ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ান স্টিভেনসন তাঁর ‘কেসেস অব দ্য রিইকারনেশন টাইপ’ বইটির প্রথম খন্ডে একটি বাঙ্গালী মেয়ে দোলনচাঁপা মিত্র অনেকখানি জায়গা দখল করে রয়েছে। স্বামী লোকেশ্বরানন্দের ‘লাইফ আফটার ডেথ’ বইটিতেও রয়েছে দোলনচাঁপার উল্লেখ। ইতিপূর্বে দোলনচাঁপার জাতিস্মর ক্ষমতার কথা প্রকাশিত হয়েছে ভারতের জনপ্রিয় একটি দৈনিক পত্রিকাসহ আরও বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায়। ভারতবিখ্যাত পরামনোবিজ্ঞানী হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দোলনচাঁপার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। দোলনচাঁপার জাতিস্মর হয়ে ওঠা নিয়ে আমিও দীর্ঘ অনুসন্ধান চালাই।
দোলনের জন্ম ১৯৬৭ সালের ৭ আগস্ট। বাবা মানিক মিত্র নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন-এর গ্রামসেবক ট্রেনিং সেন্টারের লেকচারার।‘ ১৯৭১-এর গ্রীষ্মের এক দুপুরে মা কণিকাদেবী দোলনের মুখ থেকে প্রথম জানতে পারেন, দোলন নাকি আগের জন্মে বর্ধমান শহরের এক ধনী পরিবারের বুল্টি নামের একটি ছেলে ছিল। মা ছিলেন সুন্দরী। নিজেদের মন্দির ছিল। বিরাট করে পূজো হতো। বাড়িতে ময়ুর ছিল, হরিণ ছিল। কলেজে পড়তে একবার অসুখ করে। মাথার পেছনে ব্যথা হতো। কলকাতার হাসপাতালে বহুদিন ছিল। ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারেননি। ওই রোগেই বুল্টি মারা যায়।
১৯৭১-এ স্বামী লোকেশ্বরানন্দজীর নির্দেশে মানিকবাবু ও কণিকাদেবী দোলনকে নিয়ে বর্ধমানে যান। শহর ঘুরেও দোলন বুল্টির বাড়ি খুঁজে বের করতে পারেনি। ফিরে আসার পর দোলন নিজের মাথার পেছনে ব্যথা অনুভব করতে থাকে। ১৯৭২-এর ’৩০ মার্চ দোলনের দ্বিতীয়বার বর্ধমান যাত্রা। এবার দোলনকে একটি অন্নপূর্ণা মন্দিরের কাছে নিয়ে যেতে সে চিৎকার করে ওঠে, মা, মা, এই সেই মন্দির। কাছের বিশাল বাড়িটিকে দেখিয়ে জানায়, এটাই বুল্টিদের বাড়ি। দোলন ও তার মা-বাবার দাবি, দোলন বুল্টিদের বাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো গ্রুপ ছবি থেকে বুল্টির বাবাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। বুল্টির মা, ছোটভাই শিশির ও ছোট বোন রীতাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। বুল্টি নামে সত্যি ওই পরিবারের একটি ছেলে মাথার যন্ত্রণার চিকিৎসা করাতে গিয়ে মারা যায়।
দোলনচাঁপার বিষয়ে আমি একটি দীর্ঘ অনুসন্ধান চালাই। এর আগে ইয়ান স্টিভেনসন ও ডঃ হেমেন্দ্রনাথ যে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন তাতে বুল্টিদের পরিবারের তরফ থেকে তাঁরা না কি কোন সহযোগিতা পাননি। আমি অবশ্য বুল্টিদের পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি। ফলে দোলনের দাবীর যথার্থতা পরীক্ষা করার সুযোগ আমার পক্ষে ছিল বেশি। দোলনের অনেক দাবী কাঁটায় কাঁটায় ঠিক বলে যারা সাক্ষ্য নিয়েছিলাম তাঁরা সকলেই একমত দোলন খাঁটি জাতিস্মর দোলনের অনেক দাবীকেই এককথায় নাকচ করে দিয়েছেন বুল্টির বাবা অনাথ দে, ভাই শিশির দে এবং কাকা অনিল দে। নাকচ করে দেওয়া দাবীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – বুল্টির বাবা ভাই ও মাকে চিনিয়ে দেওয়ার ঘটনা।
এর পরেও অনেকের কাছেই যেসব প্রশ্ন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় তা হল দোলন বুল্টিদের বাড়ি চিনল কি করে? বাড়িতে বুল্টি নামের কোনও ছেলে যে ছিল এবং মাথা ব্যথার একটা অসুখে মারা যায় তা জানল কি করে? দোলনের মাথায় ব্যথা হতো কেন? বাড়ির সামনের মন্দিরের হদিসই বা জানল কি করে?
দোলনের মা ও বাবা কণিকাদেবী এবং মানিকবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন, দোলনকে নিয়ে প্রথম বর্ধমান যাবার আগে তাঁরা কোনও দিন বর্ধমান যাননি। অনাথবাবু অর্থাৎ বুল্টিদের পরিবারের কারুর সঙ্গেই মানিকবাবুদের পরিবারের পরিচয় ছিল না। অতএব কেউ যদি বলেন – দোলন কারও কাছ থেকে বুল্টির কথা শুনেছিল এবং বুল্টির কাহিনী তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ফলে বুল্টির কথা ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্ককোষের কাজকর্মে বিশৃঙ্খলতার জন্য দোলন নিজেকে বুল্টি বলে ভাবতে শুরু করেছিল। মনোবিজ্ঞানের এই যুক্তি দোলনের ক্ষেত্রে খাটে না বলে মানিক মিত্রের বিশ্বাস।
বুল্টি ও তার পরিবারের বিভিন্ন ঘটনা দোলনের শোনার সম্ভাবনা ছিল কিনা, এটাই দোলনের জাতিস্মরতার দাবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আমি এ-ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচটি পরিবারের নাম হাজির করছি যারা দোলন ও বুল্টি উভয় পরিবারেরই পরিচিত।
(১) নীলাচল সামন্ত। মানিক মিত্রের বন্ধু। বুল্টির ঠাকুরদার পরিচিত। (২) স্বপ্না সামন্ত সীনাচল সামন্তর স্ত্রী। স্বপ্নাদেবীর বোন বুল্টির আত্মীয়ার বন্ধু। (৩) শশাঙ্ক ঘোষ। মানিকবাবুর বন্ধু। নরেন্দ্রপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক। দে পরিবারের বিষয়ে জানতেন। (৪) ডাঃ হেমাঙ্গ চক্রবর্তী নরেন্দ্রপুরের বাসিন্দা। মানিকবাবুদের সঙ্গে হেমাঙ্গবাবুদের পারিবারিক সখ্যতা ছিল। হেমাঙ্গবাবু ছিলেন বুল্টির বাবার বন্ধু। হেমাঙ্গবাবুর ছেলে ছিল বুল্টির বন্ধু। দোলনেরও পরিচিত। (৫) রাজেন্দ্র চক্রবর্তী। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মানিকবাবুর পারিবারিক বন্ধু। বুল্টিদের জানতেন। (৬) কানাই বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিকবাবুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বর্ধমানের মানুষ। দে পরিবারের অনেক কিছুই জানতেন।
এঁদের মধ্যে কেই কোনও দিন দোলনের উপস্থিতিতে বুল্টির বিষয়ে কোনও কিছুই বলেননি, এমন নিশ্চিত হওয়ার মতো কোন তথ্য আমার হাতে নেই। দোলনের মাথায় ব্যথা হওয়ার কারনের পেছনেও অপার্থিব কিছু নেই। কিছু মানুষ বিশেষ গঠন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এঁরা আবেগপ্রবণ, মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতা এঁদের কম। বিশেষ আবেগপ্রবণতার জন্য অনেক সময় এঁরা নিজেদের অজান্তে স্বনির্দেশ পাঠিয়ে অন্যের ব্যথা নিজের শরীরে অনুভব করেন। মানসিক চিকিৎসকদের কাছে এই ধরনের বহু ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে। দোলন অ আ ক খ থেকেই পড়াশুনো শুরু করেছিল। দোলন বাস্তবিকই জাতিস্মর হলে তার পূর্বজন্মের অন্যান্য স্মৃতির মধ্যে লেখা-পড়ার স্মৃতিও উজ্জ্বল থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। একজন মানসিক বিশৃঙ্খলার জন্য নিজেকে অন্য কেউ ভেবে তার ব্যবহার অনুকরণ করতে পারে। কিন্তু তার জ্ঞান প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। দোলনের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল। দোলন বুল্টিদের বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। দোলনকে যে মন্দিরের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল, তার আশে-পাশে বুল্টিদের বাড়িই সবচেয়ে বড়।
জাতিস্মরতা বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষার কোনও বিষয়ই নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, যার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই, তখন তা নিয়ে গবেষণা করব কেন? তবু আমি করেছিলাম এবং ভবিষ্যতেও করব। অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, সাধারণ মানুষদের অন্ধ বিশ্বাসকে ভাঙ্গতে এই ধরনের সত্যানুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।