরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
চারঃ ভূতুরে চিকিৎসা
♦ ফিলিপিনো ফেইথ হিলার ও ভূতুরে অস্ত্রোপচার
♦ ফেইথ হিলার ও জাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়র)
♦ পরকাল থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার
♦ বিদেহী ডাক্তার দ্বারা আরোগ্য লাভ
♦ ডাইনী সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার ভূতুরে চিকিৎসা
পাঁচঃ ভূতুরে তান্ত্রিক
♦ গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুরে ফটোসম্মোহন
♦ ভূতুরে সম্মোহনে মনের মত বিয়েঃ কাজী সিদ্দীকির চ্যালেঞ্জ
ছয়ঃ ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
♦ ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ
♦ ডাইনি হত্যা বন্ধে যে সব পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ
♦ জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
সাতঃ আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়- ফুঁক
♦ ‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাত চালান’এ বিষ নামান
আটঃ ঈশ্বরের ভর
♦ ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ, কখনো অভিনয়
♦ কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’ইয়ের মেলায় ভর
♦ হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর
♦ আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত
♦ একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও মা’য়ের ভর
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমী’র মধ্যে সরস্বতীর অধিষ্ঠান (?) ও প্রডিজি প্রসঙ্গঃ
♦ প্রডিজি কি? ও কিছু বিস্ময়কর শিশু প্রতিভা
♦ বংশগতি বা জিন প্রসঙ্গে কিছু কথা
♦ বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে দু-চার কথা
♦ দুর্বল স্মৃতি বলে কিছু নেই, ঘাটতি শুধু স্মরণে
♦ মানবগুণ বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব জীবনে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমীর রহস্য সন্ধানে
♦ বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মহম্মদ আলি শূন্যে ভাসেন আল্লা-বিশ্বাসে!