এতক্ষণ বিভিন্ন জাতিস্মর কাহিনী বা ‘কেস’ নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি। এ’বার দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার পালা। সংক্ষিপ্ত অথচ প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে সে’সব ঘটনার আলোচনায় যাব, যেগুলো গুরুত্বের দিক থেকেও দ্বিতীয় পর্যায়ের। গুরুত্বের মাপকাঠি ঠিক করল কে বা কারা? না, আমরা বিলকুল এ’সব ব্যাপারে নেই। তাত্ত্বিকভাবেই আমরা জানি, অতি স্পষ্টভাবে ঐ স্বচ্ছতার সঙ্গেই জানি- ‘আত্মা’=’চিন্তা’ বা চিন্তার কারণ’, যাই হোক না কেন তা অবশ্যই মরণশীল। এরপর মৃত্যুর পর আত্মার বেঁচে থাকা ও জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের চোখে ‘জাতিস্মর’ ব্যাপারটা প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বহীন ও অবাস্তব।

তবু এর পরও জাতিস্মর-কাহিনী শুনলেই আমরা যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে বারবার ছুটে গেছি ঘটনাস্থলে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে ফাঁক আর ফাঁকি আছে, এটা হাতে-কলমে প্রমাণ করতেই ছুটে গেছি। অধ্যাত্মবাদের ‘প্রতারক’ চরিত্রটিকে বে-আব্রু করতেই ছুটে গেছি। ফলও পেয়েছি। আমাদের লাগাতার ঐকান্তিক ও নিখুঁত চেষ্টার ফসল হিসেবে আজ বহু সাধারণ মানুষও এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন- “যে যত বড় প্যারাসাইকোলজিস্ট সে তত বড় প্রতারক (ওই, ‘যত বড় জ্যোতিষী তত বড় প্রতারক’-এর মত ব্যাপার আর কি)।“ “জাতিস্মর? তার মানে, ও হয় প্রতারক, নয় মানসিক রোগী।“

দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচ্য জাতিস্মর কাহিনীগুলোর ক্ষেত্রে গুরুত্বের মাপকাঠির নির্ধারক প্যারাসাইকোলজিস্টরা।

আসুন এ’বার আমরা ঘটনায় ঢুকি।

 

জাতিস্মর তদন্ত- ৭ : জ্ঞানতিলক

ঘটনাস্থল মধ্য শ্রীলংকার ছোট্ট গ্রাম হেদুনাউয়া। জল-জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ। আর পাঁচটা বাড়ির মতই পাথরের উপর পাথর চাপিয়ে তৈরি কুঁড়েতে থাকেন শ্রী ও শ্রীমতী বাডডিউথানা। শ্রীবাডডিউথানা পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ। গ্রামেই একটা ছোট্ট দোকান ওঁর। শ্রীমতী ঘর সামলান।

১৯৫৬ সালে শ্রীমতী বাডডিউথানা জন্ম দিলেন একটি মেয়ের। মেয়েটি আগাছার মতই বেড়ে উঠতে লাগল। বেশ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ সব কিছু গোলমাল হয়ে গেল। সব কিছু গোলমাল করে দিল ওই ছোট্ট মেয়েটি যার নাম এখন জ্ঞানতিলক বা জ্ঞানতিলখা। হঠাৎই ও বলতে শুরু করলে, আগের জন্মে ও জন্মেছিল তালাওকেল-এ। সে জন্মে ছিল ছেলে। বাড়িতে মা ছিল, বাবা ছিল। ভাই আশে-পাশে ছিল প্রচুর সবুজ গাছ। ছোটবেলায় বোন আমাকে মেরেছিল। দিদি ভালবাসত। দাদা আমাকে মেরেছিল। আমি স্কুলে যেতাম। স্কুলে মাস্টারমশাই পড়াতেন। মাস্টারমশাই আমাকে ভালোবাসতেন। ট্রেন দেখেছি। ট্রেনে করে রানী গিয়েছিলেন, আমি দেখেছি। মা শাড়ি পড়তেন। গায়ের রঙ ছিল ফর্সা। বাবা কাজে যেতেন। আমি বাবার সঙ্গে দোকানে গেছি। বাবার সঙ্গে পোস্ট অফিসে গিয়েছি। সমুদ্র দেখেছি। সমুদ্রের জল নীল। সমুদ্রের পাড়ে বালি থাকে নারকোলগাছ থাকে। আমি ছবি আঁকতাম। আমার নীলরঙ্গের পাজামা ছিল।

জ্ঞানতিলকের কথায় প্রথম প্রথম ওঁর মা তেমন মাথা ঘামাননি। কিন্তু তারপর এক সময় সন্দেহের দোলায় দুলেছেন সত্যিই কি আমাদের জ্ঞানতিলক জাতিস্মর? সত্যিই কি ঈশ্বর জন্মান্তরের অস্তিত্ব কলিযুগে আবার প্রমাণ করতেই জ্ঞানতিলককে পাঠিয়েছেন। প্রমাণ সংগ্রহে কৌতূহলী মা জ্ঞানতিলকের বাবাকে সব কথা জানালেন। তারপর একদিন দু’জনে মেয়েকে নিয়ে গেলেন তালাওকেল-এ। সময়টা ১৯৬০ সাল। জ্ঞানতিলক তখন চার বছরের শিশু। তালাওকেল শহর ছোট্ট শহর। বা বলা যায়, আধা-শহর, আধা-গাঁ। বাসস্ট্যান্ড থেকে পোস্ট অফিসে যাওয়ার পথেই নাকি ছিল ওদের বাড়ি। তিনজনে প্রায় সারা দিন ঘুরেও বাড়ির হদিস না পেয়ে ফিরে আসেন।

ইতিমধ্যে জ্ঞানতিলকের খবর তালাওকেল-এ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ওর মা-বাবা বাড়ির খোঁজ করতে, সম্ভাব্য পরিবারটির খোঁজ করতে অনেককেই বলেছেন তাঁদের অদ্ভুত সমস্যার কথা। মানুষ অদ্ভুত কিছুর প্রতি সাধারণত এক বাড়তি আকর্ষণ অনুভব করে। এ’ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। তালাওকেলের অধিবাসীদের অনেকেই হয় তো ভেবেছেন, ঠিক-ঠাক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় সাহায্য পেলে হয়তো দেখা যাবে জ্ঞানতিলক এক দুর্লভ জাতিস্মর, তালাওকেলের গর্ব। পরিবেশগতভাবে এদের অনেকেই এমনটা ভেবে থাকতেই পারেন- জ্ঞানতিলক জাতিস্মর প্রমাণিত হলে এও প্রমাণিত হবে জাতককাহিনী নেহাতই গল্পকথা নয়। হিন্দুরাও একই ভেবে মনে করতেই পারেন- জ্ঞানতিলকের কথার সত্যতা প্রমাণিত হলে, নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হব আত্মার অবিনশ্বরতা তত্ত্ব।

যাই হোক, দাবানলের মতই গোটা শ্রীলংকাতেই জ্ঞানতিলকের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর কাগজে ছাপার অক্ষরে খবর প্রকাশের আগেই এই কাহিনী শুনলেন কলম্বোর বিদালনকারা কলেজের বৌদ্ধ-দর্শনের অধ্যাপক পিয়দাসী থেরা। শুনলেন ক্যান্ডি কলেজের অধ্যাপক এইচ.এস. নিশাংকা। জ্ঞানতিলকের মুখ থেকে সব কিছু শুনতে পিয়দাসী ও নিশাংকা গেলাম হেদুনাউয়াতে। সেখানে সব শুনলেন। ‘নোট’ করলেন। এ’বার জ্ঞানতিলকের বর্ণনা মত সত্যিই কেউ তালাওকেলে ছিল কি না- তার খোঁজ করার পালা। অনুসন্ধানে নেমে পড়লেন স্থানীয় শ্রীপদ স্কুলের অধ্যক্ষ অসোকা কৌতমাদেসা, শিক্ষক সুমিথাপালা ও অনিরুদ্ধ স্কুলের শিক্ষক তিলক সমরিংঘে।

ওঁরা খুঁজেও বের করলেন একজনকে। তিলকরত্ন। জ্ঞানতিলকের জন্মের আগে তিলকরত্ন মারা যায়। জ্ঞানতিলক তার পূর্বজীবন সম্পর্কে যা যা বলেছে তার সঙ্গে তিলকরত্নের জীবনের আশ্চর্য রকমের মিল খুঁজে পেলেন ওঁরা ! (আরও অনেকের সঙ্গেই খোঁজার চেষ্টা করলেই মিল পেতেন। কিন্তু পাকা মাথা তো…)

এ’বার পিয়দাসী থেরা ও তাঁর অনুসন্ধান-সঙ্গীরা শ্রীলংকার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন, তাঁরা পূর্বজন্মের একটি মহত্বপূর্ণ সত্য ঘটনার সন্ধান পেয়েছেন এবং বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মঞ্জুরী কমিশন ঘটনাটি জানাল শ্রীলংকার তৎকালীন গভর্নর জেনারেলকে। গভর্নর এই তদন্তের কাজে নির্ভরযোগ্য লোক খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলেন, হাতের কাছেই ভাবতে রয়েছেন ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনেক জাতিস্মর খুঁজে বের করার পূর্বঅভিজ্ঞতা তাঁর আছে।

১৯৬১-র জুনে ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন শ্রীলংকায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালালেন। তাঁকে অনুসন্ধানে সাহায্য করলেন সিংহল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ডঃ জয়তিলকা। অনুসন্ধান শেষে তাঁরা নিশ্চিত হলেন, মেয়ে জ্ঞানতিলকই পূর্বজন্মে ছিল ছেলে তিলকরত্ন। তিলকরত্ন যে মেয়ে হয়ে জন্মাবে, তার পূর্বাভাসও নাকি তিলকরত্নই দিয়ে গিয়েছিল। অনুসন্ধানকারীরা জেনেছিলেন তিলকরত্ন দাদার চেয়ে দিদিকে বেশি ভালবাসত। দিদির সঙ্গে মিশতে বেশি পছন্দ করত। দিদির নেলপালিশ ব্যবহার করত। এ’সবই নাকি ওর মেয়ে হয়ে জন্মাবার পূর্বাভাস। (অনেক ছেলেই ছোটবেলায় মা, মাসি, দিদির দেখাদেখি নেলপালিশ ব্যবহার করে, অনেক সময় মা, দিদি, পিসিরা আদরের ছোট ছেলেটিকে শাড়ি পরিয়ে মেয়ে সাজিয়েও মজা পায়। এমন কিছু ঘটলে সে পরবর্তী জন্মে মেয়ে হয়ে জন্মাবে এমন জেনে শিহরিত হচ্ছি ! কি সাংঘাতিক ব্যাপার বলুন তো ! আমি ঘোড়া সেজে ছেলেকে পিঠে নিয়ে অনেক হামাগুড়ি দিয়েছি ! পরের জন্মে আমি ঘোড়া … শিহরিত হচ্ছি ! বিখ্যাত হরবোলা ঘনশ্যাম পাইন কি হবেন? হাঁস, মুরগি, টিয়া, বাঘ, সাপ, হাতি, ঘোড়া, এত-কিছুর ডাক গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে ডাকেন … উনিও কি তবে রামকৃষ্ণের মত বহুভাগে বিভক্ত হয়ে এতগুলো জীব রূপে জনাম্বেন??)

অনুসন্ধানকারীরা জ্ঞানতিলককে ৬১ টি প্রশ্ন করেছিলেন। তার মধ্যে ৪৬ টি তিলকরত্নের জীবনের সঙ্গে একশভাগ মিলে গিয়েছিল। মিলে যাওয়া জ্ঞানতিলকের কথাগুলো এই রকমেরঃ

১. আমার বাবা ছিল।

২. আমার মা ছিল।

৩. আমার ভাই ছিল।

৪. আমার বোন ছিল।

৫. মা রান্না করতেন।

৬. রান্না হতো কাঠের আগুনে। (ওখানে প্রায় সব বাড়িতেই কাঠের আগুনে রান্না হয়।)

৭. মা জ্বালানি কাঠ কিনতেন।

৮. গ্রামের আশে-পাশে প্রচুর গাছ ছিল।

৯. সবুজ গাছ।

১০. ছেলেবেলায় বোন আমাকে মেরেছিল।

১১. দিদি ভালবাসত।

১২. দাদা আমাকে মেরেছিল।

১৩. আমি স্কুলে যেতাম।

১৪. স্কুলে মাস্টারমশাই পড়াতেন।

১৫. মাস্টারমশাই আমাকে ভালবাসতেন।

১৬. ট্রেন দেখেছি।

১৭. ট্রেনে করে রানী গিয়েছিলেন, আমি দেখেছি। (রানী এলিজাবেথের শ্রীলংকা ভ্রমণের কথা ও বলেছিল।)

১৮. মা শাড়ি পরতেন।

১৯. মায়ের গায়ের রঙ ফর্সা ছিল।

২০. বাবা কাজে যেতেন।

২১. বাবার সঙ্গে দোকানে গেছি।

২২. বাবার সঙ্গে পোস্ট অফিসে গিয়েছি।

২৩. সমুদ্র দেখেছি।

২৪. সমুদ্রের পাড়ে বালি থাকে।

২৫. সমুদ্রের পাড়ে নারকোলগাছ আছে।

২৬. আমি ছবি আঁকতাম। (সাধারণভাবে সব বাচ্চারাই ছবি আঁকে।)

২৭. আমার নীল রঙ্গের পাজামা ছিল। ইত্যাদি… ইত্যাদি…।

মধ্য শ্রীলংকায় যে শিশু বড় হচ্ছে, সে এ’ধরনের কথা বলতেই পারে। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে, কিন্তু এই কথাগুলো কখনোই একজনকে জাতিস্মর বলে চিহ্নিত করার পক্ষে চূড়ান্ত প্রমাণ হতে পারে না। একজন শিশু কোনও কারণে নিজেকে জাতিস্মর বলে বিশ্বাস করতে থাকলে (সে বিশ্বাস সচেতন বা অবচেতন-যাই হোক না কেন) সে এই ধরনের তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর কিছু কথা বলতেই পারে, যার বেশিরভাগই পূর্বজন্মের জীবনের সঙ্গে মিলে যেতে বাধ্য। একটি শিশুর তথাকথিত জাতিস্মর হয়ে ওঠার পিছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। একঃ ‘জন্মান্তর আছে’, এই বিশ্বাস তার অবচেতন বা সচেতন মনে রয়েছে। শুনেছে একজনের জীবনের কিছু কথা ও তার মৃত্যুর খবর। নিজের অজান্তে নিজেকে মৃত মানুষটি ভাবতে শুরু করেছে। দুইঃ কোনও বিশেষ কারণে শিশুকে শেখানো হয়েছে- সে জাতিস্মর। পূর্বজন্মের নাম, ঠিকানা ও কিছু তথ্য তার মাথায় ঢোকানো হয়েছে। তিনঃ এই ধরনের কোনও শিশুর খবর পেলে তাঁকে নির্ভেজাল জাতিস্মর প্রমাণ করতে এগিয়ে আসে বিক্রি বাড়াতে চাওয়া প্রচার-মাধ্যম, জন্মান্তরবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া প্যারাসাইকোলজিস্ট-ধর্মগুরু। এ বিশয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে রাষ্ট্রশক্তি। কারণ, রাষ্ট্রশক্তি জানে, ‘এ’জন্মের বঞ্ছনা পূর্বজন্মেরই কর্মফল’ এই তত্ত্ব মানুষের মাথায় গেঁথে দিতেই জাতিস্মরের অস্তিত্ব মাঝে-মধ্যে প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন।

জ্ঞানতিলকের জাতিস্মর হয়ে ওঠার পিছনে ‘তিন’ নম্বর কারণটি অবশ্যই ছিল। সঙ্গে ছিল ‘এক’ অথবা ‘দুই’ নম্বর কারণ। জ্ঞানতিলক ছোটবেলা থেকেই শুনেছে বুদ্ধের জাতক কাহিনী, যার ফলে পূর্বজন্মে বিশ্বাস তৈরি হয়েছে।

পরামনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, জ্ঞানতিলক সমুদ্র দেখেনি। অথচ সমুদ্রের জলের রঙ্গের সঠিক বর্ণনা দিয়েছে, সমুদ্রের পাড়ে যে নারকোলগাছ থাকে তাও ও বলতে পেরেছে। সমুদ্রকূলে বালির বর্ণনাও সঠিক দিয়েছে, এ’সবই বলতে পেরেছে পূর্বজন্মের তিলকরত্নের সমুদ্র দেখার স্মৃতি উদ্ধার করে।

সমুদ্র না দেখে কি সমুদ্রের বর্ণনা দেওয়া করা অসম্ভব? নিউইয়র্ক না দেখতে কি নিউইয়র্কের বিশাল উঁচু উঁচু বাড়ির বর্ণনা করা অসম্ভব? রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি না দেখলেও কি তাঁর চেহারা আমাদের অপরিচিত?

একটা চার-পাঁচ বছরের বাচ্চাকেদ হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, ঘোড়া, ন্দী, সমুদ্র, পাহাড়, ট্রেন- এইসব নানা ধরনের জিনিসের ছবি দেখিয়ে দেখবেন, আপনার বয়স্ক চোখের চেয়েও ওদের চোখ অনেক বেশি ডিটেলস-এর দিকে নজর রাখে। ছোটদের ছবি আঁকতে একগাদা রঙ্গের মাঝখানে বসিয়ে দিন, দেখবেন, অনেক সময় ওদের ডিটেলসের কাজ আপনাকে অবাক করে দেবে। একটা ছোট শিশুকে নদী, পাহাড়, সমুদ্রের রঙ্গিন ছবি দেখাবার পর তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, সে প্রত্যেকটারই সঠিক বর্ণনা দেবে। জ্ঞানতিলক কোনও দিনই কোনও সমুদ্রের ছবি দেখেননি, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

জ্ঞানতিলকের আঁকা একটা ছবি দেখে প্যারাসাইকোলজিস্টরা নাকি বেবাক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একটা রাস্তা, একটা ব্রিজ, একটা বাড়ি, বাড়িতে ওঠার সিঁড়ি পর্যন্ত। এই ছবির মধ্যে ওঁরা খুঁজে পেলেন তিলকরত্নর স্কুলকে। স্কুলের বারান্দায় উঠতে বিস্ময়কর তথ্য কি জানেন? নদী-পাহাড়ের দেশ শ্রীলংকায় এমন ব্রিজের ছড়াছড়ি। জ্ঞানতিলকের জ্ঞানে স্থানীয় ব্রিজের ব্যাপক উপস্থিতি অধরা ছিল না। তাই ছবিতে ব্রিজ এসেছে- এটা ওর জাতিস্মরতার পক্ষে প্রমাণ হল কোথায়? বাড়ি আঁকতে কয়েক ধাপ সিঁড়ি, প্রায় শিশুদের ছবিতেই এর দেখা পাবেন। না জোর করে আমার যুক্তিকে খাড়া করতে এ’কথা বলছি না, ছোটদের ‘বসে আঁকো’ ধরনের অনেক প্রতিযোগিতাতেই অনেক সময় হাজির থাকতে হয়েছে একটু আধটু ছবি-আঁকা বলে। সেখান থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার সূত্রেই এ’কথা বলা। বাড়িতে সিঁড়ির ধাপ দেখে সেটাকে ধরে নেওয়া হল এগুলো স্কুলের সিঁড়ির ধাপ এঁকেছে, অতএব ও জাতিস্মর। সিঁড়ির ধাপ না এঁকে বাড়ির পাশে গরু, কুকুর, বেড়াল, কাক, এমন কি সূর্য আঁকলেও ওইধরনের ছেঁদো যুক্তি খাড়া করে বলাই যেত- এটা একেবারে একশভাগ তিলকরত্নর স্কুল। কারণ ওর স্কুলের সামনে গরু দেখা যেত। একইভাবে স্কুলের কাছে কুকুর, বেড়াল, কাক কিংবা সূর্যের ছবির উপস্থিতিও প্রমাণ করে ছাড়াত- ছবিটা স্কুলেরই।

এবার আসুন আমরা দু’একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য জেনে রাখি।

জ্ঞানতিলকের গ্রাম হেদুয়াউনা থেকে তিলকরত্নের ছোট্ট শহর তালাওকেলের দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার।

অনুসন্ধানকারীরা তাঁদের রিপোর্টে জানিয়েছেন, তলিকরত্নের মৃত্যু ৯ নভেম্বর ১৯৫৪। তাঁদের উল্লিখিত ডেথ সার্টিফিকেট অনুসারে- মৃতের পুরো নাম জানা যায়নি। সংক্ষিপ্ত নাম জি. তিলকরত্ন। নিবাস আবানায়েক। বাবা-মা’র নাম জানা যায়নি। বয়স ১৬ বছর।

অথচ জ্ঞানতিলক বলেছিল, সে থাকত তালাওকেলে (আবানায়েকে নয়)। তালাওকেলের যে তিলকরত্ন শ্রীপদ স্কুলে পড়ত, এবং যাকে বর্তমান জন্মের জ্ঞানতিলক বলে অনুসন্ধানকারীরা চিহ্নিত করেছিলেন, সেই তিলকরত্নর নাম তুরিন তিলকরত্ন। অর্থাৎ সংক্ষেপে টি. তিলকরত্ন, জি. তিলকরত্ন নয়। জি. তিলকরত্নের মৃত্যু ১৬ বছর বয়সে, এবং তুরিন তিলকরত্নের মৃত্যু ১৩ বছর ৯ মাস বয়সে। জি. তিলকরত্নের  মৃত্যু জ্ঞানতিলকের জন্মের বছর দু’য়েক আগে হলেও তালাওকেলের তুরিন তিলকরত্ন মারা যায় জ্ঞানতিলকের জন্মের মাত্র পাঁচ মাস আগে।

জ্ঞানতিলকের মা শ্রীমতী বাডডিউথানা স্বাভাবিকভাবেই দশমাস গর্ভ ধারণের পরই জ্ঞানতিলককে ভূমিষ্ট করেছিলেন। মাতৃগর্ভে জ্ঞানতিলকের যে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল তিলকরত্নের মৃত্যুর প্রায় পাঁচ মাস আগে, সেখানে তিলকরত্নের আত্মার শ্রীমতী বাডডিউথানার গর্ভে প্রবেশের প্রসঙ্গই আসতে পারে না।

এই একটি কারণে, শুধুমাত্র এই একটি কারণেই জ্ঞানতিলকের জাতিস্মর হয়ে ওঠার তত্ত্বকে বাতিল করা যায়।

error: Content is protected !!