বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে হার, দুল, আংটি, টাকা পয়সা বা ঘড়ি- এমন ক্ষেত্রে এই একবিংশ শতাব্দীতে পা বাড়াবার মুহূর্তেও অনেকেই থানা-পুলিশ করার চেয়ে গুণীনের দ্বারস্থ হোওয়াটাই বেশি পছন্দ করেন।

শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ ও আদিবাসী সমাজের মানুষরাই গুণীনের চোর ধরার ক্ষমতায় বেশি রকম আস্থাবান। গুণীনদের অনেকেই চোর ধরতে সন্দেহজনকদের ‘চাল-পড়া’ খাওয়ায়।

চোর ধরতে চাল-পড়ার প্রচলন বহু প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। চাল-পড়া জিনিসটা কি? আসুন ছোট্ট করে বলি। ধরুন আপনার বাড়িতে চুরি হয়েছে। বুঝতে আপনার অসুবিধে হয়নি, এ সিঁধেল চোরের কান্ড নয়। আপনারই চেনা-জানা, বাড়ির কাজের লোক অথবা পাড়ারই কোনও হাত-টান দু’চারজনকে সন্দেহ করছেন। হাতে-নাতে প্রমাণ নাই, তাই বসে বসে হাত-কামড়ানো ছাড়া কোনও উপায় নেই বলে যখন ভাবছেন, ঠিক তখনই খবর পেলেন তিন মাইল দূরের সাঁওতাল পল্লীর কার্তিক মুর্মু খুব বড় গুণীন। অব্যর্থ ওর চাল পড়া। আপনি হারানো জিনিস ফেরত পেতে পুলিশের ওপর নির্ভর করাটা ডাহা বোকামো ধরে নিয়ে কার্তিক মুর্মুর দ্বারস্থ হলেন। কার্তিক জানালেন কবে কখন যাবেন। আপনাকে নির্দেশ দিলেন সেই সময় পরিবারের সকলকে এবং সন্দেহজনকদের হাজির রাখতে। সময় মত কার্তিক এলেন। সঙ্গে এক ফুলধারিয়া। শুরু হল কার্তিকের বকবকানি। তার মন্ত্রঃপূত চাল পড়া খেয়ে কোন গ্রামের কে কবে মারা গেছে তার এক দীর্ঘ ফিরিস্তি পেশ করে উপস্থিত অনেকেরই পিলে চমকে দিলেন। যারা হাজির রয়েছে তারা চাল পড়া খাইয়ে চোর ধরার অনেক কাহিনীই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। তাই কার্তিক যখন বলল, সে চালে মন্ত্র পড়ে দেওয়ার পর প্রত্যেককে খাওয়াবে, যে চুরি করেছে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হবে, বুক ধড়ফড় করতে থাকবে, চুরির কথা স্বীকার না করলে মুখ থেকে রক্ত উঠে মারা যাবে- তখন কার্তিকের কথায় অবিশ্বাস করার কোনও কারণ উপস্থিত কেউ খুঁজে পেল না।

আপনার গৃহিণীর কাছ থেকে সামান্য চাল নিয়ে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন কার্তিক। সে কি মাথা ঝাঁকানি। ফাঁপানো বাবড়ি চুলগুলো উথাল-পাথাল করতে লাগলো। কার্তিকের শরীর দুলতে লাগল, মাঝে মাঝে হুঙ্কার। এক সময় রক্ত লাল চোখ মেলে কার্তিক এক একজনকে ধরে ধরে খাওয়াতে লাগলো মন্ত্রঃপূত চাল বা চাল পড়া। এরপর তিন রকমের যে কোনও একটি ঘটনা ঘটতে পারে। একজন চাল পড়া হাতে পেয়ে মুখে পোরার পরিবর্তে আশেপাশে পাচার করার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলে একবার গুণীনের কাছে আছড়ে পড়ে, একবার আপনার পা ধরে, অপরাধ স্বীকার করে বার বার ক্ষমা চাইতে পারে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটতে পারে এই ধরনের- চাল পড়া খাওয়া মানুষদের মধ্যে একজন কেমন যেন অসুস্থবোধ করতে থাকে। শ্বাস কষ্ট হতে থাকে, বুক ধড়ফড় করতে থাকে, বুক জ্বলে যায়, চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায় আতঙ্কে। নিজেকে বাঁচাতে অপরাধ স্বীকার করে। গুণীনের পায়ে মাথা কুটে বার বার করুন আবেদন জানাতে থাকে- ‘মরে গেলাম, আর সহ্য করতে পারছি না, মন্ত্র কাটান দাও।’

আবার এমন ঘটতে পারে, সবাইকে চাল পড়া খাওয়াবার পরেও কারও শরীরেই সামান্যতম অস্বস্তি দেখা গেল না, অপরাধী ধরা পড়লো না। গুণীন ঘোষণা করলো, ‘যারা এখানে উপস্থিত তাদের মধ্যে চোর নেই।’ গুণীনের এই ঘোষণাকে অনেক মানুষই সত্য বলে মেনে নেয়।

ঘটনা তিনটিকে আমরা একটু যুক্তি দিয়ে বিচার করি আসুন। চাল পড়ার ক্ষেত্রে এই তিন ধরনের যে কোনও একটি ঘটনাই ঘটে থাকে- তবে হয়তো সামান্য রকমফের করে। এর কোনটিই চাল পড়ার অভ্রান্ততা বা অকাট্যতার প্রমাণ নয়। চাল পড়া না খেয়েই চোর কেন অপরাধ স্বীকার করে এটা নিশ্চয়ই আপনারা প্রত্যেক পাঠক-পাঠিকাই বুঝতে পেরেছেন। গুণীনের কথায় চোর বিশ্বাস করেছে। তাই চাল খেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে অপরাধ স্বীকার করাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছে।

চাল পড়া খেয়ে কেন চোরের শারীরিক নানা অসুবিধে হতে থাকে, সে বিষয়ে নতুন করে বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখি না। কারণ ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’-এর প্রথম খন্ডে এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা বহু উদাহরণ সহ হাজির করা হয়েছে। যারা এখনও প্রথম খন্ড পড়ে উঠতে পারেননি, তাঁদের জন্য খুব সংক্ষেপে দু’চার কথায় ব্যাখ্যা হাজির করছি।

যে সব সন্দেহভাজনদের চাল পড়া খাওয়ানো হয়, তাদের মধ্যে চোর থাকতেই পারে। চোরের মনে চাল পড়ার প্রতি ভীতি থাকতেই পারে। যে সব আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু ইত্যাদির মধ্যে সে বড় হয়েছে তাদের অনেকের কাছেই হয় তো নানা অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছে, শুনেছে তুক-তাক, ঝাড়ফুঁকের নানা বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা। পড়তে জানলে ছোটবেলা থেকেই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি পড়ে অলৌকিক নানা ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে অলৌকিকতার প্রতি বিশ্বাস। অনেক সময় চেতন মন অনেক অলৌকিক কাহিনীকে অগ্রাহ্য করতে চাইলেও মনের গভীর তিল তিল করে গড়ে ওঠা অলৌকিক বিশ্বাস কিন্তু দুর্বল মুহূর্তে আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

চোর হয়তো ইতিমধ্যে মা-ঠাকুমা, পাড়া-পড়শী অনেকের কাছেই চাল পড়া খাইয়ে চোর ধরার অনেক গাঁ শির-শির করা ঘটনা শুনেছে। শুনেছে চাল পড়া খেয়ে চোরের বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা ইত্যাদি নানা গল্প। বিশ্বাসও করেছে। হয়তো গুণীনের দেওয়া চাল পড়া খাওয়ার আগে গুণীনের ক্ষমতা বিষয়ে সন্দেহ ছিল। এমনও হতে পারে, মন্ত্র-শক্তির প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল না। আর তাইতেই খেয়ে ফেলেছে। খাওয়ার পর দ্বিধাগ্রস্থ দুর্বল মনে চিন্তা দেখা দিল- চাল পড়ার সত্যিই যদি ক্ষমতা থাকে তবে তো আমি মাতা যাবো। মৃত্যুর আগে আমার শ্বাসকষ্ট হতে থাকবে, বউ ধড়ফড় করবে, বুক জ্বালা করবে। আমার কি তেমন করছে? কোনও অস্বস্তি কি শরীরে অনুভব করছি? হ্যাঁ। আমার যেন একটা অস্বস্তি লাগছে! দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুকেও যেন কেমন একটা জ্বালা জ্বালা করছে? আমি মিথ্যে ভয় পাব না। কিন্তু এ তো মিথ্যে ভয় নয়। সত্যিই তো বুকে জ্বালা করছে। বুক জ্বলে যাচ্ছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।

বাস্তবিকই চোরটি তখন এইসব শারীরিক কষ্ট অনুভব করতে থাকে। চাল পড়ার ক্ষমতার প্রতি চোরটির বিশ্বাস বা আতঙ্কই তার এই শারীরিক অবস্থার জন্য পুরোপুরি দায়ী। এই শারীরিক কষ্টগুলো সৃষ্টি হয়েছে মানসিক কারণে, চাল পড়ার অলৌকিক ক্ষমতায় নয়।

একটি মাত্র উদাহরণ হাজির করে আপনাদের ধৈর্যের ওপর অত্যাচার থেকে বিরত হবো। ৮৮ সালের ঘটনা। ডাইনি সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার তখন রমরমা বাজার। পত্র-পত্রিকা খুলেই ঢাউস-ঢাউস ঈপ্সিতা, ঈপ্সিতার নাম, অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পত্র-পত্রিকাগুলোর প্রচারের ঠেলায় আমাদের সমিতির সভ্যদের তখন পিঠ বাঁচানোই দায়। ঠিক করলাম, ঈপ্সিতার মুখোমুখি হবো। শুনে আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির জনৈক সদস্য আমাদের বললেন, ‘আরে ধু-র, ঈপ্সিতার কোনও ক্ষমতাই নেই। ওর বুজরুকি ফাঁস করতে আবার সময় লাগে? গিয়ে একবার চ্যালেঞ্জ করুন না, ভুডু বাণ মেরে আপনাকে মেরে ফেলতে; দেখি কেমন ভাবে মারে?’

বললাম, ‘ঠিক আছে, তাই হবে, কাল দেখা করে সেই চ্যালেঞ্জেই জানাবো। বলবো বাণ মেরে আপনাকে মারতে।‘

শুনেই উনি হঠাৎ দপ করে রেগে উঠলেন। বললেন, ‘আমাকে কেন মারতে বলবেন? চ্যালেঞ্জ জানান আপনি। আপনি নিজেকে মারতে বলুন।‘

পরের দিন রাত ন’টা নাগাদ আমার বাড়িতে হাজির হলেন ওই সদস্য। সরাসরি জানতে চাইলেন ঈপ্সিতাকে বাণ মারার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছি কি না। বললাম, জানিয়েছি। এবং আমাদের সমিতির তরফ থেকে আপনিই বাণের মুখোমুখি হতে চান, এ কথাও জানিয়েছি। আমার কাছ থেকে আপনার কিছু পারটিকুলারস নিয়েছেন। জানিয়েছেন, তিন দিন তিন রাতের মধ্যেই আপনার ওপর বাণের অ্যাকশন শুরু হবে।

ব্যাংক আন্দোলনের নেতা ওই তরুণ তুর্কি আমার কথা শুনে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। তারপর বার কয়েক মিন মিন করে বললেন, ‘আমি তো ওঁকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইনি। আমাকে এর মধ্যে জড়ান নীতিগত ভাবে আপনার উচিৎ ছিল না।‘

পরের সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই খবর পেলাম, তরুণ তুর্কির স্ট্রোক হয়েছে। দৌড়লাম দেখা করতে। প্রথমেই ওঁর স্ত্রীর মুখোমুখি হলাম। আমাকে জবাবদিহী করালেন, ‘আপনার কি উচিৎ ছিল, ঈপ্সিতার বিরুদ্ধে আমার হাসব্যান্ডকে লড়িয়ে দেওয়া?’

বুঝলাম কোথাকার জল কোথায় গড়িয়েছে। আসামী আমি রোগী ও তার স্ত্রী দুজনের কাছেই এবার সত্য প্রকাশ করলাম, ‘ঈপ্সিতার সঙ্গে ভুডু মন্ত্রে কাউকে মারবার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাই হয়নি। মজা করতে আর কিছুটা পরীক্ষা করতেই মিথ্যে গল্পটা ফেঁদেছিলাম।‘

এক্ষেত্রে তরুণ বন্ধুটি ঈপ্সিতার ক্ষমতায় বিশ্বাস করে আতঙ্কের শিকার হয়েছিলেন। হয় তো মরেও যেতেন। মারা গেলে যেতেন ঈপ্সিতার অলৌকিক ক্ষমতায় নয়, ঈপ্সিতার অলৌকিক ক্ষমতার আতঙ্কে।

error: Content is protected !!