‘সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর ’

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আপনার উর্বর মস্তিষ্কের রঙিন কল্পনায়ও কি কখনো – একটিবারও মনে হয়েছে, আকাশের বুকে হাজারো লক্ষ কোটি গ্রহ-তারা-নীহারিকা আর গ্রহাণুপুঞ্জ নিয়ে তৈরি এই যে আমাদের এত পরিচিত বিশাল মহাবিশ্ব, এর বাইরেও এমনি ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্ব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে? আপনার আমার কাছে তা যতই অবিশ্বাস্য ঠেকুক না কেন, পদার্থবিজ্ঞানীরা কিন্তু খুব গুরুত্ব দিয়ে এই সম্ভাবনার ব্যাপারটি ভাবছিলেন অনেক দিন ধরেই, এবং অতি সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে, এর কিছু পরীক্ষালব্ধ প্রমাণেরও হদিস পেতে শুরু করেছেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে যাবার আগে চলুন আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নিই মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাটি আসলে কী বলছে, কিভাবেই বা এই ধারণাটি বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

 

মাল্টিভার্স কী?

অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা কিন্তু অনেক পুরনো। সেই যে প্রাচীন দার্শনিক জিয়োর্দিনো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০), যার কথা আমরা বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে জেনেছি; তিনি কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করতে গিয়ে চার্চের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। বাইবেলবিরোধী সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থনের অপরাধে ঈশ্বর-পুত্রের দল তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। সেই ব্রুনো কেবল সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করেই ক্ষান্ত হননি, ১৫৮৪ সালে একটি ভয়ংকর বই লিখে ফেলেছিলেন De l’Infinito Universo et Mondi নামে, যার বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘অনন্ত মহাবিশ্ব এবং বহু বিশ্ব নিয়ে’। সে বইটিতে তিনি অনন্ত মহাবিশ্ব থাকার জোরালো সম্ভাবনার ব্যাপারটি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী তো সৌরজগতের কেন্দ্র নয়ই, এমনকি এই মহাবিশ্বের সংখ্যাও একটি নয়, বরং এর সংখ্যা হতে পারে অনন্ত অসীম। ব্রুনো আরো বললেন, এই মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। আবার, সেরকম প্রাণওয়ালা একাধিক গ্রহ থাকতে পারে অন্য মহাবিশ্বেও।

ব্রুনোর এ ধারণাগুলো সে সময়ের তুলনায় ছিল ভীষণ বিপ্লবী, এমনকি আজকের প্রেক্ষাপটেও তা কম কী? অতিমাত্রায় আজগুবিও হয়তো বলবেন কেউ কেউ। কিন্তু তার পরও ব্রুনোর কথার গুরুত্ব কিছু কিছু দার্শনিক ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যেমন, জার্মান দার্শনিক এর্নস্ট ক্যাসির ব্রুনোর অনন্ত মহাবিশ্বের চিন্তাধারাকে ‘চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তির’ প্রথম সোপান উল্লেখ করে লেখেন ‘ব্রুনোর অসীম মহাবিশ্বের এই মতবাদটি মানুষের চিন্তার দাসত্ব থেকে সচেতনভাবে মুক্তির সর্বপ্রথম সোপান। মানুষকে আর সসীম মহাবিশ্বের সংকীর্ণ চৌহদ্দির কারাগারে বন্দী আসামির মতো জীবন কাটিয়ে যেতে হবে না, সে হবে সত্যিকারের মুক্ত বিহঙ্গ; সে ভেঙেচুরে ফেলবে কাল্পনিক যত দেয়াল, যা মিথ্যে অধিবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে তার অস্তিত্বকে বন্দী করে রেখেছিল এক স্বর্গীয় গোলকের অভ্যন্তরে। অনন্ত অসীম মহাবিশ্বের ধারণা মানুষকে দেয় মানুষ হিসেবে সত্যিকার মুক্তির আস্বাদন, সে মানুষের জন্য নির্ধারণ করে না কোনো কৃত্রিম দেয়ালের সীমা-পরিসীমা, বরং মানবযুক্তির জন্য হয়ে উঠে সত্যিকারের অনুপ্রেরণা। মানব বুদ্ধিবৃত্তি নিজের অসীমত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে উঠে অসীম মহাবিশ্বের মায়াবী ক্ষমতায়’ (Infinite worlds of Giordano Bruno by Antoinette Mann Patterson, 1970 )।

এর্নস্ট ক্যাসিরের মতো দার্শনিকেরা গুরুত্ব বুঝলে কী হবে, চার্চের মাথায় যেন বাজ পড়ল। এমনিতেই কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব সমর্থন করা নিয়ে ব্রুনোর ওপর চার্চ মহাখাপ্পা ছিলেন। তাঁরা ভাবতেন, এই পৃথিবীটা একটা বিশিষ্ট গ্রহ যা ঈশ্বরের তৈরি এক বিশেষ সৃষ্টি। পৃথিবীটা বিশিষ্ট গ্রহ বলেই পৃথিবীকে স্থির রেখে এর চারদিকে সমস্ত গ্রহ, তারিকামণ্ডলীসহ সকল মহাজাগতিক বস্তুকণা ঘুরছে। আর এ কথা সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে বাইবেলে। কাজেই কোপার্নিকাসের তত্ত্ব ছিল তাঁদের চোখে সাক্ষাৎ ব্লাসফেমি, কারণ তাঁর সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বে আস্থা রাখলে পৃথিবীর বিশিষ্টতা নিমেষেই ক্ষুণ্ন হয়ে যায়। আর এর মধ্যে অসীম মহাবিশ্ব আমদানি করলে তো পোয়াবারো মানবজাতি আর তার পুরোধা চার্চের ভূমিকাও গৌণ হয়ে যাবে। অসীম মহাবিশ্বে কি অগণিত মানবজাতি থাকবে, আর তাদের জন্য অগণিত পোপ, কিংবা অগণিত যিশু? ছি ছি রাম রাম…মাথা খারাপ নাকি? “দে শালারে পুড়াইয়া’…

ঈশ্বরপুত্রদের তাণ্ডবে ব্রুনোর নশ্বর দেহ পুড়ে ছাই গয়ে গেল। দিনটি ছিল ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ।

চার্চ হয়তো ভেবেছিল গ্যালিলিওকে অন্তরীণ করে রেখে কিংবা ব্রুনোকে পুড়িয়ে দিয়েই পৃথিবীর ঘূর্ণন থামাবেন তাঁরা। আর পুঁড়ানোর সাথে সাথেই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাও বোধ হয় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

Scientists find first evidence that many universes exist; http://phys.org/news/2010-12-scientists-evidence-universes.html

Epic Discovery Update: “We are One of Many Universes”, http://www.dailygalaxy.com/my_weblog/2010/12/epic-discovery-update-we-are-one-of-many-universes.html

Astronomers Find First Evidence Of Other Universes, http://www.technologyreview.com/view/421999/astronomers-find-first-evidence-of-other-universes/

অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ (পুনর্মুদ্রণ ২০০৬)

কিন্তু চার্চের হয়তো জানার বাকি ছিল যে, ব্যক্তিকে পোড়ানো যায়, কিন্তু তার মতবাদকে নয়। ব্রুনোর অনন্ত মহাবিশ্বের মতবাদ আবারো ফিরে এসেছে বিজ্ঞানে মূলত আধুনিক কোয়ান্টাম পদার্থবিদ এবং জ্যোতিঃপদার্থবিদদের হাত দিয়ে। আধুনিক পদার্থবিদের কিছু গবেষক অনেক দিন ধরেই আলামত পাচ্ছিলেন যে, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব এটি কোনো অনন্য বা ইউনিক কিছু নয়, বরং এমনি ধরনের হাজারো মহাবিশ্ব হয়তো ছড়িয়ে আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা একদমই ওয়াকিবহাল নই। বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর আশির দশকে ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক গণিতগুলো সমাধান করতে গিয়েই এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারটা বেরিয়ে আসছিল ক্রমশ। যাঁরা সে সময় এ নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দুজন গবেষক আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন ও আঁদ্রে লিন্ডে খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন মহাজাগতিক স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামে না। এ ব্যাপারটাকেই বিজ্ঞানীরা আজ ‘চিরন্তন স্ফীতি’ (Eternal Inflation) নামে অভিহিত করছেন। অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা মূলত এই চিরন্তন স্ফীতি তত্ত্বেরই স্বাভাবিক একটি গাণিতিক পরিণতি। অতি সংক্ষেপে অনন্ত মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ধারণাটি এরকমঃ

আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের শূন্যতার ভেতর দিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু একাধিকবার ঘটতে পারে, এবং হয়তো বাস্তবে ঘটেছেও। এই একাধিক মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ব্যাপারটি প্রাথমিকভাবে ট্রিয়ন আর পরবর্তীতে মূলত আঁদ্রে লিন্ডে ও আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিনের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সৃষ্টির উষালগ্নে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদ (Expanding Bubbles) থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে সংস্পর্শবিহীন অবস্থায় দূরে সরে গেছে। এ ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্বের একটিতেই হয়তো আমরা অবস্থান করছি অন্যগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে একেবারেই জ্ঞাত না হয়ে।

চিত্রঃ আঁদ্রে লিন্ডের দেওয়া তত্ত্ব কেওটিক ইনফ্লেশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সম্প্রসারিত বুদ্বুদ এবং প্রতিটি সম্প্রসারিত বুদ্বুদই আবার জন্ম দিয়েছে এক-একটি 'বিগ- ব্যাং'-এর। আর সেই এক একটি বিগ-ব্যাং পরিশেষে জন্ম দিয়েছে এক-একটি পকেট মহাবিশ্বের। আমরা এ ধরনেরই একটি পকেট মহাবিশ্বে বাস করছি।

আসলে নব্বইয়ের দশকে দেশকাল (spacetime) কিভাবে ‘ফ্লাকচুয়েট’ করে এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কয়েকজন বিজ্ঞানী (যেমন, এডওয়ার্ড ফাৰ্হি, অ্যালেন গুথ ও জেমাল গুভেন প্রমুখ) দেখলেন, দেশকালকে কেবল আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী ইচ্ছেমতো বাঁকানো কিংবা প্রসারিত করাই যাচ্ছে না, সেই সাথে একে টুকরো করে ভেঙেচুরেও ফেলাও সম্ভব। কখনোসখনো বৃহৎ মহাবিশ্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে খুব ক্ষুদ্র স্থান বা দেশ জন্ম নিতে পারে। এটিই সেই ‘শিশু মহাবিশ্বের’ উৎপত্তির ধারণা, যেটি নিয়ে স্টিফেন হকিং একটি বই লিখেছিলেন ১৯৯৪ সালে ‘কৃষ্ণগব্বর এবং শিশু মহাবিশ্ব’ নামে।

সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টটিউট অব টেকনোলজির স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ শন ক্যারল একটি সুলিখিত বই লিখেছেন ‘ফ্রম এটর্নিটি টু হেয়ার’ নামে। কিভাবে ডিসিটার স্পেস থেকে (যে স্থানে খুব স্বল্প পরিমাণ ধনাত্মক ‘ভ্যাকুয়াম এনার্জি’ লুকিয়ে থাকে) ফলস ভ্যাকুয়াম বুদ্বুদের মাধ্যমে শিশু মহাবিশ্বের জন্ম হতে পারে, তা শন ক্যারল ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বইয়ে। সেই সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। 

বিস্তারিত তথ্যের জন্য The Inflationary Universe: The Quest for a New Theory of Cosmic Origins, Alan H. Guth, Perseus Books Group ( March 1, 1998) দেখুন।

Stephen W. Hawking, Black Holes and Baby Universes and Other Essays, Bantam; First Bantam trade paper edition edition, 1994

সদ্যজাত মহাবিশ্বকে জনপ্রিয় মিডিয়ায় ‘শিশু মহাবিশ্ব’ নামে অভিহিত করলেও মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে শিশু বিচ্ছিন্ন হবার পর অভিভাবকের সাথে সেই শিশু মহাবিশ্বের কোনো সম্পর্কই থাকে না। কাজেই মানুষের জৈবিক সন্তানের সাথে সাদৃশ্য করার চেষ্টা হলেও বেবি ইউনিভার্সের সাথে বায়োলজিক্যাল চাইল্ডের পার্থক্য রয়েছে। খুব বেশি গাণিতিক জটিলতায় না ঢুকে নিচের ছবির মাধ্যমে শিশু মহাবিশ্ব উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হলোঃ

চিত্রঃ ডিসিটার স্পেসে কোয়ান্টাম দোদুল্যময়তার ফলে অসদ বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে শিশু মহাবিশ্ব উদ্ভবের প্রক্রিয়া, এবং পুরো প্রক্রিয়াটি অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে চালিত হয়ে তৈরি করতে পারে প্রায় অসীমসংখ্যক মহাবিশ্বের (শন ক্যারলের ‘ফ্রম এটর্নিটি টু হেয়ার' গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত)।

মাল্টিভার্সের আরেকটা জোরালো প্রমাণ এসেছে সম্প্রতি স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে, খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই। তবে সেখানে যাবার আগে চলুন স্ট্রিং তত্ত্ব নিয়েই কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেওয়া যাক।

প্রথমে আসা যাক মূল প্রশ্নে – হঠাৎ স্ট্রিং তত্ত্বের দরকার পড়ল কেন? আসলে প্রকৃতি জগতের চারটি মৌলিক বল—মহাকর্ষ, দুর্বল নিউক্লীয় তাড়িত চৌম্বক এবং সবল নিউক্লীয়—এই চারটি বল যে এক সুতায় গাঁথা, তা বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের মাথায় ঘুরছিল। আইনস্টাইন প্রকৃতি জগতের বলগুলোকে একটিমাত্র সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করবার লক্ষ্যে জীবনের ত্রিশ বছর ধরে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু সফল হননি। আইনস্টাইন যে প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই জায়গাটিতেই আশার প্রদীপ হয়ে যেন হাজির হয়েছে আমাদের এই স্ট্রিং বা তন্তু তত্ত্ব। এই তত্ত্ব আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভেতরকার বিরোধ মিটিয়ে প্রকৃতি জগতের বলগুলোকে এক সুতায় গাঁথার আভাস দিচ্ছে। সেজন্যই স্ট্রিং তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সমস্যাটা হলো স্ট্রিং তত্ত্ব মেনে নিলে আমাদের চেনাজানা জগতের ছবিটা অনেকখানি পাল্টে যায়। আমরা এত দিন ধরে ভাবতাম, ইলেকট্রন আর কোয়ার্ক- এর মতো প্রাথমিক কণিকাগুলোই মূল কণিকা (এই বইয়ের দ্বাদশ অধ্যায় দ্রঃ)। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব কণিকা জগতের পরিচিত এই পরিচিত ছবিকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা করছে এই ইলেকট্রন আর কোয়ার্কগুলো আর কিছুই নয়, বরং একমাত্রিক একধরণের কম্পনশীল সুতোর কম্পনসৃষ্ট শক্তির এক -একটি রূপ। এই তন্তু বা সুতোগুলো কিন্তু সত্যই খুব ছোট, প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমান (১০৩৩ সে.মি)। একটি পরমাণু কেন্দ্রীণ বা নিউক্লিয়াসেরও লক্ষ লক্ষ গুণ ছোট এরা। এরাই আসলে পদার্থের ক্ষুদ্রতম গঠন একক। এই ধারণা অনুযায়ী, যে সমস্ত কণিকাকে প্রাথমিক কণিকা বলে বিজ্ঞানে উল্লেখ করা হয় তারা সবই আসলে ১০৩৩ সে.মি দৈর্ঘ্যের সুতার বিভিন্ন মাত্রায় কম্পনের ফল ছাড়া আর কিছু নয়। গিটারের একটি তারকে বিভিন্নভাবে আঘাত করলে আমরা যেমন বিভিন্ন মাত্রার শব্দ শুনতে পাই, প্রায় একই রকম ব্যাপার ঘটে স্ট্রিং তত্ত্বের বেলাতেও। তবে স্ট্রিং তত্ত্বের স্ট্রিংগুলো কম্পিত হলে বিভিন্ন মাত্রার সুরধ্বনি পাওয়া যায় না, বরং পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের কণিকা। কণিকাগুলোর ভর, চার্জ, ঘূর্ণন সবকিছুই আসলে নির্ধারিত হয় স্ট্রিং-এর কম্পনের বিভিন্ন রকমফেরে। ইলেকট্রনের বেলায় স্ট্রিং এক রকমভাবে কাঁপে, আর কোয়ার্কের ক্ষেত্রে কাঁপে অন্যভাবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একটিমাত্র স্ট্রিংই বিভিন্নভাবে স্পন্দিত হয়ে বস্তুকণার নির্দিষ্ট ভর, নির্দিষ্ট তড়িৎ আধান, নির্দিষ্ট ঘূর্ণন — এ ধরনের নানা বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলোই কিন্তু একধরনের কণা থেকে আরেক ধরনের কণাকে আলাদা করছে।

এখানেই শেষ নয়। স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের আরেকটি চেনা-পরিচিত ছবিতেও আঘাত করেছে খুব জোরেশোরে। এত দিন আমরা আমদের চেনাজানা বিশ্বজগৎকে জানতাম তিনটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা)। সময়কে আরেকটি মাত্রা ধরলে মাত্রার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় চারে। এই তিন মাত্রার (সময়সহ চার) ব্যাপারটা আমাদের কাছে এত দিন ধরে যেন ধ্রুব সত্য বলেই বিবেচিত হয়েছে। নিউটন থেকে ম্যাক্সওয়েল, আর ম্যাক্সওয়েল থেকে আইনস্টাইন—সবাই তাঁদের পরিচিত বিশ্বকে ত্রিমাত্রিক বিশ্ব (সময়সহ চার) হিসেবেই দেখেছেন—এ যেন অনেকটা আগামীকাল সূর্য ওঠার মতোই নিশ্চিত কিছু। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের এত দিনকার বদ্ধমূল ধারণায় কুঠারাঘাত করে বলছে—আমাদের বিশ্বজগৎ‍ তিন বা চার মাত্রার নয়, একেবারে দশ মাত্রার। বর্তমানে স্ট্রিং তত্ত্বের যে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বটিকে হিসেবে ‘থিওরি অব এভ্রিথিং’-এর জোরালো দাবিদার হিসেবে গ্রহণ করেছেন সেটাকে বলে ‘এম তত্ত্ব’ । এম তত্ত্বের ‘এম’ বলতে ঠিক কী বোঝায় তা কেউ জানে না, কেউ বলেন ‘মিস্ট্রি’, কেউ বলেন’ ম্যাজিক’ । এর বাইরে ‘মনস্টার’, ‘মেট্রিক্স’, ‘মাদার’ থেকে শুরু করে ‘মেমব্রেন’ পর্যন্ত সবকিছুর অনুকল্পই আছে। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এম তত্ত্ব আগেকার পাঁচটি স্ট্রিং তত্ত্বকে এক সুতায় গাঁথতে পেরেছে, আর এই তত্ত্বে প্রস্তাবিত মাত্রার সংখ্যা আবার একটি বেশি—এগারোটি।

এখানেই গল্প শেষ হলে তা-ও না হয় কথা ছিল। এম তত্ত্বের সমীকরণের সমাধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, তাঁরা সমীকরণটির অসংখ্য সমাধান পাচ্ছেন। সমাধানের সংখ্যাটা কতটা বিশাল তা হয়তো কল্পনাতেও আসবে না ১০৫০০ টির মতো। যে সমস্যাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে অসীমসংখ্যক সমাধান উঠে আসে, সেই সমাধান নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। হচ্ছিলও। বহু স্ট্রিং তাত্ত্বিকই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন সে সময়। হননি ‘ব্যাড বয় অব ফিজিকস্’ হিসেবে পরিচিত লিওনার্ড সাসকিন্ড-এর মতো গবেষকেরা। সাসকিন্ড হতাশ হননি, বরং উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন—‘আরে এই ধরনের সমাধানই তো আমরা খুঁজছিলাম’। তিনি বললেন, ১০৫০০ টি সমাধানের অর্থ হলো, কোয়ান্টাম দোদুল্যময়তার মাধ্যমে ১০৫০০ টির মতো ভ্যাকুয়াম স্তরের (vacuum state) উদ্ভব ঘটছে, এবং এ স্তরগুলো থেকে জন্ম নিচ্ছে আলাদা আলাদা মহাবিশ্ব, যে সমস্ত মহাবিশ্বে একেক ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কার্যকরী হতে পারে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘স্ট্রিং ল্যান্ডস্কেপ’ বা ‘তন্তু ভূদৃশ্যের’-এর ধারণা। এ ধারনায় মনে করা হয় যে আমাদের চেনাজানা কোনো নয়নাভিরাম ভূদৃশ্যের মতোই এখানেও পর্বতশীর্ষ আর আর উপত্যকার সমারোহ থাকে, তবে ‘স্ট্রিং ল্যান্ডস্কেপ’-এর ক্ষেত্রে উপত্যকার খাঁজগুলোতে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মহাবিশ্বের।

চিত্রঃ স্ট্রিং তত্ত্বের সাম্প্রতিক গণনা ১০৫০০ টির মতো ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের ‘ল্যান্ডস্কেপ’-এর ভবিষ্যদ্বাণী করছে।

এ প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিং তাঁর সাম্প্রতিক ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ গ্রন্থে বলেন, এম তত্ত্বের নিয়মগুলো ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ধারণাকে সম্ভাব্য করে তুলে। মহাবিশ্বগুলোর প্রকৃতি কী রকম হবে তা নির্ভর করবে আন্তস্থানের (internal space) বক্রতার প্রকৃতির ওপর। কাজেই, এম তত্ত্ব থেকে পাওয়া সমাধান অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তার সংখ্যা হতে পারে এমনকি ১০°টিও। এর মানে হলো, আমাদের চারপাশে ১০৫০০টির মতো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, এবং প্রতিটির ওপর কাজ করতে পারে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সূত্র।

এভাবেই সাধিত হলো স্ফীতি তত্ত্ব আর স্ট্রিং তত্ত্বের মেলবন্ধন। লিন্ডের ‘চিরন্তন স্ফীতি’ মডেলে যে অসংখ্য মহাবিশ্বের প্রস্তাবনা ছিল, সেগুলোকেই স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা খুঁজে পেতে শুরু করলেন যেন তাঁদের গাণিতিক সমীকরণের নির্ধারিত উপত্যকায়।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও সমাধান হাজির করেছে মাল্টিভার্স। পদার্থবিদদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক সমস্যা’–যার কথা আমরা আগের অধ্যায়ে কিছুটা জেনেছি, সেটারও একধরনের সমাধান হাজির করেছে মাল্টিভার্স। যদি মহাজাগতিক স্ফীতির ফলে অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি হয়, তবে বিভিন্ন মহাবিশ্বে মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান ভিন্ন হবে, এবং এটাই সম্ভবত বাস্তবে ঘটেছে। আমরা এমন এক মহাবিশ্বে রয়েছি যেখানে মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান খুব কম; যেটা প্রকারান্তরে প্রাণের অভ্যুদয়ের জন্য সহায়ক। অন্য অনেক মহাবিশ্বেই ধ্রুবকের মান এমন যে, সে নিয়ে প্রশ্ন করার মতো হয়তো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

Leonard Susskind, The Cosmic Landscape: String Theory and the Illusion of Intelligent Design, Back Bay Books, 2006

ব্যাপারটাকে অনেকটা বিজ্ঞানী কেপলারের ‘সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থানগত ধাঁধার’ সাথে তুলনা করা যায়। বিজ্ঞানী কেপলারের একসময় মহা চিন্তিত হয়ে পড়লেন : সৌরজগতের সব গ্রহ বাদ দিয়ে কেন এই পৃথিবীতেই প্রাণের উদ্ভব হলো—এই রহস্য নিয়ে। তিনি ভাবলেন, এমন কোনো মহাজাগতিক নিয়ম নিশ্চয় আছে যার কারণে পৃথিবীটা সূর্য থেকে ঠিক ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে আছে; আর ঠিক এই অবস্থানে থাকার ফলেই একসময় এখানে প্রাণের অভ্যুদয় ঘটার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কী সেই নিয়ম? তিনি দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট করে নানা ধরনের গণিত সমাধান করলেন, কিন্তু ব্যাপারটির কোনো সুরাহা করতে পারলেন না। এখন আমরা কিন্তু সহজেই বুঝতে পারি, আসলে কেপলার এক্ষেত্রে ভুল পথে চিন্তা করছিলেন। কেপলারের পছন্দমতো কোনো কোনো ‘প্রাণের উন্মেষকারী মহাজাগতিক নিয়ম’ পাওয়া যায়নি, কেননা সে ধরনের কোনো নিয়মই আসলে নেই। মূল কথা হলো—সৌরজগতের অন্য সব গ্রহের মধ্যে সেই গ্রহেই প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে যেখানে সূর্যের থেকে দূরত্ব, তাপ, চাপ, বায়ুমণ্ডল, আর্দ্রতা সবকিছু মিলিয়ে অনুকূল পরিবেশ ছিল। সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহগুলোতে এই প্রশ্ন করার মতো কেউ নেই, কারণ সেখানে কোনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আর এমন কোনো নিয়ম আসলে নেই যার বদৌলতে পৃথিবীটা সূর্য থেকে ঠিক মাপমতো জায়গায় (মানে ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে) বসবে বলে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। এটা আসলে মহাবিশ্বের অসংখ্য এলোপাতাড়ি ঘটনার মাঝে ঘটে যাওয়া সাধারণ একটি ঘটনা বই কিছু নয়।

মাল্টিভার্সের ব্যাপারটাও ঠিক তেমনি। মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান কেন আমাদের মহাবিশ্বে এত কম (প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০৮ আর্গ)—এটা আসলে কেপলারের ঐ প্রশ্নের মতো ভুল প্রশ্ন। আসলে মাল্টিভার্সকে গোনায় ধরলে মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান একটি নয়, অসংখ্য। এই অসংখ্য মান ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বে ভিন্ন ভিন্নভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিড়ে আমাদের মহাবিশ্ব ধ্রুবকের একটা ক্ষুদ্র পরিসীমায় থাকা মান নিয়ে আছে বলেই, এটা নিয়ে কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে রয়েছি আমরা ।

 

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বনাম মাল্টিভার্স

১৮৩৭ সালে ইংরেজ সাহিত্যিক রবার্ট সৌথি বাচ্চাদের জন্য একটি রূপকথার গল্প লেখেন ‘গোল্ডিলক্স এবং তিন ভালুকের গল্প’ শিরোনামে। সেই গল্পে গোল্ডিলক্স নামের এক কিশোরী বনের মধ্যে পথ হারিয়ে এক ভালুক-দম্পতির বাসা খুঁজে পায়। ক্ষুধার্ত কিশোরীটি বাবা ভালুকের খাবার খেয়ে দেখল সেটি খুব গরম——মুখে দিলেই মুখ পুড়ে যায়। মা ভালুকের খাবারটি খেয়ে গোল্ডিলক্স দেখল সেটি আবার খুব ঠান্ডা। আর বাচ্চা ভালুকের খাবারটা চেখে দেখে, সেটা না গরম না ঠান্ডা একদম ঠিকঠাক তাপমাত্রার, ও সুস্বাদু। ঠিক একইভাবে বসার চেয়ার আর শোয়ার বিছানাটা পরীক্ষা করতে গিয়েও দেখে বাবা ভালুকের চেয়ারটা বেশি বড়, আর বিছানাটা খুব শক্ত, মা-ভালুকের চেয়ারটা খুব ছোট, আর বিছানাটা অনেক বেশি নরম। কিন্তু বাচ্চা ভালুকের বিছানা আর চেয়ার তার খাবারের মতোই নিখুঁত; চেয়ারটা মাপমতো, মানে না বড় না ছোট, আর বিছানাটা না নরম না শক্ত, বড়ই আরামের। অর্থাৎ বাচ্চা ভালুকের জিনিসগুলো একদম গোল্ডিলক্সের মনোমতো করেই যেন তৈরি; আর গোল্ডিলক্সের পছন্দ সেটাই।

অনেক দার্শনিক বলেন, আমাদের মহাবিশ্বটাও নাকি ঠিক গোল্ডিলক্সের মতো আমাদের জন্য ‘জাস্ট রাইট’। আর এটি এমনি এমনি হয়নি, এর পেছনে কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সত্তার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও ডিজাইনের আলামত আছে। মাইকেল বিহে, উইলিয়াম ডেম্বস্কি, জর্জ এলিস, জন ডি. ব্যারো এবং ফ্রাঙ্ক জে. টিপলার প্রমুখ এ ধারণাগুলোর ধারক ও সমর্থক। এঁদের যুক্তি হলো, আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এমন কিছু চলক বা ভ্যারিয়েবলের সূক্ষ্ম সমন্বয়ের (ফাইন টিউনিং) সাহায্যে তৈরি হয়েছে যে এর একচুল হেরফের হলে আর আমাদের এ পৃথিবীতে কখনোই প্রাণ সৃষ্টি হতো না। তাঁদের বক্তব্য হলো, আমাদের মহাবিশ্বে গ্র্যাভিটেশনাল অথবা কসমোলজিক্যাল ধ্রুবকগুলোর মান এমন কেন, কিংবা মহাবিশ্বের চেহারাটাই বা এমন কেন হয়েছে তার উত্তর পেতে হলে ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ এবং মানুষের উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য সর্বোপরি মানুষের আবির্ভাবের জন্য এই মৌলিক ধ্রুবক আর চলকগুলোর মান ঠিক এমনই হওয়া দরকার ছিল, সে জন্যই ওগুলো ওরকম। দৈবক্রমে ওগুলো ঘটেনি, বরং এর পেছনে হয়তো এক বুদ্ধিদীপ্ত সত্তার একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত রক্ষণশীল পদার্থবিজ্ঞানী হিউ রস, যিনি মনে করেন ‘বিগ ব্যাং তত্ত্বের জনক হচ্ছে বাইবেল’, তিনি তাঁর ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ক্রিয়েটর অ্যান্ড দ্য কসমস’ নামক এক ছদ্মবিজ্ঞানময় গ্রন্থে দাবি করেছেন, মহাজগতের প্রায় ছাব্বিশটি প্যারামিটার নাকি সূক্ষ্মভাবে সমন্বিত, একচুল এদিকওদিক হলে আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটত না, আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে এরকম জ্ঞানগর্ভ আলোচনার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। আর হিউ রসের মতে, এটি যিশুখ্রিষ্টে বিশ্বাসী হবার জন্য ‘বাস্তব প্রমাণ”।

মূলধারার বিজ্ঞানীরা অবশ্য হিউ রস কথিত ছাব্বিশটি প্যারামিটারকে মোটেই গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন না; তাঁরা এটিকে বরং রক্ষণশীল প্রোপাগান্ডাই মনে করেন। তার পরও অনেকে বলেন, ছাব্বিশটি না হোক, অন্তত ছয়টি প্যারামিটার আছে যেগুলো মহাবিশ্বের বুকে আমাদের অস্তিত্বের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ। বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী এবং কেম্ব্রিজের রয়েল সোসাইটির রিসার্চ প্রফেসর মার্টিন রিস ২০০০ সালে একটি বই লিখেছেন এ নিয়ে ‘কেবল ছয়টি সংখ্যা’ (Just Six Numbers) শিরোনামে248। মার্টিন রিসের বই এবং অন্যান্য প্রামাণিক গবেষণাপত্র থেকে হদিস পাওয়া যে প্যারামিটারগুলোকে সূক্ষ্ম সমন্বয়ের জন্য জরুরি বলে মনে করা হয় সেগুলো হলো –

প্যারামিটার—————- সর্বোচ্চ বিচ্যুতি

ইলেকট্রন ও প্রোটনের অনুপাত—– ১০৩৭ ভাগের ১ ভাগ

তড়িচ্চুম্বকীয় বল ও মাধ্যাকর্ষণ বলের অনুপাত—– ১০৪০ ভাগের ১ ভাগ

মহাবিশ্বের প্রসারণের হার—– ১০৫৫ ভাগের ১ ভাগ

মহাবিশ্বের ঘনত্ব—– ১০৫৯ ভাগের ১ ভাগ

মহাজাগতিক ধ্রুবক—– ১০১২০ ভাগের ১ ভাগ

এর বাইরে জাগতিক মাত্রার সংখ্যা ৩ হওয়াটাও একধরনের সূক্ষ্ম সমন্বয় বলে অধ্যাপক রিস মনে করেন।

সংশয়বাদী পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্য বহুভাবেই দেখিয়েছেন যে, এই ছয়টি প্যারামিটারের এ ধরনের মান গ্রহণ করার পেছনে কোনো সূক্ষ্ম সমন্বয় নেই, বরং জানা পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানের সাহায্যেই এর এগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।

এ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। আমরা সবাই জানি, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে একটি ধ্রুবক আছে, যাকে আমরা বলি মহাকর্ষ ধ্রুবক, G। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে দেখা যায় যে দুটি বস্তুকণার মধ্যে আকর্ষণ বলের পরিমাণ নির্ধারিত হবে ঐ মহাকর্ষ ধ্রুবকের সংখ্যাবাচক মান দ্বারা। যদি ধ্রুবকটির মান এখন যা আছে তা না হয়ে অন্যরকম হত তাহলে দুটি কণিকার মধ্যে আকর্ষণ বলের পরিমাণও বদলে যেত। সাদা চোখে ব্যাপারটি সামান্য মনে হতে পারে। আকর্ষণ বলের তারতম্য ঘটলে এমন কী এসে যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে এটি সামান্য নয়, এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর। তাঁরা বলেন যে ঐ মহাকর্ষ ধ্রুবকের বর্তমান মান আসলে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে। ধ্রুবকটির মান একটু অন্যরকম হলে তারকাদের মধ্যে হাইড্রোজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে হিলিয়াম উৎপাদনের মাত্রাকে বদলে দিত। হাইড্রোজেন-হিলিয়ামের পর্যাপ্ততা শুধু এই মহাকর্ষ ধ্রুবকের ওপরই অবশ্য নয়, মহাকর্ষ ও দুর্বল নিউক্লীয় বলের মধ্যকার শক্তির ভারসাম্যের ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। যেমন, তাঁরা দেখিয়েছেন যে দুর্বল নিউক্লীয় বলের শক্তি যদি সামান্য একটু বেশি হতো, এই মহাবিশ্ব পুরোটাই অর্থাৎ শতকরা একশ ভাগ হাইড্রোজেন পরমাণুতে পূর্ণ থাকত, কারণ ডিউটেরিয়াম (এটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মামাতো ভাই, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘আইসোটোপ’) হিলিয়ামে পরিণত হবার আগেই সমস্ত নিউট্রন নিঃশেষ হয়ে যেত। আবার এর উল্টোটি ঘটলে, অর্থাৎ দুর্বল নিউক্লীয় বলের শক্তিমত্তা আর একটু কম হলে সারা মহাবিশ্বে কেবল থাকত শতকরা একশ ভাগ হিলিয়াম। কারণ সেক্ষেত্রে নিউট্রন নিঃশেষিত না হয়ে তা উৎপন্ন প্রোটনের সাথে যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন তৈরিতে বাধা দিত। কাজেই এ ধরনের দুই চরম অবস্থার যেকোনো একটি ঘটলে মহাবিশ্বে কোনো নক্ষত্ররাজি তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা কখন সৃষ্টি হতো না, ঘটত না আমাদের এই মলয় শীতলা ধরণীতে ‘কার্বন-ভিত্তিক’ প্রাণের নান্দনিক বিকাশ।

Martin Rees, Just Six Numbers: The Deep Forces That Shape The Universe, Basic Books, 2000

Victor J. Stenger, The Universe Shows No Evidence for Design, লিঙ্ক

http://www.colorado.edu/philosophy/vstenger/Fallacy/NoDesign.pdf

এ প্রসঙ্গে আরো দেখুন, Victor J. Stenger, The Fallacy of Fine – Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us, Prometheus Books, 2011

চিত্রঃ অনেক বিজ্ঞানী বলেন, খুব সীমিত পরিসরে (গোল্ডিলক্স এলাকা) জীবনের বিকাশ ঘটেছে; এমন কেন হয়েছে তার উত্তর পেতে হলে ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ ও মানুষের উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে।

আবার, বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন যে ইলেকট্রনের ভর নিউট্রন ও প্রোটনের ভরের পার্থক্যের চেয়ে কিছুটা কম। তাঁরা মনে করেন যে এর ফলে একটি মুক্ত নিউট্রন সহজেই প্রোটন, ইলেকট্রন ও প্রতি-নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হতে পেরেছে। যদি ইলেকট্রনের ভর সামান্য বেশি হত, নিউট্রন তাহলে সুস্থিত হয়ে যেত, আর সৃষ্টির প্রারম্ভে উৎপাদিত সকল প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলেমিশে নিউট্রনে পরিণত হতো। এর ফলে যা ঘটত সেটি আমাদের জন্য খুব একটা সুখপ্রদ কিছু নয়। এমনতর পরিস্থিতিতে খুব কম পরিমাণ হাইড্রোজেন টিকে থাকত, আর তাহলে নক্ষত্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি অবশিষ্ট থাকত না। জন ডি. ব্যারো ও ফ্রাঙ্ক জে. টিপলার এ ধরনের রহস্যময় নানা যোগাযোগ তুলে ধরে একটি বই লিখেছিলেন ১৯৮৬ সালে, নাম “The Anthropic Cosmological Principle’। তাঁদের বক্তব্য হলো, আমাদের মহাবিশ্বে গ্র্যাভিটেশনাল কিংবা অন্য মহাজাগতিক ধ্রুবকসমূহের মান এমন কেন, কিংবা মহাবিশ্বের চেহারাটাই বা এমন কেন হয়েছে এর উত্তর পেতে হলে অনুসন্ধান করতে হবে পৃথিবীতে প্রাণ ও মানুষের আবির্ভাবের মধ্যে। প্রাণের বিকাশ ও সর্বোপরি বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের অভ্যুদয়ের জন্য এসব মৌলিক ধ্রুবকও পরিবর্ত রাশিগুলির মান ঠিক এমনই হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল, আর সেজন্যই ধ্রুবকগুলোর মান এ রকম হয়েছে। হঠাৎ বা দৈবক্রমে এটি ঘটেনি, বরং এর পেছনে বিধাতা পুরুষের একটি সুস্পষ্ট ইচ্ছা নিহিত ছিল।

মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্রে রেখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মনীতিগুলোকে ব্যাখ্যা করবার এই যুক্তিকে বলা হয় ‘অ্যানথ্রোপিক আর্গুমেন্ট’ বা ‘নরত্ব-বাচক যুক্তি’। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটির শেষ অধ্যায়ে এ সমস্ত যুক্তির বৈজ্ঞানিক খণ্ডন উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আমি (অ.রা) দেখিয়েছি, মহাজাগতিক ধ্রুবক আর পরিবর্ত রাশিগুলির মান পরিবর্তন করে বিজ্ঞানীরা (যেমন, ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘মাঙ্কি গড’ কম্পিউটার প্রোগ্রাম) সিমুলেশন করে আমাদের মহাবিশ্বের মতো আরও অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারেন, যেখানে প্রাণের উদ্ভবের মতো পরিবেশের সৃষ্টি হতে পারে; এবং এ জন্য ‘ফাইন টিউনিংয়ের’ কোনো প্ৰয়োজন নেই। এছাড়া ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে বিজ্ঞানী অ্যান্থনি অ্যাগুরি (Anthony Aguirre) স্বতন্ত্রভাবে দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বের ছয়টি প্যারামিটার বা পরিবর্ত রাশিগুলো বিভিন্নভাবে অদলবদল করে নীহারিকা, তারা এবং পরিশেষে কোনো একটি গ্রহে বুদ্ধিদীপ্ত জীবন গঠনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব”। এখানে সেগুলো নিয়ে পুনর্বার আলোচনায় যাবার খুব বেশি ইচ্ছে নেই। এ অধ্যায়ে আমরা দেখাব যে, এত ধরনের জটিলতায় (অ্যান্থনি অ্যাগুরিসহ বিভিন্ন বিজ্ঞানীর যে সমস্ত সমাধান উল্লেখ করেছি) না গিয়েও মাল্টিভার্স তত্ত্বের মাধ্যমেও এই রহস্যময় ‘ফাইন টিউনিং’-এর আরো একটি সহজ সমাধান আমরা পেতে পারি।

“Natural Explanations for the Anthropic Coincidences.” Philo 3(2000): 50-67.

Anthony Aguirre, “The Cold Big-Bang Cosmology as a Counter- example to Several Anthropic Arguments”, Journal of Physical Rev, D64:083508, 2001.

চিত্রঃ মাল্টিভার্স হাইপোথিসিস অ্যান্থ্রোপিক ও ফাইন টিউনিং আর্গুমেন্টগুলোর একটি সহজ সমাধান দেয়।

আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি, সাদামাটা কথায় মাল্টিভার্স তত্ত্ব বলছে যে, হাজারো-লক্ষ-কোটি মহাবিশ্বের ভিড়ে আমাদের মহাবিশ্বও একটি। স্রেফ সম্ভাবনার নিরিখেই একটি মহাবিশ্বে চলকগুলোর মান এমনিতেই অমন সূক্ষ্মভাবে সমন্বিত হতে পারে, অন্যগুলোতে হয়তো হয়নি। আমাদের মহাবিশ্বে চলকগুলো কোনো একভাবে সমন্বিত হতে পেরেছে বলেই এতে প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে; এতে এত আশ্চর্য হবার কিছু নেই! অধ্যাপক মার্টিন রিস সেটিই খুব চমৎকারভাবে একটি উপমার মাধ্যমে উল্লেখ করেছেনঃ

অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিড়ে আমাদের মহাবিশ্বও একটি। অন্য মহাবিশ্বে বিজ্ঞানের সূত্র আর চলকগুলো হয়তো একেবারেই অন্যরকম হবে।…কাজেই ঘড়ির কারিগরের সাদৃশ্য এখানে একেবারেই অচল। তার বদলে বরং আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অনেকটা পরিত্যক্ত সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের দোকানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দোকানের মজুদ যদি বিশাল হয় তবে দোকানের কোনো একটি জামা আপনার গায়ে ঠিকমতো লেগে গেলে আপনি নিশ্চয় তাতে বিস্মিত হবেন না! ঠিক একইভাবে আমাদের মহাবিশ্ব যদি ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি হয়ে থাকে, দোকানের একটি জামার মতোই সূক্ষ্মসমন্বয় দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

সম্প্রতি স্টিফেন হকিংও তাঁর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ের ‘আপাত অলৌকিকতা’ অধ্যায়ে একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি তাঁর বইয়ে বলেন (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ১৬৪)–

মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর এতসব যাবতীয় সূক্ষ্মসমন্বয় দেখে অনেকেই ভাবতে বাধ্য হয়েছিলেন, এটি বোধ হয় কোনো গ্র্যান্ড ডিজাইনারের গ্র্যান্ড ডিজাইন। কিন্তু এটি কোনো বৈজ্ঞানিক উত্তর হলো না। আমরা বরং বৈজ্ঞানিকভাবে দেখেছি, আমাদের এই মহাবিশ্ব অসংখ্য অগণিত মহাবিশ্বরই একটি যার প্রতিটিতে কাজ করবে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সূত্রাবলি। এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা সূক্ষ্মসমন্বয়ের অলৌকিকতাকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়নি, বরং এটা ‘নো বাউন্ডারি কন্ডিশন’255 এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যান্য আধুনিক তত্ত্বেরই সফল অনুসিদ্ধান্ত।…ঠিক যেভাবে ডারউইন ও ওয়ালেস ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন জীবজগতের আপাত অলৌকিক ডিজাইনের মতো ব্যাপারগুলো যেমনি উদ্ভূত হতে পারে কোনো ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই, ঠিক তেমনি অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা প্রাকৃতিক সূত্রগুলোর সূক্ষ্ম সমন্বয়কে ব্যাখ্যা করতে পারে কোনো পরম করুণাময় কোনো সত্তার উপস্থিতি ছাড়াই।

অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্ব, যাকে এত দিন প্রকৃতির পুরো অংশ বলে ভেবে নেওয়া হতো, আসলে হয়তো এটি এক বিশাল কোনো মহাজাগতিক দানবের (অমনিভার্স) খুব ক্ষুদ্র অংশবিশেষ ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের অবস্থাটা এত দিন ছিল সেই বহুল প্রচলিত ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ গল্পের অন্ধ লোকটির মতো – হাতীর কান ছুঁয়েই যে ভেবে নিয়েছিল ওইটাই বুঝি হাতির পুরো দেহটা।

এখানেই কিন্তু গল্প শেষ নয়। এই মাল্টিভার্স থিওরির বাই প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে আবার ইদানীং উঠে এসেছে আরো এক ডিগ্রি মজাদার তত্ত্ব— ‘সমান্তরাল মহাবিশ্ব’ বা ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’-এর ধারণা। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি আছে সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে, নাম ইরন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পাশাপাশি সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং বৈজ্ঞানিক সাময়িকীগুলোতেও ঠাঁই করে নিয়েছে। যেমন, সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ডেটচস ১৯৯৭ সালে একটি বই লিখেছেন The Fabric of Reality: The Science of Parallel Universes – And Its Implications নামে। একই দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থবিজ্ঞানী মিচিও কাকু ২০০৬ সালে বই লিখেছেন ‘সমান্তরাল বিশ্ব’ নামে।

২০০৩ সালের মে মাসের সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সংখ্যায় ম্যাক্স টেগমার্ক Parallel Universes নামের একটি প্রবন্ধ লেখেন। লেখাটিতে টেগমার্ক তিনটি মডেলের সাহায্যে অত্যন্ত বিস্তৃত ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’-এর ধারণাকে পাঠকদের মাঝে তুলে ধরেন । প্যারালাল ইউনিভার্সের তত্ত্ব বলছে যে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ-কোটি মহাবিশ্বের মধ্যে কোনো কোনোটি যে আকার, আয়তন আর বৈশিষ্ট্যে একদম ঠিক ঠিক আমাদের মহাবিশ্বের মতোই হবে না, এমন তো কোনো গ্যারান্টি নেই।

Martin J. Rees, Other Universes – A Scientific Perspective,

Stephen Hawking, The Grand Design, Bantam;, 2010

Michio Kaku, Parallel Worlds: A Journey Through Creation, Higher Dimensions, and the Future of the Cosmos, Anchor, 2006

Max Tegmark, “Parallel Universes”, Scientific American, May 2003

চিত্রঃ বিজ্ঞানী ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের জানা গণিতের সম্ভাবনার নিরিখেই হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব থেকে পায় (১০১০)১১৮ মিটার আমাদের মহাবিশ্বের মতোই অবিকল মহাবিশ্ব থাকতে পারে যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই একই ধরনের প্রাকৃতিক সূত্র কাজ করছে, এমনকি সেখানে হয়তো আপনারই একজন নকল প্রতিরূপ কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটি পড়ছে, তা আপনি কোনো দিন জানতেও পারবেন না!

পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোও সেই মহাবিশ্বে একই রকমভাবে কাজ করার কথা। ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের জানা গণিতের সম্ভাবনার নিরিখেই হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, এই মহাবিশ্ব থেকে পায় (১০১০)২৮ মিটার দূরে আপনারই এক ‘আইডেন্টিকাল টুইন’ হয়তো কম্পিউটারের সামনে বসে এই লেখাটি পড়ছে, তা আপনি কোনো দিন জানতেও পারবেন না!

বেশ বুঝতে পারছি, মাল্টিভার্সের ধারণাই হয়তো পাঠকদের অনেকে হজম করতে পারছেন না, তার ওপর আবার প্যারালাল ইউনিভার্স, আইডেন্টিকাল টুইন – হেনতেন চলে আসায় নিশ্চয় মাথা তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওপরের ধারণা, কিংবা তত্ত্বগুলো যতই আজগুবি মনে হোক না কেন ওগুলো নির্মাণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেননি। তার পরও সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা এখনো ‘সাই-ফাই’, বড়জোর গাণিতিক সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবের পর্যায়েই রয়েছে, তার চেয়ে প্রচলিত মাল্টিভার্সের ধারণাগুলো বরং অনেক বাস্তব হয়ে উঠছে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে। কিন্তু সেখানে যাবার আগে আমাদের একটু অক্কামের ক্ষুর সম্বন্ধে দু’-চার কথা জানা প্রয়োজন।

 

মাল্টিভার্সের ধারণা কি অক্কামের ক্ষুরের লঙ্ঘন?

দর্শনশাস্ত্রে ‘অক্কামের ক্ষুর’নামে একটি সূত্র প্রচলিত আছে। এ নিয়ে আমি (অ.রা) একটা পোস্ট লিখেছিলাম মুক্তমনা ব্লগে258। সোজা বাংলায় এই সূত্রটি বলে, ‘অনর্থক বাহুল্য সর্বদাই বর্জনীয়’। আইডির সমর্থক অধ্যাপক জর্জ এলিস অক্কামের ক্ষুরকে ব্যবহার করেছেন মাল্টিভার্সের ধারণার বিরুদ্ধে, বলেছেন, এই তত্ত্ব অক্কামের ক্ষুরের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাঁর যুক্তি হলো, একটা মহাবিশ্ব দিয়েই যখন সমস্যা সমাধান করা যায়, হাজার কোটি মহাবিশ্ব টেনে এনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আসলে বাতুলতা মাত্র, অনর্থক অপচয়। কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টেকে না। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর তাঁর ‘টাইমলেস রিয়ালিটি’ এবং ‘হ্যাজ সায়েন্স ফাউন্ড গড’ বইয়ে এই যুক্তি খণ্ডন করে বলেছেন, পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তত্ত্বগুলোর কোনোটাই অসংখ্য মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে বাতিল করে দেয় না। বরং যেখানে লিন্ডের তত্ত্ব কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত করছে, সেখানে কেউ যদি অযথা বাড়তি একটি প্রকল্প আরোপ করে বলেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব ছাড়া আর কোনো মহাবিশ্ব নেই, কিংবা কখনোই তৈরি হওয়া সম্ভবপর নয়, তবে সেটাই বরং হবে অক্কামের ক্ষুরের লঙ্ঘন। অধ্যাপক স্টেঙ্গরের মতে, লিন্ডের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসা সমাধানের ভুল ধরিয়ে দিয়ে নিজের সজ্ঞাত ধারণাটি—‘একটি মহাবিশ্বই টিকে থাকতে পারবে’— প্রমাণ করার দায়িত্ব থাকছে কিন্তু ওই দাবিদারদের ঘাড়েই -যারা একটিমাত্র মহাবিশ্বের ধারণায় আস্থাশীল। এখন পর্যন্ত কেউই সে ধরনের কোনো ‘স্পেশাল নিয়ম’ হাজির করতে পারেননি, যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে কেবল একটি মহাবিশ্বই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, অন্যগুলো বাতিল হয়ে যাবে।

বিজ্ঞানী ম্যাক্স টেগমার্কও তাঁর সায়েন্টিফিক আমেরিকানের প্রবন্ধে অক্কামের ক্ষুরকে খণ্ডন করে লেখেন, একটিমাত্র মহাবিশ্বের চেয়ে অনন্ত মহাবিশ্বই বরং এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ‘সহজ সমাধান’ হাজির করেছে। তাই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা অক্কামের ক্ষুরের কোনো লঙ্ঘন নয়।

কানাডার প্রিমিয়ার ইনস্টটিউটের অধ্যাপক লি স্মোলিন একটু অন্যভাবে সমস্যাটা নিয়ে ভাবছিলেন। কেন আমাদের মহাবিশ্বই টিকে রইল, অন্যগুলো রইল না এ প্রশ্নটির সমাধান দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বায়োলজি বা জীববিদ্যা হয়তো এক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাতে পারে। জীববিজ্ঞানে এ ধরনের ঘটনার হাজারো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কড মাছ মিলিয়ন মিলিয়ন ডিম পাড়ে, তার মধ্যে খুব কমই শেষ পর্যন্ত নিষিক্ত হয়, আর নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেওয়া অধিকাংশ পোনাই আবার বিভিন্ন কারণে মারা যায়, কিংবা অন্য মাছদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, খুব কম পোনাই টিকে থাকে আর তারপর পূর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের নিরানব্বই শতাংশই প্রথম মাসে কোনো- না-কোনোভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, আর বাকি যা বেঁচে থাকে তারও নব্বই ভাগ প্রথম বছরেই ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষসহ প্রতিটি স্তন্যপায়ী প্রাণীরই কোটি কোটি স্পার্মের প্রয়োজন হয় কেবল এটি নিশ্চিত করতে যে এদের মধ্যে একটিমাত্র স্পার্মই বিভিন্ন চড়াই- উতরাই পেরিয়ে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করবে আর শেষপর্যন্ত পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখবে। অর্থাৎ প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে বেশি উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। এ ব্যাপারটিকেই চলতি কথায় যোগ্যতমের বিজয় বা ‘সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ বলা হয়। ডারউইন প্রকৃতির এই নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ যার মাধ্যমে তিনি জীবজগতের বিবর্তনকে সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন।

লি স্মোলিন ভাবলেন, জীবজগতের বিবর্তনের নিয়মের মতো ‘কিছু একটা’ সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বের বিবর্তনের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে কি না। ইনফ্লেশনের ফলে মহাবিশ্বের ইতিহাসে যে অগুনতি সিংগুলারিটি তৈরি হয়েছিল, এমনও তো হতে পারে যে, এদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটিমাত্রই টিকে রইল, যেভাবে মানবদেহে নিষেক ঘটানোর অভিপ্রায়ে মিলিয়ন শুক্রাণুর মধ্যে টিকে রয় একটিমাত্র স্পার্ম বা শুক্রাণু। তাহলে কি যোগ্যতম শুক্রাণুর মত কোন এক যোগ্যতম অদ্বৈত বিন্দু থেকেই ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে আমাদের এই পরিচিত মহাবিশ্ব? কে জানে, হতেও তো পারে! তা-ই যদি হয়, তবে ‘ফাইন-টিউনিং’ আর ‘অ্যান্থ্রোপিক আর্গুমেন্ট’-এর জন্য অতিপ্রাকৃত স্বৰ্গীয় সমাধান খুঁজে আর লাভ নেই। কারণ ডারউইনীয় বিবর্তনবাদী ধারণা বলছে, হয়তো এ প্রকরণগুলোই আমাদের মহাবিশ্বকে অন্যগুলো থেকে অধিকতর ‘যোগ্যতম’ হিসেবে আলাদা করে দিয়েছিল! তাই এটি টিকে গেছে।

অনন্ত মহাবিশ্বের সমস্যা সমাধানে লি স্মোলিনের এই বিবর্তনবাদী দর্শন খুব আকর্ষণীয় সমাধান দিলেও এটি জ্যোতিঃপদার্থবিদদের কাছ থেকে কখনোই তেমন সমর্থন পায়নি। এর কারণ মূলত দুটি। অধিকাংশ পদার্থবিদদের সবাই পদার্থবিদ্যার জানা নিয়মনীতির মধ্যে থেকেই এই রহস্যের সমাধান চান- হঠাৎ করেই এক ভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক নিয়মের মাধ্যমে একধরনের ‘গোঁজামিল’ দেওয়া ব্যাখ্যা নয়; আর তাছাড়া লি স্মোলিন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলছেন তার কোন গাণিতিক মডেল উপহার দিতে পারেননি যা পদার্থবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার এক অন্যতম পূর্বশর্ত।

আর তার চেয়েও বড় কথা হলো বিজ্ঞানীরা মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ পেতে শুরু করেছেন সম্প্রতি।

 

এলো মাল্টিভার্সের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ

মাল্টিভার্সের ধারণা বিজ্ঞানীরা হাজির করার পর থেকেই একে বিভিন্ন সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত মাল্টিভার্স নামের এই বিপ্লবাত্মক ধারণার প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়ে বলা হতো- এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা সঠিক নাকি ভুল, তা এই মুহূর্তে পরীক্ষা করে বলবার কোনো উপায় নেই। কার্ল পপার ‘ফলসিফায়েবিলিটি’র যে বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হিসেবে নির্ধারিত করে রেখেছেন, তার আওতায় কিন্তু মাল্টিভার্স পড়তো না বলে ভাবা হতো। সমালোচকরা বলতেন, গাণিতিক বিমূর্ততায় ঠাসা মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা যতটুকু না বাস্তবতার কাছাকাছি, তার চাইতে ঢের বেশি কাছাকাছি অধিপদার্থবিদ্যার (মেটা ফিজিকস)। কাজেই এটি বিজ্ঞান হয় কী করে?

মাল্টিভার্সের সমর্থকরা ফলসিফায়াবিলিটি বা যাচাইযোগ্যতার খুব ভালো জবাব দিতে না পারলেও সে সময় মিনমিন করে বলতেন, ওই অধিপদার্থবিদ্যা আর পদার্থবিদ্যার মাঝখানের সীমারেখাটা যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হয়ে আসছে। অতীতে আমরা দেখেছি পর্যবেক্ষণবিরোধী বহু তত্ত্বই—যেমন গোলাকার পৃথিবীর ধারণা, অদৃশ্য বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র, উচ্চগতিতে ভ্রমণকালে সময় শ্লথতা, কোয়ান্টাম উপরিপাতন, স্থান-কালের বক্রতা, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি সবকিছুই শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের অংশ হয়ে গেছে। অনন্ত মহাবিশ্বকেই বা আমরা তালিকায় রাখতে পারব না কেন?

এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে। মাল্টিভার্সের সমর্থকদের আর মিনমিন করে জবাব দিতে হচ্ছে না। আগেই বলেছি, পদার্থবিজ্ঞানের অন্তত তিনটি পৃথক পৃথক ক্ষেত্র—স্ট্রিং তত্ত্বের ‘ল্যান্ডস্কেপ’, স্ফীতি-তত্ত্ব থেকে পাওয়া সমাধান এবং গুপ্ত শক্তির নিম্নমান—সবাই এক বাক্যে মাল্টিভার্সের অস্তিত্বের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। এর বাইরে আছে ‘কোয়ান্টাম মাল্টিভার্স’ এবং ‘হলোগ্রাফিক মাল্টিভার্সের’ নীরব উপস্থিতি। আরো বড় ব্যাপার, এই সব তত্ত্বকথার পাশাপাশি কিছু পরীক্ষালব্ধ প্রমাণও হাজির করা যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, মাল্টিভার্স আর ধারণা কিংবা ‘স্পেকুলেশন’-এর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ক্রমশ হয়ে উঠেছে যেন শক্তপোক্ত বিজ্ঞান!

বছর কয়েক আগে স্ফীতি তত্ত্বের জনক অ্যালেন গুথ এবিসি নিউজ রিপোর্টারের কাছ থেকে অদ্ভুত এক ফোন কল পেলেন। রিপোর্টার তাঁকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আমাদের মহাবিশ্ব যদি ইনফ্লেশনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদ্বুদের একটি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য মহাবিশ্বের (মহাবিশ্বগুলোকে বাতাসে ভেসে বেড়ানো অসংখ্য সাবানের বুদ্বুদের মতো কল্পনা করুন) কোনো একটির সাথে টক্কর লেগে ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা কতটুকু? গুথের হাতে তাৎক্ষণিক কোন হিসাব ছিল না। তবে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এর একটি সম্ভাব্য উত্তর দিয়েছিলেন তিনি, এবং বলা বাহুল্য, তাঁর উত্তরটি তেমন কোনো নাটকীয় কিছু ছিল না। কিন্তু এবিসির অনুষ্ঠান শেষ হবার পর গুথ প্রশ্নটি নিয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা শুরু করলেন। সত্যিই তো এরকম টক্কর লাগলে কী হবে? সেটা কি আমাদের মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে আসবে? আমাদের পর্যবেক্ষণে কি সেটা ধরা পড়বে? তিনি ব্যাপারটি সমাধানের জন্য তাঁর দুই দিকপাল বন্ধু আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন ও জমি গ্যারিগার সাথে মিলে এক গবেষকদল তৈরি করলেন।

তাঁরা হিসাব করে দেখলেন এ ধরনের সংঘর্ষ হবার এবং সেই সংঘর্ষে আমাদের মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু ধ্বংস না হলেও ছোটখাটো ঠোকাঠুকি কি হতে পারে, যাতে মহাবিশ্বের জীবন সংশয় হয়তো ঘটবে না, কিন্তু মহাবিশ্বের গায়ে তৈরি করবে বেদনার রক্তিম কিছু ক্ষত?

এই ব্যাপারটিই বেরিয়ে এল লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক স্টিফেন ফিনি আর তাঁর দলবলের অনুসন্ধানী গবেষণা থেকে। তাঁরা জানতেন যে এ ধরনের ‘ক্ষত’ আবিষ্কার করার একমাত্র জায়গা হচ্ছে নাসার উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ এনিসোট্রপি প্রোব ডেটা যাকে প্রচলিতভাবে অভিহিত করা হয় WMAP ডেটা হিসেবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ পরিমাপের জন্য এই WMAP ডেটা ব্যবহার করে থাকেন। মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্ব প্রসারণের ফলে ধীরে ধীরে যে শীতল হয়ে পরম শূন্যের প্রায় ৩ ডিগ্রি ওপরে এসে পৌঁছেছে, সেটা এই WMAP ডেটায় ধরা পড়েছিল, এবং এটিই ছিল মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-এর প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ, এর জন্য পেনজিয়াস এবং উইলসন একসময় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই WMAP ডেটাকে এখন গুপ্ত পদার্থ ও গুপ্ত শক্তি শনাক্তকরণ, মহাবিশ্বের স্ফীতির নিখুঁত হার নির্ণয়সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি নাসা তার বিগত সাত বছরের WMAP ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেই ফলাফলের ওপরেই চোখ রাখলেন স্টিফেন ফিনি। তাঁরা জানতেন, অতীতে যদি মহাজাগতিক বুদ্বুদীয় কোনো সংঘর্ষ ঘটে থাকে, তবে তার প্রভাব WMAP ডেটায় পড়বে। কারণ এ ধরনের সংঘর্ষ ‘আন্তবুদ্বুদীয় মহাজগতে একধরনের বিষমস্বাত্বক বিকৃতি (inhomogeneities in the inner-bubble cosmology) তৈরি করবে, যা মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণে ধরা পড়তে বাধ্য। স্টিফেন ফিনি এবং তাঁর দল ‘মডুলার এজ ডিটেকশন এলগোরিদমের’ সাহায্যে WMAP ডেটায় সংঘর্ষের ক্ষতস্থানগুলো নির্ণয় করলেন। তারা দেখলেন অন্তত চারটি জায়গায় এরকম সংঘর্ষের আলামত পাওয়া যাচ্ছে; তার মানে অতীতে অন্তত চারবার আমাদের মহাবিশ্বের সাথে খুব ছোট স্কেলে হলেও অন্য মহাবিশ্বের বুদ্বুদীয় সংঘর্ষ ঘটেছিল। স্টিফেন ফিনির সম্পূর্ণ পেপারটি মুক্তমনা থেকে পড়া যাবে।

Brian Greene, The Hidden Reality: Parallel Universes and the Deep Laws of the Cosmos, Vintage, 2011

Zeeya Merali, Will Our Universe Collide With a Neighboring One?, Discover, October 2009 issue; published online November 4, 2009

WMAP PRODUCES NEW RESULTS, http://map.gsfc.nasa.gov/news/index.html

Stephen M. Feeney, First Observational Tests of Eternal Inflation, http://mukto-mona.net/Articles/avijit/multiverse/supporting_doc/Feeney_multiverse_observational_test.pdf

চিত্রঃ মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণের উপাত্তে খুঁজে পাওয়া চক্রাকার ক্ষত – বুদ্বুদীয় সংঘর্ষ এর আলামত। স্টিফেন ফিনির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে জানা যাচ্ছে, অতীতে অন্তত চারবার আমাদের মহাবিশ্বের সাথে খুব ছোট স্কেলে অন্য মহাবিশ্বের সাথে বুদ্বুদীয় সংঘর্ষ ঘটেছিল। আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও অন্য অনেক মহাবিশ্ব থাকার প্রথম পরোক্ষ প্রমাণ বলে একে অভিহিত করা হচ্ছে।

একটি ব্যাপার এখনো বলা প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা এখনো কিন্তু এই ফলাফলকে সংশয়ের চোখেই দেখছেন, এবং স্টিফেন ফিনি নিজেও এটি ভালো করে জানেন। তিনি নিজেই সেটি স্বীকার করে বলেন, মহাজাগতিক বিকিরণের মতো এত বড় উপাত্ত-সমাবেশে এ ধরনের ছোটখাটো ভিন্নতা থাকাটা আর সেটা খুঁজে পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিঃসন্দেহে আমাদের এই গবেষণা এ ব্যাপারে প্রথম পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ, কিন্তু এখনো নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নয় যদিও।

আমাদেরও কিন্তু এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে। তার পরও বলব, যদিও স্টিফেন ফিনীর এই পরীক্ষার ফলাফল এখনো চূড়ান্ত নিশ্চয়তা প্রদানকারী কিছু নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের জগতে এটি একটি আশাবাদী ঘটনা। আর দর্শনগত দিক থেকে তো ব্যাপারটির গুরুত্ব অসীম। মাল্টিভার্স হাইপোথিসিসকে অনেকেই এত দিন ভ্রু কুঁচকে বিজ্ঞানের বাইরে ঠেলে দিতে চাইতেন। এ ধরনের সাম্প্রতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো যেন একে বিজ্ঞানের জগতে প্রথমবারের মতো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দিল শক্তিশালীভাবে। এই ধরনের গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসছে যে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও অসংখ্য মহাবিশ্ব হয়তো ছড়িয়ে আছে, যেগুলোর কোনোটির সাথে হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের সংঘর্ষ সংগঠিত হয়েছিল সুদূর অতীতে। আর বিজ্ঞানীরা কেবল এই ফলাফলের ওপরেই নির্ভর করে বসে নেই; আমরা জানি, তাঁরা ভবিষ্যতে আরো অনেক পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন এই অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণাকে সঠিকভাবে পরীক্ষা করার জন্য। এমনি একটি ভবিষ্যৎ পরীক্ষা হচ্ছে লিসা স্যাটেলাইটের (Laser Interferometer Space Antenna, সংক্ষেপে LISA) উৎক্ষেপণ। বিজ্ঞানীরা এর জন্য এখনই উদগ্রীব হয়ে বসে রয়েছেন। লিসা ভবিষ্যতে আমাদের শক-তরঙ্গ শনাক্তকরণের মাধ্যমে আরো নিশ্চিতভাবে জানাতে পারবে সত্যিই বহির্বিশ্বে আরো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে কি না, আর সত্যই অতীতে আমাদের সাথে লেগেছিল নাকি কারো বুদ্বুদীয় টক্কর। যদি লিসা আমাদের অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করতে পারে, তবে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, কারণ এই ফলাফল দেবে অনন্ত মহাবিশ্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যা সূচনা করবে আরেকটি কোপার্নিকাসীয় বিপ্লবের।

আমরা বইটি শুরুই করেছিলাম এই বলে—‘শূন্য আর অসীম, এরা যেন একে অন্যের যমজ। যেখানে শূন্য সেখানেই সীমাহীনতা’। মাল্টিভার্স যেন সেই দার্শনিক অভিব্যক্তিরই সার্থক প্রতিচ্ছবি। বিজ্ঞান আজ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, স্ফীতি তত্ত্ব অনুসরণ করে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হচ্ছে, এবং সংখ্যায় সেগুলো এটি দুটি নয়, প্রায় অসীমসংখ্যক! শূন্য আর অসীম যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মাল্টিভার্সের জগতে এসে। রবি ঠাকুরের গানের কথাগুলো মনে পড়ছে খুব – ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর’।

♦ ড. মিজান রহমান

♦ অভিজিৎ রায়

♦ ভূমিকা

♦ শূন্য অধ্যায়ঃ অশূন্য মতামত

♦ প্রথম অধ্যায়ঃ কিছু না

♦ দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ শূণ্যের ভীতি

♦ তৃতীয় অধ্যায়ঃ পশ্চিমে নয়, পুবের দিকে

♦ চতুর্থ অধ্যায়ঃ শূন্য এল ইউরোপে

♦ পঞ্চম অধ্যায়ঃ প্রকৃতির শূন্যবিদ্বেষ ?

♦ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিজ্ঞানে শূন্যের আভাস

♦ সপ্তম অধ্যায়ঃ আইনস্টাইনের বিশ্ব

♦ অষ্টম অধ্যায়ঃ শূন্যতার শক্তি

♦ নবম অধ্যায়ঃ মহাবিস্ফোরণের কথা

♦ দশম অধ্যায়ঃ বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?

♦ একাদশ অধ্যায়ঃ কোয়ান্টাম শূন্যতা ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি

♦ দ্বাদশ অধ্যায়ঃ হিগস কণার খোঁজে

♦ ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি

♦ চতুর্দশ অধ্যায়ঃ অনন্ত মহাবিশ্বের সন্ধান শূন্য ও অসীমের মেলবন্ধন

♦ পঞ্চদশ অধ্যায়ঃ অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি: কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?

“শূন্য থেকে মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒অভিযোগ বা মন্তব্য⇐

error: Content is protected !!