শুনেছিলাম ‘ফকিরবাড়ি’ কল্যাণীর কাছে। কিন্তু বারাসত পার হওয়ার পরই রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়তে লাগল, স্লোগান-লেখা রঙিন পোস্টার—‘চলো যাই ফকিরবাড়ি’। এই পোস্টার কলকাতার রাস্তায় আর লোকাল ট্রেনের কামরায় প্রায়ই চোখে পড়ে আজকাল। কলকাতা থেকে ৫০ কিলোমিটারের পথ গাদামারা হাট। হাট পেরলেই ডাইনে খোয়ার রাস্তা। ও রাস্তা ধরে এগোলে

ফকিরবাবা

পথ হারাবার উপায় নেই। প্রতিটি ল্যাম্ব-পোস্টে পথ-নির্দেশঃ ‘ফকিরবাড়ি এই পথে। হাইওয়ে ছেড়ে ২ কিলোমিটারের পথ গাজিপীরের মাজার। মাজারের কোল ঘেঁষে বাংলো প্যাটার্নের একতলা ‘ফকিরবাড়ি’। অঞ্চলটার নাম ‘পশরডাঙা’। ফকির এস পি আলি ওরফে শেখ পাঞ্জাব আলির বয়স ৫৮ চলছে। দেখলে অবশ্য ৪০-এর ধারে কাছে বলেই মনে হবে। কথাবার্তায় ভীষণ রকম ঝকঝকে। শৈশব থেকেই কবিরাজি ওষুধ, মলম, মাজন ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করছেন বাংলা, বিহার আসাম, ওড়িশা ও উত্তরপ্রদেশের হাটেবাজারে। ফকিরসাহেব জানালেন, ওঁর বাপঠাকুর্দারা ছিলেন এ গাঁয়ের জমিদার। বংশপরম্পরায় পীর ওঁরা। পীরের বংশধর হিসেবে শৈশব থেকেই টুকটাক অলৌকিক ক্ষমতা পেয়েছিলেন ফকির এস পি আলি। চূড়ান্ত অধিকারী হন ১৯৮৭-র সবে বরাত-এর রাতে। বন্ধ ঘরে একা বসেছিলেন ফকির সাহেব। হঠাৎই তাঁর সামনে হাজির হলেন মাজারের পীর মানিকপীর। মানিকপীরকে মানুষ শেষ দেখেছিল, তা প্রায় ৫০০ বছর আগে। মানিকপীর দুয়া-কালাম করে তিনবার ফু দিলেন ফকির সাহেবের শরীরে। বললেন, ‘তোরে দিয়েই আমি মানুষের উপকার করব।’ মানিকপীর মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু মেলাল না মানিক পীরের কথার সত্যতা। তারপর থেকে নিশ্চিত প্রতিকারের জন্য শনি, মঙ্গল, অমাবস্যা, পূর্ণিমায় হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন। কঠিন রোগ, বিবাহে বাধা, প্রেমে বিরোধ, চাকরিতে বাধা, বাণমারা রোগী, ভূতে পাওয়া, জিনে পাওয়া, এমনি সাত-সতের সব সমস্যারই গ্যারান্টি দিয়ে সমাধান করেন। গ্রহের বিরূপতারও প্রতিকার করেন। ভাগ্য জানতে হাত দেখার ছক দেখার প্রয়োজন হয় না। মানিকপীরের কৃপায় মানুষ দেখলেই ভূত-ভবিষ্যৎ জানা হয়ে যায় তাঁর। এসব ফকির সাহেবই বললেন। আমি শুধু কথাগুলি ক্যাসেটবন্দি করলাম।

একইভাবে আগুনের গোলা করছেন এক সাধু

এটা ছিল প্রথম সাক্ষাৎকার ১০ সেপ্টেম্বর ‘৯৩ শনিবারের বিকেলে। সেদিন কথার মাঝখানে হঠাৎই উত্তেজিতভাবে ফকির সাহেব বললেন, ‘যুক্তিবাদী সমিতির প্রবীর ঘোষকে ৫০ হাজার টাকা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি : উনি প্রমাণ করুন, আমি বুজরুক।’ আমাকে চিনতে পারলেন না। দাবি মতো যদিও মানুষ দেখলেই মানুষটির নাড়ি-নক্ষত্রের খবর জানার কথা তাঁর। তবু, আর একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। গলার স্বরে আকুতি মিশিয়ে বললাম, ‘বয়স হল ৫০। বিয়ে হয়নি আজও। মা মারা গেছেন। বাবা হাঁপানি রোগী। যাকে ভালবাসতাম, তার ব্লাড-ক্যানসার ধরা পড়ল। আমার সঙ্গে বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পর, হপ্তা ঘোরার আগেই ওর মৃত্যু। সেই শোক, স্মৃতি আজও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবু, এখন বিয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। কিন্তু দ্বিধা-সঙ্কোচ আজ বিয়ের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার বিয়ে কি সত্যিই হবে।’

ফকিরবাবা ধ্যানস্থ হলেন। একটু পরেই বললেন, ‘আপনার বিয়েতে বাপা দিয়েছে আপনার প্রেমিকার মৃত্যু। সে মৃত্যু-শোক আজও ভুলতে পারেননি। দেখতে পাচ্ছি, আপনার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে-শোক আপনি সহ্য করেছেন। আমি একটা তদ্বির করে ভাবিজ দিচ্ছি। আমি মানিকপীরের নামে বলছি, এটা ডান হাতে ধারণ করলে, কয়েক মাসের মধ্যে আপনার কুমার-জীবনের অবসান ঘটবে।’ বেরিয়ে আসছি, ফকির সাহেব বললেন, ‘অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় আসুন। নিজের চোখেই দেখতে পাবেন আমার ক্ষমতা।’ ফকির সাহেবের কিছু আপনজন ধারালো দা দিয়ে বাখারি চাঁচতে চাঁচতে আমাদের দেখলেন আড়চোখে।

২৮ ডিসেম্বর, ’৯৩ মঙ্গলবার। ভরা পূর্ণিমা। বিকেল হয় হয়। ফকির সাহেবের অলৌকিক ক্ষমতা ক্যামেরায় বন্দি করতে ভিডিও ক্যামেরাও সঙ্গে নিয়েছি। ফকিরবাড়ির ১০ কিলোমিটার দূরে ওই অঞ্চলের থানা আমডাঙা। থানায় আমাদের পরিকল্পনা বুঝিয়ে সঙ্গে নিলাম দুই তরুণ পুলিস অফিসার সুপ্রিয় দাস ও গৌতম ঘোষকে। আজ বেজায় ভিড়। শুনলাম, সকাল থেকে ভিড় পাতলা হতে হতে এখন পড়ে আছে শুধু তলানি। কালো লুঙ্গি, কালো আলখাল্লা, মাথায় কালো রুমাল, চোখে চশমা — ফকিরবাবা বাড়ির লাগোয়া খোলা মাঠে বসেছেন। মাটির তৈরি তিনটি প্রদীপ জ্বলছে। ফকিরের বাঁ পাশে একরাশ পাকানো কাপড়ের মোটা পলতে। ডান পাশে সাজানো রয়েছে ধুনো আর কর্পূর গুঁড়ো। ফকির সাহেবকে ঘিরে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে মোট সিঁদুরের আলপনার গণ্ডি। ভক্তদের বেশিরভাগই দরিদ্র। তবে মধ্যবিত্ত এবং অর্থ-সাচ্ছল্যে ঝলমলে চেহারার নারী-পুরুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যে কেউ, যে সমস্যা নিয়েই আসুন, নিদান একটাই। সমস্যাক্লিষ্ট মানুষটি এসে বসছেন গণ্ডির ভেতর ফকিরের মুখোমুখি। ফকির সাহেব একটা কাপড়ের পলতে প্রদীপের তেলে ভিজিয়ে, প্রদীপের আগুনে জ্বালিয়ে নিয়ে যতক্ষণ বাঁ হাত নাড়তে নাড়তে দুয়া-কালাম করছেন, ততক্ষণে ফকিরের কোন এক সহযোগী সমস্যাপীড়িত মানুষটির আপাদমস্তক ঢেকে দিচ্ছেন ভিজে কাপড়ে। আর এক সহযোগী এই সময় ফকিরের প্রসারিত ডান হাতের তালু ভর্তি করে দিচ্ছেন ধুনো আর কর্পূরের মিহি গুঁড়োয়। তার ওপর চাপাচ্ছেন মেটে সিঁদুর আর ফুল। হঠাৎ এক বিকট চিৎকার ছাড়ছেন ফকির, ‘মা-লি-ক’! ছুড়ে দিচ্ছেন মুঠোবন্দি হাত। ‘বু-উ-ম’–একটা গম্ভীর আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হচ্ছে একটা আগুনেরগোলক। কাপড় জড়ানো মানুষটির গায়ে ধাক্কা খেয়ে অগ্নিগোলক মুহূর্তে লাফিয়ে উঠছে ১০/১২ ফুট। সে এক দারুণ উত্তেজক দৃশ্য। এমনই তিনবার অগ্নিগোলক সৃষ্টির পরই তাকে উঠিয়ে নিয়ে এসে পাশে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে স্নান করানো হচ্ছে এক হাঁড়ি জল মাথায় ঢেলে। স্নান শেষ হতেই ফকির সাহেবের এক সহকারী হাতে বেঁধে দিচ্ছেন তিন ফেত্তা দেওয়া মোটা সাদা সুতো। সহকারীটির শুকনো চেহারা। কাঁচা-পাকা চুল। কাঁচা-পাকা ছাগল দাড়ি। পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। মাথায় সাদা টুপি ।

গণ্ডি থেকে একজন উঠছে, আর একজন বসছে। যে উঠছে, সে স্নান করছে, হাতে সুতো বাঁধছে, প্রণামী দিচ্ছে ফকির সাহেবের বউয়ের হাতে। এমনটাই চলছিল। হঠাৎই দেখা গেল ফকিরের ছুড়ে দেওয়া ধুনো কর্পূর-সিঁদুর-ফুল আগুনের গোলা হয়ে লাফিয়ে উঠল না! ফকির আবারও ‘মা-লি-ক’ হুংকার ছুড়ছেন। ধুনো ইত্যাদি এ-বারও আগুনের গোলা তৈরি হল না ভিজে কাপড় জড়ানো মানুষটিকে ঘিরে।

ফকির হুংকার ছাড়লেন, ‘কেউ নিশ্চয়ই, দু-হাত একসঙ্গে ধরে আছেন। হাত ছাড়ুন এক্ষুনি, হাতে হাত ধরে রেখেছেন বলেই আগুনের গোলা তৈরি হচ্ছে না।’

দর্শক ও ভক্তদের মধ্যে একটা গুঞ্জন, নড়াচড়া। ফকির আবার ধুনো টুনো নিয়ে ছুঁড়লেন, এ-বার আগুনের গোলা লাফিয়ে উঠল। ভক্তেরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এটা বড় ধরনের অঘটনের হাত থেকে যেন বাঁচলেন !

ছবি তোলার বিরতি নেই। আজকাল পত্রিকার চিত্র-সাংবাদিক শান্তি সেনের ক্যামেরার পাশাপাশি ভিডিও ক্যামেরাতেও ছবি তুলছি। সব কিছু মিলিয়ে ফকির সাহেব আজ খুব ফর্মে আছেন বুঝলাম। আমাকে উদ্দেশ করে কিন্তু সক্কলকে শোনাতে বাজখাই গলায় চেঁচালেন, ‘বিজ্ঞানের যত বড় ডিগ্রি নিয়ে কেউ আসুন না কেন, এমনটা ঘটাতে পারবেন? এ-সবই মানিকপীরের ক্ষমতার চমৎকার! আনুন না যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষকে। ও তো বলে যুক্তিবাদী, সত্যানুসন্ধানী। সত্যানুসন্ধান করে বলুক—আমি বুজরুক, নাকি এটা অলৌকিক ক্ষমতা ? আপনাদের পত্রিকায় লিখুন প্রবীর ঘোষকে পঞ্চাশ হাজার টাকা চ্যালেঞ্জ করছি। ও এসে করুক এ-রকম আগুনের গোলা তৈরি। প্রবীর ঘোষ সৎ হলে এখানে আসবে, আমার অলৌকিক ক্ষমতাকে মানবে, আমার হয়ে প্রচার করবে।’

আমি জুতো খুলে গণ্ডির ভিতর ঢুকলাম। জুতো খোলার কারণ—তৈরি হয়ে থাকা পাবলিক সেন্টিমেন্টকে মর্যাদা দেওয়া। সমস্ত মানুষের দৃষ্টি আমাদের দুজনকে ঘিরে। সকলেরই কান খাড়া।

সকলকে শোনাবার মতো গলা চড়িয়ে বললাম, ‘গত ২০ নভেম্বর আপনার এখানে এসেছিলাম। আপনি আপনার অলৌকিক শক্তির সাহায্যে আমার জীবনের অনেক অতীত ও ভবিষ্যতের কথা শুনিয়েছিলেন।’

আমার কথার মাঝখানে ফকির সাহেব বললেন, ‘আমার আর অলৌকিক ক্ষমতা কোথায় ? আপনি যা দেখছেন, সে-সবই মানিকপীরের কৃপা।

বললাম, ‘আপনি সেদিন বলেছিলেন আমার বিয়ে হয়নি প্রেমিকার শোকে। ভুল বলেছিলেন । আমি বিয়ে করেছি ২৫ বছর আগে। স্ত্রী জীবিত। বলেছিলেন, আমার মা মারা গেছেন। তাও ভুল। বলেছিলেন, বাবা বেঁচে—সেখানেও ভুল করেছিলেন। আপনর মতো একজন অলৌকিক ক্ষমতাবান ফকির আমার সম্বন্ধে যা বললেন, সব ভুল বললেন! এ ব্যাপারে কী বলবেন?’

ফকিরবাবা এত মানুষের সামনে এমন অতর্কিত আক্রমণের মুখে বলতে গেলেন, ‘আমি ঠিক অমন কথা..।’ কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘আমাদের কথাবার্তা ক্যাসেট করেছিলাম, মনে আছে? আপনি বললে, এখনই বাজিয়ে শোনাচ্ছি।’ ফকিরবাবা বললেন, ‘ভুল নিশ্চয়ই বলেছি, না-হলে আপনি এ-সব কথা বলবেন কেন? আমিও তো একটা মানুষ। সব সময় কি জানতে চাইলেই বলা যায়? তার জন্য একটা সময় চাই। এই যেমন এখন, এই আসনে বসার পর মানিকপীরের কৃপায় এখন যে কোনও লোক আমার সামনে এলেই তার সব কিছু জানা হয়ে যায়। একেবারে এক্স-রে আই। যাক্ গে, অলৌকিক ক্ষমতা কি ব্যাপার নিজের চোখেই তো দেখলেন, এবার যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের কাছে আমার চ্যালেঞ্জটা পৌঁছে দিন।’

‘না না। এখনও আপনি কিছুই ঠিক-ঠাক বলতে পারছেন না। আগে বুঝবেন, তবে তো বলবেন। আপনি কি বুঝতে পেরেছেন—আমিই যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ?”

‘বাজে কথা। মিথ্যা কথা। আপনি প্রবীর ঘোষ নন। আমার ভক্তদের সামনে আমাকে অপ্রস্তুত করতে মিথ্যে কথা বলছেন।’ ফকির আবার ফর্মে ফিরলেন। হারানো জমি ফিরে পেতে গলা চড়ালেন।

কাঁধের ব্যাগ থেকে বের করলাম ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি। বইয়ে যত ছবি আছে, যাতে আমি যে প্রবীর ঘোষ, ভক্তদের সামনে প্রমাণ করা গেল খুব দ্রুত।

ফকিরবাবার অবস্থা ‘মরিয়া না মরে রাম’। ফকিরবাবা, তার দ্বিতীয় পক্ষের দজ্জাল বউ, ছেলে ও সাকরেদরা বেজায় চেঁচামেচি শুরু করলেন। পুলিশ অফিসার সুপ্রিয় দাস ও গৌতম ঘোষ আমার দু পাশে দাঁড়ালেন। আগে থেকেই ভক্ত সেজে হাজির হওয়া যুক্তিবাদী সমিতির ছেলেরা । এখন তারা আমার পাশে পাশে।

ফকির সুপ্রিয় ও গৌতমকে বললেন, ‘ও আপনারা তবে প্রবীর ঘোষকে প্রোটেকশন দিতে এসেছেন। প্রবীর ঘোষের কথায় আর যাই হোক আমার আগুনে গোলা তৈরির অলৌকিক ক্ষমতা মিথ্যে হয়ে যাবে না। কেউ পারবে? তারপর আমার মুখের কাছে তর্জনি নেড়ে বললেন, ‘আপনি পারবেন এমন করতে? পারবেন না, এর জন্য প্রচুর সাধনা চাই।’

ফকিরবাবাকে বললাম, ‘আপনার জিনিসগুলি আমাকে ব্যবহার করতে দিন। একই ঘটনা ঘটিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছি আপনি বুজরুকি।’ ব্যবহার করতে তো দিলেনই না, বরং প্রচণ্ড চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন ফকিরবাবা ও সাকরেদরা। ঘুরলাম জনতার দিকে। বললাম, ‘এই আগুনের গোলা তৈরির পেছনে কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। আপনারা প্রত্যেকেই এমনটা ঘটাতে পারবেন। জ্বলন্ত পলতে-ধরা হাতটা টানটান করে মেলে ধরে, আর এক হাতে ধুনো ও কর্পূরের গুঁড়ো এমনভাবে ছুড়ে দিন যাতে ওই গুঁড়ো পলতের আগুন ছুঁয়ে যায়। তারপর তাই ঘটবে, যা ঘটাচ্ছেন ফকিরবাবা।’

ফকিরবাবা ও তাঁর সাকরেদদের সাধ্য ছিল না গণজাগরণের মোকাবিলা করেন। সুতরাং গণ্ডির ভেতর আবারও আমি। আমার সামনে সমিতির একটি ছেলেকে ভেজা কাপড় জড়িয়ে বসালাম। বা মুঠোয় ধরলাম জ্বলন্ত পলতে। ডান মুঠোয় কর্পূর ও ধুনো। তারপর ‘জয় যুক্তিবাদ’ বলে ছুঁড়লাম কপূর-ধুনো। জ্বলন্ত পলতে স্পর্শ করে বসে থাকা ছেলেটির গায়ে আছড়ে পড়ল বিশাল এক আগুনের গোলা।

উত্তেজিত ও অবাক জনতাকে বললাম, ‘এবার আপনারা হাতে হাত রেখে দিন, তাও আগুনের গোলা তৈরি হবে দেখুন ।

জনতার প্রায় সকলেই একটা হাত দিয়ে আর একটা হাত ধরে দাঁড়ালেন। তাতেও আগুন-গোলা তৈরি হল। ‘আপনাদের বিভ্রান্ত করতে, মুগ্ধ করতে ফকিরবাবা পলতের আগুনের স্পর্শ বাঁচিয়ে দু-বার মুঠো ভর্তি ধুনো-কর্পূর ছুড়েছেন। তাই দু-বার আগুন-গোলা তৈরি হয়নি।’ জনতার উল্লাসের মধ্যে আমরা গাড়িতে উঠলাম।

প্রতিবেদনটি আজকাল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় পাঁচ কলম জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়

১৯৯৪-এর ডিসেম্বরে আর একবার গিয়েছিলাম ফকিরবাড়ি। আমার ঘণ্টা কয়েক আগে গিয়েছিলেন লন্ডনের চ্যানেল ফোর-এর ডিরেক্টর-প্রডিউসর রবার্ট ঈগল সদলবলে। তাঁরা আগাম খবর দিয়ে গিয়েছিলেন। অতি সতর্কতার সঙ্গে সব কিছু দেখেশুনে ফকিরবাবাকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিলেন তাঁর এক ভক্ত ইঞ্জিনিয়ার-প্রমোটার।

আমরা আমডাঙা থানায় অপেক্ষা করছিলাম আহ্বানের। আহ্বান এলো। একটা মারুতি ভ্যানে রওনা হলাম। ভ্যানের গায়ে লেখা ‘চ্যালেঞ্জ’। সঙ্গী দু-জন পুলিশ অফিসার ও সমিতির কয়েকজন । আমরা যখন পৌঁছলাম, ফকিরবাবা তখন গণ্ডিতে মানুষ বসিয়ে আগুনের গোলা তৈরি করছিলেন। রবার্টের টিম ছবি তুলছেন। দোভাষীর কাজ করে চলেছেন সুমিত্রা। বড় একটা

বুজরুকি ফাঁস করছেন প্রবীর ঘোষ, ছবিঃ ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক

ডাইরিতে সুমিত্রার কথা থেকে প্রয়োজনীয় অংশ নোট করে নিচ্ছিলেন রবার্টের পি. এ. অ্যানা । ফকিরবাবা এদিনও দু-বার ধুনো কর্পূর ছুঁড়ে আগুনের গোলা তৈরি করতে পারলেন না । নাটকীয়ভাবে আবার সেই দর্শকদের উদ্দেশে চিৎকার—‘কে হাত বেঁধে রেখেছেন?’ সেই জনতার উস। আবার গোলা তৈরি।

ফকিরবাবার বউ ও ছেলে সুমিত্রাকে তখন বলছেন, তাড়াতাড়ি ক্যামেরা গুটোতে। বলছেন, ওই যে ওরা মারুতি ভ্যানে এল, সব গুণ্ডা। তাড়াতাড়ি চলে যান, নয় তো ওরা আপনাদের ক্যামেরা লুটে নেবে ।

ইতিমধ্যে উজ্জ্বল নেমে পড়েছে গণ্ডিতে। আবার সেই অভিনয়। এবার আমার বদলে উজ্জ্বল। ম্যালকম ক্যামেরা বন্দি করে রাখলেন সব। উজ্জ্বল তখন গোলা তৈরি করছে, আগুনের গোলা। আমরা ফিরে এলাম আমডাঙা থানায়। সেখানে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলো। ফকিরবাবার প্রতারণা ও ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৫৪’ লঙ্ঘনের জন্য। অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করলেন ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’র পক্ষে সাধারণ সম্পাদক সুমিত্রা পদ্মনাভন ও ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র পক্ষে আমি।

অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হলেন ফকিরবাবা। এই গ্রেপ্তারের খবরও প্রকাশিত হল অনেক পত্রিকাতেই। আর ঈগলের ছবি ‘গুরু ব্যাস্টার্স’ তো এখন পৃথিবীর এক অতি জনপ্রিয় ডকু-ফিল্ম। তাতেও ধরা আছে ফকিরবাবার বুজরুকি ফাঁসের ইতিহাস।

♦ কিছু কথা

প্রথম খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !

অধ্যায়ঃ তিন

♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…

অধ্যায়ঃ চার

♦ মেঠাইবাবার রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ হাড় ভাঙ্গার দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ কাকদ্বীপের দৈব-পুকুর

অধ্যায়ঃ সাত

♦ আগরপাড়ায় ‘ভূতুরে’ আগুন

অধ্যায়ঃ আট

♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা

অধ্যায়ঃ নয়

♦ কামধেনু নিয়ে ধর্মব্যবসা

অধ্যায়ঃ দশ

♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !

অধ্যায়ঃ বারো

♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ চলো যাই ফকিরবাড়ি

অধ্যায়ঃ চোদ্দ

♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !

অধ্যায়ঃ পনেরো

♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !

অধ্যায়ঃ ষোলো

♦ জলাতঙ্ক ও দৈব-চিকিৎসা

অধ্যায়ঃ সতেরো

♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন

দ্বিতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ পক্ষিতীর্থমের অমর পাখি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !

অধ্যায়ঃ চার

♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ পাথর যখন কথা বলে

অধ্যায়ঃ আট

♦ ফাঁদে পড়ে জ্যোতিষী শ্রীঘরে

অধ্যায়ঃ নয়

♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…

অধ্যায়ঃ দশ

♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও

অধ্যায়ঃ এগারো

♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর

অধ্যায়ঃ বারো

♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা

অধ্যায়ঃ তেরো

♦ নিমপীঠের গুগি মা

তৃতীয় খন্ড

♦ কিছু কথা

অধ্যায়ঃ এক

♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ

অধ্যায়ঃ দুই

♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন

চতুর্থ খন্ড

অধ্যায়ঃ এক

♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা

অধ্যায়ঃ দুই

♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা

অধ্যায়ঃ তিন

♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল

অধ্যায়ঃ চার

♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যিশুর মূর্তি থেকে রক্তপাত

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ সত্য সাঁই-এর সত্যি-মিথ্যে

অধ্যায়ঃ সাত

♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি

অধ্যায়ঃ আট

♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন

অধ্যায়ঃ নয়

♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’

অধ্যায়ঃ দশ

♦ জাতিস্মরঃ রাজেশ কুমার

♦ অলৌকিক শক্তিধরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ

“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!