সনাতন ধর্মীয় মতে- পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে বৃহত্তম বস্তুপিন্ড। বস্তুত সাধারণ বা স্থুল দৃষ্টিতে তা-ই মনে হয়ে থাকে। মূলত পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্রের অবস্থিত নয় এবং পার্থিব জগতের বৃহত্তম বস্তুপিন্ডও নয়।

কোনো স্থানের কেন্দ্রবিন্দু স্থির করতে হলে তার পরিধি জানা আবশ্যক। ‘পরিধি’ নির্ধারণ না করে ‘কেন্দ্র’ নির্ধারণ করা অসম্ভব। ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বের পরিধি নির্ধারণ না করেই পৃথিবীকে বিশ্বের ‘কেন্দ্র’ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

পৃথিবী সূর্য থেকে প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল দূরে থেকে এক গোলাকার (দুইদিকে ঈষৎ চাপা) কক্ষপথে  ভ্রমণ করছে এবং প্রায় একই সমান্তরাল কম-বেশী দূরে থেকে আরো … টি গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহদের এই আবর্তনক্ষেত্রকে বলা হয় সৌরজগত। সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত আছে সূর্য এবং সীমান্ত আছে … গ্রহ। পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রেও নয় এবং সীমান্তেও নয়। অধিকন্তু সৌররাজ্যে পৃথিবীর আয়তনও উল্লেখযোগ্য নয়। নেপচুন গ্রহটি পৃথিবী থেকে আয়তনে ৬০ গুণ বড়, শনি গ্রহটি বড় ৭৩৪ গুণ। বৃহস্পতি বড় ১৩১২ গুণ এবং আয়তনে সূর্য পৃথিবীর চেয়ে ১৩ লক্ষ গুণ বড়।

সৌরজগতের বাইরে যে সকল জ্যোতিষ্ক দেখা যায়, তাদের দূরত্ব এতো বেশি যে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে হলে মাইল বা ক্রোশে কুলোয় না। তাই তা হিসাব করতে হয় আলোক বছরে। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৮৬ হাজার মাইল বেগে চলে আলো এক বছরে যতোটা পথ অতিক্রম করতে পারে, তাকে বলা হয় আলোক বছর। সৌরজগতের বাইরের যে কোনা জ্যোতিষ্কের দূরত্ব নির্ণয় করতে হলে ‘আলোক বছর’ ব্যবহার করতে হয়। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ৯৩০ লক্ষ মাইল এবং সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছুতে সময় লাগে প্রায় ৮ মিনিট। কিন্তু মহাকাশে কোটি কোটি নক্ষত্রের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছে যে নক্ষত্রটি আছে, তার আলো পৃথিবীতে আসতেও সময় লাগে প্রায় ৪ বছর। মহাকাশে ৪ আলোক বছরের কম দূরত্বে কোনো দিকে কোন নক্ষত্র নেই।

এ পর্যন্ত মহাকাশে প্রায় ১০,০০০ কোটি নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। উক্তরূপ দূরে দূরে থেকে ঐ সমস্ত নক্ষত্র যে বিশাল স্থান জুড়ে আছে, তাকে বলা হয় ‘নক্ষত্রজগত’। নক্ষত্ররা সকলেই এক একটা সূর্য, কোনো কোনোটি মহাসূর্যও বটে। মহাকাশে এমন নক্ষত্রও আছে, যারা আমাদের সূর্য অপেক্ষা কোটি কোটি গুণ বড়।

আমাদের সূর্য যে নক্ষত্র জগতে অবস্থিত আছে, সেই নক্ষত্রজগতটা আবর্তিত হচ্ছে। আমাদের সৌরজগটা এ৩ই নক্ষত্রজগতের কেন্দ্র হতে প্রায় ৩০ হাজার আলোক বছর দূরে থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৭৫ মাইল বেগে নক্ষত্রজগতের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে। একবার প্রদক্ষিন করতে সময় লাগে প্রায় ২২X১/২ কোটি বছর। আমাদের এই সৌরজগতটাও নক্ষত্রজগতের কেন্দ্রে নয়।

নক্ষত্রজগতকে সুদূর হতে দেখলে তার নক্ষত্রগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায় না, সমস্ত নক্ষত্র মিলে একটা ঝাপসা আলো বা মেঘের মতো দেখায়। ঐরূপ মেঘকে ‘নীহারিকা’ বলা হয় (এ ভিন্ন আর এক জাতের নীহারিকা আছে, তারা শুধু বাষ্পময়)। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি নীহারিকা বা নক্ষত্রজগতের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং সবগুলো নীহারিকা মিলে যে পরিমাণ স্থান জুড়ে আছে, তাকে বলা হয় নীহারিকাজগত বা বিশ্ব। আমাদের নক্ষত্রজগত বা নীহারিকাজগতটাও যে বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত, এমন কথাও বলা চলে না। এই বিশ্ব এতোই বিশাল যে, এর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তের দূরত্ব প্রায় ৪,০০০ কোটি আলোক বছর।

বিশ্বের আয়নের বিশালতা আমরা শুধু কথায় বা লেখায়ই প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু ধারণায় আনতে পারি না। এই কল্পনাতীত বিশ্ব এমনই  বিশাল যে, জীবসমাকুল পৃথিবী, গ্রহসমাকুল সৌরজগত, এমন কি সৌরসমাকুল নক্ষত্রজগত পর্যন্ত এর মধ্যে হারিয়ে যায়। অর্থাৎ বিশ্বে এমনও স্থান আছে, যেখান থেকে চাইলে আমাদের পৃথিবী, সূর্য, এমনকি নক্ষত্রজগতও অদৃশ্য হয়ে পড়ে।

আমরা যে নক্ষত্রজগতে বাস করছি, এই নক্ষত্রজগতের আকৃতি গোল অথচ চ্যাপ্টা, কতকটা ডাক্তারদের ‘ট্যাবলেট’- এর মতো। আমাদের পৃথিবীটাও গোল, তবে উত্তর ও দক্ষিনে কিঞ্চিৎ চাপা। অর্থাৎ এর বিষুবীয় অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯২৬  মাইল  ও মেরু অঞ্চলের ব্যাস ৭,৯০০ মাইল; ব্যবধান ২৬ মাইল মাত্র। আর আমাদের নক্ষত্রজগতটার বড় ব্যাস ১২০ হাজার আলোক বছর এবং ছোটো ব্যাস ২০ হাজার আলোক বছর; ব্যবধান ১ লক্ষ আলোক বছর।

প্রত্যেকটি নক্ষত্রজগত বা নীহারিকার মাঝখানের দূরত্ব লক্ষ লক্ষ আলোক বছর। যে কোনো দুইটি নীহারিকার মাঝখানে যে স্থান – সেখানে তাপ নেই, চাপ নেই, আলো নেই; তা চির অন্ধকার, চিরশীতল, বিশাল মহাশূন্য বা ঈথার।

নীহারিকাগুলো পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে এবং নীহারিকা-বিশ্বটি ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। আমাদের নক্ষত্রজগত থেকে যেই নীহারিকার দূরত্ব যতো বেশি, সেই নীহারিকার দূরে সরে যাওয়ার বেগও ততো বেশি। প্রতি এক লক্ষ আলোক বছর দূরত্ব বৃদ্ধিতে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মাইল বেগ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সব চেয়ে দূরের নীহারিকার দূরে দূরে যাওয়ার বেগ আলোর বেগের ৯/১০; অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ১,৬৭,৪০০ মাইল।

নীহারিকাগুলো কত যুগযুগান্ত হতে এইরূপ প্রচন্ড বেগে ছুটে চলেছে, তার ইয়ত্তা নেই এবং কোনো কালেও যে তারা কোনো সীমান্তে পৌঁছুবে, আজ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস পাওয়া যায় না।

আরও একটি কথা। আমরা যে পৃথিবীটায় আছি, তারই চতুষ্পারশে যে নক্ষত্র নীহারিকাগুলো ভীর জমিয়ে আছে, এরূপ মনে করবার কোনো কারণ নেই। হয়তো এই বিশ্বের অনুরূপ কোটি কোটি বিশ্ব নিয়ে ‘মহাবিশ্ব’ গঠিত হয়ে থাকবে। আবার কোটি কোটি মহাবিশ্ব নিয়ে ‘পরমবিশ্ব’, ‘চরমবিশ্ব’ ইত্যাদি অনন্ত বিশ্ব থাকা বিচিত্র নয়। তাই আমার মনে হয় যে, ‘বিশ্ব অসীম’।

এ যাবত যেও সমস্ত আলোচনা করা হল, তা সমস্তই পার্থিব জগতের স্থিতি সম্বন্ধে, আদি ও অন্ত অর্থাৎ সৃষ্টি ও লয় সম্বন্ধে নয়। সে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমি আমার ‘;সৃষ্টি-রহস্য’ নামক পুস্তকখানাতে। তাই এখানে আলোচনাআ বৃদ্ধি না করে সে বিষয়ে সামান্য আলোচনা করে এ প্রসঙ্গ শেষ করবো।

মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ সূর্য, নক্ষত্র, নীহারিকা ইত্যাদি সকলেই অতিশয় উষ্ণ পদার্থ এবং সকলেই নিয়ত তাপ বিকিরণ করছে। বিকিরিত তাপ বা আলো কখনো কেন্দ্রে ফিরে যায় না। জ্যোতিষ্কপুঞ্জ হতে তাপ বিকিরণ হতে হতে এককালে এমন অবস্থা আসতে পারে, যখন মহাবিশ্বের কোথায়ও কোনো জ্যোতিষ্কের তাপের সঞ্চার থাকবে না। হয়তো তখন ঘটবে বিশ্বজোড়া মহাপ্রলয়। কিন্তু ঐরূপ মহাপ্রলয় ঘটলে তা কতোকাল পরে ঘটবে, কেউ তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে না।

উপরোক্ত মতে- বিশ্বের যাবতীয় নীহারিকা বা নক্ষত্ররাজ্যের প্রতিটি নক্ষত্র বা সূর্য একদিন না একদিন নিভে যাবে। তখন বিশ্বের কোথায়ও উত্তাপ বা আলোকের নামগন্ধও থাকবে না, সর্বত্র বিরাজ করবে কল্পনাতীত শৈত্য ও অন্ধকার। সেই হিমান্ধকার ব্যোমসমুদ্রে ভাসতে থাকবে নক্ষত্র ও গ্রহাদির মৃতদেহগুলো।

শৈত্যে সঙ্কুচিত ও উত্তাপে প্রসারিত হওয়া বস্তুজগতের একটি সাধারণ নিয়ম। সেই কালান্তকালের মহাশৈত্যে তখনকার বস্তুপিন্ডগুলো সম্ভবত অতিমাত্রায় সংকুচিত হবে এবং তার ফলে বস্তুপিন্ডের মধ্যে প্রবল চাপ সৃষ্টি হবে, যার ফলে পদার্থের পরমাণু ভেঙ্গে তা তেজ বা শক্তিতে রূপান্তরিত হবে।

‘শক্তি’ কখনো নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। তাই শক্তির সক্রিয়তার ফলে আবার শুরু হবে ধাপে ধাপে নতুন সৃষ্টির প্রবাহ। অর্থাৎ আবার সৃষ্টি হতে থাকবে ইলেক্ট্রন, প্রোটন, পরমাণু, নীহারিকা, নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহাদি বস্তুসমূহ, অবশেষে প্রান ও প্রাণী। কালান্তে আবার প্রলয়, আবার সৃষ্টি, আবার প্রলয়। এভাবে অনাদিকাল থেকে চলছে ও চলবে ‘সৃষ্টি’ ও ‘প্রলয়’- এর প্রবাহ। সুতরাং ‘সৃষ্টি ও প্রলয়’ একবার-দু’বার নয়, অসংখ্যবার। অর্থাৎ ‘সৃষ্টি ও প্রলয়’ এর আরম্ভ বা শেষ কল্পনাতীত। কেননা এ প্রবাহ চক্রবৎ ঘুরছে।

“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

নিবেদন

অধ্যায়ঃ সত্যের সন্ধান

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

মূলকথাঃ প্রশ্নের কারন

প্রথম প্রস্তাবঃ আত্মা বিষয়ক

দ্বিতীয় প্রস্তাবঃ ঈশ্বর বিষয়ক

তৃতীয় প্রস্তাবঃ পরকাল বিষয়ক

চতুর্থ প্রস্তাবঃ ধর্ম বিষয়ক

পঞ্চম প্রস্তাবঃ প্রকৃতি বিষয়ক

ষষ্ঠ প্রস্তাবঃ বিবিধ

উপসংহার

টীকা

অধ্যায়ঃ অনুমান

ভূমিকা

রাবনের প্রতিভা

ফেরাউনের কীর্তি

ভগবানের মৃত্যু

আধুনিক দেবতত্ত্ব

মে’রাজ

শয়তানের জবানবন্দি

সমাপ্তি

অধ্যায়ঃ স্মরণিকা

লামচরি গ্রামের অবস্থান ও পরিবেশ

লাইব্রেরী ও সমাধি নির্মাণ

লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও ৭৯ সালের বৃত্তি দান

উদ্বোধনী ভাষণ

মানব কল্যাণের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

১৯৮০ সালের বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠান

পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠান

পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানের ভাষণ

অবহেলিত একটি প্রতিভার স্বীকৃতি বাকেরগঞ্জ জিলা পরিষদ কর্তৃক বিশেষ পুরস্কার দান

বার্ষিক অধিবেশন ও ৮১ সালের বৃত্তিপ্রদান

আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরীর দানপত্র সংক্রান্ত দলিলসমূহের অনুলিপি

স্মৃতিমালা

কেন আমার মৃতদেহ মেডিক্যালে দান করছি

বেদ-এর অবদান

অসমাপ্ত পান্ডুলিপি

ভাবি প্রশ্ন

না বুঝের প্রশ্ন

টুকুটাকি

অধ্যায়ঃ আমার জীবনদর্শন

প্রস্তাবনা

জগত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা

জীবন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা

সমাজ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা

বিভিন্ন আলোকচিত্র

হস্তাক্ষরে লেখা চিঠি

নির্ঘণ্ট

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x