নীল অরিন্দম

২০১৩ এর শেষের দিকের কথা – ক্লাসের অবসরে সারাদিন ফেসবুক ব্রাউস করি আর নিজের একটা ব্লগে কবিতা লিখি । আমার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড(সঙ্গত কারনে নাম উল্লেখ করছি না ) একদিন দেখলাম একটা লিংক শেয়ার করেছে। যেখানে মুক্তমনা শব্দটা ভেসে আছে। মুক্তমনা শব্দটাতে কেমন যেন আকৃষ্ট হয়ে গেলাম, কখন যে লিংক এ ক্লিক করে পড়তে শুরু করেছিলাম জানিই না। যদিও তখন এই মুক্তমনা শব্দটার সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলাম না। যাইহোক, মুক্তমনা ব্লগে ঢুকে দু একটি লেখা পড়ার পর-ই কেমন যেন আমার ভেতরে এতকাল জমে থাকা প্রশ্নগুলো উল্টে পাল্টে দিলো মুহূর্তক্ষনেই। ওমন অগ্নিগর্বা কলামগুলো আমাকে সত্যিই বেশ ভাবিয়েছিলো।

যদিও পড়ার নেশা প্রায় ছোটবেলা থেকেই ছিল। এমনকি মাধ্যমিকের সময়ই হুমায়ুন আজাদ ও তসলিমা নাসরিনের অনেকগুলো বই পড়া হয়েগিয়েছিল । কিন্তু এদিকে আমি কট্টরপন্থি হিন্দু পরিবারের ছেলে হবার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই এ পুজা, সে পুজা দেখে দেখে বড় হয়ছি ; এমন কি ধর্মের প্রতি উদাসীনতা থাকা সত্তেও বাবা-মায়ের চাপে ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহন করতে বাধ্য হয়েছি । তখন থেকেই ঈশ্বর শব্দের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ি। তারপর সেই ষোল বছর থেকেই সকল ধর্মীয় কার্যকলাপকে বিদেয় জানিয়েছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর নামক কাল্পনিক সত্ত্বাটাকে তখনো পুরোপুরি বিদেয় জানাতে পারি নি।

মুক্তমনার লেখা নিয়মিত পড়তে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে ঈশ্বরের কার্যকলাপই না, ঈশ্বর নামক বস্তুর অস্তিত্বের প্রতিও হলাম সন্দিহান। আর এদিকে মুক্তমনায় যে সব বইগুলো রিকমান্ড করতো, সেই বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়তে শুরু করলাম। ততদিনে অভিজিৎ রায় সম্পর্কে জেনে গিয়েছি। জেনে গিয়েছিলাম মুক্তমনার মানে।

আর ২০১৪ এর শেষের দিকে আমার হাতে এলো “অবিশ্বাসের দর্শন” বইটি। বইটা পড়তে শুরু করার পরই এক অকৃত্তিম ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিলো অভিজিৎ রায়ের লেখনির প্রতি । একটা দুর্বোদ্ধ কথাকেও যে অতি সহজে মনোমুগ্ধকর প্রাঞ্জল ভাবে প্রকাশ করা যায়, তা অভিজিৎ রায়ের এই “অবিশ্বাসের দর্শন” না পড়লে কোনকালে জানতেও পারতাম না।

আর নিজের ভেতর থাকা কাল্পনিক ঈশ্বর নামক সত্ত্বাকে পুরোপুরি দূরও করতে পারতাম না। আর তারপর থেকেই এই অভিজিৎ রায় কে অভিজিৎ দা হিসেবে সম্বোধন করা শুরু করলাম বন্ধুবান্ধবের আড্ডায়। আর তারপর থেকেই শুরু আমার অবিশ্বাসী জীবন । এদিকে ফেসবুকে নিজের অবিশ্বাসের কথা বলতে বলতে সমমনা আরও অনেকের সাথে যুক্ত হলাম । আর অভিজিৎ রায়ের বিশ্বাসের ভাইরাস, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব ও আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইগুলো আমার সেল্ফে । কিন্তু তখনও পড়ে উঠি নি বইগুলো।

আর এবছরের ফেব্রুয়ারি তে অভিজিৎ রায় বাঙলাদেশে আসবেন বলে ফেসবুকে সমমনা অনেকেই দেখলাম উৎফুল্ল । আমিও খুশি হয়েছিলাম । কিন্তু এরকম একটা আমূল পরিবর্তন বাঙলাদেশের ব্লগিং এ হবে তা ভাবিনি সেদিন কেউই । আর যার সূত্রপাত হবে আমার অভিজিৎ’দার……… । তারপর সেদিন থেকে আমি অভিজিৎ দার বইগুলো যতবার পড়েছি চোখের জলের দাগ রেখে দিয়েছি জমিয়ে।

অভিজিৎ রায়, গ্যালিলিও রা হাজার বছর পর পর পৃথিবীতে আসেন । আর পৃথিবীর মানুষের মতো দেখতে অমানুষেরা তাদের চলার পথ কে রুদ্ধ করে দেয় বার বার । কিন্তু যতদিন পৃথিবীতে একজনও সত্যিকারের মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন অভিজিৎ রায় দের মৃত্যু নেই । তোমার প্রতি সহস্র মানুষের এ ভালবাসা যেন শতাব্দী থেকে শতাব্দীময় প্ৰতীক্ষা।

error: Content is protected !!