প্রদীপের জন্ম ১৯৮৩-তে। এরই মধ্যে বিভিন্ন হিন্দি পত্র-পত্রিকার কল্যাণে প্রদীপ জাতিস্মর হিসেবে যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে। প্রদীপের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের আলিগড় জেলার সীতামাই গ্রামে। গ্রামের প্রায় সকলেই গরিব ভূমিহীন কৃষক।

প্রদীপরাও এর বাইরে নয়, প্রদীপের বাড়ি বলতে মাটির চার দেওয়ালের ওপর খড়ের চাল।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানতে পারা যায়, প্রদীপ হঠাৎই একদিন বলতে শুরু করল, ওর গত জন্মের নাম কুল্লো লালা। থাকত মেদু গ্রামে। ব্যবসা করত। যথেষ্ট ধনী ছিল।

প্রদীপের কথায় কেউই মাথা ঘামায়নি। বাচ্চা ছেলের খামখেয়ালি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। মেদু সীতামাই থেকে বারো কিলোমিটার দূরে। মেদুর এক ফলওয়ালা ফেরি করে ফল বিক্রি করত। সীতামাইতেও যেত ফলের পসরা নিয়ে। সেখানে প্রদীপের মুখে কুল্লো লালা ও মেদু গ্রামের কথা শুনে চমকে উঠল। সত্যিই তো মেদু গ্রামে কুল্লো লালা ছিলেন। ৮০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চম্বলের ডাকাতদের গুলিতে মারা গেছেন। কতই বা বয়স তখন কুল্লোর? বছর ছত্রিশ।

ফলওয়ালা প্রদীপের কথা জানাল কুল্লোর দাদা মুন্না লালাকে। মুন্নাও ধনী ব্যবসায়ী। নিজের ধান্দাতেই ব্যস্ত থাকেন। প্রদীপের কথা কানে গেল কুল্লোর স্ত্রী সুধা ও দুই ছেলে রবিকান্ত ও প্রকাশের। প্রধানত সুধা, রবি ও প্রকাশের আগ্রহে মুন্না লালা একদিন ফলওয়ালার সঙ্গে সীতামাই গেলেন। প্রদীপের সঙ্গে দেখা করতেই বিস্মিত হলেন। প্রদীপ মুন্নাকে চিনতে পেরেছিল কুল্লোর দাদা বলে। মুন্না প্রদীপকে মেদুতে নিয়ে এলেন।

মেদুতে এসে আরও চমক দেখাল প্রদীপ। চিনতে পারল স্ত্রী সুধাকে, দুই ছেলে রবিকান্ত ও প্রকাশকে। কুল্লো লালা ফিরে এসেছেন শুনে তাঁর পরিচিতেরা অনেকেই এমন এক বিস্ময়কর ঘটনাকে নিজের চোখে দেখতে ছুটে এলেন। প্রদীপ প্রত্যককে চিনতে পারল। প্রত্যেক ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক। প্রদীপ একতা তাক থেকে কিছু টাকা বের করল, যে টাকা মৃত্যুর আগে কুল্লো রেখেছিল। এই টাকার হদিস কুল্লো ও সুধা ছাড়া আর কারোরই জানা ছিল না।

পত্র-পত্রিকায় এই জাতীয় প্রতিবেদন পড়ার পর সাধারণ মানুষ মাত্রেই ধরে নিয়েছিলেন আত্মা যে অমর, পুনর্জন্ম আছে, তারই অব্যর্থ প্রমাণ এই প্রদীপ। প্রদীপের জাতিস্মর রহস্যের উন্মোচন করা ছিল যুক্তিবাদীদের কাছে চ্যালেঞ্জ। ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির সানান এডামারুকু তথ্যানুসন্ধানে হাজির হলেন মেদু গ্রামে। মুন্না লালা তাঁর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, খবরের কাগজের প্রতিবেদনগুলো সত্যি নয়। সম্ভবত রং-চঙ্গে গল্প ফেঁদে পাঠকদের আকর্ষণ করার জন্য ওইসব লিখেছে। নতুবা এমন সব মিথ্যে লেখার কারণ কি থাকতে পারে?

মুন্নার কথায় আসল ঘটনা হল, এক ফল বিক্রেতা প্রায় দিনই এসে ঘ্যান ঘ্যান করত- সীতামাই গ্রামে নাকি কুল্লো আবার জন্ম নিয়েছে প্রদীপ নামে। ও নাকি হলফ করে বলতে পারে প্রদীপই কুল্লো। ফলবিক্রেতার কথায় একটুও বিশ্বাস করিনি, একটুও আমল দেইনি। তবু দিনের পর দিন ও এসেছে। একই কথা বলে গেছে। শেষ পর্যন্ত কুল্লোর স্ত্রী ও ছেলেদের কথায় পদীপকে দেখতে গেছি, সঙ্গী হয়েছিল ওই ফলবিক্রেতা।

প্রদীপের বাড়ি গিয়ে ওই ফলবিক্রেতা আমাকে দেখিয়ে বলেছিল আমি কুল্লোর বড় ভাই মুন্না, আমাকে প্রদীপ চিনতে পারছে কি না?

প্রদীপ বলেছিল, চিনতে পারছে, তারপরই এক দৌড়ে খেলতে চলে গিয়েছিল।

প্রশ্ন- প্রদীপকে আপনি মেদিতে নিয়ে আসার পর আপনার কি মনে হয়েছিল ও কুল্লো?

উত্তর- না মশাই, আমি প্রদীপকে আদৌ নিয়ে আসিনি, আমি সীতামাই থেকে ফিরে আসার পর হঠাৎই একদিন প্রদীপকে নিয়ে ওর মা-বাবা ও সেই ফলবিক্রেতা এসে হাজির। সেই সময় ও অবশ্য আমাকে চিনতে পেরেছিল।

প্রশ্ন- ওর পূর্বজন্মের স্ত্রীকে চিনতে পেরেছিল?

উত্তর- না। প্রদীপের বাবা প্রদীপকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলো তো তোমার আগের জন্মের বউয়ের নাম কি?

উত্তরে প্রদীপ জানিয়েছিল- সুধা। ওর মুখে ‘সুধা’ নামটা শুনে আমাদের পরিবারের সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য মনে হয়েছে- প্রদীপকে হয়তো শেখানো হয়েছিল ওর আগের জন্মের স্ত্রীর নাম সুধা। কাছাকাছি গ্রাম। সুতরাং এ-সব বাড়ির খবর কারও জানার ইচ্ছে থাকলে নিশ্চয়ই জেনে নিতে পারে।

মুন্না জানিয়েছেন প্রদীপের তাক থেকে টাকা বের করার কথটা একেবারেই গপ্পো কথা।

মুন্না আরও জানালেন, পত্র-পত্রিকায় যেভাবে লেখা হয়েছে প্রদীপ কুল্লোর ছেলেদের ও পরিচিতজনদের চিনতে পেরেছিল, ব্যাপারটা ঠিক তেমনভাবে ঘটেনি। কুল্লোর পরিচিতজনেরা ও দুই ছেলে প্রদীপকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের অনেকেই প্রশ্ন করেছিল- আমাকে চিনতে পারছ?

প্রদীপ এক সময় উত্তর দিয়েছিল- তোমাদের প্রত্যেককে আমি চিনতে পারছি।

সুধা জানিয়েছিলেন, প্রদীপ তাকে সুধা বলে চিনতে পেরেছিল- কথাটা ঠিক নয়। প্রদীপ জানিয়েছিল তার আগের জন্মের স্ত্রীর নাম সুধা।

প্রশ্ন- আপনি কি প্রদীপকে কোন প্রশ্ন করেছিলেন?

উত্তর- হ্যাঁ, বিয়ের রাতে আমার স্বামী আমাকে যে আংটিটা দিয়েছিলেন, সেটা দেখিয়ে প্রদীপকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলো তো এটা কবে আমাকে দিয়েছিলে?

প্রশ্ন- কি উত্তর দিল?

উত্তর- আমার আংটিটা দেখে কোন উত্তর না দিয়ে বলল- পরে বলব। কিন্তু আর বলেনি।

রবিকান্ত ও প্রকাশ জানালেন- তাঁদের দুজনকে প্রদীপ চিনতে পারেনি। কুল্লোর দুই ছেলের নাম বলেছে। এ তো সামান্য চেষ্টাতেই আগে থেকে জেনে নেওয়া সম্ভব। প্রদীপ আগের জন্মে বাবা ছিল, এমনটা মেনে নিতে দু’জনেরই ঘোরতর আপত্তি আছে।

 প্রতিবেদক সীতামাই গ্রামে প্রদীপের বাড়ি হাজির হয়েছিলেন মিথ্যে পরিচয়ে- কুল্লো লালার আত্মীয়।

প্রদীপকে যখন প্রশ্ন করা হল, “তোমার আগের জন্মের নাম কি ছিল?”

“কুল্লো লালা, তাই না?” বলে প্রদীপ ওর মায়ের দিকে তাকাল।

“তোমার আগের জন্মের স্ত্রীর নাম কি ছিল?”

“সুধা বলো সুধা।“ মা ও বাবা প্রদীপকে উত্তর যুগিয়ে দিলেন। প্রদীপ বলল, “হ্যাঁ সুধা।“

“যখন তুমি কুল্লো ছিলে তখন কোন কলেজে পড়তে মনে আছে? মথুরা কলেজ, না আলিগড় কলেজে?”
প্রদীপ মায়ের দিকে তাকাল।

প্রতিবেদকের আবার প্রশ্ন- “তুমি আলিগড় কলেজে পড়তে মনে পড়ছে না?”

প্রদীপের উত্তর দিল, “হ্যাঁ মনে পড়েছে। আলিগড় কলেজে পড়তাম।“

বাস্তবে কুল্লো ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিলেন।

ফেরার সময় প্রতিবেদক ১৯৮৭ সালের মডেলের মারুতিতে উঠতে উঠতে প্রদীপকে বলেছিলেন, “মনে পড়ছে, এই গাড়িটা তুমি আগের জন্মে নিজেই চালাতে?”

পদীপ ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ মনে পড়েছে।“

বুঝুন? ৮৭ সালের মডেল ৮০ সালে মৃত কুল্লো চালাতেন?

লালা পরিবারের প্রত্যেকেরই সন্দেহ প্রদীপকে কুল্লো বলে চালাবার পেছনে প্রদীপের পরিবার ও ফলবিক্রেতার গভীর কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে। সম্ভবত ধনী লালা পরিবারের ধনের লোভেই প্রদীপকে কুল্লো সাজাতে চাইছে ওরা।

error: Content is protected !!