ইমাম ইবন কাছীরের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি হইল ‘তাফসীরুল কুরআনিল করীম’। উহাই ‘তাফসীরে ইব্ন কাছীর’ নামে জগজ্জোড়া খ্যাতি লাভ করিয়াছে। ইহার প্রতি খণ্ডের পাতায় পাতায় লেখকের কঠোর পরিশ্রম, গভীর অনুসন্ধিৎসা, ব্যাপক অধ্যয়ন ও অগাধ পাণ্ডিত্যের ছাপ বিদ্যমান।
আল্লামা সুয়ূতী বলেন- ‘এই ধরনের তাফসীর আজ পর্যন্ত অন্য কেহ লিপিবদ্ধ করেন নাই। রিওয়ায়েত ভিত্তিক তাফসীরসমূহের মধ্যে ইহাই সর্বাধিক কল্যাণপ্রদ ও উপকারী।’ মূলত তাফসীরে ইব্ন কাছীর ইমাম ইব্ন কাছীরের এক অমর ও অবিস্মরণীয় অবদান। প্রাথমিক যুগে রচিত তাফসীর গ্রন্থসমূহের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছে। কোন কোন তাফসীর গ্রন্থ পাণ্ডুলিপি আকারেই হয়ত কোন লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত রহিয়াছে। যে সকল গুরুত্বপূর্ণ তাফসীর গ্রন্থাকারে আলোর মুখ দেখিয়া কালোত্রীর্ণ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছে, তাফসীরে ইব্ন কাছীর তন্মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তার দাবীদার। মানুকূলা তথা রিওয়ায়েতভিত্তিক তাফসীরসমূহের মধ্যে তাফসীরে ইব্ন কাছীরই সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য তাফসীর। এই ধারায় পূর্বে রচিত তাফসীরে তাবারী ও তাফসীরে কুরতুবী ইত্যাদির বিশিষ্ট দিকগুলির ইহাতে সমাবেশ ঘটিয়াছে। পরন্তু সেই সব তাফসীরের দুর্বল দিকগুলি ইহাতে পরিশীলিত ও বিশুদ্ধ হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। অপূর্ব রচনাশৈলী, বর্ণনার লালিত্য ও অকাট্য দলীল প্রমাণ প্রয়োগে অসাধারণ পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ইহা পূর্ববর্তী তাফসীরের চাইতেও এক ধাপ আগাইয়া গিয়াছে। হাদীসের সনদ ও মতনের সার্বিক ও যথাযথ বিশ্লেষণ ইহাকে অত্যধিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করিয়াছে। কুরআন পাকের জটিল ও দুর্বোধ্য অংশগুলির বিশদ ব্যাখ্যা ও বিভিন্নার্থক শব্দসমষ্টির আভিধানিক ও পারিভাষিক বিশ্লেষণ ইহাকে সুসমৃদ্ধ করিয়াছে। বিশেষত বিভিন্ন ভ্রান্ত ও আজগুবী মতামত দলীল প্রমাণের ক্ষুরধার তরবারি দ্বারা খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া যেভাবে ইহাতে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে, তাহা সত্যই বিস্ময়কর। মোটকথা, ইহা বিদআত ও বিভ্রান্তির বেড়াজালমুক্ত কুরআন সুন্নাহর এক অত্যুজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হইয়া দেখা দিয়াছে।
ইমাম ইব্ন কাছীর তাঁহার পাণ্ডিত্য বিমণ্ডিত এই তাফসীরে কোথাও দুরূহতা বা জটিলতাকে প্রশ্রয় দেন নাই। বর্ণনার পারিপাট্য, ভাষার স্বচ্ছ-সাবলীলতা ও শাব্দিক প্রাঞ্জলতা তাঁহার তাফসীরকে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও গতিময় করিয়াছে। যে কোন বিতর্কমূলক বিষয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক নিরাসক্তি ও ঐতিহাসিক নির্লিপ্ততা বজায় রাখিয়া নিজ অভিমত পেশ করিয়াছেন। তিনি যাহা কিছুই বলিয়াছেন, কুরআন হাদীসের অকাট্য দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে বলিয়াছেন, কোথাও নিজের ভাবাবেগকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেন নাই। ঠিক এই কারণেই তিনি তাঁহার তাফসীরে ইব্ন জারীর তাবারীর তাফসীরের ইসরাঈলী আজগুবী কাহিনী ও জাল হাদীস ভিত্তিক অলীক উপাখ্যানসমূহ প্রত্যাখ্যান করিয়া বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে নির্ভরযোগ্য ঘটনার সমাবেশ ঘটাইয়াছেন। তাই তাঁহার তাফসীরকে ন্যায়সঙ্গতভাবেই ‘তাফসীরে সলফী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তাফসীর ইব্ন কাছীরের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লামা হাফিজ আবূ আলী মুহাম্মদ শওকানী বলেনঃ
“আলোচ্য তাফসীরে তাফসীরকার হাদীসের রিওয়ায়েতসমূহ এরূপ পূর্ণাঙ্গভাবে আহরণ করিয়াছেন যে, কোথাও ত্রুটি-বিচ্যুতির বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তেমনি তিনি ইহাতে বিভিন্ন মাযহাব ও মতবাদ, প্রাসঙ্গিক হাদীস, আছার ও কওল এরূপ সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করিয়াছেন যে, কাহারও কোন সংশয়ের লেশমাত্র অবকাশ থাকে না !”
তাফসীরে ইবন কাছীরের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে কুরআনের তাফসীর করিতে প্রথমে কুরআন ব্যবহার করা হইয়াছ। তারপর রাসূলের হাদীস, অতঃপর সাহাবার আছার ও পরিশেষে তাবেঈনের আকওয়াল ব্যবহৃত হইয়াছে। হাদীস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বর্ণনার সূত্র, বর্ণনাকারীর চরিত্র ও হাদীসের স্তর ও শ্রেণীভেদের প্রতিটি দিক ইহাতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষিত হইয়াছে। আছার ও আকওয়ালের প্রয়োগ ক্ষেত্রেও উহা সত্যাসত্যের কষ্টিপাথরে ভালভাবে যাঁচ-পরতাল করিয়া লওয়া হইয়াছে। মোটকথা, তাফসীরটিকে সত্যের মানদণ্ড হিসাবে দাঁড় করাইতে যত রকমের সতর্কতা ও সযত্ন প্রয়াস প্রয়োজন তাহা সবই করা হইয়াছে। ইহার ফলেই তাফসীর জগতের এই অনন্য নির্ভরযোগ্য অমর সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ সম্ভব হইয়াছে।
তাফসীরে ইবন কাছীরকে ‘উন্মুত তাফাসীর’ বা ‘তাফসীর জননী’ বলা হয়। মূলত পরবর্তীকালের সকল নির্ভরযোগ্য তাফসীর এই তাফসীর হইতেই জন্ম নিয়াছে। এই তাফসীর মুসলিম মিল্লাতের যে অপরিমেয় কল্যাণ সাধন বরিয়াছে, গ্রন্থ জগতে তাহার তুলনা সত্যিই বিরল। সত্যের শাণিত তরবারি দিয়া ইমাম ইব্ন কাছীর পূর্ববর্তী তাফসীরসমূহের ইসরাঈলী কাহিনী ও জাল হাদীসের জঞ্জালগুলি কচুকাটা করিয়া মুসলিম মিল্লাতকে মহান কুরআনের এক নির্ভেজাল ভাষ্য উপহার দিয়া গিয়াছেন ৷
উদাহরণস্বরূপ সূরা বাকারার গাভী সম্পর্কিত বিভিন্ন ইসরাঈলী উপাখ্যানের কথা বলা যাইতে পারে। তিনি একে একে সব উপাখ্যানই তুলিয়া ধরিয়াছেন। অতঃপর বর্ণনাকারীদের বর্ণনাসূত্রের অসারতা ও খোদ বর্ণনাকারীদের দুর্বলতা সুপ্রমাণিত করার পর তিনি সেইগুলিকে অলীক ও অনির্ভরযোগ্য ঘোষণা করিয়াছেন। তেমনি ‘সূরা কাফ’-এর শুরুতে ব্যবহৃত প্রথম ‘কাফ’ অক্ষরটিকে পূর্বসূরী তাফসীরকারগণ যে সারাবিশ্ব বেষ্টনকারী ‘কোকাফ’ পাহাড় অর্থে চালাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি তদ্রূপ কোন পাহাড়ের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস্য বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন।
ইমাম ইবন কাছীর তাঁহার এই সুবিস্তারিত তাফসীরে শুধু হাদীস শাস্ত্রই ঘাটেন নাই, ফিকাহ শাস্ত্রেরও বিভিন্ন জরুরী মাসায়েলের বিশ্লেষণ পেশ করিয়াছেন। উহাতে তিনি নিরাসক্তভাবে বিভিন্ন মাযহাবের মতামত তুলিয়া ধরিয়াছেন। তবে স্বভাবতই নিজ মাযহাবের প্রতি তিনি অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। কিন্তু অন্যান্য মাযহাবের বিরুদ্ধে তাঁহার কোন অসহিষ্ণু মনোভাবের প্রকাশ ঘটে নাই। সত্যিকার সত্যানুসন্ধিৎসা লইয়াই তিনি অত্যন্ত বিনয় ও সংযমের সহিত মাসআলার যথার্থ সমাধান নির্ণয় করিতে প্রয়াসী হইয়াছেন।
তাফসীরের শুরুতে তিনি অত্যন্ত মূল্যবান একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা প্রদান করিয়াছেন। উহাতে তাফসীর করার বিভিন্ন শর্ত ও প্রয়োজনীয় দিকগুলি তিনি তুলিয়া ধরিয়াছেন। তাঁহার এই ভূমিকাটি পরবর্তী তাফসীরকারদের দিক-নির্দেশনার কাজ দিয়াছে।
ইমাম ইব্ন কাছীরের এই জগজ্জোড়া আলোড়ন সৃষ্টিকারী তাফসীর ও শুধু বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হইয়াছে তাহা নহে, পরন্তু ইহার বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত সংস্করণও বাহির হইয়াছে। আরবী ভাষায় ইহার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরি করেন শায়খ মুহাম্মদ আলী আস্ সাবূনী। বৈরুতের ‘দারুল কুরআনিল করীম’ প্রকাশনা হইতে তিন খণ্ডে উহা অত্যন্ত সুন্দরভাবে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। উর্দুতে উহার সংক্ষিপ্তসার অনূদিত হয় এবং উর্দু অনুবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মাওলানা মুহাম্মদ জুনাগড়ী।
এখানে উল্লেখ্য, ইহার মূল সংস্করণটি চার খণ্ডে সমাপ্ত ও প্রতি খণ্ডের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছয় শতাধিক। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মূল সংস্করণেরই প্রথম বঙ্গানুবাদ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে।