সমকামীদের যৌনপ্রবৃত্তি আমাদের পরিচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামী লোকজনের থেকে আলাদা, এটা আমরা জানি। কারণ তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে আকর্ষণ অনুভব করে সমলিঙ্গের প্রতি। যেহেতু বিজ্ঞানের কাজই হচ্ছে প্রতিটি ঘটনার পেছনে যুক্তিনিষ্ঠ কারণ অনুসন্ধান, তাই বৈজ্ঞানিক পেশায় নিয়োজিত অনেক গবেষকই অনুমান করলেন সমকামিতার পেছনেও নিশ্চয় কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ থাকতে হবে। কিন্তু কারণের উৎসটা কোথায়? তাদের মস্তিষ্কের আকার, আকৃতি বা গঠন কি সাধারণদের থেকে একটু আলাদা? এ ব্যাপারটি বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে পুরোমাত্রায়। ভাবনার কারণ আছে। কারণ যৌন-প্রবৃত্তির কেন্দ্রীয় উৎস হলো মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের নানা পছন্দ, অপছন্দ, ঘৃণা, অভিরুচি আর ফ্যান্টাসি। মস্তিষ্কই জীবনের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সিদ্ধান্তে আসে আমাদের ঐশ্বরিয়াকে ভালো লাগতে হবে, নাকি শাহরুখকে। মস্তিষ্কই সিদ্ধান্ত নেয় এই মুহূর্তে আমাদের ভূতের গল্প ভালো লাগবে, নাকি আবেগময় রোমান্টিক উপন্যাস। কাজেই যৌনপ্রবৃত্তি তৈরিতে মস্তিষ্কের ভূমিকা কি সেটা বিজ্ঞানীদের জন্য খুব ভালো করে বোঝা চাই। কিন্তু সমকামী মস্তিষ্ক বিশ্লেষণের আগে বিজ্ঞানীরা আরেকটি জিনিস খুব গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ করেছেন। সেটা হচ্ছে নারী পুরুষের মস্তিষ্ক আর অর্জিত ব্যবহারে পার্থক্য।
মস্তিষ্কের যৌনতাঃ নারী বনাম পুরুষ
বিজ্ঞানীরা প্রথম এধরনের গবেষণা শুরু করেছিলেন ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরদের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে। ১৯৭৮ সালে ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার গোর্কি ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন ছেলে ইঁদুরের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালমাস (Hypothalamus) নামের প্রত্যঙ্গটি মেয়ে ইঁদুরের থেকে তিনগুণ বড়। ঠিক একই ধরনের পার্থক্য বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে পেলেন মানুষের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করেও। পুরুষ মস্তিষ্কের সুপ্রাকিয়াস্মিক নিউক্লিয়াসের (Suprachiasmatic Nucleus) আকার মেয়েদের চেয়ে প্রায় ২.৫ গুণ বড় হয়। আবার মেয়েদের ক্ষেত্রে কর্পাস কালোসাম (Corpus Callosum) এবং এন্টিরিয়র কমিসুরের (Anterior commissure) নামে দুইটি প্রত্যঙ্গের আকার পুরুষদের প্রত্যঙ্গগুলোর তুলনায় বিবর্ধিত পাওয়া গেছে। কিন্তু এগুলোর কোনো প্রভাব কি প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় আছে? এক কথায় জবাব দেয়া মুশকিল। জীববিজ্ঞানীরা যেমন পুরুষ-নারীর মস্তিষ্কের আকার আয়তন আর গঠন নিয়ে গবেষণা করেছেন, তেমনি তাদের অর্জিত ব্যবহার নিয়ে নানা ধরনের কৌতুহলোদ্দীপক কাজ করে চলেছেন বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা। তারা বলেন, ডারউইনের ‘যৌনতার নির্বাচন’ (Sexual Selection) বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রেখে থাকে তবে এর একটি প্রভাব আমাদের দীর্ঘদিনের মানসপট তৈরিতেও পড়বে। যৌনতার উদ্ভবের কারণে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নারী-পুরুষ একই মানব প্রকৃতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়ছে এক ধরনের মনোদৈহিক পার্থক্য – জৈববৈজ্ঞানিক পথেই। মনোবিজ্ঞানীরা অনেকেদিন ধরেই লক্ষ করছিলেন যে, ছেলে মেয়েদের পারস্পরিক চাহিদা পছন্দ, অপছন্দে যেমন মিল আছে, তেমনি আবার কিছু ক্ষেত্রে আছে চোখে পড়ার মতোই পার্থক্য। এটা হবার কথাই। নারী পুরুষ উভয়কেই সভ্যতার সূচনার প্রথম থেকেই ডারউইন বর্ণিত ‘সেক্সুয়াল সিলেকশন’ নামক বন্ধুর পথে নিজেদের বিবর্তিত করে নিতে হয়েছে, শুধু দৈহিকভাবে নয় মন মানসিকতাতেও। দেখা গেছে, ছেলেরা আচরণগত দিক দিয়ে মেয়েদের চেয়ে অনেক প্রতিযোগিতামূলক (Competitive) হয়ে থাকে। ছেলেদের স্বভাবে প্রতিযোগিতামূলক হতে হয়েছে কারণ তাদের বিভিন্ন গোত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করে, যুদ্ধ বিগ্রহ করে বাঁচতে হয়েছে আদিকাল থেকেই। যারা এ ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে পেরেছে তারাই অধিকহারে সন্তান সন্ততি এ পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পেরেছে।
আধুনিক জীবনযাত্রাতেও পুরুষদের এই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতাকে একটু চেষ্টা করলেই ধরা যাবে। একটা মজার উদাহরণ দেয়া যাক। আমেরিকার একটি জরিপ থেকে দেখা গেছে গাড়ি চালানোর সময় কখনো পথ হারিয়ে ফেললে পুরুষেরা খুব কমই পথের অন্য মানুষের কাছ থেকে সাহায্য চায়। তারা বরং নিজেদের বিবেচনা থেকে নিজেরাই পথ খুঁজে নিতে তৎপর হয়, না পারলে বড়জোর পথ-চিহ্ন বা মানচিত্রের দ্বারস্থ হয়, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করে না । আর অন্যদিকে মেয়েরা প্রথমেই গাড়ি থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেয়। আসলে পুরুষেরা গাড়ি থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পছন্দ করে না, কারণ তাদের ‘আত্মভরি’ মানসিতার কারণে ব্যাপারটাকে তারা ‘যুদ্ধে পরাজয়’ হিসেবে বিবেচনা করে ফেলে নিজেদের অজান্তেই । আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তাদের মানসপটে এত প্রবলভাবে রাজত্ব করে না বলে তারা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করে সমাধানে পৌঁছুতে উদগ্রীব থাকে। শুধু গাড়ি চালানোই একমাত্র উদাহরণ নয়; পুরুষেরা নারীদের চেয়ে অর্থ, বিত্ত আর সামাজিক প্রতিপত্তি এবং প্রতিষ্ঠার প্রতি যে বেশি আকৃষ্ট তা যে কোনো সমাজেই প্রযোজ্য। এটাও এসেছে দীর্ঘদিনের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা থেকে।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মুলতঃ বিজ্ঞানের দুটো চিরায়ত শাখাকে একীভুত করেছে; একটি হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (Evolutionary Biology) এবং অন্যটি বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান (Cognitive Psychology) । বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বিষয়ে আমার একটি ই-বুক মুক্তমনা ওয়েব সাইট থেকে ডাউন লোড করা যাবে। ঠিকানা – http://www.mukto-mona. com/Articles/avijit/ Manob prokriti Avijit.pdf। এ অধ্যায়টির বেশ কিছু অংশ আমার বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের উপর করা ই-বুক থেকে নেওয়া হয়েছে।
মানব ইতিহাসের পাতায় এবারে একটু চোখ রাখি। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পুরুষেরা এক সময় ছিল হান্টার বা শিকারি, আর মেয়েরা ফলমূল সংগ্রাহক। প্রয়োজনের তাগিদেই একটা সময় পুরুষদের একে অন্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে; অন্য গোত্রের সাথে মারামারি হানাহানি করতে হয়েছে; নিজের সাম্রাজ্য বাড়াতে হয়েছে; অস্ত্র চালাতে হয়েছে। তাদেরকে কারিগরি বিষয়ে বেশি জড়িত হতে হয়েছে। আদিম সমাজে অস্ত্র চালনা, করা শিকারে পারদর্শী হওয়াকে বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। যারা এগুলোতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে তারাই অধিকহারে সন্তান সন্ততি এ পৃথিবীতে রেখে যেতে পেরেছে, যারা এগুলো পারেনি তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যাবে পুরুষেরা শুধু আত্মরক্ষা করতেই যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্য বাড়াতে, আর সম্পত্তি এবং নারীর দখল নিতে। এখনো এই মানসিকতার প্রভাব বিরল নয়। এর বাস্তব প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন ভেনিজুয়ালার আদিম গোষ্ঠী ইয়ানোমামো (Yanomamo)দের নিয়ে গবেষণা করে। নৃতত্ত্ববিদ নেপোলিয়ন চ্যাংনন এই আদিম গোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খুব অবাক হয়েই লক্ষ করেন,
‘এরা শুধু সম্পদ আহরণের জন্য যুদ্ধ করে না, এরা যুদ্ধ করে নারীদের উপর অধিকার নিতেও।’
দেখা গেল গোষ্ঠীতে যতবেশি শক্তিশালী এবং সমর-দক্ষ পুরুষ পাওয়া যাচ্ছে, তত বেশি তারা নারীদের উপর অধিকার নিতে পেরেছে।
আসলে যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, কিংবা শুনতে আমাদের জন্য যতই অস্বস্তি লাগুক না কেন, প্রাককৃষি সমাজে যে সহিংসতা এবং আগ্রাসনের মাধ্যমে জোর করে একাধিক নারীদের উপর দখল নিয়ে পুরুষেরা নিজেদের জিন ভবিষ্যত প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছিল, এটা নিঠুর বাস্তবতা। পুরুষদের এই সনাতন আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় আজকের সমাজে ঘটা যুদ্ধের পরিসংখ্যানেও। এখনো চলমান ঘটনায় চোখ রাখলে দেখা যাবে – প্রতিটি যুদ্ধেই অসহায় নারীরা হচ্ছে যৌননির্যাতনের প্রথম এবং প্রধান শিকার। বাংলাদেশে, বসনিয়া, রুয়ান্ডা, আলবেনিয়া, কঙ্গো, বুরুন্ডিয়া, প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরানসহ প্রতিটি যুদ্ধের ঘটনাতেই সেই নগ্ন সত্যই বেরিয়ে আসে যে, এমনকি আধুনিক যুগেও নারীরাই থাকে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিকার।
এদিকে পুরুষেরা যখন হানাহানি মারামারি করে তাদের ‘পুরুষতান্ত্রিক’ জিঘাংসা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে, মেয়েরা দায়িত্ব নিয়েছে সংসার গোছানোর। গৃহস্থালির পরিচর্যা মেয়েরা বেশি অংশগ্রহণ করায় তাদের বাচনিক এবং অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষমতা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্ধিত হয়েছে। একটি ছেলের আর একটি মেয়ের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে গঠনগত যে বিভিন্ন পার্থক্য পাওয়া গেছে, তাতে বিবর্তনীয় অনুকল্পই সঠিক প্রমাণিত হয় । ছেলেদের ব্রেনের আকার গড়পরতা মেয়েদের মস্তিষ্কের চেয়ে অন্তত ১০০ গ্রাম বড় হয়121, কিন্তু ওদিকে মেয়েদের মস্তিষ্ক ছেলেদের চেয়ে অনেক ঘন থাকে। মেয়েদের মস্তিষ্কে কর্পাস ক্যালোসাম এবং এন্টেরিয়র কমিসুর নামক প্রত্যঙ্গ সহ টেম্পোরাল কর্টেক্সের যে এলাকাগুলো ভাষা এবং বাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহায়তা করে বলে মনে করা হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে সেগুলো ছেলেদের চেয়ে অন্তত ২৯ ভাগ বিবর্ধিত থাকে। শুধু তাই নয়, মেয়েদের মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালনের হার ছেলেদের ব্রেনের চেয়ে শতকরা ১৫ ভাগ বেশি বলে জানা গেছে।
আরো কিছু পার্থক্য উল্লেখ করা যাক। ছেলেদের মস্তিষ্কের প্যারিয়েটাল কর্টেক্সের আকার মেয়েদের মস্তিষ্কের চেয়ে অনেক বড় হয়। বড় হয় অ্যামাগদালা (Amygdala) নামের বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গের আকারও । এর ফলে দেখা গেছে ছেলেরা জ্যামিতিক আকার নিয়ে নিজেদের মনে নাড়াচাড়ায় মেয়েদের চেয়ে অনেক দক্ষ হয়122। তারা একটি ত্রিমাত্রিক বস্তুকে সামনে থেকে দেখেই নিজেদের মনের আয়নায় নড়িয়ে চড়িয়ে ঘুরিয়ে ঘারিয়ে বুঝে নিতে পারে বস্তুটি, পেছন থেকে, নীচ থেকে বা উপর থেকে কিরকম দেখাতে পারে। জরিপ থেকে দেখা গেছে, ছেলেরা গড়পরতা বিমূর্ত এবং ‘স্পেশাল’ কাজের ব্যাপারে বেশি সাবলীল, আর মেয়েরা অনেক বেশি বাচনিক এবং সামাজিক কাজের ব্যাপারে।
একটি ব্যাপার এখানে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। বইয়ের এই অংশে জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোনো থেকে নারী-পুরুষের মস্তিষ্কের গঠনগত পার্থক্য দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, এটি কোনো লিঙ্গভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা নয়। ছেলেদের মস্তিষ্কের আকার বড় হবার অর্থ এই নয় যে, ছেলেদের বুদ্ধি মেয়েদের থেকে বেশি কিংবা ছেলেরা যে কোনো কাজে মেয়েদের থেকে অধিকতর দক্ষ। অতীতে পুরুষতান্ত্রিক প্রথা টিকিয়ে রাখতে এ ধরনের ভুল স্টেরিওটাইপিং এর চেষ্টা করা হয়েছিলো। ছেলে আর মেয়েদের মস্তিষ্কের গঠনে জৈববৈজ্ঞানিক কিছু পার্থক্য রয়েছে, যার কারণ বিবিধ। এইটি বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরাই মূল উপজীব্য।
মস্তিষ্কের গঠনগত পার্থক্যের প্রভাব পড়ে তাদের অর্জিত ব্যবহারে, আর সেই ব্যবহারের প্রভাব আবার পড়ে সমাজে। অভিভাবকেরা সবাই লক্ষ করেছেন, মেয়ে শিশুরা ছেলে শিশুদের চেয়ে অনেক আগে কথা বলা শিখে যায় – একই রকম পরিবেশ দেয়া সত্ত্বেও। ছেলেদের বাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলো গড়পড়তা মেয়েদের মতো উন্নত না হওয়ায় ডাক্তাররা লক্ষ করেন পরিণত বয়সে ছেলেরা সেরিব্রাল পালসি, ডাইলেক্সিয়া, অটিজম এবং মনোযোগ-স্বল্পতাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এ ধরনের আরো পার্থক্য আছে। ব্যবহারিক জীবনে দেখা যায় ছেলেরা যখন কাজ করে অধিকাংশ সময়ে শুধু একটি কাজে নিবদ্ধ থাকতে চেষ্টা করে, এক সাথে দু-তিনটা কাজ করতে পারে না, প্রায়শই বিশৃঙ্খল করে ফেলে। আর অন্যদিকে মেয়েরা অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে ছয় সাতটা কাজ একই সাথে করে ফেলে। এটাও হয়েছে সেই শিকারী –সংগ্রাহক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই। শিকারি হবার ফলে পুরুষদের স্বভাবতই শিকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হতো, ফলে তাদের মানসজগত একটিমাত্র বিষয়ে নিবদ্ধ হয়ে গড়ে উঠেছিল, আর মেয়েদের যেহেতু ঘরদোর সামলাতে গিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে হাজারটা কাজ করে ফেলতে হতো, তারা দক্ষ হয়ে উঠেছিল একাধিক কাজ একসাথে করাতে। ‘মাল্টি টাস্কিং’ এই মজ্জাগত দক্ষতার কারণেই বোধ হয় আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক ‘কর্পোরেট জগতে’ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে মেয়েরা ভালো করছে, এবং তাদের অধিকহারে সে সব জায়গায় নিয়োগ দেয়া হয়। একটা জিনিস এখানে পরিষ্কার করে বলা দরকার। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বলে যে, ছেলেরা গড়পরতা বিশেষ এবং নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে (সাধারণত) বেশি দক্ষ হয়, আর মেয়েরা সামগ্রিকভাবে বহুমাত্রিক কাজে (Multitasking)। আমাদের আধুনিক সমাজ বহু কিছুর সংমিশ্রনে। এখানে সফল হতে ‘স্পেসিফিক’ দক্ষতা যেমন লাগে, তেমনি লাগে ‘মাল্টিটাসকিং’ও। কাজেই, কেউ যদি নারীদের গৃহবন্দি করার অভিপ্রায়ে সেই পুরাতণ ‘ব্যাক টু দ্য কিচেন’ আর্গুমেন্ট নিয়ে আসতে চান সেটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ পর্যালোচনায় অফিসের চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করার ব্যাপারটা কিন্তু খুবই আধুনিক ঘটনা। এটা ঠিক পুরুষেরা একসময় শিকারি ছিল, আর মেয়েরা সংগ্রাহক, কিন্তু তা বলে কি এটা বলা যাবে, মেয়েরা যেহেতু একসময় সংগ্রাহক ছিল, সেহেতু এখন তারা অফিসে কাজ করতে পারবে না বা কম্পিউটারের চাবি টিপতে পারবে না, এমন দিব্যি তো কেউ দিয়ে দেয়নি।সেজন্যই আধুনিক বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে মেয়েরা অফিস আদালতে তো বটেই, ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়েই কাজ করে চলেছে মাইনিং ফিল্ড থেকে শুরু করে একেবারে নাসার বহির্জাগতিক গবেষণাগারসহ মোটামুটি সব জায়গাতেই।
Linn, M. C., & Peterson, A. C. (1985). Emergence and characterization of sex differences in spatial ability: A meta-analysis. Child Development, 56 (6), 1479-1498.
কিন্তু তারপরেও ছেলে-মেয়েদের পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। ছেলেরা গড়পরতা সুনির্দিষ্ট এবং বিশেষ কাজের ব্যাপারে দক্ষ বলেই সম্ভবত অধিকহারে স্থাপত্যবিদ্যা, গণিত কিংবা প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে উৎসুক হয়, আর মেয়েরা যায় শিক্ষকতা, নার্সিং, ডাক্তারি কিংবা সমাজবিদ্যায়। এই ঝোঁক সংস্কৃতি এবং সমাজ নির্বিশেষে একই রকম দেখা গেছে। এই রকম সুযোগ দেয়ার পরও বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরা বড় হয়ে বুয়েটের চেয়ে মেডিকেলে পড়তেই উদগ্রীব থাকে। কোনো সংস্কৃতিতেই ছেলেরা খুব একটা যেতে চায় না নার্সিং- এ, মেয়েরা যেমনিভাবে কখনোই ‘গ্যারেজ মেকানিক’ হতে চায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
শুধু তাই নয়, মস্তিষ্ক কীভাবে সমন্বিত হবে সেই প্রক্রিয়াতেও আছে নারী-পুরুষে পার্থক্য। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (FMRI) বিশ্লেষণ করে। একটি পরীক্ষায় এক দল মেয়ে এবং ছেলেদের আলাদা করে বসিয়ে তাদের ‘লেট্’, ‘জে’ প্রভৃতি অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করতে দেয়া হয়েছিল। শব্দগুলো উচ্চারণের সময় FMRI ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রক্রিয়াগুলোর ছবি তুলে নেয়া হলো। ফলাফল যা পাওয়া গেল তা সত্যই বিস্ময়কর। দেখা গেল একই কাজ করতে গিয়ে ছেলেদের মাথা আর মেয়েদের মাথা কাজ করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে। ছেলেরা শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে মস্তিষ্কের কেবল একটি অংশের (বাম ইনফেরিও- র ফ্রন্টাল গাইরাস) উপর নির্ভরশীল থাকে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের দুই অংশই (বাম এবং ডান ইনফেরিওর ফ্রন্টাল গাইরাস ) সমানভাবে আন্দোলিত হয়। এর থেকে বোঝা যায় যে, মেয়েদের মস্তিষ্ক ছেলেদের তুলনায় অনেক সুষমভাবে বিন্যস্ত হয়ে কাজ করে। FMRI-র মাধ্যমে তোলা ছবিগুলো সত্যই নাটকীয় – বিজ্ঞানীরা দেখেছেন শব্দোচ্চারণের সাথে সাথে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ আলোকিত হয়ে উঠে এবং নারী পুরুষে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এবং ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
নারী-পুরুষের মস্তিষ্কের গঠনগত পার্থক্যের ছাপ আছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদায়। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড বাস ছয়টি মহাদেশ এবং পাঁচটি দ্বীপপুঞ্জের ৩৭টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জন লোকের উপর সমীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা গড়পরতা দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে, কিন্তু পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুণ্য এবং সৌন্দর্য। অন্যদিকে মেয়েরাও গড়পরতা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ আর স্ট্যাটাস। এ ধরনের চাহিদার পার্থক্য আরো প্রকট হয়েছে নারী-পুরুষদের মধ্যকার যৌনতা নিয়ে ‘ফ্যান্টাসি’ কেন্দ্রিক গবেষণাগুলোতেও। ব্রুস এলিস এবং ডন সিমন্সের করা ইউনিভারসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে যে, পুরুষ এবং নারীদের মধ্যকার যৌনতার ব্যাপারে ফ্যান্টাসিগুলো যদি সততার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনজনের মধ্যে একজন পুরুষ একাধিক নারীর সাথে যৌনতার ফ্যান্টাসিতে ভোগে, এমনকি সারা জীবনে তাদের পার্টনারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কল্পনা করে তারা আমোদিত হয়ে উঠে- আর মেয়েদের মধ্যে সে সংখ্যাটা শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। এলিস এবং সিমন্সের সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অর্ধেক সংখ্যক নারীরা অভিমত দিয়েছে, যৌনতা নিয়ে কল্পনার উন্মাতাল সময়গুলোতেও তারা কখনো সঙ্গী বদল করে না, অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে এই সংখ্যাটা শতকরা মাত্র ১২ ভাগ। মেয়েদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো তার নিজের পরিচিত যৌনসঙ্গীকে কেন্দ্র করেই সবসময় আবর্তিত হয়, আর অন্যদিকে পুরুষদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো সময়ে সময়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েকে নিয়েও উথলে ওঠে । একারণেই গবেষক এলিস এবং সিমন্স তাদের গবেষণাপত্রে এই বলে উপসংহার টেনেছেন।
‘পুরুষদের যৌনতার বাঁধন-হারা কল্পনাগুলো হয়ে থাকে সর্বব্যাপি, স্বতঃস্ফুর্ত, দৃষ্টিনির্ভর, বিশেষভাবে যৌনতাকেন্দ্রিক, নির্বিচারী, বহুগামী এবং সক্রিয়। অন্যদিকে মেয়েদের যৌন অভিলাষ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, আবেগময়, অন্তরঙ্গ এবং অক্রিয়।
ছেলে মেয়েদের যৌন-অভিলাষের পার্থক্যসূচক এই প্রবণতার প্রভাব পড়েছে আজকের দিনের বাণিজ্যে এবং পণ্য-দ্রব্যে। এমনি একটি দ্রব্য হচ্ছে ‘পর্ণগ্রাফি’ অন্যটি হলো ‘রোমান্স নভেল’। পর্ণগ্রাফির মূল ক্রেতা নিঃসন্দেহে পুরুষ। পুরুষদের উগ্র এবং নির্বিচারী সেক্স ক্রেজের চাহিদা পূর্ণ করতে বাজার আর ইন্টারনেট সয়লাব হয়ে আছে সফট পর্ণ, হার্ড পর্ণ, থ্রি সাম, গ্রুপ সেক্সসহ হাজার ধরনের বারোয়ারি জিনিসপত্রে। এগুলো পুরুষেরাই কিনে, পুরুষেরাই দেখে। মেয়েরা সে তুলনায় কম। কারণ, মেশিনের মতো হার্ডকোর পর্ণ পুরুষদের তৃপ্তি দিলেও মেয়েদের মানসিক চাহিদাকে তেমন পূর্ণ করতে পারে না। সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীর নগ্ন দেহ দেখে পুরুষেরা যেমন সহজেই আমোদিত হয়, পুরুষের নগ্ন দেহ দেখে মেয়েরা তেমনি হয় না। কারণ – মেয়েদের অবারিত সেক্স জাগ্রত করতে দরকার অবারিত ইমোশন!
আর মেয়েদের এই অবারিত আবেগ জাগ্রত করতে বাজারে আছে ‘রোমান্স নভেল’। এই সমস্ত প্রেমোপন্যাসের মূল ক্রেতাই নারী। প্রেম-বিচ্ছেদের পসরা সাজিয়ে শ’য়ে শ’য়ে বই সাড়া দুনিয়া জুড়ে বের করা হয় – আর সেগুলো অনায়াসে বিক্রি হতে থাকে সাড়া বছর জুড়ে, মূলত মেয়েদের হাত দিয়ে। বাংলাদেশে যেমন আছে ইমদাদুল হক মিলন, তেমনি আমেরিকায় সুসান এলিজাবেথ ফিলিপ্স, ভারতে তেমনি সুবোধ ঘোষ কিংবা নীহারঞ্জন গুপ্ত । প্রেম কত প্রকার ও কি কি তা বুঝতে হলে এদের উপন্যাস ছাড়া গতি নেই। আমি শুনেছি, রোমান্স নভেলের জন্য প্রকাশকেরা ইদানীংকালে বিশেষত উঠতি লেখকদের নাকি বলেই দেয় – কীভাবে তার উপন্যাস ‘সাজাতে’ হবে, আর কি কি থাকতে হবে। একটু প্রেম, অনুরাগ, কমিটমেন্ট, মান–অভিমান, বিচ্ছেদ, ক্লাইম্যাক্স তারপর মিলন। আবেগের পশরা বেশি থাকতে হবে, সে তুলনায় সেক্সের বাসনা কম। বইয়ের নায়িকার সেক্সের সাথে আবার আবেগ মিলিয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি। এভাবে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রোমান্স নভেলের ম্যানুফ্যাকচারিং। মেয়েরা অনায়াসে কিনছে, আবেগে ভাসছে, হাসছে, কখনো বা চোখের পানি ফেলছে। আর বই উঠে আসছে বেস্ট সেলার তালিকায়।
আরো কিছু আনুষঙ্গিক মজার বিষয় আলোচনায় আনা যাক। পশ্চিমা বিশ্বে এক সময় ‘প্লে বয়’-এর পাশাপাশি একসময় প্লে গার্ল’ চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। চলেনি । মেয়েরা এ ধরনের পত্রিকা কেনেনি, বরং কিনেছে সমকামী পুরুষেরা ঢের বেশি। ছেলেরা শুধু কেন বল খেলবে আর মেয়েরা পুতুল – এই শিকল ভাঙ্গার অভিপ্রায়ে ভিন্ন ধরনের খেলনা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল – চলেনি। কারণ কি? কারণ হচ্ছে, আমরা যত আড়াল করার চেষ্টাই করি না কেন, ছেলে মেয়েদের মানসিকতায় পার্থক্য আছে- আর সেটা দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় ছাপ থাকার কারণেই। এই ব্যাপারটিই প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্টে এক মায়ের আর্তিতে। সেই মা পত্রিকায় (নভেম্বর ২, ১৯৯২) তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন –
‘আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনার পত্রিকার বিজ্ঞ পাঠকেরা কি বলতে পারবেন কেন একই রকমভাবে বড় করা সত্ত্বেও যতই সময় গড়াচ্ছে আমার দুই জমজ বাচ্চাদের মধ্যকার নারী-পুরুষজনিত পার্থক্যগুলো প্রকট হয়ে উঠছে? কার্পেটের উপর যখন তাদের খেলনাগুলো একসাথে মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়, তখন দেখা যায় ছেলেটা ঠিকই ট্রাক বা বাস হাতে তুলে নিচ্ছে, আর মেয়েটা পুতুল বা টেডি বিয়ার”।
Shaywitz BA, Shaywitz SE, Pugh KR, Constable RT, Skudlarski P, Fulbright RK, Bronen RA, Fletcher JM, Shankweiler DP, Katz L, et al., Sex differences in the functional organization of the brain for language, Nature. 1995 Feb 16;373(6515):561-2.
Buss, D.M., 1989. Sex differences in human mate preferences: evolutionary hypotheses tested in 37 cultures. Behavioral and Brain Sciences 12, pp. 1-49.
B.J. Ellis, D. Symons (1990), “Sex Differences in Sexual Fantasy: an Evolutionary Psychological Approach”, Journal of Sex Research, Vol. 27 pp.527 – 555.
শুধু মানব শিশু নয়, মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি ভার্ভেট বানর (Vervet Monkeys) নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তাদের হাতে যদি খেলনা তুলে দেয়া হয়, ছেলে বানরেরা ট্রাক, বাস, গাড়ি, ঘোড়া নিয়ে বেশি সময় কাটায় আর মেয়ে বানরেরা পুতুল কোলে নিয়ে। মানব সমাজে দেখা গেছে খুব অল্প বয়সেই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে খেলনা নিয়ে এক ধরনের পছন্দ তৈরি হয়ে যায়, বাবা মারা সেটা চাপিয়ে দিক বা না দিক। দোকানে নিয়ে গেলে ছেলেরা খেলনা-গাড়ি কিংবা বলের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে, আর মেয়েরা পুতুলের প্রতি। এই মানসিকতার পার্থক্যজনিত প্রভাব পড়েছে খেলনার প্রযুক্তি, বাজার এবং বিপণনে। যে কেউ আমেরিকার টয়েস আর আসের(Toys r us) মতো দোকানে গেলেই ছেলে-মেয়েদের জন্য খেলনার হরেক রকম সম্ভার দেখতে পাবেন। কিন্তু খেলনাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে – এগুলো যেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দাদের চাহিদাকে মূল্য দিতে গিয়ে আলাদা আলাদাভাবে বানানো।
গে মস্তিষ্কের খোঁজে
বিজ্ঞানীরা ইঁদুর আর বানর নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছেন, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে হাইপোথ্যালমাসের মধ্যে ‘মেডিয়াল প্রিঅপ্টিক’ বলে যে এলাকাটা (Medial Preoptic Area) আছে, সেটা কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে যৌনতার পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে ছেলে ইঁদুরেরা মেয়ে ইঁদুরের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। বানর নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা একই ধরনের ফল পেয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হাইপোথ্যালমাস-বিশিষ্ট বানরদের আচরণ হয়ে থাকে অনেকটা ‘যৌন-প্রতিবন্ধী’র মতো। মেয়ে বানরদের প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণই থাকে না। এ থেকে যৌনপ্রবৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে হাইপোথ্যালমাসের গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। মানুষের ক্ষেত্রেও হাইপোথ্যালমাস নামের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গটির সাথে যৌনপ্রবৃত্তির সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তারা হাইপোথ্যালমাসের এলাকাকে অভিহিত করেন ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালমাস (INAH) নামের এক অদ্ভুত নাম দিয়ে। প্রতিটি নিউক্লিয়াসকে আবার তারা বিভিন্ন নম্বর দিয়েছে- INAH, INAH2, INAH3, INAH4, 1 ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার গোর্কি এবং তাঁর এক ছাত্রী লরা এলেন আশির দশকে মানুষের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে দেখলেন ছেলেদের মস্তিষ্কের তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালমাস (INAH3)-এর আকার মেয়েদের থেকে অন্তত তিনগুণ বড় পাওয়া যাচ্ছে।
১৯৯০ সালে সিমন লেভি নামের এক আমেরিকান প্রখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী চিন্তা করলেন নারী-পুরুষের হাইপোথ্যালমাস নিয়ে যখন এত কথা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে সমকামী ব্যক্তিদের হাইপোথ্যালমাসের কি অবস্থা সেটা একটু মেপে দেখা দরকার। তিনি ১৬ জন সমকামী পুরুষের এবং ছয় জন সমকামী মহিলার হাইপোথ্যালমাসের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালালেন। তিনি দেখলেন, গোর্কির মতোই তিনিও ছেলেদের INAH,-এর আকার মেয়েদের চেয়ে আকারে দুগুন বড় পাচ্ছেন। কিন্তু সেই সাথে আরো একটা জিনিস পেলেন। সেটা হলো – INAH;-এর আকার বিষমকামীদের পুরুষদের চেয়ে সমকামী পুরুষদের ক্ষেত্রে দু থেকে তিনগুণ ছোট। অর্থাৎ, সমকামী পুরুষদের নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালমাস এর আকার মেয়েদের INAH,-এর সমান! লেভি পরবর্তীতে একটি হাসপাতালের ৪১ জন রোগীর উপর একই পরীক্ষা করেন। সেখানে ও তিনি একই ফলাফল পেয়েছিলেন। লেভির এই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি পরবর্তীতে উইলিয়াম বাইন নামের আরেকজন বিজ্ঞানী করেছিলেন। তিনিও একই ফলাফল পেয়েছেন, অর্থাৎ, সমকামী পুরুষদের নিউক্লি অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালমাসটি আকারে বিষমকামী পুরুষদের চেয়ে ছোট এবং অনেকটা মেয়েদের সমান।
তার মানে কি? এর মানে কি এই যে সমকামী পুরুষদের মস্তিষ্ক অনেকটা নারীসুলভ? বলা মুশকিল। বিজ্ঞানীরা এই অনুকল্পটিকে আরেকটু বিস্তৃতভাবে পরীক্ষা করার চেষ্টা করলেন। তারা জানেন, শুধু INAH,-এর আকারেই নয়, মস্তিষ্কের আরো অন্যান্য প্রত্যঙ্গের আকারেও পার্থক্য পাওয়া গেছে। যেমন, মেয়েদের ভাষাগত দক্ষতা যেহেতু ছেলেদের চেয়ে বেশি এবং একটু ভিন্নভাবে কাজ করে, তাদের কর্পাস কালোসাম (Corpus Callosum) এবং এন্টিরিয়র কমিসুর (Anterior Commissure) নামে দুইটি প্রত্যঙ্গের আকার পুরুষদের তুলনায় বড়। তাহলে সমকামীদের ক্ষেত্রে কি অবস্থা? হ্যা, আপনি যা সন্দেহ করেছেন তাই – সমকামী ব্যক্তিদের কর্পাস কালোসাম এবং এন্টিরিয়র কমিসুরের আকার বিষমকামী পুরুষদের চেয়ে আকারে বড় হয়, এবং মেয়েদের আকারের সাথে মিলে যায়। ১৯৯২ সালে লরা এলেন এবং রজার গোর্কি এন্টিরিয়র কমিসুর নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, সমকামীদের ক্ষেত্রে প্রত্যঙ্গটির আকার বিষমকামীদের চেয়ে বড়। আবার কর্পাস কালোসাম নিয়ে পরীক্ষা করে আরেকদল বিজ্ঞানী দেখেছেন, সমকামীদের ক্ষেত্রে এই প্রত্যঙ্গটির আকার বিষমকামীদের থেকে প্রায় শতকরা ১৩ ভাগ বেশি।
তাহলে কি দাঁড়ালো? একসময় উলরিচস (পঞ্চম অধ্যায় দ্রঃ) যেমনটি ভেবেছিলেন, – ‘সমকামী পুরুষেরা আসলে পুরুষ দেহে বন্দি নারী আত্মার অতৃপ্ত প্রকাশ” – সেটাই কি তবে ঠিক?। অনেক বিজ্ঞানী পূর্বেকার সীমিত পরীক্ষা থেকে পাওয়া সিদ্ধান্তে তাই ভেবে নিয়েছিলেন। ঢালাওভাবে ভেবে নেয়া হয়েছিল- সমকামিতার প্রকাশ মানে ‘A female spirit in a male body’। সামাজিকভাবেও আমরা দেখি সমকামী ছেলেদের ‘মেয়েলি’ বলে খোঁটা দেয়া হয়। তাহলে সত্যিই কি এই ‘স্টেরিওটাইপিং” গুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? কিন্তু এখানে এসেই দাবার ছক আবারো উলটে গেলো। মানুষের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালমাসে সুপ্রাকিয়াস্মিক নিউক্লিয়াস (VIP SCN Nucleus) নামের যে এলাকাটি আছে, যেটার আকার ছেলেদের ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে বড় থাকে। তাহলে সমকামীদের ক্ষেত্রে এই প্রত্যঙ্গটির আকার কী রকম হবার কথা? নিশ্চয় ছোট এবং মেয়েদের সমান তাই না? না, মোটেই তা নয় – সমকামীদের ক্ষেত্রে VIP SCNNucleus এর আকার পাওয়া গেল অনেক বড়, ছেলে মেয়ে দু’ দলের চেয়েই 29 । সে জন্যই জোয়ান রাফগার্ডেন তার ‘ইভল্যুশন রেইনবো’ বইয়ে শ্লেষের সাথে লিখেছেন – ‘So much for the belief that gay man have female brains!” তবে এ ব্যাপারে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি, হয়ত ভবিষ্যৎ গবেষণা এ ব্যাপারে আরো ভালোভাবে পথ দেখাবে। আরো একটি ব্যাপারও এই সাথে লক্ষ্যণীয়। নারী সমকামীদের মস্তিষ্কে এ ধরনের কোনো প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সমকামী পারিবারিক ধারার খোঁজে
আমার বাবা ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করতেন। আমিও ছোটবেলায় তাই খেলতাম। এ ধরনের অনেক বৈশিষ্ট্যই আমরা ঐতিহ্য হিসেবে বয়ে নিয়ে যাই, পারিবারিক পরিবেশ থেকে শিখে নিয়ে। মা ভালো রান্না করলে মেয়েকেও সেই গুণ পেতে সাহায্য করেন। আবার কিছু জিনিস না চাইলেও আমাদের বহন করতে হয় জেনেটিক তথ্য হিসেবে বংশ পরম্পরায়।
Byne W, Tobet S, Mattiace LA, et al. (September 2001). “The interstitial nuclei of the human anterior hypothalamus: an investigation of variation with sex, sexual orientation, and HIV status”. Horm Behav 40 (2): 86–92.
Allen LS, Gorski RA (1992). “Sexual orientation and the size of the anterior commissure in the human brain”. Proc. Natl. Acad. Sci. U.S.A. 89 (15): 7199–202. doi:10.1073/pnas.89.15.7199. 128 Scamvougeras, A., Witelson, S.F., Bronskill, M., Stanchev, P., Black, S., Cheung, G., Steiner, M., Buck, B. Sexual orientation and anatomy of the corpus callosum. Society for Neuroscience Abstracts, 1994, p 1425.
Swaab DF, Zhou JN, Ehlhart T, Hofman MA (1994). “Development of vasoactive intestinal polypeptide neurons in the human suprachiasmatic nucleus in relation to birth and sex”. Brain Res. Dev. Brain Res. 79 (2): 249–59.
চোখের এবং চুলের রঙ, নাকের গঠন, শরীর স্বাস্থ্য, হৃদরোগের ঝুঁকিসহ অনেক কিছুই। সমকামিতার ব্যাপারটিও আমরা পরিবারে বাহিত হতে দেখি। কিন্তু এটা কি জেনেটিক তথ্য হিসেবে পরিবারের ধারায় বয়ে চলে, নাকি পরিবেশ থেকে শেখা বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ?
বিজ্ঞানীরা এর উত্তর খুঁজতে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে চলেছেন। তারা ইতোমধ্যেই দেখেছেন একটি জনগোষ্ঠীতে কোনো ভাই বিষমকামী হলেও অন্তত শতকরা ৪ ভাগ সম্ভাবনা থাকে তার পরবর্তী ভাইয়ের সমকামী হয়ে জন্মাবার। কিন্তু পরিবারের একভাই সমকামী হলে অন্তত ২২ ভাগ সম্ভাবনা তৈরি হয় অপর ভাইও সমকামী হবার। অর্থাৎ পরিবারে সমকামী ভাই থাকলে পরিবারে সমকামী ধারা তৈরি হবার সম্ভাবনা অন্তত চারগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু ভাই সমকামী হলে বোন লেসবিয়ান নাকি স্ট্রেট হবে কিনা – এ সংক্রান্ত কোনো সম্ভাবনার ঝোঁক পাওয়া যায়নি। কোনো পরিবারে বোন সমকামী (লেসবিয়ান) হলে, অপর বোনেরও সমকামী হবার প্রবণতা দ্বিগুন বেড়ে যায়, কিন্তু ভাইয়ের উপর এর কোনো সম্ভাব্যতার প্রভাব জানা যায়নি।
যমজদের নিয়ে পরীক্ষা করেও কৌতুহলোদ্দীপক ফলাফল পাওয়া গেছে। ১৯৮৫ সালে রিচার্ড সি পিল্লার্ড এবং জেমস ডি ওয়েইনরিচ তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন সমকামিতার ধারাটি সম্ভবতঃ জেনেটিক তথ্য হিসেবে প্রবাহিত হয়। তারা দেখালেন যে, সদৃশ যমজদের (Identical Twins) ক্ষেত্রে এক ভাই সমকামী হলে অন্তত পঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনা থাকে অপর ভাইও সমকামী হবার। আর অসদৃশ যমজদের (Fraternal Twins) ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা থাকে চব্বিশ ভাগের মতো। এরপর থেকে অন্তত পাঁচটি যমজদের নিয়ে যৌন-প্রবৃত্তি সংক্রান্ত গবেষণার খবর লিপিবদ্ধ হয়েছে। ১৯৯১ সালে তাদের একটি গবেষণা থেকে জানা যায় সমকামী প্রবণতা সদৃশ যমজদের মধ্যে ৫৭ ভাগ, অসদৃশ যমজ দের মধ্যে ২৪ ভাগ, এবং অযমজদের মধ্যে ১৩ ভাগ সমকামীভাবাপন্ন হয়ে থাকে। একইভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে নারী সমকামিতার প্রবণতা সদৃশ যমজে থাকে শতকরা ৫০ ভাগ, অসদৃশ যমজে থাকে ১৬ ভাগ, এবং অন্যান্যদের ক্ষেত্রে থাকে ১৩ ভাগ। ১৯৯৩ সালে এ ধরনের আরেকটি গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, ছেলেদের সদৃশ যমজদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ সমকামী প্রবৃত্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে আর অসদৃশ যমজদের ক্ষেত্রে সেটা ২৯ ভাগ।
Pillard RC, Weinrich JD., Evidence of familial nature of male homosexuality, Arch Gen Psychiatry. 1986 Aug;43(8):808-12.
Bailey JM and Benishay DS, Familial aggregation of female sexual orientation, Am J Psychiatry 1993; 150:272-277
Simon Levay and Dean H. Hamer, Evidence for a Biological Influence in Male Homosexuality, Scientific American, May 1994.
Bailey JM, Pillard RC, A genetic study of male sexual orientation., Arch Gen Psychiatry. 1991 Dec; 48 (12) pp1089-96.
একইভাবে নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সদৃশ যমজের ক্ষেত্রে শতকরা ৪৮ ভাগ সমকামী হয়, আর অসদৃশ যমজের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৬ ভাগা”।
উপরের জরিপ গুলো সবই ছিল আমেরিকার। ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডে এই ধরনের একটি জরিপ চালানো হয়। সেখানকার জরিপেও প্রায় একই ধরনের ফলাফল বেরিয়ে আসে, যদিও সংখ্যাটা অনেক কম। সদৃশ যমজদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ এবং অসদৃশ যমজদের ক্ষেত্রে মাত্র ২.৫ ভাগ সমকামী পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে জরিপ চালানো হয়েছে। সেখানে অন্যান্য পদ্ধতির মতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যমজ সহোদর বাছাই করা হয়নি, বরং বাছাই করা হয়েছে নির্বাচনের ভিত্তিতে। তাদের জরিপ থেকে যে ফলাফল এসেছে তাহলো – সেখানে সদৃশ যমজদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ এবং অসদৃশ যমজদের ক্ষেত্রে মাত্র ০ ভাগ সমকামী পাওয়া গেছে; সদৃশ মেয়ে যমজদের শতকরা ২৪ ভাগ লেসবিয়ান হয় এবং অসদৃশ যমজদের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ১১ ভাগ।
উপরের পরীক্ষাগুলো থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট ; সদৃশ যমজে দুই ভাই-ই সমকামী হবার সম্ভাবনা অসদৃশ যমজের দ্বিগুণ পাওয়া যাচ্ছে। পরীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে সদৃশ যমজে দুই ভাইয়ের দুজনেই সমকামী হবার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ থেকে ৫০, এই ফলাফল নির্ভর করে কীভাবে বা কোথায় পরীক্ষা করা হচ্ছে তার উপর। তার মানে জেনেটিক ফ্যাক্টর যদি আমরা ২৫ থেকে ৫০ বলে রায় দেই, তবে পরিবেশ এবং অন্যান্য ফ্যাক্টরের প্রভাব ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ থেকেই যাচ্ছে।
এমনকি সদৃশ যমজদের দুই ভাইয়ের মধ্যেই সমকামিতা পাওয়ার যে ব্যাপারটিকে পুরোপুরি ‘জেনেটিক” বলে ভাবা হচ্ছে, সেই দাবিও কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটাও খোলা মনে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। দুই সদৃশ যমজ ভাই সাধারণত একই পরিবেশে একই ভাবে বড় হয় এবং একজনের পছন্দ, অপছন্দ অভিরুচি অনেক সময় অপরজনকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করে।
Frederick L. Whitam, Milton Diamond and James Martin, Homosexual orientation in twins: A report on 61 pairs and three triplet sets, Archives of Sexual Behavior, 22 (3), 1993, pp 187-206. Bailey J M; Pillard R C; Neale M C; Agyei Y Heritable factors influence sexual orientation in women. Archives of general psychiatry 1993;50(3):217-23
M King and E McDonald, Homosexuals who are twins. A study of 46 probands, The British Journal of Psychiatry 1993, 160: 407-409.
Bailey, J. M., & Martin, N. G. A twin registry study of sexual orientation. Paper presented at the twenty-first annual meeting of the International Academy of Sex Research, Provincetown, MA, 1995.
কাজেই, যে কেউ দাবি করতেই পারে যে, সদৃশ যমজে অসদৃশ যমজদের চেয়ে অধিক হারে সমকামী ভাতৃযুগল পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ ‘অভিন্ন জিন’ নয়, বরং তাদের বেড়ে উঠার ‘অভিন্ন পরিবেশ। থিওডোর লিজ নামে এক মনোবিজ্ঞানী এই ব্যাপারটি উল্লেখ করে তার প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিলেন একটি জার্নালে। এ উদাহরণটি আমাদের সামনে এ ধরনের পরীক্ষার জটিলতা স্পষ্ট করে তুলে। ফ্রয়েড যে কথাটা অনেক আগেই বলেছিলেন একটু অন্যভাবে, সে কথাটাই হয়ত সত্য হয়ে ফিরে আসছে –
‘সমকামিতার ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরো গভীর। … কারণ [সদৃশ] যমজেরা যেন আয়নার প্রতিবিম্ব হিসেবে বেড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যকার স্বকাম (narcissism) আরো বিবর্ধিত করে তুলে’।
তবে এই সমস্যার সমাধানের জন্য আরেক ধরনের পরীক্ষা করা যেতে পারে। যদি কোনো সদৃশ যমজ জন্মের সময়েই আলাদা হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়, এবং সেই উপাত্ত যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে হয়ত ‘অভিন্ন” পরিবেশের ফ্যাক্টরটি বাদ দিয়ে শুধু জেনেটিক ফ্যাক্টর আলোচনায় আনতে পারব, এবং বলতে পারবো সমকামী প্রবৃত্তি সত্যই জেনেটিক কিনা।
১৯৮৬ সালে এ ধরনের একটি পরীক্ষার কথা জানা যায়। ছয়টি সদৃশ যুগলের (চারটি ভগ্নি যুগল, এবং দুটি ভাতৃযুগল) সন্ধান পাওয়া যায় যারা আলাদা আলাদা পরিবেশে বড় হয়েছিল এবং যুগলদের মধ্যে একজন অন্তত সমকামী। চারটি ভগ্নি যুগলের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন সদস্য ছিলেন বিষমকামী, এবং অন্যজন সমকামী । একটি ভাতৃযুগলের ক্ষেত্রে দুই ভাইই ছিলেন সমকামী। একটি ‘গে বার’ এ পরিচয় হবার আগ পর্যন্ত এমনকি তারা একে অপরকে চিনতেনও না। আরেকটি ভাতৃযুগলের ক্ষেত্রে, দুই ভাই জন্মের পরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা আলাদা পরিবেশে বড় হয়েছিলেন। এক ভাই ১৯ বছর পর্যন্ত উভকামী হিসেবে জীবন যাপন করেছিলেন, এবং তারপর পরিপূর্ণ সমকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর অন্য ভাই পনের থেকে আঠারো বয়স পর্যন্ত সমকামী ছিলেন। তারপর বিয়ে করে নিজেকে বিষমকামী হিসেবে সমাজে পরিচিত করেন। এই ক্ষেত্রে, অন্তত সীমিত সময়ের জন্য হলেও উভয় সদস্যই সমকামিতার প্রবৃত্তি প্রদর্শন করেছিল।
Theodore Lidz, Md, Reply to ‘A Genetic Study of Male Sexual Orientation’, Arch Gen Psychiatry. 1993;50(3):240.
ED Eckert, TJ Bouchard, J Bohlen and LL Heston, Homosexuality in monozygotic twins reared apart, The British Journal of Psychiatry, 1986, 148: 421-425
কাজেই উপরের পরীক্ষা থেকে একটি জিনিস বুঝা যাচ্ছে যে, জন্মের সময় বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং ভিন্ন পরিবেশে বড় হওয়া ভাতৃযুগলে সমকামিতার উন্মেষের পেছনে জেনেটিক উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু এই জেনেটিক প্রভাব ভগ্নিযুগলে পাওয়া গেছে অনেক কম।
কিন্তু এই পরীক্ষাই শেষ কথা নয়। সমকামিতার উপর পরিবেশের প্রভাব আদৌ আছে কিনা, আর থাকলে কতটুকু – সেটা জানার জন্য আরেক ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বেইলি এবং পিল্লার্ডের ১৯৯১ সালের সেই পরীক্ষায় (আগে উল্লিখিত) দত্তক নেয়া সদৃশ যমজ সন্তানদের উপর জরিপ চালানো হয় । দেখা গেছে কোনো সমকামী পরিবার বা ব্যক্তি দত্তক নিলে সেই ভাইয়ের সমকামী হিসেবে বেড়ে উঠার সম্ভাবনা (১১%) অনেক বেশি থাকে বিষমকামী পরিবার দত্তক নেয়ের চেয়ে (৫%)। কাজেই এ সমস্ত পরীক্ষা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জেনেটিক ফ্যাকটরের পাশাপাশি পরিবেশের প্রভাবটিও থেকে যাচ্ছে পুরোমাত্রায়। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে মুখ্য কারণ হিসেবে প্রতিপন্ন করাটা এই মুহূর্তে আসলে সরলীকরণই হবে।
গে জিনের খোঁজে
১৯৯৩ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের সমকামী বিজ্ঞানী ডিন হ্যামার এবং এঙ্গেলা প্যাতাউচির একটি যৌথ গবেষণাপত্র বিজ্ঞানের সম্ভ্রান্ত জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়। ডিন হ্যামারের সেই গবেষণাপত্রে শুধু সমকামী ধারাই নয়, সেই সাথে সমকামিতার উৎস হিসেবে ক্রোমোজমের মধ্যকার জেনেটিক একটি মার্কারের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে প্রকাশিত হয়। এই ব্যাপারটিকে পরবর্তীতে কিছু পত্রপত্রিকা এবং মিডিয়া ‘গে জিন’ বলে প্রচার শুরু করে। ফলে এর পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরনের বিতর্ক শুরু হয়। এই গবেষণাপত্রটি তাই খুব সতর্কভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
ডিন হ্যামেরের আলোচিত গবেষণাতেও আগের অন্যান্য গবেষকদের মতোই পরিবারের মধ্যে সমকামী ধারা খোঁজার একটি চেষ্টা করা হয়েছে; এবং এ গবেষণা থেকেও সেই একই উপসংহার বেরিয়ে আসে – পরিবারে সমকামী ভাই থাকলে সমকামী ধারা তৈরি হবার প্রবণতা বেড়ে যায় । হ্যামার তার গবেষণা থেকে যে ফলাফল পেলেন তাহলো – যদি এক ভাই সমকামী হয়, তাহলে ১৪ ভাগ সম্ভাবনা থাকে অন্য ভাইয়েরও সমকামী হবার, আর ভাই সমকামী না হলে সমকামী হবার সম্ভাবনা থাকে শতকরা মাত্র ২ ভাগ। কিন্তু হ্যামার এ পর্যন্ত গিয়েই থেমে গেলেন না । তিনি সমকামী পরিবারের দূরবর্তী আত্মীয় স্বজনদের পারিবারিক ধারাও বিশ্লেষণে আনলেন। আর এটা করতে গিয়েই বেরিয়ে এলো অজানা এক নতুন দিক। তিনি দেখলেন, সমকামী ছেলের মামাদের মধ্যে শতকরা ৭ ভাগ এবং ফুপাতো ভাইদের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ সমকামী প্রবণতা সম্পন্ন পাওয়া ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাবার দিকে অর্থাৎ চাচা কিংবা চাচাতো ভাইদের মধ্যে সেরকম কোনো প্যাটার্ন পাওয়া গেল না।
Hamer DH, Hu S, Magnuson VL, Hu N, Pattatucci AM (July 1993). “A linkage between DNA markers on the X chromosome and male sexual orientation”. Science, 261 (5119): 321–7
তাহলে এর ব্যাখ্যা কী? সমকামী প্রবণতা কি তাহলে মায়ের দিক থেকেই জেনেটিক ভাবে প্রবাহিত হয়? ডিন হ্যামারের গবেষণা সে দিকেই ইঙ্গিত করে। আমরা জানি একটি ছেলের দেহে দু’ ধরনের ক্রোমোজম থাকে। একটি হলো Y যা সে বাবার কাছ থেকে সরাসরি পায়, আর অন্যটি X ক্রোমোজম -যা সে মায়ের দিক থেকে পায়। কাজেই জেনেটিক প্রবণতা মায়ের দিক থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হবার অর্থ হচ্ছে x ক্রোমোজমে তার ছাপ থাকা। হ্যামার এবং তাঁর গবেষক-দল জানালেন x ক্রোমোজমের একদম প্রান্তসীমার একটি এলাকা – যাকে Xq28 হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এটাই সমকামী প্রবণতা তৈরির জন্য দায়ী। হ্যামার ৪০ জন সমকামী ভাতৃযুগলের উপর পরীক্ষা করে দেখলেন তাদের মধ্যে ৩৩টি যুগলের মধ্যে এই Xq28 মার্কারের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। ৭টিতে পাওয়া যায় নি (বিষমকামীদের ক্ষেত্রে এই মার্কারটি ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত থাকে)। বলা হলো যদিও নমুনাক্ষেত্র খুব একটা বড় ছিল না, তদুপরি ৪০ জনের মধ্যে ৩৩ জনে মার্কার খুঁজে পাওয়াটা আসলেই ‘স্ট্যাটিস্টিকালি সিগনিফিকেন্ট। এইটাই হলো ডিনহ্যামারের সমকামিতা নিয়ে মাইলফলক গবেষনার সারসংক্ষেপ। তার পরীক্ষায় পাওয়া এই Xq28 মার্কারটি ‘গে জিন” হিসেবে ‘প্রচারের আলোয় উঠে আসে। আর অনেকেই ডিন হ্যামারের কাজকে এভাবে ব্যাখ্যা করে দিলেন যে, ‘ক্রোমোজমের Xq28 এলাকায় একটি জিন পাওয়া গেছে যা সমকামিতাকে ত্বরান্বিত করে।
Simon Levay and Dean H. Hamer, Evidence for a Biological Influence in Male Homosexuality, Scientific American, May 1994
কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই এত সহজ সরল নয়। এই ফলাফল খুব নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রথম কথা হলো ৪০টি যুগলের মধ্যে ৭টি যুগলে এই Xq28 মার্কারটি পাওয়া যায়নি। সমকামিতার প্রবৃত্তি তৈরিতে যদি Xq28 মার্কার থাকা ‘অত্যাবশকীয় নিয়ামক’ হতো, তাহলে ৪০টি যুগলের স্যাম্পলের সবগুলোতেই এটি পাওয়া যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। যদি ৪০টি স্যাম্পলের মধ্যে মোটামুটি ২০টিতে পাওয়া যেত, আর বাকি ২০ টিতে না পাওয়া যেত, তবে আমরা বলতে পারতাম সমকামিতার প্রবৃত্তির সাথে এই মার্কারের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সেটাও হয়নি। মার্কার পাওয়া গেছে চার-পঞ্চমাংশ ক্ষেত্রে। ৪০টি স্যাম্পলের মধ্যে ৩৩টিতে মার্কার পাওয়ার ক্ষেত্রটি নিঃসন্দেহে ফলাফলের পারিসাংখ্যিক গুরুত্বকে তুলে ধরে। ডিন হ্যামার হিসাব করে দেখিয়েছেন শুধুমাত্র সম্ভাবনার নিরিখে হিসেব করলে এমনি এমনি (নির্বিচারে) এটা ঘটার সম্ভাবনা ২০০ ভাগের মধ্যে ১ ভাগেরও কম। সে হিসেবে জেনেটিক প্রভাব থাকার প্রবণতাটাকে অস্বীকার করা হয়ত যাচ্ছে না, কিন্তু এটা কখনোই শেষ কথা বলার নিশ্চয়তাও দিয়ে দিচ্ছে না। মোটা দাগে বললে, যেহেতু যমজ ভাতৃযুগলের দুজনই সব সময় সমকামী ভাবাপন্ন হয় না, সেহেতু মার্কার থাকলেই সমকামী হবে— এটা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে, কোনো মার্কার না থাকা সত্ত্বেও ৭টি ভাতৃযুগলে সমকামী প্রভাব পাওয়া গেছে। তার মানে, মার্কারের সাথে কিংবা জিনের সাথে সমকামী প্রবৃত্তির সরাসরি সম্পর্ক শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই মার্কারের সাথে জেনেটিক একটা প্রভাব আছেই, তবুও সেটি একটিমাত্র জিনের সাথে কখনোই নয়। ডিন হ্যামার নিজেই সে কথা বলেছেন এভাবে-
‘কোনো একটি জিনকে (এ পরীক্ষায়) পৃথক করা যায়নি। পরীক্ষার মাধ্যমে যা করা হয়েছে তা হলো – ক্রোমোজমের একটি অংশ সনাক্ত করা, যে অংশটি দৈর্ঘ্যে চার মিলিয়ন বেস যুগলের সমান। এই অংশটি সমগ্র মানব জিনোমের শতকরা ০.২ ভাগেরও ছোট, কিন্তু তারপরেও এই অংশটিতে অবলীলায় কয়েকশত জিন এঁটে যেতে পারে। এই এলাকায় নিয়ামক জিনটি খুঁজে বের করা অনেকটা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতোই। সূঁচ পেতে হলে হয় আমাদের হয় আরো অনেক বেশি পরিবার দরকার হবে, অথবা সম্ভ্যাব্য সকল এলাকার ডি.এন.এ-র অনুক্রমের সম্পূর্ণ তথ্য জানা চাই”।
হ্যামার নিজে ১৯৯৫ সালে পরীক্ষাটি পুনর্বার পরিচালনা করেন হু, পাত্তাউচি এবং অন্যান্যদের সাথে মিলে। এই পরীক্ষাটি সম্পন্ন হয় ৩২টি স্যাম্পল নিয়ে, এবং এর মধ্যে ২২টি ক্ষেত্রে তিনি আগের পরীক্ষার মতোই Xq28 মার্কার খুঁজে পেলেন অর্থাৎ, শতকরা প্রায় ৬৮ ভাগ ক্ষেত্রে তিনি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারলেন যে, মার্কারের সাথে সমকামিতার একটা প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক আছে। এছাড়া স্যান্ডার এবং প্রমুখের ১৯৯৮ সালের গবেষণায়ও ৫৪টি স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করা হয়, এবং এর মধ্যে শতকরা ৬৬ ভাগ ক্ষেত্রে সমকামিতার সাথে Xq28 মার্কারের সম্পর্ক পাওয়া যায়।
১৯৯৯ সালে ক্যানাডায় জর্জ রাইসের নেতৃত্বে গবেষকের একটি দল ডিন হ্যামারের পরীক্ষাটিই করার চেষ্টা করলেন নমুনা ক্ষেত্র আরো বাড়িয়ে দিয়ে। এই পরীক্ষায় সমকামী ভাতৃযুগল সংগ্রহ করার জন্য কানাডার গে ম্যাগাজিন Xira তে বিশাল বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, শেষ পর্যন্ত ৪৬টি যুগল নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। এই যুগলগুলো নির্বাচিত হয় ‘সমকামী সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী’ (Gay Interviewer)-দের মাধ্যমে।
Simon Levay and Dean H. Hamer, Evidence for a Biological Influence in Male Homosexuality, Scientific American, May 1994. 143 Hu S, Pattatucci AM, Patterson C, et al. (November 1995). “Linkage between sexual orientation and chromosome Xq28 in males but not in females”. Nat. Genet. 11 (3): 248–56. 144 Wilson, G.D., & Rahman, Q. (2005). Born Gay: The Biology of Sex Orientation. London: Peter Owen Publishers.
এই পরীক্ষায় ৪৬টি যুগলের মধ্যে মাত্র ২০টি যুগলে মার্কার পাওয়া গেল, পারিসাংখ্যিক হিসেবে যা অর্ধেকেরও কম। যদি সমকামিতার সাথে মার্কারের নিশ্চিত সম্পর্ক থাকতো তবে ৪৬টির মধ্যে ৪৬টিতেই মার্কার পাওয়া যেত। তা তো হয়ইনি, বরং যদি হ্যামারের মতো ‘স্ট্যাটিস্টিকালি সিগনিফিকেন্ট’ ৬৮% ফলাফলের ও পুনরাবৃত্তির কথা বিবেচনা করি, তবে মার্কার পাওয়া যাওয়ার কথা ছিল অন্তত ৩২টি। যদি এলোপাথাড়ি ভাবে ঘটা সম্ভাবনার হার শতকরা পঞ্চাশভাগের কথাও চিন্তা করি, তাহলেও মার্কারের সংখ্যা আসা উচিৎ ছিল ২৩টি। কিন্তু ২০টি মাত্র মার্কার পাওয়াকে কোনোভাবেই কোনো ধরনের সম্পর্কে ফেলা যায় না। কাজেই অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন এই পরীক্ষাটি Xq28 মার্কারের সাথে ‘গে জিন’ পাওয়ার আগের দাবিগুলোকে ভুল প্রমাণ করে দেয়। ক্যানাডিয়ান গবেষকেরা তার ফলাফল সম্বন্ধে উপসংহার টেনে বলেন,
আমাদের ফলাফল হ্যামারের মূল পরীক্ষার ফলের সাথে এত পার্থক্য কেন তৈরি করলো তা পরিষ্কার নয়। … সে যাই হোক, আমাদের এই পরীক্ষার উপাত্ত যৌনপ্রবৃত্তির উপর Xq28 এলাকায় অবস্থিত একটি জিনের প্রভাব থাকার দাবিকে সমর্থন করে না। … (যদিও) এই ফলাফল জিনোমের অন্য কোনো জায়গায় সমকামিতার উপর জিনের প্রভাবকে বাতিল করে দেয় না।
এই ‘গে জিন’ পাওয়ার সাম্প্রতিক এই পরীক্ষাগত ব্যর্থতা অবশ্যই একটি ময়নাতদন্ত দাবি করে। সারা মিডিয়া জুড়ে ‘গে জিন’ নিয়ে এত হৈ চৈ হলো, অথচ দুইটি বড় পরীক্ষায় দুই রকম ফলাফল বেরিয়ে এলো কেন? তবে কি হ্যামার পরীক্ষায় কোনো বড় ভুল করেছিলেন, কিংবা ভালো ফলাফল পেতে ডেটা পরিবর্তন করেছিলেন? নাকি ক্যানাডিয়ান গবেষকেরা সমকামী যুগল নির্বাচনের সময় সনাক্তকরণে ভুল করেছিলেন? এই শেষ বিচারের সমাধান এখনো হয়নি। হ্যামার অবশ্য ক্যানাডিয়ীয় গবেষকদের ফলাফল প্রত্যাখান করেছেন এই বলে-
‘তারা (ক্যানাডীয় গবেষকেরা) প্রথমেই ধরে নিয়েছিলেন গে জিন বলে কিছু নেই, এবং তাদের পরীক্ষা ছিল পক্ষপাত দুষ্ট, কারণ পরীক্ষকের
Rice, Anderson, Risch and Ebers (1999) Male Homosexuality: Absence of Linkage to Microsatellite Markers at Xq28. Science 23 (5414): pp. 665-667.
‘The result demonstrates that there is no gay gene in Xq28′ (ref. Joan Roughgarden, Evolution’s Rainbow: Diversity, Gender, and Sexuality in Nature and People, University of California Press, May 17, 2004)।
Michael Abrams, The Real Story on Gay Genes, Discover Magazine, June, 2007
একজন প্রথম থেকেই ‘গে জিন বলে কিছু নেই’ – সেটা প্রমাণেই তৎপর ছিলেন। তাদের সেই (সমকামবিদ্বেষী) মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাদের পরীক্ষায়’।
তবে হ্যামার যাই বলুক না কেন গে-জিন নিয়ে পরীক্ষার ফলাফল একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে সাধারণ মানুষ এবং নিরপেক্ষ গবেষকদের কাছে। তাদের কাছে বিষয়টি এখনো ‘অমীমাংসিত মামলা’ই। তবে ‘অমীমাংসিত’ বলে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। এ সংক্রান্ত গবেষণা কিন্তু থেমে নেই। জিনের পথ ধরে সমাধানের পথ খুঁজতে এবারে এগিয়ে এসেছে এপিজেনেটিক্স’। এই এপিজেনেটিক্স উপরের সমস্যার একটা আকর্ষণীয় সমাধান হাজির করছে, যা ক্রমশ বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তারা দেখেছেন, জিন কেবল একা একা কাজ করতে পারে না, কাজ করে পরিবেশ থেকে পাওয়া সংকেতের মিথস্ক্রিয়ায়। বৈদ্যুতিক বাতির সুইচের যেমন টার্ন অন বা অফ করা যায়, ঠিক তেমনি পরিবেশ থেকে পাওয়া সংকেতের প্রভাবে জিনের সক্রিয়করণ (Activation) বা নিষ্ক্রিয়করণ (Deactivation) ঘটে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন মিথাইলেশন। দেখা গেছে আমাদের চারপাশের বহু কিছুই -পরিবেশ, খাদ্যাভাস, পানীয় বা ধূমপানে আসক্তি, মানসিক পীড়নসহ বহুকিছুতেই এই প্রক্রিয়াটি প্রভাবিত হয়। এই মিথাইলেশন হয় বলেই সদৃশ যমজ ভাতৃযুগলে জেনেটিক কোডে শতভাগ মিল থাকলেও তাদের আচরণে, মন মানসিকতায় কিংবা কাজকর্মে বিস্তর পার্থক্য থাকে অনেক সময়ই। মিথাইলেশনের প্রভাবে জেনেটিক কোডের একাংশ বা একাধিক অংশ টার্ন অফ হয়ে যেতে পারে । কাজেই একই জেনেটিক কোড থাকা সত্ত্বেও জেনেটিক সুইচের টার্ণ অন বা অফের কারণে একভাই বিষমকামী, আরেকভাই হয়ত সমকামী ভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। এ শুধু তত্ত্ব কথা নয়, এই ধারণার স্বপক্ষে কিছুটা প্রমাণ পাওয়া গেছে সভেন বকল্যান্ডের গবেষণায়। তিনি যমজ ভাইয়ের ঠিক কোনো জায়গায় জিন টার্ণ অন বা অফের কারণে প্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটে তার হদিস এখনো না পেলেও সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, সমকামী ছেলের জন্ম দেয়া মায়ের এক্স ক্রোমোজমের সক্রিয়তা অন্য মায়েদের চেয়ে ভিন্ন হয়। কিন্তু কীভাবে একটি জিন পরিবেশের প্রভাবে সক্রিয় বা অক্রিয় হয়ে যায়? একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে স্ট্রেস হরমোন করটিসোল।
এপিজেনেটিক্স নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই বইয়ের পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত ‘মানব প্রকৃতি এবং প্রবৃত্তিগুলো কি জন্মগত নাকি আচরণগত?’ অংশটি দ্রষ্টব্য।
Bocklandt S, Horvath S, Vilain E, Hamer DH (February 2006). “Extreme skewing of X chromosome inactivation in mothers of homosexual men”. Hum. Genet. 118 (6): 691–4.
ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কর্টিসোল স্থায়ীভাবে জিনের একাংশকে নিষ্ক্রিয় (turn off) করে দিতে পারে এবং এর ফলে ইঁদুরের স্বভাবে পরিবর্তন ঘটে। মানুষের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা একই রকম ফলাফল লক্ষ করেছেন। তারা দেখেছেন, মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে মানবদেহে এই হরমোনের আধিক্য বৃদ্ধি পায়। চাপময় পরিবেশে বেশি দিন কাটালে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায় – ফলে দেহ সহজেই সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হয় সে সময়। কিন্তু ‘ধান ভানতে শীবের গীতের মতো’ এই কর্টিসোল নিয়ে পড়ে যাওয়া হলো কেন? এই স্ট্রেস হরমোনের সাথে সমকামিতার কি কোনো সরাসরি সম্পর্ক আছে? বিজ্ঞানীরা বলেন, থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। জার্মান ডাক্তার গান্টার ডর্নারের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাপময় পরিবেশে যে সমস্ত মা গর্ভবতী হয়েছিলেন, তাদের সন্তানদের একটা বড় অংশ নাকি সমকামী হিসেবে গড়ে উঠেছিল ইতিহাসের অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যে সমস্ত ইঁদুরেরা গর্ভের সময় চাপময় পরিবেশে দিন কাটায়, তাদের সন্তানের মধ্যে পরবর্তীতে সমকামিতার আধিক্য তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। অনেক সময় আবার বিভিন্ন এলার্জিক প্রতিক্রিয়ায় দেহে টেস্টোসটেরোন হরমোনের (পুরুষ হরমোন) প্রতি সংবেদনশীলতা কমে যায়। যে সমস্ত মায়েরা সারা জীবনে অধিক সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেয়, তাদের ক্ষেত্রে শেষের দিককার সন্তানদের জন্মের সময় এ ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে বলে জানা গেছে। রে ব্ল্যানচার্ডের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো পরিবারে বড় ভাই থাকলে তার পরের ভাইদের সমকামী যৌনপ্রবৃত্তি তৈরি করার সম্ভাবনাকে শতকরা ২৮ থেকে ৪৮ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া। অর্থাৎ, একটি পরিবারে বড় ভাইদের সংখ্যা যত বেশি হবে, তত বেশি হবে পরবর্তী সন্তানের সমকামী হবার সম্ভাবনা (একে জনপ্রিয়ভাবে ‘ওল্ডার ব্রাদার ইফেক্ট’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়)। কারণ দেখা গেছে, যত বেশি সন্তানের জন্ম হয়, তত বেশি মায়ের টেস্টোসটেরোন হরমোনের প্রতি এলার্জিক প্রতিক্রিয়াও বাড়তে থাকে । হরমোন নিয়ে এই সাম্প্রতিক পরীক্ষাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনো কিছুই আসলে নিশ্চিত নয়। বহু নারীকেই আসলে বিভিন্ন সময়ে চাপযুক্ত পরিবেশে সন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের সবার সন্তান বড় হয়ে সমকামী হয়। আমার নিজের জন্মও হয়েছিল একাত্তরের দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে,আমার বাবা যখন দেশের সীমান্তে ছিলেন যুদ্ধরত। এমন পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েও কিন্তু আমি সমকামী হিসেবে বেড়ে উঠিনি। কিংবা আমার জন্মের কারণে কোনো ‘ওল্ডার ব্রাদার ইফেক্ট’ আমার ছোট ভাইয়ের উপরও পড়েনি । এমন উদাহরণ চারপাশে অজস্রই আছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় সমকামী সন্তানের জন্মদেয়া মায়েদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছে। তাদের প্রশ্ন করা হয়েছে যে, বিষমকামী সন্তানের জন্ম দেয়ার তুলনায় সমকামী সন্তানের জন্ম দেয়ার সময়টিতে কি তারা অধিক চাপযুক্ত পরিস্থিতিতে ছিলেন কিনা। তাদের মতামত থেকে এমন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি যে,সমকামী সন্তানের জন্মের সময় কোনো চাপময় পরিস্থিতি তারা অতিবাহিত করেছিলেন”।কাজেই মায়ের মানসিক চাপের সাথে সন্তানের সমকামিতার কোনো প্রত্যক্ষ যোগসূত্র আসলে প্রতিষ্ঠিতই হয়নি। এছাড়া, গান্টার ডর্নারের মূল পরীক্ষার ‘উদ্দেশ্য’ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন মহলে। গান্টার তাঁর গবেষণাপত্রে সমকামিতাকে ‘মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব’ (Psychic Disability) হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘অদূরভবিষ্যতে সমকামিতার বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।’ তার এই মনোভাব নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলেই তুমুল প্রতিবাদ হয়েছে, তার সমকামিতার প্রতি বিদ্বেষমূলক মনমানসিকতাকে ইতিহাসের কলঙ্কজনক ইউজিনিক্সের (Eugenics) সাথেও তুলনা করা হয়েছে।
Matt Ridley, The Red Queen: Sex and the Evolution of Human Nature, Harper Perennial, 2003. Blanchard, R. (1997). Birth order and sibling sex ratio in homosexual versus heterosexual males and females. Annual Review of Sex Research, 8, 27-67.
গে জিন নিয়ে মিডিয়ায় এত ঔতসুক্যই বা কেন?
বৈজ্ঞানিক গবেষণার বাইরেও রাজনৈতিক একটা মতাদৰ্শগত লড়াই যে চলছে তার প্রভাব কিছুটা হলেও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রগুলোতেও পড়ছে। রক্ষণশীল সমাজের চাপে সাড়া দুনিয়া জুড়েই সমকামীদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে হচ্ছে। এই সমকামী অধিকার কর্মীদের অনেকেই ভাবেন, যদি কখনো প্রমাণ পাওয়া যায় যে সমকামী প্রবণতা জৈবিকভাবে অঙ্কুরিত হয় –সেটা সমকামীদের দাবি আদায়ের জন্য অনেক উপকারে আসবে। কারণ তারা তখন আরো বলিষ্ঠভাবে মানুষজনকে বোঝাতে পারবেন যে, ‘সমকামীরা জন্মগতভাবেই সমকামীপ্রবণতা নিয়ে জন্মায়’, এতে তাদের কোনো ‘দোষ” নেই। ‘এডভোকেট’ নামে একটি মার্কিন গে এবং লেসবিয়নদের পত্রিকায় এ নিয়ে ১৯৯৬ সালে একটি জরিপ চালান হয়, সেখানকার শতকরা ৬১ ভাগ পাঠক মত দিয়েছিল যে, ‘যদি সমকামিতার পেছনে কোনো জেনেটিক কারণ আছে বলে জানা যায়, সেটা তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে’।
তবে এই দলের মধ্যে বিপরীত মতও আছে। যদি সমকামী প্রবণতা ‘জেনেটিক’ বলে প্রমাণিত হয়, তবে একে ‘জেনেটিক রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেবার প্রবণতা ও হয়ত বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের ভয় থেকে অনেকে আবার জিনের সাথে সম্পর্ক না পাওয়া গেলেই বরং ভালো বলে মনে করেন। তারা আশঙ্কা করেন আগে ডাক্তারেরা যেভাবে সমকামিতাকে ‘মানসিক ব্যাধি” হিসেবে চিহ্নিত করে নানা উপায়ে রোগমুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছেন, সেরকম প্রবণতা হয়ত জেনেটিস্টদের মধ্যেও ভবিষ্যতে দেখা যাবে। তারা হয়ত হান্টিংটন ডিজিজ, আলসাইমার্স, মাইগ্রেন, সিকেল সেল এনিমিয়ার মতো সমকামিতাকেও জেনেটিক রোগ হিসেবে দেখিয়ে তার চিকিৎসার দাওয়াই তখন বাৎলে দিতে চাইবেন। Xq28 এলাকার ঠিক পাশেই ক্রোমোজমের ভিন্নতার কারণে অকুলার এলবেনিজম এবং মেনকিস ডিজিস নামে দুটি দুর্লভ জেনেটিক রোগ তৈরি হয় বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। সমকামিতাও কি সে ধরনের কোনো জেনেটিক রোগ? এর জবাব আমরা খুঁজতে চেষ্টা করবো পরবর্তী অধ্যায়ে।
Francis Mark Mondimore, A Natural History of Homosexuality, The Johns Hopkins University Press, 1996
“it would mostly help gay and lesbian rights if homosexuality were found to be biologically determined” ; The Advocate (1996, February 6). Advocate Poll Results. p. 8.
♦ রূপান্তরকামীতা আর উভকামিতার জগৎ
♦ গবেষণার রুদ্ধ দুয়ার খুললেন যারা
♦ গে মস্তিষ্ক এবং গে জিনের খোঁজে
♦ সমকামিতা কি কোনো জেনেটিক রোগ?
“সমকামিতা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ