উত্তরপ্রদেশের ছোট্ট গ্রাম শ্যামনগর হঠাৎই পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে উঠল। পৃথিবীর তাবড় প্যারাসাইকোলজিস্টরা উড়ে আসতে লাগলেন কানপুর। তারপর সেখান থেকে ফারাক্কাবাদ জেলার অনামী স্টেশন যশোদা’তে। যশোদায় নেমে দু’কিলোমিটার উত্তরে গেলেই শ্যামনগর। শ্যামনগরের আয়ুর্বেদ চিকিৎসক বা কবিরাজমশাই পণ্ডিত রামস্বরূপ শর্মার যমজ পুত্র রামু ও রাজু সত্তরের দশকের শুরুতে বিশাল হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল তামাম দুনিয়ায়। ওরা গত জন্মেও ছিল যমজ ভাই ভীমসেন ও ভীষ্ম ত্রিপাঠী।

ওরা গতজন্মে যে বাস্ততবিকই ভীমসেন ও ভীষ্মই ছিল, তার সপক্ষে এতো সব জোড়ালো যুক্তি, কাঁপন ধরাবার মত সব তথ্য প্যারাসাইকোলজিস্টরা হাজির করেছিলেন যে প্রচারমাধ্যমগুলোর নাড়া না খেয়ে উপায় ছিল না।

 

কে এই রামু ও রাজু

রামু ও রাজুর জন্ম ১৯৬৪-এর আগস্টে। জন্মতারিখ ঠিকমত বলতে পারেননি ওদের বাবা পণ্ডিত রামস্বরূপ শর্মা ও মা কাপুরীদেবী। অতটা স্মরণে না রাখার কারণ সম্ভবত ষষ্ঠ ও সপ্তম সন্তান হিসেবে ওদের আগমন। ছা’পোষা পরিবারে এত সন্তান- কিছুটা অবহেলা, কিছুটা বিতৃষ্ণা হয় তো বা মনের কোণে জমে উঠেছিল। অবশ্য এর পরও একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন কাপুরীদেবী।

কাপুরীদেবী নাকি রামু ও রাজুর জন্মের আগে স্বপ্ন দেখেছিলেন। অদ্ভুত স্বপ্ন। দুটি ছেলে ভূমিষ্ট হচ্ছে তার গর্ভ থেকে। স্বপ্ন সত্য হওয়ায় কাপুরীদেবী বিস্মিত হয়েছিলেন। তবে উল্লেখ করার মত আর কিছু স্বপ্নে দেখেননি।

গাঁয়ের আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত সন্তানের মতই মাঠে-ময়দানে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সময় কাটছিল রামু-রাজু’র। পড়াশুনোর চেয়ে মাঠ-ময়দানই ওদের মত টানত বেশি করে। রামুর একটা ভালনাম হয়েছে- রামনারায়ণ ; রাজুর- শেষনারায়ণ। সম্ভবত নারায়ণরূপী সন্তানদের আগমন ঠেকাতেই এমন বিচিত্র নামকরণ। এক সময় এদেশের অনেকেই ভাবতেন এই ধরনের বিচিত্র নামকরণ করে পরবর্তী সন্তানদের জন্ম ঠেকানো যাবে ! জৈবিক কারণে যে জন্ম তাকে ‘ক্ষমা’, ‘রেহাই’, ‘মরণ’ ইত্যাদি জাতীয় হেলাফেলার নাম রেখে নাকি ঠেকানো যাবে !

আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের সন্তান লেখা-পড়া শিখবে না, এমনটি কি হয়। আর সব ভাই-বোনদের সঙ্গে দু’বছর পার না হতেই স্লেট-পেন্সিল নিয়ে বসতে হতো রামু ও রাজুকে। পড়াতেন পাশের গাঁয়ের পণ্ডিত মান্নালাল।

একদিনের ঘটনা, পণ্ডিত মান্নালালের বাড়ি যাচ্ছিলেন তাঁরই এক আত্মীয় চন্দ্রসেন ত্রিপাঠী। চন্দ্রসেন থাকেন উঁচা লারপুর এ।  উঁচা লারপুরও একটি গাঁ। শ্যামনগর থেকে ১২-১৪ কিলোমিটারের পথ, মান্নালালের বাড়ি যেতে শ্যামনগর গাঁ পার হয়েই যেতে হয়। যাচ্ছিলেন, কিন্তু যাওয়া আর হল কই ! তার আগেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘতে গেল।

বছর তিন-চারেকের দুটি যমজ শিশু পথে খেলছিল। চন্দ্রসেনকে দেখে এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে একেবারে প্রণাম। চন্দ্রসেন ভাবলেন, বাচ্চা তো, বুঝি বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁকে গুলিয়ে ফেলেই এমন প্রণাম। তবু রহস্য করে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে চেন?

-কেন চিনব না, আপনি তো আমাদের দাদা।

-দাদা মানে? কেমন দাদা আমি তোমাদের?

-দাদা, আমরা হলাম ভীম ও ভীষ্ম।

-ভীম, ভীষ্ম মানে? তোমাদের বাড়ি কোথায় ছিল? চন্দ্রসেন বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেন না।

-থাকতাম উঁচা লারপুরে। এখন আমরা এই গাঁয়ে জন্মেছি। আমাদের নাম রামু ও রাজু।

বিভ্রান্ত চন্দ্রসেন মান্নালালের বাড়ির পথ ধরে এগোন। কিন্তু বাস্তবিকই ব্যাপারটা কি ঘটল? সত্যিই কি ওরা গতজন্মের ভীম ও ভীষ্ম? নাকি গোটা ব্যাপারটাই নেহাতই নিষ্ঠুর রসিকতা? নেপথ্যে থেকে কোনও মানুষ ওদের দিয়ে এমন কিছু কথা বলিয়ে ওকে নিয়ে কি রসিকতা করল।

মান্নালালের বাড়িতে পৌঁছে-চন্দ্রসেন নাকি এই ধরনের নানা অনুমানের কথা ব্যক্ত করেছিলেন।

মান্নালালের কাছ থেকেই রামু ও রাজুর বাবা-মা পণ্ডিত রামস্বরূপ ও কাপুরীদেবী এই ঘটনার কথা নাকি জানতে পেরেছিলেন।

কিন্তু এ’টুকুতেই থেমে থাকেনি রামু ওরাজু। একটু একটু করে আরও অনেক কথাই জানিয়েছে সবচেয়ে আপনজন জেঠামশাই গয়াপ্রসাদ শর্মা এবং বাবা-মা’কে। জানিয়েছে- রামুর নাম ছিল ভীম, রাজুর ভীষ্ম। প্রধান জীবিকা ছিল, ক্ষেতি-জমি। ষাট বিঘার মত জমি ছিল। মোটামুটি সাচ্ছল্যের অভাব ছিল না। ভীমের প্রথম বিয়ে হয়েছিল। পাত্রী আতরাউলি গ্রামের। তারপর ভীষ্মের বিয়ে হয়। পাত্রী ভাওয়ালপুরের। ভীমের একটিই সন্তান। পুত্র। নাম- দ্রোণ। ভীষ্মের তিন পুত্র। রামকিশোর, রাজকিশোর ও নেত্রকিশোর। দু’ভাইয়ের যেমন ছিল স্বাস্থ্য, তেমনই ছিল সাহস। হয় তো কিছুটা উগ্রও। অবশ্য উগ্রতা ও অঞ্চলের পরিবেশেই রয়েছে। ওখানে খুন-খারাবি, বদলা, রক্তের হোলিখেলা নতুন কিছু নয়। বাবা মারা গিয়েছিলেন। ক্ষেতি-জমির দেখভাল করতেন ভীম ও ভীষ্ম। সংসারের অন্যান্য দায়িত্ব সামলাতেন বড় ভাই চন্দ্রসেন।

জমি নিয়েই শত্রুতার শুরু জগন্নাথের সঙ্গে। জগন্নাথ থাকতেন পাশের গাঁ কুন্দরিপুরায়। বয়স ৪০ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। গাঁয়ের ‘দাদা’। অর্থাৎ শক্তিমান পুরুষ হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি। জমিতে দেওয়াল তুলেছিলেন জগন্নাথ। ভীম ও ভীষ্ম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন এ দেওয়াল বেআইনীভাবে ভীমদের জমিতে তোলা হয়েছে। জগন্নাথের দাদাগিরি টেকেনি ভীম ও ভীষ্মের দুই বন্দুকের নলের মুখে। জগন্নাথ তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের সামনেই অপমানিত হয়েছিলেন। তারই মাসখানেক পরে জগন্নাথ দু’ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে নেন। একদিন বাড়িতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন দু’ভাইকে। খাটিয়ায় বসে লাড্ডু, প্যাঁড়া সহযোগে ঘটি ঘটি দুধ পান করতে করতে হঠাৎই দু’ভাই লক্ষ্য করেন তাঁদের ঘিরে ফেলেছে জগন্নাথের লোকজন। ওঠার চেষ্টা করতেই শুরু হল প্রহার। ততক্ষণে জগন্নাথের আহ্বানে একজন অ্যাসিড এনে ঢেলে দিয়েছে ভীমের চোখে। ভীমের বীভৎস চিৎকারের মাঝেই ভীষ্ম নিজেকে মুক্ত করে ছুটতে থাকে। তারপর এক সময় নিজেই ঘুরে দাঁড়ায়। আবার ফিরে যায় জগন্নাথের কুঠিতে। বদলার রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। অত সশস্ত্র রক্তপিপাসু মানুষের সঙ্গে নিরস্ত্র ভীষ্ম পেরে ওঠেনি। ওর চোখে-মুখেও ঢালা হয়েছে এ্যাসিড। তারপর দু’জনকে হত্যা করে বস্তায় পুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে কুয়োয়। মৃতদেহকে বস্তাবন্দি করার কথা এবং কুয়োতে ফেলে দেওয়ার কথাও রামু-রাজু বলেছে। রামু, রাজুর কথা থেকে আমরা বরং কুয়োতে ফেলে দেওয়ার কথাও রামু-রাজু বলেছে। রামু, রাজুর কথা থেকে আমরা বরং জানতে পারলাম, আত্মা চিন্তাই হোক, বা চিন্তার কারণ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষই হোক- আত্মার দেখার মত চোখ আছে। মানতে পারলাম কি না, সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আপাতত এটুকু নিশ্চয়ই বলতে পারি, আমরা নতুন কিছু জানতে পারলাম।

ভীম ও ভীষ্ম নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর ওদের দু’ভাইয়ের পচা-গলা দেহ পুলিশ উদ্ধার করে কুয়ো থেকে। গ্রেপ্তার করা হয় জগন্নাথ ও তার কিছু সাথীকে।

 

প্যারাসাইকোলজিস্টরা কি পেলেন

যমজ জাতিস্মরের ঘটনা নিয়ে বারবার করে অনুসন্ধানের (নাকি জাতিস্মর প্রমাণের) কাজে এই অঞ্চলে এসেছিলেন বিশ্বের তিন নামী-দামী প্যারাসাইকোলজিস্ট ডঃ আরলেন্ডার হারাল্ডসন (Dr. Erlendur Haraldson), আয়েন স্টিভেনসন (Ian Stevenson) ও মেহরোত্রা। এঁরা প্রত্যেকেই একাধিকবার এখানে এসে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। ওঁদের অনুসন্ধানের নানা রোমাঞ্চকর কাহিনী সেই সময় এদেশের ও বিদেশের বহু ভাষাভাষি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস রামু-রাজুর অসাধারণ জাতিস্মর কাহিনী দু’মলাটে বন্দি করে বাজারে ছাড়েন। এবং দারুন বাজারও পান।

এঁদের সংগৃহীত তথ্য থেকে জানতে পারি রামু ও রাজু শুধুমাত্র ভীম ও ভীষ্মের জীবনের নানা জানা ও অজানা কাহিনীই শোনায়নি, পূর্বজীবনের অনেককেই চিনিয়ে দিয়েছিল। রামু ও রাজুর কাহিনী দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরপ্রদেশের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে। রামু, রাজুকে দেখতে প্রতিদিন ছুটে আসছিল প্রচুর মানুষ। ছুটে এসেছিলেন ভীম ও ভীষ্মের মা রামদেবী ত্রিপাঠী। সঙ্গে এনেছিলেন ভীম ও ভীষ্মের পুত্রদের ও বোনকে। রামু ও রাজু ওদের প্রত্যেককেই চিনতে পেরেছিল এবং প্রকাশ্যেই চিনিয়ে দিয়েছিল। প্রমাণ করেছিল, ওদের দাবির মধ্যে কোনও অসারতা ছিল না। এই ঘটনার সাক্ষ্য হিসেবে প্যারাসাইকোলজিস্টরা রামু ও রাজুর শিক্ষক পণ্ডিত মান্নালাল, মা কাপুরীদেবী, বাবা রামস্বরূপ শর্মা ও জেঠা গয়াপ্রসাদ শর্মার কথা উল্লেখ করেছেন। রিপোর্টগুলো থেকে আরও জানতে পারি, উঁচা লারপুরের অনেককেই ওরা দু’ভাই চিনতে পেরেছিল। ভীম ও ভীষ্ম খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত ন’জনের মধ্যে যারা জামিন পেয়েছিল, তারাও ছুটে এসেছিল রামু ও রাজুকে দেখার চুম্বকীয় আকর্ষণে। রামু ও রাজু তাদের প্রত্যেককেই চিনতে পেরেছিল। যমজ জাতিস্মর এও জানিয়েছিল, তাদের খুন করার ব্যাপারে জগন্নাথের প্রধান সঙ্গী ছিল রাজারাম, বংশীগোপাল ও হরি। পুলিশের রেকর্ড ওদের এই বক্তব্যের যথার্থতাই প্রমাণ করে।

প্যারাসাইকোলজিস্টরা দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষীই বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন যে- রামু-রাজুদের পরিবার ও ভীম-ভীষ্মদের পরিবার প্রথম উভয়ের সঙ্গে পরিচিত হয় রামু-রাজু জাতিস্মর হয়ে ওঠার পর। রামু ও রাজুর বাবা ও জেঠা এই ঘটনার আগে ভীম-ভীষ্মের ঘটনা জানতেন না। এমত অবস্থায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, রামু ও রাজু বাস্তবিকই পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিস্মরের এক অনন্য উদাহরণ। যমজ ভাই মৃত্যুর পরও যমজ ভাই হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন- এ’এক অনন্য নজির।

পত্র-পত্রিকায় এইসব প্যারাসাইকোলজিস্টদের অনুসন্ধান পর্বের কথা ও তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা প্রচারিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ সন্ধান পেয়েছেন অসাধারণ যমজ জাতিস্মরের।

 

অনুসন্ধানে আমি যা পেয়েছি

১৯৭৩ এর মার্চে আমি যখন রামু ও রাজুর রহস্য নিয়ে সত্যানুসন্ধানে নামি, তখন ওরা দু’জনেই ক্লাস থ্রি’তে পড়ে। বয়স দশ ছুঁই ছুঁই।

জাতিস্মর রহস্যের জট ছাড়াবার আগে আমি কতকগুলি প্রয়োজনীয় তথ্যের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ

১. শ্যামনগর ও উঁচা লারপুর গ্রাম দু’টি একই পুলিশ স্টেশনের অন্তর্ভুক্ত। পুলিশ স্টেশনের নাম- গুরসাহিগঞ্জ।

২. দুই গ্রামের বাজার বলতে গুরসাহিগঞ্জ।

৩. দুই গ্রামের নিকটবর্তী রেল স্টেশন যশোদা।

৪. ভীম ও ভীষ্মের হত্যা এতই ভয়ঙ্কর ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছিল যে এই হত্যা কাহিনী শুধুমাত্র গুরসাহিগঞ্জ থানা এলাকার চৌহুদ্দিতে আলোড়ন তুলে থেমে থাকেনি ; ফারাক্কাবাদ জেলা তথা উত্তরপ্রদেশ জুড়েই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। ১৯৬৪ সালের ৫ মে স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় গুরুত্বের সঙ্গেই খবরটি পরিবেশিত হয়।

৫. শ্যামনগর গ্রামের বিভিন্ন বয়সের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা প্রত্যেকেই রামু-রাজুর জাতিস্মর হয়ে ওঠার কাহিনী শোনার আগেই ভীম-ভীষ্মের হত্যা কাহিনী শুনেছিলেন।

৬. রামু ও  রাজুর জেঠামশায় গয়াপ্রসাদ শর্মা দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছিলেন- রামু-রাজুর মুখ থেকে শোনার আগে তিনি ভীম-ভীষ্মের কথা জানতেন না।

গয়াপ্রসাদের এই ধরনের বক্তব্য মেনে নেওয়া একান্তই কঠিন। গাঁ-গঞ্জে যারা থাকেন, তাঁরা জানেন, আশে-পাশের কোনও গাঁয়ে এমন এক ধনী পরিবারের ডাকাবুকো, টগবগে দুটি মানুষকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার পর লাশ পাচারের চেষ্টা, লাশ আবিষ্কার, পাশের পাড়ার আর এক জবরদস্ত শক্তিমান মানুষের সদলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ঘটনা ঘটলে সেই রোমাঞ্চকাহিনী কি বিপুলভাবে আশে-পাশের দশ-বিশটা গাঁয়ের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, আলোচনার লোভনীয় চাটনি একইভাবে আশে-পাশের গাঁয়ের মানুষদের নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু একজন সুস্থ-সবল, সামাজিক মানুষ গয়াপ্রসাদ ওই ঘটনার বিন্দু-বিসর্গ কিচ্ছু জানতে পারলেন না- বিশ্বাস করা খুবই কষ্টসাধ্য।

৭. রাজু ও রামুর মা তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই যমজ সন্তান জন্মাবার আগেই তিনি ভীম-ভীষ্মের হত্যা ও সেই সূত্রে ভীমদের ও তাদের পরিবারের বিষয়ে অনেক কথাই শুনেছিলেন।

৮. ভীম ও ভীষ্মের মা রামদেবী তাঁর সাক্ষাৎকারে জাইয়েছিলেন, তিনি রামু ও রাজুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আমি কি তোমাদের মা?” ওরা উত্তর দিয়েছিল, “হ্যাঁ”। রামদেবী ভীম ও ভীষ্মের ছেলেদের হাজির করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ওরা কি তোমাদের ছেলে?” রামু ও রাজু উত্তর দিয়েছিল, “হ্যাঁ”। ভীমের বোনকে দেখিয়ে রামদেবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এ কি তোমাদের বোন?” ওরা উত্তর দিয়েছিল, “হ্যাঁ”।

এগুলো কোনওভাবেই রাজু ও রামুর আগের জন্মের মা, সন্তান ও বোনকে চিহ্নিত করার সঠিক পদ্ধতি নয়। একই বয়সের একাধিকের সঙ্গে মিশিয়ে হাজির করার পর ওরা যদি আগের জন্মের ওইসব আপনজনদের চিহ্নিত করত, সেইক্ষেত্রে ‘সঠিক চিহ্নিতকরণ’ বলে মেনে নেওয়াটা হতো যুক্তিসঙ্গত।

যে’ভাবে রামদেবী প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে উত্তর “হ্যাঁ” হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।

৯. চন্দ্রসেন তাঁর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “আমরা যে রামু ও রাজুকে দেখতে হাজির হয়েছি, তা রামু-রাজুর অজানা ছিল না। ব্যক্তির ভিতর থেকে ভেসে আসা কথা শুনতে পাচ্ছিলাম- ভীম-ভীষ্মের মা, বোন, ছেলেরা ও দাদা এসেছেন। তারপর যে ভাবে মা ওদের দু’জনকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে ওরা ‘হ্যাঁ’ বলবে এতাই স্বাভাবিক। এটা কোনওভাবেই সঠিক পরীক্ষা ছিল বলে আম্মি মনে করি না।“

১০. রামুর সাক্ষাৎকার নেবার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমার সম্পর্কে এক ভাই রামকিশোর উঁচা লারপুরেই থাকে। তাকে তোমার মনে আছে?” জবাবে রামু বলেছিল, “হ্যাঁ”।

-“রামকিশোর তোমার খুড়তুতো ভাই, তাই না?”

এবারও রামু জবাব দিয়েছিল, “হ্যাঁ”।

আমি ভীমদের পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি ‘রামকিশোর’ নামে কোনও তুতো ভাইই ভীমদের ছিল না। ভীমদের পরিবারে এক এবং অদ্বিতীয় ‘রামকিশোর’ হল ভীমেরই পুত্র।

১১. পুলিশ রেকর্ড থেকে জানতে পারি, দু’ভাইয়ের লাশ বস্তাবন্দি অবস্থায় ছিল না। কুয়ো থেকে মৃতদেহ তুললে দেখা যায় ওদের হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।

১২. এবার যে তথ্যটা পেশ করতে চলেছি, সেটাই রামু-রাজুর জাতিস্মর হয়ে ওঠার দাবিকে বাতিল করার পক্ষে সবচেয়ে জোরালো তথ্য।

পুলিশ রেকর্ড বলছে ভীম ও ভীষ্মকে সর্বশেষ দেখা যায় ২৮ এপ্রিল ১৯৬৪। মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় চারদিন পর। পোস্টমরটেম রিপোর্ট লেখা হয় ৪ মে ১৯৬৪।

অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কোর্ট রেকর্ড বলছে ২৮ এপ্রিল ৬৪ দু’ভাইকে হত্যা করা হয়েছিল।

রামু ও রাজুর জন্ম আগস্ট ১৯৬৪। অর্থাৎ ভীম-ভীষ্মের মৃত্যুর সাড়ে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে রাজু-রামুর বাবা ও মায়ের সাক্ষ্য অনুসারে কাপুরীদেবীর স্বাভাবিকভাবেই দশমাস গর্ভ ধারণের পরই যমজ সন্তানের জন্ম হয়েছিল।

রাজু ও রামুর যে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল ভীম-ভীষ্মের মৃত্যুর প্রায় মাস ছয়েক আগে, সেখানে ভীম-ভীষ্মের আত্মার কাপুরীদেবীর গর্ভে আসার প্রসঙ্গ আসে কি করে?

error: Content is protected !!