অবতারদের পুনর্জন্ম

এই তৃতীয় পর্যায়ে আমরা আলোচনায় নিয়ে আসবো আক্ষরিক অর্থে আন্তর্জাতিক পরিচিতির অধিকারী ধর্মগুরুদের ঘিরে গড়ে ওঠা জাতিস্মর কাহিনীকে। এঁরা হলেন- সত্য সাঁইবাবা, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী দলাই লামা, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব, শ্রীশ্রীসারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দ।

সত্য সাঁই ও দলাই লামা নিজেদের জাতিস্মর বলে দাবি করেন, এবং দৃঢ়তার সঙ্গেই করেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব, শ্রীশ্রীসারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। রামকৃষ্ণদেব তাঁর জীবিতকালেই স্পষত করে বলে গিয়েছিলেন, সপার্যদ তিনি আবার জন্ম নেবেন এবং বাংলার বুকেই। জন্ম নেবার নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত। রামকৃষ্ণদেবের কথা সত্যি হলে ওঁরা তিনজন তো বটেই, আরও অনেকেই এখন এই বঙ্গেই বেঁচে-বর্তে রয়েছেন। পূর্বজন্মে রামকৃষ্ণ, সারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন এমন দাবি করার মানুষও মিলেছে। এইসব রোমাঞ্চকর জাতিস্মর কাহিনী নিয়েই আমরা আলোচনা করব তৃতীয় ও শেষ্য পর্যায়ে।

 

জাতিস্মর তদন্ত- ১০ : সত্য সাঁইবাবা

বাঙ্গালরের কাছে ছোট্ট গ্রামে পুট্টাপরথি। এই গ্রামেই জন্মেছে সত্যনারায়ণ রাজু। জন্মের সালা ১৯২৬। তারিখ, ২৩ নভেম্বর। ছোট্ট রাজুর ছোটবেলা থেকেই ম্যাজিকের প্রতি বাড়তি টান। দিন কাটছিল, সময় গড়াচ্ছিল। শিশু রাজু কিশোর হল। কিশোর রাজুর যখন বয়স চোদ্দ বছর, তখন একদিন গ্রামবাসীদের সামনে শূন্য হাতে মুহূর্তে নিয়ে আসছিল ফুল অথবা মিষ্টি। কিন্তু বিষয়টা যেদিন নেহাত আর জাদুর কৌশল রইল না। কারণ রাজু ঘোষণা করেছিল, এমনটা যদিও অনেক জাদুকরই করে দেখায় কিন্তু তার এই শূন্য থেকে সৃষ্টি কোনও জাদু নয়, নির্ভেজাল অলৌকিক ঘটনা। রাজু এও জানাল, ও এই অলৌকিক ক্ষমতা হঠাৎ করে অর্জন করেনি। গত জন্মেও ওর এইসব অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। গত জন্মে ও ছিল “সির্দির সাঁইবাবা”।

সির্দির সাঁইয়ের জন্ম সির্দিতে নয়। তিনি ছিলেন হায়দ্রাবাদ স্টেটের মধ্যবিত্ত এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। জন্ম ১৯৫৬ সালে। ছোটবেলাতেই সাঁই ঘর ছাড়েন এক মুসলমান ফকিরের সঙ্গে। ঘুরতে ঘুরতে সির্দিতে আসেন ১৮৭২ সালে। ১৯১৮-তে যখন মারা যান, তখনও পর্যন্ত তিনি সির্দিতেই ছিলেন। প্রধানত দক্ষিণ ভারতে তাঁর অনেক ভক্ত ছিলেন ও আছেন, যারা মনে করেন সির্দির সাঁই ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি নাকি ছিলেন এক কল্পতরু মানুষ। তাঁর কাছে যে যা প্রার্থনা নিয়ে যেত সবই পূর্ণ হতো। কেউ কোনও দিন বিফল হয়ে ফেরেননি। (তাত্ত্বিকভাবেই এমনটা সম্ভব নয়, যদিও আমাদের এই তথাকথিত অধ্যাত্মবাদের দেশ ভারতের বহু মানুষ আজও বহু জীবিত ও মৃত তথাকথিত অবতারের এমন কল্পতরু হওয়ার শক্তিতে বিশ্বাস করেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা একবার ভাবুন তো, কোনও মামলার বাদী ও বিবাদী পক্ষ একই সঙ্গে সির্দির সাঁইয়ের মত কল্পতরু ক্ষমতার অধিকারীর কাছে মামলায় জয়ী হওয়ার প্রার্থনা করলে দু’জনের প্রার্থনা। একই সঙ্গে তিনি পূরণ করবেন কি করে? তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব নয়। যখন নক-আউট ফুটবল প্রতিযোগিতায় একটি মাত্র দলই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, একাধিক দল নয় ; তখন একাধিক দলের প্রার্থনা তাত্ত্বিকভাবেই পূর্ণ করার ক্ষমতা থাকতে পারে না কোনও কল্পতরু অবতারেরই। একইভাবে বহু ক্ষেত্রেই প্রমাণ করা যায়- কল্পতরু হয়ে সবার প্রার্থনা পূর্ণ করার ক্ষমতা কারোরই থাকতে পারে না।)

এখনও বহু লক্ষ সির্দির সাঁইয়ের ভক্তরা বিশ্বাস করেন- সাঁইয়ের করুণায় যে কোনও রোগী নীরোগ হতে পারে, অন্ধ ফিরে পায় দৃষ্টি, বোবা বলে কথা, নিঃসন্তান লাভ করে সন্তান। একই সঙ্গে বহু জায়গায় নিজের শরীর নিয়ে হাজির হতেন ভক্তদের আহ্বানে।

যাই হোক, রাজু নিজেকে পূর্বজন্মে সির্দির সাঁই বলেই শুধু ঘোষণা করল না, সির্দির সাঁইয়ের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের নামও বলে দিল। (এমন বলতে পারাটা জাতিস্মরতার প্রমাণ হলে মহা বিপদ ! যে কেউ যখন তখন আকবর কি কার্ল মার্কসের ঘনিষ্ঠ দু-চারজনের নাম বলে দিলে আমরা তাদের আকবর কি মার্কস বলে ধরে নিলে কি হবে, একবার ভাবুন তো !)

যাই হোক, ভক্ত ‘পাবলিক’ সির্দির সাঁইয়ের ওই সব অদ্ভুতুড়ে ক্ষমতাতেই শুধু বিশ্বাস করতেন না, তাঁরা রাজুকেই সির্দির সাঁই বলে ধরে নিলেন। এবং পরে নিলেন সির্দির সাঁইয়ের যে সব অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, সে সবই রাজুর  মধ্যেও আছে। রাজুর নতুন নাম হল ‘সত্য সাঁই’ (কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’ –এর মত ব্যাপার আর কি !)

আমাদের বাংলার তথা ভারতের গর্ব (!) ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও সত্য সাঁইকে জাতিস্মর বলে মেনে নিয়েছিলেন। অনেক পরীক্ষা-টরীক্ষা করে ঘোষণা করেছিলেন, ‘সত্য সাঁই’ই আগের জন্মে ছিলেন ‘সির্দির সাঁই’। কি সেইসব পরীক্ষা? সত্যি যে বড়ই কঠিন পরীক্ষা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন সত্য সাঁইও সির্দির সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতাগুলোর যোগ্য উত্তরাধিকারী কি না? তারপর পরীক্ষা অন্তে জ্ঞানতাপস ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় কি মত পোষণ করেছিলেন, তা জানতে আসুন আমরা ‘জন্মান্তরবাদঃ… বইয়ের ২০২ পৃষ্ঠার শেষ পঙক্তিতে চোখ বোলাই।

“প্রতি দিন হাজার হাজার ভক্ত তাঁর আশ্রমে উপস্থিত হয় বহু দাবী ও বাসনা নিয়ে ; তিনি তাদের সকলের ইচ্ছা পূরণ করেন, অন্ধকে চক্ষুদান করেন, সন্তানহীনাকে সন্তান, স্বল্পায়ুকে দীর্ঘ জীবন দেন।“

গ্রন্থে এ’কথাও বলা হয়েছে, সত্য সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতাগুলো সত্যিই আছে কি না, এ’জানার জন্য বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা দ্রকারে এবং তার পরেই কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যেতে পারে। সত্য সাঁইয়ের ক্ষেত্রে পরামনোবিজ্ঞানীকে সিদ্ধান্তের জন্য বিভিন্ন ঘটনা, জনশ্রুতি, বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের সত্য সাঁই সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিচার করে দেখতে হয়।

প্রশ্নটা এখানেই ! কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করবেন? যিনি নির্বাচন করবেন তিনি যদি নিজেকে বার বার ‘বিশ্বাস-অযোগ্য’ বলে প্রমাণ করেন, তবে?

যাই হোক, ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেক প্যারাসাইকোলজিস্টই সত্য সাঁইকে পূর্বজন্মের সির্দির সাঁই বলে ঘোষণা করেছিলেন। এমন ঘোষণার পিছনে প্রধান যুক্তি ছিল- সত্য সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতা।

কিন্তু মুশকিল কি জানেন? সত্য সাঁইয়ের জীবন বাঁচাতে কয়েক শত বিশেষ শিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক-দেহরক্ষী এবং জেড ক্যাটাগরির কমান্ডোকে নিজের চোখে তৎপর দেখার পর সাধারণভাবেই সাধারণ ভাত-রুটি খাওয়া মানুষের মাথায় যে প্রশ্ন উঠে আসে, তা হল- যিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তদের রক্ষা করছেন, তিনি নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম?

যাই হোক, প্যারাসাইকোলজিস্টদের দাবি ও সত্য সাঁইয়ের ক্ষমতা খোলা মনে দেখতে একটি খোলা চিঠি সাঁইয়ের কাছে পেশ করছি। ‘সর্বত্রগাঁমী’, ‘সর্বদ্রষ্টা’, ‘সর্বভাষাবিদ’, সত্য সাঁই বাবা বাস্তবিকই এই বিশেষণগুলির যোগ্য হলে খোলা চিঠির মর্ম উপলব্ধি করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসবেন।

 

ভগবান শ্রীসত্যসাঁইবাবা

প্রশান্তিনিলাময়

পুট্টাপরথি

জেলা- অনন্তপুর, অন্ধপ্রদেশ

 

প্রিয় সত্য সাঁইবাবা,

ভক্ত ও শিষ্য সংখ্যার বিচারে আপনিই সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়তম জীবন্ত ধর্মগুরু, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও গ্রন্থে আপনার অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে অনেক কিছুই পড়েছি এবং আপনার কিছু ভক্তের কাছে আপনার বিষয়ে অনেক কিছু শুনেছি। শুনেছি আপনি অন্ধকে চক্ষুদান করেন, সন্তানহীনাকে সন্তান দান। এবং এ’সবই করেন অলৌকিক ক্ষমতায়। এও শুনেছি এবং পড়েছি, আপনি সকলের ইচ্ছা পূরণ করেন।

আমার একটি তীব্র ইচ্ছে রয়েছে। আপনার কাছে ইচ্ছে পূরণের আবেদন রাখছি। আশা রাখি আপনার ভক্তদের কথা ও লেখাকে সত্য প্রতিপন্ন করতে আমার ইচ্ছে পূরণ করবেন।

আমার ইচ্ছেঃ আমার চিহ্নিত পাঁচটি অন্ধের যে কোনও একজনকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিন আপনার অলৌকিক শক্তির সাহায্যে। আপনি এই খোলা চিঠির প্রার্থনা মঞ্জুর করে চিঠির তলায় দেওয়া ঠিকানায় একটি খবর পাঠান রেজিস্ট্রি ডাকে, ‘অ্যাকনলেজমেন্ট কার্ড’ সহ। অথবা আপনি প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলনে আমার প্রার্থনা মঞ্জুরের খবর দিন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সর্বত্রগ্রামী নই, সর্বদ্রষ্টাও নই। তবু আমাদের সমিতির যে অতি সামান্য নেট-ওয়ার্ক আছে, তারই সাহায্যে খবরটা আমার কাছে আসবেই। তারপর প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের সামনেই পাঁচ অন্ধকে হাজির করব কলকাতায়। সর্বত্রগামী আপনি মাত্র একজনের দৃষ্টি দান করলেই আমার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে।

আপনি যদি আমার ইচ্ছে পূরণ না করেন, তবে অবশ্যই ধরে নেব, আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি অলৌকিক কাহিনীই মিথ্যা ; আপনি যেসব ঘটনা ‘অলৌকিক’ বলে দেখান সেগুলো নেহাতই কৌশলের দ্বারা ঘটিয়ে থাকেন। সত্য প্রকাশের ভয়ে আপনি পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন।

শুভেচ্ছা

প্রবীর ঘোষ

সাধারণ সম্পাদক

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

৩৪এ, শশীভূষণ দে স্ট্রিট

কলকাতা-৭০০ ০১২

 

এর আগেও সত্য সাঁইবাবার ‘বিভূতি’ নিয়ে একটি সত্যানুসন্ধান চালাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনও সহযোগিতা তাঁর কাছ থেকে পাইনি।

সাঁইবাবার নামের সঙ্গে ‘বিভূতি’র ব্যাপারটা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, সাঁইবাবা বললেই তাঁর অলৌকিক বিভূতির কথাই আগে মনে পড়ে। সাঁইবাবা অলৌকিক প্রভাবে তাঁর শূন্য হাতে সুগন্ধি পবিত্র ছাই বা বিভূতি সৃষ্টি করে ভক্তদের বিতরণ করেন। বছরের পর বছর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভক্তেরা দেখে আসছেন সাঁইবাবার বিভূতি সৃষ্টির অলৌকিক লীলা।

১৯৮৪’র মার্চ, ২ এপ্রিল, ২ মে ও ১ জুন সাঁইবাবাকে চারটে চিঠি দিই। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি  চিঠিরও উত্তর পাইনি। আমার ইংরেজিতে লেখা প্রথম চিঠিটির বাংলা অনুবাদ এখানে দিলাম।

ভগবান শ্রীসত্যসাঁইবাবা                 ২৮৭ দমদম পার্ক

প্রশান্তি নিলায়ম                              কলকাতা-৫৫

পুট্টাপরথি                                        পিন-৭০০ ০৫৫

জেলা- অনন্তপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ        ১.৩.১৯৮৪

 

প্রিয় সত্যসাঁইবাবা,

ভক্ত ও শিষ্য সংখ্যার বিচারে আপনিই সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়তম ধর্মগুরু। বিভিন্নপত্র-পত্রিকায় আপনার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার সম্বন্ধে অনেক কিছু পড়েছি এবং আপনার কিছু ভক্তের কাছে আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি। আপনার অলৌকিক খ্যাতি প্রধানত ‘বিভূতি’ সৃষ্টির জন্য। পড়েছি এবং শুনেছি যে, আপনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে শূন্যে হাত নেড়ে ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করেন এবং কৃপা করে কিছু-কিছু ভাগ্যবান ভক্তদের তা দেন।

আমি অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে জানতে আগ্রহী। অলৌকিক কোন ঘটনা বা অলৌকিক ক্ষমতাবান কোন ব্যক্তির বিষয় শুনলে আমি আমার যথাসাধ্য অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্যকে জানার চেষ্টা করি। দীর্ঘদিন ধরে বহু অনুসন্ধান চালিয়েও আজ পর্যন্ত একটিও অলৌকিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা ঘটনার সন্ধান পাইনি। আমার এই ধরনের সত্য জানার প্রয়াসকে প্রতিটি সৎ মানুষের মতোই আশা করি আপনিও স্বাগত জানাবেন ; সেই সঙ্গে এ-ও আশা করি যে, আপনার অলৌকিক ক্ষমতার বিষয়ে অনুসন্ধানে আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা কবেন। আপনার পোশাক ও শরীর পরীক্ষা করার পর আপনি আমাকে শূন্যে হাত নেড়ে, ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করে দেখালে আমি অবশ্যই মেনে নেব যে, আপনার অলৌকিক ক্ষমতা আছে এবং অলৌকিক বলে বাস্তবিকই কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে।

আপনি যদি আমার চিঠির উত্তর না দেন, অথবা যদি আপনার বিষয়ে অনুসন্ধানের কাজে আমার সঙ্গে সহযোগিতা না করেন, তবে অবশ্যই ধরে নেব যে, আপনার সম্বন্ধে প্রচলিত প্রতিটি অলৌকিক কাহিনীই মিথ্যে এবং আপনি ‘পবিত্র ছাই’ বা ‘বিভূতি’ সৃষ্টি করেন কৌশলের দ্বারা, অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা নয়।

শুভেচ্ছান্তে

প্রবীর ঘোষ

 

সাঁইবাবাকে লেখা পরের চিঠিগুলোর বয়ান একই ছিল, তবে সেগুলোতে আগের যে যে তারিখে চিঠি দিয়েছিলাম এবং উত্তর পাইনি, সেই তারিখগুলোর উল্লেখ ছিল।

শূন্যে হাত নেড়ে ছাই বের করাটা ঠিকমতো পরিবেশে তেমনভাবে দেখাতে পারলে যুক্তিহীনদের কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রসূত মনে হতে পারে।

১৬.৪.৭৮ তারিখের ‘সানডে’ সাপ্তাহিক জাদুকর পি. সি. সরকার জুনিয়র জানান তিনি সাঁইবাবার সামনে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে একটা রসগোল্লা নিয়ে আসেন। সাঁইবাবা এই ধরনের ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন।

ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছিল কি না ঘোরতর সন্দেহ আছে। সন্দেহের কারণ – একঃ শ্রীসরকার যে ধরনের লাগাতার মিথ্যে বলেন স্টান্ট দিতে, তার পরিচয় একের পর পাওয়ার পর এটাকে স্টান্ট বলেই মনে হয়। দুইঃ সত্য সাঁইবাবা স্বেচ্ছাসেবী দেহরক্ষীদের দ্বারা যে ভাবে সুরক্ষিত, তা একবার নিজের চোখে দেখে আসার পর শ্রীসরকারের দাবিকে আর একটি বাড়তি মিথ্যে ‘স্টান্ট’ বলেই মনে হয়। এমন মস্তানি করার সাহস শ্রীসরকার দেখাতে গেলে সত্য সাঁই ভয় পেয়ে চিৎকার করে পালাতেন না। শ্রীসরকারের প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকত ; যেমনটা এর আগেও ঘটতে দেখেছি আমরা।

শূন্যে হাত ঘুরিয়ে ছোটখাট কিছু নিয়ে আসা, এটা জাদুর ভাষায় পামিং। পামিং যেমন হাতের কৌশল, তেমনই আর একটা কৌশলকে জাদুর ভাষায় বলে ‘লোড’ নেওয়া। জাদুকর যখন শূন্য থেকে হাঁস-মুরগি-খরগোশ-ফুল-ফল-লাড্ডু ইত্যাদি বের করতে থাকে তখন অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকে লুকিয়ে রাখ্যা হয় পোশাকের আড়ালে। প্রয়োজনের সময় এগুলোকে মুহূর্তে আড়াল থেকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসে দর্শকদের চমকে দেন জাদুকর।

যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য-সদস্যরা গ্রামে-গঞ্জে হরবখৎ এমনি বিভূতি তৈরি করে দেখাচ্ছেন। এ’ক্ষেত্রে আমরা দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করি।

একঃ ছাই বেটে ছেঁকে মিহি করে তার সঙ্গে ঘন মাড় মিশিয়ে ছোট ছোট গোল গোল লাড্ডু তৈরি করি। ছাইয়ের লাড্ডু আটকে রাখি জামা, পাঞ্জাবি বা কোটের ভিতর দিকে। লাগিয়ে বা ঝুলিয়ে রাখা হয় এমন ভাবে, হাত একটু পোশাকের ভিতর দিয়ে হানা দিলেই নাগালে সাঁইয়ের লাড্ডু। হাতের মুঠোয় একটা লাড্ডু মানেই একটু চাপে অনেক ছাই। লাড্ডুতে একটু সেন্ট স্প্রে করে নিলে তো কথাই নেই ! একেবারে সুগন্ধী বিভূতি।

দুইঃ যে বিভূতি বের করে দেখাবে, তার ডান বগলে বাঁধা থাকে রাবার বা নরম প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসের ছোটখাটো ব্লাডার। ব্লাডার ভর্তি করা থাকে সুগন্ধি ছাই। ব্লাডারের মুখ থেকে একটা সরু নল হাত বেয়ে সোজা নেমে আসে হাতের কব্জির কাছ বরাবর। পোশাকের তলায় ঢাকা পড়ে যায় ব্লাডার ও নল। এবার ছাই সৃষ্টি করার সময় ডান হাত দিয়ে বগলের তলায় বাঁধা ব্লাডারটায় প্রয়োজনীয় চাপ দিলেই নল বেয়ে হাতের মুঠোয় ছাই চলে আসবে। বাঁ হাত দিয়েও ছাই বের করতে চান? বাঁ বগলেও একটা ছাই-ভর্তি ব্লাডার ঝুলিয়ে নিন। দেখলেন তো, অবতার হওয়া কত সোজা !

বোঝবার সুবিধার জন্য ছবি দেখুন।

বিভূতি আনার কৌশল
সত্য সাঁইয়ের ছবি থেকে ঝরে যে বিভূতি

সত্য সাঁইবাবা সম্বন্ধে এও শুনেছি যে, অনেকের বাড়িতে রাখা সাঁইবাবার ছবি থেকে নাকি পবিত্র ছাই বাঁ বিভূতি ঝরে পড়ে। বছর কয়েক আগে কোলকাতায় জোর গুজব ছড়িয়ে ছিল যে, অনেকের বাড়ির সাঁইবাবার ছবি থেকেই নাকি বিভূতি ঝরে পড়ছে। প্রতিটি মিথ্যে গুজবের মতোই এক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব হয়নি, ব্যাক্তিগতভাবে আমি যাদের মুখেই এইসব গুজব শুনেছি তাঁদেরই চেপে ধরেছি। আমার জেরার উত্তরে প্রায় সকলেই জানিয়েছেন যে, তাঁরা নিজের চোখে বিভূতি ঝরে পড়তে দেখেননি। যে দু-একজন প্রত্যক্ষদর্শী পেয়েছি, তাঁদের অনেকেই জাদু সম্রাট পি. সি. সরকারের গণসম্মোহনের প্রত্যক্ষদর্শীদের মতোই মিথ্যাশ্রয়ী, সেটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না।  যারা সত্যিই বাস্তবে ছবি থেকে বিভূতি পড়তে দেখেছেন, তাঁরা শতকরা হিসেবে সংখ্যায় খুবই কম। তাঁরা দেখেছেন ভক্তদের বাড়ির ছবি থেকে বিভূতি পড়তে বা ছবির তলায় বিভূতি জমা হয়ে থাকতে। এই বিভূতি বা ছাই সৃষ্টি হয়েছে দু’রকম ভাবে। (১) কোনও সাঁইবাবার ভক্ত অন্য সাঁইবাবার ভক্তদের চোখে নিজেকে বড় করে তোলার মানসিকতায় সাঁইবাবার ছবির নিচে নিজেই সুগন্ধি ছাই ছড়িয়ে রাখে। (২) সাঁইবাবার ছবির কাঁচে ল্যাক্টিক এ্যাসিড ক্রিস্টাল মাখিয়ে ঘষে দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে ল্যাক্টিক এ্যাসিড ক্রিস্টাল বাতাসের সংস্পর্শে এলে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে ছাইয়ের মতো ঝড়ে পড়তে থাকে।

ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সাঁইবাবার ওপর অনুসন্ধানের জন্য ১২ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় Saibaba Exposure Committe । বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার উপাচার্য ডঃ নরসিমাইয়া ছিলেন এই কমিটির উদ্যোক্তা। সাঁইবাবার সহযোগিতার অভাবে কমিটি শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালাতে ব্যর্থ হন।

শূন্য থেকে হীরের আংটি

মেয়েদের একটি বাংলা সাময়িক পত্রিকায় ১৯৮১ সালের জুলাই মাসের সংখ্যায় লেখা হয়েছিল সাঁইবাবা শূন্য থেকে একটি হীরের আংটি সৃষ্টি করে নাকি পণ্ডিত রবিশঙ্করকে দিয়েছিলেন। শূণ্য থেকে হীরে সৃষ্টির ঘটনা একজন যুক্তিবাদী হিসেবে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে যে কোনও জাদুকরই শূন্য থেকে হীরের আংটি এনে দিতে পারেন। আর এই ধরণের ঘটনা ঘটিয়ে দেখালেই কি ঐ জাদুকরকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ধরে নেওয়া হবে? শূন্য থেকে সৃষ্টির ক্ষমতা যদি থাকে তবে খোলামেলা পরিবেশে একটা স্কুটার কি একটা মোটর বা বিমান সৃষ্টি করে উনি দেখান না। ব্ল্যাক-আর্টের দ্বারা জাদুকররা শূন্য থেকে হাতি বা জিপ-কার সৃষ্টি করেন। জাদুকরদের এই সৃষ্টির মধ্যে থাকে কৌশল। সাধু-বাবাজীদের সৃষ্টির মধ্যে এই ধরনের কোনও কৌশল থাকলে চলবে না। কোনও বাবাজী যদি শূন্য থেকে এই ধরনের বড়-সড় মাপের কোন কিছু সত্যিই সৃষ্টি করতে পারেন, তবে নিশ্চয়ই প্রমাণিত হবে অলৌকিক বলে কিছু আছে, এবং তাবৎ বিশ্বের যুক্তিবাদীরাও আর এইসব নিয়ে কচকচানির মধ্যে না গিয়ে অলৌকিক বলে কিছুর বাস্তব অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করে নেবে।

এত কিছুর পরও কি মনে হয় সত্য সাঁই পূর্বজন্মে সির্দির সাঁই ছিলেন? মনে কি হয়- সত্য সাঁইয়ের অলৌকিক ক্ষমতাই তাঁর জাতিস্মরতার প্রমাণ? তবে বলি, সত্য সাঁই কোনও দিনই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দাবী প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা নেই, যেমন নেই কোনও অবতারেরই।

error: Content is protected !!