ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের আদিবাসী সমাজের জানগুরুরা (অঞ্চলভেদে তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন) চোর ধরতে, চুরি যাওয়া জিনিসের হদিশ দিতে, অথবা চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রচলিত দেশীয় ওষুধ ঠিক মত নির্ণয় করতে না পারলে অর্থলোভে, জীবিকার স্বার্থে অথবা নিজের অক্ষমতা ঢাকতে কোনও মানুষকেই ডাইন বা ডাইনি ঘোষণা করে এ সবের জন্য দায়ী করে। এ শুধু লোক ঠকানোর ব্যাপার নয়, শুধুই প্রবঞ্চনা ও প্রতারণার মাধ্যমে এরা অজ্ঞ গ্রামবাসীদের আর্থিকভাবে শোষণই করে না, এরা ঠান্ডা মাথায় খুনে। এরা শুধু যে অন্য কিছুর বিনিময়ে স্বার্থান্বেষীর হয়ে ঘাতকের ভূমিকা গ্রহণ করে, কাউকে ডাইনি ঘোষণা করে।

মানুষের দুর্বলতা ও অজ্ঞতাই জানগুরুদের শোষণের হাতিয়ার। মন্ত্রশক্তিকে নয়, বিজ্ঞানের কৌশলকে কাজে লাগিয়েই ওরা মানুষ ঠকিয়ে চলেছে। কি সেই কৌশল? আসুন, সেগুলো নিয়েই এখন আমরা একটু নাড়াচাড়া করি।

 

চোর ধরে আটার গুলি

বাড়িতে চুরি হলে ওঝার কাছে বাড়ির লোক হাজির হন। ওঝা পয়সা ও পাঁচপো আটা আনতে বলে। গৃহস্বামীর কাছ থেকে জেনে নেয় কাকে কাকে তিনি সন্দেহ করছেন। আটাতে মন্ত্র পড়া হয়। মন্ত্র পড়া আটা থেকে কিছুটা নিয়ে প্রয়োজন মাফিক জল ঢেলে শক্ত করে মাখা হয়। এবার আসে একটি জলভর্তি বাটি। ওঝা মাখা আটা থেকে একটু করে আটা ছিঁড়ে নিয়ে একটি করে গুলি পাকায়, একজন করে সন্দেহভাজন মানুষের নাম বলে বাটির জলে ফেলতে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মে আটার গুলি ডুবে যাওয়ার কথা। যেতেও থাকে তাই। কিন্তু দর্শকরা হঠাৎ দেখতে পান একটা গুলি জলে ডুবে গিয়ে আস্তে আস্তে আবার ভেসে উঠছে। এমনটা তো ঘটার কথা নয়? কার নামে আটা ফেলা হয়েছিল? যার নামে আটা ফেলা হয়েছিল গ্রামবাসীরা তাঁকেই ধরেন। অনেক সময় ধৃত ব্যক্তি চোরাই জিনিস বের দেন। অনেক ক্ষেত্রে জানান জিনিসটা বিক্রি করে দিয়েছেন অথবা জিনিসটা যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে এখন পাচ্ছেন না। কেউ বোধহয় চোরের উপর বাটপাড়ি করেছে।

এখন দেখা যাক কিভাবে আটার গুলি জলে ভাসে। কিভাবেই বা সত্যিই চোর ধরা পরে?
আটার গুলি বানাবার সময় আটার ভিতরে মুড়ি, খই, শোলার টুকরো বা থার্মোকলের টুকরো ঢুকিয়ে দিলে এবং মুড়ি খইয়ের উপর অতি সামান্য আটার আস্তরণ থাকলে, আটার তৈরি গুলিটা সম-আয়তনের জলের চেয়ে হালকা হলে, গুলি জলে ফেলার পর ভেসে উঠবে। মুড়ি বা খইয়ের চেয়ে শোলা বা থার্মোকলের টুকরো আটার গুলিতে ঢোকালে সেই আটার গুলি আরও কম আয়েশে ভাসান যাবে।

চোর কি করে ধরা পড়ে? এটা আগেই মনে রাখা প্রয়োজন চুরি করার কথা স্বীকার করার অর্থ কিন্তু এই নয়, বাস্তবিকই সে চোর।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। যতদূর মনে আছে ঘটনাটা এই ধরনের, একটি মহিলার বিকৃত মৃতদেহ পুলিশের হাতে আসে। পুলিশ দপ্তর থেকে ছবিটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একটি পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ছবি দেখে এবং অন্যান্য পোশাক-আশাক ও চেহারার বিবরণ দেখে জানান এটি তাঁদের পরিবারের মেয়ে। মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি স্বামী-রত্নটি বউয়ের খোঁজে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন। বউ নাকি ঝগড়া করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ। শ্বশুরবাড়িতে এসেছে কি না, তারই খোঁজ করতেই স্বামী বাবাজীর এখানে আসা।

স্বামীটিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোর্টে কেস ওঠে। স্বামী শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেন, তিনিই স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন। কেসের বিবরণ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এবার ঘটে যায় আর এক নাটক। যার হত্যা নিয়ে এই বিচার, তিনি স্বয়ং আদালতে হাজির হয়ে জানান, তিনি জীবিত, বাস্তবিকই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে ঘর ছেড়েছিলেন। এতদিন ছিলেন এক বান্ধবীর বাড়িতে। পত্রিকায় তাঁর হত্যার কথা স্বামী স্বীকার করেছেন খবরটি পরে হাজির হয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া একটা অদ্ভুত ঘটনায় মিটে গেল।

স্বামীটি হত্যা না করেও কেন হত্যার অপরাধ স্বীকার করে কঠিন শাস্তিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন? সম্ভবত শারীরিক বা মানসিক অথবা শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখে সিদ্ধান্তে পৌছেছিলেন এর চেয়ে যে কোনও শাস্তিই অনেক লঘু।

ডাইনি প্রথার ক্ষেত্রেও দেখা যায় বহু ঘোষিত ডাইনি গ্রামবাসীদের অত্যাচারে ভেঙ্গে পড়েন এবং স্বীকার করেন, তিনিই ডাইনি। ঘোষিত চোর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একান্ত বাঁচার তাগিদে অপরাধ না করেও বলেন, আমিই অপরাধী।

আটার গুলি ভাসার ক্ষেত্রে যে সব সন্দেহজনক ব্যক্তির নাম গৃহস্বামী দেন, তাদের মধ্যে কেউ চুরি করতেই পারে। তার নামের গুলি ওঝা জলে ভাসালে গণপ্রহারে চোর চুরি যাওয়া জিনিস বের করে দেয়। কিন্তু যদি ভাল মানুষের নামের গুলি ভাসে তখন গণপ্রহার থেকে বাঁচতে ভাল মানুষটিও অপরাধ স্বীকার করে জরিমানা দেওয়াকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।

error: Content is protected !!