সুনীল দত্ত সাক্সেনা আর এক বিশ্বখ্যাত জাতিস্মর। সুনীলের জাতিস্মর ক্ষমতার কথা প্রথম প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ১৯৬৪’র ৩ জানুয়ারী। সুনীলের জন্ম উত্তরপ্রদেশের ছোট্ট শহর আওনলায় ১৯৫৯-এর ৭ অক্টোবর। ১৯৬৩ সাল থেকে সুনীল জানাতে থাকে সে আগের জন্মে বুধায়ুন শহরের আদিবাসী ছিল। বুধায়ুন আওনলা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে। সুনীলের বাবার সম্পর্কে কাকা এস. প্রসাদ বুধায়ুনের বাসিন্দা। তাঁর বাড়িতেই সুনীলকে আনা হয়। এখানে এসে এক এক করে সুনীল অনেক কথাই জানায়। সে ছিল বিশাল ধনী। বিশাল বাড়ি ছিল, ঘোড়া ছিল, মোটর গাড়ি ছিল, ফ্রিজ ছিল, ফ্যাক্টরি ছিল। কলেজ প্রতিষ্ঠা করছিল। কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন বন্ধু পাঠকজি। চার বিয়ে। তিন স্ত্রীর মৃত্যুর পর চতুর্থ বিয়ে। দুই ছেলে। একটি নিজের, একটি পোষ্য। চতুর্থ স্ত্রী জলে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিলেন। তাতেই মৃত্যু। আগের জন্মে ছিল কিষেণ।

সুনীলের জাতিস্মর ক্ষমতার খবর বুধায়ুনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষের প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল সুনীল। তাঁরা ধরে নিলেন কিষেণ বলতে সুনীল শেঠ শ্রীকৃষ্ণজিকেই বোঝাচ্ছে। শেঠ শ্রীকৃষ্ণজির মৃত্যু সুনীলের জন্মের আগেই। তিনি বুধায়নের বিশিষ্ট ধনী। কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অধ্যক্ষ পদে বসিয়েছিলেন বন্ধু পাঠকজিকে। তৃতীয় পত্নীর মৃত্যুর পর ১৯৪৩ সালে শেঠজি বিয়ে করেন ষোড়শী সুন্দরী শকুন্তলাদেবীকে। শেঠজির দুই ছেলে। বড় দত্তকপুত্র শ্যামপ্রসাদ, ছোট তৃতীয় পত্নীর পুত্র রামপ্রসাদ। সুনীলের দেওয়া আর অনেক তথ্যই মিলে যাচ্ছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে সুনীলের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৬৪-র ডিসেম্বরে দুই পরামনোবিজ্ঞানী ইয়ান স্টিভেনসন এবং পি পাল সুনীলের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামেন। ১৯৭৪-এ অনুসন্ধানে নামলেন আর এক পরামনোবিজ্ঞানী ডঃ এল পি মেহেরোত্রা। অনুসন্ধান শেষে তিনজনের দাবি সুনীল জাতিস্মর। সুনীলের দেওয়া বেশির ভাগ তথ্যই না কি আশ্চর্য রকমের ঠিক। সুনীল না কি শ্রীকৃষ্ণজির পুরনো বন্ধু এবং কর্মচারীদের চিনতে পেরেছিলেন। ইয়ান স্টিভেনসন তো সুনীলকে নিয়ে বই-ও লিখে কর্মচারীদের চিনতে পেরেছিলেন। ইয়ান স্টিভেনসন তো সুনীলকে নিয়ে বই-ও লিখে ফেললেন। পৃথিবীজুড়ে হই-চই পড়ে গেল।

সুনীলকে নিয়ে প্রকাশিত তিন পরামনোবিজ্ঞানীর রিপোর্ট পড়েছি। এই প্রসঙ্গে শকুন্তলাদেবী, রামপ্রসাদ, শ্যামপ্রসাদ, শেঠ শ্রীকৃষ্ণ কলেজের অধ্যক্ষ নরেন্দ্রমোহন পান্ডে, ওই কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও শেঠজির বন্ধু এস পি পাঠকের বক্তব্যও জেনেছি। তাঁদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে রামপ্রসাদ, শ্যামপ্রসাদসহ শেঠজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের প্রায় সকলকেই চিনতে ব্যর্থ হয়েছিল সুনীল। সুনীলকে শেঠজির প্রতিষ্ঠিত কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অধ্যক্ষের চেয়ারে বসা নরেন্দ্রমোহন পান্ডেকে পাঠকজি বলে সুনীল চিহ্নিত করেছিল। পাঠকজি ছিলেন শেঠজির জীবনদশায় কলেজের অধ্যক্ষ। রামপ্রসাদ সুনীলকে শেঠজির মোটরগাড়ির ও ঘোড়ার রঙ কি ছিল, জিজ্ঞেস করায় সুনীল জানিয়েছিল গাড়ি ও ঘোড়ার রঙ ছিল কালো। শকুন্তলাদেবী এবং রামপ্রসাদের জবানিতে জানতে পারি গাড়ির রঙ ছিল চকোলেট এবং ঘোড়ার রঙ ঘন বাদামী। এঁদের জবানিতে জানতে পারি গাড়ির রঙ ছিল চকোলেট এবং ঘোড়ার রঙ ঘন বাদামী। এঁদের জবানিতে আরও জানা যায় শেঠজি কোনদিনই ফ্রিজ ব্যবহার করেননি।

এরপরেও অনেকের মনেই এ-প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঁকি দিতে পারে, যে-সব তথ্য সুনীল সঠিক দিয়েছিল জাতিস্মর না হলে সেগুলো জানলো কি করে? এখানেও আমি লক্ষ্য করেছি শেঠ শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে তথ্যগুলো জানার সমস্ত রকম সম্ভাবনাই সুনীলের ছিল। সুনীলের বাবার সম্পর্কে কাকা এস. প্রসাদ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণজির যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। প্রসাদজির সঙ্গে সুনীলদেরও সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। সুনীলের কাকা জয়নারায়ণ সাক্সেনা ছিলেন রাজ্যের এক মন্ত্রীর পি-এ এবং শ্রীকৃষ্ণজির বিষয়ে তিনি ভালোমতোই ওয়াকিবহাল ছিলেন। সুনীলের বাবা সি এল সাক্সেনা যে স্টোরেজে কাজ করতেন, তাঁর মালিক ছিলেন শেঠ শ্রীকৃষ্ণেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবনারায়ণ দাস। এঁদের কারো কাছ থেকে শেঠজির বিষয়ে শুনে নিজেকে শেঠজি বলে ভাবতে ভাবতে বিশ্বাস করার সম্ভাবনা সুনীলের ক্ষেত্রে রয়েছে। এটাও অসম্ভব নয় যে শেঠজির বিশাল সম্পত্তিতে ভাগ বসাবার লোভই সুনীলকে পুনর্জন্মের শ্রীকৃষ্ণজি বলে হাজির করা হয়েছিল।

শেঠজির মৃত্যুর পর শকুন্তলাদেবী শেঠজির দত্তক-পুত্র শযামাপ্রসাদকে বিয়ে করায় শকুন্তলাদেবী নাবালাক রামপ্রসাদের অভিভাবক্ত হারান এবং সম্পত্তি নিয়ে একটা গোলমাল পাকিয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে সুনীলদের পরিবারের তরফ থেকে সুনীলকেই শেঠজি হিসেবে হাজির করে পত্র-পত্রিকায় ও স্থানীয় মহলে এমন একটা সোরগোল তোলা হয়েছিল যে, স্থানীয় জনগণ সুনীলকে বাস্তবিকই শেঠজি বলে গ্রহণ করেছিলেন।

রামপ্রসাদ এবং পাঠকজি স্পষ্টতই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন সুনীলের এই জাতিস্মরের দাবির পেছনে শেঠজির সম্পত্তি দাবির অভিসন্ধি লুকানো ছিল। অর্থাৎ সুনীলের ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনাই থেকে যাচ্ছে। হয় সে  মানসিক রোগী, অথবা প্রতারক।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x