পৃথিবী ও চাঁদ ছাড়াও সৌরজগতে আছে আরো আটটি গ্রহ, তাদের চাঁদগুলো, এবং একরাশ গ্রহাণু ও ধূমকেতু। গ্রহগুলোর মধ্যে পৃথিবী পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ, বেশ ছোটো গ্রহ; পৃথিবী আর প্লাতো-আরিস্ততল-টলেমি এবং জিহোভা ও অন্যান্য পৌরাণিক বিধাতার জগতের মতো বিশ্বের রাজধানি নয়, কখনোই ছিলো না, মানুষের— ও তাদের কল্পিত বিধাতাদের- ভুল ধারণাই পৃথিবীকে বসিয়েছিলো বিশ্বের কেন্দ্রে । পৃথিবী ও আমরা মহাবিশ্বের অংশ, কেন্দ্র নই। সৌরজগত মহাবিশ্বের, এবং ছায়াপথ তারকাপুঞ্জের, একটি ছোটো এলাকা, যেখানে সূর্য নামের একটি মাঝারি তারাকে কেন্দ্র ক’রে ঘুরছে নটি গ্রহ, তাদের উপগ্রহগুলো, ও একরাশ গ্রহাণু ও ধূমকেতু। সৌরজগতের কেন্দ্র সূর্যের পরে আছে এ-গ্রহগুলোঃ বুধ (মারকিউরি), শুক্র (ভিনাস), পৃথিবী (আর্থ), মঙ্গল (মার্স), বৃহস্পতি (জুপিটার), শনি (স্যাটার্ন), ইউরেনাস, নেপটুন বা নেপচুন, ও প্লুটো। সূর্যের ব্যাস বৃহস্পতির ব্যাসের ১০ গুণ, বৃহস্পতির ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১০ গুণ। সূর্য গ্যাসে গঠিত একটি তারা, আর গ্রহগুলো গঠিত মোটামুটিভাবে কঠিন পদার্থে।

গ্রহ-উপগ্রহগুলোর আলো নেই, সূর্যের আলো প্রতিফলিত ক’রে এগুলো আলোকিত হয়ে ওঠে । গ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে; উপগ্রহগুলো প্রদক্ষিণ করে নিজ নিজ গ্রহকে । গ্রহগুলোকে ভাগ করা হয় দু-ভাগে, সূর্যের কাছাকাছি বা অন্তর্ভাগের চারটি গ্রহকে বলা হয় পার্থিব গ্রহঃ টেরেস্ট্রিয়াল প্ল্যানেট :: বুধ (মারকিউরি), শুক্র (ভিনাস), পৃথিবী (আর্থ), মঙ্গল (মার্স)। আকারে ও গঠনে এগুলোর মিল আছে পৃথিবীর সাথে। সৌরজগতের বহির্ভাগের চারটি বিশাল গ্রহকে বলা হয় মহাকায় গ্রহঃ জায়েন্ট প্ল্যানেট :: বৃহস্পতি (জুপিটার), শনি (স্যাটার্ন), ইউরেনাস, নেপটুন। এগুলো পার্থিব গ্রহগুলোর থেকে বহুগুণে বড়ো, এগুলোর গঠনও ভিন্ন । প্লুটো এর কোনো ভাগে পড়ে না; এটি এক বিশেষ রহস্যময় গ্রহ। সূর্য থেকে গ্রহগুলোর দূরত্বের মধ্যে একটি অদ্ভুত সম্পর্ক আছেঃ আগের গ্রহটির দূরত্ব যতোটা পরের গ্রহটির দূরত্ব সাধারণত তার দ্বিগুণ। এটা প্রথম বের করেছিলেন জর্মন জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইটিয়াস, ও একে জনপ্রিয় করেছিলেন ইয়োহান বোড। এটা বোর্ডের সূত্র নামে পরিচিত। ১৭৮১ অব্দে বোডের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ঠিক জায়গায়, সূর্য থেকে শনির দূরত্বের দ্বিগুণ দূরে, আবিষ্কৃত হয় ইউরেনাস; তারপর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে একটি গ্রহ খুঁজতে থাকেন; তাঁরা কোনো নতুন গ্রহ পান না, কিন্তু এক ইতালীয় পুরোহিত ঠিক জায়গায় আবিষ্কার করেন ‘সেরেস’ নামের প্রথম ও বৃহত্তম গ্রহাণুটি।

বুধঃ মৃত ভুবন

বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ; সৌরজগতরে দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম গ্রহ। বুধের ব্যাস ৪,৮৭৮ কিমি, ভর ৩.৩০ X ১০২৩ কেজি, এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ৮৭.৯৭ দিনে, নিজের অক্ষের ওপর একবার আবর্তিত হয় ৫৮.৬৫ দিনে, সূর্য থেকে বুধের দূরত্ব ০.৩৮৭ জ্যোতি একক, ৫৭,৯০০,০০০ কিমি. এর ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ৫.৪৩ গ্রাম, ওপরতলের অভিকর্ষ ০.৩৮ পার্থিব অভিকর্ষ, মুক্তিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৪.৩ কিমি। এর কোনো উপগ্রহ বা চাঁদ নেই; এবং আমাদের চাঁদের মতোই এক মৃত জগত বুধ।

বুধগ্রহ। বুধ একটি গহ্বরপূর্ণ গ্রহ। বুধের সাথে মিল আছে। আমাদের চাঁদের। এর বৃহত্তম গহ্বরগুলোর আয়তন প্রায় ২০০ কিমি। ছবিটি তুলেছে ম্যারিনার ১০ মহাশূন্যযান।

বুধগ্রহ আকারে পৃথিবীর ৪০% ভাগ, চাঁদের থেকে এটি বড়ো ৪০% ভাগ ৷ বুধ গহ্বরে পরিপূর্ণ গ্রহ, এর কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। বুধ সূর্যের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ করে ৮৮ দিনে, আর নিজের অক্ষের ওপর একবার আবর্তন করে ৫৯ দিনে; এ-দুটি গতি মিলিয়ে দেখা যায় বুধের আকাশে সূর্য চলে খুব ধীরে, এক দুপুর থেকে আরেক দুপুরে যেতে লাগে ১৭৬ দিন। পৃথিবীর দিন যেমন নিজের অক্ষের ওপর একবার আবর্তনের সমান, বুধের দিন তেমন নয়; বুধ নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ৫৯ দিন সময় নিলেও তার দিন হয় ১৭৬ দিনে। অর্থাৎ বুধের একদিন তার এক বছরের দ্বিগুণ। সূর্যকে ঘিরে ঘুরতে গিয়ে এক রহস্যপূর্ণ কাজ করে বুধ, বছরে বছরে ধীরেধীরে বদলে যায় এর পেরিহেলিয়ন বা সূর্য থেকে সন্নিকটতম অবস্থান । বিশাল সূর্যের ভরে এক শতাব্দীতে চাপের ৪৩.০৩ সেকেন্ড বিচলিত হয় বুধের কক্ষপথ। বুধ সূর্যের খুব কাছে ব’লে বিকেলে এর তাপমাত্রা ৫০০ কেলভিনের (৪৪১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি, রাতে ১০০ কেলভিনের কম। চাঁদের মতোই বুধের ওপরতলে আছে অসংখ্য গর্ত, এটা এক বন্ধুর এলাকা। ৩.৫ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে বুধের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিলো লাভার প্রবাহ, এটি প্রচণ্ডভাবে আহত হয়েছিলো আগ্রহ বস্তুদের আঘাতে। বুধের ভূভাগ চাঁদের ভূভাগের মতো- ধুলোতে আচ্ছন্ন পাহাড় সেখানে আবৃত হয়ে আছে শিলাস্তরে । বুধের আকাশ কৃষ্ণ; তার দিনের আকাশে জ্বলে পৃথিবীর সূর্যের থেকে ২১/২ গুণ সূর্য; রাতের আকাশে অনেক সময় জ্বলজ্বল করে আমাদের আকাশের যে-কোনো তারার থেকে অনেক উজ্জ্বল দুটি গ্রহ : নীলাভ পৃথিবী আর হলুদাভ-শাদা শুক্র । বুধে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই; তবে আছে সোডিয়াম অণুর প্রাচুর্য।

শুক্রঃ মেঘে ঢাকা নরক

শুক্র সূর্য থেকে দ্বিতীয় গ্রহ, এর আকার পৃথিবীর আকারের মতো ব’লে একে পৃথিবীর সহোদরা ব’লেই মনে করা হয় অনেকটা। শুক্রের ব্যাস ১২,১০৪ কিমি, ভর ৪.৮৭ X ১০২৪ কেজি, নিজের অক্ষের ওপর শুক্র একবার আবর্তিত হয় ২৪৩ দিনে, এটি সামনের দিকে আবর্তন করে না অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পুব দিকে আবর্তিত হয় না শুক্র, এটির গতি পশ্চাৎগতি, আবর্তিত হয় পুব থেকে পশ্চিমে, সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ২২৫ দিনে, সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ০.৭২৩ জ্যোতি-একক, ১০৮,২০০,০০০ কিমি; এর মুক্তিবেগ প্রতি সেকেন্ড ১০.৪ কিমি, ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ৫.২৫ গ্রাম, এর ওপরতলের অভিকর্ষ ০.৯০ পার্থিব অভিকর্ষ। এর কোনো উপগ্রহ নেই।

শুক্রগ্রহ। শুক্রের সবচেয়ে কাছে থেকে তোলা এটিই প্রথম সম্পূর্ণ গোলকের ছবি। ছবিটি তুলেছে পাইওনিয়ার ভিনাস নভযান । ছবিতে দেখা যাচ্ছে শুক্রের মেঘ। এটিই ভোরে শুকতারা সন্ধ্যায় সন্ধ্যাতারা হয়ে দেখা দেয়, যদিও এটি মেঘে ঢাকা এক নরক।

শুক্রের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ৯৫% ভাগ, ভর পৃথিবীর ভরের ৮২% ভাগ । শুক্র পৃথিবীর কাছাকাছি গ্রহ হ’লেও এটি থেকেছে রহস্যময়, কেননা এটি ঢাকা মেঘে; এক সময় মনে করা হতো এটি পৃথিবীর মতোই, একে মনে করা হতো পৃথিবীর যমজ বোন ব’লে; তবে নভচারীহীন নভযানের তোলা ছবি থেকে বোঝা গেছে যে শুক্র খুবই ভিন্ন পৃথিবীর থেকে। এটি প্রথমেই ভিন্ন হয়ে যায় বুধ, পৃথিবী, ও মঙ্গল থেকে এর ভিন্ন আবর্তনের জন্যে; অন্য সব গ্রহ আবর্তিত হয় সামনের দিকে- পশ্চিম থেকে পুবে; কিন্তু শুক্র ঘোরে পেছনের দিকে- পূব থেকে পশ্চিমে । এর আবর্তনও খুব ধীর, অক্ষের ওপর এক পাক খেতে শুক্র সময় নেয় ২৪৩ দিন । এ-অস্বাভাবিক আবর্তনের পেছনে হয়তো আছে পৃথিবী ও শুক্রের মাঝে সক্রিয় জোয়ারভাটার শক্তি, বা হয়তো অনেক আগে শুক্র সংঘর্ষে পড়েছিলো আমাদের চাঁদের থেকে বড়ো কোনো বস্তুর সাথে, যাতে উল্টে গেছে তার আবর্তনের অভিমুখ । শুক্রের বায়ুমণ্ডল আছে, এটা আবিষ্কার করেন ১৭৬১ অব্দে রুশ বিজ্ঞানী লোমোনোসোভ; শুক্রের বায়ুমণ্ডলের ৯৬% ভাগ কার্বনডাইঅক্সাইড। শুক্র ঢেকে আছে শাদা আবরণে। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর অনেক লেখক মনে করতেন শুক্রের আবরণের নিচে চলছে মেঘবজ্রের ঘনঘটা, মুষলধারায় হচ্ছে বৃষ্টি, সেখানে আছে ব্রাজিলের অরণ্যের মতো নিবিড় বৃষ্টি-অরণ্য; কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে এর বিকিরণ মেপে দেখা যায় শুক্র এক নরক- এর নিচের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ৭৫০ কেলভিন (৮৯১ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। তাই সেখানে জল বা প্রাণ থাকতে পারে না । ১৯৭০-এ সোভিয়েত গবেষণাযান ভেনেরা ৭ প্রথম সফলভাবে নামে শুক্রে, ২৩ মিনিট ধ’রে উপাত্ত পাঠায় শুক্রের ওপরস্তরের। তাতে জানা যায় শুক্রে বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের ৯০ গুণ; পৃথিবীতে প্রতি বর্গইঞ্চির ওপর বায়ুমণ্ডলে চাপ ১৪.৭ পাউন্ড, শুক্রে চাপ ১৩২০ পাউন্ড।

খুবই বিস্ময়কর ভুবন শুক্র; শুক্রের মেঘপুঞ্জ জলকণায় গঠিত নয়, তার আকাশে জমে সালফিউরিক এসিডের মেঘ। শুক্রের এসিডের মেঘমণ্ডল ভাসে ৪৮ থেকে ৫৮ কিমি ওপরে; পৃথিবীর মেঘপুঞ্জ ভাসে ১০ কিমিরও নিচে। শুক্রের মেঘ জমে পৃথিবীর মেঘের মতোই, শুধু উপাদান ভিন্ন; শুক্রের সালফিউরিক এসিডের বৃষ্টি তার ভূমিতে পড়তে পারে না, পড়ার আগেই প্রচণ্ড তাপে পরিণত হয় বাষ্পে ৷ শুক্রের মেঘমণ্ডলে ঘটে ভয়ঙ্কর বিদ্যুৎত্বজ্রের বিস্ফোরণ। শুক্রে সূর্যের আলো শোষণ ও অবলোহিত (ইনফ্রারেড) আলো বিকিরণের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সবুজগৃহ পরিণতি : গ্রিনহাউজ ইফেক্ট। সবুজগৃহে কাচের দেয়াল ভেদ করে সূর্যালোক ঢুকতে পারে, কিন্তু অবলোহিত আলো বেরিয়ে যেতে পারে না । তাই ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে সবুজগৃহ। শুক্রের প্রকাণ্ড কার্বনডাইঅক্সাইড মেঘমণ্ডল অবলোহিত বিকিরণকে বেরিয়ে যেতে দেয় না, তাই প্রচণ্ড গরম হয়ে আছে শুক্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার গবেষণাযান (ভেনেরা ৭, ৯, ১০, ১৩, ১৪ প্রভৃতি) পাঠিয়েছে শুক্রে; এসব যান বহু চমৎকার ছবি পাঠিয়েছে শুক্রের ভূভাগের । তাতে দেখা যায় সেখানে আছে কৌণিক পাথরখণ্ড, কাঁকর, বিভিন্ন জায়গায় আছে মসৃণ মাটি; তার ভূভাগ কমলা-ধূসর রঙের, তার ৬০% ভাগই নিম্ন সমভূমি। শুক্রের মাটির ওপর বাতাসও বয় ধীরে, ঘণ্টায় ১/২ থেকে ৩ মাইল বেগে । শুক্রের ইউরোপি নাম ভিনাস, এ-নাম রাখা হয়েছিলো রোমান সৌন্দর্য ও প্রেমের দেবীর নামে । যাঁরা এ-নাম রেখেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন সৌন্দর্যের ঢেউ বয়ে যায় ভিনাসের শরীরের ওপর দিয়ে, কিন্তু এটিতে আছে ভয়াবহ সৌন্দর্য । আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও শুক্রের মানচিত্র তৈরি ক’রে তার নানা এলাকার নাম রাখছেন পৌরাণিক ও বাস্তব নারীদের নামে। শুক্রের বৃহত্তম মহাদেশের নাম রাখা হয়েছে আফ্রোদিতি তেরা, তার অগ্নিগিরির নাম ইশতার তেরা, একটি গহ্বরের নাম রাখা হয়েছে ইভ বা হাওয়া। শুক্র অবশ্য শুকতারা ও সন্ধ্যাতারা হয়ে জ্বলে আমাদের আকাশে, তার উজ্জ্বলতায় মুগ্ধ না হয়ে পারি না।

মঙ্গলঃ লাল গ্রহ

মঙ্গল সূর্য থেকে চতুর্থ গ্রহ, শুক্রের পরই এটি পৃথিবীর কাছের প্রতিবেশী গ্রহ। মঙ্গলের ব্যাস ৬৭৮৭ কিমি, ভর ৬.৪৪ X ১০২৩ কেজি, অক্ষের ওপর একবার আবর্তিত হয় ১.০২ দিনে, সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ৬৮৭ দিনে, সূর্য থেকে এর দূরত্ব ১.৫২৪ জ্যোতি-একক, ২২৭,৯০০,০০০ কিমি, এর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৫ কিমি, এর ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ৩.৯৫ গ্রাম, অভিকর্ষ ০.৩৮ পার্থিব অভিকর্ষ। মঙ্গলের আছে দুটি উপগ্রহ : ফোবোস ও ডিমোস। মঙ্গলের ইউরোপি নাম মার্স রাখা হয়েছে রোমান সমরদেবতার নামে (গ্রিক নাম আরেস, তাও তাদের সমরদেবতার নামে); তার চাঁদ দুটির নামও রাখা হয়েছে মার্সের রথের দুটি অশ্বের নামে- অভ্যন্তর ভাগের উপগ্রহ ফোবাস, অর্থ ‘ভয়’, আর বহির্ভাগের উপগ্রহ ডিমোস – অর্থ ‘ত্রাস’।

মঙ্গলগ্রহ। নিচের দিকে মাঝামাঝি দেখা যাচ্ছে গভীর গিরিখাত ভালেস মারিনেরিস। গিরিখাতটির পশ্চিম দিক ৫ কিমি গভীর। বাঁ দিকে দেখা যাচ্ছে তিনটি অগ্নিগিরি। ছবিটি তুলেছে ভাইকিং ১ মহাশূন্যযান।

প্রাচীন কাল থেকেই মঙ্গল বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ ক’রে এসেছে তার স্পষ্ট লাল বর্ণের জন্যে, যা পৃথিবী থেকে খালি চোখেও দেখা যায়। মঙ্গল যখন সবচেয়ে কাছে আসে পৃথিবীর, তখন থাকে মাত্র ৫৬ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে, সাধারণ দূরবিন দিয়েও দেখা যায় তার লাল ভূস্তর, মেরু অঞ্চলের বরফ, মেঘ, আর ঝাপসা দাগগুলো । দূরবিন দিয়ে মঙ্গলগ্রহ প্রথম দেখেছিলেন গ্যালিলিও ১৬১০ অব্দে; তিনি বুঝেছিলেন যে এটি গোলাকার, আর আলোকিত হয় সূর্যের আলোতে। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স, ১৬৫৯ অব্দে, প্রথম স্পষ্ট ছবি এঁকেছিলেন মঙ্গলের দাগগুলোর; কয়েক বছর পর জিওভান্নি দেমেনিকো কাসিনি দাগগুলো দেখে হিশেব করেন যে মঙ্গল আবর্তনে সময় নেয় ২৪ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। মঙ্গলে ঋতুবদল ঘটে; মঙ্গলের ঋতু পৃথিবীর ঋতুর দ্বিগুণ দীর্ঘ, কেননা মঙ্গলের বছর পৃথিবীর বছরের দ্বিগুণ দীর্ঘ । প্রথম দিকের অনেক পর্যবেক্ষক মঙ্গলের অন্ধকার এলাকাগুলোকে সাগর মনে ক’রে নাম দিয়েছিলেন মারিয়া, যা ভুল ব’লে প্রমাণিত হয়েছে। মঙ্গল সম্পর্কে বেশি আশা ছিলো সকলের মনে, তাই একে ঘিরে তৈরি হয়েছিলো নানা কিংবদন্তি। ১৮৬৯ অব্দে অ্যাঞ্জেলো সেকি মঙ্গলের দাগগুলোর নাম দেন ‘কানালি’ বা খাল; একে জনপ্রিয় ক’রে তোলেন জিওভান্নি শিয়াপারেলি । ১৮৯৫ অব্দে বেরোয় পার্সিভাল লাওয়েলের বই মার্স, যাতে মঙ্গলের খাল ও জীবনধারার উজ্জ্বল কাল্পনিক বিবরণ দেন লাওয়েল । তিনি বলেন মঙ্গলে রয়েছে কৃত্রিম খালের সুশৃঙ্খল বিন্যাস, যা দিয়ে মেরু-অঞ্চল থেকে বইয়ে আনা হয় জল, কেননা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে মঙ্গল । তিনি দাবি করেন সেখানে রয়েছে অত্যন্ত দক্ষ সরকার। এসব পরে সম্পূর্ণ ভুল রূপকথা ব’লে প্রমাণিত হয়েছে।

মঙ্গল নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু শিহরণজাগানো কল্পকাহিনী, বহু সাইফাই; বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় তার সবই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ‘উড়ন্ত সসার’, ‘অশনাক্ত উড়ন্ত বস্তু’ প্রভৃতি কিংবদিন্ত গ’ড়ে ওঠে মঙ্গলকে নিয়েই । দূরবিন দিয়ে পর্যবেক্ষকেরা মঙ্গলে যে-সব খালের বিন্যাস দেখেছেন, সেগুলো মঙ্গলে ছিলো না, ছিলো পর্যবেক্ষকদের মনে । অনেকে কল্পনা করেছেন মঙ্গলগ্রহের অতিবুদ্ধিমান প্রাণীরা আক্রমণ করেছে পৃথিবী। ১৮৯৮ অব্দে বেরোয় এইচ জি ওয়েসের দি ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস, যাতে মঙ্গলবাসীরা তাদের মুমূর্ষু গ্রহ ছেড়ে এসে আক্রমণ করে পৃথিবী । ৩০ অক্টোবর ১৯৩৮-এ অরসন ওয়েলেস্ প্রচার করেন এর বেতার নাট্যরূপ; একে শ্রোতারা সত্য মনে ক’রে ভয়ে হৈচৈ শুরু করে; এবং জন্ম নেয় এক সৌরজাগতিক কেলেঙ্কারি। কোনো মাঙ্গলিক সভ্যতা নেই, বুদ্ধিমান প্রাণীও নেই মঙ্গলগ্রহে; এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে মঙ্গলে গবেষণানভোযান পৌঁছোনোর পর। সোভিয়েন ইউনিয়ন ১৯৭১-১৯৭৪-এ মঙ্গলে পাঠায় তিনটি গবেষণাযান, তিনটিই ব্যর্থ হয়; চাঁদে মানুষ নামার ৭ বছর পর ২০ জুলাই ১৯৭৬-এ মঙ্গলে প্রথম সফলভাবে নামে মার্কিন নভোযান ভাইকিং ১। ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬-এ নামে ভাইকিং ২ । এ-দুটি যে-ছবি পাঠায় মঙ্গলের তাতে নেই কোনো মঙ্গলবাসী, নেই জনশূন্য নগরী, খাল, বা নিবিড় অরণ্য। মঙ্গল দেখা দেয় এক শূন্য ঠাণ্ডা লাল-হলুদ মরুভূমিরূপে।

মঙ্গলে আছে খুব লঘু বায়ুমণ্ডল, যার বেশির ভাগ, ৯৫%, কার্বন ডাইঅক্সাইড; দিনে সেখানে তাপমাত্রা ২৪৪ কেলভিন ( ২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) আর রাতে ১৮৭ কেলভিন (−১২৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। সেখানে বাতাসের বেগ মোটামুটিভাবে ঘণ্টায় ১৭ কিমি। মঙ্গলের মেরুদেশে জ’মে আছে বরফ । মঙ্গলের শিলা লাভার প্রবাহে গঠিত। মঙ্গলে যে সামান্য পানি আছে, তা আছে অণুরূপে । মঙ্গলের গায়ে যে-গাঢ় দাগগুলো দেখা যায়, একদা যেগুলোকে মনে করা হতো অরণ্য, সেগুলো সম্ভবত ধুলোর স্তূপ। মঙ্গলে কখনো কখনো ঝড়ের ফলে ২ থেকে ৬ কিমি উঁচু ধুলোর স্তম্ভ ওঠে। মঙ্গলে আছে বহু গহ্বর, তাতে মনে হয় মঙ্গলের ওপর গ্রহাণুর আঘাত হয়েছে ব্যাপকভাবে। ১৯৭১ অব্দে মেরিনার ৯ মঙ্গলে আবিষ্কার করে সৌরজগতের সবচেয়ে বড়ো অগ্নিগিরিগুলো। উচ্চতম অগ্নিগিরিটির নাম দেয়া হয়েছে অলিম্পাস মোন্স, এর উচ্চতা ২৪ কিমি বা ৭৮,০০০ ফুট। বহু অগ্নিগিরি আছে মঙ্গলে, তবে সেখানে শেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিলো সম্ভবত ১.৩ বিলিয়ন বছর আগে । মঙ্গলের বর্তমান পরিবেশ জীবনের সম্পূর্ণ প্রতিকূল । ভাইকিং নভোযানগুলো দেখিয়েছে যে মঙ্গলের উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যস্ত জীবনের প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে না, যদিও এমন একটি আশা অনেকের ছিলো । ১৮৭৭ অব্দে আসাফ হল আবিষ্কার করেন মঙ্গলের দুটি উপগ্রহ; তিনি অন্তর্ভাগের উপগ্রহটির নাম দেন ফোবোস, বহির্ভাগেরটির নাম দেন ডিমোস। মঙ্গলের চাঁদ দুটিও অদ্ভুত, এ-দুটি গোল আলুর মতো দেখতে দুটি চাপখাওয়া শিলাখণ্ড। ফোবোসের দৈর্ঘ্য ২৮ কিমি, ডিমোসের দৈর্ঘ্য ১৬ কিমি। এ-দুটি আছে মঙ্গলের খুব কাছাকাছি; ডিমোস ৩০১, ঘণ্টায় মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করে, পুবে উঠে অস্ত যায় পশ্চিমে; আর ফোবোস ৭১৩ ঘণ্টায় প্রদক্ষিণ করে মঙ্গলকে, পশ্চিমে উঠে অস্ত যায় পুবে।

মহাকায় গ্রহরাশি

পার্থিব গ্রহগুলো সূর্যের কাছাকাছি; গ্রহাণুবলয়ের পর সৌরজগতের বহির্ভাগের গ্রহগুলো— বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, ও নেপটুন- মহাকায়। একটি ছোটো গ্রহ আছে এ-ধারেঃ প্লুটো। বৃহস্পতি বৃহত্তম গ্রহ, সবগুলো গ্রহের ভরের ৭১% ভাগ ভরই বৃহস্পতির; আর এ-গ্রহগুলোর প্রত্যেকের আছে উপগ্রহবাহিনী- সব মিলে কমপক্ষে ৪১টি। সবগুলো গ্রহের ভরের 99½% ভাগ ভরই ধারণ করে এ চারটি গ্রহ। তবে এগুলোর গড়ঘনত্ব পার্থিব গ্রহগুলোর ঘনত্বের থেকে কম। শনির ঘনত্ব পানির ঘনত্বের থেকেও কম, সৌরজগতের সমান একটি সাগরে পড়লে এটি ভেসে থাকবে বরফের টুকরোর মতোই! মহাকায় গ্রহগুলো প্রধানত বরফ ও তরল হাইড্রোজেনে গঠিত । বৃহস্পতির ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১০ গুণ, আর শনির ব্যাস ১০ গুণের সামান্য কম । ইউরেনাস ও নেপটুনের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৪ গুণ। এগুলো বড়ো দুটি কারণে; এগুলোতে বেশি আছে বরফ, আর এগুলো অভিকর্ষ দিয়ে নিজেদের মধ্যে টেনে এনেছে হাইড্রোজেন বোঝাই গ্যাস। বৃহস্পতি, সূর্যের পরেই, সৌরজগতের বৃহত্তম বস্তু; এর ভর অন্য সব গ্রহের মিলিত ভরের 2½ গুণ। সূর্য থেকে বৃহস্পতির গড়দূরত্ব ৫.২০৩ জ্যোতি-একক, ৭৭৮,৩০০,০০০ কিমি, নিকটতম দূরত্ব ৪.৯৫১ জ্যোতি-একক, দূরতম দূরত্ব ৫.৪৫৫ জ্যোতি-একক; বৃহস্পতি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ১১.৮৬ বছরে (৪,৩৩৩ দিনে), একবার আবর্তিত হয় ৯ ঘণ্টা ৫০ মিনিটে; এর গড়ব্যাস ১৩৭,৫০০ কিমি (পৃথিবীর ব্যাসের ১০.৭৯ গুণ), ভর ১.৯০ × ১০৩০ গ্রাম (পৃথিবীর ভরের ৩১৮.১ গুণ), প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ঘনত্ব ১.৩৩ গ্রাম; অভিকর্ষ ২.৬৪ পার্থিব অভিকর্ষ, মুক্তিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৫৯.৫ কিমি; মেঘের চুড়োর তাপ ১৩০ কেলভিন, অ্যালবেডো বা আলো প্রতিফলনের শক্তি ০.৫১। বৃহস্পতির আছে ১৬টি চাঁদ : আইও, ইউরোপা, গ্যানাইমিড, কালিস্তো, আমালথিয়া, হিমালিয়া, এলারা, পাসিফায়ে, সাইনোপি, লাইসিথিয়া, কার্যে, আনানকে, লিডা, থিবি, অ্যান্ড্রাস্টিয়া, মেতিস।

বৃহস্পতিগ্রহ ও তার গ্যালিলিও উপগ্রহগুচ্ছ। এ-চারটি চাঁদ- আইও, ইউরোপা, গ্যানাইমিড, ও কালিস্তো- আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালিলিও, দেখিয়েছিলেন সব কিছু ঘোরে না পৃথিবীকে ঘিরে।

বৃহস্পতি সম্পূর্ণ ভিন্ন সৌরজগতের অন্তর্ভাগের গ্রহগুলো থেকে। বৃহস্পতির বিষুবরেখার সাথে সমান্তরালভাবে আছে গাঢ় ও লঘু মেঘাঞ্চল; গাঢ় মেঘাঞ্চলকে বলা হয় বলয় বেল্ট, আর লঘু মেঘাঞ্চলকে বলা হয় এলাকাঃ জোন। এ-দু-অঞ্চলে মাঝেমাঝে দেখা যায় কুণ্ডলিপাকানো গোলাকার কলঙ্ক, আর ডোরা; ওগুলো দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। ওগুলোর কোনো কোনোটি পৃথিবীর থেকেও বড়ো। মেঘের বলয়গুলোতে দেখা যায় স্পষ্ট বাদামি, লালাভ, ও সবুজাভ রঙ; আর লঘু এলাকাগুলোতে দেখা যায় শাদাটে ও হলুদাভ রঙ বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে আছে প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম বা সৌরক। এর বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের জলবায়ু নয়, হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের বায়ুমণ্ডল ৷ সূর্যও এ-গ্যাসেই গঠিত। বৃহস্পতি সূর্য থেকে বহু দূরে ব’লে তার বায়ুমণ্ডল খুবই শীতল । বৃহস্পতিতে ৩০০ বছর ধ’রে বয়ে চলছে পৃথিবীর থেকে ৩ গুণ বড়ো আয়তনের প্রচণ্ড ঝড়। বৃহস্পতি সূর্যালোক প্রতিফলিত করা ছাড়াও বিচ্ছুরিত করে তিন ধরনের বিকিরণঃ অবলোহিত তাপ বিকিরণ, ক্ষুদ্রতরঙ্গ রেডিও বিকিরণ, ও দীর্ঘতরঙ্গ রেডিও বিকিরণ। বৃহস্পতি সূর্য থেকে যে-পরিমাণ শক্তি শোষণ করে, তার দ্বিগুণ বিকিরণ ঘটায়; এ-অতিরিক্ত শক্তি কোথায় পায় বৃহস্পতি? মনে করা হয় বৃহস্পতি সম্ভবত সংহত সংকুচিত হচ্ছে, তার ভেতর থেকে আভিকর্ষিক বল বেরিয়ে আসছে তাপ ও বিকিরণরূপে । এটি নিজের শক্তি বিকিরিত করলেও এটি তারা নয়, কেননা তার শক্তি পারমাণবিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় না । বৃহস্পতি পৃথিবীর মতো শিলা ও লোহায় গঠিত গ্রহ নয়; এর অভ্যন্তর ভাগ সম্ভবত গঠিত ৬০% হাইড্রোজেন ও ৪০% ভাগ হিলিয়াম, সিলিকেট প্রভৃতিতে।

বৃহস্পতির আছে ১৬টি উপগ্রহ; এর মধ্যে আছে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উপগ্রহ, আবার দুটি আছে বুধগ্রহের থেকেও বড়ো। উপগ্রহগুলোকে আবিষ্কারের ক্রমানুসারে সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। বৃহত্তম ৪টি উপগ্রহ স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালিলিও এবং মারিয়াস ১৬১০ অব্দের পরপর দু-রাতে হাতে দূরবিন পাওয়ার সাথে সাথে। এ-উপগ্রহগুলো- গ্যানাইমিড, কালিস্তো, আইও, এবং ইউরোপা- পরিচিত ‘গ্যালিলিওর উপগ্রহ’ নামে । টলেমীয় বিশ্বকাঠামোর বিপক্ষে প্রমাণ হিশেবে এগুলোকেই ব্যবহার করেছিলেন গ্যালিলিও, দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে সব কিছু পৃথিবীকে ঘিরে ঘোরে না, তাই পৃথিবী বিশ্বের কেন্দ্র নয়।

শনিঃ চক্রধর ভয়াল সুন্দর গ্রহ

সৌরজগতের সবচেয়ে ভয়াল সুন্দর দৃশ্য শনিগ্রহ- শনি বিখ্যাত তার চক্র বা বলয়ের জন্যে; তার চারদিকের স্তরবিন্যস্ত বলয় বা চক্রের ছবি দেখলেই এক মহাজাগতিক শিহরণ জাগে। সূর্য থেকে শনির গড়দূরত্ব ৯.৫৫৫ জ্যোতি-একক, ১,৪২৭,০০০,০০০ কিমি, সূর্যের থেকে নিকটতম দূরত্ব ৯.০২০ জ্যোতি-একক, দূরতম দূরত্ব ১০.০৯০ জ্যোতি-একক, সূর্যকে শনি একবার প্রদক্ষিণ করে ২৯.৪৬ বছরে (১০,৭৫৯ দিনে), শনি একবার আবর্তিত হয় ১০ ঘণ্টা ১৩ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে, শনির ব্যাস ১১৩,৪৫০ কিমি (পৃথিবীর ব্যাসের ৮.৯১ গুণ), শনির ভর ৫.৬৯ × ১০২৯ গ্রাম (পৃথিবীর ভরের ৯৫.২ গুণ), ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ০.৬৯ গ্রাম, অভিকর্ষ ১.১৩ পার্থিব অভিকর্ষ, মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৩৫.৬ কিমি, মেঘের চূড়োয় তাপমাত্রা ৯৫ কেলভিন, অ্যালবেডো ০.৫০। শনির উপগ্রহ আছে ১৭টিঃ মিমাস, এনকেলাদুস, টিথিস, ডিওনে, রিয়া, টাইটান, হাইপেরিয়ন, আইয়াপেটাস, ফিবি, জানুস, এপিমিথিউস, হেলেন, তেলেস্তো, ক্যালিপ্সো, অ্যাটলাস, প্রোমিথিউস, প্যান্ডোরা। সন্দেহ করা হয় আরো ৩টি উপগ্রহ আছে, যা আজো ধরা পড়ে নি।

শনিগ্রহ। পৃথিবী থেকে দূরবিনের ভেতর দিয়ে যেমন দেখায় শনিকে । ছবিতে শনির চক্রের গঠনও ধরা পড়েছে।

গ্যালিলিও শনিকে প্রথম দেখেছিলেন ১৬১০ অব্দে, অস্পষ্ট ছোপের মতো একটি চাকতির দু-দিকে দেখেছিলেন দুটি অস্পষ্ট বস্তু। তিনি এর ছবি এঁকেছিলেন ত্রয়ীগ্রহরূপে। ১৬৫৫ অব্দে হাইগেন্স আবিষ্কার করেন যে গ্রহটিকে ঘিরে আছে বলয় বা চক্রের গুচ্ছ। চক্রগুলো এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ২৭৪,০০০ কিমি বিস্তৃত, তবে ওগুলো ১০০ মিটারের থেকেও কম পুরু। শনির চক্রগুলো কোটি কোটি পৃথক কণিকায় গঠিত, পৃথিবী থেকে এগুলো দেখা অসম্ভব । ১৮৯৫ অব্দে ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দেখান যে চক্রগুলো কঠিন চাকতি হ’তে পারে না, কঠিন হ’লে এগুলো ভেঙেচুরে কণিকায় পরিণত হতো। এখন জানা গেছে চক্রগুলোর কণিকা জমাট জলে গঠিত, বা আবৃত। চক্রগুলো কতকগুলো শূন্যস্থান বা ফাঁক দিয়ে বিভক্ত; এর মধ্যে সবচেয়ে বড়োটিকে বলা হয় ‘কাসিনির বিভাগ’, কেননা ১৬৭৫ অব্দে এটি আবিষ্কার করেন জি ডি কাসিনি। শনির যে-সব বিস্ময়কর ছবি পাঠিয়েছে ভয়েজার ১ ও ২, সেগুলোতে দেখা যায় চক্রগুলোতে আছে হাজার হাজার বিভাগ ও ক্ষুদ্র চক্র। শনির মেঘমণ্ডল বিভক্ত দু-ভাগে, একভাগ উজ্জ্বল আরেক ভাগ অন্ধকার । শনি সূর্য থেকে বৃহস্পতির দ্বিগুণ দূরত্বে আছে ব’লে খুবই শীতল। শনির বায়ুমণ্ডল প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামে গঠিত।

শনির আছে কমপক্ষে ১৭টি চাঁদ। আছে একটি ছোটো বহিপ্রান্তিক চাঁদ, আছে একগুচ্ছ বেশ বড়ো চাঁদ, যেগুলোর মধ্যে বৃহত্তমটির নাম টাইটান। এছাড়াও চক্রগুলোর কাছে আছে অজস্র ছোটো ছোটো চাঁদ। মিমাস নামের একটি বরফের চাঁদ আছে, যার ব্যাস ৩৯৪ কিমি; আরেকটি চাঁদ এনকেলাদুস, এর ব্যাস ৫০২ কিমি; টিথিস, ডিওনে ও রিয়া নামের চাঁদ তিনটির ব্যাস ১০০০ থেকে ১৫০০ কিমি। সবচেয়ে বড়ো চাঁদ টাইটান, এর ব্যাস ৫১৫০ কিমি; হাইপেরিয়ন নামের চাঁদটি বিস্কুট আকৃতির, এর ব্যাস ৩৫০ কিমি। চাঁদ আইয়াপেটাসের ব্যাস ১৪৩৬ কিমি, এর আছে দুটি মুখ- এক দিক কালো আরেক দিক শাদা। ফিবি নামের একটি চাঁদ আছে শনির, যার ব্যাস ২২০ কিমি, এবং দেখতে কালো । এটি হয়তো শুরুতে শনির চাঁদ ছিলো না, ছিলো হয়তো একটি গ্রহাণু, কিন্তু এক সময় ধরা প’ড়ে গেছে শনির অভিকর্ষের ফাঁদে।

ইউরেনাসঃ হেলে পড়া গ্রহ

১৭৮১ অব্দে উইলিয়ম হার্শেল আবিষ্কার করেন ইউরেনাস। গ্রহটির নাম রেখেছিলেন ইয়োহান বোড, কেননা রোমান পুরাণে ইউরেনাস স্যাটার্নের (শনি) পিতা, আবার স্যাটার্ন জুপিটারের (বৃহস্পতি) পিতা। ইউরেনাস সূর্য আর পৃথিবী থেকে বহু দূরে ঘুরছে সৌরজগতের উপপ্রান্তে। সূর্য থেকে ইউরেনাসের গড়দূরত্ব ১৯.২১৮ জ্যোতি-একক, ২,৮৬৯,০০০,০০০ কিমি, সূর্য থেকে নিকটতম দূরত্ব ১৮.৩১ জ্যোতি-একক, দূরতম দূরত্ব ২০.১২ জ্যোতি-একক, সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ৮৪.০১ বছরে (৩০,৬৮৫ দিনে), নিজের অক্ষের ওপর একবার আবর্তন করে ১২.২ ঘণ্টায় এবং হেলে আছে ৯৭ ডিগ্রি ৫৫ মিনিট; ইউরেনাসের ব্যাস ৫১,২০০ কিমি (পৃথিবীর ব্যাসের ৪.০১ গুণ), ভর ৮.৬৭ × ১০২৮ গ্রাম (পৃথিবীর ১৪.৫ গুণ), ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ১.২ গ্রাম, মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ২১.২ কিমি । এর তাপমাত্রা ৯৫ কেলভিন, অ্যালবেডো ০.৬৬। ইউরেনাসের আছে পাঁচটি চাঁদ— এগুলোর নাম রাখা হয়েছে শেক্সপিয়রের মিডসামার নাইটস্ ড্রিম নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের নামে : এরিয়েল, উমব্রিয়েল, টিটানিয়া, ওবেরন, মিরান্ডা। ১৯৮৫ ও ১৯৮৬তে ভয়েজার ২ ইউরেনাসের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আবিষ্কার করে আরো ১০টি ছোটো চাঁদ।

ইউরেনাস। এটি এক অস্পষ্ট আকাশি-নীল গ্রহ। সৌরজগতের অন্তর্ভাগ থেকে বহির্ভাগে যাওয়ার সময় ছবিটি তোলে ভয়েজার ২ মহাশূন্যযান।

ইউরেনাস ৮৪ বছরে একবার ঘোরে সূর্যের চারদিকে; তাই আবিষ্কারের পর এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে দু-বার। খুব বেশি, ৯৮ ডিগ্রি, হেলে আছে এটি কক্ষপথের ওপর; এ থেকে বোঝা যায় ইউরেনাস অক্ষের ওপর ঘুরছে পেছনের দিকে, অর্থাৎ পুব থেকে পশ্চিমে । যখন এর উত্তর মেরু সোজাসুজি থাকে সূর্যের দিকে, তখন দক্ষিণ গোলার্ধ একটানা ২১ বছর ডুবে থাকে অন্ধকার ও শীতে; উত্তর গোলার্ধে ২১ বছর গ্রীষ্ম ও দক্ষিণ গোলার্ধে ২১ বছরব্যাপী শীতকালের পর সূর্য আলো দেয় ইউরেনাসের বিষুবাঞ্চলে। এ-সময় গ্রহটির ১৭ ঘণ্টা ধ’রে আবর্তনের কালে সব স্থানে দিনরাত্রি হয় । ২১ বছর পর দক্ষিণ মেরু সোজাসুজি হয় সূর্যের দিকে, আর দক্ষিণ গোলার্ধে শুরু হয় ২১ বছরের গ্রীষ্মকাল। এর বায়ুমণ্ডলে আছে ৩/৪ ভাগ হাইড্রোজেন আর ১/৪ ভাগ হিলিয়াম ও অন্যান্য গ্যাস। এর তাপমাত্রা ৫১ কেলভিন (~৩৬৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। ইউরেনাসের কয়েকটি চক্রও আছে।

নেপটুনঃ আলোর ফোঁটা

ইউরেনাস আবিষ্কারের ফলে আবিষ্কৃত হয় নেপটুন বা নেপচুন। ইউরেনাসের অস্বাভাবিক গতির জন্যে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন আরো দূরে আছে আরেকটি গ্রহ, যার টানে এমন করছে ইউরেনাস । অজানা গ্রহটি আবিষ্কারের জন্যে ব্যগ্র হন অ্যাডাম্স ও লেভেরিয়ের । বোডের সূত্রানুসারে তাঁরা পৃথকভাবে হিশেব করেন যে অজানা গ্রহটি থাকবে সূর্য থেকে ৩৮ জ্যোতি-একক দূরে; কিন্তু গ্রহটি ছিলো ৩০ জ্যোতি-একক দূরে। লেভেরিয়েরের হিশেব অনুসারে দুজন তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্রহ খোঁজা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬ অব্দে আবিষ্কার করেন অজানা গ্রহটি । রোমান সমুদ্রদেবতার নামে এর নাম রাখা হয় নেপটুন । সূর্য থেকে নেপটুনের গড়দূরত্ব ৩০.১১০ জ্যোতি-একক, ৪,৪৯৮,০০০,০০০ কিমি, নিকটতম দূরত্ব ২৯.৮৪ জ্যোতি-একক, দূরতম দূরত্ব ৩০.৩৮ জ্যোতি-একক; এটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ১৬৪.৮ বছরে (৬০,১৮৮ দিনে), অক্ষের ওপর আবর্তিত হয় ১৭ ঘণ্টা ৫০ মিনিটে; এর ব্যাস ৫০.৪৬০ কিমি (পৃথিবীর ৩.৯৬ গুণ), ভর ১.০৩ × ১০২৯ গ্রাম (পৃথিবীর ১৭ গুণ), ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ১.৬৬ গ্রাম, অভিকর্ষ ১.০৮ পার্থিব অভিকর্ষ, মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ২৩.৬ কিমি, তাপমাত্রা ৫০ কেলভিন, অ্যালবেডো ০.৬২। এর চাঁদ আছে দুটিঃ ট্রাইটন ও নেরিড। সন্দেহ করা হয় যে আরো একটি চাঁদ আছে নেপটুনের । ইউরেনাস আবিষ্কৃত হয়েছিলো আকস্মিকভাবে, নেপটুন আবিষ্কৃত হয় বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে । তখন সন্দেহ দেখা দিয়েছিলো যে নিউটনের অভিকর্ষের সূত্র হয়তো এতো দূরে কাজ করে না; কিন্তু অনেকে মনে করেন ইউরেনাসের অস্বাভাবিক গতির পেছনে আছে অন্য কোনো গ্রহের অভিকর্ষ। নিউটনের সূত্রানুসারে হিশেব ক’রে ঠিক জায়গায় আবিষ্কৃত হয় গ্রহটি, ঘোষণা করে অভিকর্ষতত্ত্বের জয়।

সৌরজগতের নবম ও জানা শেষ গ্রহ প্লুটো। ৪০ জ্যোতি-একক দূরে থেকে এটি প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে । প্লুটো থেকে সূর্যকে মনে হবে একটি উজ্জ্বল তারা, কিন্তু তার তাপ গিয়ে পৌঁছোবে না। নেপটুন আবিষ্কারের পর দেখা যায় ইউরেনাস ও নেপটুনের গতিতে রয়েছে কিছুটা অস্বাভাবিকতা; তখন অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করতে থাকেন যে নেপটুনের কক্ষপথ ছাড়িয়ে হয়তো আছে আরো একটি গ্রহ । পার্সিভাল লাওয়েল ১৯০৫ অব্দে খুঁজতে শুরু করেন নবম গ্রহটি । ছবি তুলে তিনি ছবির প্লেটে খুঁজতে থাকেন গ্রহটি, কিন্তু তিনি কোনো গতিশীল আলোর বিন্দু দেখতে পান না । লাওয়েলের মৃত্যুর পর লাওয়েল মানমন্দিরে যোগ দেন ক্লাইড টমবাও; এবং ১৯৩০-এ তিনি লাওয়েলের ছবির প্লেটে আবিষ্কার করেন একটি ভ্রাম্যমান আলোর বিন্দু । এটিই গ্রহ প্লুটো। এর নাম রাখা হয় রোমান পুরাণের পাতালদেবতার নামানুসারে, তবে এর প্রতীকটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে থাকে পার্সিভাল লাওয়েলের স্বাক্ষরঃ ‘পি’ এবং ‘এল’। সূর্য থেকে প্লুটোর গড়দূরত্ব ৩৯.৪৪ জ্যোতি-একক, ৫,৯০০,০০০,০০০ কিমি, নিকটতম দূরত্ব ২৯.৫৭ জ্যোতি-একক, দূরতম দূরত্ব ৪৯.৩১ জ্যোতি একক, এটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ২৪৮.৮ বছরে (৯০,৭০০ দিনে), আবর্তিত হয় ৬.৩৮৭ দিনে, ব্যাস ২৩০০ কিমি, ভর ১.৩ × ১০২৫ গ্রাম, ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ০.৫-০.৯ গ্রাম, অভিকর্ষ ০.০২৪-০.০৩৪ পার্থিব অভিকর্ষ, মুক্তিগতি সেকেন্ডে ০.৯-১.১ কিমি, তাপমাত্রা ৪০ কেলভিন, অ্যালবেডো ০.২৫-০.৩৬। এর চাঁদ একটিঃ চ্যারোন।

প্লুটোকে নবম ও শেষ গ্রহ মনে করা হ’লেও প্লুটো এখন আক্রান্ত; এখন প্ৰশ্ন উঠছে এটি কি আদৌ কোনো গ্রহ? প্লুটো অন্যান্য গ্রহের তুলনায় খুবই ছোটো; এর ব্যাস মাত্র ২৩০০ কিমি; এটি পৃথিবীর থেকে ছোটো তো বটেই, এমনকি আমাদের চাঁদও এর থেকে বড়ো। এটির কক্ষপথ হওয়ার কথা ছিলো নেপটুনের কক্ষপথের দ্বিগুণ দূরে, কিন্তু এর কক্ষপথ তার থেকে অনেক কাছে, এবং এর কক্ষপথ অনেকখানি চ’লে গেছে নেপটুনের কক্ষপথের ভেতর দিয়ে । এটি হয়তো গ্রহ নয়; বিভিন্ন গ্রহের ভেতরের পথ দিয়ে চলছে যে-সব আন্তগ্রহ বস্তু, এটি হয়তো সেগুলোর মধ্যে বৃহত্তমটি । প্লুটোর চাঁদ চ্যারোন প্লুটোর তুলনায় খুবই বড়ো, এতো বড়ো চাঁদ থাকার কথা নয় এতো ছোটো গ্রহের; অন্যান্য গ্রহের চাঁদ গ্রহগুলোর তুলনায় এতো বড়ো নয়। তাই অনেকে মনে করেন প্লুটো গ্রহ নয়; পুটো ও চ্যারোন সম্ভবত দুটি যুগল গ্রহাণু। হয়তো কিছু পরে গ্রহের মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে প্লুটো, বলা হবে সৌরজগতে গ্রহ আছে আটটি। প্লুটোর চাঁদ চ্যারোন আবিষ্কৃত হয় ১৯৭৮-এ। চ্যারোন প্লুটোর দিকে এক মুখ স্থির রেখে প্লুটোকে প্রদক্ষিণ করে ৬.৩৯ দিনে। প্লুটোর থেকে চ্যারোন কিছুটা কালো, হয়তো তার গায়ে লেগে আছে ময়লাধরা বরফ।

কোনো কোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানী খুব খুঁজেছেন আরেকটি গ্রহ- আকাশে ও ছবিতে- প্লুটোকে পেরিয়ে, যেটাকে অনেক সময় বলা হয় ‘প্ল্যানেট এক্স’। প্লুটোর আবিষ্কারক ক্লাইড টমবাও প্লুটোকে পেরিয়ে অনেক দূরে অনেক বছর খুঁজেছেন একটি গ্রহ; শেষে সূর্য থেকে ১০০ জ্যোতি-এককের মধ্যে নেপটুনের আকারের কোনো গ্রহ পাওয়ার সম্ভাবনাকে বাতিল ক’রে দিয়েছেন তিনি। ১৯৭৮-এ প্লুটোর চাঁদ চ্যারোন আবিষ্কৃত হওয়ার পর অনেকে আবার মনে করতে থাকেন হয়তো সৌরজগতের শেষ সীমায় আছে কোনো গ্রহ। আকাশে এখন নিয়মিত চলছে খোঁজাখুঁজি, মাঝেমাঝে পাওয়া যাচ্ছে নতুন জিনিশ, কিন্তু নতুন কোনো গ্রহ পাওয়া যায় নি। কোনো একদিন গ্রহ এক্স পাওয়া যেতেও পারে; যদি যায়, তবে সেটি হবে এক স্তিমিত স্নান ঠাণ্ডা সুদূর বস্তু, বিশাল দূরবিন ছাড়া যাকে দেখা যাবে না।

মহাশূন্যের টুকরোটাকরি

সৌরজগতের অধীশ্বর সূর্য, মুখ্য অধিবাসী গ্রহরাশি, ও তাদের চাঁদগুলো; তবে এরাই শুধু সৌরজগতের সদস্য নয়, সৌরজগতে আছে কমপক্ষে আরো চার ধরনের আন্তরগ্রহ বস্তু । এগুলো মহাশূন্যের ভাঙাচোরা টুকরোটাকরি, যারা ছুটে চলছে গ্রহগুলোর মধ্যবর্তী শূন্য এলাকা দিয়ে । আছে ধূমকেতু (কমেট), গ্রহাণু (অ্যাস্টিরয়িড), উল্কা (মিটিয়র), উল্কাপিণ্ড (মিটিয়রাইট), আর আন্তরগ্রহ ধুলো । ধূমকেতু হচ্ছে কয়েক কিলোমিটার লম্বা বরফপিণ্ড; গ্রহাণু হচ্ছে কয়েক শো থেকে ১০০০ কিলোমিটার ব্যাসের শিলা ও ধাতুতে গঠিত অতি ক্ষুদ্র গ্রহ; উল্কা হচ্ছে মহাশূন্যের কয়েক সেন্টিমিটার ব্যাসের ছোটো ছোটো বস্তুকণিকা, যেগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সাথে সাথে ঘর্ষণের ফলে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্ব’লে উঠে নিঃশেষে মিলিয়ে যায়- মনে হয় আকাশ থেকে ছুটে পড়ছে চঞ্চল তারা, এগুলো কখনো মাটিতে পৌঁছোতে পারে না। উল্কাপিণ্ড হচ্ছে একটু বড়ো আকারের শিলা বা ধাতুর খণ্ড, যেগুলো মহাশূন্য থেকে কখনো কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীতে। আন্তরগ্রহ ধুলো হচ্ছে অতি সূক্ষ্ম ধুলোকণা, যেগুলো ভ’রে রেখেছে বিভিন্ন গ্রহের মধ্যবর্তী শূন্যস্থান। ধূমকেতু, গ্রহাণু, উল্কা, উল্কাপিণ্ড আজকের জিনিশি নয়, ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে যখন গ’ড়ে উঠেছিলো সৌরজগত তখনই উৎপত্তি ঘটেছিলো এসবের; গ্রহগুলো সৃষ্টি হওয়ার সময় আঘাতে সংঘর্ষে বিস্ফোরণে সৃষ্টি হয়েছিলো মহাশূন্যের এই ভাঙাচোরা বস্তুগুলোর। এগুলো মহাশূন্যের বর্জ্য, টুকরোটাকরি; এগুলো গ্রহ বা চাঁদ হয়ে উঠতে পারে নি, পারে নি কোনো গ্রহ বা চাঁদের অংশ হ’তে; কিন্তু স্বাধীনভাবে ছুটে চলছে মহাশূন্যের সড়ক সরণি বিশ্বপথ দিয়ে।

ধূমকেতু

মহাশূন্যের ছোটো বস্তুগুলোর মধ্যে ধূমকেতু সবচেয়ে জমকালো, দেখা দিয়ে অকারণে সন্ত্রস্ত ক’রে তোলে পৃথিবীর কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষদের। সৌরজগতের ভেতরের পথে ভেসে ভেসে পৃথিবীর কাছাকাছি দিয়ে ধূমকেতু চলতে থাকে ধীরেধীরে রাতের পর রাত, প্রেতের মতো ঝুলে থাকে তারাদের মধ্যে। ধূমকেতু তীব্র বেগে ছুটে আসে না, কিন্তু মানুষের ধারণা ধূমকেতু ছুটে আসে তীব্র বেগে। মানুষ হাজার হাজার বছর ধ’রে একে মনে করেছে অশুভ সংকেত, কেঁপে উঠেছে ধূমকেতুর কথা শুনে। ধূমকেতু অশুভ কিছু নয়। ধূমকেতু স্রষ্টার শনিও নয়, বিপ্লবও বাধায় না; কিন্তু ধূমকেতুকে অশুভ মনে করেছে প্রতিটি জাতি। হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিয়েছিলো ৬৬ অব্দে; পরে অনেকে একে মনে করেছে এটা ছিলো ৭০ অব্দে জেরুজালেম ধ্বংসের পূর্বাভাস। রাজারা খুব ভয় পেয়েছে ধূমকেতুর আগমনকে । হেনরি ৬ নাটকে শেক্সপিয়র লিখেছেন, ‘ধূমকেতু, সময় ও রাষ্ট্রগুলোকে বদলে দিয়ে, এসো আকাশে তোমার স্ফটিক কেশর ঘোরাতে ঘোরাতে।’ ধূমকেতু সম্পর্কে পাওয়া যায় অজস্র উক্তি; আমার পছন্দ ১৭৮৩ অব্দে স্যামুয়েল জনসনের লেখা দু-পংক্তি পদ্যঃ ‘যদি তুমি এলে ধ্বংস হয় রাজন্যেরা, তবে ধূমকেতু, এসো প্রতিদিন, থাকো সম্পূর্ণ বছর।

ইকেয়া-সেকি। ১৯৬৫ অব্দে আবিষ্কৃত হয় ধূমকেতুটি। ঊষার আকাশে তারাদের পটভূমিতে চলছে ধূমকেতুটি; শির দিগন্তের দিকে, লেজ ওপরের দিকে।

ধূমকেতুর কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে; এর মধ্যে উজ্জ্বলতম অঙ্গটি শির বা মাথা। এর মাথা থেকে ম্লান যে-বিভা বেরিয়ে আসে, সেটি লেজ। ধূমকেতুর লেজ থাকে সূর্যের বিপরীত দিকে, হতে পারে ১ জ্যোতি-এককের থেকেও দীর্ঘ। ধূমকেতুর মাথার ভেতরে থাকে তারার মতো একটি বিন্দু; সেটি ধূমকেতুর কেন্দ্রস্থল। ধূমকেতুর কেন্দ্রস্থলটি নোংরা বরফের পিণ্ড, যা দৈর্ঘ্যে হ’তে পারে ১ থেকে ২০ কিলোমিটার। ধূমকেতুর কেন্দ্রস্থলটি যে নোংরা বরফপিণ্ড বা হিমশৈল ১৯৫০ অব্দের দিকে তা নির্দেশ করেন ফ্রেড হুয়িপেল। ধূমকেতুর মাথা ও লেজের বাকি অংশ গ্যাস ও ধুলো। ধূমকেতুর লেজ সব সময় সূর্য থেকে স’রে থাকে সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা সৌরবাতাসের চাপের ফলে। ১৭০৪ অব্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি হিশেব ক’রে দেখেন যে ধূমকেতুগুলো ভ্রমণ করে দীর্ঘ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে, এবং কোনো কোনো ধূমকেতু আসে বারবার। তিনি দেখেন ১৪৫৬, ১৫৩১, ১৬০৭, ও ১৬৮২ অব্দে দেখা দেয়া চারটি ধূমকেতুর কক্ষপথ অভিন্ন, এবং এগুলো আসে প্রায় ৭৫ বছর পরপর । তিনি সিদ্ধান্তে পৌছেন এগুলো একই ধূমকেতু; আর এগুলো কখনো যে একটু আগে আসে কখনো যে আসে একটু পরে, তার মূলে রয়েছে বিভিন্ন গ্রহের, বিশেষ ক’রে বৃহস্পতির, অভিকর্ষ। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এটি আবার আসবে ১৭৫৮তে। ঠিকই সেটি এসে উপস্থিত হয় ক্রিসমাসের রাতে। এটির নাম রাখা হয় ‘হ্যালির ধূমকেতু’। ১৯১০ অব্দে পৃথিবী যায় এর লেজের ভেতর দিয়ে, এবং এটি খুবই বিখ্যাত হয়ে ওঠে । এটি আবার দেখা দেয় ১৯৮৬তে।

ধূমকেতুর বাসভূমি কোথায়, আসে কোথা থেকে? ধূমকেতু কোথা থেকে আসে, এর প্রথম ঠিক উত্তর দেন, ১৫৭৭ অব্দে, টাইকো ব্রাহে । তিনি তারাদের পটভূমিতে ধূমকেতুর কৌণিক অবস্থানের কোনো প্যারাল্যাক্স বদল দেখতে না পেয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে ধূমকেতু চাঁদের থেকেও দূরের কোনো এলাকা থেকে আসে । ১৯৫০ অব্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়ান আের্ট আবিষ্কার করেন যে ধূমকেতুরা তাদের অধিকাংশ সময় কাটায় সূর্য থেকে ৫০,০০০ জ্যোতি- একক দূরে এক স্থানে। সেখানে আছে কোটি কোটি ধূমকেতু; ওই স্থানটিকে আের্টের নাম অনুসারে বলা হয় ‘আের্ট মেঘ’ । ধূমকেতু সৌরজগতের অন্তর্ভাগে ঢোকার পর কয়েক মাস যাপন করে সূর্যের কাছাকাছি, তখন আমরা দেখতে পাই ধূমকেতু; তারপর ধীরেধীরে ফিরে যায় আের্ট মেঘে। সেখান যাপন করে হাজার হাজার বছর । মাঝেমাঝে কোনো কোনো ধূমকেতু বৃহস্পতি বা অন্য কোনো গ্রহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওই গ্রহের অভিকর্ষে ফিরে আসে সৌরজগতের অন্তর্ভাগে, ঘুরতে থাকে এখানেই। অধিকাংশ বিখ্যাত ধূমকেতুই এ-ধরনের; এগুলোকে বলা হয় স্বল্প পর্বের ধূমকেতু । এমন দুটি ধূমকেতু হচ্ছে এনকে, ও হ্যালির ধূমকেতু । আের্ট মেঘ সৌরজগতেই অবস্থিত, তাই ধূমকেতুরা সৌরজগতেরই সদস্য।

উল্কা ও উল্কাপিণ্ড

মহাশূন্যের ছোটো ছোটো বস্তু, সাধারণত কয়েক সেন্টিমিটার যাদের ব্যাস, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে জ্ব’লে ছাই হয়ে যায়; এগুলোকে বলা হয় উল্কা । সাধারণত মধ্যরাতের আগে ঘণ্টায় ৩টি, আর মধ্যরাতের পরে ঘণ্টায় ১৫টি উল্কাপাত দেখা যায়। তবে প্রতি বছর কোনো কোনো রাতে দেখা যায় বৃষ্টিধারার মতো উল্কাবৃষ্টি । তখন ঘণ্টায় দেখা যায় ৬০টিরও বেশি উল্কাপাত । উল্কার খুব গভীর সম্পর্ক আছে ধূমকেতুর সাথে; অধিকাংশ উল্কাই হচ্ছে ধূমকেতুর দেহ থেকে খ’সে ছড়িয়ে পড়া টুকরোটাকরি।

আকাশ থেকে মাঝেমাঝে পৃথিবীতে এসে পড়ে যে-সব পাথুরে ও ধাতব বস্তু, সেগুলোকে বলা হয় উল্কাপিণ্ড। উল্কাপিণ্ড গ্রহাণুর টুকরো। মহাশূন্যে গ্রহাণুদের মধ্যে সংঘর্ষে ওগুলো ভেঙেচুরে সৃষ্টি হয়েছিলো উল্কাপিণ্ড । এগুলোর উদ্ভব ঘটেছিলো ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে।

উল্কাপিণ্ডকে চিরকাল ভয়ের চোখে দেখেছে মানুষ, এবং মনে করেছে পবিত্র। এগুলো ভয়ের, কেননা প্রচণ্ড বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে উল্কাপিণ্ড, কিন্তু এগুলো পবিত্র নয় । এফিসিসে ডায়নার মন্দিরে পুজো করা হতো আকাশ থেকে পড়া একটি পাথরকে । কাবাঘরের কালো পাথরটিও আকাশ থেকে পড়েছে ব’লে বিশ্বাস করা হয় । তাহলে এটি একটি উল্কাপিণ্ড। প্রাচীন মানুষ বিশ্বাস করতো যে আকাশ থেকে বিধাতা ফেলে পবিত্র পাথর, আর আঠারো শতকে জ্ঞানীরা মনে করতেন আকাশ থেকে পাথর পড়তে পারে না। ১৮০৩ অব্দে ফ্রান্সের এক শহরে পড়ে একটি উল্কাপিণ্ড; সেটি সত্যিই আকাশ থেকে পড়েছে কি না, তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পড়ে বিজ্ঞানী জে বি বাইয়টের ওপর। তিনি সব কিছু বিবেচনা ক’রে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে আকাশ থেকে সত্যিই পাথর পড়তে পারে । বড়ো আকারের উল্কাপিণ্ড সাধারণত পড়ে না; তবে প্রতি বছরই পড়ে ইটের আকারের দু-একটি উল্কাপিণ্ড ৷ ১৯৭২ অব্দে ১০০০ টনের মতো একটি উল্কাপিণ্ড পড়তে পড়তে পৃথিবীর পাশ দিয়ে চ’লে যায় । ১৯০৮ অব্দে সাইবেরিয়ায় পড়েছিলো ১০,০০০ টন ওজনের একটি উল্কাপিণ্ড ৷ এতো বড়ো উল্কাপিণ্ড পড়ে কয়েক শতাব্দীতে একবার।

গ্রহাণু

আন্তরগ্রহ বস্তুদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো হচ্ছে গ্রহাণু । এগুলোর ব্যাস কয়েক শো মিটার থেকে ১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হ’তে পারে। বৃহত্তম গ্রহাণুটির নাম সেরেস, এটির ব্যাস ১০০০ কিমি । ১৮০০ অব্দের আগে গ্রহাণু সম্পর্কে আমরা কিছু জানতাম না । সূর্য থেকে ২.৮ জ্যোতি-একক দূরে, মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে, একটি গ্রহ খুঁজতে গিয়ে ১৮০১ অব্দের প্রথম রাতেই আবিষ্কৃত হয় কোনো গ্রহ নয়- একটি গ্রহাণু, ঠিক ২.৮ জ্যোতি-একক দূরে। গ্রহাণুটির নাম সেরেস । ১৮০২ থেকে ১৮০৭ অব্দের মধ্যে ওই এলাকায় আবিষ্কৃত হয় আরো কয়েকটি গ্রহাণু বা ছোটো গ্রহ । ১৮৯০ অব্দের মধ্যে আবিষ্কৃত হয় প্রায় ৩০০টি গ্রহাণু। এগুলো মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যবর্তী স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে ব’লে ওই এলাকাকে বলা হয় গ্রহাণুবলয়ঃ অ্যাস্টিরয়িড বেল্ট। তবে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী ওই বলয়ের বাইরেও রয়েছে বেশ কিছু গ্রহাণুঃ অ্যাপোলো ও ট্রোজান গ্রহাণু । অ্যাপোলো গ্রহাণুগুলোর মধ্যে প্রথমটির নাম রাখা হয়েছিলো অ্যাপোলো, তাই এগুলোকে বলা হয় অ্যাপোলো গ্রহাণু। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে থেকে এসে ঢোকে পৃথিবীর কক্ষপথের ভেতরে। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে ৩০টি অ্যাপোলো গ্রহাণু। দুটি বিখ্যাত অ্যাপোলো গ্রহাণু হচ্ছে আইকারুস ও ইরোস। অ্যাপোলো গ্রহাণুগুলো বেশ কাছে আসে পৃথিবীর কোনো-না-কোনো দিন, হয়তো কয়েক লক্ষ বছর পর, পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ হবে কোনো অ্যাপোলো গ্রহাণুর। আরেকগুচ্ছ গ্রহাণু রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় ট্রোজান গ্রহাণু। এগুলোর নাম হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের পাত্রপাত্রীদের নামে রাখা হয়েছে ব’লে এগুলোকে বলা হয় ট্রোজান গ্রহাণু। এগুলো আছে বৃহস্পতির কক্ষপথের ভেতরে দুটি এলাকায়; সূর্য ও বৃহস্পতির অভিকর্ষের টানে ঝুলে আছে দুটি স্থানে। সবচেয়ে বড়ো ট্রোজান গ্রহাণুটির নাম হেকটর। সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে আছে যে-গ্রহাণুটি, তার নাম কিরন; আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৭৭-এ। এটি শনির কক্ষপথের ভেতর থেকে গিয়ে ইউরেনাসের কক্ষপথে ঢুকে প্রদক্ষিণ করে সূর্যকে। গ্রহাণুগুলো সম্ভবত অণু-গ্রহ, যেগুলো গ্রহ হয়ে উঠতে পারে নি।

রাশিচক্রের আলো

সূর্যের অভিমুখে সৌরজগতের সমতলে ছড়িয়ে আছে অজস্র আন্তরগ্রহ ধুলোকণা, আর পৃথক পৃথক অণু ও পরমাণু । এগুলো খুবই ছোটো, এক সেন্টিমিটারের লাখ ভাগের এক ভাগের থেকেও ছোটো। সূর্যাস্তের পরে, ও সূর্যোদয়ের আগে, দিগন্তের আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় এক রকম আলো । একে বলা হয় রাশিচক্রের আলোঃ জৌডিআক্যল লাইট । না কি বলবো গোধূলির আলো? আস্তরগ্রহ ধুলোকণা, আর পৃথক পৃথক অণু ও পরমাণুর ওপর সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি হয় এই স্নিগ্ধ ঝাপসা আলো। এ-আলো রাশিচক্রের পথ ধ’রে সূর্যাস্তের ১ ঘন্টা পর থেকে দেখা যেতে শুরু করে; সূর্যাস্তের 1½ ঘণ্টা পরে দেখা যায় সবচেয়ে ভালোভাবে, দিগন্তের পেছন থেকে লম্বভাবে উঠতে থাকে ওপরের দিকে, আর সূর্যাস্তের ২ থেকে 2½ ঘণ্টা পর অস্ত যায় । শহরের কাছাকাছি এ-আলো দেখা যাবে না, দেখতে হ’লে যেতে হবে শহর থেকে অনেক দূরে কোনো স্বচ্ছ পল্লী বা প্রান্তরের আকাশের নিচে- অন্ধকার রাতে।

error: Content is protected !!