১৯৯৬-এর নববর্ষের সকালে কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘকে সম্মোহিত করে গলায় মালা পরাতে গিয়ে বাঘের থাবার আঘাতে প্রাণ দিলেন তরতাজা তরুণ জয়প্রকাশ তিওয়ারি। মারাত্মক রকম আহত হন আর এক তরুণ, সুরেশ রাই।
ঘটনার শুরু সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ চিড়িয়াখানার ‘ওপেন এয়ার’ বাঘের আবাসে। নতুন বছরের প্রথম দিনের সকাল। চিড়িয়াখানায় বেজায় ভিড়। ভিড় বাঘের মুক্ত আবাসের কাছেও। হঠাৎই সেখানে জয়প্রকাশ ও সুরেশের আগমন। দু’জনে উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে চিৎকার করে হিন্দিতে ঘোষণা করেন যে, তারা ‘জাদুটোনা’ জানেন । জানেন জন্তু-জানোয়ারকে সম্মোহিত করতে। আজ সকলের সামনে বাঘকে সম্মোহিত করে তার গলায় মালা পরিয়ে তারা ফিরে আসবেন। উপস্থিত দর্শকদের কেউ কেউ দুই তরুণকে বিরত করার চেষ্টা করলেও অনেকেই তাদের উৎসাহিত করেন। দুই তরুণ জনতার সামনেই কংক্রিটের পাঁচিল টপকে পরিখায় নামেন। সাঁতরে পরিখা ঘেরা বাঘের ডেরায় গিয়ে ওঠেন। এরপর একটিই বাধা ছিল ওঁদের ও বাঘের মাঝখানে—লোহার জাল। জালও টপকালেন দুই তরুণ। শত শত অবাক দৃষ্টির সামনে সুরেশ, জয়প্রকাশ এগুলেন বিশ্রামরত বাঘ ‘শিবা’র কাছে। সম্মোহন করতে চোখে চোখ রাখতে হবে। কিন্তু দুটি আগন্তুকের আবির্ভাবকে পাত্তা না দিয়ে শিবা শীতের রোদ গায়ে মেখে বিশ্রাম নিতে লাগল। সুরেশ শিবার দৃষ্টি ফেরাতে খোঁচালেন। বিরক্ত শিবা পরিবর্তে সুরেশের গায়ে একটি চাপড় মারল। বাঘের চাপড়ে আহত সুরেশ কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন। জয়প্রকাশ এতে একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে মিতা নামের বাগিনীকে সম্মোহিত করতে চেষ্টা করলেন। শিবা ঘুরে জয়প্রকাশের গলায় কামড় বসিয়ে এক ঝটকা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে খাঁচার দিকে।
তারপর জনতার চিৎকার, রক্ষীদের ছোটাছুটি, ঘুম পাড়ানো গুলি, জনতার বিক্ষোভ, ভাঙচুর সবকিছুই চূড়ান্ত হল। ফলে অবস্থা সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সকে (র্যাফ) নামানো হল ।
সুরেশ ও জয়প্রকাশ পাগল ছিলেন, এমন কোনো তথ্যই আমাদের হাতে নেই। বরং সুরেশ এবং জয়প্রকাশের আপনজনদের কথামতো দু’জনেই ছিলেন পুরোপুরি প্রকৃতিস্থ। তবে দু’জনই যে সম্মোহন বিষয়ে এবং ‘ব্ল্যাকম্যাজিক’ বা তুকতাক বিষয়ে জানার জন্য অনেক সময় ও শ্রম দিতেন, তাও তাদের আপনজনেরা জানাতে ভোলেননি। তারা পশুকে সম্মোহন করার জাদুটোনা শিখেছিলেন এক তান্ত্রিকের কাছ থেকে।
কমিক্স বইয়ের ম্যানড্রেককে আমরা অবশ্য বহুবারই দেখেছি পশুদের সম্মোহন করতে। কিন্তু সে’সবই গল্প কথা। গুপী-বাঘার বাঘকে সম্মোহন করার গল্পও নেহাতই গল্প । কিন্তু এইসব গল্প কমিক্সের বইতে পড়ার বা সিনেমায় দেখার প্রভাব যে মোটেই শূন্য নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পাই।
সম্মোহন শিখতে চাওয়া গাদা গাদা চিঠি হরদম পাই। এইসব চিঠি আসে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে। এঁদের মধ্যে ছাত্র থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপক সবাই আছেন ৷ সম্মোহন সম্বন্ধে এঁদের ধারণাও বিচিত্র। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন সম্মোহন করে মানুষকে হুকুমের চাকর বানানো যায়। শরীরে হারকিউলিসের মতো শক্তি আনা যায়। বাঘ- সিংহের মতো হিংস্র প্রাণীদেরও মেনি বেড়াল বানিয়ে রাখা যায়।
এমন ভুল ভাবার মতো হরেক রকম ফাঁদ পাতা রয়েছে এই দুনিয়ায়। এমন কিছু কিছু জাদুকরকে আমি দেখেছি, যাঁরা দাবি করেন পশু-পাখি প্রত্যেককেই সম্মোহন করার বিদ্যে তাঁদের করায়ত্ত। প্রমাণ দিতে তাঁরা সব সময়ই বেছে নেন মুরগি। তারপর মুরগির মাথাটা মেঝেতে বা মঞ্চের প্ল্যাটফর্মে চেপে ধরে ঠোঁটের কাছ থেকে সাদা খড়ির লম্বা দাগ টেনে ছেড়ে দেন। অবশ্য এই সময় চলতে থাকে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ বা জাদুকরদের সম্মোহনের কায়দায় হাত নাড়া। ছেড়ে দেওয়ার পর দেখা যায় মুরগিটি বাস্তবিকই স্বভাব সুলভভাবে ছটফট করছে না। ছাড়া পেয়েও পালাবার চেষ্টা করছে না। সম্মোহিত হয়ে চুপটি করে বসে রয়েছে।
এঁদের এমন কর্মকাণ্ড দেখে অনেকেই জন্তুকে সম্মোহন করার বিদ্যে শিখতে দস্তুরমতো খরচাপাতি করে, জাদুকরের খিদমদ খাটে। তারপর ওরা যা শেখে, সে বিদ্যে বাঘটাঘের কাছে ফলাতে গেলে পরিণতি হয় জয়প্রকাশ, সুরেশের মতোই।
মুরগির এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী, নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনারাও যে কোনো মুরগিকে এমনি করে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবেন। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, প্রতারক জাদুকরের মতো আপনারাও আবার এটাকে সম্মোহন বলে প্রচার করবেন না।
একটি মুরগিকে ধরে তার মাথাটা মোঝেতে চেপে মুরগির ঠোটের কাছ থেকে সাদা খড়ির একটা সোজা দাগ টেনে মুরগিকে ছেড়ে দিলেই দেখবেন ও চুপটি করে বসে আছে।
এমনটা আচরণের কারণ মুরগির দুটি চোখের দৃষ্টিরেখা ঠোটের শেষপ্রান্তে একই বিন্দুর দিকে অগ্রসর হয়েছে। তাই মুরগির ঠোঁটের কাছ থেকে সাদা খড়ির রেখা টানলে মুরগি ভাবে তার ঠোটে দড়ি জাতীয় কোনো কিছু দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তাই ব্যথা পাওয়ার ভয়ে ঠোঁট নাড়তে চায় না। এমনকি নড়তেই চায় না।
এই অবস্থা থেকে মুরগিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একবার জোরে আওয়াজ করলেই হল। আর দর্শকরা ভাবে–এভাবে বুঝি সম্মোহন থেকে মুরগিটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো।
পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?
পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ
অধ্যায়ঃ এক
♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ Hysterical neurosis – Conversion type
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)
পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)
অধ্যায়ঃ দুই
♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব
পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ এক
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ