ছায়াসঙ্গী

হুমায়ূন আহমেদ

 

উৎসর্গ

আলমগীর রহমান

যিনি ভূত বিশ্বাস করেন না তবে

ভূতের গল্প শুনলে ভয়ে রাতে ঘুমুতে পারেন না।

তাহার ধূসর ঘোড়া চরিতেছে নদীর কিনারে

কোনো এক বিকেলের জাফরান দেশে।

কোকিল কুকুর জ্যোৎস্না ধুলো হ’য়ে গেছে কত ভেসে।

মরণের হাত ধ’রে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?

জীবনানন্দ দাশ

 

পূর্ব কথা

আপনি ই ভূত বিশ্বাস করেন?

আমাকে অনেকেই এই প্রশ্ন করেছেন, আমি মজা করার জন্য প্রতিবারই বলেছি, ভূত-প্রেত-বিশ্বাস করি তবে মানুষ বিশ্বাস করি না।

উত্তর ঠিক  না। কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই। চল্লিশ বছর পার করে দিয়েছি, এখন পর্যন্ত ভূত দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই হয়নি। আমার অতি পরিচিত কেউও ভূত দেখেছেন বলে আমার জানা নেই। তা হলে হঠাত করে ভূতের গল্প লিখতে বসলাম কেন?

আসলে গল্পগুলি ঠিক ভূতের নয় – অন্যরকম অভিজ্ঞতার গল্প, যে অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই আছে এবং যা চট করে ব্যাখ্যা করা যায় না। উদাহরণ দিই – ছোটবেলায় মরিয়ম   বলে আমাদের একটা কাজের মেয়ে ছিল। বয়স বারো-তেরো। অসম্ভব বোকা। তার ঘুম ছিল প্রবাদের মতো। বাথরূমে কাপড়ে সাবান মাখাতে মাখাতে ঘুমিয়ে পড়ত। এই মেয়েটা কোন এক বিচিত্র উপায়ে ভবিষ্যৎ বলতো। ঘর ঝাঁট দিতে দিতে হঠাত হয়তো বলল, আইজ আমরার বাসাত বুড়া কিসিমের একটা লোক আসব, সাথে ছোট মাইয়া। লোকটার শইল্যে হইলদা জামা।

সত্যি সত্যি তা-ই হতো। মরিয়ম ভবিষ্যদ্বাণী করেছে অথচ তা হয়নি এই নজির নেই। ভবিষ্যদ্বাণীগুলি কিভাবে করত তা সে নিজেও জানে না। প্রশ্ন করলে বলত- চউক্ষের সামনে দেহি। ক্যামনে দেহি জানি না।

আমাদের পরিবারে একটা বড় দুর্ঘটনার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার পর এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবার পর তাকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়। এই পৃথিবীতে যুক্তিগ্রাহ্য নয় এমন বিষয়ও যে ঘটে তা মরিয়মকে দেখেই আমি প্রথম বুঝতে পারি।

অবিশ্যি এটা স্বীকার করে নেয়া ভালো যে – আজকের বিজ্ঞান  যা ব্যাখ্যা করতে পারছে না আগামী দিনের বিজ্ঞান তা পারবে। হয়তো মরিয়মের ভবিষ্যৎ বলতে পারার যে-ক্ষমতাকে আমাদের কাছে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বলে মনে হচ্ছে, আসলে তা মোটেই নয়। হয়তো আগামীদিনের বিজ্ঞান সময়কে জয় করবে। তখন ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান বলে আলাদা কিছু থাকবে না।

আমি লক্ষ্য করেছি খুব শজে অধিকাংশ ভৌতিক অভিজ্ঞতারই লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। ছোটবেলায় আমি আমার নানুর কাছ থেকে তাঁর জীবনের একটা ভয়াবহ ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প শুনতাম। সেই সময় গল্প শুনে ভয়ে ও আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। এখন মনে হচ্ছে আমার মাতামহীর অভিজ্ঞতার একটি সহজ ব্যাখ্যা আছে, সেই ব্যাখ্যা খুব খারাপ না।

আবার কিছু কিছু গল্প এমন যে তার কোন ব্যাখ্যাই দাঁড় করানো যায় না। আমি নানাভাবে চেষ্টা করেও কিছু পাইনি। হয়তো আমার বুদ্ধিবৃত্তি তত উন্নত নয়। এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি এলে থমকে দাঁড়ানো ছাড়া পথ নেই। আমি অনেক বার থমকে দাঁড়িয়েছি। আমার মনে হয়েছে আমাদের আলোকিত জগতের পাশাপাশি একটি অন্ধকার জগতও আছে। সেই জগতের নিয়মকানুন ভিন্ন।

আমি এই গল্প সঙ্কলনে অন্ধকার জগতের কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প। কিছু বাইরের গল্পও আছে, তার মালমশলা আমার অতি প্রিয়জনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে, কিংবা অন্য ভুবন সম্পর্কে কোন ধারণা দেবার জন্যে গল্পগুলি লেখা হয়নি। লিখেছি এই পৃথিবীর রহস্যময় ব্যাপারগুলির দিকে ইঙ্গিত করার জন্যে। লেখালেখি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করার জন্যেই বলব।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ব্যাখ্যার অতীত কিছুই নেই। আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না, তা আমার অক্ষমতা, অন্য কেউ করবেন।

হুমায়ূন আহমেদ

শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x