সাম্প্রতিককালের মধ্যে যে জাতিস্মর কলকাতাসহ তামাম ভারতের প্রচারমাধ্যমগুলোকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সে হল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ছোট শহর চাকদার ছোট্ট মেয়ে অগ্নিশিখা।
খবরটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা দৈনিক পত্রিকা ‘বর্তমান’এ। ১০ জুন ১৯৯৪ প্রথম পাতায় বিশাল গুরুত্ব দিয়ে ছবিসহ ছাপা হয়েছিল জেনুইন-জাতিস্মর অগ্নিশিখার লোমখাড়াকরা কাহিনী। অগ্নির প্রবল আবির্ভাবে শহর কলকাতা যেন জাতিস্মরের জ্বরে কাঁপতে লাগল।
সেদিনই জরুরি তলব পেয়ে গেলাম ‘সানন্দা’র দপ্তরে। ‘সানন্দা’ আনন্দবাজার গ্রুপের জনপ্রিয় পাক্ষিক। সানন্দার আগামী সংখ্যা জাতিস্মর নিয়ে। আর তার কেন্দ্রবিন্দু চাকদার অগ্নিশিখা। অগ্নিশিখার আগামী সংখ্যা জাতিস্মর নিয়ে। আর তার কেন্দ্রবিন্দু চাকদার অগ্নিশিখা। অগ্নিশিখার খবরটা এনে দিয়েছিল আনন্দবাজার গ্রুপের সাংবাদিক বাল্মীকি চট্টোপাধ্যায়। বাল্মীকি দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে অগ্নিকে জাতিস্মর বলে নিশ্চিত হয়ে সে কথা জানিয়েছেন ‘সানন্দা’কে। এমন এক উত্তেজক ‘ক্যাচি ম্যাটার’কে আরও আকর্ষণীয়ভাবে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে প্রেজেন্ট করতে একগাদা মাথা খেটেছে। দ্রুত তৈরি হয়েছে পরিকল্পনা। বাল্মীকির অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে জাতিস্মর বিষয়ক নানা লেখা দিয়ে সাজানো হয়েছে আগামী সংখ্যাটি। কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। অগ্নির জাতিস্মর হয়ে ওঠা নিয়ে অনুসন্ধান পর্বটি চালানো হয়েছিল অতি গোপনে, যাতে অন্য কোনও পত্রিকা যেন অগ্নির বিন্দু-বিসর্গ না জানতে পারে। আজ কোনও দৈনিক জানতে পারলে, কালই তা ছেপে বের করে দেবে। পাক্ষিক পত্রিকার পক্ষে আজ জানলে কাল ছাপার কোনও উপায় নেই। তাই পাক্ষিক পত্রিকার পক্ষে অতি আকর্ষণীয় খবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে অতি সতর্কতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা একান্তই প্রয়োজনীয়। অগ্নির ক্ষেত্রে সে গোপনীয়তা পুরোপুরি রক্ষা করার চেষ্টা সত্ত্বেও গোটা পরিকল্পনা ও পরিশ্রমই বরবাদ হয়ে গেছে। ‘বর্তমান’ এর কাছ থেকে আসা আচমকা আঘাত ওঁদের টেনশন বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী সংখ্যাটির কেন্দ্রবিন্দু যেহেতু অগ্নি, তাই ‘বর্তমান’এ খবরটা বড় করে বেরিয়ে যাওয়ায় সংখ্যাটি পাঠকদের কাছে ব্রাত্য হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান। এই পরিস্থিতিতে অগ্নিকে নিয়ে আমার অনুসন্ধানমূলক লেখা পাঠকদের টানতে পারে মনে করে এই তলব। আমিও জাতিস্মরতার মুখোশ ছেঁড়ার এমন একটা সুযোগ গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করিনি।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল আগামীকালই নেমে পড়ব কাজে। আমার অনুসন্ধান পদ্ধতিতে না জানি কি আছে- ভেবেই বোধহয় সঙ্গী হওয়ার তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করলেন ‘সানন্দা’র দুই সম্পাদক সহযোগী অনিরুদ্ধ ধর ও উজ্জ্বল চক্রবর্তী।
অগ্নিশিখার দাবি সে গত জন্মে জন্মেছিল বর্ধমানের কোটিপতি ব্যবসায়ী ধনপতি দত্তের প্রাসাদে। নাম ছিল দেবযানী। বিয়ে হয়েছিল ধনী ব্যবসায়ী চন্দন বণিকের সঙ্গে। চন্দন ও শ্বশুর চন্দ্রনাথ প্রায়ই শারীরিক অত্যাচার করত। শেষ পর্যন্ত স্বামী ও শ্বশুর ওকে হত্যা করে।
দেবযানী হত্যা মামলা
বর্ধমানের ধনী ব্যবসায়ী ধনপত্তি দত্ত’র মেয়ে দেবযানী। ১৯৭৫-এ বিয়ে। কলকাতার হিন্দুস্থান পার্ক নিবাসী ধনী ব্যবসায়ী চন্দ্রনাথ বণিকের বড় ছেলে চন্দনের সঙ্গে, বিয়ের পর কোলে আসে তিনটি সন্তান। দুই ছেলে, এক মেয়ে।
১৯৮৩ সালের ২৮ জানুয়ারি বণিকদের প্রাসাদেই খুন করা হয় দেবযানীকে। দেবযানীর মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করে ২৯ জানুয়ারি। মৃতদেহে ততক্ষণে পচন শুরু হয়ে গিয়েছিল। মৃতের গলায় ছিল ফাঁসের দাগ।
৩০ জানুয়ারি পুলিশ ওই প্রাসাদ থেকেই গ্রেপ্তার করে দেবযানীকে তিন ননদ জয়ন্তী, সুমিত্রা ও চিত্রাকে।
২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হ্যয় দেবযানীর পতি নন্দন, শ্বশুর চন্দ্রনাথ ও দেওর অসীমকে।
১৯৮৩-র ১৩ সেপ্টেম্বর আসামীদের বিরুদ্ধে দায়রা বিচার শুরু হয় আলিপুরে দশম অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজের আদালতে।
সরকার পক্ষে সাক্ষী ছিলেন ৬৬ জন। আসামীর পক্ষে ২ জন।
বিচারক দিলীপনারায়ণ সেন ৮৫-র ১১ এপ্রিল তাঁর রায়ে চন্দন ও চন্দ্রনাথের ফাঁসির আদেশ দেন।
কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করলেও রায় অপরিবর্তিতই থাকে। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চনও চন্দন ও চন্দ্রনাথের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে। বহাল থাকে সুমিত্রার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপের অপরাধে অসীম ও জয়ন্তীর ২ বছর কারাদন্ডের আদেশ দেন ডিভিশন বেঞ্ছ।
সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন চন্দন ও চন্দ্রনাথ। ১৯৮৭-র ১১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে দুই বিচারপতি-বিশিষ্ট বেঞ্ছে শুনানি হয়। দুই বিচারক তাঁদের রায়ে বলেন, ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। আসামী চন্দ্রনাথ উনসত্তর বছরের বৃদ্ধ। অপর আসামী চন্দন অতি তরুণ ও তিনটি শিশুর পিতা। এই বিষয়গুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে চন্দন ও চন্দ্রনাথকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জানা গিয়েছিল দেবযানীর কোটিপতি পিতাকে বার বা দোহন করতেই দেবযানীর উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালাতেন চন্দন ও তাঁর পরিবার। ২৮ জানুয়ারি দেবযানীকে হত্যা করে মৃতদেহ ঘরের মধ্যে বিছানা জড়ানো অবস্থায় ফেলে রেখে চন্দনের পরিবারের লোকজন সিনেমা দেখেছেন। মৃতদেহ পাচারের সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু পচা গন্ধই ওদের পরিকল্পনায় বাদ সেধেছিল।
দেবযানী হত্যাকান্ডের ঘটনা গোটা পশ্চিমবাংলা তোলপাড় করেছিল।
১১ জুন, ১৯৯৪
চাকদার উত্তর ঘোষপাড়ায় আমরা যখন হাজির হলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। অমিত দে’র বাড়ির হদিস জানতে পথচারীদের সাহায্য চাইতে গিয়ে অদ্ভুত ধরনের নিঃস্পৃহ ব্যবহার পেলাম। যে মধ্য-বয়স্ক মানুষটির কাছে শেষ সাহায্য চেয়েছিলাম, তিনি অমিত দে’র বাড়ির দু-কদম দূরেই থাকেন। চোখ মটকে দু’কাঁধ ঝাঁকিয়ে থুতনি-নির্দেশে একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন, “দেখুন, বোধহয় ও’বাড়িটা।“ বললাম, “আমরা যে অমিতবাবুকে খুঁজছি, তার মেয়ে জাতিস্মর।“
ভদ্রলোক আবার কাঁধ ঝাঁকালেন, “কে জানে মশাই। আমরা পাড়া-পড়শিরা তো এতদিন কিচ্ছুটি জানতে পারলাম না। জানলাম কালকের কাগজ পড়ে।“
ছোট দোতলা বাড়ি। একতলার সম্মুখের দুটি ঘরেই তালা ঝুলছে। আমাদের দিকে গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে এলেন এক মলিনবসনা প্রৌঢ়া, তাঁর পিছু-সঙ্গী দু’টি গৃহবধূ, ছিটের সস্তা ফ্রক পরা তিনটি বালিকা ও লুন্নগি পরা আদুড়-গায়ের দুটি কিশোর। তাঁরা শোরগোল তুলে আমাদের বোঝাতে লাগলেন, বাইরে তালা ঝোলানো থাকলেও ভিতরে লোক আছে। গলা তুলে ডাকুন।
আমরা সেই শুনে হাঁক-ডাক পাড়তেই দোতলার জানালা দিয়ে একটি-দুটি করে মোট একজোড়া পুরুষ ও একজোড়া নারীর মুখ উঁকি মেরেই সরে গেল। একটু পরেই সরু গলিপথ দিয়ে এলেন এক পঞ্চাশ উত্তীর্ণ মহিলা। একটা ঘরের তালা খুলে দিয়ে চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “আপনারা কি কোনও পত্রিকার থেকে এসেছেন?”
সম্ভবত আমাদের গাড়ি দেখে অনুমান করে থাকবেন। বললাম, “হ্যাঁ।“
-“কোন পত্রিকা?”
-“আনন্দবাজার গ্রুপের সানন্দা’র তরফ থেকে আসছি।“
ঘরের ভিতরে পা দিয়েই বললেন, “তাড়াতাড়ি ভিতরে আসুন।“
ঘরে ঢুকলাম আমি, অনিরুদ্ধ, উজ্জ্বল ও চিত্র-সাংবাদিক সুদীপ আচার্য। তখনই প্রৌঢ়া চাপা গলায় ফিসফিস করলেন, “দরজাটা বন্ধ করে দিন, ছিটকিনি আর খিল দু’টোই বন্ধ করে দিন, “তারপর বিড়বিড় করে আপনমনেই বললেন, “সব হিংসা… হিংসুকগুলো আড়িপাতার চেষ্টায় আছে …”
পড়শিদের হিংসে কেন? এবাড়ির শিশুকন্যাটি আগের জন্মে এক কোটিপতির আদবের তনয়া ছিল প্রমাণ হলে কোটিপতি পরিবারের দাক্ষিণ্যের কিছুটা এই পরিবারের উপর বর্ষাতে পারে অনুমান করেই কি? তারই সূত্র ধরে পড়শিদের ঈর্ষার কথা ভেবেই উষ্মা প্রকাশ করলেন কি অধৈর্য এই প্রৌঢ়া?
উজ্জ্বল দরজার খিল ও ছিটকিনি আটকালেন, প্রোঢ়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার পরিচয়?”
-“জাতিস্মর অগ্নিশিখার ঠাকুমা। মানে ওর বাবার মা।“ তারপরই দ্রুততার সঙ্গে বললেন, “বর্তমানের লোক বিষ্যুদবার এসেছিল। কাল শুক্রবারই ওরা বের করে দিয়েছে। আপনাদেরটাও বের করে দ্যান তাড়াতাড়ি করে।“
-“আর কোনও পত্রিকা ইতিমধ্যে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কি?”
-“আজকে দুটো ছেলে আসছিল, বললেন। ওরা দুটো ফটো দেখাল আমাদের। একটা দেবযানী ও দেবযানীর বরের। আর একটা দেবযানীর বর একটা বাচ্চা নিয়ে। অগ্নিশিখার কাছে ওরা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল- এই ছবি দেখে ও ওর বর আর মেয়েকে চিনতে পারছে কি না! ওরা ফলস দিচ্ছিল।“
-“ফলস যে দিচ্ছিল, এটা কে ধরল, অগ্নিশিখা?”
-“না, আমার বউ ধরে ফেলেছে। আমাকে আড়ালে ডেকে বলেছে, মা মা শোনেন, ওরা কিন্তু মিথ্যা। একজন ভদ্রলোকের মেয়ের হাতে তো চুড়ি থাকবে না, ন্যাংটো থাকবে না। আমরা অমনি অগ্নিশিখাকে সরিয়ে নিয়ে গেছি।“
-.এঁরা কারা?”
-“দিল্লির হিন্দী পত্রিকার লোক, কাঁচড়াপাড়া বাড়ি। আপনাদের মত গাড়ি নিয়ে আসেনি।“
-“আপনারা ছবিগুলো অগ্নিশিখাকে দেখতে যদি দিতেনও তাতেই বা কি হতো?”
-“আমরা চাইনি এই জিনিসটা বাইর হোক। দেড় বছর ধরেই আমার নাতনি কথা-বার্তাগুলো বলছিল। আপনারা কি বললেন না, কি বইটা বের করবেন?”
-“সানন্দা।“
-“সানন্দায় তাড়াতাড়ি বের করে দ্যান, দেরি করতেছেন কেন?”
তারই মাঝে ঘরে ঢুকলেন অগ্নিশিখার বাবা অমিত দে। উচ্চতা পাঁচফুট চার ইঞ্চি থেকে পাঁচ ইঞ্চি। স্বাস্থ্য ভালো। বয়স পয়তিরিশের মধ্যে। ওষুধের ব্যবসায়ী। এসে প্রথমেই জানালাটার ছিটকিনি লাগিয়ে সতর্কতার সঙ্গে আমাদের প্রত্যেককেই একবার ভালোমত ‘মেপে’ নিলেন, ঠাকুমা দরজার আড়ালে দাঁড়ানো বউমা আঁকড়ে তখন পুতুল। শ্যামলা রং। মিষ্টি মুখ। কদমফুলের মতো চুল।
অমিতবাবু একটা চেয়ারে বসে, ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “সানন্দা তো খুবই ইনভেসটিগেশন করেছে। সবকিছু টেপিংও করা আছে। ওখান থেকে তো সবই শুনতে পারবেন, জানতে পারবেন। আজ স্কালীকজন আসছিল। তাকেও এ’কথাও বলেছি।“
-“কিন্তু বর্তমান’কে তো বলেছেন।“
-“কথার ছলে একটু হয় তো বলা হয়েছে।“
-“বর্তমানের ছবিটা দেখে মনে হল ওটা পুরনো ছবি। আপনারাই দিয়েছেন।“
-“হ্যাঁ, আমাদের অ্যালবাম থেকেই কথায় কথায় দিয়ে দিয়েছে।“
অগ্নিশিখার ঠাকুরদা অজিতবাবুর ব্যেস ষাটের কাছাকাছি হলেও স্বাস্থ্য দেখে বঝার উপায় নেই। উনি সরাসরি জানতে চাইলেন আমরা যে ‘সানন্দা’র লোক, অন্য কোনও পত্রিকার প্রতিনিধি নই, তার কোনও প্রমাণপত্র সঙ্গে আছে কি?
সুদীপ পকেট থেকে ‘প্রেস-কার্ড’ বের করে হাতে ধরিয়ে দিতে অজিতবাবু শুধু কার্ডটাই পড়লেন না, ছবির সঙ্গে সুদিপকে মিলিয়ে নিলেন, মাঝবয়সী এক প্রতিবেশী ইতিমধ্যে ঘরের চৌকাঠে। আমাকে দেখিয়ে বললেন, “কিন্তু ওঁকে আগে যেন কোথাও দেখেছি!”
অনিরুদ্ধই জিজ্ঞাসায় লাগাম পোরালেন। “সাংবাদিক তো, কত জায়গায় ঘোরাফেরা করেন, দেখতেই পারেন।
গন্ধটা খুব সন্দেহজনক। অগ্নিকে দেবযানী বলে প্রচার করার জন্য পত্র-পত্রিকাগুলোকে ব্যবহার করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অগ্নির পরিবারের মানুষজনের আছে- এ যেমন সত্যি ; তেমনই সত্যি-ওরা প্রচার-মাধ্যমগুলোর মধ্যে কার কাছে মুখ খুলবে, কার কাছে না এ বিষয়ে অতি মাত্রায় সতর্ক। একটি বিশেষ ব্যক্তি (অনুমান করতে পারি- প্রবীর ঘোষ) ও একটি বিশেষ পত্রিকার (অনুমান করতে পারি, সাধারণত আমাদের সমিতির ও আমার সত্যানুসন্ধানের যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সে ‘আজকাল’) আবির্ভাব ঘটার সম্ভাবনায় সদা শঙ্কিত ও সতর্ক !
এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই আমি নাম ভাঁড়িয়েছিলাম। পরীক্ষান্তে সন্দেহের মেঘ কাটতে পরিবারের সকলের মাথা থেকে যেন একটা দুশ্চিন্তার বোঝা নামল। অগ্নির মা সন্ধ্যা দে গুটোন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে মুখ খুলেছেন। “বছর দেড়েক ধরেই অগ্নি বলেছে, ওর কলকাতায় বিশাল বাড়ি আছে। গাড়ি আছে। ছ’মাস আগে জানিয়েছে, ওর আগের জন্মের বাবার নাম ছিল ছিল ধনপতি দত্ত। তারপর তো সবই বলেছে- বিয়ের পর স্বামী চন্দন, শ্বশুর চন্দ্রনাথ বণিক আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব মারত। চাইত, দেবযানী যাতে বাপের বাড়ি থেকে মাঝে-মাঝেই টাকা এনে দেয়। শেষ্য পর্যন্ত চন্দন, চন্দ্রনাথ ওরা তো মেরেই ফেলল দেবযানীকে।“
অগ্নির বন্ধু হয়ে উঠতে একটুও দেরি হল না আমার। খাটের উপরে মাদুর বিছানো। তার উপরে আমি আর অগ্নি দুই বন্ধুতে তুমুল হুটোপুটি, খেলাধুলো শুরু করে দিলাম। অগ্নি আদৌ গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। খেলতে খেলতে তারই মাঝে এটা-ওটা কথার মাঝে আমার প্রশ্নগুলো গুঁজে দিচ্ছিলাম। উত্তরও পাচ্ছিলাম।
-“আগের জন্মে তুমি স্কুলে পড়েছ?”
-“বল কোন স্কুলে পড়েছ।“ ঠাকুমা বললেন।
-“নার্সারি।“
উত্তরটা ভুল। তবু সে কথা না বলে হৈ-চৈ করা খেলার মাঝখানে পরের প্রশ্নটা করলাম।
-“তুমি যে স্কুলে পড়েছ, সেটা ছোট না বড়?”
-“বড়।“
-“স্কুলটার কি রং ছিল?”
-“লাল রং।“
-“দিদিমণিদের নাম মনে আছে?”
-“দিদিমণি, দিদিমণি।“
-“স্কুলের বন্ধুদের নাম মনে আছে?”
-“বন্ধু, বন্ধু।“
-“বন্ধু, তার নাম।“
-“তারই নাম শুধু বন্ধুই বন্ধু। বাঃ খুব ভাল বলেছ।“
-“তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?”
-“হ্যাঁ।“
-“তোমার সুজাতা নামে এক বন্ধুর কথা মনে আছে?” (সুজাতা নামের বন্ধুটি আমারই কল্পনায় সৃষ্টি।)
অগ্নিকে চুপ করে থাকতে দেখে বললাম,
“তোমার বিয়েতে এসেছিল, অনেক গয়না দিয়েছিল। একটা জড়োয়ার সেট দিয়েছিল। মনে আছে?”
-“আমার আছে সেট। বাড়িতে আছে।“
-“সুজাতা নামে কোনও বন্ধুর কথা মনে পড়ে?”
ঠাকুমা অগ্নিকে বললেন, “লজ্জা কোরো না, বল। ওই দেখুন ও হ্যাঁ বলছে, মুখ দিয়ে বল।“
-“হ্যাঁ।“
-“তোমার মনে আছে রীতা দিদির কথা, তোমাকে পড়াত?”
-“হ্যাঁ … হ্যাঁ।“
-“বাঃ।“
ঠাকুমা পুতুলরানী নাতনীর এমন উত্তরে খুশি গদ্গদ কন্ঠে বললেন, “হ্যাঁ ঠিক আছে। ও বলেছিল ওর মাকে।“
শুনে হাসবো, কি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রীতা দিদি এক কাল্পনিক চরিত্র। আর তাকে নিয়েই কি না…। শিশুর খামখেয়ালিপনাকেও কাজে লাগিয়ে যেভাবে পুতুলরানী অগ্নিকে দেবযানী প্রমাণ করতে তৎপরতা দেখালেন, তাতে বিষয়টাকে নতুন করে ভাবতে বসাটাই অতিমাত্রায় যুক্তিসঙ্গত মনে হল।
-“আমার বই দেখবে?”
-“নিশ্চয়ই দেখব, দেখাও, দেখাও।“
– অগ্নি কাচ-আলমারি থেকে একটা ছড়া-ছবিতে এ-বি-সি-ডি’র বই বের করতে গিয়ে মাঝেতে ফেলে দিল আর একটি চটি বই। বইটি পর্ণো-পুস্তক। পুতুলরানী দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পর্ণো-পুস্তক বা ‘নীল বই’টি তুলে রাখলেন তাকে। যে বইটির উপর রাখলেন, সেটিও একটি ‘নীল বই’। ওই আলমারিতে কেন, গোটা ঘরেই আর কোন বইয়ের দেখা পেলাম না। দেখা পেলাম না গতকালকের ‘বর্তমান’ ছড়া আর কোনও পত্রিকার। পড়াশুনার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এমন একটি পরিবারের পক্ষে আমার সম্বন্ধে জানা ও তার দরুন শঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক নয়, কখনোই স্বাভাবিক নয়। কেউ তবে আমার আগমনের সম্ভাবনা বিষয়ে অগ্নির পরিবারকে অবহিত করেছেন, সতর্ক করেছেন? কে ? ? সেই কি তবে অগ্নিদের চালিত করছে আড়ালে থেকে? ?
অগ্নি বইয়ের ছবিগুলো দেখাচ্ছিল। আমি একটা করে ছবি দেখিয়ে বলে চলেছাইলাম, “এটা জবা, এটা গাঁদা, গোলাপ।“ পদ্মফুলের ছবি দেখিয়ে বললাম, “এটা পদ্ম। মনে আছে পদ্ম তোমাদের বাড়িতে কাজ করত?”
পুতুলরানী বললেন, “ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে চাইছে,” তারপর অগ্নিকে বললেন, “মুখ দিয়ে হ্যাঁ হল, মুখ দিয়ে বল।“
অগ্নি সরল শিশুটি ঠাকুমার কথায় বলল, হ্যাঁ।“ এখানেও গোলমাল। ‘পদ্ম’, আমারই সৃষ্ট একটি চরিত্র।
-“আমাদের বাড়িতে একটা ব্যাঙ আছে।“
-“সেটা কি করে? টাকা দেয়? না লাফায়?”
-বাইরের উঠোনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে অগ্নি বলল, “ওই জায়গায় ব্যাঙ থাকত। ধূপ ধূপ করে লাফাত। ব্যাঙ আবার টাকা দেয় না কি ! কি বোকা !”
বুঝতে আমাদের কারুরই অসুবিধে হল না, ‘ব্যাঙ’ বলতে অগ্নি ‘ব্যাঙ’ই বুঝিয়েছিল ‘ব্যাঙ্ক’ নয়।
-“তোমাদের কটা গাড়ি ছিল মনে আছে?”
-“হ্যাঁ।“
-“কটা।“
-“একটা।“
-“কি রঙ্গের গাড়ি গো?”
-“সাদা রঙ্গের।“
-“কোন বাড়িতে, বিয়ের আগে?”
-“না।“
অগ্নির বাবা একটুক্ষণের জন্য বেরিয়েছিলেন। ফিরে এলেন একটা ছোট্ট ঠোঙ্গায় চানাচুর নিয়ে। অগ্নির হাতে ঠোঙ্গাটা দিতেই ও মহা-আনন্দে শোরগোল তুলে ঢেলে দিল বইয়ের উপর। তারপর খুঁটে খুঁটে দুটো-চারটে দানা মুখে ফেলতে লাগল। আমার মুখেও ফেলল কয়েকবার।
-“তুমি ক্যাডবেরি খেতে ভালোবাস?”
-“অগ্নির বাবাই উত্তর দিলেন, “না না, ক্যাডবেরি দেবেন না। খাবে না, ফেলে দেবে। সানন্দার বাল্মীকিবাবু ক্যাডবেরি দিয়েছিলেন। ও ফেলে দিয়েছে।“
ধাক্কা খেলাম, বড় একটা ধাক্কা ! বাল্মীকি কেন মিথ্যে তথ্য হাজির করলেন তাঁর লেখায়? কেন জানালেন, অগ্নি ক্যাডবেরি ভালোবাসে, ক্যাডবেরি ভালবাসত দেবযাণী। দেবযানীর ক্যাডবেরি প্রেমের খবর দিয়েছিল যাবযানীরই মেজভাই গোরা। যেবযানী ও অগ্নির খাবারের পছন্দেও মিল ছিল- এমন মিথ্যে তথ্য হাজির করার মধ্যে আর যাই থাক, সত্যানুসন্ধান ছিল না। তবে কি ছিল??
দ্বিধা ও সংশয়ে দীর্ণ হতে হতেও আবার মন দিলাম বন্ধু অগ্নির দিকে।
-“আগের জন্মে তোমার বাবার নাম কি ছি গো?” অগ্নিকে জিজ্ঞেস করলাম।
-“ধনপতি দত্ত।“
-“কি করে জানতে পারলে তোমার বাবার নাম ধনপতি দত্ত? কে বলেছে তোমাকে?
উত্তর দিল না অগ্নি। “এখনকার বাবার নাম কি? মনে আছে?” প্রশ্ন করলাম।
-“অমিত দে।“
-“কে তোমাকে শেখালো বাবার নাম অমিত দে?”
উত্তর পেলাম না, আমি নিজের বুকে আঙ্গুল ঠুকে বললাম, “এই জেঠুটার নাম কি বলত?”
অগ্নি চুপ। বললাম, “এই জেঠুর নাম সঞ্জয়। মনে থাকবে? কি বলতো আমার নাম?”
-“ছঞ্জয়।“
-“তাহলে এই জেঠুর নাম?”
-“ছঞ্জয়।“
-“আমার নাম যে ছঞ্জয়, কে শেখালো গো?”
-“তুমি।“
-“কে বলল গো। তোমার বাবার নাম ধনপতি দত্ত?”
-“মা।“
-“তোমার বিয়ে হয়েছিল ওগুলো কে বলল গো?”
-“মা।“
শরবৎ খেতে খেতে আমরা অগ্নির বাবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, “দেবযানীর মেজ’দা কি আজ-কালের মধ্যে আসবেন?”
উত্তর দিতে পারিনি। কিন্তু প্রশ্ন খচ-খচ করছে, দত্ত পরিবারের সব্বাইকে ছেড়ে দিয়ে শুধু মেজদার কথাই তুললেন কেন অমিতবাবু? উনি কি তবে খবর পেয়েছেন, দেবযানীর মেজদা দেবযানীর ফিরে আসার খবরে আপ্লুত? কি করে এই খবর অমিতবাবু পেলেন? এটাও একটা কোটি টাকার প্রশ্ন।
অগ্নি আমাদের কাছে দেবযানীর জীবনের কিছু কিছু ঘটনা ও কিছু কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছিল। তার কিছু ঠিক ; কিছু ভুল। অগ্নি সেই-সেই তথ্যই ঠিক-ঠাক দিতে পেরেছিল, যে’সব তথ্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ; অথবা একটু চেষ্টা করলেই সংগ্রহ করা সম্ভব। ১২ জুন ৯৪ সকালে আমাদের সমিতির সদস্য সুদীপ দে সরকার এসেছিলেন আমার ফ্ল্যাটে। বরাহনগরে ছোটখাট একটা কারখানার অংশীদার। কাজের সুবাদে বর্ধমানেও যান-টান। তিনি ধনপতি দত্তের পরিবারের নানা ধরনের ব্যবসার খোঁজ-খবর রাখেন, দেখলাম। দত্ত-পরিবারের কোল্ডস্টোরেজ, পেট্টলপাম্প, বাজার, সিনেমা হল, পুকুর, স্টিলের নৌকো অনেক কিছুর হদিসই দিলেন। চন্দ্রনাথ বণিক পরিবারের অনেক কথাই সুদীপের জানা, যে-সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। এমন জানা মানুষ নিশ্চয়ই সুদীপ একা নন। এমন দুই বিখ্যাত ধনী পরিবার দেবযানী হত্যার পর আরও বেশি প্রচারের আলোয় এসেছেন। ফলে, ওই দুই পরিবারের বিভিন্ন হাঁড়ির-খবর জানা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।
অগ্নি সেই সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা তুলনামূলকভাবে একটু কঠিন। অথবা শুধুমাত্র দেবযানী এবং তার ঘনিষ্ঠদের পক্ষেই জানা সম্ভব।
অগ্নির কিছু সাফল্য ও ব্যর্থতাকে বিশ্লেষণ করলে এম্নটাস্নদেহ করার অবকাশ থেকেই যায়, একটি সরল শিশুকে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করতেই শিশু মনে বারংবার ঢোকানো হয়েছে- তোর আগের জন্মের বাবার নাম ধনপতি দত্ত ; তোর বিয়ে হয়েছিল বণিক পরিবারে… ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এমন একটা সিদ্ধান্তে কেন এলাম? এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠতে পারে, অনেক মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ-চিকিৎসক নিশ্চয়ই বলতে পারেন- এমনও হতে পারে, অগ্নি কারও কাছ থেকে দেবযানীর কথা শুনেছিল এবং দেবযানী-কাহিনী ওর শিশুমনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল, আকৃষ্ট করেছিল। ফলে অগ্নি প্রায়ই দেবযানীর কথা ভাবতে শুরু করে এবং ভাবতে ভাবতে এক সময় মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের কাজকর্মে বিশৃঙ্খলার জন্য অগ্নি নিজেকে দেবযানী বলে ভাবতে শুরু করেছে এবং দেবযানী সংক্রান্ত শোনা তথ্যগুলো উগরে দিচ্ছে।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানীদের এই যুক্তি অগ্নির বেলায় খাটে না। কারণ অগ্নির মা-বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুরমার জবানবন্দী অনুসারে তাঁরা কেউই অগ্নির দেওয়া দেবযানীর তথ্যগুলো আগে জানতেনই না। অগ্নির কাছে দেবযানীর জীবনের কথা তাঁরা নাকি আগে কোন দিনই বলেননি। অন্য কোন আপনজনদের পক্ষেও নাকি অগ্নিকে দেবযানীর গল্প শোনানো সম্ভব নয়। কারণ অগ্নির অভিভাবকদের অগোচরে অগ্নি তেমন কোথাও যায় না। তিন বছরের শিশু বলেই যায় না, সম্ভাব্য দিকগুলো নিয়ে বিচার করলে এক কথাই বলতে হয়- অগ্নি কোন মানসিক রোগী নয়, যেমনটা অনেক সময় মানসিক রোগীরা ভাবতে থাকে সে আগের জন্মে অমুক ছিল, বা তাকে ভূতে ধরেছে, অথবা তার উপর ঈশ্বরের ভর হয়েছে। অগ্নিকে কেউ দেবযানীর জীবনের বেশ কিছু কথা বার-বার শুনিয়েছে এবং বুঝিয়েছে- সে ছিল দেবযানী।
কেন এমনটা বোঝাবে? দেবযানী দত্ত পরিবারের ‘চোখের মণি’, ‘আদরের ধন’ ছিল- এ’কথা অনেকেরই অজানা নয়। ওই আদরের ধন আবার ফিরে এসেছে প্রমাণিত হলে কোটিপতি দত্ত পরিবারের ভালোবাসার কিছুটা চুইয়ে নামলেও বিশাল্লাভ- এই হিসেব কষেই কি অগ্নিকে দেবযানী দত্ত (বণিক) বানাবার এক চক্রান্ত বাঁধতে শুরু করেছে?
এই জিজ্ঞাসাটা বিশাল হয়ে ওঠে, যখন দেখি, পাড়া-প্রতিবেশী কেউই অগ্নির জাতিস্মর হওয়ার খবর জানতে পারলেন না গত দেড় বছরে। তাঁরা জানলেন একটি পত্রিকা পড়ে। অথচ মেয়ে ‘জাতিস্মর’ -এমন আবিষ্কারের কথা অগ্নির পরিবারের মানুষদের সবচেয়ে আগ বলার কথা প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠদেরই। এটাই ছিল মনস্তত্ত্বের স্বাভাবিক প্রকাশ। কেন এই স্বাভাবিক প্রবণতার প্রকাশ দে-পরিবারের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত?
পাড়া-পড়শিরা কেউ জানতে পারলেন না, অথচ কলকাতার বড়-বড় পত্রিকাগুলোতে এই জাতিস্মরের খবর খাওয়ানো হয়েছে। কারা খাওয়ালেন? কারা ছিলেন এই প্রচার-মাধ্যমগুলোর যোগাযোগ মাধ্যম?
দে পরিবার কেন চাইছেন না অগ্নি তার পূর্বজন্মের স্মৃতি ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক? কেন তাঁরা হাঁক-পাঁক করছেন- অগ্নি যে দেবযানী এটা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খুব দ্রুত প্রচারিত হোক?
এটা আমাদের চারজনের (আমি, অনিরুদ্ধ, উজ্জ্বল ও সদীপ) কাছেই পরিষ্কার ছিল, দে পরিবার অগ্নির বিষয়টা প্রচারে আনতে আগ্রহী হলেও কোনও এক পত্রিকা-লেখকের আগমন আশঙ্কায় অতিমাত্রায় সতর্ক। আমরা অনুমান করতে পারি, লেখকটি আর কেউ নন স্বয়ং আমি। সত্যানুসন্ধানে কেন ভয় থাকবে? ঘটনা সত্যি হলে, এমন ভয় থাকতেই পারে না। তবে কি দে পরিবার তাঁদের মিথ্যে ধরা পড়ার আশঙ্কায় ভুগছেন?
পত্র-পত্রিকা ও লেখা-পড়ার জগত থেকে শত কিলোমিটার দূরে থাকা দে পরিবারের পক্ষে ভয়ের কারন হিসেবে আমাকে চিহ্নিত করা স্বাভাবিক নয়। পরিবারের বাইরের অন্য কোনও পরিপক্ক মাথা কি তবে গোটা ব্যাপারটা ঘটিয়ে চলেছেন, এবং তিনি আমার সম্পর্কে ভালমতই খোঁজ- খবর রাখেন?
এরপরঅ কেউ যদি প্রশ্ন করেন, তিন বছরের একটা বাচ্চার পক্ষে কি এত কিছু মনে রাখা সম্ভব? তাহলে বলবো, সাধারণ ও স্বাভাবিক বুদ্ধির একটি তিন বছরের বাচ্চার উপর পরীক্ষা চালালেই প্রশ্নকর্তা দেখতে পাবেন, এই ধরনের গপ্পো ওরা কি দারুণ রকম মনে ধরে রাখে।
পরিশেষে সম্ভাব্য পরিপক্ক মাথা ও দে পরিবারের প্রতি আন্তরিক অনুরোধ- একটি মেয়ের সুস্থ জীবনকে অসুস্থ করে তোলার অমানবিক খেলা থেকে বিরত হোন। অর্থ-লোভে পরমাত্মীয়ের বুকে ছুড়ি মারার ইতিহাস যেমন নতুন নয়, বরং বহমান তেমনই বহমান সমাজে মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষদের উপস্থিতি। তাই তো আজও দেখা মেলে রেল ক্রসিং এর গেটকিপার শুকদেবের, যে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচায় পরের জীবন ; ট্যাক্সি ড্রাইভার স্বপন সাহা এক সাপে-কাটা অপরিচিতকে নিয়ে হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরে নিজের শেষ সম্বলটুকুও উজাড় করে দেয়। সমাজের এমন সচেতন মানুষরাই পারেন এমন ঘটতে যাওয়া অমানবিক ঘটনাকে প্রতিরোধ করতে।
২৪ জুন ১৯৯৪ সংখ্যার ‘সানন্দা’য় আমার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল জিঞ্চিৎ বাড়তি গুরুত্ব সহকারে (সম্পাদকীয়তে জানানো হয়েছিল আমাকে অকুস্থলে তদন্তে পাঠাবার কথা, ছবি-সহ ছাপা হয়েছিল আমার একটি সাক্ষাৎকার। আর প্রতিবেদন – সে তো ছিলই)। প্রতিবেদনটির শেষে লিখেছিলাম, “আমার এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুলের মতো সুন্দর এক শিশুর জীবনে নেমে আসতে পারে কয়েক জোড়া কঠিন হাতের শাসন। যেমনটা অনেক সময়ই ফেল করা শিশুদের উপর নেমে আসে। সেখানে অগ্নির প্রতিবেশীদের প্রতি অনুরোধ- অগ্নির খারাও দিন এলে, তার পাশে দাঁড়ান। ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে সাহায্য করুন।”
যে আবেদন অপগ্নির প্রতিবেশীদের কাছে রেখেছি, সেই আবেদনই রাখছি আগামী কোনও অগ্নির প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যেও। আপনারাই পারেন বুজরুকি বন্ধ করতে, আপনারাই পারেন লোভীর অত্যাচার থেকে তথাকথিত জাতিস্মরকে বাঁচাতে, মানুষ করে গড়ে তুলতে।
অগ্নিশিখা সম্বন্ধে বাল্মীকি যা বলেছেন | বাস্তবে যা দেখেছি |
১। অগ্নি আধো-আধো ভাষায় কিন্তু বড়দের মতো গুছিয়ে কথা বলে। যেমন, “আমি দুম করে পড়ে গেলাম। মাতিতে। মাথায় খুব লাগল। এখানতায়, দেখো দেখো, তখন আমাকে পেতাল। পেতে লাথি মারল। দমাদ্দম, দমাদ্দম লাথি মারল। বলল, তোকে মারব…” ইত্যাদি। | ১। অগ্নি আর পাঁচটা মধ্য-বিত্ত বাঙ্গালী পরিবারের তিন বছরের শিশুর মতই এলোমেলো ভাষায় কথা বলে। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ওর সঙ্গে কাটিয়েছি খেলে, গল্প করে। দেখেছি অগ্নি আদৌ গুছিয়ে কথা বলে না। |
২। “অগ্নিশিখার চাঞ্চল্যকর কথাবার্তা শোনার পরই লাইব্রেরিতে গিয়ে বণিক হত্যার যাবতীয় ফাইলপত্র আবার ঘেঁটে ফেলা হয়। কিভাবে মারা গিয়েছিল দেবযানী? কে কে মেরেছিল? বাপের বাড়ি কোথায়? কিন্তু এত তথ্য কোনও কাজেই লাগল না। কারণ, ওই ছোট মেয়েটি নিজে থেকে তার আগের জন্ম নিয়ে যতটুকু বলেছে তার বেশি কিছু পাইনি ফাইল ঘেঁটে।” | ২। অগ্নি ততটুকুই ঠিক বলেছে, যতটুকু ফাইলে আছে, কাগজে প্রকাশিত হয়েছে অথবা যতটুকু একটু কষ্ট করলেই জানা সম্ভব। অগ্নি সে’সব তথ্য ভুল দিয়েছে, যে’সব ফাইলে নেই, সামান্য আয়াসে জানা সম্ভব নয়। অথচ অগ্নি আগের জন্মে দেবযানী হলে ওইসব তথ্য অবশ্যই জানা উচিতই। |
৩। অগ্নি জানিয়েছিল- বাড়ির নিচে ‘উবি ব্যাঙ’ আছে। বাস্তবিকই কলকাতায় ধনপতি বণিকদের (দেবযানীর শ্বশুর) বাড়ির নিচে রয়েছে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, সংক্ষেপে ইউ.বি.আই.। অগ্নিশিখা আধো-আধো কথায় ‘উবি ব্যাঙ’ বলে ‘ইউ.বি.আই. কেই বোঝাতে চেয়েছিল। | ৩। অগ্নি দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছিল ওর বাড়ির ব্যাঙটা টাকা দেয় না, লাফায়। অর্থাৎ ওর ‘ব্যাঙ’ ব্যাঙই ছিল, ‘ব্যাংক’ নয়। |
৪। অগ্নিশিখা ক্যাডবেরি ভালোবাসে। যেমনটা ভালবাসতো দেবযানী। | ৪। অগ্নির বাবা জানিয়েছিলেন, অগ্নি ক্যাডবেরি এতোটাই অপছন্দ করে যে, ফেলে দেয়। |
মন্তব্যঃ গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৪র্থ খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি
অধ্যায়ঃ চার
♦ এ’দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘সানন্দা’র দপ্তরে প্ল্যানচেটের আসর
♦ ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা
♦ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
♦ স্বামী অভেদানন্দের সামনে আত্মা লিখল শ্লেটে
♦ ভূতের ভরে পটকা মেয়েও পেয়ে যায় হাজার হাতির বল
♦ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ভূতে পাওয়া কি
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার উৎপত্তি
♦ থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রেতচর্চা
♦ উনিশ শতকের সেরা মিডিয়ামদ্বয় ও দুই শৌখিন জাদুকর
♦ থিওজফস্টদের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
♦ থিওজফিস্টদের প্রতি লেখা বিজ্ঞানী হাক্সলের মজার চিঠি
অধ্যায়ঃ সাত
♦ যুক্তির নিরিখে ‘আত্মা’ কি অমর?
অধ্যায়ঃ আট
♦ অসাম্যের বিষবৃক্ষের মূল শিকড় অধ্যাত্মবাদ অধ্যাত্মবাদের মূল শিকড় আত্মা
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন-ঝন বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”
♦ সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের চারটি পায়া কারা
অধ্যায়ঃ দশ
♦ হিন্দু ছাড়া কেউ জন্মান্তর মানে না
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ আত্মার অস্তিত্বে বিশাল আঘাত হেনেছিল চার্বাক দর্শন
অধ্যায়ঃ বারো
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ তবু জাতিস্মর বার বার ঘুরে ফিরে আসে
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ জাতিস্মর কাহিনীর প্রথম পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ২ : চাকদার অগ্নিশিখা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৩ : সুনীল সাক্সেনা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৪ : যমজ জাতিস্মর রামু ও রাজু
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৫ : পুঁটি পাত্র
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৬ : গুজরাটের রাজুল
অধ্যায়ঃ পনের- জাতিস্মর কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৭ : জ্ঞানতিলক
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৯ : ত্রিশের দশকে কলকাতায় জাতিস্মর
অধ্যায়ঃ ষোল- অবতারদের পুনর্জন্ম
♦ জাতিস্মর তদন্ত-১০ : সত্য সাঁইবাবা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ১১ : দলাই লামা
অধ্যায়ঃ সতের
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদারদের প্রতি ১৫০,০০০ টাকার চ্যালেঞ্জ