গত কয়েক বছরে যুক্তিবাদী আন্দোলন সাধারণ মানুষের ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর অংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষকে কুযুক্তির গারদ ভেংগতে স্বচ্ছ চিন্তার জগতে নিয়ে আসতে যুক্তিবাদী আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে এগিয়ে এসেছে বহু বিজ্ঞান ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, নাট্য গোষ্ঠী, লিটিল ম্যাগাজিন প্রমুখ গণসংগঠন। কাজ-কর্মে এরা অনেকেই খুবই আন্তরিক। কুসংস্কার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এদের অনেকেই আরও নানা ধরনের সমাজ কল্যাণমূলক, সমাজসংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। সাক্ষরতা অভিযান, বুজদান, চক্ষুদান, মরণোত্তর দেহদান, কৃষিজমি পরীক্ষা, হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার সুব্যবস্থার দাবী তোলা, জলা বাঁচাও, বৃক্ষরোপণ, বিনামূল্যে চিকিৎসাকেন্দ্র, ফ্রি কোচিং সেন্টার, ফ্রি রিডিংরুম এমনই আরও বহুতর সেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে অনেক মানুষের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছাও এইসব সংস্থার পাথেয় হয়েছে। ফলে এরা সার্থক গণসংগঠন হয়ে উঠেছে।
জনকল্যাণমূলক কাজেব মধ্য দিয়ে জনচিত্ত জয় করার পদ্ধতিটি আরো সফল ভাবে কাজে লাগিয়েছেন বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। মাদার টেরিজা, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, মোআমার- অল- আলক – আল-ইসলামী প্রমুখ বহু ধর্মী প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের জনকল্যানমূলক কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রেখেছে। হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম, বন্যায় বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মশালা এমনি নানা ধরনের জনকল্যানমূলক কাজকর্মের প্রলেপে সাধারণেব মন জয় কবে তাদের আবেগ সিক্ত, কৃতার্থ হৃদয়ে রহস্যবাদ, দুর্জ্যেয়বাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ, কর্মফল ও রকমারি ভাববাদী চিন্তাও ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আবেগ সিক্ত, ঋণী, কৃতার্থ মগজ তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষে এদের নিপীড়িত মানুষদের বন্ধু হিসেবেই ধরে নিচ্ছে। নিপীড়িত, শোষিত মানুষগুলো এইসব প্রতিষ্ঠানকর্মীদের সেবাব সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করছেন এইসব ভালো-লাগা মানুষগুলোর চিন্তাও।
ভাববাদী শিবিবের এই ধবনের মগজ ধোলাই কৌশল থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মীদেরও প্রয়োজনে জনচিত্ত জয়ের জন্য নানা জনকল্যানমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত হতে হবে পাল্টা মগজ ধোলাই করতে। যাঁরা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সাধারণ মানুষের চেতনা মুক্তি এবং সেই পথ ধরে সার্বিক শোষণ মুক্তিব স্বপ্ন দেখছেন তাদের কিন্তু একটা বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে—উপলক্ষ্য যেন লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে না যায়। কুসংস্কার মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে জনকল্যানমূলক কাজকর্ম যে শুধু মাত্র উপলক্ষ্যই হতে পারে, এই বিষয়ে অতি সচেতনতার প্রয়োজন। স্পষ্টতই মনে রাখতে হবে পরম সত্যটি–সেবায় আর যাই করা যাক, সমাজ ব্যবস্থা পাল্টান যায় না, শোষণমুক্তি ঘটতে পারে না। শোষণমুক্তি ঘটতে পাবে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সমাজ সচেতনতা বোধ থেকে। সাধারণ মানুষের বৃহত্তর অংশ যেদিন বুঝতে শিখবে তাদের বঞ্চনার কারণ অদৃষ্ট নির্ধারিত নয়, পূর্বজন্মের কর্মফল নয়, ঈশ্বরজাতীয় কোনও কিছুর অভিশাপ নয়, বঞ্চনার কারণ শোষকশ্রেণী, সে-দিন তাদের নিজেদের স্বার্থেই, বাঁচার তাগিদেই বঞ্চনামুক্তির জন্য পাথর না পরে, পুজো না দিয়ে আঘাত হানবে শোষকশ্রেণীর দুর্গে।
কিন্তু এই আঘাত হানার প্রসঙ্গে তখনই আসবে যখন শোষিতশ্রেণীর ঘুম ভাঙ্গবে, তারা বঞ্চনার কারণগুলো বুঝতে পারবে। গরীবদের ক্ষোভকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই ধনীব অর্থে চলছে ‘দরিদ্র-নারায়ণ সেবা’। দরিদ্র নারায়ণের সেবা যাদের চিরন্তন লক্ষ্য, তাদেব সেবা বিলোবার জন্য দরিদ্র-নারায়ণের সরবরাহও যে চিরন্তন হওয়া প্রয়োজন-এই সত্যটুকু আমাদের ভুললে চলবে না। এই সেবামূলক কাজে তাৎক্ষনিক লাভ গরীবদের হলেও ভবিষ্যতের জন্য পড়ে রইল অনন্ত বর্ণনাময় জীবন।
জনসেবামূলক কাজের সঙ্গে শোষণমুক্তির সংগ্রামের সম্পর্কটা বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, যুক্তিবাদী আন্দোলনের, শোষণমুক্তির সংগ্রামের সম্পর্কটা। যাঁরা বুঝতে চাইবেন না, বুঝতে পারবেন না, তাঁরা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না। কিছুতেই পারা সম্ভব নয়। এইভাবে যুক্তিবাদী আন্দোলনকে সাধারণ মানুষের ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর অংশে নিশ্চয়ই ছড়িয়ে যেতে দেবে না রাষ্ট্রশক্তি । কাৰণ রাষ্ট্রশক্তি সাধারণ মানুষের চেতনাকে ততদূর পর্যন্তই এগিয়ে নিয়ে যেতে দেবে, যতদূর পর্যন্ত এগোলে তাদের কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই। যখনই বিপদের গন্ধ পাবে, তখনই নানাভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। কখনও সংস্থাকে আর্থিক সাহায্যে মুড়িয়ে দিয়ে লেজুড় করতে চাইবে, কখনও সংস্থা দখল করতে চাইবে নিজের পেটোয়া দালালদের নিয়ে, কখনও ব্যক্তিগতভাবে নেতাদের পাওয়া দেওয়ার রাজনৈতিক চালেই কিনে নিয়ে সংস্থাকে পকেটে পুরতে চাইবে, কখনও সংস্থাকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে লাগাতারভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, কখনও সংস্থার সুনাম জনমানসে মলিন করতে সংস্থা-প্রধানের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হবে, কখনও বা সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করা হবে সমাজসংস্কারমূলক, জনসেবামূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য । শেষ পদ্ধতিটি আপাত নিরীহ হলেও মগজ ধোলাইয়ের পক্ষে শাসকশ্রেণীর পক্ষে খুবই কার্যকর অস্ত্র। সেবামূলক বা সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্ম যেমন বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ দূষণ, রক্তদান, মরণোত্তর দেহদান, চক্ষুদান, সাক্ষরতা অভিযান ইত্যাদির পক্ষে দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপক প্রচার চালান। যে সব ব্যক্তি ও সংস্থা এ-সব কাজে এগিয়ে আসে বার বার তাদের মুখ ভেসে ওঠে দূরদর্শনে, গলা ভেসে ওঠে বেতারে। এগিয়ে আনা হয় আরো সব প্রচার মাধ্যমকে। মন্ত্রীরা বার বার হাজি হতে থাকেন এইসব সংস্থার অনুষ্ঠানগুলোতে। মন্ত্রীর সহচার্য, বেতার দূরদর্শনে প্রচার, সব মিলিয়ে একটা ক্রেজ। একটু একটু করে আরো বেশি বেশি সংস্থা সমাজসেবা, সমাজসংস্কারের কাজে এগিয়ে আসতে থাকেন। অনেকেই আরও বেশি বেশি করে অনুভব করতে থাকেন এই ধরনের কাজ কর্মে এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা ।
আসুন আমরা ফিরে যাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের সময়ে। ইয়ং বেঙ্গলরা প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে ভয়ংকর সব স্পর্শকাতর বিষয়ের বিরুদ্ধে সমাজসংস্কারে ঝুঁকেছিলেন। সতীদাহ, বিধবাবিবাহ, বাল্য বিবাহ, জাত-পাত ইত্যাদির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। গরুর মাংস প্রকাশ্যে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এর কোনোটাই যে সমাজ-অগ্রগতির সূচক নয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ ভারতের মুসলমানরা। মুসলমান সমাজে সতীদাহ প্রথা চিরাকলই অনুপস্থিত, বিধবা বিবাহ প্রচলিত, কনের পূর্ণ সম্মাতিতে বিয়ে হতে হয় বলে একটা চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপার রয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্কার বিয়ে ইসলামী মতে হতে পারে না, অর্থাৎ মুসলমান সমাজে বাল্যবিবাহ হতে পাবে না। কিন্তু ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজে অপ্রাপ্তবয়স্কার বিয়ে হয়, এবং এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র হিন্দু প্রতিবেশীদের প্রভাবে। মুসলমানরা গরুর মাংসই গ্রহণ করে। অর্থাৎ, যে কয়টি বিষয় ঘিরে গত শতকে বাংলার রেনেসাঁ যুগে সমাজসংস্কারের আন্দোলন গড়ার চেষ্টা হয়েছিল তার প্রায় সব কটি সংস্কারেরই ঊর্ধ্বে ছিল বাংলার মুসলিম সমাজ। কিন্তু তাতে বাংলাব মুসলমান সমাজের শোষণমুক্তি ঘটেছিল কী? না, ঘটেনি। বাংলার মুসলমানদের সংখ্যাগুরু অংশই ছিলেন হিন্দু সংখ্যাগুরু অংশের চেয়েও তুলনামূলকভাবে বেশি শোষিত।
সমাজসংস্কার ও সমাজসেবার মাধ্যমে সমাজের শোষণ মুক্তি ঘটেছে—এমন একটি দৃষ্টান্তও আজ পর্যন্ত কোনও ঐতিহাসিকের জ্ঞানের ভাণ্ডারে নেই। হাজারটা রামকৃষ্ণ মিশন, হাজারটা ভারত সেবাশ্রম সংঘ, হাজার মাদার টেরিজা ভারতের শোষিত জনতার শোষণমুক্তি ঘটাতে পারবে না ।
এই কথাটাও স্পষ্ট করে বলি-সমাজসেবা নিশ্চয়ই ভালো, কিন্তু সমাজ সেবার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে সাধারণ মানুষের চিন্তায় চেতনায় রহস্যবাদ, অদৃষ্টবাদ, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদি ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তাকে রুখতে আমরাও কী পারছি, সমাজ সেবার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের চেতনায় স্বচ্ছতা আনতে? যদি পারি, তবেই আমাদের স্বার্থকতা, নতুবা আমরা সমাজসেবার আবর্তে শাসক ও শোষকশ্রেণীর সুতোর নাড়াতে পুতুল নাচই নেচে যাব।
কিছু কথা
♦ শোষণ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখতেই মগজ ধোলাই চলছে
♦ দেশপ্রেম নিয়ে ভুল ধারনা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে
♦ গণতন্ত্র যেখানে বর্বর রসিকতা
♦ জনসেবা নিয়ে স্বচ্ছতা থাকা অতি প্রয়োজনীয়
♦ যুক্তিবাদের আগ্রাসন প্রতিরোধে কাগুজে যুক্তিবাদীর সৃষ্টি
♦ যুক্তিবাদবিরোধী অমোঘ অস্ত্র ‘ধর্ম’
♦ যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে প্রহসন কতদিন চলবে?
♦ আন্দোলনে জোয়ার আনতে একটু সচেতনতা, আন্তরিকতা
অধ্যায়ঃ এক
♦ পত্র-পত্রিকায় সাড়া জাগানো কিছু ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে
অধ্যায়ঃ দুই- অশিক্ষা, পদে পদে অনিশ্চয়তা এবং পরিবেশ মানুষকে ভাগ্য নির্ভর করে
♦ অদৃষ্টবাদ যেখানে অশিক্ষা থেকে উঠে আসে
♦ অনিশ্চয়তা আনে ভাগ্য নির্ভরতা
♦ পরিবেশ আমাদের জ্যোতিষ বিশ্বাসী করেছে
♦ মানব জীবনে দোষ-গুণ প্রকাশে পরিবেশের প্রভাব
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
♦ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের পার্থক্য
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦জ্যোতিষশাস্ত্রের বিচার পদ্ধতি
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ জ্যোতিষীরা জ্যোতিষশাস্ত্রের পক্ষে যে-সব যুক্তি হাজির করেন
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের যুক্তি
অধ্যায়ঃ নয়
♦ মানব শরীরে রত্ন ও ধাতুর প্রভাব
অধ্যায়ঃ দশ
♦ জ্যোতিষচর্চা প্রথম যেদিন নাড়া খেল
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ কিভাবে বার-বার মেলান যায় জ্যোতিষ না পড়েই
অধ্যায়ঃ বারো
♦ জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি চ্যালেঞ্জ
২য় পর্বঃ কিছু কথা
অধ্যায়- একঃ নস্ট্রাডামুসের সঙ্গে পরিচয়
♦ নস্ট্রাডামুসের ‘আশ্চর্য’ ভবিষ্যদ্বাণী কতটা ‘আশ্চর্যজনক’?
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
অধ্যায়ঃ এগারো
অধ্যায়ঃ বারো
♦ এ-দেশের পত্র-পত্রিকায় নস্ট্রাডামুস নিয়ে গাল-গপ্পো বা গুল-গপ্পো
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৩য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ