‘সুনীল সাক্সেনা’ বিশ্বের তাবৎ প্যারাসাইকোলজিস্টদের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম- এক অতিবিতর্কিত নাম ! সুনীলের জাতিস্মর হয়ে ওঠার কথা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় ১৯৬৪ সালের ৩ জানুয়ারি। সুনীলের জন্ম ও নিবাস উত্তর প্রদেশের ছোট্ট শহর আওনলায় ১৯৫১ –এর ৭ অক্টোবর। ছ ভাই-বোনের মধ্যে সুনীল তৃতীয়।

সুনীলের বাবা চাদাম্মিলাল সাক্সেনা চালাক-চতুর ও কর্মঠ মানুষ। সুনীলের জাতিস্মর হয়ে ওঠার সময় চাদাম্মিলাল একটা কোল্ড-স্টোরেজে কাজ করতেন। সঙ্গে কিছু বাড়তি আয়ের জন্য বুটিক প্রিন্টের কাজ করতেন। প্রিন্টের কাজটা করাতেন একজন কর্মচারীকে রেখে, অর্ডারটা নিতেন নিজের নামে। মা রামেশ্বরী ছোট্ট একটা স্কুলে পড়াতেন। মোটামুটি আয়, পেট অনেক। টেনে-টুনে দিন চলত।

একবার সুনীলের মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল কাকা জয়নারায়ন সাক্সেনার বাড়ি। কাকা থাকে নিউ দিল্লি। সময়টা ১৯৬৩ সাল। কাকার অবস্থা ভাল। বাড়িতে রেডিও, ফ্রিজ, ফোন সবই আছে। রেডিওর গান শুনে, ফ্রিজের ঠান্ডা জল আর আইসক্রীম খেয়ে, ফোনের মধ্যে দিয়ে দূরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখে চার বছরের চালাক-চতুর সুনীল দারুণ উত্তেজিত, বেজায় খুশি।

কাকার বাড়ি থেকে ফিরে এলেও রেডিওর গান, আইসক্রিমের স্বাদ, ঠান্ডা জল খাওয়ার মজা ও ফোনে কথা বলার আকর্ষণকে এড়াতে পারল না। এই সময় প্রথম মা’কে জানায়- ও আগে ও খুব বড়লোক, ‘শেঠ আদমী’ ছিল। ওর বাড়িতেও রেডিও, ফ্রিজ, ফোন সবই ছিল।

মা প্রথম প্রথম সুনীলের ওসব কথাকে একটুও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এরপর থেকে নাকি সুনীল পূর্ব জন্মের বিষয়ে বিস্তৃতভাবে এমন সব বর্ণনা দিতে থাকে, যাকে আর ‘ছেলেমানুষি’ বলে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। সুনীল নাকি এই সময় জানিয়েছিলেন ও ছিল ‘বুধায়ুন’ শহরের এক ‘শেঠ’ বা ধনী ব্যবসায়ী। নিজের বিশাল বাড়ি ছিল, ,গাড়ি ছিল, টাঙ্গা ছিল। কারখানা ছিল। বুধায়নে কলেজ তৈরি করে দিয়েছিল ও। চার বিয়ে। দুটি ছেলে, একটি  নিজের। আর একটিকে দত্তক নিয়েছিল। চতুর্থ স্ত্রী জলে বিষ মিশিয়ে পান করিয়েছিলেন। তাতেই মৃত্যু। বুধায়ুন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন বন্ধু পাঠকজী। টাউন স্কুলে পড়েছিল। সেই স্কুলের এক মাস্টারের কথা খুব মনে পড়ে, যাকে ডাকত ‘মাস্টার সাহেব’ বলে।

সুনীলের কাছে এ’সব কথা শুনেছিলেন ওদের বাড়িওয়ালা গোবিন্দ মুরারীলাল। গোবিন্দ সব শুনে সুনীলের কথাগুলো যাচাই করে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেন। সুনীলের বাবা চাদাম্মীলালকে চাপ দিতে থাকেন, বোঝাতে থাকেন-সুনীল বাস্তবিকই জাতিস্মর না এ’সবই ওর পাগলামি, এতা জানার জন্য সুনীলকে একবার বুধায়ুনে নিয়ে যাওয়াটা জরুরি। গোবিন্দ আরও বলেন, তাঁর আপাতভাবে মনে হচ্ছে সুনীল বোধহয় শেঠ শ্রীকৃষ্ণ আগরওয়ালের কথা বলছে। শেঠ শ্রীকৃষ্ণ বুধায়ুনের বিশাল নামী-দামী মানুষ ছিলেন। মারা গেছেন সুনীলের জন্মের বছর কয়েক আগে।

আওনলা থেকে বুধায়ুন মাত্র ৩৫ কিলোমিটারের পথ। তবু যাচ্ছি-যাব করে আরও দু-একটা মাস গড়িয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সুনীলকে নিয়ে ওর বাবা-মা গেলেন বুধায়ুন। নির্দিষ্ট লক্ষ্য- সুনীল সত্যিই জাতিস্মর কি না, এ’বিষয়ে সত্যানুসন্ধান, সঙ্গী হিসেবে গেলেন চাদাম্মিলালের এক বন্ধু। তারিখটা ২৯ ডিসেম্বর। সালঃ ১৯৬৩।

সুনীল ও ওর মা-বাবার বক্তব্য অনুসারে- সুনীল ওখানে গিয়ে সত্যিই আমাদের সব্বাইকে অবাক করে দিল। শুধু আমাদেরই বা বলি কি করে ! শেঠ শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয় এবং পরিচিতেরাও দারুন রকম অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ও চিনতে পেরেছিল শেঠজীর চতুর্থ পত্নী শকুন্তলাদেবীকেও, দত্তক পুত্র শ্যামপ্রকাশ ও শেঠজীর ঘনিষ্ঠদের। শেঠজী প্রতিষ্ঠিত কলেজ দেখে সুনীল জানিয়ে ছিল- এই কলেজই আমি তৈরি করে দিয়েছিলাম, শেঠজীর প্রাসাদতুল্য বাড়িটি দেখেই নিজের বাড়ি বলে চিনতে পেরেছিল।

সুনীলের বুধায়ুনে আগমন ও তার পরবর্তী ঘটনা প্রচারমাধ্যমগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সুনীলের ওপর অনুসন্ধান ও গবেষণা চালাতে ছুটে এসেছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির (নাকি অখ্যাতি?) অধিকারী প্যারাসাইকোলজিস্টরা। ৬৪-র ডিসেম্বরেই সুনীলকে নিয়ে অনুসন্ধানে নামলেন প্রণব পাল। তারপর ৭১-এ এলেন আয়েন স্টিভেনসন। ৭৪-এ ময়দানে নামলেন আর এক পরামনোবিজ্ঞানী ডঃ এল.পি. মেহরোত্রা। অনুসন্ধান শেষে তিনজনই দাবি জানালেন- সুনীল জাতিস্মর। কারণ হিসেবে তিনজনই জানালেন- সুনীলের দেওয়া বেশীর ভাগ তথ্যই আশ্চর্য রকম ঠিক এবং শ্রীকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠদের সকলকেই ও চিনতে পেরেছিল। আয়েন স্টিভেনসন তো সুনীলকে নিয়ে বই-ই লিখে ফেললেন, তারপর পৃথিবী জূড়ে হৈ-চৈ পড়ে গেল। ‘অধ্যাত্মবাদের দেশ ভারত’ও চুপ করে রইল না। নানা ভাষাভাষি পত্র-পত্রিকাও গাঁ ভাসাল সুনীলের স্রোতে।

 

শেঠ শ্রীকৃষ্ণ আগরওয়াল-এর শেষ জীবন এবং

শেঠ শ্রীকৃষ্ণ আগরওয়াল ছিলেন সম্ভবত শহরের সবচেয়ে বড় ধনী। শেঠজীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে তাঁর শেষ বয়সের উপর কিছু  আলোকপাত করছি।

শেঠজীর দুটি বিষয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। একঃ ধর্ম-কর্ম ; দুইঃ যৌন আকাঙ্ক্ষা। শেঠজী প্রতিদিন পুজো করতেন। বহু দেব-দেবতাতেই ভক্তি থাকলেও রামের প্রতি ছিল একটু বাড়তি ভক্তি। শহরের গান্ধী পার্কে প্রতি বছর রামলীলা উপলক্ষে বিরাট মেলা বসাতেন শেঠজী। অনেক দূর দূর থেকেও লোক আসত মেলায়। উত্তরপ্রদেশের অনেক জায়গাতেই ধর্মশালা করে দিয়েছিলেন। শহরে নিজের প্রাসাদ ছাড়াও ছিল আরও কয়েকটি বাড়ি। তৈরি করে দিয়েছিলেন কলেজ। তেলের বিরাট মিল ছাড়াও ছিল আরও ব্যবসা।

চারটি বিয়ে করেছিলেন শেঠজী। চতুর্থ বিয়ের ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। এক উত্তরপ্রদেশের আদিবাসীর স্ত্রীর রূপ-যৌবনে মোহিত হয়ে শেঠজী আদিবাসী পুরুষটিকে মোটা টাকা দেন। সেই সঙ্গে বাঁধা মাসোহারার ব্যবস্থা। তারপর ষোড়শী সুন্দরীটিকে বিয়ে করে প্রাসাদে তুললেন। নাম দিলেন শকুন্তলা। শকুন্তলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। অন্য জায়গা থেকে শকুন্তলাকে বিয়ে করে নিয়ে আসায় বইয়ের পিছনের ঘটনা হাতে গোনা দু-চারজন ছাড়া প্রায় সকলেরই ছিল অজানা। কিন্তু শকুন্তলার স্বামী এক সময় বুধায়নে এসে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করতে থাকে শেঠজীকে। শহরে এই নিয়ে দ্রুত কানাকানি শুরু হয়। এই কেলেংকাড়ি শেঠজীর বিপুল জনপ্রিয়তায় কিছুটা ফাটল ধরিয়েছিল।

শেঠ শ্রীকৃষ্ণ কলেজের অধ্যক্ষ এস. ডি. পাঠক ছিলেন শেঠজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঘনিষ্ঠতা এতই গভীর ছিল যে পাঠকজী থাকতেন শেঠজীর প্রাসাদেই। শেঠজী শেষ বয়সে এই পাঠকজীর কাছ থেকেও গভীর আঘাত পেয়েছিলেন। শেঠজী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন পাঠকজীর সঙ্গে শকুন্তলার একটি অবৈধ সম্পর্ক আছে। শেঠজী নিজে যোউন অক্ষম ছিলেন না। যৌন ক্ষমতাকে ধরে রাখতে শরীরচর্চার পাশাপাশি আয়ুর্বেদিক ঔষধও সেবন করতেন। শেঠজী বাস্তবিকই সুসবাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন।  ভালোবাসার (?) বিনিময়ে শকুন্তলার এমন বিশ্বাসঘাতকতা শেঠজীর মন ভেঙ্গে দিয়েছিল। ভাঙ্গা মন আরও খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে, যখন শেঠজী আবিষ্কার করলেন তাঁরই দত্তক পুত্র শ্যামপ্রকাশের সঙ্গেও শকুন্তলা একই সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখে চলেছে।

১৯৫১ সালের ১৪ এপ্রিল সকালে শেঠজী হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। বিকেলে মৃত্যু। শহরে গুজব ছড়ায় শেঠজীকে বিষ পান করিয়ে মারা হয়েছে। মেরেছেন শকুন্তলা। ষড়যন্ত্রের আড়ালে শ্যামপ্রকাশ ও পাঠকজীই আছেন বলে রটে যায়। পরবর্তীকালে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে আমার মনে হয় এটা স্রেফ গুজবই।

শেঠজীর মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিয়ে আত্মীয় ও ব্যবসার অংশীদারদের মধ্যে নানা রকম ঝগড়া-বিবাদ-ষড়যন্ত্র ইত্যাদি মাথা চাড়া দেয়। এরই মধ্যে শকুন্তলা দেবী কলেজের প্রেসিডেন্ট হলেন, যদিও তিনি লেখাপড়া জানতেন না। সম্ভবত একই সঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষ ও শেঠজীর দত্তক পুত্রকে নাচাতে পারারই পুরস্কার এটা। শেঠজীর নিজের ছেলে রামপ্রকাশ তখনও নাবালক এবং শকুন্তলাই তার অভিভাবক।

শকুন্তলা এক সময় খোলামেলা ভাবেই শ্যামপ্রকাশের সঙ্গে তাঁর প্রেম-প্রেম খেলা চালাতে লাগলেন। শেঠজীর স্ত্রী শেঠজীরই ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছেন- এটা মেনে নিতে পারেনি শহরের তামাম মানুষ। সম্পর্কে মা-ছেলের এই জৈবিক প্রেম শেঠজীর কলেজের ছাত্র এবং অভিভাবকদের পক্ষে বরদাস্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে শকুন্তলা দেবী কলেজের প্রেসিডেন্টের পদ হারান ; হারান রামপ্রকাশের অভিভাবকত্বও। এতে শকুন্তলাকে বাগে আনা গিয়েছিল, বা তাঁর স্বভাব চরিত্রে পরিবর্তন আনা গিয়েছিল, এমন ভাবার মত কোনও দৃষ্টান্ত আমার চোখে পড়েনি। শকুন্তলা শ্যামপ্রকাশকে বিয়েই করে ফেললেন। এ’ভাবে শকুন্তলা ‘অফিসিয়াল’ তৃতীয় বিবাহ সেরে ফেললেন ছেলের সঙ্গে।

ইতিমধ্যেই অধ্যক্ষ পাঠকজীর যৌন-কেলেংকারি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তিনি জন-রোষে কলেজ থেকে বিতাড়িত হন। অধ্যক্ষ পদে আনা হয় নরেন্দ্র মোহন পান্ডাকে। নরেন্দ্র মোহনও শেঠজীর পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।

 

অনুসন্ধানে আমি যা পেয়েছি

১৯৭১-এর শেষে সুনীলের আওনলায় যাই। আওনলা বেরিলি শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। সুনীল তখন সিস্কের ছাত্র। সুনীলের মা-বাবা জানালেন ও ছাত্রও ভালো। সেকেন্ড স্ট্যান্ড করে ক্লাসে উঠেছে। সুনীল পোশাক-আশাকে যে টিপটপ থাকে, সেটা দেখেছিলাম। বিভিন্ন সাক্ষীরা জানিয়েছিলেন টিপটপ থাকাটাই সুনীলের অভ্যেস। সুনীল আমার সঙ্গে চা খেয়েছিল। খাদ্যাভাসের পরিচয় নিতে গিয়ে জেনেছি- আমিষাশী।

এই অনুসন্ধান পর্বে আমি বুধায়ুনেও গিয়েছিলাম। শেঠজীর ঘনিষ্ঠ মানুষজনদের সাক্ষ্য থেকে জেনেছি শেঠজী পোশাক-আশাকের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। সাজগোজে কোন বিলাসিতা ছিল না। চা কখনই খেতেন না। নিরামিষাশী ছিলেন।

তিন প্যারাসাইকোলজিস্ট অন্তত একবার করে ঘোষণা রেখেছিলেন, তাঁরা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছেন শেঠজীর পরিবারের সঙ্গে সুনীলের পরিবারের কোনও যোগসূত্র ছিল না। সুতরাং শেঠজী সম্পর্কে খুঁটিনাটি বহু কিছু জানা সুনীলের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল না। তিনপ্যারাসাইকোলজিস্টের মধ্যে যিনি সবচেয়ে নামী-দামী সেই আয়েন স্টিভেনসন ‘India Cases of the Reincarnation Type’ গ্রন্থে সুনীল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ১১০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “So far as I could ascertain, the two families had no prior acquaintance before the development of the case. Sakuntala Devi, widow of Seth Sri Krishna, on the One side, both denied any previous knowledge of the other’s family. Chandammi Lal Saxena said he had never heard of the Seth or his college in Budaun until Sunil began talking about him.” অর্থাৎ- আমি নিশ্চিন্তে, দুটি পরিবার এই ঘটনার আগে উভয়ের বিষয়ে কিছুই জানত না। শকুন্তলাদেবী এবং সুনীলের বাবা চাদাম্মিলাল দু’জনেই জানিয়েছিলেন, দুই পরিবারই এই ঘটনার আগে দুই পরিবারের পরিচিত ছিল না। চাদাম্মিলাল আরও জানিয়েছিলেন, তিনি শেঠজী বা শেঠজীর কলেজের নামও সুনিলের কাছ থেকে শোনার আগে কখনো শোনেননি।

এই প্যারাসাইকোলজিস্টদের মতামতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, অথবা অন্য কোনও প্রভাবশালী মহলের দ্বারা চালিত হয়ে পত্র-প্ত্রিকাগুলো এভাবে শোরগোল তুলেছিল যে, স্থানীয় জনগণ সুনীলকে বাস্তবিকই শেঠজী বলে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধানে আমি যা পেয়েছি, তা এবার আপনাদের সামনে হাজির করছি।

সুনীলের দাবী যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি আমার মন্তব্য
১। আমি বুধায়ুনে ছিলাম। নাম ছিল কিষেণ। ১। রামেশ্বরী সাক্সেনা ২। চাদাম্মিলাল সাক্সেনা ৩। গোবিন্দ মুরারীলাল (সুনীলদের বাড়িওয়ালা) ১। রামেশ্বরী সাক্সেনা ২। চাদাম্মিলাল সাক্সেনা ৩। গোবিন্দ মুরারীলাল (সুনীলদের বাড়িওয়ালা)
২। বাড়িতে রেফ্রিজারেটর ছিল। ১। জয়নারায়ন সাক্সেনা (সুনীলের নয়াদিল্লির কাকা) ২। সুনীলের বাবা ৩। সুনীলের মা ৪। শকুন্তলাদেবী সুনীল রেফ্রিজারেটর কথাটি না বলে ফ্রিজ দেখিয়ে বলেছিল- আমার বাড়িতেও এটা ছিল, জানিয়েছিলেন জয়নারায়ন সাক্সেনা। শকুন্তলা দেবীর সাক্ষ্যে জানতে পারি, শেঠজীর মৃত্যু পর্যন্ত বাড়িতে কোনও ফ্রিজ ছিল না। তথ্য ভুল।
৩। মটোর ছিল কালো রঙ্গের। ১। সুনীলের বাবা ২। সুনীলের মা ৩। শকুন্তলাদেবী ৪। রামপ্রকাশ (শেঠজীর পুত্র) সুনীল জানিয়েছিল ওর মটোর ছিল। রামপ্রকাশ জিজ্ঞেস করে, “মটোরের রং কি ছিল?” উত্তরে সুনীল জানিয়েছিল কালো। শকুন্তলা ও রামপ্রকাশের সাক্ষ্য অনুসারে গাড়ির রং ছিল ‘চকোলেট’। তথ্য ভুল।
৪। কলেজ ‘পাড়া মহল্লা’য় অবস্থিত। ১। সুনীলের মা ২। সুনীলের বাবা ৩। নরেন্দ্র মোহন পান্ডা (শ্রীকৃষ্ণ কলেজের অধ্যক্ষ) ৪। স্থানীয় লোকজন ‘পাড়া মহল্লা’ বলে বুধায়ুনে কোনও অঞ্চল বা পাড়াই নেই। কলেজ যে অঞ্চলে, তার কাছে রয়েছে ‘বড়া বাজার’। তথ্য ভুল।
৫। টাঙ্গা ছিল। টাঙ্গার ঘোড়ার রং ছিল কালো। ১। সুনীলের মা ২। সুনীলের বাবা ৩। এস. ডি. পাঠক (কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ) ৪। সাফাৎ উল্লা (শেঠজীর ‘মুনশি’) ঘোড়ার রং ছিল লালচে বাদামী। কালো নয়। তথ্য ভুল।
৬। চার বিয়ে, এক স্ত্রীর গয়ের রং কালো। তিন জন ফর্সা। ১। সুনীলের মা ২। স্থানীয় মানুষ ৩। পাঠকজী চার বিয়ে। এবং তৃতীয় স্ত্রীর গায়ের রং কালো ছিল। তথ্য ঠিক।
৭। বড় মেলা বসাত বুধায়ুনে। ১। রামেশ্বরী (সুনীলের মা) ২। স্থানীয় মানুষ। মেলা বসত রামনবমী উপলক্ষে। মেলা বসাতেন শেঠজীই। তথ্য ঠিক।
৮। একটা সিনেমা হল ছিল। ১। সুনীলের মা ২। সুনীলের বাবা ৩। পাঠকজী ৪। রামেশ্বরী ৫। স্থানীয় মানুষ না। কোন সিনেমা হল ছিল না। একটা হল তৈরি করেছিলেন বটে। কিন্তু সেই হলটা ছিল ‘স্টোর হাইজ’। সিনেমা হল নয়। তথ্য ঠিক নয়।
৯। ‘মুনশি’ সাফাৎ উল্লাকে চিনতে পেরেছিল। ১। সুনীলের মা ২। সুনীলের বাবা ৩। ‘মুনশি’জী সুনীলের মা ও বাবা যদিও বলেছিলেন সুনীল শেঠজীর মুনশিকে চিনিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু মুনশিজী দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছিলেন সুনীলের মা-বাবার এই দাবী ‘বিলকুল ঝুট’। তথ্য ঠিক নয়।
১০। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে গিয়েছিল। ১। সুনীলের মা ২। শকুন্তলাদেবী ৩। পাঠকজী ৪। গোপাল বৈদ্যজী (শেঠজীর পারিবারিক চিকিৎসক) ১০। ঘোড়া থেকে কোনও দিনই পড়ে যাননি। পা’ও মচকায়নি। একবার এক দুর্ঘটনায় পা ভাঙ্গে। তবে তা ঘোড়া থেকে পড়ে নয়। তথ্য ভুল।
১১। শেঠজীর বোন, বোনের জামাই সুন্দরলাল ও বোনের মেয়ে আনন্দীকে চিনতে পেরেছিল। ১। সুনীলের মা ২। সুনীলের বাবা ৩। রামপ্রকাশ ৪। শকুন্তলাদেবী ৫। পাঠকজী সুনীলের মা-বাবার সাক্ষ্যকে সমর্থন করেননি কেউই। বাঁকি তিনজন জানিয়েছিলেন, তাঁদের সামনে এই ঘটনা ঘটেনি। পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ কারও সামনে সুনীল এঁদের চিহ্নিত করেছিল, এমন ঘটনাও ওঁরা শোনেননি।
১২। শেঠজীর প্রাসাদে তিনজনের একসঙ্গে তোলা একটা ছবি দেখে বলে দিয়েছিল, একজন-নিজে বাকি দু’জন- স্ত্রী ও পুত্র। ১। শকুন্তলাদেবী ২। শ্যামপ্রকাশ সুনীল শেঠজীকে চিনতে পেরেছিল। কিন্তু বাঁকি দুজনকেই চিনতে ভুল করে ছিলেন। ঘরে শেঠজীর এতই ছবি ছিল, যে সে’সব দেখে শেঠজীকে যে কোনও শিশুর পক্ষেই চিনে ফেলা সহজ।
১৩। গোপাল বৈদ্যজীকে চিনতে পেরেছিল। ১। সুনীলের মা ২। গোপাল বৈদ্যজী গোপাল বৈদ্যজী’র কথামত তিনি যখন রোগী দেখছিলেন, সেই সময় সুনীলরা এসেছিল। বৈদ্যজী প্রশ্ন করেছিলেন- তুমি আমাকে চিনতে পারছ? উত্তরে সুনীল বলেছিল- হ্যাঁ, আপনি রোগীদের ওষুধ দেন। সুনীলের এই উত্তর থেকে কখনোই স্পষ্টতর হয়নি সুনীল গোপালজীকে গোপালজী হিসেবে চিনতে পেরেছিল।
১৪। শেঠজীর বন্ধু রামগোপাল ব্যাস’কে চিনতে পেরেছিল। আরও জাইয়েছিল- শেঠজীর আর এক বন্ধু শিবনারায়ণ দাসের গয়নার দোকান ছিল। ১। রামগোপাল ব্যাস ২। শিবনারায়ণ দাস রামগোপাল ব্যাস ছিলেন শেঠজীর বন্ধু। সুনীল রামগোপালকে চিনতে পেরেছিল। রামগোপালকে শুধু সুনীলই নয়, সুনীলের মা-বাবাও চিনতেন। রামগোপাল সুনীলদের বাড়ি যেতেন, কারণ, সুনীলের বাবা চাদাম্মিলাল রামগোপালের কোল্ড স্টোরেজেই কাজ করতেন। শুধু রাম গোপালই শেঠজী ও সুনীলদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত একমাত্র ব্যক্তি নন। স্বল্প আয়াসেই আর কয়েকজনের নাম সংগ্রহ করতে পেরেছি যারা একই সঙ্গে দুটি পরিবারকেই জানতেন। দু’নম্বর ব্যক্তির নাম সেবতি প্রসাদ। সেবতি সম্পর্কে সুনীলের বাবার কাকা। বুধায়ুনের বাসিন্দা সেবত্রি মাঝে-মাঝেই আসতেন সুনীলদের বাড়ি। সেবতি প্রসাদের কথা- শেঠ শ্রীকৃষ্ণকে খুব ভালমতই চিনতাম। তিনঃ সুনীলের এক কাকা জয়নারায়ণ সাক্সেনা এই সময় ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব বা Personal Assistant। বুদ্ধিমান, রাজনীতিবিদ, বৈষয়িক জয়নারায়ণ শেঠ শ্রীকৃষ্ণের পরিচিত ছিলেন। চারঃ শেঠ শিবনারায়ণ দাস। শিবনারায়ণ শ্রীকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বুধায়ুনে শিবনারায়নের একটি অলংকারের দোকান আছে। আওনলায় শিবনারায়ণ রামগোপাল ব্যাসের সঙ্গে অংশীদারী ব্যবসা হিসেবে কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসা করতেন। সুনীলের বাবা ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ওখানে কাজ করতেন এবং শিবনারায়ণের পরিচিত ছিলেন। সুতরাং শিবনারায়ণের বুধায়নে অলংকারের দোকানের খবর সুনীলের জানতে পারার মধ্যে অবাক হবার মত কিছুই দেখতে পাই না। মাত্র এইটুকু তথ্য পাওয়ার পরই আমরা বলতে পারি, যে সব প্যারাসাইকোলজিস্টরা জানিয়েছিলেন “আমি নিশ্চিত, দুটি পরিবার ওই ঘটনার আগে উভয়ের বিষয়ে কিছুই জানত না।” -তাঁরা নিশ্চিত ভাবেই ভুল করেছিলেন। অবশ্য এই ভুল ইচ্ছাকৃত, কি অনিচ্ছাকৃত সে আর এক গবেষণার বিষয়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলতেই পারি এ’ক্ষেত্রে সুনীলের জাতিস্মর হয়ে ওঠার পিছনে দু’টির যে কোনও একটি কারণ ক্রিয়াশীল। একঃ সুনীল উভয় পরিবারের পরিচিত কারও কাছ থেকে শেঠজীর বিষয়ে কিছু কিছু কথা শুনেছিল। শেঠজীর বিচিত্র জীবন সুনীলের মনকে দারুনভাবে নাড়া দিয়েছিল। সুনীল গভীরভাবে শেঠজীর কথা ভাবতে ভাবতে নিজের অজ্ঞাতেই নিজের মধ্যে অন্যের সত্তাকে খুঁজে পেতে থাকে। অর্থাৎ নিজেকে শেঠজী বলে ভাবতে শুরু করে। এটা সুনীলের মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের কাজকর্মে বিশৃঙ্খলা থেকে সৃষ্ট অবস্থা। দুইঃ শেঠজীর বিশাল সম্পত্তিতে ভাগ বসাবার লোভেই সুনীলকে পূর্বজন্মের শেঠজী বলে হাজির করা হয়েছিল। শেঠজী সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্য সুনীলের মাথায় ঢোকানো হয়েছিল। সুনীল বাস্তবিকই জাতিস্মর হলে ওর দেওয়া তথ্যে ভুল-ভ্রান্তি থাকত না। ওর প্রচুর ভুলই প্রমাণ করে ও জাতিস্মর নয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে অন্যান্য প্যারাসাইকোলজিস্টরা সুনীলের তথ্যে প্রচুর মিল খুঁজে পেলেন কি করে? উদাহরণ হিসবে সবচেয়ে নামী-দামী প্যারাসাইকোলজিস্ট আয়েন স্টিভেনসনের লেখা থেকে অংশ তুলে দিচ্ছি। এ’থেকেই আসল রহস্যের হদিস আপনারা পেয়ে যাবেনঃ আমি বুধায়ুনে থাকতাম। আমার বাবা ছিল। আমার মা ছিল। আমার বউ ছিল। আমার সন্তান ছিল। আমার ফ্যান ছিল। আমার চাকর ছিল। আমার জামাকাপড় ছিল। আমি বউয়ের জন্য গয়না কিনেছিলাম। আমার বাড়ি ছিল- ইত্যাদি অকনিঞ্চিতকর সব কথা-বার্তা। এইসব তথ্য মেলাতে জাতিস্মর হতে হয় না। একটি সাধারণ মানুষ-ছানা হলেই চলে। কিন্তু এমন ধরনের গোটা চল্লিশের মিলের পর (যে সব মিলে মধ্যে ধরে নিতেই পারেন রয়েছে, চুল কাটাতাম নাপিতের কাছে, মন্দিরে যেতাম, বাড়িতে পূজো করতাম, দুধ ভালবাসতাম, প্যাঁড়া ভালবাসতাম, লাড্ডু ভালবাসতাম ইত্যাদি ইত্যাদি) গোটা দশ-পনের অমিল পাত্তাই পায় না প্রচার মাধ্যামগুলোর কাছে, তা সে’সব অমিল যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন ! সাংবাদিকদের মাইনে দেয় ‘সত্যবাদিতা’ নয়, ‘সংবাদপত্র’। সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করতে হলে সংবাদপত্রের পলিসির সঙ্গে মানিয়েই কলম চালাতে হবে। নইলে ‘আউট’। তাই একজন সাংবাদিক ব্যক্তিগতভাবে চান বা না চান পত্রিকা চাইলে তাঁকে দিনকে রাত করতে হয়, রাতকে দিন। তাইতো পত্রিকার লাগাতার প্রচারে ‘জোনাকি’ ‘নক্ষত্র’ হয়, আর সত্যের সূর্যকে ঢাকতে নেমে আসে ‘ব্ল্যাক-আউট’ -এর কালো মেঘ বা ‘ইয়োলো জারনালিজম’ -এর নোংরা ধোঁয়া।
error: Content is protected !!