এ’বার আমরা ‘আত্মা’ ও ‘জাতিস্মর’ –এর অনস্তিত্ব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার খোলস ছেড়ে প্রয়োগের দিকে নজর দেব। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, ‘আত্মা’ ও ‘জাতিস্মর’ প্রসঙ্গ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পরও কোনও এক জাতিস্মর কাহিনীকে টেনে এনে প্রশ্নকর্তা এ’বিষয়ে সরাসরি আমাদের মতামত জানাতে বলেন।
জানতে চাওয়ার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সাধারণত জানতে চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের আন্তরিকতাও একান্তভাবেই খাঁটি। তাঁদের এই জানতে চাওয়া কাহিনীগুলো সাধারণভাবে মাত্র কায়েকটি কাহিনীর মধ্যেই আবর্তিত হয়।
আলোচনার এই শেষ পর্যায়ে আমরা প্রচলিত সেই সব জনপ্রিয় ও সাড়া জাগানো জাতিস্মর কাহিনী নিয়েই আলোচনা করব। এই কাহিনীগুলোকে আমরা তিনটি পর্যায়ে ভাগ করব। প্রথম পর্যায়ে থাকবে অতি বিখ্যাত, আমাদের দেশে সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনাগুলো। এ’গুলো নিয়ে আমরা বিস্তৃত আলোচনায় যাব। দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখব জনপ্রিয় কিন্তু আমাদের দেশে জনপ্রিয়তার নিরিখে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিখ্যাত কিছু কাহিনীকে। তৃতীয় পর্যায়ে আলোচনা করব অবতারদের পুনর্জন্ম নিয়ে গড়ে ওঠা রোমাঞ্চকর কিছু কাহিনী। এই পর্যায়ের অবতাররা অবশ্যই আন্তর্জাতিক পরিচিতির অধিকারী।
আসুন আমরা এ’বার প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় ঢুকি।
জাতিস্মর তদন্ত ১ : দোলনচাঁপা
দোলনের কথা
দোলনচাঁপা মিত্রের জাতিস্মর হয়ে ওঠা নিয়ে অনুসন্ধান চালাবার প্রথম অনুরোধ জানান আবৃত্তিকার পার্থ ঘোষ। কলকাতার আকাশবাণী ভবনে এক প্রযোজকের ঘরে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সম্ভবত আমার উপস্থিতির কারণেই আড্ডার আলোচনাটা এক সময় মোড় নিয়েছিল তথাকথিত নানা অলৌকিক ঘটনা নিয়ে। এরই মাঝে এক সময় এল দোলনচাঁপার কথা। পার্থ জানালেন, দোলনচাঁপা তাঁর পরিচিতা। দীর্ঘ বছর ধরেই দোলনের পরিবারকেই চেনেন পার্থ। দোলন নাকি পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে। ওর ওই জাতিস্মর-ক্ষমতা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় বেশ কিছু বছর আগে একটা খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাব-আন্দোলনের আন্তর্জাতিক প্রবক্তা লোকেশ্বরানন্দ দোলনের জাতিস্মর ক্ষমতার দাবিকে ‘যথার্থ’ বলে সমর্থন করায় বিষয়টা খুবই গুরুত্ব পেয়েছে।
পার্থ আরও জানালেন, “আপনি তো যুক্তিবাদী, সত্যানুসন্ধানী। অনুসন্ধান চালিয়ে দেখুন না, বাস্তবিকই ঘটনাটা কি ! এবং তারপর আপনার মতামত জনসাধারণকে জানান।“
দোলনের খবর আমার চোখে প্রথম পড়েছিল ১৯৮০ সাল নাগাদ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্যারাসাইকোলজিস্ট, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজি বিভাগের প্রধান আয়েন স্টিভেনসন (Ian Stevenson) এর লেখা “কেসেস অফ দ্য রিইনকারনেশন টাইপ” (Cases of The Reincarnation Type) বইয়ের প্রথম খন্ডে প্রচণ্ড গুরুত্ব পেয়েছে দোলনের কেসটি।
৮৮-র এপ্রিলের এক বিকেলে হাজির হলাম মানিক মিত্রের অফিসে। মানিকবাবু তখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের গ্রাম সেবক ট্রেনিং সেন্টারের সিনিয়র লেকচারার। ভাল নাম ঔদার্যময়, তবে মানিক নামেই বেশি পরিচিত। মানিকবাবু কাটিহারের ছেলে। চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন পাটনাতে পশু চিকিৎসালয়ের চিকিৎসক হিসেবে। ৫৮ সালে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কাজে যোগ দেন। ৬২-তে বিয়ে করেন কণিকাকে। ৬৩ সালে জন্ম হয় ছেলে জয়ন্ত’র। ৮ আগস্ট ৬৭তে দোলনের জন্ম। সন্তান বলতে এই দুটিই।
ফর্সা টুকটুকে ছোট্ট দোলন এক বছর বয়সে কথা বলা শুরু করেছিল। দু’বছরের মধ্যেই স্পষ্ট কথা বলতে শিখে ফেলল। রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমের মধ্যেই মানিকবাবুর কোয়ার্টার। হাজারো রকমের গাছ-গাছালিতে ঘেরা আশ্রমের পরিবেশের মধ্যেই বড় হয়ে উঠতে লাগল দোলন। তিন বছর বয়স থেকে দোলনের পোশাক-পরিচ্ছদের ভাললাগার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা খুঁজে পেলেন মা কণিকা। দোলন ফ্রক পড়তে চায় না। ছেলেদের মত প্যান্ট-সার্ট পরার প্রতিই ওর তীব্র আগ্রহ। সুন্দর ও দামী ফ্রকের চেয়ে দাদার বেঢপ মাপের প্যান্ট-সার্ট পরেই ওর আনন্দ।
৭১-র গরমকালের এক দুপুর। দোলনকে দাদার প্যান্ট পরে থাকতে দেখে মা একপ্রস্থ খুব বকা-ঝকা করলেন, “এ কি উদ্ভট স্বভাব ! মেয়েদের পোশাক না পরে সব সময়ই ছেলেদের পোশাক পরে?”
দুপুরে খাওয়ার পাট চুকিয়ে মা ডাকলেন, “আয় দোলন আমার পাশে শুবি আয়।“
দোলন ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দিল, “আমি তোমার পাশে শোব না। তুমি মোটেই ভাল মা নও। আমাকে খুব বকো। আগের মা আমাকে খুব ভালবাসতো।“
মেয়ের কথা শুনে হেঁসে ফেলেন কণিকাদেবী। “তোর আগের মা আবার কেউ ছিল নাকি?”
“ছিলই তো। সেই মা’কে দেখতে তোমার চেয়েও সুন্দর। কত গয়না পরতো। আমাকে কত আদর করতো। কখনো বকতো না।“
“তোর সেই মা এখন গেল কোথায়?” হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন কণিকাদেবী।
“কোথায় আবার? নিজের বাড়িতেই আছে।“
“নিজের বাড়ি মানে? তোমার আগের মা’র নিজের বাড়ি কোথায়?”
“বর্তমানে। ওখানে আমাদের মস্ত একটা লাল বাড়ি আছে।“ ছোট্ট দোলন ঘাড় দোলাল।
“ওখানে আর কে কে থাকে রে?” কণিকা জিজ্ঞেস করলেন। “বাবা থাকেন। আমার আগের জন্মের বাবা, বাবাও আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমি তো আগে ছেলে ছিলাম। আমার কত প্যান্ট-সার্ট ছিল। আমরা তো খুব বড়লোক ছিলাম।“
“ঠিক আছে, আগের জন্মে তুই ছেলে ছিলই। এ’বার তো মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, তাই মেয়েদের পশোয়াক পরতে হয়। আয় শুবি আয়।“
অভিমানী মেয়ের তাও অভিমান ভাঙ্গে না। মায়ের কাছে এসেও দোলন গজ-গজ করে। “জান, আমাদের মটোর গাড়ি ছিল। আমি মটোরে করে স্কুলে যেতাম ; কলেজে যেতাম। আমাদের বাড়ির কাছে একটা মন্দির ছিল। বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো। আমার এক বন্ধু ছিল-রঞ্জিত।“
একরত্তি ছোট্ট মেয়ের মুখে ওইসব কথা শুনে মা কেমন যেন ঘাবড়ে যান। তারপর মনকে সায় দেন, ও’সবই বাচ্চাদের কল্পনা।
প্রথম সাক্ষাৎকারে কণিকাদেবীই আমাকে এ’সব কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, “ওই দিনের পর থেকে দোলন যেন কেমন পাল্টে গেল। সব সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকত, চিন্তায় ডুবে থাকত। চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। প্রায়ই বর্ধমানের বাড়ির কথা বলত। সে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না ধরত। ওর আগের জীবনের অনেক কথাই বলত। বলত- আমার নাম ছিল বুল্টি। একবার আমার অসুখ করেছিল। মাথায় ব্যথা হতো। হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতালের বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। পায়ে ব্যথা লেগেছিল।“
“কোন হাসপাতালে ছিলই?” মায়ের প্রশ্নের উত্তরে দোলন জানিয়েছিল, “কোলকাতার হাসপাতালে।“
দোলন একটু একটু করে বুল্টির জীবনের অনেক কথাই জানিয়েছিল। ফুটবল খেলত, ক্রিকেট খেলত। বাড়ির কাছেই একটা মন্দির ছিল। বাড়িতে হরিণ ছিল, ময়ূর ছিল। নীল ডোরাকাটা একটা সার্ট ছিল। বাড়ি ছিল বর্ধমান শহরে।
দোলনের কথার মধ্যে এমন একটা প্রত্যয় ছিল, যা মানিকবাবু ও কণিকাদেবীকে চিন্তিত করে তুলেছিল। দোলন কি তবে সত্যিই জাতিস্মর? এতদিন ধর্মগ্রন্থ ও অধ্যাত্মবাদের বইয়ের পাতাতেই শুধু পড়েছেন জন্মান্তরের কথা। সেই চরম বিশ্বাসকে সত্যি বলে প্রমাণ করতে তাঁদের বাড়িতেই জাতিস্মরের জন্ম হয়েছে। ভগবানের কি অপার লীলা।
যত দিন যাচ্ছিল দোলনের মধ্যে বর্ধমানে যাওয়ার আকুতি ও যন্ত্রণা ততই তীব্রতর হচ্ছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে বাস্তব ঘটনাকে জানার আগ্রহে মানিকবাবু ঠিক করলেন, দোলনকে নিয়ে বর্ধমান যাবেন।
মানিকবাবু ও কণিকাদেবী দোলনকে নিয়ে প্রথম বর্ধমান গেলেন ৭১-এর অক্টোবরে। বর্ধমানের মহারাজার প্রাসাদের কাছে ওকে ছেড়েও দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও দোলন তার পূর্বজন্মের বাড়ি খুঁজে বের করতে পারল না। সে’দিনই দোলনকে নিয়ে ওর মা-বাবা নরেন্দ্রপুরে ফিরে এলেন।
দোলনের খুব মন খারাপ। ভালোমত খায় না, খেলে না। মাঝে মাঝে নিজের মনে কাঁদে আর কান্না-ভেজা গলায় মা-বাবাকে অনুরোধ করে- আর একটি বার বর্ধমানে নিয়ে চল। এই সময় থেকে দোলন তার মাথার পিছন দিকে একটা ব্যথা অনুভব করতে থাকে।
নীলাচল সামন্ত বর্ধমানের মানুষ। সম্পর্কে বম্বের সিনেমাওয়ালা শক্তি সামন্তের ভাই। চাকরি করেন নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে। মানিকবাবুর বন্ধু। দোলনের কথাগুলোকে পূর্বজন্মের স্মৃতি থেকে উৎসারিত কথা ভেবে তিনিও মাথা ঘামাতে শুরু করেন। তিনি মানিকবাবুকে জানালেন- বর্ধমান মহারাজার বাড়ির কাছেই একটি ধনী পরিবার থাকেন। সেই পরিবারের চারু দে তাঁর পরিচিত। সেই সুবাদে পরিবারের অনেক কিছুই তাঁর জানা। ওই পরিবারের একটি ছেলের নাম ছিউল বুল্টি। ভাল নাম নিশীথ দে। নিশীথ মাথার ব্যথায় ভুগছিল। সম্ভবত ব্রেন-টিউমার হয়েছিল। কলকাতায় এসেছিল চিকিৎসা করাতে। তারপর মারা যায়। বুল্টি মারা গেছে ১৯৬৪-তে দোলনের জন্মের তিনবছর আগে। বুল্টির বাবা অনাথশরণ দে বর্তমানে পরিবারের কর্তা। বুল্টি ছিল অনাথবাবুর বড় ছেলে। মেজ শিশির। ডাক নাম ন্যাড়া। তিন মেয়ে। নাম যথাক্রমে শ্যামলী, জ্যোৎস্না ও রীতা।
নীলাচল সামন্তর স্ত্রী স্বপ্নাও বর্ধমানের মেয়ে। নিশীথ দে’র আত্মীয় পৃথ্বীশচন্দ্র দে’র পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনেক দিনের। সেই সুবাদের স্বপ্না বুল্টি ও তার পরিবারের অনেক হেঁসেলের কথাই জানতেন। স্বপ্নাও দোলনের ‘আবোল-তাবোল’ কথার মধ্যেই খুঁজে পেলেন এক ধর্মীয় সত্যকে- এক জাতিস্মর দোলনকে। স্বপ্নদেবী ও নীলাচলবাবুর কথায় মানিকবাবু ও কণিকাদেবী যেন খুঁজে পেলেন দোলনের হেঁয়ালির কিছুটা হদিস।
স্বামী লোকেশ্বরানন্দ তাঁর স্নেহভাজন স্বপ্নাদেবী ও নীলাচলবাবুর পরামর্শে মানিকবাবু, তাঁর স্ত্রী ও কন্যা দোলনকে নিয়ে আবার বর্ধমান গেলেন। সময়টা ৭২ সালের ৩০ মার্চ। বর্ধমানে ওঁরা উঠলেন স্বপ্না সামন্তর বোন প্রতিমা দাঁ’ড় বাড়িতে।
বর্ধমানে এসে দোলনের আনন্দ আর ধরে না। সেদিনই বিকেলে দোলনকে নিয়ে বেরুলেন কণিকাদেবী, প্রতিমা দাঁ ও পৃথ্বীশ দে’র স্ত্রী মীরা দে। ওঁরা দোলনকে নিয়ে হাজির হলেন বুল্টিদের বাড়ির কাছের অন্নপূর্ণার মন্দিরে। তারপর সেখান থেকে বুল্টিদের বাড়ির দিকে। লাল রঙ্গের বিশাল প্রাসাদ। দোলনকে ওঁরা জিজ্ঞেস করলেন- এটা তোমার বাড়ি?
ছোট্ট দোলন, খুশিতে ডগমগ করতে করতে জানাল, হ্যাঁ, এটাই ওদের বাড়ি ছিল।
সদর দরজায় ‘নক’ করতে দরজা খুলে দিয়েছিলেন অনাথবাবুর ছোট মেয়ে রীতা। অতিথিদের আগমনের অদ্ভুত কারণে হতবাক রীতা। ভিতরে নিয়ে এলেন ওঁদের। অনাথবাবু বাড়ি ছিলেন না। গিয়েছিলেন কলকাতায়। পুরুষ সদস্য হিসেবে সে সময় বাড়িতে ছিলেন শুধু অনাথবাবুর ছোট ছেলে শিশির। দোলনের কাহিনী শুনে বাড়ির সকলেই অতিমাত্রায় কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। সত্যিই কি বুল্টি দোলন হয়ে এ’বাড়িতে এসেছে? উপস্থিত অনেকেই দোলনকে জেরা করে নিজেদের কৌতূহল মেটাতে চান। উপস্থিত মহিলাদের একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বল তো আমি কে?” দোলন লক্ষ্মীদেবীর দিকে একটু সময় তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি ও’বাড়ির ছোট কাকীমা।“ রীতা দোলনকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার আগের জন্মের মা কে বল তো?” দোলন একজন ফর্সা মোটাসোটা মহিলার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “এই তো আমার মা।“
দোলন বুল্টির মা’কেই নিজের মা বলে চিহ্নিত করেছিল। এমন একটা অদ্ভুত, অকল্পনীয় ব্যাপার চোখের সামনে ঘটতে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বুল্টির মা। দু’চোখে তার বিস্ময়ের ঘোর। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। কোনও একটা মানসিক দ্বন্দ্বে পীড়িত হচ্ছিলেন। দোলন আদরের প্রত্যাশায় বুল্টির মায়ের গাঁ ঘেঁসে এসে দাঁড়াল।
কণিকাদেবী দোলনের মনোভাব বুঝে বললেন, “ওকে একটু কোলে নিন। ও আপনার আদর পেতে চায়।“
বুল্টির মা হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলেন। দোলনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনার মেয়েকে আপনি নিন। আমার কোনও দরকার নেই।“
অভিমানী দোলন দুঃখ পেয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করেছে, “মা আমাকে আদর করেনি ; আমাকে বকেছে।“
এরপরও দোলন বুল্টির জীবনের সঙ্গে জড়িত অনেক কিছুই বলতে পেরেছে, অনেক কিছুই চিনতে পেরেছে। একটা গ্রুপ ফটো থেকে বুল্টির বাবা অনাদি দে’কে চিনিয়ে দিয়েছিল। শিশিরের ছবি দেখে চিনতে পেরেছিল। দেখিয়ে দিয়েছিল বুল্টির শোবার ঘর, পড়ার ঘর, আলমারির চাবি। আলমারিতে একটা ডোরা-কাটা নীল সার্টও পাওয়া গিয়েছিল।
এ’সব যা লিখলাম, সবই শুনেছি দোলন ও তার মা-বাবার কাছ থেকে।
বুল্টির পরিবারের তরফ থেকে দোলনকে আগের জন্মের বুল্টি বলে মেনে না নেওয়ায় দোলন হতাশ হয়েছিল। নরেন্দ্রপুরে ফিরে এসে আগের জীবনের কথা আর খুব একটা বলত না। এরই কিছু পরে স্বামী লোকেশ্বরানন্দের ইচ্ছেয় এবং যোগাযোগ দোলনের জাতিস্মর হয়ে ওঠা নিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৭২-এর ৭ মে। মানিকবাবুর কথায়- স্বামীজী চেয়েছিলেন খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পর এই নিয়ে গবেষণার কাজে কোনও বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠান যদি এগিয়ে আসে, তবে তার মধ্য দিয়ে সত্য বেরিয়ে আসবে, প্রতিষ্ঠিত হবে বেদ, উপনিষদ, গীতার কথা- আত্মা জন্মহীন, নিত্য।
এগিয়ে এসেছিলেন একাধিক প্যারাসাইকোলজিস্ট
দোলনের খবরটা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানিকবাবু কয়েকজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন বলে মানিকবাবু জানান। তাঁরা দোলনের জন্মসময় জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৭২-এর জুলাইতে প্রণব পাল এগিয়ে এলেন দোলনকে নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে। তিনি পেশায় অধ্যাপক হলেও নেশায় প্যারাসাইকোলজিস্ট। প্রণববাবু প্রাথমিক অনুসন্ধান চালিয়ে ঘটনাটি জানান ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্যারাসাইকোলজিস্ট আয়েন স্টিভেনসনকে।
অক্টোবরে স্টিভেনসন উড়ে এলেন। অধ্যাপক পালের সঙ্গে নরেন্দ্রপুরে যান, যান বর্ধমানে। নভেম্বরে দেশে ফিরে যান।
আবার ফিরে আসেন ৭৩-এর মার্চে। আবার এক দফা অনুসন্ধান। ১৯৭৫-এ Ian Stevenson এর ‘Cases of The Reincarnation Type, Volume I’ –এ প্রকাশিত হয় দোলনচাঁপার কাহিনী। সেখানে স্টিভেনসন লিখেছেন, “Dolan made all except a few of the Statements about the previous life…” অর্থাৎ, দোলন আগের জীবনের কয়েকটি ছাড়া সব তথ্যই মিলিয়ে দিয়েছিল।
কি কি তথ্য দোলন স্টিভেনসনের সামনে হাজির করেছিল, কি কি মেলাতে পারেনি- তার একটা লিস্ট তিনি লেখাটিতে তুলে ধরেছেন। দোলনের ব্যর্থতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অবশ্যই বিস্ময়কর দিক হল- ও না- বলতে পেরেছিল নিজের পূর্বজন্মের নাম, না বলতে পেরেছিল আগের জন্মের পরিবারের সদস্যদের নাম। স্টিভেনসনের ভাষায়, “…she never mentioned his name or that of any other member of his family”.
দোলনের দেওয়া বহু তথ্যই যে মিলে গেছে বলে স্টিভেনসন দাবি করেছেন, সে সব তথ্যের অনেকগুলোই অতি হাস্যকর। যেমন, “She had a house in Burdwan”. “She had a father in Burdwan”. অর্থাৎ ওর বর্ধমানে বাড়ি ছিল। বর্ধমানে ওর বাবা ছিল। এমনি আরও আগে। যেমন- ওর মা ছিল। ওর কাকা কাকী ছিল ইত্যাদি। দোলন ছেলেদের পোশাক পরত, ছেলেদের খেলা খেলত- এ’কথা উল্লেখ করার পর স্টিভেনসন স্বীকার করেছেন, “It happened that in The Ramakrishna Mission Ashrama, where her family lived, the close neighbours had mostly boys”. অর্থাৎ গোদা বাংলায়- দোলনের পরিবার যে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে থাকত, সেখানে ওর পড়শি ও সঙ্গীদের বেশিরভাগই ছিল ছেলে।
ওই আশ্রমটি যেহেতু ছেলেদের আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্র, তাই দোলন আশ্রমের ঘেরা কমপাউন্ডে খেলার সঙ্গী-সাথী যাদের পেয়েছে, যাদের দেখেছে, যাদের সঙ্গে মিশেছে তাদের বেশির ভাগই ছেলে। ফলে ও ছেলেদের পোশাক ও ছেলেদের খেলাধুলার দিকে আকর্ষণ অনুভব করতেই পারে। সাংস্কৃতিক পরিবেশগত এই প্রভাবের ফলকে জাতিস্মর হওয়ার প্রমাণ হিসেবে ধরে নিলে তা হবে এক বিশাল ভুল।
ভারতের নামী প্যারাসাইকোলজিস্ট অর্থাৎ ভূত-প্রেত-অলৌকিক-জাতিস্মর ইত্যাদির গবেষক ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৫-এর জানুয়ারীতে নামলেন দোলনের জাতিস্মর হয়ে ওঠা নিয়ে অনুসন্ধানের কাজে। কথাটা একটু ভুল লিখে ফেললাম। ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় নামলেন দোলনকে জাতিস্মর বলে প্রমাণ করতে। ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় দোলনকে জাতিস্মর প্রমাণ করতে যে সব যুক্তিকে গুরুত্বের সঙ্গে হাজির করেছেন, সেগুলো হলঃ
(১) “আমি এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আমরা দুজনেই অনুসন্ধান করে দেখেছি মিত্র পরিবারের সঙ্গে দে পরিবারের কোন যোগাযোগ আগে ছিল না এবং দোলনের পক্ষে অন্য সূত্র থেকেও দে পরিবারের বা নিশীথ (বুল্টি) সম্পর্কে কোন কিছু জানার সুযোগ ছিল না।“
(২) “দোলনই পূর্বজন্মে নিশীথ না হলে এই পড়ে যাবার ঘটনাটি (হাসপাতালের বেড় থেকে) জানতে পারার আর কোন উপায় তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।“
(৩) “দোলনের আর একটি কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দোলন আগেই বলেছিল যে সে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিল এবং ঐ হাসপাতালেই খাট থেকে পড়ে যাবার কিছুদিন বাদেই সে মারা যায়। হাসপাতালে থাকার সময় তার মাথায় খুবই যন্ত্রণা হত।“
দোলন হাসপাতালে ছিল, সেখানে থাকাকালীন বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিল, এই দুটি তথ্যকে জাতিস্মরতার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রতিষ্ঠিত করতেই হয়- এ’জাতীয় কোনও তথ্যই দোলনের পক্ষে জানা কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন এক নম্বর যুক্তিটি, তিনি ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান করে দেখেছেন বুল্টির পারিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন কারও সঙ্গে দোলনের পরিবারের যোগাযোগ ছিল না। এই অনুসন্ধান যে আগাপাশতলাইয়া ভুল অথবা ভুল পথে জনচিত্তকে চালিত করার অপচেষ্টা তারই প্রমাণস্বরূপ দুই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এমন বহু পারিবারের নাম হাজির করেছিলাম ‘আলোকপাত’ মাসিক পত্রিকার জুলাই ১৯৮৮ সংখ্যায়। সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করেছিলাম বুল্টির বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জানার সুযোগ দোলনের ছিল। এ’বিষয়ে পরে বিস্তৃত আলোচনার যাব।
১৯৭৫ সালে মানিভবাবু কণিকাদেবী ও দোলনকে নিয়ে ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান গিয়েছিলেন। মানিবাবুর কথামত বুল্টিদের পরিবারের কাছ থেকে অনুসন্ধান চালাতে কোনও সহযোগিতা পাননি ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ এই অনুসন্ধান ছিল একতরফা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এক অসম্পূর্ণ অনুসন্ধান।
বুল্টি বা নিশীথ দে’র জীবনী
নিশীথ দে অনাথশরণ দে’র বড় ছেলে। জন্ম ১৯৪০ সালে। নিশীথ পড়ত বর্ধমানের রাজ স্কুলে ও রাজ কলেজে। মৃত্যুর সময় ও ছিল বি. কম. –এর ছাত্র। খেলাধুলায় যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল ও ক্রিকেট। একটি মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
বুল্টিদের পরিবার ছিল শহরে অতি ধনী পরিবারের অন্যতম। বুল্টির পরিবার ধনাঢ্য পরিবার ছাড়া মিশত না। এমন কি ধনবান নয়, এমন আত্মীয়ের সঙ্গেও ওরা দূরত্ব বজায় রেখে চলত। বুল্টির স্বভাব এ বিষয়ে ছিল ভিন্ন রকমের। ও ধনী ও গরিব সব বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গেই মিশতে পছন্দ করত।
১৯৬৪-তে যখন বুল্টির বয়স ২৪ বছর, সে সময় বুল্টি ও তার মাথার পিছন দিকে একটা ব্যথা অনুভব করতে থাকে। ব্যথার সঙ্গে মাঝে মাঝে বমি হত। স্থানীয় ডাক্তার ছ-আট মাস চিকিৎসা করেন। তারপর বুল্টিকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এ। সেখানে অনুমান করা হয় বুল্টির ব্রেন টিউমার হয়েছে। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার আগেই বুল্টির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পরের দিন ‘কোমা’য় থেকে ২৫ জুলাই ৬৪ বুল্টি মারা যায়। বুল্টির দেহ পোড়ানো হয় কলকাতার নিমতলা শ্মশান ঘাটে।
দোলন এখন
বর্ধমানের দে পরিবারের কাছ থেকে শীতল ব্যবহার পেয়ে শিশুমনে যে আঘাত পেয়েছিল তার ক্ষত একুশটি বসন্ত পার হয়ে আসা দোলন যে ভুলতে পারেনি, সে কথা ৮৮-তে নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে আমার মুখোমুখি বসে দোলন জানিয়ে ছিল। আরও জানিয়েছিল- আন্তরিকভাবেই ও দুঃখজনক স্মৃতিগুলো ভুলতে চায়। আর অনেকটা ভুলে থাকার তাগিদেই গানের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।
ছেলেদের পোশাকের প্রতি যে আকর্ষণ ছিল, বর্ধমান থেকে ফিরে আসার কয়েক বছরের মধ্যে সে আকর্ষণ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে। জানি না, এই বিচ্ছিন্ন করার পিছনে কতখানি ছিল ব্যথা, কতখানি মনের জোর।
৮৬-র একদিন বুল্টির খুড়তুতো ভাই ছোট কাকীমা লক্ষ্মী দে ও খুড়তুতো ছোটকাকা প্রণবকুমার দে এলেন মানিক মিত্রের কর্মস্থলে। দু’জনের পরিচয় পেয়ে মানুকবাবু খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। বললেন, “আপনারা এত বছর পর। এখানে কি মনে করে?”
লক্ষ্মীদেবী বললেন, “আপনারা চলে আসার পর থেকেই আপনাদের খোঁজ করে চলেছি। আমার বোনের বিয়ে হয়েছে নরেন্দ্রপুরেই। ওর কাছ থেকে আপনার খোঁজ পেয়ে আসা। কোনও কূট-তর্ক করতে আসিনি। আমরা এসেছি বুল্টিকে অর্থাৎ দোলনকে একবার চোখের দেখা দেখব বলে।“
মানিকবাবু ওদের কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। লক্ষ্মীদেবী দোলনকে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমাকে চিনতে পারছ?”
“হ্যাঁ, তুমি ছোট কাকীমা।“ বলেছিল দোলন।
প্রণব জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমি কে বল তো?”
“তুমি ছোট কাকা।“
লক্ষ্মীদেবী ও প্রণববাবুর গুরুভাই বম্বের অভিনেতা অভি ভট্টাচার্য। অভি ভট্টাচার্য লক্ষ্মীদেবীর কাছে দোলনের কাহিনী শোনার পর থেকে প্রায়ই জোর তাগাদা দিতেন- যেমন করেই হোক দোলনের ঠিকানা খুঁজে বের কর।
৮৮-র জুনের এক দুপুরে লক্ষ্মীদেবী ও প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁদের গোয়াবাগানের বাড়িতে বসে কথা বলতে এ’সব জেনেছি। আরও জেনেছি বুল্টির পরিবারের সঙ্গে প্রণববাবুর পরিবারের সম্পর্ক আদৌ মধুর নয়, বরং কিছুটা তিক্ত। তবে বুল্টিকে ওঁরা দু’জনেই ভালোবাসতেন। লক্ষ্মীদেবী ও প্রণববাবুর অকৃত্রিম ভালোবাসায় দোলন তার দমিত দুঃখের অনেকটাই ভুলতে পেরেছিল।
দোলন ৮৭-র দক্ষিণ ২৪ পরগনার হরিনাভি স্কুল থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করার পর দোলনের মা ঠিক করলেন, এ’বার ওর বইয়ে দিয়ে দেবেন। মনের মত একটি পাত্রও পেয়ে গেলেন। এই সময় লক্ষ্মীদেবী দোলনকে নিয়ে যান তাঁর গুরুদেব ‘দাদাজী’র কাছে। দাদাজীর স্ত্রী দোলনের বিয়ের কথা শুনে বলেন, “এইটুকু মেয়ের এখনি বিয়ে দেবে কি? ও গান ভালবাসে, ওকে বরং শান্তিনিকেতনে গান শেখাতে ভর্তি করে দাও। দেখবে ওর ভাল বিয়েই হবে।“ দাদাজীও একই মত প্রকাশ করেন। তারই ফলস্বরূপ বিয়ের সম্বন্ধ শিকেয় তুলে দোলনকে ভর্তি করা হল শান্তিনিকেতনে। বিষয় নিল- সঙ্গীত।
এ’সব তথ্য জেনেছি দোলন, মানিকবাবু, কণিকাদেবী, লক্ষ্মী দে এবং প্রণব দে’র কাছ থেকে।
১৯৯০-এর জানুয়ারিতে দোলনের জীবনে আসেন সুব্রত রাহা। সুব্রত তখন শান্তিনিকেতনেই পড়তেন। বিষয়ঃ ব্যাচিলার অফ সোসাল ওয়েলফেয়ার। ফেব্রুয়ারীতেই দোলন বিয়ে করতে চাইলেন সুব্রত’কে। সুব্রতার কথা মত- এমন বেকার অবস্থায় বিয়ে করায় তার প্র্যাক্টিক্যাল অসুবিধে ছিল। তবু এরপরও এপ্রিলেই বক্রেশ্বর মন্দিরে গিয়ে দু’জন বিয়ে করেন। কারণ হিসেবে সুব্রত জানিয়েছেন, “দোলন আমাকে হুমকি দেয় তাকে immediately বিয়ে না করলে সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে এবং অস্বাভাবিক সব ব্যবহার করতে থাকে, যেমন কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বমি করা, দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়া, হঠাৎ কাউকে না চিনতে পারা, সারা শরীর কাঁপা ইত্যাদি। এসব দেখে আমিও একটু ভয় পেয়ে যাই এবং মনে মনে ভাবি একে বিয়ে করলে বোধ হয় সে সত্যিকারের আত্মহত্যা করবে বা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে।“ ২৬ এপ্রিল ৯০ দু’জনের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়।
বইয়ের পর সুব্রত রাহা আমাকে এক দীর্ঘ পত্র লিখে আমার প্রতি তাঁর উষ্মা প্রকাশ করেন। কারণ সে সময় দোলনের জাতিস্মরতা প্রসঙ্গে যা লিখেছিলাম তার মোদ্দা কথা- দোলন হয় মানসিক রোগী, নয় প্রতারক।
১৯৯৪-এ সুব্রত রাহা মানবতাবাদী সমিতির সম্পাদককে একটি চিঠি লিখে দোলন থেকে উদ্ভূত সমস্যা থেকে রেহাই পেতে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তাতে এ কথাও চিঠিতে লেখা রয়েছে, “শ্রীযুক্ত প্রবীর ঘোষ তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতেন, দোলনকে মানসিক রোগী বলে দাবী করতেন তখন আমার ওনার ওপর একটু রাগ হতো, তবে আজ আমি বুঝতে পারছি উনি। ০০% সঠিক।“
সুব্রতর কেন এমন মনে হল? সে প্রসঙ্গে চিঠিটিতে সুব্রত লিখছেন “দোলনের মিথ্যা কথা বলার অস্বাভাবিক প্রবণতা আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়ে দিয়েছে এবং তার মিথ্যে কথাগুলো অত্যন্ত নীচু মনের পরিচায়ক। কিন্তু যে মুহূর্তে দোলন ধরা পড়ে যেত যে সে মিথ্যে বলছে বা বলেছে, সাথে সাথে হয় দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে যেত” … “আজ পরিচয় হলে আগামী কালই তাকে মনে রাখতে পারত না। তার এই শরীর কাঁপুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আমার কাছে খুবই অস্বাভাবিক লাগত কারণ কোনোদিন সে এর জন্য ওষুধ খেতে রাজি হতো না” … “বেশ কয়েকবার তাকে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাব বলি, এবং এটা শুনলেই সে প্রচণ্ডভাবে চিৎকার করে উঠত এবং জিনিষপত্তর ছুঁড়তে শুরু করত” … “আমাকে উঠতে বসতে প্রায়ই বলত যে ও হয় আত্মহত্যা করবে বা পালিয়ে যাবে যদি আমি ওর কথায় না উঠি বা বসি, সাথে ভয় দেখাত যে সুইসাইডও নোটে আমাকে ও আমার মা-ভাইকে ফাঁসিয়ে দেবে।“
সুব্রত রাহা এখন জলপাইগুড়ি জেলার বেইন্টগুড়ি টি এস্টেটে ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। দোলন ও সুব্রতর একটি কন্যা হয়েছে। কন্যার আগমণও পারেনি দু’জনের মনের ভাঙ্গনকে জোড়া লাগাতে। ৯৪-এর সেপ্টেম্বরে দু’জনে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা এনেছেন কোর্টে।
দাদাজী ও তাঁর পত্নীর ভবিষ্যৎবাণী “দেখবে ওর ভালই বিয়ে হবে” মিথ্যে হয়ে গেছে। মিথ্যে হয়ে গেহে দাদাজীর অলৌকিক ক্ষমতার দাবি। ওঁরা সে সময় যদি দোলনকে মানসিক চিকিৎসা করাতে বলতেন, তাহলে এমনভাবে দু’টি জীবন ও দুটি পরিবারের শান্তি এভাবে নষ্ট হতো না।
আমি অনুসন্ধানে যা পেয়েছি
সেই প্রকৃত যুক্তিবাদী, যে খোলা মনের। এই খোলা মন নিয়েই দোলনের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছিলাম। উদ্দেশ্য- সত্য প্রকাশিত হোক। এই বিষয়ে যাদেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাদের কয়েকজনকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, “আপনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তথ্য গোপন না করে বা বিকৃত না করে আপনার মতামত লিখব।“ সঙ্গে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, “সত্যানুসন্ধানের নামে পাঠক-পাঠিকাদের রোমাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যে গল্প ফাঁদটাকে আমি ঘৃণ্য অপরাধ বলেই মনে করি।“ তবু একাধিক ক্ষেত্রে যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তাঁরা আমাদের কথপোকথন টেপবন্দী করে রেখেছেন। উদ্দেশ্যঃ সত্য যাতে বিকৃত না করতে পারি।
প্যারাসাইকোলজিস্ট অধ্যাপক প্রণব পাল, আয়েন স্টিভেনসন এবং ডঃ হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমানের দে পরিবার, অর্থাৎ বুল্টিদের পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে সহযোগিতা পাননি বলে লেখায় পড়েছি এবং শুনেছি। আমার অনুসন্ধানপর্বে কিন্তু দে পরিবার পরিপূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন।
দোলন যা বলেছে | এই বিষয়ে যাদের সাক্ষ্য নিয়েছি | আমার মন্তব্য |
১। দোলন বুল্টির বর্ধমানের বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল। | মানিক মিত্র, কণিকা মিত্র, দোলন। | বুল্টিদের প্রাসাদতুল্য বাড়ির কাছে দোলনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাছাকাছি ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় বাড়ি। |
২। বুল্টির জীবিতকালে ওদের বাড়ির রং ছিল টুকটুকে লাল। | মানিক মিত্র, কণিকা মিত্র, দোলন, অনাথশরণ দে, শিশির দে, প্রণব দে, লক্ষ্মী দে। | ভুল। দে পরিবারের বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য এবং স্থানীয় মানুষদের সাক্ষ্যে জানতে পারি বাড়ির রং চিরকালই হালকা গেরুয়া। |
৩। দোলন গ্রুপ ছবি দেখে বুল্টির বাবাকে চিনিয়ে দিয়েছিল। | কণিকা মিত্র, দোলন, অনাথশরণ দে, শিশির, লক্ষ্মী। | লক্ষ্মী দে বলেন, ওঁর ঠিক স্মরণ নেই, অনাথশরণ ও শিশির জানান, দোলন বুল্টির বাবা বলে যার ছবি দেখিয়েছিল, সেটা ছিল বুল্টির কাকা অনিলকুমার দে’র ছবি। |
৪। দোলন বুল্টির ভাই শিশিরকে চিনিয়ে দিয়েছিলদবিতীয় বর্ধমান যাত্রায় ছবিতে এবং ৭৫-র তৃতীয় যাত্রায় বাস্তবে শিশিরকে চিহ্নিত করেছিল। | দোলন, কণিকা, শিশির, অনাথশরণ। | অনাথশরণ এবং শিশির জানান, গ্রুপ ছবি থেকে শিশিরকে চিহ্নিত করার কাহিনী পুরোপুরি মিথ্যে। ৭৫-এর তৃতীয় যাত্রায় শিশির যে বুল্টির ভাই, এটা আদৌ গোপন ছিল না। তাই নতুন করে চিনিয়ে দেবার প্রশ্নও ছিল না। |
৫। দোলন বুল্টির ছোটবোন রীতাকে চিনতে পেরেছিল। | কণিকা, শিশির, অনাথশরণ, লক্ষ্মী। | কণিকা ও লক্ষ্মীর কথায় দোলনের বক্তব্যের সমর্থন মেলে। অনাথশরণ ও শিশির জানান, রীতা তখন ঘরেই ছিল না। অতএব রীতাকে দেখা ও চিনে ফেলার প্রশ্নই ওঠে না। |
৬। দোলন লক্ষ্মীকে ‘ও বাড়ির ছোট কাকীমা’ বলে জানিয়েছিল। | লক্ষ্মী। দোলন, শিশির, অনাথশরণ, প্রণবকুমার দে। | লক্ষ্মীদেবী বলেছেন, দোলন ও কথা বলেছিল। শিশির বলেন, “প্রকাশ্যে আর কারও সামনে দোলন ও কথা বলেনি সুতরাং লক্ষ্মী কাকীমার কথা সত্যি, কি মিথ্যে, বলতে পারব না।” “লক্ষ্মীদেবী ও শিশির স্বীকার করেন তাদের দুই পরিবারের সম্পর্ক বেশ কিছু বছর ধরে খুবই খারাপ। ১৯৭৫ সালে গোয়াবাগানের বাড়ির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে পার্টিশন স্যুট করেন প্রণব দে, ১৯৮১ তে বাড়ির দখল নিয়ে আরও একটি কেস শুরু হয়েছে বলে জানান লক্ষ্মী ও প্রণব। অনাথশরণ ও নিশীথ জানান- তাঁদের অপ্রস্তুত করার জন্য লক্ষ্মী দেবী এই বিষয়ে মিথ্যে কথা বললে তাঁরা অবাক হবেন না। |
৭। দোলন বুল্টির শোবার ঘর দেখিয়েছিল। | দোলন, কণিকাদেবী, অনীল দে, লক্ষ্মী দে, শিশির দে। | অনাথশরণ ও শিশির জানান, বুল্টির নির্দিষ্ট কোন শোবার ঘর ছিল না। বেশ কয়েকটা ঘরেই ও শুতো। যে ঘরটা দোলন দেখিয়েছিল, সে ঘরেও বুল্টি শুতো। |
৮। দোলন বুল্টির পড়ার ঘর চিনিয়ে দিয়েছিল | দোলন, কণিকাদেবী, অনিল দে, লক্ষ্মী দে, শিশির দে। | দোলন একটা পড়ার ঘরে ঢুকেছিল। সেখানে চেয়ার, টেবিলে বই-পত্র ছিল। দোলন একটু দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘এখানে আমি পড়তাম। অনাথ দে’র ভাই অনিল দে এবং শিশির এ কথা জানান। বুল্টি সত্যিই ও ঘরে পড়ত। পড়ার ঘরের পরিবেশ দেখে ‘এ ঘরে পড়তাম’ বলার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। |
৯। দোলন বুল্টির পোশাকের আলমারি চিনিয়ে দিয়েছিল। | দোলন, কণিকা মিত্র, লক্ষ্মী দে, শিশির দে, অনাথ দে। | শিশির দে এবং অনাথ দে জানান, ‘তেমন করে নির্দিষ্ট ভাবে কোনও বিশেষ আলমারি দোলন দেখিয়ে দেয়নি।। একটা আলমারি দোলন খুলেছিল। সেটা বুল্টির নিজস্ব আলমারি নয়।’ আরও অনেকেরই পোশাক ওতে থাকত। আর একটা কথা। বুল্টির পোশাক শুধুমাত্র ঐ আলমারিতে থাকত না। আরও অনেক আল্মারিতেই থাকত। দোলনও বলেছে, ওই আলমারিতে আরও অনেকের জামা-কাপড় ছিল। |
১০। দোলন ঐ আলমারির চাবি চিনিয়ে দিয়েছিল। | দোলন, কণিকা মিত্র, লক্ষ্মী দে, নিশীথ দে। | কণিকা মিত্র ও লক্ষ্মী দে দোলনের কথা সমর্থন করলেও শিশির দে জানালেন, ‘আলমারির চাবি চেনাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ চাবিই দোলনকে দেওয়া হয়নি।’ |
১১। আলমারিতে নীল ডোরা-কাটা সার্ট ছিল। | শিশির দে। | ছিল। ‘কিন্তু সেটা আমার সার্ট’ এই কথা জানিয়েছেন শিশির। |
১২। বাড়িতে হরিণ ও ময়ূর ছিল। | অনাথ দে, শিশির দে, অনিল দে। | আংশিক সত্য। তিনজনেই জানালেন হরিণ কোন দিনই ছিল না। ময়ূর ছিল। |
১৩। বাড়িটা দোতলা। | অনাথ দে, শিশির দে, অনিল দে, প্রণব দে, লক্ষ্মী দে। | বাড়িটা তিনতলা বুল্টির আমলেই। |
১৪। স্কুল ছিল বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে মোটরে স্কুলে যেতাম। | অনাথ দে, শিশির দে, অনিল দে, লক্ষ্মী দে। | বুল্টি রাজ স্কুলে পড়ত। সেটা বাড়ির খুব কাছে। স্কুলে প্রথম দিকে হেঁটে এবং পরে সাইকেলে যেত। |
১৫। কলেজে মোটরে যেতাম। | অনাথ দে, শিশির দে, অনিল দে, প্রণব দে, লক্ষ্মী দে। | বুল্টি রাজ কলেজে পড়ত। সাইকেলে কলেজে যেত। |
১৬। ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতাম। | অনাথ দে, শিশির দে। | ফুটবল, ক্রিকেট জনপ্রিয় খেলা। তাই সকলেই খেলে। বুল্টিও খেলত। শিশির জানালেন, ‘আমিও খেলতাম, প্রতিটি পাড়ার আর দশটা সাধারণ ছেলেও খেলে।’ |
১৭। ছোট্ট বয়স থেকেই ছেলেদের পোশাকের প্রতি আকর্ষণ ছিল। | দোলন, মানিক দে, কণিকা দে। | ছেলেদের মিশনের কোয়ার্টারে থেকে দোলন সঙ্গী হিসেবে প্রধাণত ছেলেদেরই পেয়েছে। তাদের খেলাধুলায় অংশ নিয়েছে। এই পরিবেশে ছেলেদের পোশাকের প্রতি মেয়েদের পোশাকের চেয়ে বেশি আকর্ষণ অস্বাভাবিক নয়। আমি এই প্রতিবেদক স্বয়ং চার বোনের মধ্যে মানুষ হচ্ছিলাম বলে ছেলেবেলায় একবার পুজোর পোশাক হিসেবে ফ্রকের বায়না ধরেছিলাম। |
১৮। বাড়ি বর্ধমানে, ধনী পরিবারে জন্ম, কাছে মন্দির, পদবী দে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাই। ও মারা যাই। | দোলন, মানিক মিত্র, কণিকা মিত্র, অনাথ দে, লক্ষ্মী দে, প্রণব দে। | প্রতি সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং বাস্তব পর্যবেক্ষণ বলছে এগুলো সত্যি। মানিক মিত্র এবং কণিকাদেবী বলেছেন তাঁরা কেউই কোনও দিনই বর্ধমানে যাননি। দোলনের প্রথম বর্ধমান যাত্রাই ওঁর মা-বাবারও প্রথম যাত্রা। অনাথবাবুর পরিবারের সঙ্গে কোনও রকম পরিচয় ছিল না বলে মিত্র পরিবারও জানিয়েছেন। অতএব মা বাবার কাছ থেকে বুল্টির কথা দোলন শুনেছিল এবং অবচেতন মনে তা ছিল, একনাগাড়ে বুল্টির কথা ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্ক-কোষের কার্যকলাপের বিশৃঙ্খলার দরুন দোলন নিজের সত্তার মধ্যে বুল্টির সত্তাকে অনুভব করেছিল, এই মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব এক্ষেত্রে খাটে না বলে মানিক মিত্রের বিশ্বাস। বুল্টি ও তার পরিবারের গল্প দোলনের শোনার সম্ভাবনা ছিল কি না এটা জাতিস্মরের এই ঘটনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দোলনের পরিবারের ঘনিষ্ঠ মানুষজনের অনেকেই বর্ধমানের মানুষ এবং অনাথবাবুদের পরিবারের পরিচিত। উদাহরণঃ ১. নীলাচল সামন্ত মানিক মিত্রের বন্ধু। বুল্টিদের পরিবারকে চিনতেন। বুল্টির ঠাকুরদা চারুবাবুর সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল। ২. স্বপ্না সামন্ত, নীলাচল সামন্তের স্ত্রী। বুল্টিদের পরিবারের অনেক কিছুই জানতেন। ধনী পরিবারের বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। স্বপ্না দেবীর বোন প্রতিমা দাঁ বুল্টিদের আত্মীয় পৃথ্বীশ দে এবং তাঁর মা মীরা দে’র পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ৩. কানাইলালা ব্যানার্জি। মানিকবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বাড়িতে আসতেন। তিনি বর্ধমানের মানুষ। দে পরিবারের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-পরিচয় না থাকলেও দে পরিবারের বিষয়ে অনেক কিছুই জানতেন। ৪. শশাংক ঘোষ। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক। মানিকবাবুর বন্ধু। বাড়িতে আসতেন। দে পরিবারের বিষয়ে জানতেন। ৫. রাজেন্দ্র চক্রবর্তী। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দে পরিবারকে জানতেন। মানিকবাবুর বন্ধু হিসেবে মাঝে মধ্যে নরেন্দ্রপুরে বসবাস শুরু করেছিলেন। সেই সঙ্গে শুরু করেছিলেন হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস। মানিকবাবুর পরিবারের সঙ্গে হেমাঙ্গবাবুর পরিবারের সখ্যতা ছিল। হেমাঙ্গবাবু অনাথশরণ দে’র পরিচিত ও বন্ধু ছিলেন। হেমাঙ্গবাবুর ছেলেও ছিলেন নিশীথের বন্ধু। এদের কেউ কোনও দিন অনাথবাবু ও বুল্টির গল্প মানিকবাবুদের বাড়িতে বসে করেননি অথবা হেমাঙ্গবাবুর ছেলের কাছ থেকে বুল্টির গল্প কখনো শোনেননি এমন নিশ্চিত বিশ্বাস করার মত কোনও তথ্য আমার হাতে নেই। |
১৯। দোলন তার মাথায় ব্যথা অনুভব করত। | দোলন, মানিক মিত্র, কণিকা মিত্র। | কিছু কিছু মানুষ মস্তিষ্কের বিশেষ গঠন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এরা আবেগপ্রবণ, মস্তিষ্ক-কোষের সহনশীলতা কম। বিশেষ সংবেদনশীলতার জন্য বহু সময় এরা নিজেদের অজান্তে স্বনির্দেশ পাঠিয়ে ‘সমব্যথী চিহ্ন’ বা অন্যের ব্যথা নিজের শরীরে সৃষ্টি করেন, অনুভব করেন। এই ধরনের বহু ঘটনাই মানসিক চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে। দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘সমব্যথী’ চিহ্ন বিষয়ে বিস্তৃত জানতে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ১ম খন্ড পড়ুন। |
২০। বর্তমানে দোলনের মাথায় কোনও ব্যথা নেই। বুল্টিকে নিয়ে চিন্তা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথাও কমছিল। | দোলন | মনোবিজ্ঞানে এই ধরনের দৃষ্টান্ত মোটেই বিরল নয়। আবেগ-প্রবণতা কমার সঙ্গে নিজের সত্তার মধ্যে বুল্টির সত্তাকে অনুভব করার প্রবণতা কমেছে, কমেছে স্বনির্দেশ পাঠিয়ে অন্যের ব্যথা অনুভব করার প্রবণতা। |
২১। অ, আ, ক, খ, A, B, C, D, 1, 2, 3, 4 থেকেই পড়াশুনো শুরু করতে হয়েছিল। বুল্টি বি. কম পর্যন্ত যা পড়েছে তার কিছুই দোলনের মনে ছিল না। | দোলন, মানিক মিত্র, কণিকা মিত্র। | জাতিস্মর হলে পূর্বজন্মের অন্যান্য স্মৃতির মতো পূর্বজন্মের লেখা-পড়ার স্মৃতিও উজ্জ্বল থাকা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মানসিক ভাবে কারও সত্তাকে অনুভব করলে তার ব্যবহার অনুকরণ করতে পারে কিন্তু জ্ঞান প্রয়োগ সম্ভব নয়। দোলনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। |
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৪র্থ খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি
অধ্যায়ঃ চার
♦ এ’দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ ‘সানন্দা’র দপ্তরে প্ল্যানচেটের আসর
♦ ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা
♦ রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা
♦ স্বামী অভেদানন্দের সামনে আত্মা লিখল শ্লেটে
♦ ভূতের ভরে পটকা মেয়েও পেয়ে যায় হাজার হাতির বল
♦ চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ভূতে পাওয়া কি
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার উৎপত্তি
♦ থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রেতচর্চা
♦ উনিশ শতকের সেরা মিডিয়ামদ্বয় ও দুই শৌখিন জাদুকর
♦ থিওজফস্টদের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
♦ থিওজফিস্টদের প্রতি লেখা বিজ্ঞানী হাক্সলের মজার চিঠি
অধ্যায়ঃ সাত
♦ যুক্তির নিরিখে ‘আত্মা’ কি অমর?
অধ্যায়ঃ আট
♦ অসাম্যের বিষবৃক্ষের মূল শিকড় অধ্যাত্মবাদ অধ্যাত্মবাদের মূল শিকড় আত্মা
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন-ঝন বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”
♦ সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের চারটি পায়া কারা
অধ্যায়ঃ দশ
♦ হিন্দু ছাড়া কেউ জন্মান্তর মানে না
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ আত্মার অস্তিত্বে বিশাল আঘাত হেনেছিল চার্বাক দর্শন
অধ্যায়ঃ বারো
অধ্যায়ঃ তেরো
♦ তবু জাতিস্মর বার বার ঘুরে ফিরে আসে
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ জাতিস্মর কাহিনীর প্রথম পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ২ : চাকদার অগ্নিশিখা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৩ : সুনীল সাক্সেনা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৪ : যমজ জাতিস্মর রামু ও রাজু
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৫ : পুঁটি পাত্র
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৬ : গুজরাটের রাজুল
অধ্যায়ঃ পনের- জাতিস্মর কাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৭ : জ্ঞানতিলক
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ৯ : ত্রিশের দশকে কলকাতায় জাতিস্মর
অধ্যায়ঃ ষোল- অবতারদের পুনর্জন্ম
♦ জাতিস্মর তদন্ত-১০ : সত্য সাঁইবাবা
♦ জাতিস্মর তদন্ত- ১১ : দলাই লামা
অধ্যায়ঃ সতের
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবীদারদের প্রতি ১৫০,০০০ টাকার চ্যালেঞ্জ