আহমদ শরীফ
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য বাণীবিদ্ধ মনমাতানো গান আছে, পামমোচন গীতিনাট্যে ব্যবহৃত তেমনি একটি গান নাটকের বক্তব্য সম্পৃক্ত হলেও বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্রভাবে ভিন্ন তাৎপর্যেও একে অনুভবের ও উপলব্ধির মাধ্যমে উপভোগ করা যায় বলে আমাদের ধারণা । এখানে পুরো গানটি তাই উদ্ধৃত করছিঃ
রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে,
অশ্রু জলের করুণ রাগে॥
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে ॥
যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,
রক্তে তোমার চরণ- দোলা লাগিয়ে দিয়ে ।
আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,
পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর ধারা জাগে,
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্ত্র জাগে
বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,
কাঁদন-বাঁধন ভাঙিয়ে দিয়ে ।
এক এক মানুষের জীবনে প্রেমের প্রভাবে ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আদর্শের প্রভাবে নতুন চেতনার ও চিন্তার প্রভাবে জীবনদৃষ্টির জীবনের গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয় । সাদামাঠা কথায় জীবনের খোল নলচে বদলে যায়। এ প্রভাব আমরা ব্যক্তিগত জীবনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্বীকার করি। এ প্রভাবের অনুগত হই । ব্যক্তির সমষ্টিতে গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি, রাষ্ট্র । আদি ও আদিমকাল থেকেই একটা গোষ্ঠী, গোত্র বা সমাজ কারো না কারো প্রভাবে, নেতৃত্বে, আদেশে, নির্দেশে উপদেশে বা পরামর্শে চালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় । এবং সেই ভাবেই কিছু নীতিনিয়ম রীতি রেওয়াজ প্রথাপদ্ধতি গড়ে ওঠে, যা জনজীবনে তাদের ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে অভিব্যক্তি লাভ করে । অতএব ব্যক্তির উপর ব্যক্তির প্রভাব যেমন পড়ে, তেমনি বড় মনের, বড় মগজের, বড় মননের, বড় মনীষার প্রভাব ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে গোষ্ঠী গোত্র দেশ জাতি প্রভৃতিকে অতিক্রম করে বৃহত্তর মানব সমাজে ছড়িয়ে পড়ে । এবং শাস্ত্রের ক্ষেত্রে তা প্রায় চিরন্তন হয়ে বহু মানুষের জীবন, জগৎ ও জীবনভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে, এভাবে পৃথিবীর ধর্ম সম্প্রদায়গুলো গড়ে উঠেছে নবী, অবতার, সন্ত, দরবেশ প্রভৃতির ব্যক্তিত্বের ও মনীষার প্রভাবে । বস্তু যেমন পুরোনো হলে রূপ বদলায় রঙ বদলায় জীর্ণতা পায়, তেমনি তত্ত্ব, তথ্য ও সত্যও কালে কালে বিবর্তন ও বিকৃতি পায় অনেক সময়ে তাৎপর্য হারিয়ে উপযোগরিক্ত হয়ে রীতিরেওয়াজের প্রথাপদ্ধতির অসার্থক অংশ হয়ে টিকে থাকে এবং কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ করে বেশি । কাজেই বস্তু যেমন চিরকাল ব্যবহার্য থাকে না, তত্ত্ব, তথ্য এবং সত্যও তেমনি কালক্রমেও ও প্রজন্মক্রমে পরিবর্তিত প্রতিবেশে, অবস্থায় ও অবস্থানে তার তাৎপর্য ও উপযোগ হারায়, তখন তা বর্জন করাই বাঞ্ছনীয় কল্যাণকর হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ জীবিকাচিন্তায় প্রাধান্য দেয় বলে এবং প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকে বলে তাদের আস্তিক্যবোধের শাস্ত্রচিন্তার রূপ-স্বরূপ বিচারে-বিশ্লেষণে কখনো মনোযোগী হয় না । ফলে আশৈশব শ্রুত, প্রাপ্ত ও দৃষ্ট গতানুগতিক বিশ্বাসে সংস্কারে ও ধারণায় চালিত হয়ে সারা জীবন নিঃসংশয় জীবন-যাপন করে । মনে করে এর চেয়ে শ্রেয়স কোন মত-পথ-নৈতিক চেতনা বা আদর্শ অথবা জীবনদৃষ্টি হতেই পারে না । এ হচ্ছে এক রকমের মূর্খের স্বর্গে বাস করা এবং এই নিশ্চিন্ত নিষ্ক্রিয় গতানুগতিক জীবনে তাই তাদের অন্ধতা ঘোচেনা, মানবিক গুণেরও হয় না বিকাশ । এমনকি অধিকাংশ মানুষ থেকে যায় নিতান্ত প্রাণীর স্তরেই । তারা লৌকিক স্থানিক অলৌকিক অলীক উপযোগরিক্ত বিশ্বাসে, সংস্কারে ধারণায় খাঁচায় বন্ধ পাখির মতো এক ঘেয়ে জীবন যাপনে থাকে তুষ্ট তৃপ্ত ও হৃষ্ট, অথচ প্রতিদিনের নতুন সূর্যের সঙ্গে তাল রেখে নতুন নতুন চিন্তায় ও চেতনায় মন মগজ মনন মনীষা রাঙিয়ে না তুললে নতুনভাবে চিন্তায় কর্মে ও আচরণে নতুন কিছু যুক্ত না হলে জীবন যে পিছিয়ে পড়ে, মগজ মনন মনীষা যে গতানুগতিক ধারায় আবর্তিত হয়, চিত্তলোকে নতুন চেতনার ও আনন্দের সঞ্চার পন্থা রুদ্ধ হয় তা তাদের ধারণার মধ্যেও থাকে না । ভাববাদী কবির এই কবিতা বা গান আমরা উদ্ধৃত করেছি অন্তরে ভক্তিভাব জাগানোর জন্যে নয়। কোন আধ্যাত্মিক অনুভূতির মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যেও নয় । আমরা শেষের দিকের কয়েকটি চরণের আক্ষরিক রূপায়ণ জীবনে কাম্য বলেই মনে করি সমকালীন জীবনের চাহিদা পূরণের জন্যে অনুপ্রাণিত
হওয়ার লক্ষ্যে চরণগুলো এই-
আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,
পাষাণ গুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্ত্র জাগে ।
বিশ্বনাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,
জীবনকে কালোপযোগী করে গড়ার জন্যে, চালিত করার জন্যে এবং উপভোগ করার জন্যে আর সার্থক করার জন্যেই চাই বটে যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক জীবন, যন্ত্র বিজ্ঞানে বাণিজ্যে এবং সম্পদ সঞ্চয়ে গুরুত্ব । এছাড়া একালে ফ্রিথিংকার না হলে কারো পক্ষে মুক্ত চিন্তা ও শ্রেয়স চেতনা নিয়ে যুক্তি ও বুদ্ধি গ্রাহ্য জীবন যাপন সম্ভব নয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, সাংস্কৃতিক জীবনে, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে আর বৈষয়িক ও আন্ত জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধ রক্ষায় এমনি এক জাগ্রত জীবনপদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন । নইলে আমরা ক্রয় করা যন্ত্রে ব্যবহারিক জীবনে আধুনিক থাকব বটে, কিন্তু মানসিক জীবনে সেই হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার বছর আগেকার জীবনের পুরোনো জগতেই বাস করব । সেই জীবন কারো অভিপ্রেত হতে পারে না, কেন না মনে, মগজে, মননে, মনীষায় সমকালীনতা না থাকলে, তা জীবনের সম্পদ না হয়ে জীবনের বোঝা হয়েই দাঁড়ায় । আমাদের সর্বপ্রকারে রেনেসাঁসপন্থী হতে হবে । অতীত ও ঐতিহ্যমুখিতার নাম হচ্ছে রিভাইভ্যালিজম, তা কাম্য নয় ।
সমাজের মানুষকে নতুনভাবে চিন্তায়, চেতনায়, কর্মপ্রেরণায় রাঙিয়ে দেওয়ার মতো, জাগিয়ে দেওয়ার মতো, মনে ধরিয়ে দেওয়ার মতো, মর্মে লাগিয়ে দেওয়ার মতো মনীষা সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান লোকের আবির্ভাব সবসময়ে কাম্য হলেও দেখা যায় কোটিতে গুটিকও মেলে না শতাব্দীর পর শতাব্দীর কালের পরিসরেও কোন কোন দেশে বা সমাজে । তাই সংস্কৃতিতে সভ্যতায় মানুষের কোন অগ্রগতি হয় না, লাটিমের মতো গতানুগতিক অভ্যস্ত রীতিতে জীবন অবক্ষয়গ্রস্ত হয় মাত্র। আমাদের দেশে আমরা এই রাঙিয়ে দেয়ার মতো, জাগিয়ে দেবার মতো, মুক্তির স্পৃহা জাগানোর মতো মানবিক গুণে আত্ম-বিকাশে অনুপ্রাণিত হবার মতো মানবতায় ও মনুষ্যত্বে ঋদ্ধ হওয়ার প্রবর্তনা দেওয়ার মতো লোক চাই । এ লোক আমাদের বিরলতায় দুর্লক্ষ্য। আমাদের অতীত ও ঐতিহ্যমুখিতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে যুক্তি-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রয়োগে যৌক্তিক বৌদ্ধিক জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্যে আমরা সাহিত্যে, শিল্পে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, যন্ত্র আবিষ্কারে- নির্মাণে, সম্পদ সৃষ্টিতে, বাণিজ্যে সংস্কারমুক্ত স্বাধীন চিন্তা- চেতনা সম্পন্ন মানববাদী ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বের, মনীষার প্রত্যাশী ।
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ