শ্লোকঃ ২২-২৫
শ্রীভগবানুবাচ
প্রকাশং চ প্রবৃত্তিং চ মোহমেব চ পাণ্ডব ।
ন দ্বেষ্টি সংপ্রবৃত্তানি ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি ।। ২২ ।।
উদাসীনবদাসীনো গুণৈর্যো ন বিচাল্যতে।
গুণা বর্তন্ত ইত্যেবং যোহবতিষ্ঠতি নেঙ্গতে ৷। ২৩ ।।
সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ সমলোষ্ট্রাষ্মকাঞ্চনঃ ।
তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ো ধীরস্তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ ।। ২৪ ।।
মানাপমানয়োস্তুল্যগুল্যো মিত্রারিপক্ষয়োঃ
সর্বারম্ভপরিত্যাগী গুণাতীতঃ স উচ্যতে ।। ২৫ ।।
শ্রীভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন, প্রকাশ-প্রকাশ, চও প্রবৃত্তিম — প্রবৃত্তি; চ—ও; মোহম্― মোহ; এব চ —ও; পাণ্ডব –হে পাণ্ডুপুত্র ন দ্বেষ্টি—দ্বেষ করেন না; সংপ্রবৃত্তানি — আবির্ভূত হলে; ন — না; নিবৃত্তানি — নিবৃত্ত হলে, কাঙ্ক্ষতি—আকাঙ্ক্ষা করেন; উদাসীনবৎ— উদাসীনের মতো; আসীন:- অবস্থিত; গুণৈঃ—গুণসমূহের দ্বারা; যঃ – যিনি; ন–না, বিচাল্যতে বিচলিত হন; গুণাঃ—গুণসমূহ; বর্তন্তে— স্বীয় কার্যে প্রবৃত্ত হন; ইতি একা—এভাবেই জেনে যঃ – যিনি; অবতিষ্ঠতি — অবস্থান করেন; ন—না; ইঙ্গতে চঞ্চল হন। সম-সম- ভাবাপন্ন; দুঃখ-দুঃখ; সুখঃ-সুখ; স্বস্থঃ- আত্মস্বরূপে অবস্থিত, সম—সম- ভাবাপন্ন, লোষ্ট্র—মাটির ঢেলা, অশ্ম –পাথর, কাঞ্চনঃ – স্বর্ণ, তুলা – সমভাবাপন্ন; প্রিয়—প্রিয়; অপ্রিয়ঃ—অপ্রিয়; ধীরঃ—ধৈর্যশীল; তুলা – তুলায়ন: নিন্দা – নিন্দা; আত্মসংস্তুতিঃ– নিজের প্রশংসা, মান-সম্মান, অপমানয়োঃ – অসম্মান, তুল্যঃ- সমভাবাপন্ন; তুল্যঃ — সমজ্ঞান-সম্পন্ন: মিত্র – বন্ধু: অরি—শত্রু পক্ষয়োঃ—দলে; সর্ব— সমস্ত; আরম্ভ — প্রচেষ্টা; পরিত্যাগী — পরিত্যাগী; গুণাতীতঃ — জড়া প্রকৃতির গুণের অতীত, সঃ—তিনি; উচ্যতে — কথিত হন।
গীতার গান
শ্রীভগবান কহিলেনঃ
প্রকাশ প্রবৃত্তি আর মোহন যে তিন।
গুণের প্রভাব সেই হয় ভিন্ন ভিন্ ৷।
তাহাতে যে দ্বেষাকাঙ্ক্ষা ছাড়িল জীবনে ।
গুণাতীত হয় সেই বুঝ ত্রিভুবনে ।।
গুণকার্যে উদাসীন মতো যে আসীন ।
বিচলিত নহে তাহে প্রবৃদ্ধ প্রবীণ ।।
অনাসক্ত গুণকার্যে যেবা হয় ধীর।
সম দুঃখ সুখ স্বস্থঃ লোষ্ট্র স্বর্ণ স্থির ।।
তুল্য প্রিয়াপ্রিয় তার তুল্য নিন্দাস্তুতি ।
তুল্য মান অপমান শত্রু মিত্ৰ অতি ।।
ভোগ ত্যগাদিতে নহে সে আসক্ত ৷
গুণাতীত হয় সেই নিৰ্গুণেতে যুক্ত ।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন – হে পাণ্ডব! যিনি প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ আবির্ভূত হলে দ্বেষ করেন না এবং সেগুলি নিবৃত্ত হলেও আকাঙ্ক্ষা করেন না; যিনি উদাসীনের মতো অবস্থিত থেকে গুণসমূহের দ্বারা বিচলিত হন না, কিন্তু গুণসমূহ স্বীয় কার্যে প্রবৃত্ত হয়, এভাবেই জেনে অবস্থান করেন এবং তার দ্বারা চঞ্চলতা প্রাপ্ত হন না; যিনি আত্মস্বরূপে অবস্থিত এবং সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন; যিনি মাটির ঢেলা, পাথর ও স্বর্ণে সমদৃষ্টি-সম্পন্ন; যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়ে সম ভাবাপন্ন, যিনি ধৈর্যশীল এবং নিন্দা, স্তুতি, মান ও অপমানে সমভাবাপন্ন; যিনি শত্রু ও মিত্র উভয়ের প্রতি সমভাব সম্পন্ন এবং যিনি সমস্ত কর্মোদাম পরিত্যাগী— তিনিই গুণাতীত বলে কথিত হন।
তাৎপর্যঃ অর্জুন তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন এবং ভগবান একে একে সেগুলির উত্তর দিচ্ছেন। এই শ্লোকগুলিতে শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে বলেছেন যে, যে ব্যক্তি গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তিনি কারও প্রতি দ্বেষযুক্ত নন এবং তিনি কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করেন না। জীব যখন জড় দেহে আবদ্ধ হয়ে এই জড় জগতে অবস্থান করে, তখন বুঝতে হবে যে, সে এই জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের কোনও একটির নিয়ন্ত্রণাধীন। সে যখন দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, তখন সে জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকেও মুক্ত হয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না সে দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হাতে পারছে, ততক্ষণ তাকে গুণের প্রভাবের প্রতি উদাসীন থাকতে হবে। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় তাকে নিযুক্ত হতে হবে, যাতে জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতে তার পরিচয়ের কথা সে আপনা থেকেই ভুলে যেতে পারে। কেউ যখন তার জড় দেহের চেতনার যুক্ত থাকে, তখন সে কেবল তার ইন্দ্রিয়-তর্পণের জন্য কর্ম করে। কিন্তু সেই চেতনা যখন শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত হয়, তখন ইন্দ্রিয়তর্পণ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। এই জড় দেহের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই জড় দেহের আদেশ পালন করারও কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। দেহে অবস্থিত প্রকৃতির গুণগুলি কর্ম করে যাবে, কিন্তু চিন্ময় সত্তারূপে আত্মা এই সমস্ত কার্যকলাপ থেকে পৃথক। তিনি পৃথক হন কিভাবে? তিনি জড় দেহটিকে ভোগ করবার আকাক্ষা করেন না অথবা এই দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেন না। এভাবেই গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবদ্ভক্ত আপনা থেকেই মুক্ত হন। জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাঁকে কোন রকম চেষ্টা করতে হয় না।
পরবর্তী প্রশ্নটি হচ্ছে গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির আচরণ সম্বন্ধে। জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষ দেহ সম্বন্ধীয় তথাকথিত সম্মান ও অসম্মানের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি এই ধরনের মিথ্যা সম্মান ও অসম্মানের দ্বারা প্রভাবিত হন না। কৃষ্ণভাবনায় বিভোর হয়ে তিনি তাঁর কর্ম করে যান এবং মানুষ তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করল না অসম্মান করল, তার প্রতি তিনি ভ্রূক্ষেপ করেন না। কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করবার পক্ষে যা অনুকূল, তা তিনি গ্রহণ করেন। তা ছাড়া পাথর হোক বা সোনাই হোক, তার কোন জড় বস্তুর দরকার হয় না। কৃষ্ণভক্তির অনুশীলনে যারা তাকে সাহায্য করেন, তাঁদের সকলকেই তিনি প্রিয় বন্ধু বলে মনে করেন এবং তার তথাকথিত শত্রুকেও তিনি ঘৃণা করেন না। তিনি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন এবং সব কিছুই তিনি সমদৃষ্টিতে দর্শন করেন। কারণ, তিনি ভাল মতেই জানেন যে, জড়-জাগতিক জীবনে তাঁর কিছুই করবার নেই। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি তাকে প্রভাবিত করে না। কারণ, তিনি সামাজিক উত্থান ও গোলযোগের অনিত্যতা সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত। তাঁর নিজের জন্য তিনি কোন প্রচেষ্টা করেন না। শ্রীকৃষ্ণের জনা তিনি সব কিছু করতে পারেন, কিন্তু তাঁর নিজের জন্য তিনি কোন কিছু করেন না। এই রকম আচরণের দ্বারাই প্রকৃতপক্ষে গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত হতে পারা যায়।
শ্লোকঃ ২৬
মাং চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে ॥ ২৬ ॥
মাম্—আমাকে; চ—ও; যঃ—যিনি : অব্যভিচারেণ –ঐকান্তিক; ভক্তিযোগেন— ভক্তিযোগ দ্বারা; সেবতে— সেবা করেন; সঃ— তিনি; গুণান্—প্রকৃতির গুণকে সমতীত্য— অতিক্রম করে; এতান—এই সমস্ত; ব্রহ্মভূয়ায় — ব্রহ্মভূত স্তরে উন্নীত, কল্পতে—হন।
গীতার গান
ত্রিগুণের অতিক্রমে যে কার্য করয় ।
সেই সে আমার ভক্তি জানহ নিশ্চয় ।।
যে অব্যভিচারী ভক্তি আমাতে করয় ৷
জড় গুণ অতিক্রমে ব্রহ্মভূত হয় ।।
অনুবাদঃ যিনি ঐকান্তিক ভক্তিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি প্রকৃতির সমস্ত গুণকে অতিক্রম করে ব্রহ্মভূত স্তরে উন্নীত হন।
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকটি হচ্ছে অর্জুনের তৃতীয় প্রশ্ন— নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়ার উপায় কি তার উত্তর। পূর্বেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে, জড় জগৎ পরিচালিত হচ্ছে জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাবে। তাই, জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাবে বিচলিত হওয়া উচিত নয়। তাঁর চেতনাকে এই সমস্ত কার্যকলাপে মনোনিবেশ না করে শ্রীকৃষ্ণের সেবামূলক কার্যে নিযুক্ত করা যেতে পারে। শ্রীকৃষ্ণের সেবামূলক কাজকে বলা হয় ভক্তিযোগ—শ্রীকৃষ্ণের জন্য সর্বদাই কর্ম করা। কৃষ্ণভক্তি বলতে কেবল শ্রীকৃষ্ণের সেবাই বোঝায় না, রাম, নারায়ণ আদি শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন স্বাংশ প্রকাশের সেবাও বোঝায়। শ্রীকৃষ্ণের অসংখ্য স্বাংশ প্রকাশ আছে। যিনি তাঁদের যে কোন একটি রূপের সেবা করেন, তিনি নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হন। এটিও জেনে রাখা উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণের সব কয়টি রূপই সম্পূর্ণরূপে গুণাতীত এবং সৎ, চিৎ ও আনন্দময়। ভগবানের এই সমস্ত প্রকাশ সর্ব শক্তিসম্পন্ন, সর্বজ্ঞ এবং তাঁরা সব রকম দিব্য গুণাবলীতে বিভূষিত। সুতরাং, কেউ যখন দৃঢ় আত্ম-প্রত্যয়ের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বা তাঁর স্বাংশ প্রকাশের সেবার নিজেকে নিযুক্ত করেন, যদিও জড়া প্রকৃতির গুণগুলি অতিক্রম করা অসম্ভব, তবুও তিনি অনায়াসে তাদের অতিক্রম করতে পারেন। সপ্তম অধ্যায়ে সেই কথা পুর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হন। কৃষ্ণভাবনায় বা কৃষ্ণভক্তিতে যুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের মতো হওয়া। ভগবান বলছেন যে, তাঁর স্বরূপ হচ্ছে সৎ, চিৎ ও আনন্দময় এবং জীব হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্নাংশ, ঠিক যেমন সোনার কণা সোনার খনির অংশ। এভাবেই জীবের চিন্ময় স্বরূপ গুণগতভাবে সোনার মতো, অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের মতো গুণসম্পন্ন। জীব ও ভগবানের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য সর্ব অবস্থাতেই বর্তমান থাকে। তা না হলে ভক্তিযোগের কোন প্রশ্নই হতে পারে না। ভক্তিযোগের অর্থ হচ্ছে যে, ভগবান আছেন, ভগবানের ভক্ত আছেন এবং ভগবানের সঙ্গে ভক্তের প্রেম বিনিময়ের ক্রিয়াকলাপও আছে। তাই, পরম পুরুষোত্তম ভগবান ও জীব এই দুজন ব্যক্তির স্বাতন্ত্রই বর্তমান। তা না হলে ভক্তিযোগের কোন অর্থই হয় না। যে অপ্রাকৃত স্তরে ভগবান রয়েছেন, সেই স্তরে যদি উন্নীত না হওয়া যায়, তা হলে ভগবানের সেবা করা সম্ভব নয়। রাজার সচিব হতে হলে তাঁকে উপযুক্ত গুণ অর্জন করতে হয়। এভাবেই সেই গুণ হচ্ছে ব্রহ্মাভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া অথবা সব রকমের জড় কলুষ থেকে মুক্ত হওয়া। বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ব্রহ্মৈব সন্ ব্রহ্মাপ্যেতি। ব্রহ্মে পর্যবসিত হওয়ার মাধ্যমে পরমব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। অর্থাৎ, গুণগতভাবে ব্রহ্মের সঙ্গে এক হতে হবে। ব্রহ্মাত্তর প্রাপ্ত হলে, একজন স্বতন্ত্র আত্মারূপে জীব তার শাশ্বত ব্রহ্ম পরিচয় হারিয়ে ফেলে না।
শ্লোকঃ ২৭
ব্ৰহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ ।
শাশ্বতস্য চ ধর্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্য চ ॥ ২৭ ॥
ব্রহ্মণঃ—নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতির; হি— অবশ্যই; প্রতিষ্ঠা — আশ্রয়; অহম্ – আমি: অমৃতস্য – অমৃতের, অব্যয়স্য— অব্যয়, চ–ও, শাশ্বতস্য — নিত্য, চ-এবং, ধর্মসা— ধর্মের, সুখসা সুখের ঐকান্তিকস্যা — ঐকান্তিক; চ—ও।
গীতার গান
ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা আমি অমৃত শাশ্বত ।
আনন্দ যে সনাতন আমাতে নিহিত ।।
আমার আশ্রয়ে সেই সকল সুলভ ।
অতএব মোর ভক্তি হয় সুদুর্লভ ।।
অনুবাদঃ আমিই নির্বিশেষ ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা বা আশ্রয়। অব্যয় অমৃতের, শাশ্বত ধর্মের এবং ঐকান্তিক সুখের আমিই আশ্রয়।
তাৎপর্যঃ ব্রহ্মের স্বরূপ হচ্ছে অমরত্ব, অবিনশ্বরত্ব, নিত্যত্ব ও আনন্দ। পরমার্থ উপলব্ধির প্রথম স্তর হচ্ছে ব্রহ্ম-উপলব্ধি, দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে পরমাত্মার উপলব্ধি এবং পরম- তত্ত্বের চরম স্তরের উপলব্ধি হচ্ছে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের উপলব্ধি। তাই, পরমাত্মা ও নির্বিশেষ ব্রহ্ম এই উভয় তত্ত্বই হচ্ছে পরম পুরুষ ভগবানের অধীন তত্ত্ব। সপ্তম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, জড়া প্রকৃতি পরমেশ্বর ভগবানের নিকৃষ্ট। শক্তির প্রকাশ। ভগবান তাঁর পরা শক্তির কণিকাসমূহের দ্বারা অনুৎকৃষ্টা জড়া প্রকৃতিকে সক্রিয় করেন এবং সেটিই হচ্ছে জড়া প্রকৃতিতে চেতনের প্রকাশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ জীব যখন পারমার্থিক জ্ঞানের অনুশীলন শুরু করেন, তখন তিনি জড় অস্তিত্ব থেকে ধীরে ধীরে পরম-তত্ত্বের ব্রহ্মভূত অবস্থায় উন্নীত হন। জীবের এই ব্রহ্মভূত অবস্থা হচ্ছে আত্মজ্ঞানের প্রথম স্তর। এই স্তরে ব্রহ্মাঞ্জ পুরুষ জড় অবস্থার অতীত, কিন্তু তিনি পূর্ণরূপে ব্রহ্ম-উপলব্ধি করতে পারেননি। তিনি যদি চান, তা হলে তিনি এই ব্রহ্মভূত অবস্থাতেই থাকতে পারেন এবং তারপর ধীরে ধীরে পরমাত্মা উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হতে পারেন এবং তারপর পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করতে পারেন। বৈদিক শাস্ত্রে তার অনেক নিদর্শন আছে। চতুঃসন বা চার কুমারেরা প্রথমে নির্বিশেষ ব্রহ্মে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তারপর তাঁরা ধীরে ধীরে ভগবদ্ভক্তির স্তরে উন্নীত হন। যিনি ব্রহ্মের নিরাকার নির্বিশেষ উপলব্ধির ঊর্ধ্বে উন্নীত হতে পারেননি, তাঁর সর্বদাই অধঃপতনের সম্ভাবনা থাকে। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, কেউ নির্বিশেষ ব্রহ্ম-উপলব্ধির স্তরে উপনীত হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি আর অগ্রসর না হন, পরম পুরুষ ভগবানের তথ্য তিনি যদি না জানেন, তা হলে বুঝতে হবে যে, তাঁর চিত্ত পূর্ণরূপে নির্মল হয়নি। সুতরাং, ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় যুক্ত না হলে ব্রহ্ম-উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হওয়ার পরেও পতনের সম্ভাবনা থাকে। বৈদিক শাস্ত্রে এটিও বলা হয়েছে, রসো বৈ সঃ রসং হি এবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি – “কেউ যখন পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত রসের আধার বলে জানতে পারেন, তখন তিনি দিব্য আনন্দময় হতে পারেন।” ( তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২/৭/১) পরমেশ্বর ভগবান যড়ৈশ্বর্যপূর্ণ এবং ভক্ত যখন তাঁর সমীপবর্তী হন, তখন এই ষড়ৈশর্যের বিনিময় হয়। রাজার সেবক রাজার সঙ্গে প্রায় একই পর্যায়ভুক্ত হয়ে আনন্দ উপভোগ করেন, তেমনই ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করলে শাশ্বত আনন্দ, অক্ষয় সুখ ও নিতা জীবন লাভ করা যায়। তাই, ব্রহ্ম-উপলব্ধি অথবা নিত্যত্ব অথবা অবিনশ্বরত্ব ভক্তিযুক্ত ভগবানের সেবার অন্তবর্তী। ভক্তিযোগে যিনি ভগবানের সেবা করছেন, তিনি এই সব কয়টি গুণেরই অধিকারী।
জীব যদিও প্রকৃতিগতভাবে ব্রহ্ম, তবুও জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য করবার বাসনা তার রয়েছে এবং তার ফলে সে অধঃপতিত হয়। তার স্বরূপে জীব জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের অতীত। কিন্তু জড়া প্রকৃতির সংস্রবে আসার ফলে সে সত্ত্ব, রজ ও তম—- – প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই তিনটি গুণের সংসর্গের ফলে জড় জগতের উপর আধিপত্য করবার বাসনার উদয় হয়। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভক্তিযোগে যুক্ত হবার ফলে সে তৎক্ষণাৎ গুণাতীত স্তরে অধিষ্ঠিত হয় এবং জড়া প্রকৃতির উপর আধিপত্য করার বিধি-বহির্ভূত বাসনা দূর হয়। সুতরাং ভগবদ্ভক্তির পন্থা, যা শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ আদির মাধ্যমে শুরু হয়, অর্থাৎ ভগবদ্ভক্তি উপলব্ধির জন্য অনুমোদিত নবধা ভক্তির অঙ্গ ভক্তসঙ্গে অনুশীলন করা উচিত। এই প্রকার সঙ্গ করার ফলে, সদগুরুর প্রভাবে ধীরে ধীরে আধিপত্য করার জড় বাসনাগুলি দূর হয়। তখন ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে নিযুক্ত হওয়া যায়। এই অধ্যায়ের বাইশ থেকে শুরু করে শেষ শ্লোক পর্যন্ত সব কয়টি শ্লোকে এই পন্থার অনুশীলন করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করা অত্যন্ত সরল। এতে কেবল সর্বদা ভগবানের সেবায় নিযুক্ত হতে হয়, শ্রীবিগ্রহকে নিবেদিত প্রসাদ গ্রহণ করতে হয়, ভগবানের চরণে অর্পিত ফুলের ঘ্রাণ গ্রহণ করতে হয়, ভগবান যে সমস্ত স্থানে তাঁর অপ্রাকৃত লীলা বিলাস করেছেন, সেই স্থানগুলি দর্শন করতে হয়, ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন লীলাসমূহ পাঠ করতে হয়, ভগবদ্ভক্তের সঙ্গে প্রীতিমূলক ভাবের আদান- প্রদান করতে হয়, সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম সমন্বিত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র — হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে- জপ-কীর্তন করতে হয় এবং ভগবান ও তাঁর ভক্তের আবির্ভাব ও তিরোভাব তিথিগুলিতে উপবাস পালন করতে হয়। এই পন্থা অনুশীলন করার ফলে জড় কার্যকলাপের বন্ধন থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হওয়া যায়। এভাবেই যিনি ব্রহ্মজ্যোতিতে অধিষ্ঠিত হতে পারেন, তিনি গুণগতভাবে পরম পুরুষোত্তম ভগবানের সমপর্যায়ভুক্ত।
ভক্তিবেদান্ত কহে শ্রীগীতার গান ।
শুনে যদি শুদ্ধ ভক্ত কৃষ্ণগত প্ৰাণ ॥
ইতি— জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ বৈশিষ্ট্য বিষয়ক গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ’ নামক শ্রীমদ্ভগবদগীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য সমাপ্ত।