শহর বরিশালের প্রায় ছয় মাইল উঃ পূঃ দিকে কীর্তন খেলা নদীর পশ্চিম তীরে চর বাড়ীয়া লামচরি গ্রামটি অবস্থিত। সাধারণ্যে ইহা “লামচরি” নামে পরিচিত। গ্রামটির বয়স দেড়শত বছরের বেশী নয়। গ্রামটি ছিল খুবই নীচু, বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকত জলমগ্ন। তাই এর নামকরণ হয়- “লামচরি” অর্থাৎ নীচু চর। এ গ্রামে লোকের বসবাস শুরু হয় মাত্র ১১৬২ সাল হতে। নবাগত বাসীন্দারা সমস্তই ছিলেন কৃষক। এই নবাগতদের মধ্যে একজন মধ্যবিত্ত কৃষক ছিলেন আমান উল্লাহ্ মাতুব্বর এবং তার তৃতীয় পুত্র এন্তাজ আলী মাতুব্বর আমার পিতা। মা বলেছেন আমার জন্ম ১৩০৭ সালের ৩রা পৌষ।
চরম দুর্দিন
লামচরি মৌজাটি ছিল লাখুটিয়ার রায়বাবুদের জমিদারীর অধীন। আমার চার বছর বয়সের সময় অর্থাৎ ১৩১১ সালে আমার পিতা পরলোকগমন করিলে ১৩১২-১৩১৫ সাল পর্যন্ত বাকি খাজানায় নালিশ করে ১৩১৭ সালে রায়বাবুরা আমার ভূসম্পত্তিটুকু নীলাম-খরিদ করে নেন এবং; কর্জ-দেনার দায়ে বসত ঘরখানা নীলাম করে নেন বরিশালের কুখ্যাত কুসীদ জীবি জনাৰ্দন সেন ১৩১৫ সালে। বিত্ত ও গৃহহীনা হয়ে অতিকষ্টে বিধবা মাতা রবেজান বিবি আমাকে প্রতিপালন করতে থাকেন।
লামচরির মক্তব
১৩৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত এখানে কোন রাস্তা হাট-বাজার, দোকান-পাট বা কোনরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবে মসজিদ ছিল কয়েক খানা। বাসীন্দারা প্রায় সমস্তই মুসলমান।
আমাদের গ্রামে নিয়মিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও -মুর্দ জানাজা, ফাতেহা ও মৌলুদ পাঠ, বিবাহের কলেমা, তালাক পড়ানো ইত্যাদি কাজের জন্য কেহ কেহ বাড়ীতে মুন্সি ধরনের বিদেশী আলেম রাখতেন। তারা সকাল-বিকেল কর্তার ছেলে-মেয়েদের বাংলা ও আরবী পড়াতেন বা মুখেমুখে-কলেমা, ছুরা-কেরাত ও নামাজ শিক্ষা দিতেন। কেহ কেহ পাড়া প্রতিবেশীর ছেলে মেয়েদেরও পড়াতেন। এ জন্য কাউকে নিয়মিত বেতন দিতে হত না। কেননা তারা ওপরী যা পেতেন, তাতেই তাদের চলত। বিবাহ-তালাকটা কচিং শহরে হলেও শরীয়তের অন্যান্য কাজগুলোতে ছিল তাদের একচেটিয়া অধিকার, অধিকন্তু কলেরা, বসন্তাদি মহামারীতে বেশী সংখ্যক লোক মারা গেলে ত কথাই ছিল না।
মুন্সি তাহের আলী
দক্ষিণ লামচরি নিবাসী কাজেম আলী সরদার সাহেব – মুন্সি তাহের আলী নামক ঐ রকম একজন মুন্সি রেখে ১৩১৯ সালে তার বাড়ীতে একখানা মক্তব খোলেন এবং গ্রামের লোকদের ছেলে-মেয়েগণকে সেখানে পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান, আমার মাকেও। মক্তবের বেতন ও পুস্তকাদি কিনে দিতে মা অপারগ বলে জানালে সরদার সাব বল্লেন যে, তিনি আমার বেতন নিবেন না এবং এ বছর বই পুস্তকও আবশ্যক হবে না। কেননা এ বছর তালপাতা ও কলা পাতায়ই চলবে। সিদ্ধ তালপাতা ও খাগের কলম নিয়ে মক্তবে যেতে শুরু করলাম।
প্রথম দিনে মুন্সি সাব একটা ছুচালো লোহা দ্বারা তালপাতায়ে স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ এঁকে দিলেন এবং পড়া বলে দিতে লাগলেন। আমি অন্যান্য ছেলেদের সাথে পড়তে শুরু করলাম। স্বর ও ব্যাঞ্জন বর্ণ পড়তে-লেখতে বছর খানেক কেটে গেল।
মুসী তাহের আলী সাব ছিলেন মূলাদীর বাসীন্দা। মক্তব বন্ধ দিয়ে একদা তিনি দেশে গেলেন, আর ফিরলেন না। পরে শোনা গেল যে, তিনি মারা গেছেন। মক্তবটি বন্ধই রইল।
মুন্সি আবদুল করিম
১৩২০ সালে স্থানীয় মুন্সি আবদুল করিম সাব তার শশুর আবদুল মল্লিকের বাড়ীতে আর একখানা মক্তব খোলেন এবং পাড়ার লোকদের কাছে ছাত্র ভর্তির আমন্ত্রন জানান। ছাত্রদের মাথাপিছু বেতন ধার্য করলেন চার আনা।
পাড়ার অনেক ছেলে মক্তবে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমার যাওয়া হল না, কেননা মা আমার বেতন দিতে পারবেন না। একদা মুন্সি সাব আমাদের বাড়ীতে এসে মাকে বল্লেন যে, আমাকে তার মক্তবে পড়তে দিলে তিনি আমার বেতন নিবেন না এবং পারেন ত কিছু সাহায্য করবেন। মা রাজী হলেন এবং আমি মক্তবে যেতে শুরু করলাম।
এ হলো আমার শিক্ষা-জীবনের দ্বিতীয় বছর। “বানান” ও “ফলা” লেখা শুরু হলো কলা পাতায়ে। লেখতে হত- বাঁশের টুনীর কলম (খাগ জুঠত না বলে) এবং মেটে দোয়াতেলেখের কালি, চাল পোড়াবাটা ভৃঙ্গুরাজের পাতার রসে তৈরী কালির দ্বারা। পয়সা এতে খরচ হত না মোটেই। কিন্তু এর পর মুন্সি সাব বল্লেন যে, আমাকে একখানা “আদর্শ লিপি” বই ও এক খানা শ্লেট কিনতে হবে। বাড়ীতে গিয়ে মাকে উহা জানালে তিনি বল্লেন- “পয়সা কই”?
মক্তবের সকল ছেলেই তাল ও কলা পাতায় পড়া-লেখা করত না, অনেকেরই আদর্শ লিপি’ বই ও শ্লেট-পেন্সিল ছিল, ছিল না মাত্র আমার মত কয়েকটি গরীব ছেলের। মক্তবে আমার অল্প কয়েক দিনের পড়া লেখার ফল ভাল দেখে আমার জ্ঞাতি চাচা মরহুম মহব্বত আলী মাতুব্বর সা’ব দু আনা পয়সা দিয়ে আমাকে একখানা আদর্শলিপি (সীতানাথ বসাক কৃত) বই কিনে দিলেন এবং জ্ঞাতি ভ্রাতা মরহুম হামজে আলী মাতুব্বর দিলেন তার একখানা ভাঙ্গা শ্লেটের আধখানা। পেন্সিল বানালাম মেটে পাত্র-ভাঙ্গা চাড়া কেটে। কোন রকম পড়া ও লেখা চলতে লাগল।
————–
(১) এর পর মুন্সি সাব ফরমায়েস দিলেন যে, একখানা “বাল্য শিক্ষা” বই কিনতে হবে। মাকে উহা জানালে তিনি আগের মতই উত্তর দেন “পয়সা কই ?”
এতদিন পর মূল্যটা ঠিক স্মরণ নাই তবে রামসুন্দর বসু প্রণীত একখানা “বাল্য শিক্ষা” ও একখানা “ধারাপাত” বই কিনে দিলেন আমাকে আমার ভগ্নিপতি মরহুম আঃ হামিদ মোল্লা এবং মুন্সি সা’ব স্বয়ং সংগ্রহ করে দিলেন আরবী কায়দা সম্বলিত একখানা “আমপারা”। এ সময় আমি পড়তে লাগলাম “বাল্য শিক্ষা” বই ও “আমপারা” এবং লেখতে লাগলাম “শতকিয়া-কড়াকিয়া” আর কষতে লাগলাম “যোগ-বিয়োগাদি (অমিশ্র) অঙ্ক”।
(২) এটা হলো আমার শিক্ষা-জীবনের তৃতীয় বছর অর্থাৎ ১৩২১ সাল। আমাদের গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই ছিলেন বিত্তবান। কিন্তু শিক্ষার প্রতি ছিলেন উদাসীন। তাই কেউই রীতিমত মুন্সি সাবকে ছাত্র বেতন দিতেন না। মুন্সি সাবও ঘরের খেয়ে পরের গেয়ে সময় নষ্ট না করে মক্তবটি বন্ধ করে দিলেন। আর এখানেই হলো-“বাল্য শিক্ষা” বই পড়ে আমার বাল্য-শিক্ষার সমাপ্তি বা সমাধি।