শ্লোকঃ ১৩

অপ্রকাশোহপ্রবৃত্তিশ্চ প্রমাদো মোহ এব চ ।

তমস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে কুরুনন্দন ॥ ১৩ ৷৷

অপ্রকাশঃ—ডঅজ্ঞান-অন্ধকার, অপ্রবৃত্তিঃ— নিষ্ক্রিয়তা, চ–এবং; প্রমাদঃ—উন্মত্ততা; মোহঃ— মোহ; এব—অবশ্যই; চ–ও; তমসি— তমোগুণ: এতানি—এই সমস্ত; জায়ন্তে—উৎপন্ন হয়; বিবৃদ্ধে—বর্ধিত হলে; কুরুনন্দন – হে কুরুনন্দন।

গীতার গান

অপ্রকাশ অপ্রবৃত্তি মোহ তমোর লক্ষণ ।

বিবিধ গুণের কার্য হে কুরুনন্দন ৷।

অনুবাদঃ হে কুরুনন্দন ! তমোগুণ বর্ধিত হলে অজ্ঞান-অন্ধকার, নিষ্ক্রিয়তা, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হয়।

তাৎপর্যঃ বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে আলোকোম্মেষ না হলে জ্ঞানের অনুপস্থিতি ঘটে। তামসিক মানুষ বিধিবন্ধ নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কখনই কর্ম করে না; সে নিজের খেয়াল-খুশি মতো উদ্দেশ্য-বিহীনভাবে আচরণ করে। যদিও তার কাজ করার ক্ষমতা আছে, তবুও সে কোন রকম প্রচেষ্টা করে না। তাকে বলা হয় মোহ। যদিও তার চেতনা আছে, তবুও তার জীবন নিষ্ক্রিয়। এগুলি হচ্ছে তমোগুণ-সম্পন্ন মানুষের লক্ষণ।

শ্লোকঃ ১৪

যদা সত্ত্বে প্রবৃদ্ধে তু প্রলয়ং যাতি দেহভৃৎ।

 তদোত্তমবিদাং লোকানমলান প্রতিপদ্যতে ॥ ১৪ ৷৷

যদা— যখন; সত্ত্বে—সত্ত্বগুণ; প্রবৃদ্ধে—বর্ধিত হলে; তু– কিন্তু; প্রলয়ম-প্রলয়; যাতি—প্রাপ্ত হয়; দেহভৃৎ — দেহধারী জীন; তদা — তখন; উত্তমবিদাম্—মহর্ষিদের; লোকান্—লোকসমূহ: অমলান্ – নির্মল; প্রতিপদ্যতে—লাভ করেন।

গীতার গান

প্রবৃদ্ধ যে সত্ত্বগুণে দেহের প্রলয় ৷

নিষ্পাপ উত্তম লোক তাঁর প্রাপ্তি হয় ॥

অনুবাদঃ যখন সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কালে দেহধারী জীব দেহত্যাগ করেন, তখন তিনি মহর্ষিদের নির্মল উচ্চতর লোকসমূহ লাভ করেন।

তাৎপর্যঃ সাত্ত্বিক লোকেরা ব্রহ্মলোক বা জনলোক আদি উচ্চতর গ্রহলোকে গমন করেন এবং সেখানে স্বর্গসুখ উপভোগ করেন। এখানে অমলান কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর অর্থ হচ্ছে রজ ও তমোগুণ থেকে মুক্ত। জড় জগৎ পাপময়, কিন্তু সত্ত্বগুণ হচ্ছে জড় জগতের সবচেয়ে নিষ্পাপ অবস্থা। নানা রকম জীবের জন্য নানা রকম গ্রহলোক আছে। সত্ত্বগুণে যাঁদের মৃত্যু হয়, তারা উচ্চতর লোকে উন্নীত হন, যেখানে মহাঋষি ও মহান ভক্তেরা বাস করেন।

শ্লোকঃ ১৫

রজসি প্রলয়ং গত্বা কর্মসঙ্গিবু জায়তে ।

তথা প্রলীনত্তমসি মূঢ়যোনিষু জায়তে ৷। ১৫ ।।

রজসি — রজোগুণে, প্রনয়ম্ – মৃত্যু: গত্বা—প্রাপ্ত হলে; কর্মসঙ্গি—কর্মাসক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে; জায়তে—জন্ম হয়; তথা — তেমনই; প্রলীনঃ — মৃত্যু হলে; তমসি— তমোগুণে; মূঢ়যোনিষু – পশু যোনিতে, জায়তে জন্ম হয়।

গীতার গান

প্রবৃদ্ধ সে রজোগুণে দেহের নির্বাণ ।

কর্মীর সঙ্গেতে হয় তার অনুষ্ঠান ॥

প্রবৃদ্ধ যে তমোগুণে শরীর ছাড়ায় ।

মূঢ় পশুযোনি মধ্যে তার জন্ম হয় ৷৷

অনুবাদঃ রজোগুণে মৃত্যু হলে কর্মাসক্ত মনুষ্যকুলে জন্ম হয়, তেমনই তমোণ্ডাণ মৃত্যু হলে পশু যোনিতে জন্ম হয়।

তাৎপর্যঃ কিছু লোক মনে করে যে, মনুষ্য-জীবন লাভ করলে আর অধঃপতন হয় না। এই ধারণা ভ্রান্ত। এই শ্লোকে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি তমোগুণের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে জীবন যাপন করে, তা হলে মৃত্যুর পরে তার আত্মা অধঃপতিত হয়ে পশুযোনি প্রাপ্ত হয়। সেই অবস্থা থেকে তাঁকে আবার ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে এক শরীর থেকে আর এক শরীর প্রাপ্ত হতে হতে অবশেষে মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত হতে হবে। তাই, মনুষ্য শরীরের গুরুত্ব যাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাঁদের উচিত সাত্ত্বিক আচরণ করা এবং সাধুসঙ্গে এই গুণগুলি অতিক্রম করে কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হওয়া। সেটিই হচ্ছে মানব-জীবনের উদ্দেশ্য। তা না হলে মানুষ যে আবার মনুষ্য-শরীর প্রাপ্ত হবে, সেই সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা নেই।

error: Content is protected !!