যেখানে জাতিস্মর, সেখানেই দৌড়োও। কথাগুলো আমাকে সেই থেকে আজও তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে- চলাটাই হল অমৃতলাভ, চলাটাই তার স্বাদু ফল, এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। তেমনি চলতে চলতে, জাতিস্মর তদন্তের পুঁটলি আজ দস্তুর মত এক ভারী বোঝা। সেই বোঝা ঘেঁটে খুব সতর্কতার সঙ্গে মাপ-জোক করে, ঝাড়াই-বাছাই করে সেইসব জাতিস্মর রহস্যকে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় যেতে চাইছি যেগুলো বিস্ফোরক, অনেক মানুষের চেতনাকে নাড়িয়ে দেবার মত, আচ্ছন্ন করার মত, অথবা যেগুলো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খ্যাতি বা কুখ্যাতির অধিকারী প্যারাসাইকোলজিস্টরা ‘উল্লেখযোগ্য কেসহিস্ট্রি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁদের নানা সাক্ষাৎকারে ও লেখায়। এইসব ‘উল্লেখযোগ্য কেসহিস্ট্রি’ নিয়ে বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয়ে দারুণ দামের গাবদা-মোটা ঝাঁ-চকচকে বই। ভারত থেকে ‘জন্মান্তরবাদ’ নিয়ে যে’সব বই প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোতেও এইসব ‘কেসহিস্ট্রি’ জায়গা করে নিয়েছে। এ’বার যে ঘটনা নিয়ে আলোচনায় যাব, সেটাও বিশ্ব-বিখ্যাত উল্লেখযোগ্য জাতিস্মর কেসহিস্ট্রির অন্যতম।

“এই ঘটনার মুখ্য চরিত্রদের আমি ব্যাপকভাবে অনুধাবন করার পর স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে গীতার মৃত্যুর সাথে সাথেই তার বিদেহী আত্মা অন্য এক মাতৃগর্ভে একটি ভ্রুণের প্রাণ সঞ্চার করে- ন’মাস পরে যে শিশুটি রাজুল নামে জন্মগ্রহণ করেছিল।”

কে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন? কে স্থির ও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন- রাজুল পূর্বজন্মে ছিল গীতা? ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামী-দামী প্যারাসাইকোলজিস্ট ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জন্মান্তরঃ রহস্য ও রোমাঞ্চ” গ্রন্থে (‘রহস্য ও রোমাঞ্চ’ সিরিজের জন্মান্তর নিয়ে গল্প-কাহিনী বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না) এই রাজুল কাহিনী স্থান পেয়েছে। স্থান দিয়েছেন কতটা গুরুত্বের সঙ্গে? ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “রাজুল শাহ-র পুনর্জন্মের ঘটনাটিকে আমি আমার দশটি উল্লেখযোগ্য কেসহিস্ট্রির মধ্যে অন্যতম বলে মনে করি।”

এ’ পর্যন্ত নানা ধরনের কিছু উল্লেখযোগ্য জাতিস্মর-কাহিনী আপনাদের সামনে হাজির করেছি। বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই জাতিস্মর হয়ে ওঠার পিছনে ছিল সত্য-গোপন, তথ্যের বিকৃতি ঘটানো, সত্যানুসন্ধানে আন্তরিকতার অভাব- ইত্যাদি জাতীয় বেশ কিছু ফাঁক-ফোকর। এবার আমরা দৃষ্টিকোণ পাল্টাব। এই রাজূল কাহিনীর সূত্র ধরে আমরা একটু একটু করে বে-আব্রু করব ‘প্যারাসাইকোলজিস্ট’ নামধারীদের গবেষণার নামে প্রতারণার বীভৎস দ্গদগে রূপের একটি নমুনা।

স্রষ্টা সৃষ্টির চেয়ে মহান। জাতিস্মর-স্রষ্টা প্যারাসাইকোলজিস্টরাও তাঁদের সৃষ্টির চেয়ে মহান। এই মহান মানুষদের মুখোশহীন করা একান্তই জরুরি, সাংস্কৃতিক-দূষণ রোধের জন্যই জরুরি। প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা,আসুন, এই জরুরি কাজের জন্য আমরা আমাদের দৃষ্টিকোণ পাল্টাই।

গুজরাটের রাজকোট জেলা হঠাৎই গোটা ভারতের পত্র-পত্রিকায় অনেকটা জায়গা করে নিয়েছিল ১৯৬৫-র নভেম্বর-ডিসেম্বরে। রাজকোটের পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে রাজুল শাহ জাতিস্মর।

রাজুলের জন্ম ১৯৬০ সালের ৪ আগস্ট। বাবা প্রভীনচন্দ্র শাহ। মা প্রভাবেন। রাতুল প্রভীন-প্রভাবেন-এর পঞ্চম সন্তান। মেয়ে। রাজুল জন্মেছিল ছোট্ট শহরে ভিনচিয়াতে। প্রভীন ব্যাংকে কাজ করেন। বদলির চাকরি। রাজুলের জন্মের পর প্রভীন বদলি হলেন রাজকোট থেকে কেশর শহরে। রাজকোট গুজরাটের জেলা শহর। কেশর ওই জেলারই ছোট্ট একটি শহর।

রাজুলের ঠাকুরদা ভি.জে শাহ (ডাক নাম ভজু) পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। কাজ থেকে অবসর নেবার পর ১৯৬০ সাল থেকে সস্ত্রীক থাকতে শুরু করেন ওয়াংকানের-এর গ্রামের বাড়িতে। এ’বাড়িতে থাকতেন ভজু শাহু’র আর এক ভাই হিম্মৎলাল ও হিম্মৎলালের স্ত্রী সুশীলবেন।

বুড়ো-বুড়িদের সংসার। বুঝিবা কিছুটা নিঃসঙ্গতা কাটাতেই ভজু শাহ তাঁর নাতনি রাজুলকে মাঝে-মধ্যে নিজের কাছে এনে রাখতেন। শিশুবয়সের একটা দীর্ঘ সময় রাজুলের কেটেছে দুই ঠাকুরদা ও ঠাকুরমার সঙ্গে।

১৯৬৩ সালে রাজুল প্রথম এমন কিছু কথা বলল, যার মধ্যে লুকোন ছিল ওর পূর্বজন্মের স্মৃতিমন্থন ক্ষমতার পূর্বাভাস। রাজুল এই সময় জানিয়েছিল, ও থাকত জুনাগড়-এ। জুনাগড়? এমন শহরের নাম তো তিন বছরের ছোট্ট রাজুলের জানার কথা নয় ! বিস্ময় আকাশ ছুঁয়েছিল যখন রাজুল জানাল, ওর নাম ছিল গীতা। গীতা? এমন নামে তো ভুলেও কেউ কোনও দিন ডাকেনি রাজুলকে? আর তাছাড়া এমন হিন্দু নাম তো এই জৈন পরিবারের নিকট কি দূর, কোনও আত্মীয়েরই নেই ! গীতার প্রিয় বান্ধবীটির নাম জ্যোৎস্না। এতদিন রাজুলের সব বন্ধু আর বান্ধবীদের নামই জানা হয়ে গেছে। কিন্তু, জ্যোৎস্না নাম তো এই প্রথম শোনা গেল রাজুলের মুখে। প্রথম শুনলে কি হবে, জ্যোৎস্নাই নাকি সেরা বন্ধু ! গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময় ! কিন্তু কৌতূহলী ও কিছুটা বিস্মিত ঠাকুরদা-ঠাকুরমা রাজুলকে এব্যাপারে বিশেষ কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি। কারণ পরদিনই রাজুলকে বাবা প্রভীন নিজের বাসা-বাড়ি কেশর-এ নিয়ে যান। প্রভীনকে অবশ্য তাঁর বাবা রাজুলের এইসব অদ্ভুত কথাবার্তার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রভীন সে’সব কথায় বিশেষ কান দেননি। এইটুকু বাচ্চা মেয়ের ওসব আজগুবি কথায় গুরুত্ব দেওয়া নেহাতই পাগলামি।

কেটে গেছে আরও দুটি বছর। ৬৫-র মে’তে রাজুল এলো ঠাকুরদাদের বাড়িতে। রাজুলের বয়স এখন পাঁচ। ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে রাজুল এ’বার এসেই শুরু করল, ও যখন গীতা ছিল তখনকার নানা কথা। এ’বার আর বুঝতে অসুবিধে হল না রাজুল ওর গতজন্মের কথা বলছে। এতদিন যে’সব কথা বাবা-মা ও ভাই-বোনদের কাছে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারেনি ওদের কল্পনা বলে উড়িয়ে দেবার প্রবণতায়, সে-সব না বলা কথাই বেরিয়ে আসতে লাগল এ’বাড়িতে উৎসাহী শ্রোতাদের পেয়ে।

একদিনের ঘটনা। রাজুল আপন মনে গোল হয়ে ঘুরছিল, আর মুখে কি যেন বলছিল। ঠাকুরদা ভজু শাহ রাজুলের কাছে জানতে চাইলেন, এটা কি খেলা? রাজুল জানাল, “আমি ‘জুনাগড় গিরভি’ খেলছি। আগের জন্মে যখন গীতা ছিলাম, তখন তো জুনাগড়ে থাকতাম, তখন এই খেলা খেলতাম।”

তারপর একটু একটু করে গীতার জীবনের অনেক কথাই বলেছে। কি কি বলছে, তা ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটি থেকেই তুলে দিচ্ছিঃ

একঃ “আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন সকলে আমাকে ‘বেবি’ বলে ডাকত। তারপরে যেদিন বসন্তের টিকা দেওয়া হয়ে গেল তখন থেকে আমাকে সবাই ‘গীতা’ নামে ডাকত।”

দুইঃ “খুব ছোটবেলাতেই আমার একবার ভীষণ বেশি জ্বর হয় আর তাতেই আমি মারা যাই।”

তিনঃ “আমার আগের বাবার লোহালক্কড়ের দোকান ছিল।”

চারঃ “আমার এখনকার বাবা তো ফুলপ্যান্ট পরে কিন্তু আগের বাবা বেশিরভাগ সময়েই ধুতি পরত।”

পাঁচঃ “আমরা সবাই পিতলের বাসনে খেতাম। কেবল বাবা স্টিলের থালা ছাড়া খেত না।”

ছয়ঃ “তখন আমরা বেশ রাত্রি হলে খাবার খেতাম ঘুমোতে যাবার আগে। এখন তো সূর্য ডোবার আগেই রাতের খাবার খেয়ে নিতে হয়।” (জৈনরা সূর্য ডোবার আগেই রাতের খাবার খান।)

সাতঃ “আমাদের পুরোনো বাড়ির ঠাকুরেরা সব জামা-কাপড় পরা চেহারার কিন্তু এখনকার ঠাকুরের গায়ে কোন কাপড় নেই।” (রাজুলরা ছিল জৈন ধর্মের দিগম্বর সম্প্রদায়ের। দিগম্বর সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতা নগ্ন।)

আটঃ “আগের মা খুব লম্বা ও রোগা দেখতে ছিল।”

নয়ঃ “যখন তার নাম গীতা ছিল তখন তারা যে বাড়িতে থাকত সেটা এখনকার মত অত বড় নয়।”

দশঃ “সে বাড়িতে বারান্দা ছিল।”

এগারোঃ “দীপাবলীর সময়ে তার আগের জীবনের বাবা বাড়িটাতে লাল রঙ্গের চুনকাম করেছিল।”

বারোঃ “থ্যাকাররা প্রচুর দুধ কিনতেন এবং বড় বড় পাত্রে সেই দুধ রাখা থাকত।”

রাজুলের ঠাকুরদা ভজু শাহ এ’সব দেখে-শুনে সত্য জানতে দারুন-রকম উৎসাহী হয়ে পড়েন- সত্যিই কি রাজুল জাতিস্মর? নাকি, গোটাই ওর কল্পনা-বিলাস? ভজু শাহর এক জামাতা থাকেন সুরেন্দ্রনগর। নাম- প্রেমচাঁদ শাহ। প্রেমচাঁদের ব্যবসা আছে। ব্যবসার কাজে মাঝে-মধ্যে জুনাগড় যেতে হয় তাঁকে। শ্বশুর ভজু জামাই প্রেমকে অনুরোধ করলেন এ’বার জুনাগড়ে গেলে ও যেন গীতাদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়।

৬৫-র জুনেই কাজে জুনাগড়ে এলেন প্রেমচাঁদ। কাজের ফাঁকে এক সময় গেলেন মিউনিসিপ্যাল রেজিস্টার’স অফিসে। রাজুলের জন্মের বছর খানেকের মধ্যে ‘গীতা’ নামের কেউ মারা গিয়েছিল কি না, এটা দেখাই ছিল উদ্দেশ্য। একজন ক্লার্ক বাবুলাল এ’বিষয়ে প্রেমচাঁদকে সাহায্য করেন। (১৯৬৯-এ আমি যখন জুনাগড় মিউনিসিপ্যাল রেজিস্টার’স অফিসে গিয়েছিলাম, তখন এই বাবুলালই মৃত্যু নথিভুক্তির রেজিস্টার খুলে আমাকে দেখিয়েছিলেন গীতার নাম, গীতা থ্যাকার। মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ১৯৫৯। বাবার নাম গোকুলদাস থ্যাকার।)

রাজুলের কথা এভাবে সত্যি হয়ে ওঠায় শিহরিত হলেন ভজু শাহ। তিনি ঠিক করলেন রাজুলকে নিয়ে গোকুলদাসের বাড়ি যাবেন। যাওয়ার আগে রাজুলের বক্তব্যগুলো মিলিয়ে দেখার জন্য একটা ‘লিস্ট’ তৈরি করে ফেললেন। রাজুলের পূর্বজীবনের বাইশটা বক্তব্যের তালিকা। (ভজু শাহই আমাকে এই বাইশটা বক্তব্যের তালিকা তৈরির কথা জানিয়েছিলেন। এই তালিকার বারোটি ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তালিকায় উল্লেখ করেছি। বাঁকি এখানে তুলে দিচ্ছি।)

একঃ গীতার বাবা দেওয়ালী উপলক্ষে বাড়ির বাইরেটা লাল রং করার আগে বাড়ির রং ছিল সবুজ।

দুইঃ ওরা থাকত একতলায়।

তিনঃ উনুনে রান্না হতো। দুধ গরম হতো।

চারঃ মায়ের নাম শান্তা অথবা কান্তা।

পাঁচঃ রাজুলের বাবা ছিলেন গীতার বাবার বয়সী।

ছয়ঃ বাবার মিষ্টির দোকান ছিল। (ওদের যে লোহার ব্যবসা ছিল, এ’কথাও বলেছিল রাজুল।)

সাতঃ গীতার একটি ছোট ভাই ছিল।

আটঃ প্রিয় বন্ধু জ্যোৎস্নারা থাকত বাড়ির কাছেই।

নয়ঃ মা প্যাঁড়া বানাত।

দশঃ বাড়ির পুজোয় ঠাকুরকে খেতে দেওয়া হতো প্যাঁড়া।

(১৯৬৯-এর ডিসেম্বরে শ্রীশাহ আমাকে জানিয়েছিলেন, আমার আসার প্রায় আগে আগেই ডঃ আয়েন স্টিভেনসন ও ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন রাজুল রহস্য নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে। তাঁদের দু’জনকেই শ্রীশাহ রাজুলের বাইশটি বক্তব্যের তালিকা দেখিয়েছিলেন। ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “.জন্মান্তরবাদঃ রহস্য ও রোমাঞ্চ” গ্রন্থে দেখেছি তিনি তালিকার এগারোটি বক্তব্য আলোচনায় এনেছেন। এগারোটি বিষয়ে অদ্ভুত নীরবতা পালন করেছেন। এটি অবশ্যই একটি তথ্য গোপনের দৃষ্টান্ত। কেন তথ্য গোপন? এই তথ্য গোপন কি সত্যকে বিকৃত করেছে? নাকি এই তথ্য ছিল অতি অপ্রয়োজনীয়?

না, এ’বিষয়ের কোন মন্তব্য না করে নিরাসক্ত ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন তথ্য হাজির করব, যার সাহায্যে প্রিয় পাঠক-পাঠিকারাই উত্তর খুঁজে নিতে পারবেন।

আয়েন স্টিভেনসন তাঁর লেখা “The Case of Rajul Shah”-তে এই ধরনের সরাসরি তথ্য গোপনের কোন স্থূল চেষ্টা করেননি। তিনি শ্রীশাহের তৈরি বাইশ-দফা তালিকা হিসেবে আইটেমগুলোর উল্লেখ না করলেও রাজুল যে এ’সব কথা বলেছিলেন, গ্রন্থটিতে তা জানিয়েছিলেন।)

১৯৬৫-র নভেম্বরে ভজু শাহ রাজুল রহস্য সন্ধানে জুনাগড়ে এলেন। সঙ্গে স্ত্রী, ভাই হিম্মৎলাল, জামাই প্রেমচাঁদ ও রাজুল। গোকুলদাস থ্যাকারের বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু গোকুলদাসকে পাওয়া গেল না। কারণ, গীতার মৃত্যুর পর গোকুলদাস বাড়ি পাল্টেছেন। সেদিন  না পাওয়া গেলেও পাওয়া গেল। দু’লাখ লোকের ছোট শহর জুনাগড়ে ব্যবসায়ী গোকুলদাসের ঠিকানার গদিস পাওয়া অসম্ভব ছিল না বলেই পাওয়া গেল।

তারপর যা যা ঘটল তা সবই নানাভাবে নানা রঙ্গে নানা ঢঙ্গে প্রকাশিত হল নভেম্বর, ডিসেম্বর ধরে ভারতের নানা পত্রিকায়। সবারই মদ্দা কথা- রাজুল এক নির্ভেজাল জাতিস্মর !!

সে খবর পড়ে অনেক প্যারাসাইকোলজিস্টই এলেন। এলেন ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আয়েন স্টিভেনসন, ডঃ এল. পি. মেহরোত্রা, ডঃ যমুনা প্রসাদ, স্বামী কৃষ্ণানন্দ ; যাকে বলে একেবারে স্টার-মেগাস্টার- সম্মেলন। একটা কাকতালীয় ব্যাপার হল, এঁরা প্রত্যেকেই এসেছিলেন ঝড় তোলা খবরটি প্রকাশের চার বছর বাদে ১৯৬৯-এ। বরং এঁরা প্রত্যেকেই এলেন নভেম্বর-ডিসেম্বরে। এই সময়ই এইসব বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্টদের দারুণ উজ্জলতার পাশে একটি নিরুজ্জল অতি সাধারণ মানুষও সত্যানুসন্ধানে এসেছিলেন। সেই অকিঞ্চিৎকর মানুষটি এই লেখক।

৬৫ ও তার পরবর্তী রাজুল রহস্যের অনুসন্ধান পর্বে কি কি ঘটেছিল? সেটা জানতে আসুন আমরা উঁকি মারি ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জন্মান্তরবাদঃ …এর পাতায়। পাশাপাশি আমরা ফিরে তাকাব এই একই প্রসঙ্গে সম্পর্কিত সাক্ষীরা কি বলেছেন, তার দিকে।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

১. ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় ভজু শাহ’র বক্তব্য হিসেবে যা লিখেছেনঃ “থ্যাকারদের বাড়ির কাছে পৌঁছনোর আগেই এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা রাস্তার ধারে দোকান থেকে দুধ কিনছিলেন। তাঁকে দেখেই রাজুলের মুখে হাঁসি ফুটে ওঠে। রাজুল ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে জানায়ঃ “আমার আগের জন্মের মা”।

শ্রীভজুভাই শাহ তারপর ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, “আমরা ভদ্রমহিলার কাছে এগিয়ে গিয়ে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি কিছুটা সন্দিহানভাবে আমাদের লক্ষ্য করতে করতে জানালেন, তাঁর নাম কান্তাবেন-তিনি গোকুলদাস থ্যাকারের স্ত্রী।”

“আমাদের তখনকার অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিছুটা আত্মস্থ হয়ে আমি ভদ্রমহিলাকে আমার নাতনির কথা বললাম, জানালাম সে তাঁর মৃত কন্যা ‘গীতা’ বলে নিজেকে মনে করে।

“কান্থাবেন বিমূঢ়ভাবে রাজুলকে লক্ষ্য করতে থাকেন। দ্বিধা এবং অবিশ্বাসের দোলায় তিনি বিচলিত বোধ করতে থাকেন। কিন্তু ক্রমশ রাজুলের উৎসাহী ও উৎফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর চোখে জল ভরে আসে। সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত না হতে পারলেও তিনি গভীর স্নেহে কোলে তুলে নেন। তিনি আমাদের সকলকে তাঁর বাড়িতে আসতে বললেন …”

কাদের সাক্ষী গ্রহণ করেছি

১. শ্রীভজু শাহ (রাজুলের ঠাকুরদা),

২. হিম্মৎলাল শাহ (ভজু শাহ’র ভাই),

৩. কান্থাবেন থ্যাকার (গীতার মা)।

আমি কি পেয়েছি এবং মন্তব্য

ক. ভজু শাহ’র কথামত, “সকলে আমরা থ্যাকারদের বাড়ি একটা প্রাথমিক ভ্রমণ সেরে এসে দ্বিতীয় দফায় যখন ও বাড়ি যাচ্ছি, তখন গীতার মা কান্থাবেন থ্যাকারের সঙ্গে আবার দেখা। কান্থাবেনকে দেখিয়ে রাজুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই ভদ্রমহিলাকে চেন?’ রাজুল একটু ভেবে উত্তর দিল, ‘আমার ও’জন্মের মা’।”

খ. হিম্মৎলাল ভজু সাহেব বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন।

গ. কান্থাবেন একটু অন্য কথা বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, “আমাকে দেখিয়ে শ্রীভজু শাহ রাজুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ইনি কি গীতা’র মা?’ উত্তরে রাজুল জানিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, গীতার মা’।”

কান্থাবেনও জানিয়েছিলেন, “শ্রীশাহদের পরিবারের লোকেরা জানতেন আমি কে। কারণ এই ঘটনার দিন সকালেই শাহ পরিবারের লোকেরা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন।

আয়েন স্টিভেনসন “The Case of Rajul Shah”-তে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “V.J. Shah himself had met Kantaban Thacker that morning (in a preliminary visit to the Thacker family), and so he knew who she was when Rajul recognized her;”

স্টিভেনসনের এই বক্তব্য আমার কথাকেই সমর্থন করছে, যদিও স্টিভেনসন রাজুলকে শেষ পর্যন্ত জাতিস্মর বলে চালাতে চেয়েছেন।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

২. ভজু শাহ’রা থ্যাকারদের বাড়িতে পৌঁছনোর পর কান্থাবেন “তাঁর স্বামী গোকুলদাস থ্যাকারকে খবর পাঠালেন তখনি বাড়িতে আসবার জন্যে।”

“গোকুলদাস ঘরেতে এসে কিছু বলবার আগেই বা তাঁর সঙ্গে অন্য কেউ কথা বলবার আগেই রাজুল সকলকে বিস্মিত করে হাসিমুখে বলে ওঠে, ‘আমার আগের বাবা এসে গেছে।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. হিম্মৎলাল শাহ (ভজু শাহ’র ভাই),

৩. গোকুলদাস থ্যাকার (গীতার বাবা),

৪. কান্থাবেন থ্যাকার।

আমি কি পেয়েছি এবং মন্তব্য

ক. ভজু শাহ’র বক্তব্যঃ “আমরা গোকুলদাসের ঘরে বসে। এমন সময় গোকুলদাস এলেন। কেউ একজন রাজুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কে বল তো?’ রাজুল উত্তরে বলেছিল, ‘গোকুলদাস’।”

খ. আমার এক প্রশ্নের উত্তরে হিম্মৎলাল শাহ জানিয়েছিলেন, “সেই সময় অবশ্য আমরা গোকুলদাসের আসা নিয়ে কথা বলছিলাম। ওদের পরিবারের কেউ একজন বলেছিলেন, “খবর পাঠানো হয়েছে। এখুনি গোকুলদাস এসে পড়বেন। হতে পারে রাজুল এ’কথা শুনেছিল।

গ. গোকুলদাস অবশ্য অন্য কথা বলেছিলেন। তাঁর কথা মত, “আমি ঘরে ঢুকতেই ভজু শাহ রাজুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গোকুলদাস কে বল তো?’ রাজুল তখন আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘এ, এ আমার বাবা’।”

ঘ. কান্থাবেনের কথা মত, “গীতার বাবা আসার আগে ওকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি ও আমাদের পরিবারের আরও একজন কেউ কোনও একটা প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলাম, ‘গীতার বাবা এখুনি এসে পড়বেন।”

ঙ. কান্থাবেন এও জানিয়েছিলেন, তাঁর মনে আছে, ‘গীতার বাবা এখুনি এসে পড়বে’ বলার পর প্রথম যিনি ঘরে ঢুকেছিলেন, তিনি গীতার বাবা।

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে এরপর বলতেই পারি- উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিনি মিথ্যে তথ্য পরিবেশন করেছেন। ১৯৬৯-এ আমি যখন সত্যানুসন্ধানে নামই তখনও পর্যন্ত রাজুল একবারের জন্যেও গীতার বাবার নাম জানাতে পারেনি। পূর্বজন্মের এতো স্মৃতি মনে রেখে বাবার নামটাই ভুলে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক !

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৩. “রাজুল জানায় যে তার আগের বাবার লোহালক্কড়ের দোকান ছিল। এটা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়…”

কাদের মন্তব্য গ্রহণ করেছি

১. গোকুলদাস থ্যকার

২. ভজু শাহ

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

ক. গীতার বাবা গোকুলদাসের ব্যবসা ছিল চাল, গম, ডাল ইত্যাদি বিক্রির।

খ. ‘সাইড-বিজনেস’ হিসেবেও লোহালক্কড়ের ব্যবসা ছিল না।

গ. রাজুল এও বলত- গীতার বাবার মিষ্টির দোকান ছিল। এটিও ছিল ভুল তথ্য।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৪. “বাড়ি ঘর দোরের বর্ণনা বাইরের রং ইত্যাদি নিয়ে তার সব কথাই মিলে যায়।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. গোকুলদাস থ্যাকার,

২. আমি নিজে দেখে এসেছি,

৩. ভজু শাহ।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

ক. রাজুল বলেছিল, ওদের ঘরের রং ছিল সবুজ।

খ.(১). গোকুলদাস জানিয়েছিলেন, গীতার জীবনে বাড়ির রং কোন সময়ের জন্যেই সবুজ ছিল না।

খ. (২). বাড়ির রং ছিল হলদে। আমিও হলদেই দেখেছি।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৫. “গোকুলদাস থ্যাকার দেওয়ালির সময়ে বাড়িতে লাল চুনকাম করিয়েছিলেন।” রাজুলের দেওয়া এই তথ্য মিলে গিয়েছিল।

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. গোকুলদাস থ্যাকার (গীতার বাবা)

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনও দেওয়ালিতেই বাড়িতে লাল রং লাগাননি।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৬. গোকুলদাসের বাড়িতে বারান্দা ছিল।

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. গোকুলদাস থ্যাকার

২. আমি নিজে দেখে এসেছি।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

ও বাড়িতে কোনও বারান্দা ছিল না।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৭. “প্রচুর দুধ কিনতেন এবং বড় বড় পাত্রে সেই দুধ রাখা থাকত।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. গোকুলদাস থ্যাকার,

২. কান্থাবেন থ্যাকার।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

খুব সামান্য পরিমাণ দুধই কেনা হত। পরিমাণটা আধ সের থেকে বেশি হলে কখন-সখন এক সেরের মত।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৮. “রাজুল জানায়ঃ ‘আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন সকলে আমাকে ‘বেবি’ বলে ডাকত। তারপর যেদিন বসন্তের টিকা দেওয়া হয়ে গেল তখন থেকে আমাকে সবাই ‘গীতা’ বলে ডাকত।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. গোকুলদাস থ্যাকার,

২. কান্থাবেন থ্যাকার।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার বাবা ও মা দু’জনেই জানিয়েছিলেন, গীতা নামকরণের আগে তাঁরা মেয়েকে ডাকতেন ‘টিকুডি’ বলে।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

৯. “যখন তার নাম গীতা ছিল তখন তারা যে বাড়িতে থাকত সেটা এখনকার মত অত বড় নয়।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. গোকুলদাস থ্যাকার,

৩. প্রভানচন্দ্র শাহ (রাজুলের বাবা)।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতারা যে বাড়িতে থাকত, তাতে ছিল দুটি শোয়ার ঘর ও একটি রান্নাঘর। রাজুলের বাবা থাকতেন যে বাড়িতে, তাতেও ছিল দুটি ঘর ও একটি রান্নাঘর।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

১০. “সঠিক সনাক্তকরণ থেকে রাজুলকে জাতিস্মর অর্থাৎ গীতার পুনর্জন্ম ছাড়া অন্য কোন সংজ্ঞায় বিচার করা যায় না।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. নির্মলা (গীতার দিদি),

৩. কান্থাবেন,

৪. গোকুলদাস।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

ক. গীতার মা কান্থাবেন থ্যাকারের সনাক্তকরণ কখনোই ত্রুটিমুক্ত সঠিক সনাক্তকরণ নয়।

খ. গীতার বাবা গোকুলদাস থ্যাকারের সনাক্তকরণও কখনই ত্রুটিমুক্ত সঠিক সনাক্তকরণ ছিল না।

দুটি সনাক্তকরণই যে ত্রুটিযুক্ত, সে বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি। এ’বার বাঁকি সনাক্তকরণের দিকে চোখ ফেরাইঃ

গ. গীতার দিদি নির্মলা’কে সনাক্ত করতে রাজুল ব্যর্থ হয়েছিল। ভজু শাহ যখন রাজুল সহ গোকুলদাসের বাড়ি গিয়েছিলেন, তখন নির্মলা কৌতূহলী চোখে রাজুলকে দেখছিল। গোকুলদাস পরিবারের একজন রাজুলকে জিজ্ঞেস করেন, “এই মহিলাকে চিনতে পার?” উত্তরে রাজুল জানিয়েছিল, “ও ছিল আমার পিসি।” নির্মলা ছিল গীতার দু’বছরের এবং রাজুলের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়।

ঘ. কাকিমা সেই সময় ঘরে উপস্থিত ছিলেন। কাকিমা’কে দেখিয়ে যখন প্রশ্ন করা হয়, “একে চিনতে পারছ?” রাজুল চিনতে পারেনি।

 

ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে

১১. “বাড়িতে পৌঁছে রাজুল গোকুলদাস আসার আগে অন্যসব বৃদ্ধাদের মধ্যে থেকে গীতার ঠাকুমা শ্রীমতি জাদোবেনকে সনাক্ত করে।”

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. গোকুলদাস,

৩. কান্থাবেন,

৪. নির্মলা,

৫. হিম্মৎলাল শাহ (ভজু শাহর ভাই)।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

পাঁচ সাক্ষ্যের বক্তব্য থেকে একই কথা জানতে পারি, সেই সময় গোকুলদাসের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন একমাত্র বৃদ্ধা, এবং তিনি হলে গীতার ঠাকুমা। রাজুল তার দুই ঠাকুমাকে দেখছে। দু’জনই বৃদ্ধা। ফলে ওকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছে “এদের মধ্যে কে গীতার ঠাকুমা, বলতে পার?” রাজুল উপস্থিত একমাত্র বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলেছে, “এই গীতার ঠাকুমা”। কারণ রাজুলের চোখে- ঠাকুমা ও বৃদ্ধা সমার্থক শব্দের মত হয়ে গেছে। ফলে বৃদ্ধাকে ঠাকুমা বলে চিহ্নিত করবে, এটাই স্বাভাবিক।

এটা কোনওভাবেই সঠিক সনাক্তকরণের দৃষ্টান্ত নয়। সঠিক সনাক্তকরণ বলা যেতে পারত তখন, যখন সমবয়স্ক বৃদ্ধাদের সঙ্গে ঠাকুমা হাজির, এবং রাজুল তাকে ঠাকুমা বলেই চিনিয়ে দিচ্ছে। সঠিক সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসার ধরন অবশ্যই খুবই সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয়। কারণ জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়েও যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তাকে চালিত করা যায়, তাকে সঠিক উত্তর দিতে সাহায্য করা যায়। প্রশ্নের মধ্যে এমন কোনও ইঙ্গিত থাকলে সনাক্তকরণ আর নিরপেক্ষ থাকে না। মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

রাজুল যে পরিস্থিতিতে গীতার ঠাকুমাকে সনাক্ত করেছিল, তা কোনওভাবেই সঠিক সনাক্তকরণ ছিল না।

 

ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থটিতে এরপরও ছাপার অক্ষরে লেখা আছে “পুনর্জন্মের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রাজুল গীতার জীবনের যা কিছু উল্লেখ করেছে তার সবকটিই অভ্রান্ত সত্য এবং বাস্তবিক ঘটনার সঙ্গে তার একশভাগ মিল ছিল।“

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক জগতে এমন নিটোল একশভাগ মিথ্যাচারিতার দৃষ্টান্ত খুব বেশি একটা দেখেছেন কি?

এতক্ষণ আমরা আলোচনা করেছি ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজুলের কথার সঙ্গে রাজুলের পূর্বজীবনের যে সব আশ্চর্য (!) মিল খুঁজে পেয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে। ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গ্রন্থটিতে যেসব কথা মুদ্রিত হয়নি, অথচ সত্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে যার উল্লেখ থাকা একান্তই জরুরি ছিল, সেগুলোর দিকে আমরা এ’বার  নজর দেব।

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

১. গীতার বাবা দেওয়ালি উপলক্ষে বাড়ির বাইরেটা লাল রঙ করেছিল।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজুশাহ,

২. গোকুলদাস।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার জীবনকালে কোনও সময়ের জন্যেই বাড়ির বাইরে বা ভিতরে লাল রঙ করা হয়নি।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

২. লাল রঙ করার আগে বাড়ির রঙ ছিল সবুজ।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. গোকুলদাস।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার জীবনকালে কখনই বাড়ির বাইরের রঙ সবুজ ছিল না।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

৩. গীতারা থাকত একতলায়।

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. গোকুলদাস,

৩. কান্থাবেন।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতা তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাটিয়েছে তিনতলার ফ্ল্যাটে।

এই ভুলকে কিভাবে ঢাকা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন আয়েন স্টিভেনসন, একটু দেখুন। স্টিভেনসন বলছেন, “The error is a natural one for a small girl who played much of the time in the downstairs area, returning to the family apartment mainly to eat and sleep.”

অর্থাৎ একটা ছোট মেয়ের পক্ষে এ ধরনের ভুল করাটা স্বাভাবিক, কারণ সারা দিনের বেশির ভাগ সময়ই ও একতলায় খেলত। সাধারণত নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরত খেতে ও ঘুমোতে।

অতএব ‘সাত খুন মাপ’। রাজুল মুহ বললেও আসলে ঠিকই বলেছিল।

প্যারাসাইকোলজিস্টদের এমনই সব কুযুক্তির হেলায় একশভাগ ভুলও একশভাগ ঠিক হয়ে যায়।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

৪. উনুনে রান্না হতো। দুধ গরম হতো।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. কান্থাবেন থ্যাকার।

আমি কি পেয়েছি ও মন্তব্য

রান্না ও দুধ গরম হতো স্টোভে। এখানেও স্টিভেনসনের মত প্যারাসাইকোলজিস্টদের অদ্ভুত যুক্তি- এতটুকু মেয়ে কি উনুন ও স্টোভের পার্থক্য বোঝে? অতএব এক্ষেত্রেও রাজুলের বক্তব্য একশভাগ ঠিক।

ভারি বিচিত্র ওঁদের একশভাগের হিসেব।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

৫. গীতার মায়ের নাম ‘শান্তা’ অথবা ‘কান্থা’।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

ক. ভজু শাহ’র কথামত, রাজুল জানিয়েছিল ওর আগের জন্মের মায়ের নাম ছিল ‘কান্থা’।

খ. সুশীলাবেনের কথা মত, রাজুল জানিয়েছিল ওর আগের জন্মের মায়ের নাম ছিল ‘শান্তা’।

গ. গীতার নাম ‘কান্থাবেন’।

ঘ. ভজু শাহ এ’কথায় স্বীকার করেছিলেন, না, তাঁর কাছে রাজুল গীতার মায়ের নাম ‘শান্তা’ ছাড়া আর কোনও নাম কখনো বলেনি।

অর্থাৎ, রাজুল গীতার মায়ের নাম ঠিক বলেছিল, কি ভুল বলেছিল- এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই- রাজুল কিন্তু কখনোই ওর গত জন্মের বাবার নাম বলতে পারেনি।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

৬. রাজুলের বাবা ছিলেন গীতার বাবার বয়সী।

কাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. সুধানের দেশাই (ভজু শাহর মেয়ে),

২. ভজু শাহ,

৩. গোকুলদাস,

৪. রাজুল।

আমি যা পেয়েছি ও মন্তব্য

ক. রাজুল এ’কথা বলেছিল ওর পিসি সুধাবেনের। সুধাবেনের কাছ থেকে ভজু শাহ এই তথ্য জেনেছিলেন।

খ. রাজুলের বাবার জন্ম সাল ১৯৩২, গীতার বাবার জন্ম সাল ১৯২৭।

গ. দুজনের বয়সের পার্থক্য ৫ বছর।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পারিবারকে যা বলেছিল

৭. গীতার বাবার মিষ্টির দোকান ছিল।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. গোকুলদাস,

৩. রাজুল।

আমি যা পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার বাবার কোনও দিনই মিষ্টির দোকান ছিল না।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

৮. গীতার একটি ছোট ভাই ছিল।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. কান্থাবেন,

৩. গোকুলদাস,

৪. রাজুল।

আমি যা পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার কোনও ছোট ভাই ছিল না।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

৯. গীতার প্রিয় বন্ধুর নাম জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না থাকত গীতাদের বাড়ির কাছেই।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. হিম্মৎলাল শাহ,

৩. রাজুল,

৪. গোকুলদাস,

৫. কান্থাবেন,

৬. নির্মলা (গীতার দিদি)

আমি যা পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার মা, বাবা ও দিদি তিনজনই জানিয়েছিলেন, ওরা গীতার খেলার যতজন সঙ্গীদের চেনেন, তাদের মধ্যে ‘জ্যোৎস্না’ নামের কেউ ছিল না।

নির্মলা এ’কথাও বলেছে, “বোনের সঙ্গী সক্কলকেই চিনতাম। ওর প্রিয় সঙ্গী, অথচ চিনতাম না- এমনটা হতেই পারে না।“

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

১০. গীতার মা ‘প্যাঁড়া’ (ক্ষীরের সন্দেশ) বানাতেন।

যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি

১. ভজু শাহ,

২. কান্থাবেন,

৩. রাজুল।

আমি যা পেয়েছি ও মন্তব্য

গীতার মা কান্থাবেন কখনোই প্যাঁড়া বানাতেন না। প্যাঁড়া খাওয়ার ইচ্ছে হলে দোকন থেকে কিনে আনতেন।

গুজরাটে প্যাঁড়া জনপ্রিয় মিষ্টি। অনেক বাড়ির মহিলারাও বাড়িতেই প্যাঁড়া তৈরি করেন। রাজুল ওর মা প্রভাবেনকেও প্যাঁড়া বানাতে দেখেছে।

 

রাজুল পূর্বজন্ম বিষয়ে ভজু শাহ পরিবারকে যা বলেছিল

১১. ভজু শাহ,

২. কান্থাবেন,

৩. নির্মলা।

আমি যা পেয়েছি ও মন্তব্য

বাড়ির পুজোয় ফল দেওয়া হতো, প্যাঁড়া নয়।

সত্যানুসন্ধানের স্বার্থে স্বীকার করছি রাজুলের পূর্বজীবন বিষয়ে কিছু কথা গীতার জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। কোন কোন কথাগুলো মিলে গিয়েছিল একটু দেখা যাক।

একঃ গীতা ছোটবেলাতেই মারা যায়।

দুইঃ বাবা বেশিরভাগ সময় ধুতি পরত। (গুজরাটের হিন্দুদের বেশিরভাগই ধুতি পরেন। রাজুলও তেমনটাই দেখে এসেছে। ফলে রাজুলের পক্ষে এমনটা বলাই স্বাভাবিক।)

তিনঃ গোকুলদাস স্টিলের বাসনে খেতেন।

চারঃ গীতারা রাতের খাবার খেত রাতে। (রাজুলের খেলার সঙ্গীদের অনেকেই ছিল হিন্দু। তারা রাতের খাবার রাতে খায়, এটা রাজুলের যে অজানা ছিল না, সে কথা রাজুল নিজেই বলেছে।)

পাঁচঃ গীতাদের বাড়ির ঠাকুরের গাঁয়ে থাকত পোশাক।

(রাজুলরা জৈন, দিগম্বর সম্প্রদায়ের। রাজুল যেমনভাবে জানত ওদের ধর্মের ঠাকুরের শরীরে পোশাক থাকে না, তেমনভাবেই জানত, ওর হিন্দু বন্ধুদের ঠাকুর পোশাক পরে। রাজুল বলতে চেয়েছিল, ও গত জন্মে হিন্দু পরিবারে জন্মেছিল। তাই গীতার ঠাকুর পোশাক পরেছিল- রাজুলের বর্ণনায়।)

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই কথাগুলোই বা কি করে মিললো? আসলে, এ’সব মিলিয়ে দেওয়া খুবই সোজা। ধরুন, আপনি বললেন-

১. গতজন্মের আমার নাম ছিল গোপাল।

২. জন্মেছিলাম কলকাতায়।

৩. মারা যাই শৈশবে।

৪. আমার বাবা ছিল।

৫. আমার মা ছিল।

৬. আমার কাকা ছিল।

৭. আমার মামা ছিল।

৮. বাবা প্যান্ট-সার্ট পরতেন।

৯. ঘরে পড়তেন পাজামা অথবা লুঙ্গি।

১০. বাবা দাঁড়ি কামাতেন।

১১. বাবা বাজার থেকে আলু, তরকারি এ’সব নিয়ে আসতেন।

১২. বাবার উচ্চতা ছিল মাঝারি।

১৩. বাবা মাঝে-মাঝে পেটের গোলমালে ভুগতেন।

১৪. বাবা আমাকে বকতেন।

১৫. বাবা আমাকে আদর করতেন।

১৬. মা রান্না করতেন।

১৭. মা খেতেন আমাদের খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর।

১৮. আমরা ভাত খেতাম।

১৯. মাঝে-মাঝে রুটি খেতাম।

২০. আমি মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি।

২১. মা-বাবার সঙ্গে দুর্গাপূজোয় ঠাকুর দেখেছি।

২২. আমাদের পাড়ায় দুর্গাপুজো হতো।

২৩. আমার মা গয়না পরতেন।

২৪. মা সিঁদুরের টিপ দিতেন।

২৫. বাবা মাঝে-মাঝে মাকে বকতেন।

২৬. মামা-মাসিরা বেড়াতে এলে মা’র খুব আনন্দ হতো।

২৭. আমি সেলুনে চুল ছাঁটতাম।

২৮. আমি স্কুলে পড়েছি।

২৯. আমার বই খাতা ছিল।

৩০. আমার নীল রঙ্গের একটা সার্ট ছিল।

আপনার এক তিরিশটা মন্তব্য মিলে যাওয়া একগাদা গোপাল আপনি পেয়ে যাবেন। ধরুন আপনার বয়স এখন তিরিশ। একত্রিশ বছর আগে থেকে ঘাঁটতে থাকুন কলকাতা কর্পোরেশনের মৃত্যু নিবন্ধিকরণের খাতা। এক বছরের পাতা ওল্টালেই বহু গোপালের মৃত্যুর হদিস পেয়ে যাবেন। পাঁচ-দশ বছরের খাতা ঘাঁটলে এত গোপালের মৃত্যু দেখতে পাবেন যে তখন বলতে ইচ্ছে হবে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। এ’বার ওইসব গোপালদের ঠিকানা নিয়ে তিরিশ দফা মন্তব্য মেলাতে শুরু করুন। তাতেও পেয়ে যাবেন বহু গোপাল।

আপনি গোপাল ছেড়ে নিজেকে আগের জন্মের ফতেমা ঘোষণা করুন, তাতেও অসুবিধে নেই। বলতে শুরু করুন-

১. আমি কলকাতায় থাকতাম।

২. স্বল্প বয়সে মারা যাই।

৩. আমার বাবা ছিল।

৪. আমার মা ছিল।

৫. আমার বাবার দু’বিয়ে।

৬. আমার ভাই-বোন ছিল।

৭. আমার মা শাড়ি পরতেন।

৮. বেড়াতে গেলে শাড়ির ওপর বোরখা পরতেন।

৯. মা’র কালো রঙ্গের বোরখা ছিল।

১০. আমি বোরখা পরতাম না।

১১. আমি সালোয়ার-কামিজ পরতাম।

১২. আমার কালো রঙ্গের জরি বসানো সালোয়ার-কামিজ ছিল।

১৩. আমার সুন্দর রঙ্গিন চটি ছিল।

১৪. বাবা লুঙ্গি পরতেন।

১৫. বাবা সার্ট ও পাঞ্জাবি দুইই পরতেন।

১৬. বিশেষ বিশেষ দিনে বাবা টুপি পরতেন।

১৭. আমাদের বাড়ি আতর আসত।

১৮. আমাদের বাড়ি সুর্মা আসত।

১৯. আমরা ভাত ও রুটি দুই খেতাম।

২০. মা রান্না করতেন।

২১. মা মাঝে-মাঝে মাংস রাঁধতেন।

২২. আমি বিরিয়ানি খেয়েছি।

২৩. আমার কাকা ছিল।

২৪. আমার বই ছিল।

২৫. আমার খাতা ছিল।

এমনি আরও অনেক কিছুই সামান্য মাথা খাটিয়ে গড়্গড় করে বলে যেতে পারেন। একজন প্যারাসাইকোলজিস্ট পাকড়ে যদি তাঁকে এ’সব কথা শোনাতে পারেন, তাহলে একগাদা ফতেমার খোঁজে আপনাকে আর দৌড়ো-দৌড়ি করতে হবে না। বরং এত ফতেমা নিয়ে পাগল হবার যোগাড় হবেন সেই প্যারাসাইকোলজিস্ট। অবশ্য যদি তিনি শিক্ষানবিশ হন, তবেই। পাকা মাথা হলে এক ফতেমার খোঁজ পেতেই প্রচার-মাধ্যমগুলো তোলপাড় করে ছাড়বেন। কোন তথ্য হাজির করবেন, কোনটা চেপে যাবেন, এ’সব করেই তো মাথা পেকেছে। তারপর এ’গুলো খাওয়াবেন প্রচার-মাধ্যমগুলোকে। আর এ’ব্যাপারে প্রায় প্রতিটি প্রচার-মাধ্যমেরই অবস্থা, “এই কাঙ্গাল, তুই ভাত খাবি?” “নুন নিয়ে তো বসেই আছি।“

আসুন, এবার ‘রাজুল’ নাটকে যবনিকা ফেলার আগে জরুরি আর দু’একটি তথ্য আমরা জেনে নেই।

রাজুলের জন্ম ১৯৬০-এ আগস্টে। রাজুলের বাবা ১৯৬০-এর ডিসেম্বর থেকে থাকতে শুরু করেন ‘কেশর’-এ। দুটি স্থানই গীতার শহর জুনাগরের কাছেই। জুনাগর থেকে কেশরের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটারের পথ। আঘঘণ্টা থেকে পয়তাল্লিশ মিনিট লাগে এক শহর থেকে আর এক শহরে যেতে। ওয়াংকানেরও জুনাগরের কাছেরই এক শহর। এই তিন শহরের লোকজনদের মধ্যে যাতায়াত আছে, আত্মীয়তা আছে, পরিচিতি আছে। অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেচি- আছে। রাজুল ওর বন্ধু বা অন্য কারও কাছ থেকে গীতার বিষয়ে কিছু কিছু কথা শুনে থাকতে পারে। এটা সম্ভব। তারপর শিশু রাজুল তার আবেগ ও কল্পনার সাহায্যে একসময় নিজের অজান্তে নিজেকে পূর্বজন্মের ‘গীতা’ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সেই বিশ্বাস থেকে উৎসারিত কথার কিছু কিছু মিলে যেতেই কেউ কেউ আবেগরাড়িত হয়েছেন, উত্তেইত হয়েছেন। আঁকড়ে ধরা প্রাচীন বিশ্বাসকে সত্যি হয়ে উঠতে দেখার উত্তেজনা।

অতি আবেগের স্রোতে অনেক সময়ই যুক্তি ভেসে যায়। এখানেও অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে। তাঁরা ‘না মেলা’ বিষয়ে অনেক সময়ই সচেতন বা অচেতনভাবে নীরব থেকেছেন। সোচ্চার হয়েছেন ‘হ্যাঁ মেলা’ নিয়ে। রাজুলকে ‘গীতা’ বলে চালিয়ে দিয়ে ভজু শাহ পরিবারের কোনও আর্থিক লাভের সম্ভাবনা ছিল না। কারণ রাজুলদের পরিবার গীতাদের পরিবারের তুলনায় বিত্তবান। গীতারা নেহাতই মধ্যবিত্ত।

সমস্ত দিক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর একথা বলতে পারি- রাজুলের জাতিস্মর হয়ে ওঠার পিছনে কোনও প্রতারণার ষড়যন্ত্র ছিল না, ছিল রাজুলের মানসিক অবস্থা।

error: Content is protected !!