চণ্ডীমঙ্গলের আছে দুটি বেশ চমৎকার গল্প : একটি কালকেতু-ফুল্লরার, অন্যটি ধনপতিলহনা-খুলনার। চণ্ডীমঙ্গলের গল্প মধুর আনন্দের, বেদনার বদলে এ-গল্পে আছে সুখের কথা। বেদনা যা আছে মাঝেমাঝে, তা শুধু সুখ বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে। কালকেতু-ফুল্লরার গল্পটি আমি বলবো। স্বর্গে বেশ সুখে ছিলো নীলাম্বর। ফুল তুলে শিবপুজো করে, নিজের স্ত্রী ছায়াকে ভালোবেসে সুখে সময় কাটাচ্ছিলো নীলাম্বর। কিন্তু ক্রমশ তার ভাগ্যাকাশে দুঃখের মেঘ দেখা দিতে লাগলো। চণ্ডীর ইচ্ছে হয়েছে পৃথিবীতে তার পুজো প্রচারের। কিন্তু কে করবে তার পুজো প্রচার? চণ্ডী এ-কাজে নীলাম্বরকে মনে মনে মনোনীত করলো। চণ্ডী তার স্বামী শিবকে বললো, নীলাম্বরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও, সে পৃথিবীতে আমার পুজো প্রচার করবে। শিব বললো, বিনা অপরাধে আমি তাকে কী করে স্বর্গ থেকে বিদায় দিই? চণ্ডী মনে মনে পরিকল্পনা আঁটলো, সে নীলাম্বরকে পাঠাবেই। একদিন শিবপুজোর জন্যে বাগানে ফুল তুলছিলো নীলাম্বর। চণ্ডী সেখানে গেলো, নিজেকে বিষাক্ত কীটে রূপান্তরিত করলো, এবং নীলাম্বরের তোলা ফুলে গোপনে লুকিয়ে রইলো। ঘনিয়ে এলো নীলাম্বরের স্বর্গ থেকে বিদায়ের দিন। নীলাম্বর ফুল দিয়ে শিবপুজো করতে গেলে ফুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কীট শিবকে দংশন করলো। কীটের কামড়ে শিউরে উঠলো শিব, অভিশাপ দিলো নীলাম্বরকে, যাও পৃথিবীতে গিয়ে জন্ম নাও ব্যাধ হয়ে। শিবের অভিশাপে দেবতা নীলাম্বরের সব দেবত্ব বিলীন হয়ে গেলো। বেচারির নিজের কোনো অপরাধ ছিলো না, তবু দৈব দয়ায় তাকে চলে আসতে হলো এ-কষ্টভরা পৃথিবীতে। সে জন্ম নিলো ধর্মকেতু নামক এক ব্যাধের পুত্র হয়ে। অন্যদিকে তার স্ত্রী ছায়াও চলে এলো পৃথিবীতে অন্য এক ব্যাধের কন্যা হয়ে। নীলাম্বরের নাম হলো কালকেতু, আর ছায়ার নাম হলো ফুল্লরা।
কালকেতু ব্যাধের ছেলে, সুন্দর স্বাস্থ্যবান। বনের ভয়ঙ্কর পশুরা তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠলো। তার বিয়ে হলো এগারো বছর বয়সে ফুল্লরার সাথে। পৃথিবীতেও তারা বেশ সুখে দিন কাটাতে লাগলো। কালকেতু ছিলো অসাধারণ শিকারী, তার নিক্ষিপ্ত শরে প্রতিদিন প্রাণ হারাতে লাগলো সংখ্যাহীন বনচর পশু। ছোটোখাটো দুর্বল পশুদের তো কথাই নেই, এমনকি বাঘসিংহরাও ভীত হয়ে উঠলো। বনে পশুদের বাস করা হয়ে উঠলো অসাধ্য। পশুরা ভাবতে লাগলো কী করে রক্ষা পাওয়া যায় এ-শিকারীর শর থেকে। সব পশু একত্র হয়ে ধরলো তাদের দেবী চণ্ডীকে; বললো, বাঁচাও কালকেতুর শর থেকে। চণ্ডী বললো, বেশ। শুরু হলো চণ্ডীর চক্রান্ত। কালকেতুকে অস্থির করে তুললো সে নানাভাবে। কালকেতু জীবিকা নির্বাহ করে পশু মেরে। একদিন সে বনে গিয়ে দেখলো বনে কোনো পশু নেই। চণ্ডী সেদিন ছল করে বনের পশুদের লুকিয়ে রেখেছিলো। সেদিন কালকেতু কোনো শিকার পেলো না, না খেয়ে তাকে দিন কাটাতে হলো। পরদিন আবার সে তীরধনুক নিয়ে শিকারে গেলো। পথে দেখলো সে একটি স্বর্ণগোধিকা অর্থাৎ গুইসাপ। এজিনিশটি অলক্ষুণে; তাই কালকেতু চিন্তিত হয়ে পড়লো। রেগে উঠলো কালকেতু। সে গোধিকাটিকে বেঁধে নিলো। মনে মনে ভাবলো, আজ যদি কোনো শিকার না মেলে তবে এটিকেই খওয়া যাবে।
সেদিন কোনো শিকার মিললো না তার। সে গোধিকাটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখলো তার প্রতীক্ষায় বসে আছে ফুল্লরা। কিছু রান্না হয় নি। গতকাল তারা খেতে পায় নি, আজো খেতে পাবে না। কালকেতুকে শিকারহীন ফিরে আসতে দেখে প্রায় কেঁদে ফেললো ফুল্লরা। কালকেতু ফুল্লরাকে বললো, এ-গোধিকাটিকে আজ রান্না করো, পাশের বাড়ির বিমলাদের থেকে কিছু খুদ এনে রাঁধ, আমি হাটে যাচ্ছি। এ বলে কালকেতু চলে গেলো। তার পরেই এলো বিস্ময়, ঘটলো অভাবনীয় ঘটনা। গোধিকাটি আসলে ছিলো দেবী চণ্ডী। ফুল্লরা বিমলাদের বাড়িতে যেতেই সে এক অপরূপ সুন্দরী যুবতীর রূপ ধারণ করলো। বিমলাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে নিজের আঙ্গিনায় এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ফুল্লরা। সাথে সাথে হলো ভীতও। ফুল্লরা তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। দেবী চণ্ডী ছলনাময়ী, শুরু করলো তার ছলনা। সরলভাবে বললো, কালকেতু আমাকে নিয়ে এসেছে।
একথা শুনে ভয় পেলো ফুল্লরা। এতোদিন সে স্বামীকে নিয়ে সুখে ছিলো, ভাবলো এবার বুঝি তার সুখের দিন ফুরোলো। ফুল্লরা অনেক বুঝালো যুবতীটিকে। বললো, তুমি খুব ভালো, তুমি খুব সুন্দরী। তুমি তোমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাও, নইলে মানুষ নানা কথা বলবে। কিন্তু যুবতী ফুল্লরার কথায় কোনো কান দিলো না; বললো, আমি এখানে থাকবো। এতে কেঁদে ফেললো ফুল্লরা, দৌড়ে চলে গেলো হাটে কালকেতুর কাছে। বললো সব কথা। শুনে কালকেতুও অবাক। সে বাড়ি ফিরে এলো ফুল্লরার সাথে, এবং যুবতীকে দেখে অবাক হলো। কালকেতু বার বার তাকে বললো, তুমি চলে যাও। কিন্তু কোনো কথা বলে না যুবতী। তাতে রেগে গেলো কালকেতু, তীরধনুক জুড়লো, যুবতীকে সে হত্যা করবে। যখন কালকেতু তীর নিক্ষেপ করতে যাবে তখন ঘটলো আরো বিস্ময়কর এক ঘটনা। এবার দেবী চণ্ডী নিজের মূর্তিতে দেখা দিলো। সে-আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে পরিণত হলো দেবী চণ্ডীতে। চোখের সামনে এমন অলৌকিক ব্যাপার ঘটতে দেখে ব্যাধ কালকেতু মুগ্ধ হয়ে গেলো। চণ্ডী বললো, তোমরা আমার পুজো প্রচার করো, আমি তোমাদের অজস্র সম্পদ দেবো, রাজ্য দেবো। রাজি হলো কালকেতু-ফুল্লরা। অবশ্য দেবীর কথা প্রথমে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নি ফুল্লরা, কেননা এ ছিলো অভাবিত। দেবী সাথে সাথে সাত কলস ধন দান করলো। কালকেতু ছিলো একটু বোকাসোকা মানুষ। অভাবিত ধন পেয়ে কালকেতু বোকার মতো ব্যবহার করেছে, তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন কবি মুকুন্দরাম। কিছু অংশ তুলে আনছি :
এক ঘড়া অবশেষে দেখি মহাবীর।
নিতে নারে দেড়ি ভার হইল অস্থির।।
মহাবীর বলে মাতা করি নিবেদন।
চাহিয় চিন্তিয়া দেহ এক ঘড়া ধন।।
যদি গো অভয়া ধন না দিবা অপর।
এক ঘড়া ধন মাগো নিজ কাঁখে কর।।
অস্থির দেখিয়া বীর ভাবেন অভয়া।
ধন ঘড়া কাঁখে কৈলা বীরে করি দয়া।।
আগে আগে মহাবীর করিল গমন।
পশ্চাতে চলিল চণ্ডী লয়ে তার ধন।।
মনে মনে মহাবীর করেন যুকতি।
ধন গড়া লয়ে পাছে পালায় পার্বতী।।
কালকেতু বাঁকে করে দু-ঘড়া করে ধন নিয়ে যাচ্ছে তার বাড়িতে। ওপরের ঘটনাটি হচ্ছে তৃতীয় বার যখন সে ধন নিতে এসেছে তখনকার। সে দেখে এক ঘড়া ধন বাকি থেকে যাচ্ছে। দেবীকে ধন পাহারায় রেখে যেতে তার সাহস হচ্ছে না। তাই দেবীকে সে বলছে, যদি এ-ধন তুমি আর কাউকে না দিতে চাও, তবে একটু কাঁখে করে এক ঘড়া ধন তুমি নিজেই আমার বাড়িতে পৌছে দাও। দেবী তাতে রাজি হয়। কালকেতু আগে আগে যায়, দেবী যায় পাছে পাছে। কালকেতুর মনে বড়ো ভয় যদি দেবী ধন নিয়ে পালিয়ে যায়! একটু বেশ নির্বোধ না হলে কেউ কি এমন কথা ভাবে।
কালকেতু এ ধনে ধনী হয়ে গুজরাটে বন কেটে বিরাট নগর নির্মাণ করলো। সেখানে ছিলো ভাড়দত্ত নামের এক দুষ্ট লোক। দুষ্টরা মন্ত্রী হতে চায় চিরকালই, সেও এসে কালকেতুর মন্ত্রী হতে চাইলো। কালকেতু তাতে রাজি হলো না। এতে ভাড়দত্ত ক্ষেপে গেলো। সে চলে গেলো কলিঙ্গে, সেখানকার রাজাকে নানা কিছু বুঝিয়ে কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি করালো। বেধে গেলো যুদ্ধ। কালকেতু আগে ছিলো ব্যাধ, এখন রাজা। সে যুদ্ধ জানে না। তাই যুদ্ধে হেরে গেলো, এসে পালিয়ে রইলো, বউয়ের পরামর্শ মতো, ধানের গোলার ভেতরে। কলিঙ্গরাজ তাকে বন্দী করে নিয়ে গেলো, কারাগারে বন্দী করে রাখলো। ব্যাধ কালকেতু দেবীর বরে রাজা হয়েছিলো, এখন সে বন্দী। কারাগারে কালকেতু স্মরণ করলো দেবী চণ্ডীকে।
চণ্ডী কালকেতুর ওপর সব সময় সদয়, কেননা কালকেতু তার ভক্ত। দেবী কলিঙ্গের রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিলো। বললো, কালকেতু আমার ভক্ত, তাকে মুক্তি দাও, তার রাজ্য ফিরিয়ে দাও। কলিঙ্গরাজ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মুক্তি দিলো কালকেতুকে, ফিরিয়ে দিলো তার রাজ্য। কালকেতু তার রাজ্যে ফিরে এসে আবার রাজা হলো, রাজত্ব করতে লাগলো বেশ সুখে। ফুল্লরা তার সুখী রানী। অনেক দিন রাজত্ব করে বৃদ্ধ হলো কালকেতু আর ফুল্লরা, এবং এক শুভদিনে মহাসমারোহে আবার নীলাম্বর-ছায়ারূপে ফিরে গেলো স্বর্গে।
“লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী” উপন্যাস বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ প্রদীপ জ্বললো আবারঃ মঙ্গলকাব্য
♦ কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
♦ উজ্জ্বলতম আলোঃ বৈষ্ণব পদাবলি
♦ দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
♦ গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা