চার্বাক মতবাদ একই সঙ্গে নিরীশ্বরবাদী, অনাত্মাবাদী ও ভূতবাদী। ভারতের প্রথম বস্তুবাদী চিন্তার প্রতিফলন হয়েছিল চার্বাক মতবাদে। এই দর্শনের আরও একটা নাম বস্তুবাদী দর্শন। প্রাচীন বস্তুবাদী মতবাদের নামটা নিয়ে একটু আলোচনা স্বল্প পরিসরে সেরে নেওয়া যাক।
‘চার্বাক’ কথাটা কোথা থেকে এলো? অনেক দার্শনিকের মতে ‘চারু + বাক্ থেকে চার্বাক কথাটা এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক ভোগ প্রবৃত্তির কথা যে মতবাদ চারু’ বা সুন্দর করে বলে, তাই চার্বাক মতবাদ। চার্বাক মতে, ইহ জগতেই সব কিছুর শেষ। মৃত্যুর পরে অন্য জগৎ বলে কিছু নেই। অতএব ভোগ কর।
অন্য মতে ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) করে যে—এই অর্থে চার্বাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলতে চান—চর্ব-চোষ্য খানা-পিনার মধ্যেই জীবনের চরমতম সার্থকতা যে মতবাদ খুঁজে পায়, তার-ই নাম চার্বাক দর্শন।
ব্যাকরণ মানতে গেলে দুটো মতকেই বাতিল করতে হয়। ‘চারু + বাক্’ থেকে ‘চারুবাক্’ অথবা ‘চার্বাক্’ বা ‘চার্বাক’-এর ‘ক’-এ হসন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে। আবারে ‘চর্বণ করে যে’ সে চার্বাক’ নয় চার্বক’, অর্থাৎ ‘ব’-এ আ-কার হবে না ।
পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস ডেভিডস (Rhys Davids)-এর মতে মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাক-এর নাম থেকেই ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারতে আছে—চার্বাক ছিল দুর্যোধনের বন্ধু আর এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ তাঁদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাক-এর আসল পরিচয় জেনে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন।
প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবদেটির প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে মতবাদটির নাম রেখেছিলেন।
সে’যুগের কিছু ভাববাদী, চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে—অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করলেন বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধঃপাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ভ্রান্ত মতবাদ রচনা করলেন। তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হল।
এখানেও দেখতে পাই—বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদ-ই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল—এই রকম প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা স্পষ্ট।
শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা এই বস্তুবাদী মতবাদকে ‘লোকায়ত’ নামে অবহিত করার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন—দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই ‘লোকায়ত’ দর্শন। এখানে ভাববাদী দার্শনিকদের লোকায়ত মতবাদের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট।
অনেক পাঠক-পাঠিকার মনেই এ-চিন্তা নিশ্চয়ই উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে, চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদে কী এমন কথা বলা হয়েছে, যা অবহেলায় পাশে সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য সে যুগের রথী-মহারথী দর্শনিকদের ছিল না (যদিও প্রকৃত অর্থে তাঁরা কেউ-ই ‘দার্শনিক’ ছিলেন না।) যার ফলে ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী এই খন্ডিত দর্শনটিকে লক্ষ করে তীক্ষ্ণ আক্রমণ হেনেছেন? সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন? সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এর মতো মহাকাব্যগুলোতে ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনী, অনেক নীতিকথা। রামায়ণের অযোধ্যা-কাণ্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন,
কচিন্ন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ।।
অর্থাৎ “আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।”
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্রাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমানের জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যা কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শিয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানবজীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পুণ্যের ফল সঞ্চল করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মলাভের পরেও কেউ কি পারে সে-জীবন ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শিয়াল, সে নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মেছিল। কিন্তু সে-জন্মে চূড়ান্ত মূর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিল বলেই আজ এই শিয়াল জন্ম।
চূড়ান্ত মূর্খের মত মহাপাতকের কাজটা কী? এ-বারই বেরিয়ে এলো নীতিকথা—
অহমাংস পণ্ডিতকো হৈতুকো দেবনিন্দকঃ।
আন্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যম্ অনুরক্তো নিরার্থিকাম।।
হেতুবাদান্ প্রবদিতা বক্তা সুংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রাহ্মবাক্যেষু চ দ্বিজান্ ।।
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিকঃ।
ভাস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ।।
(শান্তিপূৰ্ব ১৮০/৪৭-৪৯ )
অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক বেদ-সমালোচক তার্কিক পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদ্যায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম তর্কবিদ্যিার প্রবক্তা। যুক্তিবলে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কিনা পণ্ডিত্যভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম ।
ভারতবর্ষে অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী দর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ‘উপনিষদ’ সাহিত্যে। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী যুক্তিবাদের সূচনা সঠিক কবে হয়েছিল বলা সম্ভব নয়। অনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘পঞ্জিকা’তে বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই।
কমলশীলের গুরু শান্তরক্ষিত নিজের মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী যুক্তি-তর্ক নির্ভর মতবাদকে তিনি ‘চার্বাক’ না বলে ‘লোকায়ত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন ।
শান্তরক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী দার্শনিকের রচনায় ‘লোকায়ত’ বা ‘চার্বাক’ নামের যুক্তি-তর্ক নির্ভর মতবাদটির উল্লেখ আছে। সে-সময় ভারতীয় দর্শনের প্রথামত পরমত খণ্ডন করে নিজের মত স্থাপন করা হতো। পরমত হিসেবেই এইসব ভাববাদী দার্শনিকেরা চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক দর্শন বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে পারি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন, যা ছড়া হিসেবে প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে। অলিখিত এই ছড়াই লোকগাথার রূপ পেয়েছিল।
আত্মা অবিনশ্বর হলে তবেই মৃত্যুর পর আসে স্বর্গ বা নরক ভোগের প্রশ্ন, জন্মান্তর পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদি প্রশ্ন। আত্মা নশ্বর, হলে এইসব প্রশ্ন-ই অর্থহীন হয়ে যায়।
চার্বাক বা লোকায়ত-দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলো ইতরজন বা সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল।
চার্বাক দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে
দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভাববাদী
দর্শনের? সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা
‘অমর’ কি ‘মরণশীল’—এই নিয়ে।
লোকায়ত দর্শন মতে— কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। বিশ্বাস-নির্ভর অনুমানের সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনুমান-নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস-নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি।
প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও প্রত্যক্ষ- অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিলেন। অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশ্যই হবে ‘পূর্ব প্রত্যক্ষ’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি
ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন, ‘ঋষি’ নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে, ধর্মগুরুদের অন্ধ-বিশ্বাসকে— যার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল আত্মা সংক্রান্ত মতবাদ বা অধ্যাত্মবিদ্যা।
আজও যাঁরা বলেন, “বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং অধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব
নেই, বরং অধ্যাত্মতত্ত্বই ‘পরম বিজ্ঞান’, তাঁরা এটা ভুলে যান-
প্রত্যক্ষল জ্ঞান বা অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের
প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়। আরা
‘অধ্যাত্মতত্ত্ব’ দাঁড়িয়ে আছে ‘আত্মা অমর’
এই বিশ্বাসের উপর, যা বিজ্ঞান-
বিরোধী বিশ্বাস।
লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ-অনুগামী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিল—চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র। আর ‘আধ্যাত্মত্ত্ব’ বা আত্মার অবিনশ্বরতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা তত্ত্ব বিজ্ঞানের লক্ষণ নয়; অজ্ঞানের লক্ষ্মণ ।
লোকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্য যে যুক্তি রেখেছিলেন তা হল— লোকায়তদের মতে দেহের মূল উপাদান, জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত-পদার্থ। এই প্রতিটি ভূত-পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চয়ই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেওয়া উচিত—চৈতন্য বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক যে-সব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্যেই শঙ্করাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—জড় বা অচেতন পদার্থে গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে?
লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিও হাজির করেছে—মদ তৈরির উপকরণগুলোতে আলাদা করে কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা।
লোকায়তিকদের চৈতন্যের সঙ্গে মদশক্তির তুলনা নিয়ে কোন বিপক্ষ দার্শনিকই কূটতর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। তবে, তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তো চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন ? লোকায়ত দর্শনের আত্মা বা চৈতন্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এটাই সবচেয়ে জোরালতম যুক্তি ।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন এর বিপক্ষে জোরাল কোনও যুক্তি হাজির করতে পারেনি। প্রাচীনকালের পটভূমিতে শারীরবিদ্যার অনগ্রসরতার যুগে এই ধরনের যুক্তির কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আজ বিজ্ঞানের তথা শারীর-বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু জেনেছি। পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই জানব। যেটুকু জেনেছি, তারই ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দেহ ও মৃতদেহের ধর্ম সমান নয়। চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া ।
মৃতদেহের ক্ষেত্রে মৃতদেহেরই অংশ মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষেরও যেহেতু মৃত্যু ঘটে তাই স্নায়ুকোষের ক্রিয়াও ঘটে না, ফলে মৃতদেহের ক্ষেত্রে চৈতন্য বা চিন্তা থাকে অনুপস্থিত।
লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক যুক্তি দেখানো হয়েছে, যে’সব যুক্তি এ যুগের যুক্তিবাদীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মত। দু-একটা উদাহরণ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। মূল শ্লোক থেকে বংলা তর্জমা করলে এমনটা দাঁড়ায়—
উদাহরণ- ১ : ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত।
এ-ছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।
উদাহরণ- ২ : যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ।
তবে, নেভা-প্রদীপে দিলে তেল উচিত জ্বলন ।।
উদাহরণ- ৩ : পৃথিবী ছেড়ে যে ভূতপদার্থে ফেরে
তার পাথেয় দিতে পিণ্ডদান বৃথা।
যেমন, ঘর ছেড়ে যে গ্রামান্তরে
তার পাথেয় (খাদ্যবস্তু) ঘরে দেওয়া বৃথা।
উদাহরণ- ৪ : চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা?
তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা।।
উদাহরণ- ৫ : যদি, জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে
বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে।
তবে, পিতাকে পাঠাতে স্বর্গে
ধরে-বেঁধে বলি দাও যজ্ঞে।।
উদাহরণ- ৬ : ভণ্ডরা পশুর মাংস খেতে অজুহাত চান ।
তাই তাঁরা দিয়েছেন বলির বিধান।।
বুদ্ধের যুগের পর চার্বাক দর্শনের বিকাশের কোনও খবর আমরা পাইনি। তার কারণ হতে পারে, (১) বৌদ্ধ দর্শন চার্বাক দর্শনের তুলনায় অনেক উন্নততর, সংঘবন্ধ, সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য দর্শন ছিল, (২) বৌদ্ধ দর্শনের আবির্ভাব বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বৌদ্ধ অনুরাগীদের অগ্রগমন, পিছিয়ে থাকা চার্বাক দর্শনকে আরও পিছিয়ে দিয়েছিল, (৩) চার্বাক দর্শনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মগজ ধোলাই। ফলে আমরা দেখতে পেলাম, যে শোষিত সাধারণ মানুষদের উপকারের জন্য চার্বার দর্শন আত্মাবাদ ও ঈশ্বরবাদকে শানিত যুক্তিতে খণ্ডন করেছিল, সেই শোষিত সাধারণ মানুষই একসময় চার্বাক দর্শনকে এক নীতিহীন দর্শন বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি ‘চার্বাক’ শব্দটিকে লোকে গালাগাল বলেই ভাবতে শুরু করেছিল।
উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাসীরা চার্বাকদের আরও নানা নামে চিহ্নিত করেছিল— লোকায়ত, বৃহস্পত্য, স্বাভাবিক, ভূতবাদী ইত্যাদি। চার্বাকরা মনে করতেন, জগৎ স্বভাবগতভাবেই বৈচিত্র্যময় ও বৈচিত্র্যের কারণ। অতএব ঈশ্বরকে বৈচিত্র্যের স্রষ্টা ভাবাটা ভুল। ভূতবাদী হিসেবে ওঁরা মনে করতেন—ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন) ও মরুৎ (বায়ু), এই চারটি মৌল পদার্থ থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। ধ্বংসে সবই আবার এই চার ভূতেই বিলীন হয়।
চার্বাক দর্শনও সঠিক অর্থে ‘দর্শন’ নয়, সামগ্রিক জীবনদর্শন হয়ে উঠতে না পারার কারণে। তৃতীয় অধ্যায়ে ‘দর্শন’ নিয়ে যখন বিস্তৃত আলোচনায় ঢুকবো, তখন বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
“ভূতবাদ’ একটি বিপ্লবাত্মক চিন্তা
‘ভূতবাদ’ মনে করে পৃথিবীতে মৌল পদার্থের পরিমাণ পাঁচ। আবার কিছু ভূতবাদীদের মতে পৃথিবীতে মৌল পদার্থের পরিমাণ চার। এই মৌল পদার্থ থেকেই পৃথিবীর বস্তু ও প্রাণী, সবেরই সৃষ্টি। ধ্বংসে সব-ই আবার পঞ্চভূতে বা চারভূতে বিলীন হয়। এই মৌল পদার্থগুলো কী কী, তা নিয়ে একটু আগেই আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু এই চারটি বা পাঁচটি মৌল পদার্থের তত্ত্ব মেনে নিতে আমাদের অসুবিধে আছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি,
প্রকৃতিতে মোট মৌলপদার্থের সংখ্যা ১০৫টি। ১০টি মৌল পদার্থ তৈরি
করা সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম উপায়ে। অর্থাৎ এই ১০টি গবেষণাগারে তৈরি।
সংখ্যা তত্ত্ব ছেড়ে ভূত তত্ত্বে ফিরলে স্বীকার করতেই হয়, দু’আড়াই
হাজার বছর আগের কিছু চিন্তাবিদ কী অসাধারণ
বিপ্লবাত্মক চিন্তায় পৌঁছেছিলেন—মৃত্যুর
পর মৃতদেহ মৌল পদার্থে
বিলীন হয়ে যায়।
সব শেষ হয়ে যায়। দেহাতীত আত্মা বলে কিছু নেই। এমন চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিল সম্ভবত মৃত্যুর পর দেহের পরিণতি দেখে, অস্ত্র ও তৈজসপত্রের ভঙ্গুরতা দেখে। মৃতদেহকে পচে-গলে মাটিতে মিশতে দেখেছে। পুড়ে শেষ হতে দেখেছে। দেখেছে আগুনের শিখাকে বাতাসে লাফিয়ে উঠতে। দেখেছে ধোঁয়াকে বাতাসবাহী হয়ে আকাশে মিলিয়ে যেতে। নদীতে ভাসমান দেহকে জলেই বিলীন হতে। ভাঙা হাঁড়ি-কুড়ি, মরা গাছকে দেখেছে এক সময় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। অনুমান করা যেতে পারে, তাদের এসব প্রত্যক্ষ প্রমাণ চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বে পৌঁছে দিয়েছিল।
সে সময়ের প্রেক্ষিতে চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বকে অবশ্যই অসাধারণ বলতেই হয়। দুঃখ এই, আজকের যুগে মৌল পদার্থ নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা যখন বিশাল রকম এগিয়ে গেছে, এগিয়েছে শরীর বিজ্ঞান, তখনও এ’দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর দেহ মাটিতে পুঁতে ফেলার পর বা আগুনে পুড়িয়ে দেবার পরও সব শেষ হয় না। বেঁচে থাকে আত্মা, অর্থাৎ চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন।
আড়াই হাজার বছরে বিজ্ঞান অনেক এগোলো, কিন্তু আমাদের
চেতনা এগোল কই! আমরা তো যুক্তিহীনতার আবর্তে
তলিয়ে যাচ্ছি। এই অধঃপাতকেই কি
মেনে নেবো আমরা?
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি