শ্লোকঃ ১৯
নান্যং গুণেভ্যঃ কর্তারং যদা দ্রষ্টানুপশ্যতি ।
গুণেভ্যশ্চ পরং বেত্তি মদ্ভাবং সোহধিগচ্ছতি ।। ১৯ ৷।
ন—না; অন্যম্ —অন্য; গুণেভ্যঃ গুণসমূহ থেকে; কর্তারম্—কর্তাকে; যদা – দ্রষ্টা—দ্রষ্টা; অনুপশ্যতি—দেখেন; গুণেভ্যঃ—জড়া প্রকৃতির গুণসমূহ থেকে; চ— এবং; পরম্—গুণাতীত; বেত্তি— জানেন; মদ্ভবম্ — আমার পরা প্রকৃতি; সঃ – তিনি; অধিগচ্ছতি লাভ করেন।
গীতার গান
গুণ ভিন্ন অন্য কর্তা নাহি ত্রিভুবনে ।
সূক্ষ্ম দর্শন যার গুণ নিরূপণে ।।
গুণাতীত মোর ভক্তি আমার সে ভাব
স্বরূপেতে শুদ্ধ জীব প্রাপ্ত সে স্বভাব ।।
অনুবাদঃ জীব যখন দর্শন করেন যে, প্রকৃতির গুণসমূহ ব্যতীত কর্মে অন্য কোন কর্তা নেই এবং জানতে পারেন যে, পরমেশ্বর ভগবান এই সমস্ত গুণের অতীত, তখন তিনি আমার পরা প্রকৃতি লাভ করেন।
তাৎপর্যঃ প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষের কাছ থেকে জড়া প্রকৃতির গুণগুলি সম্বন্ধে যথার্থভাবে অবগত হওয়ার ফলে গুণের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া যায়। প্রকৃত গুরুদেব হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং এই দিব্যজ্ঞান তিনি অর্জুনকে দান করেছেন। তেমনই, যাঁরা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময়, তাঁদের কাছ থেকেই প্রকৃতির গুণের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ম সম্বন্ধীয় এই বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করা উচিত। তা না হলে জীবন বিপথগামী হবে। সদ্গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করার মাধ্যমে জীব তার চিন্ময় স্বরূপ, জড় দেহ, ইন্দ্ৰিয়সমূহ, বদ্ধ অবস্থা ও জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্নতা সম্বন্ধে অবগত হতে পারে। এই সমস্ত গুণের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে সে অসহায় হয়ে পড়ে। কিন্তু সে যখন তার যথার্থ স্বরূপ দর্শন করতে পারে, তখন সে পারমার্থিক জীবন লাভ করার সুযোগ পেয়ে অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, জীব তার বিভিন্ন কর্মের কর্তা নয়। জড়া প্রকৃতির কোন বিশেষ গুণের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোন বিশেষ শরীরে অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সে কর্ম করতে বাধ্য হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ সদগুরুর কৃপা লাভ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার যথার্থ অবস্থা সম্বন্ধে কোন মতেই অবগত হতে পারে না। সদগুরুর সস লাভ করার ফলে সে তার প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে অবগত হতে পারে এবং তার ফলে সে পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হতে পারে। কৃষ্ণভক্ত জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা পরিচালিত হন না। সপ্তম অধ্যায়ে ইতিমধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন, তিনি জড়া প্রকৃতির সমস্ত প্রভাব থেকে মুক্ত। তাই যিনি যথাযথভাবে সব কিছু দর্শন করতে পারেন, তিনি ধীরে ধীরে জড়া প্রকৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হন।
শ্লোকঃ ২০
গুণানেতানতীত্য ত্রীন দেহী দেহসমুদ্ভবান্ ।
জন্মমৃত্যুজরাদুঃখৈর্বিমুক্তোহ মৃতমশ্নুতে ॥ ২০ ॥
গুণান্—গুণকে, এতান্—– এই, অতীত্য – অতিক্রম করে, ত্রীন—তিন, দেহী—জীব, দেহ—দেহে; সমুদ্রবান্—উৎপন্ন; জন্ম—জন্ম, মৃত্যু—মৃত্যু; জরা— জরা; দুঃখঃ —দুঃখ থেকে, বিমুক্তঃ—মুক্ত হয়ে; অমৃতম্ — অমৃত, অশ্রুতে— ভোগ করেন।
গীতার গান
গুণাতীত হতে দেহী গুণদেহ ছাড়ে ।
জন্ম-মৃত্যু-জরা-দুঃখ বাঁধে না তাঁহারে ॥
অনুবাদঃ দেহধারী জীৰ এই তিন গুণ অতিক্রম করে জন্ম, মৃত্যু, জরা ও দুঃখ থেকে বিমুক্ত হয়ে অমৃত ভোগ করেন।
তাৎপর্যঃ এই জড় শরীরে থাকা সত্ত্বেও শুদ্ধ কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হয়ে কিভাবে গুণাতীত অবস্থায় থাকতে পারা যায় তা এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে। সংস্কৃত দেহী শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘দেহধারী’। এই জড় দেহ থাকলেও দিব্যজ্ঞান লাভ করার ফলে মানুষ প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন। এমন কি এই দেহের মধ্যে তিনি দিব্য জীবনের চিন্ময় আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, কারণ এই দেহ আগ করার পর তিনি অবশ্যই চিৎ-জগতে ফিরে যাবেন। কিন্তু এমন কি এই দেহের মধ্যে তিনি দিব্য আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। পক্ষান্তরে বলা যায়, ভক্তিযোগে কৃষ্ণভাবনাময় হওয়াই হচ্ছে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষণ। অষ্টাদশ অধ্যায়ে সেই কথা ব্যাখ্যা করা হবে। কোন মানুষ যখন জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হন, তখন তিনি ভক্তিযোগে ভগবানের সেবায় যুক্ত হন।
শ্লোকঃ ২১
অর্জুন উবাচ
কৈর্লিঙ্গৈগ্রীন গুণানেতানতীতো ভবতি প্রভো।
কিমাচারঃ কথং চৈতাংস্ত্ৰীন্ গুণানতিবর্ততে ॥ ২১ ॥
অর্জুনঃ উবাচ——অর্জুন বললেন; কৈঃ – কি কি, লিঙ্গেঃ লক্ষণ দ্বারা; ত্রী—তিন; গুণান্–গুণ, এতান্—এই অতীতঃ – অতীত; ভবতি – হন, প্রভো – হে প্রভু, কিম্—কি রকম; আচারঃ — আচরণ; কথম্ — কিভাবে চ—ও, এতান্—এই: ত্রীন— তিন; গুণান্—গুণ; অতিবর্ততে— অতিক্রম করেন।
গীতার গান
অর্জুন কহিলেন
কি লক্ষণ কহ প্রভো গুণাতীত হলে ।
আচরণ কিবা হয় ত্রিগুণ জিতিলে ॥
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন – হে প্রভু! যিনি এই তিন গুণের অতীত, তিনি কি কি লক্ষণ দ্বারা জ্ঞাত হন? তাঁর আচরণ কি রকম? এবং তিনি কিভাবে এই তিন গুণ অতিক্রম করেন ?
তাৎপর্যঃ এই শ্লোকে অর্জুনের প্রশ্নগুলি খুবই যুক্তিসঙ্গত। তিনি জানতে চাইছেন, যে মানুষ ইতিমধ্যেই জড়া প্রকৃতির গুণগুলি থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁর লক্ষণ কি? প্রথমে তিনি এই ধরনের দিব্য পুরুষের লক্ষণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছেন। কিভাবে জানতে পারা যাবে যে, তিনি ইতিমধ্যেই জড়া প্রকৃতির গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়েছেন? দ্বিতীয় প্রশ্নে তিনি জিজ্ঞাসা করছেন, তিনি কি রকম জীবন যাপন করেন এবং তাঁর কাজকর্ম কি রকম। সেগুলি কি নিয়ন্ত্রিত না অনিয়ন্ত্রিত। তারপর অর্জুন জিজ্ঞাসা করছেন, কি উপায়ে দিবা প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়। সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিব্যস্তরে অধিষ্ঠিত হওয়ার সরাসরি উপায় সম্বন্ধে যতক্ষণ পর্যন্ত না অবগত হওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই লক্ষণগুলি প্রদর্শন করার কোন সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং, অর্জুনের এই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভগবান নিজেই সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দিচ্ছেন।